আমার একটা ফেসবুক পেইজ আছে । সেখানে মাঝে মাঝেই অনেকে আমাকে গল্প লিখে দিতে বলে । এই কাজটা আমি করি কম । অন্যের জন্য গল্প লিখতে কেমন জানি লাগে । তবে মাঝে মাঝে এম কাজ করতেও ভাল লাগে । গত বছরই এমন একটা কাজ করেছিলাম । বেশ কিছু মানুষের কাছ থেকে থিম নিয়ে গল্প লিখেছিলাম কয়েকটা । সেই গল্প গুলো এখানে পাবেন । এইবারও এমন কিছু কাজ করেছি । নিজের গল্প গুলো আমি লিখলেও গল্প গুলোর থিম আমার নয় । অন্যের থিমে গল্প গুলো আমি লিখেছি ।
ভালবাসার দিবসে ভালবাসার গল্প গুলো আপনাদের জন্য । সবাইকে ভালবাসা দিবসের শুভেচ্ছা ।
গল্প নং একঃ নতুন সকাল
চোখ মেলে কিছু সময় বুঝতে পারলাম না ঘুম টা কেন ভাঙ্গলো । কিছু সময় ছাদের দিকে তাকিয়ে রইলাম কেবল । কেমন যেন শূন্য শূন্য মনে হচ্ছে । এমনটা আমার ছোট বেলা থেকেই মনে হয় । ঘুম ভাঙ্গার পরপরই আমার পুরো পৃথিবীটা বড় বিষাদ মনে হয় । যখন ছোট ছিলাম তখন ঘুম ভাঙ্গার পরে কান্না কাটি করতাম খুব । তবে বয়স বাড়ার সাথে সাথেই সেই কান্নাকাটির বব্যাপারটা বন্ধ হয়েছে । কিন্তু এই মনখারাপের ব্যাপারটা কমে নি । এটা ঠিক হতে আরও কিছুটা সময় লাগবে !
আমি একটা নড়তে গিয়েই আবিস্কার করলাম জেরি আমাকে জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে । ঘরটা একেবারে অন্ধকার না । ঢাকা শহরে রাত কখনই পুরোপুরি অন্ধকার হয় না । রাতের বেলা চাঁদের আলো তো আছেই, সেই সাথে আশে পাশের কোন না কোন ফ্ল্যাটে সারারাত আলো জ্বলেই । যদিও এখন কেবল চাঁদের আলো এসে পড়ছে জেরির মুখে । চাঁদের আলোতে জেরির মুখটা আশ্চর্য মায়াময় মনে হচ্ছে । আমি বেশ কিছুটা সময় সেই ঘুমন্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে রইলাম । আবিস্কার করলাম যে আমার ঘুম থেকে উঠার পর সেই শূন্য শূন্য ভাবটা কেটে যাচ্ছে ! কেবল জেরির চেহারার দিকে তাকিয়েই মনটা ভাল হতে শুরু করেছে ।
ছোটবলো ঘুম থেকে মায়ের মুখটা না দেখলে কান্না জুড়ে দিতাম । তারপর যখনই মায়ের মুখটা চোখের সামনে আসলে মনটা শান্ত হয়ে আসতো । তারপর বড় হওয়ার পরে আরেকটা মানুষের মুখ আমার দেখা লাগতো ঘুম থেকে ওঠার পরে । কিন্তু এমন পরিস্থিতি ছিল না যে তাকে ঘুম থেকেই উঠেই আমি দেখতে পেতাম । আর এখন জেরির মুখটা মনকে শান্ত করার কাজে লাগছে !
মানুষের মন কি অদ্ভুত । সময়ের সাথে ঠিকই সব কিছু মানিয়ে নিতে শুরু করে । এই জন্যই তো জেরির মুখটা দেখে আজকে আমার শান্তি লাগছে । নয়তো কোন হয়তো শান্তিই পেতাম না । ঘুম থেকে উঠে সারা জীবন আমাকে হাহাকারই করতে হত !
