ছবি কার্টেসীঃ রহমান আযাদ
সামিনা হকের মনটা মেজাজটা বেশ ফুরফুরে লাগছে । আলিপুরের বাজারে গিয়েছিলেন পরিদর্শনে । বাজারে লোকজন একেবারে নেই । একেবারে সব ফাঁকা । কয়েকটা দোকান খোলা । কেবল নিত্য দরকারি আর কাঁচা বাজারের দোকান গুলো খোলার অনুমূতি আছে এখন। বাকি সব কিছু বন্ধ থাকবে। সব কিছু ঠিক মত চলছে কি না সেটাই দেখতে গিয়েছিলেন । চলেই আসছিলেন তখন দেখতে পেলেন একজন ইলিশ মাছ নিয়ে বসে আছে । হাত দিয়ে দেখলেন সেগুলো একেবারে তাজা । সম্ভবত এখনই আড়ত থেকে এসেছে । চট জলদি ছয়টা মাছ কিনে নিলেন । সামিনার স্বামী আর ছোট ছেলেটা এই ইলিশ মাছ অনেক পছন্দ করে । আজকে বাসায় গিয়ে গরম গরম ভেজে দিতে হবে ।
প্রায় দুই বছর ধরে তিনি এই উপজেলাতে কর্মরত আছে । এখানকার ভূমি উপজেলা সহকারী কমিশনার সে। নিত্য দিন নানা সময়ে নানান স্থানে যাতায়াত করতে । প্রতিটা সময় তিনি এখানে অসংখ্যা মানুষ দেখতে পেতেন । সব দোকান পাট খোলা থাকে । মানুষ জন তাদের দৈনন্দিন কাজে ব্যস্ত থাকে । কিন্তু আজ কদিন থেকে সব যেন থেমে গেছে । এক মরণ ঘাতি ভাইরাসের ছোবল থেকে বাঁচতে সরকার সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছে । মানুষকে ঘরে থাকতে বলা হয়েছে । আর মানুষ যেন ঘরের ভেতরে থাকে সেই ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে । সেই কাজটাই সে করছে নিষ্ঠার সাথে ।
এমন সময় ফোন বেজে উঠলো । ওসি সাহেব ফোন দিয়েছে ।
-হ্যা বলুন বদলুল সাহেব ।
-ম্যাডাম একটু রসুল পুর বাজাতে আসতে হবে ।
-আমি রাস্তাতে আছি । আসছি । কি হয়েছে ?
-ম্যাডাম কজন বাজার বসিয়েছে । আমরা মানা করেছিলাম ।
-আচ্ছা ধরে রাখুন । আমি আসছি ।
সামিনা হক ফোন রেখে সামনের দিকে তাকালো । রাস্তাঘাট একেবারে ফাঁকা । ড্রাইভার বেশ দ্রুতই গাড়ি টানছে । খুব বেশি সময় লাগলো না বাজারে পৌছাতে । সেখানে গিয়ে দেখতে পেল ওসি সাহেব তিন বৃদ্ধকে দাড় করিয়ে রেখেছে ।
তিনজনের শরীরই হাড় জিরজিরে । পরনে লুঙ্গি আর সেন্ড গেঞ্জি । একজনের আমার গেঙ্গিটা ছেড়া । একেবারে প্রান্তিক মানুষ দেখলেই বোঝা যায় । এই করোনা ভাইরাসের কারণে সব থেকে বেশি বিপদে পড়ে এই মানুষ গুলো । সামিনা হক তিন জনের দিকে এগিয়ে যেতেই ওসি সাহেব এগিয়ে এল । তার দিকে তাকিয়ে ওসি সাহেব বললেন, একে তো এখানে মানা করা সত্ত্বেও এরা নিজেদের মালামাল নিয়ে বসেছে । তার উপরে মাস্ক পরে নি । দুইটা অপরাধ করেছে । এদের কি করা উচিৎ ? শক্ত একটা মাইর দিলে অন্যেরা সাহস করবে না ।
সামিনা হক ওসি সাহেবের কথায় খুব বেশি মনযোগ দিলেন না । তিনি আরও একটু এগিয়ে গেলেন । বৃদ্ধ তিন জনের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললেন, কি ব্যাপার মানা করা সত্ত্বেও কেন বের হয়েছেন ?
বৃদ্ধ বলে উঠলো, কি করমু মেডাম আমাদের তো জমা টাকা নাই । খাইতে তো হইবে ।
-তা মাস্ক পরেন কি কেন ?
-একটা মাসকের দাম ৪০ টেকা । চাল কিনতে পারতাছিনা আর মাসক !
