-আফা কই যাইবেন?
আমি লোকটার দিকে ফিরে তাকালাম । গ্রামের এই মেঠো পথটাতে অনেক সময় ধরেই আমি দাঁড়িয়ে আছি । এই পথ দিয়ে যে-ই যাচ্ছে সে-ই আমার দিকে ফিরে তাকাচ্ছে । কেউ কেউ আবার দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকছে কিছু সময় ধরে । অবশ্য ওদেরকে আমি দোষ দেই না । আমি ওদের জায়গাতে হলে আমিও হয়তো এইরকমই কৌতুহল দেখাতাম !
নিজের পোশাকের দিকে তাকিয়ে আরেকবার মনে হল এখানে এইভাবে এই পোশাকে আসাটা ঠিক হয় নি । কিন্তু সেলোয়ার কামিজ পরে বাইক চালানোটা একটু ঝামেলার মনে হয় আমার কাছে । এর থেকে জিন্স, টি-শার্ট আর জ্যাকেটই ভাল । আমার দিকে এইভাবে তাকিয়ে থাকার কারন সম্ভবত এই পোশাক । আর এই বাইকটা ।
এখনও ঢাকা শহরের মানুষই মেয়েদের বাইক চালানোটা ঠিক মেনে নিতে পারে নি । মেয়েদের স্কুটি চালানোটা অনেকে মেনে নিলেও সুজুকি বাইক নিয়ে কোন মেয়ে রাস্তায় ঘোরাফেরা করছে এই ব্যাপারটা তারা মেনেই নিতে পারে না । আর এই গ্রামের মানুষগুলোতো পারবেই না !
আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম । তারপর বললাম,
-কোথাও যাবো না ভাইয়া । এখানে একজনের জন্য অপেক্ষা করছি?
-এই গেরামের?
আমি আবারও হাসলাম । মনে মনে বললাম, বেটা কোন গ্রামের সেটা দিয়ে তোর দরকার কি? এতো প্রশ্নের উত্তরই বা তুই জানতে চাস ক্যান?
কিন্তু চাইলেই সব কিছু বলা যায় না । আমিও বলতে পারলাম না । বললাম,
-না ভাইয়া, এই গ্রামের কেউ না । পাশের জেলার এক ছেলে । বিয়ে করতে যাচ্ছে, আমি সেই বরকে নিয়ে পালাবো!
কথাটা বলে আমি আবারও হাসলাম । লোকটার চেহারা দেখে মনে হল সে আমার কথা বিশ্বাস করলো না । আবার অবিশ্বাসও করতে পারছে না । তাকে আরও একটু দ্বিধায় ফেলে দিতে বললাম,
-আচ্ছা আশেপাশে কাজী অফিস কোথায় আছে বলতে পারেন? ছেলের বাবা বুঝছেন, সেই ডেঞ্জারাস মানুষ । হয়তো দেখা যাবে পথের মাঝে আবারও আমাদের ধরে ফেলেছে । তাই ভাবছি কাছেই বিয়ে করে নিবো কোথাও ! আছে নাকি ?
লোকটা আমার দিকে এবার কেমন চোখে যেন তাকালো । তারপর বলল,
-হ, আমগো গেরামেই আছে কাজী । সুরুজ মিয়া । আশেপাশের দশ গ্রামে হেতেই বিয়া পড়ায় !
আমার আসলে বেশ মজাই লাগছিলো কথা বলতে । বললাম,
-একটা কাজ করতে পারবেন ?
-কি কাজ কন ?
-কাজী সাহেবকে রেডি থাকতে বলবেন প্লিজ ! ছেলেকে নিয়ে আসলেই যেন ফট করে বিয়ে করে ফেলা যায় ! আর সেই সাথে চারজন সাক্ষীর ব্যবস্থা করবেন প্লিজ ! দুজন ছেলে আর দুজন মেয়ে । বয়স্ক হলে ভাল হয় ! পারবেন আমার জন্য ? আমার কাছে কিছু টাকা পয়সা আছে । দেওয়া যাবে ! পারবেন ?
লোকটা এবার হাসলো । বলল,
-হ পারুম ।
-তাহলে প্লিজ তাই করুন ।
লোকটা এবার সত্যি সত্যিই উৎসাহ পেয়ে গেল যেন । গ্রামের দিকে হাটা দিতে শুরু করলো । আমি বললাম,
-আরে আপনার নাম কি ?
লোকটা পেছন ফিরে তাকালো । তারপর বলল,
-আমার নাম হাসু ।
-আচ্ছা হাসু ভাই জলদি ব্যবস্থা করুন প্লিজ । ছেলের আসার সময় হয়ে গেছে !
