তৃষা খানিকটা বিরক্ত চোখে বুয়ার দিকে তাকালো । বুয়া আজকে দুইদিন পরে বাসায় এসেছে । এখন দেশের পরিস্থিতি ভাল না । ওকে বেশির ভাগ সময়ই হাসপাতালে থাকতে হচ্ছে । বাসায় আসার সময় পাচ্ছে খুব কম । তার উপর যদি বুয়া এভাবে কামাই করে তাহলে ঘর সংসারের কি অবস্থা হবে কে জানে ! তৃষা বলল, কি ব্যাপার কাজে আসছো না কেন ?
বুয়া খানিকটা কাচুমচু কন্ঠে বলল, আফা আমি আর আফনের বাড়িত কাম করুম না ।
তৃষা এবার বিরক্ত হল না । বরং খানিকটা বিস্মিত হল । বুয়াকে সে চেনে অনেক দিন । বুয়া তার খুবই ভক্ত । বুয়ার টাকা পয়সার সমস্যা থেকে শুরু করে বুয়া যখনই কোন সমস্যাতে পড়ে তৃষা সবার আগেই এগিয়ে আসে। মাঝে মাঝে বুয়াকে তো কিছু বলতেও হয় না। তৃষা নিজ থেকেই সাহায্য করে । কদিন আগেই বুয়ার বড় মেয়ের এসএসসি পরীক্ষার ফি দিতে পারছিলো না । তৃষা সেটা জানতে পেরে বুয়াকে টাকা দিয়ে দিল । এবং সাথে সাথে এও বলে দিল যে এই টাকা তাকে ফেরৎ দিতে হবে না । এই রকম আরও কত সাহায্য যে করেছে তার ঠিক নেই । আর আজকে বুয়া বলছে সে তার বাসায় কাজ করবে না । তৃষা বলল, কেন করবে না ?
বুয়া চুপ করে রইলো । কিছু যেন বলতে চেয়েও বলতে পারছে না । হঠাৎ পেছন থেকে তাইশা এসে বলল, আম্মু রাহেলা আন্টি মানা করেছে ।
তৃষা নিজের মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, মানে ?
-মানে জানো না ? তুমি না ডাক্তার !
-তো ?
-রাহেলা আন্টি মনে করে যে আমাদের বাসায় কাজ করলে বুয়ার কাছ থেকে তার বাসায় করোনা ভাইরাস চলে যাবে । তিনি আমাদের বিল্ডিংয়ের সব ছেলে মেয়েদের বলে দিয়েছে যেন আমার সাথে না খেলে !
কথা টা শুনতেই তৃষার মাথায় আগুন ধরে গেল । এই অকৃতজ্ঞ মানুষ গুলোর জন্য সে সহ এতো ডাক্তারেরা কষ্ট করে যাচ্ছে । তৃষার বুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, এটাই কি কারণ ?
-জে আফা !
-এই বাসার কত গুলো ফ্ল্যাটে কাজ কর তুমি ?
-আপনে বাদ দিয়া আরও তিন বাসা ?
-কত পাও সব মিলিয়ে ?
-ছয় হাজার টেকা দেয় !
-আমি তোমাকে সাত হাজার দিবো । ওদের বাসার কাজ ছেড়ে দাও ! কেবল আমার বাসায় কাজ কর ! করবা ?
বুয়ার মুখ উজ্জল হয়ে গেল । সে তৎক্ষনাত বলল, জে আফা করুম ।
-তোমার করোনার ভয় নাই তো ?
-জে না আফা ! আমি জানি আফনে কিরাম সাবধান মানুষ । তাইশা মামনির কিছু হয় এরাম কাম আফনে কুনো দিন করবেন না !
তাইশার দিকে তাকিয়ে তৃষা বলল, মামনি কটাদিন ছাদে যাওয়ার দরকার নেই । বাবার সাথে খেলবে কেমন ! বাবা চলে আসবে এখনই। তোমার বাবার অফিস কাল থেকে বন্ধ থাকবে । সে বাসায় থাকবে ।
-আচ্ছা মামনি । আমার বাবার সাথেই খেলতে বেশি ভাল লাগে !
