লিফটের কাছে আসতেই মৌসুমীর মেজাজটা খারাপ হয়ে এল । শরীরটা ক্লান্তিতে ভরা অথচ লিফট দেখাচ্ছে আউট অব সার্ভিস ! মৌসুমীর ফ্ল্যাটটা ছয় তলাতে । এখন সিড়ি ভেঙ্গে যদি ওর এই ছয়তলাতে উঠতে হয় তাহলে ওর খবর হয়ে যাবে ।
দারোয়ানকে ডাক দিলো চিৎকার করে । দারোয়ান দৌড়ে এল । মৌসুমী বিরক্ত হয়ে বলল, কি হল লিফট বন্ধ কেন ?
-ম্যাডাম লিফটের কাজ চলতেছে ।
-কই কাজ চলতেছে ?
-মানে চলতেছিলো । আইজ শেষ হয় নাই । কাইল আবার আইবো !
কিছু বলতে গিয়েও বলল না । দারোয়ানকে বকা দিয়ে কোন লাভ নেই । সেই সকাল থেকে ও ডিউটিতে করেছে হাসপাতালে এখন বাজে রাত দশটাতে । এমনিতেও এদেশে ডাক্তারদের সংকট । আর এখন এই সংকটময় সময়ে ডাক্তারদের দায়িত্ব বেড়ে গেছে অনেক গুণে । আগে যেখানে ৭/৮ ঘন্টার সিফট করতে হত এখন সেখানে ১২/১৪ ঘন্টার আগে কোন ডাক্তার বাসায় যেতে পারছে না । মৌসুমী সেই সকাল বেলা বের হয় আর আসতে আসতে প্রতিদিনই রাত দশটা বাজে ।
ব্যাগটা হাতে নিয়ে মাস্কটা আরও একটু টেনে নিল । তারপর সিড়ির দিকে পা বাড়ালো । সিড়ি চড়তে ওর সমস্যা নেই তবে এখন ওর শরীর খুবই ক্লান্ত হয়ে আছে । লিফটটা হলে ভাল হত । যাক কি আর করা ।
সিড়ি দিয়ে ধীরে ধীরে উঠতে শুরু করলো উপরে । সারা দিনে মোবাইলটা বের করার সময় পায় নি একদমই । সিড়িতে উঠতে উঠতে মোবাইলটা একটু দেখার সিদ্ধান্ধ নিল । ফেসবুকে একটু ঢু মারা যাক !
কিন্তু সেটা আর হল না মৌসুমীর । ওদের এই এপার্টমেন্ট টা মোট ছয় তলা । প্রতি ফ্লোরে দুইটা করে ফ্ল্যাট । দ্বিতীয় তলায় উঠলো মোবাইলের দিকে চোখ রেখেই । তাই লক্ষ্য করলো না যে কখন দুটো ফ্ল্যাটের দরজা খুলে গেল । সেখান থেকে একটা ছোট ছেলে বের হয়ে এসেছে । হাতে একটা ভুভুজেলা । সেটা ফু দিতেই মৌসুমী খানিকটা চমকে উঠলো । তাকিয়ে দেখলো ফ্ল্যাট দুটোর দরজা ঠেলে দুই পরিবারের মানুষ বের হয়েছে ।
সাথে সাথেই মৌসুমীর চোখটা সিক্ত হলে এল । কারণ মানুষ গুলোর হাতে বড় বড় দুইটা কাগজ ধরা । সেখানে বড় বড় করে লেখা "থ্যাঙ্কিউ ডক্টর ফর ফাইটিং ফর আস " নিচে আরও লেখা "উই লাভ ইউ"
মৌসুমীর মন থেকে ক্লান্তিটা সাথে সাথে দুর হয়ে গেল । পিচ্চি একজন খানিকটা দৌড়ে এল ওর দিকে । হাত বাড়িয়ে ওকে একটা কার্ড ধরিয়ে দিল । অন্য ফ্ল্যাটের ছোট মেয়েটি এগিয়ে এল একটা ক্যাডবেরি চকলেট ধরিয়ে দিল ওর হাতে ।
মৌসুমী ঠিক তখনই উপরের তলা থেকে চিৎকার আর বাঁশির আওয়াজ শুনতে পেল । ওর বুঝতে কষ্ট হল না যে কেন আজকে লিফটা বন্ধ করে রাখা হয়েছে । যাতে করে ওকে সিড়ি দিয়ে উঠতে হয় ।
প্রতিটা তলাতে মোসুমী যখন উঠছিলো সবার হাতেই দেখতে পেল নানান ধরনের ধন্যবাদ জ্ঞাপক কার্ড ধরা । প্রতি তলা যখন পার হচ্ছিলো সবাই হাতে তালি দিয়ে ওকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলো । চকলেন আর কার্ডে ওর হাত ভরে গেল । নিজেকে সত্যিই খুব ভাগ্যবান মনে হচ্ছিলো সেই সাথে এটা মনে হয়ে খুব ভাল লাগছিলো যে ওরা যে এতো পরিশ্রম করছে সেটা সার্থক হয়েছে ।
যখন নিজের ফ্ল্যাটের সামনে এসে দাড়ালো ওর পাশের ফ্ল্যাটের আন্টিও ওর দিকে মুখ হাসি করে বলল, আজকে তোমার আমার বাসায় দাওয়াত বুঝেছো ! ফ্রেশ হয়ে খেতে আসো !
মৌসুমী এই মহামারির চিকিৎসা জন্য ওর বাসার মানুষজন সব সময় খুব চিন্তিত ছিল । ডাক্তারেরা সব থেকে বেশি ঝুকির ভেতড়ে থাকে । কিন্তু আজকে ওর মনে হল যে যদি সে আক্রান্তও হয় তবুও ওর মনে কোন দুঃখ নেই । সত্যিই কোন দুঃখ কোন ভয় নেই আর !
গল্পটা বানানো নয় । একেবারে সত্যিই একটা গল্প । কেবল স্থানটা কাল্পনিক । গতকাল একটা ভিডিওতে দেখলাম জার্মানি কিংবা ফ্রান্সের ভিডিওটা সম্ভবত । নার্স নিজের ডিউটি শেষ করে সিড়ি দিয়ে উঠছে আর তার প্রতিবেশরা তার জন্য হাতে তালি দিচ্ছে । প্রতি ফ্লোরে যাচ্ছে আর সবাই তাকে প্লাকার্ড হাতে নিয়ে ধন্যবাদ দিচ্ছে কার্ড দিচ্ছে ।
আর আমাদের দেশের বাঙ্গালীরা ডাক্তারদের বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিচ্ছে, এলাকা ছাড়ার নোটিশ দিচ্ছে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২১ রাত ২:১৬