ওসি বদলুল বৃদ্ধ লোকটার দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে বলল, চুপ ! মুখে মুখে কথা ।
সামিনা এবার একটু বিরক্ত হল । সে এখানে দাড়িয়ে আছে । তার পরেও ওসি বদলুল কথা বলছে । সে ওসি সাহেবের দিকে তাকাতেই সে চুপ করে গেল । সামিনা পেছন দিকে তাকিয়ে ডাক দিল, রুপম এই রুপম ।
রুপম তার ড্রাইভারের নাম । সে দৌড়ে এল ।
-জি ম্যাডাম ।
দেখো তো আমার গাড়ির পেছনে কয়েকটা মাস্ক আছে । ওগুলো নিয়ে আসো ।
বদলুল সাহেব এগিয়ে এসে কিছু বলতে যাচ্ছিলো তাকে হাতের ইশারাতে থামিয়ে দিল । রুপম ততক্ষনে দৌড়ে গাড়ি থেকে মাস্ক নিয়ে চলে এসেছে । সামিনা হক নিজে এগিয়ে গিয়ে মাস্ক গুলো বৃদ্ধ তিনজনের হাত দিল । তারপর বললেন, ঐ যে নলকূপটা দেখছেন ওখানে প্রতি এক ঘন্টা পরপর গিয়ে হাত ধুয়ে আসবেন । মনে থাকবে?
-জে মেডাম ।
-আর কেউ যদি কিছু কিনতে আসে তাদের কিছু দেওয়ার আগে হাত ধুয়ে নিবেন । মনে থাকবে । এটা অনেক দরকারি । এই মাস্ক পরে নিন । যতক্ষন এখানে থাকবেন । খুলবেন না ।
সামিনা হকের ঘুরে চলেই যাচ্ছিলো তখনই চোখ গেল বাজারের দিকে । বাজারে লোকজন নেই বললেই চলে । বৃদ্ধ তিনজনের একজন আবার ভ্যান চালক । আজকে কি তারা ঠিক মত বাজার করে নিয়ে যেতে পারবে বাসায় ! কেউ কি কিনতে আসবে কিছু ? মনের ভেতরে কেমন যেন একটা অশান্তি কাজ করতে লাগলো । চিন্তাটা মাথা থেকে দুরে দিতে চাইলো । এখানে আপাতত আর কাজ নেই । দুপুর গড়িয়ে যাচ্ছে । বাসায় যাওয়া দরকার ।
গাড়ির কাছে গিয়ে পেছনে রাখা মাছ গুলোর তাকিয়ে সামিনার কি যেন হয়ে গেল । মাছ গুলো দুইটা প্যাকেটে রাখা । একটা প্যাকেট তিনি তুলে নিলেন হাতে । তারপর আবার হাটা দিলেন ঐ তিন বৃদ্ধের দিকে । মাছ তিনটা যখন তিনজনের হাতে দিলেন সামিনা হক লক্ষ্য করলেন তীব্র বিস্ময় তিনি তিনজন তার দিকে তাকিয়ে আছে । তার থেকেও অবিশ্বাস চোখে ওসি বদলুল তাকিয়ে আছে তাদের দিকে ।
সামিনা হক দেখতে পেল তীব্র বিস্ময় একটা সময়ে অশ্রুতে পরিনত হল । তিনজনই অশ্রুসজল চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে ।
সামিনা হক বলল, বাসায় গিয়ে গরম গরম ভেজে খাবেন । ঠিক আছে ?
তিনজনই কেবল মাথা কাত করলো । কোন কথা বলতে পারলো না । তীব্র আনন্দে মানুষের মুখ দিয়ে কথা বের হতে চায় না ।
সামিনা হক আসার আগে বললেন, আমি কি আপনাদের একটা ছবি তুলতে পারি ।
-তুলেন আম্মা ! কুনো সমস্যা নাই ।
সামিনা হক একটু খুশি হলেন । একটু আগে তাকে এই লোক গুলো ম্যাডাম বলে ডাকছিলো । সবাই তাকে ম্যাডাম বলেই ডাকে । কিন্তু এখন আম্মা বলে ডেকেছে । আপন আপন একটা ভাব চলে এসেছে সেই ডাকে । বৃদ্ধ তিনজন তাকে কাছের মানুষই মনে করছে ।
নিজের মোবাইলের ক্যামেরা তুলে ধরলো সামিনা হক । বৃদ্ধ তিনজন তাদের সামনে মাছটা তুলে ধরলো মুখে হাসি নি । সামিনা টুপ করে ছবি তুলে নিল । বৃদ্ধ লোক গুলোর আনন্দ দেখে নিজের মনে অদ্ভুত এক আনন্দ এসে জমা হয়েছে । যে অশান্তিটা কাজ করছিলো সেটা চলে গেছে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মার্চ, ২০২০ দুপুর ২:৩১