আমি খুব সাবধানে জেরিকে এক পাশে রেখে উঠে বসলাম । বারান্দায় চাঁদের আলোয় বসতে ইচ্ছে করছে কিছু সময় । জেরির ঘুম অবশ্য খুব বেশি গাঢ় না । জেগে যেতে পারে এই ভয়ে খুব সাবধানে বিছানা থেকে নেমে এলাম ।
জেরির সাথে বিয়ে হয়েছে মাত্র এক মাস হয়েছে । এরই ভেতরে মেয়েটার প্রতি আমার একটা আলাদা টান চলে এসেছে । এটাই সম্ভবত স্বাভাবিক কিংবা বলা যায় এমনটাই হয় । বিয়ের মত একটা পবিত্র সম্পর্কে যখন মানুষ জড়িয়ে পড়ে তখন সামনের মানুষটার প্রতি একটা টান উপর থেকে তৈরি হয়ে যায় ! জেরির প্রতিও তাই চলে এসেছে ।
আমি বারান্দায় দাড়িয়ে কিছু সময় নিশ্চুপ শহরের দিকে তাকিয়ে রইলাম । বেশির ভাগ বিল্ডিংই নিশ্চুপ হয়ে রয়েছে আলো নেভালো তবে কিছু কিছু ফ্ল্যাটে এখনও আলো জ্বলছে । সারা জ্বলবে এগুলো । একটা সময় ছিল আমার ফ্ল্যাটেও আলো জ্বলতো প্রায় সারা রাত ! ঐশীর সাথে রাত ভয় কথা নয়তো চ্যাটিং চলতো । আচ্ছা আজকে ঐশীর সাথে যদি আমার বিয়ে হত তাহলে কি আমরা রাত ভর আলো জ্বেলে গল্প করতাম ?
বলতে পারি না । অনেক কিছুই হতে পারতো ! এখন সে কোথায় আছে ?
দুর দেশে অন্য কারো বুকে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে ?
নাহ ! এখন ঐ দেশে সবে মাত্র সন্ধ্যা । আমি মাথা থেকে ঐশীর চিন্তাটা দুর করে দিলাম । এখন আর ওকে নিয়ে ভাবাভাবির কিছু নেই । নিজের স্বার্থের জন্য যে মেয়ে আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারে তার কথা ভেবে কি লাভ !
-ঐশীর কথা ভাবছো ?
আমি খানিকটা চমকে উঠলাম । কখন যে জেরি পেছনে এসে দাড়িয়েছে বুঝতেই পারি নি । আমি বললাম, কই নাতো !
জেরি হাসলো । আমার মিথ্যে বলা টা ও ঠিকই ধরতে পারলো । তবে কিছু বলল না । মন খারাপ করলো না । কিংবা মন খারাপ হল ওর আমি ঠিক ধরতে পারলাম না ।
জেরি আবারও আমার শরীর ঘেষে দাড়ালো । তারপর ওর নরম গালটা আমার বুকের মাঝে খানিকটা সময় ঘষাঘষি করলো । বলল, মাঝ রাতে বউকে রেখে স্বামীরা যখন বারান্দায় উদাস হয়ে দাড়ায় তখন এর অর্থ কি দাড়ায় বলতো?
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না ।
বিয়ের রাতে ঐশীর কথা জেরিকে বলাটা কি ঠিক হয়েছিলো ?
একদিন না একদিন ঠিকই জেরিন জেনে যেত । আর জেরি নিজেও ওর আগের রিলেশনের কথা আমাকে বলেছিলো । সেইদিন ওর একটা কথা শুনে আমার খুব ভাল লেগেছিলো । ও বলেছিলো, অতীত নিয়ে আমাদের মাঝে কখনও ঝগড়া লাগবে না । অতীতকে অতীতেই রাখবো আমরা । যা হয়েছে হয়েছে । সামনের দিন গুলো আমাদের ভাল হবে । দেখো তুমি আমি মিলে একটু চেষ্টা করলেই ভাল হবে !
জেরি বুকে মুখ রেখেই বলল, আর কটাদিন সময় দাও আমাকে দেখো আর মনে পড়বে না অন্য কারো কথা !
আমি ওকে আমার চোখের সামনে নিয়ে এসে ওর কপালে একটা ছোট্ট করে চুমু খেলাম ! বললাম, আমি জানি !
-কফি খাবা ?
আমি এবার ওকে খানিকটা জড়িয়ে ধরে বললাম, আসো কফি পরে খাওয়া যাবে । আপাতত এখানে খানিকটা সম দুজন দাড়াই !