হাসু মিয়াকে দেখলাম প্রায় দৌড়েই গ্রামের দিকে যেতে । লোকটা চলে যেতেই একটু স্বস্তি পেলাম ।
তবে হাসুকে তাড়ানোর জন্য আমি যাই বলি না কেন ঘটনা কিন্তু আসলে এটাই । আমি ফয়সালকে ভাগিয়ে নিয়ে যেতেই এখানে এসেছি । সত্যি বলতে ব্যাপারটা আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না । এতোদিন শুনেছি ছেলেরা বউকে ভাগিয়ে নিয়ে যায় বিয়ের আসর থেকে । আর আমি এমন এক কুম্ভকর্ণের সাথে প্রেম করেছি যে সে নিজে নিজে পালাতে পারবে না । তার নাকি সেই সাহস নেই । এই যুগে এসেও যে কেউ নিজের বাবাকে এতো ভয় পেতে পারে সেটা ফয়সালকে না দেখলে আমার বিশ্বাস হত না । আরে বাবা তুই কি কোন অন্যায় করছিস ? একজনকে পছন্দ করিস সেটা তোর বাবাকে বলতে পারবি না কেন ?
ফয়সালের উপর এমন রাগ হচ্ছিলো যে ইচ্ছে হচ্ছিলো ওর মাথার চুল ধরে সব ছিঁঁড়ে দেই । এমন ভীতু একটা গাধার সাথে ব্রেকআপই করে ফেলি । কিন্তু কি আর করবো ! ভাল তো বাসি ! চাইলেই ছেড়ে চলে যেতে পারি না । অন্যদিকে সে আমার কাছেই ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করেছে । বড় অসহায় শোনাচ্ছিলো ওর কন্ঠটা । পরে ওকে বললাম বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আসতে ! প্রথমে রাজি না হলেও যখন বললাম যে অন্য কাউকে বিয়ে করলে আমি ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে মরে যাবো আর চিঠি লিখে যাবো যে আমার মৃত্যুর জন্য ফয়সাল নামের আহাম্মক দায়ী তখন রাজি হল । যদিও এখনও কাজ হবে কি না বুঝতে পারছি না । সত্যিই ও আসবে কি না সেটাও আমি নিশ্চিত না ।
আমি একটু আগেই ওকে আমার জিপিএস লোকশন পাঠিয়ে দিয়েছি । গতকালই গুগল ম্যাপ ঘেটে এই স্থানটা খুঁজে পেয়েছি । মূল সড়কের পাশেই এটা । ভেতরে বেশ কিছু গাছগাছালি রয়েছে । পথটা দিয়ে একটু দূরে গেলেই প্রধান সড়কে ওঠা যাবে । এখন ফয়সাল ঠিকমত এখানে নেমে আসতে পারলেই হল !
আচ্ছা যদি ও না নামে ?
যদি সত্যিই ঐ মেয়েটাকে বিয়ে করে নেয় ?
আমি এই কথাটা মাথায় আনতে চাইলাম না । এমনটা হতে পারে না । আমার ফয়সাল এমন একটা কাজ করতে পারে না । আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতেই পারে না । কিন্তু সত্যিই যদি সে অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলে তাহলে আমি আসলেই মারা যাবো । ওকে ছাড়া একটা দিনও কল্পনা করা আমার পক্ষে সম্ভব না । কোনভাবেই সম্ভব না । আমার মনে দৃঢ় বিশ্বাস, ও আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারে না ।
আমার কথাটা সত্যি প্রমাণিত করতেই যেন ফয়সালকে দেখতে পেলাম আমি । গাছপালার ভেতর থেকে খানিকটা দৌড়েই এসে হাজির হল । এদিক ওদিক খুঁজতে লাগলো । আমার দিকে চোখ পড়তেই হাসলো । আমি উঠে দাঁড়ালাম বাইক থেকে । ফয়সাল আমার দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করলো ।
আমার কাছে এসে বলল, চল এখন এখান থেকে পালানো যাক !
-কোন দিকে যাবো ?
-আমি কি জানি ? তুমি জানো !
-আমি জানি মানে কি ? এই এলাকা তোমার । তুমি ভাল করে চিনবা । আমি চিনবো নাকি !
-আরে আমি কি এখানে থাকি নাকি ? আমার জেলা পাশেরটা । এই জেলায় আগে এসেছি নাকি ?
মনে মনে গাধাটাকে আরেকবার গালি দিলাম । তবে এখন আর এসব বলে লাভ নেই । আমাকেই কিছু করতে হবে । আমি ফয়সালকে বললাম,
-শুনো, এখন আমরা ঢাকার দিকে যাবো না ।
-কেন ?
-কারন এমন হতে পারে যে আমাদের পেছনে তোমার বাবা ঢাকায় মানুষ পাঠাতে পারে, আমাদের ধরেও ফেলতে পারে ।
-তাহলে ?