-গুড ! আর সব সময় হাত পা পরিস্কার রাখবে ।
তারপর বুয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি বাসায় এসে আগে ভাল করে গোসল করবে । মনে থাকবে ? যেহেতু এখন অন্য কারো বাসাতে যাচ্ছো না তাই সকাল বেলা আসবে । এখানে গোসল দিবে খাবে, কাজ করবে, টিভি দেখবে বিকেলে যাবে । মনে থাকবে ?
-জে আফা !
তৃষার মেজাজটা তবুও ভাল হল না । এই মহিলাকে সে দেখে নিবে । এই মহিলা শুরু থেকেই এই ঝামেলা করে আসছে । একবার সামনে পড়ুক । তখন মহিলাকে কড়া কথা শুনিয়ে দিবে। তৃষার সামনে ঠিকই রাহেলা বানু পড়লো তবে অন্য পরিস্থিতিতে ।
তৃষা রোগীদের একবার রাউন্ড দিয়ে এসে নিজের চেম্বারে এসে বসলো । আজকে যেন একটু বেশিই ক্লান্ত লাগছে তার । তাইশার সাথে একটু কথা বলতে ইচ্ছে হল ।
অপুর ফোনে ভিডিও কল দিতেই অপু সেটা ধরলো সাথে সাথে। ভিডিও কলে তাইশাকে দেখ গেল একটু দুরে বসে কি যেন আঁকছে । দুজনই ড্রয়িং রুমে বসে আছে । টিভি চলছে ।
-বাবা মেয়ে কি করছো ?
-দেখছেই পাচ্ছো ? একটু আগে তাইশার সাথে ছবি আকার প্রতিযোগিতা দিয়েছি আমি ।
-তারপর ?
-যথারীতি হেরে গেছি ।
-হারবাই । কার মেয়ে দেখতে হবে না ?
-ইস ! আমার মেয়ে যেন না !
-কি করেছো শুনি ? আমার মেয়ে ! আমার !
-আইছে আমার !
-এই ভাষা ঠিক করো !
-আচ্ছা বাবা ! আসছে আমার ! এই শুনো শুনো ....
-কি হল ?
-তোমার জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে ?
-কি সারপ্রাইজ ? বল ।
-আমি বলবো না । তবে একটু পরেই টের পাবা !
-কি হয়েছে বল না !
-আহা টের পাবা । আগে দেখো তাইশা কি একেছে ! তাইশা মাকে ছবি দেখাও ।
তৃষা দেখতে পেল তাইশা এগিয়ে এল । মোবাইলে ওর খাতাটা এগিয়ে দিল । দেখতে পেল একজন ডাক্তার রোগীদের দেখছে । পাশে লেখা আমার আম্মু !
তৃষার মনটা মুহুর্তেই ভাল হয়ে গেল । সব ক্লান্তি দুর হয়ে গেল সাথে সাথেই।
সেই সময়েই বাইরে একটু হইচইয়ের আওয়াজ পাওয়া গেল । তৃষা বলল, এই শুনো ঝামেলা হয়েছে কিছু একটা । আমি রাখি কেমন !
-আচ্ছা । সাবধানে থেকো !
ফোন রেখে দিতেই তৃষা বাইরে এল । এসেই একটু অবাক হল । ওদের রাহেলা বানু আর তার স্বামী গার্ডের সাথে কথা কাটাকাটি করছে । ওকে দেখতেই রাহেলা বানু চিৎকার করে ওকে ডাক দিল । তৃষা এগিয়ে যেতেই গার্ড বলল, ম্যাডাম ইনারা আসলে করোনা ইউনিটে ঢুকতে চাচ্ছে । বলছে আপনাকে নাকি চিনে !