ওকে জড়িয়ে ধরেই বেশ কিছুটা সময় আমরা সামনের দিকে তাকিয়ে রইলাম । জেরি শরীরের উষ্ণতা আমার মনকে আনন্দ দিচ্ছিলো । ধীরে ধীরে চাঁদের আলো কমে এসে পুব আকাশে আল ফুটতে শুরু করে দিল । তারপর দুরে কোথাও আযানের আওয়াজ শুনতে পেলাম । এরপর আস্তে আস্তে পুরো শহরের মসজিদের মাইক গুলো যেন জেগে উঠলো । একে একে সব কটা মসজিদের আযান শুনলাম আমরা !
নামাজের পর জেরির সাথে আবারও বারান্দায় এসে বসলাম । জেরি এরই ফাঁকে আমার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে এসেছে । দুজন তাকিয়ে রইলাম পূর্ব দিকে । আজকে ওর সাথে আমার প্রথম বারের ভোর হওয়া দেখা হবে । নতুন জীবনের শুরুটা আরও ভাল ভাবে হবে আজ থেকেই ।
গল্প নং দুইঃ জন্মদিন
শিশিরের মনটা অস্থির হয়ে আছে । খানিকটা মন খারাপও । মোবাইলটা হাতে মনে হল একবার অপুকে ফোন দেয় কিন্তু দিতে পারলো না । এই সময়ে বাসার সবাই জেগে আছে । ফোনে কথা বলতে গেলেই ওর মা কিংবা বাবা টের পেয়ে যাবে । মায়ের ফোনটাও এখন কোন ভাবেই পাওয়া যাবে না । আগে ওর মা ঘুমাক তারপর কিছু একটা ভাবা যাবে । কিন্তু অপু কি আজকে কি বলল ওর মাথায় ঢুকছে না ।
বলেছিলো যে কালকে ও আমার সাথে দেখা করবে যেকোন ভাবেই । কিন্তু কিভাবে করবে ?
কাল শুক্রবার ! কোন ভাবেই শিশির বাসা থেকে বের হতে পারবে না । কোন অযুহাতেই বের হওয়া যাবে না । ও মা এই ব্যাপারে খুব কড়া ! আর মাকে কোন ভাবেই বোকা বানানোর উপায় নেই । রাতের বেলা মায়ের কাছ থেকে কোন রকমে ফোনটা চেপে নিয়ে আসতে পারে গান শুনবে বলে । এটাতে ওর মা মানা করে না । কিন্তু এর বেশি আর কিছুই করার নেই ।
শিশির মনটা খারাপ অবশ্য অন্য কারনে । কাল ভালবাসা দিবস । এমন একটা ছুটির দিনে ভালবাসা দিবস পড়েছে কোন ভাবেই বাসা থেকে বের হওয়ার উপায় নেই । ওর বান্ধবীরা যেভাবে প্রেম করে সেই ভাবে কিছু করার কথা ও একবার চিন্তাও করতে পারে না । কিন্তু অন্তত চোখের দেখা হলেই ও খুশি । অপু ওর দিকে কি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে বড় বড় চোখ নিয়ে । সেই দৃষ্টিতে ওর শান্তি কেবল ! এই শান্তিটা ও মন প্রাণ জুড়ে অনুভব করে । আর বারবার মনে হয় কেউ কি এমন ভাবে কাউকে ভালবাসতে পারে !!
শিশিরের আজও মনে হয় সেদিনও অপুকে সে কতই না বকাঝকা করেছে আর আজকে ওর মনটা কেবল অপুর দিকে তাকিয়ে থাকতে চায় । কি অদ্ভুত এই মানুষের মন । পড়াশুনাতে শিশির বরাবরই ভাল । ক্লাসে সব সময় প্রথম হয় । সব বিষয়ে ওর বেশি নম্বর পাওয়া চাই ই চাই । সেটা কলেজের পরীক্ষা হোক আর কোচিংয়ের পরীক্ষাই হোক না কেন ! এমন একটা পরীক্ষায় যখন শিশির দেখতে পেল ও সব থেকে বেশি নম্বর পাই নি তখন ওর চোখ কপালে উঠলো । রাগে পুরো শরীর জ্বলে যাচ্ছিলো । বারবার মনে হচ্ছে এই বদটা কে যে ওর থেকে বেশি নম্বর পেয়েছে ।
যদিও তখন অপু নামের কাউকেই সে চেনে না । নতুন ম্যাথ কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছে ও । ওর কাছে ওর কয়েকটা বন্ধুও ভর্তি হয়েছে । সেখানেই প্রথম পরীক্ষাতে ওর থেকে এই মুরাদ সরকার অপু নামের একজন ওর থেকে বেশি পেয়েছে । নোটিশ বোর্ডে ওর নিজের নামের আগে অন্য একজনের নাম দেখেই ওর মেজাজটা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো । ইচ্ছে করছিলো খুব করে মাইর দেয় সে এই ছেলেটাকে ! কিন্তু চাইলেই সব কিছু করা যায় না ! বান্ধুদের কাছে এই অপুর ব্যাপারে খোজ খবর নিতে শুরু করলো ।