-আমরা তোমার শহরের দিকেই যাবো । গুগল ম্যাপ বলছে এই কাঁচা রাস্তা দিয়ে বেশ কিছুটা দূরে গেলে আমরা মেইন রাস্তায় উঠতে পারবো ।
ফয়সালকে কেমন যেন দ্বিধান্বিত মনে হল । আমার কথা যেন ঠিক মেনে নিতে পারছে না । আবার আমার সম্ভাবনাকে ফেলেও দিতে পারছে না । তবে আমার বুদ্ধিটাই ওর কাছে বেশি যুতসই মনে হল । বলল,
-আচ্ছা চল, ঐদিকেই যাওয়া যাক আগে ।
-আফা । কাজী রেডি !
আমি ফয়সালের সাথে কথা বলাতে এতোই ব্যস্ত ছিলাম যে হাসু মিয়া কখন যে পেছনে চলে এসেছে টেরই পাই নি । আমি ঘুরে দাঁড়ালাম । হাসু মিয়া হাসি মুখে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে । বলল,
-ভাইজান চইলা আইসে । চলেন, কাজী সাহেব বইসা আছে !
ফয়সাল কিছু বুঝতে পারছিলো না । আমার দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে বলল,
-কি ব্যাপার ? কাজী মানে ?
আমি কি করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না । আমি হাসু মিয়াকে কেবল তাড়ানোর জন্য ঐ কথাগুলো বলেছিলাম । ভাবি নি যে বেটা সবকিছু এতো দ্রুত ব্যবস্থা করে ফেলবে । ভেবেছিলাম ফয়সাল আসতেই ওকে নিয়ে বাইকে উঠে দৌড় দিবো । আমাদের আর কেউ খুঁজে পাবে না ।
কিন্তু এখন মনে হচ্ছে আর পালানো হল না । তারপরই মনে হল, আচ্ছা, এখানেই বিয়েটা সেরে ফেললে কেমন হয় !
খারাপ হয় না মোটেও !
আমি ফরসালের দিকে তাকিয়ে বললাম,
-চল এখানেই বিয়েটা করে ফেলা যাক !
-মানে ?
আমার কিছু বলার আগেই হাসু মিয়া বলল,
-ভাইজান কুনো টেনশন নিয়েন না । সব রেডি কইরা আইছি । কাজী আর সাক্ষী সব রেডি ! যাইবেন আর কবুল কইবেন । ব্যস, ঝামেলা শ্যাষ ।
আমার দিকে তাকিয়ে ফয়সাল বলল,
-এসব কোথা থেকে জোগাড় করলে ?
বললাম,
-তুমি তো আর করবে না কিছু । সবকিছু আমাকেই জোগাড় করতে হল । এখন চল । আগে বিয়ে করা যাক । পরে ভেবে দেখা যাবে ।
যতখানি ভেবেছিলাম তার থেকে সহজেই বিয়ে হয়ে গেল আমাদের । কেবল বিয়েই নয়, দুপুরের খাওয়াটাও আমরা হাসু মিয়ার বাড়িতেই খেলাম । হাসু মিয়ার বউ বারবার কেবল আমাদের কাছে ক্ষমা চাইতে লাগলো । তার কেবল একটাই কথা যে সে একদমই সময় পায় নি । আরও আগে থেকে জানলে আরও কিছু ব্যবস্থা করা যেত ।
আমি সত্যিই ভাবি নি যে এখানে এমন একটা অপরিচিত স্থানে এসে এমন উপকার পাবো । সেই গ্রাম থেকে বের হতে হতে বিকেল হয়ে গেল । আসার আগে হাসু মিয়ার হাতে আমি হাজার পাঁচেক টাকা গুঁজে দিলাম । প্রথমে নিতে চাইছিলো না । পরে জোর করেই টাকাটা দিতে হল । বলে গেলাম পরে অবশ্যই আসবো এখানে । তখন যেন ভাল আয়োজন করে আমাদের জন্য ।
ফয়সালকে এভাবে বিয়ে করতে হবে আমি কোনদিন ভাবি নি । ইচ্ছে ছিল ফয়সাল আসবে বরযাত্রী নিয়ে । আমি দোতলার বারান্দা থেকে সেই বর আসা দেখবো । ওর আর আমার চোখাচোখি হবে । তখন একটা আলাদা অনুভূতি বয়ে যাবে আমাদের মাঝে । তখনই আমার ঐ মেয়েটার কথা মনে পড়লো । সে হয়তো ফয়সালের আসার জন্য অপেক্ষা করে আছে । হয়তো সেও বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে । বর আসলেই উপর থেকে তাকিয়ে দেখবে ! আমার কেন জানি মন খারাপ হল অচেনা ঐ মেয়েটার জন্য !
গল্পটি আমার লেখা উপন্যাসিকা দ্বিতীয় বাসর এর একটি অংশ বিশেষ
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২১ রাত ২:১৬