তৃষা বলল, হ্যা চিনে । যাও তুমি আমি দেখছি ।
তারপর রাহেলা বানুর দিকে তাকিয়ে বলল, আপনারা আসুন আমার সাথে !
নিজের চেম্বারে বসালো । তৃষা বলল, বলুন কি সমস্যা ?
রাহেলা বানু এবার হঠাৎ করেই কেঁদে ফেলল । তৃষা খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো । বলল, আরে কি হয়েছে বলবেন তো !
তারা যা বলল তার সারমর্ম হচ্ছে রাহেলার বানুর বড় মেয়ে আর মেয়ে জামাই বাহরাইন থাকতো । কারোনার কারনে তারা দেশে চলে এসেছে । দেশে আসতে গিয়ে পুলিশ তাকে আটকে দিয়েছে এয়ারপোর্ট থেকেই । তাদের শরীরে করোনার লক্ষ্যন দেখা গিয়েছে । তাদের প্রথমে আইসোলোশনে এবং পরীক্ষার পরে করোনা পজেটিভ আসার হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে । এবং এই হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে । এখন রাহেলা তাদেরকে একটু দেখতে চায় !
তৃষা বলল, এভাবে তো আসলে দেখা করার নিয়ম নাই ।
-মা তুমি প্লিজ একটু কিছু কর ! চাইলেই পারবা ! আমি জানি ! একটু সাহাস্য করো !
তৃষা খুব ইচ্ছে করলো সেদিনের কথা তুলতে । কিন্তু তুলতে পারলো না । অসহায় মানুষকে আঘাত করা ওর মন মানসিকতা না । এদেশের অসংখ্যা মানুষ আছে এই রাহেলা বানুদের মত যারা নিজেদের ভাল ছাড়া আর কিছু বোঝে না । যেই মানুষ গুলো তাদের জন্য কষ্ট করে যাচ্ছে, ঝুকি নিচ্ছে নিজেদের জীবন সেই মানুষ গুলোকেও এরা এক ঘরে করে দিতে পিছপা হয়না ।
তৃষা এক কলিগকে তার বাড়িওয়ালা বাসা ছেড়ে দিতে বলেছে কেবল সে এখানে কাজ করে বলে । তৃষা নিশ্চিত সে যদি এই মহিলার বাসায় ভাড়া থাকতো এই মহিলাও তাই করতো । তৃষা বলল, আচ্ছা আমি দেখছি কি করা যায় !
রাহেলা বানু আর তার স্বামীকে তার মেয়ে আর মেয়ে জামাইকে দেখার সুযোগ করে দিল সে । তবে কথা হল না । কেবল দুর থেকে দেখতে দেওয়া হল । আসার সময় তৃষার হাত ধরে মহিলা আবারও কেঁদে উঠলো । তার মেয়েকে যেন ভাল ভাবে দেখা হয় সেই অনুরোধ করলো বারবার । তৃষা তাকে আস্তত্ব করলো যে এখানে তার মেয়ে ভাল থাকবে । তারা সর্বোচ্চ সেবা দিবে ।
তৃষায় বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল । বাসায় ফিরে দেখে অপু এক মনে সোফাতে বসে বই পড়ছে । তাইশা ওর কোলে ঘুমাচ্ছে । ওকে ঢুকতে দেখে উঠে বসতে গেল । তৃষা ওকে উঠতে মানা করলো । দিন শেষে শত ক্লান্তির পরেও এই দুইজনের মুখ দেখলে তৃষার সব ক্লান্তি দুর হয়ে যায় । এদের নিরাপদ রাখতে অন্য সব মানুষকে সেবা দিয়ে যেতে হবে । যত সে কাজ করবে ততই এরা নিরাপদ থাকবে । মানুষ তাদের কে না চাক, অন্যায় আচরন করুক, সে তবুও এদের জন্য কাজ করে যাবে । যেতে হবে !
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০২০ রাত ৯:৩৭