আর মনে মনে ঠিক করে নিল যে এইবার তাকে সব থেকে বেশি নম্বর পেতেই হবে ।
ক্লাস করতে শুরু করলো মন দিয়ে। সেই সময়েই একদিন আবিস্কার করলো যে একটা ছেলে পুরো ক্লাসের সময়ই ওর দিকে কেমন হা করে তাকিয়ে থাকে । একদিন যখন মনে মনে ঠিক করেই রেখেছে এই ছেলেটাকে আচ্ছা করে বকা দিবে । যদি তাতে কাজ না হয় তাহলে বাবার কাছে বলে দিবে । শিশিরের বাবার এই শহরে বেশ প্রভাব রয়েছে । ক্ষমতাও আছে বেশ । সে সব কিছু সামলে নিতে পারবে ।
কিন্তু যখন জনতে পারল যে এই ছেলেটার নামই অপু তখন কেন জানি শিশির কিছুই বলতে পারলো না । কেন বলতে পারলো ও নিজেও বলতে পারে না । পরের পরীক্ষাতেও অপু সব থেকে বেশি নম্বর পেল । ওর থেকে দুই নম্বরে এগিয়ে । তবে এইবার অপুকে সে মোটেই বকাঝকা করলো না মনে মনে । আর সেই সাথে এটাও লক্ষ্য করলো যে অপু ওর দিকে কি অদ্ভুত মায়া নিয়ে তাকিয়ে থাকে সেটা ওর কাছে মোটেও খারাপ লাগছে না ।
কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো অন্য খানে । একদিন কলেজ থেকে ফেরার সময় ওর বান্ধবীর নিলিমা ওকে ডেকে বলল, এই শুনছিস ?
-কি ?
-অপু আছে না ?
অপুর নামটা শুনেই কেমন যেন বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো ওর মাঝে ! নিজেকে কোন ভাবে সামলে বলল, কি হয়েছে ?
-ও তোকে আজকে একটা চিঠি দিতে বলেছিলো আমাকে ?
নিলিমার দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, তারপর ?
-তারপর আর কি ? আমি তো তোকে চিনি । খুব স্পষ্ট করেই বলে দিয়েছি যে এসব তোর পছন্দ নয় । আর এরপর যদি বেশি কিছু করে তাহলে তোর বাবাকে বলে দিবো ।
-তারপর ?
-আরে তারপর আবার কি ? চলে গেল । বেশি কিছু করতে গেলে আমি নিজেই তোমার বাবার কাছে রিপোর্ট করে দিবো । বেটার সাহস তো কম না !
অন্য যে কারো বেলাতে এই কাজটা করা হলে হয়তো শিশির খুশিই হত কিন্তু অপুর বেলাতে কেন জানি ও খুশি হতে পারলো না । কিন্তু নিকিমাকে কিছু বলতেও পারলো না । পরের দিন কোচিংএ গিয়ে অপুকে আর দেখতে পেল না । পরপর এক সপ্তাহ যখন অপুকে আর কোচিংএ দেখতে পেল না তখন ওর মন খানিকটা অস্থির হয়ে উঠলো। ও খোজ নিয়ে জানতে পারলো অপু কোচিং ছেড়ে দিলো । এরপর কত সময় কেটে গেছে শিশিরের ঠিক মনেও নেই । মনের মাঝে ঐ ছেলেটার কথাই কেবল ঘুরপাক খেতে লাগলো
শিশিরের যখন মনে হল যে অপুর সাথে সম্ভবত আর কোন দিন দেখা হবে না তখনই খানিকটা আশ্চর্য ভাবে অপুর ফোন নম্বর ওর কাছে এসে হাজির হল । কত দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাটিয়ে মায়ের ফোন থেকে একদিন রাতের বেলা ও অপুকে ফোন দিয়ে ফেলল । ও পাশ থেকে ফোন রিসিভ হওয়া পরেও শিশিরের মুখ দিয়ে একটা কথা বের হচ্ছিলো না । বুকের মাঝে কেমন ধরফর করছিলো । মনে হচ্ছিলো যেন ও বুঝি এখনই মারা যাবে ।
শিশির কিছু না বললেও কিভাবে যেন অপু বুঝে গেল যে কে ফোন দিয়েছে । শান্ত কন্ঠে বলল, এক গ্লাস পানি খাও আগে । অস্থিরতা কমবে ।
পাশের টেবিলে রাখা গ্লাসটা থেকে পানি খেয়ে নিল । কিছুটা ধাতস্ত হতে অপু বলল, এতোদিন পরে আমার কথা মনে পড়লো ?
শিশির চুপ করে থেকে বলল, আমি কোন দিন ভুলিই নি !
ব্যাস আর কোন কথা হয় নি সেদিন । তবে এরপর থেকে প্রা্যই কথা হত । তবে অবশ্যই সেটা সবার চোখ এড়িয়ে । ঠিক পরের ভেলেন্টাইনে অপুকে সরাসরি ভালবাসি বলে দিল । যদিও বলার কোন দরকার ছিলো না । ততদিনে দুজনেই বুঝে গেছে যে তারা একে অন্য কে ভালবাসে !
শিশির ঘড়ির দিকে তাকালো । বারোটা বেজে গেছে একটু আগে । ওর মায়ের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে এসেছে । যে কোন সময় অপু দিবে । কিন্তু রাত একটা বেজে গেল তবুও অপুর ফোন এল না । যখন মনে যে আজকে হয়তো আর ফোন দিবে না তখনই মোবাইলটা একটু ভাইব্রেট করে উঠলো । একটা মেসেজ এসেছে ।
মেসেজটা পড়তেই ওর পুরো শরীরটা কেঁপে উঠলো ।
অপু পাঠিয়েছে মেজেসটা । ও এখন ঠিক ওদের বাসার পেছনের গেটে দাড়িয়েছে ।
শিশির কি করবে বুঝতে পারছে না । এখন ঘর থেকে বাইরে বের হতে গেলে যে কেউ দেখে ফেলতে পারে । তখন একটা কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে । ও চাইলে এখনই অপুকে একটা ফিরতি মেসেজ দিয়ে জানাতে পারে যে সে বাইরে বের হতে পারবে না । তাহলে হয়তো অপু চলে যাবে । কিন্তু কিছুতেই সে কাজটা করতে পারলো না । দীর্ঘ একটা দম নিল । তারপর দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল । পা টিপে টিপে এগিয়ে গেল বাড়ির পেছনের দরজার দিকে । বুকের মাঝে ভয়টা আস্তে আস্তে বাড়ছেই ওর !
অপু বলেছিলো আজকে দেখা হবেই । ওর দেওয়া কথাটা সত্য করতেই হবে !
গল্প নং তিনঃ ফিরে আসা বসন্ত
অপুর সাথে এখানে এভাবে দেখা হয়ে যাবে মৌ সেটা ভাবতেই পারে নি । মৌ আগে থেকেই জানতো অপু এই শহরেই থাকে । মনে হয়েছিলো কোন না কোন দিন অপুর সাথে দেখা হলেও হয়ে যেতে পারে কিন্তু আজই যে দেখা হয়ে যাবে সেটা ও ভাবতেই পারে নি । আজকের দিনটা ওর জন্য কত খানি আনন্দের ছিল । জীবনের প্রথমবারের মত একুশের বই মেলাতে এসেছে ।
ছোট বেলা থেকেই ওর বইয়ের প্রতি আলাদা একটা টান ছিল । সেখানে বই সেখানেই মৌ । ওদের জেলাতে বছরে একবার মেলা হত শিল্পকলা প্রাঙ্গনে । তবে সেটা হত খুবই ছোট পরিসরে আর মাত্র তিন দিনের জন্য । সেখানে গিয়ে মৌয়ের কিছুতেই মন ভরতো না । টিভিতে যতবার একুশের বইমেলা বিষয়ক অনুষ্ঠান দেখানো হত ততবারই ও মনযোগ দিয়ে সেটা দেখতে । একদিন স্বপ্ন দেখতো যে ও নিজেও বইমেলাতে গিয়ে হাজির হবে । নিজের পছন্দ মত বই কিনবে ।
মৌ জানতো যে অপু এই ঢাকাতেই থাকে। কিন্তু এভাবে আজকে চোখের সামনে পড়ে যাবে সেটা ও ভাবতেও পারে নি। ওর সব আনন্দ যেন চোখের নিমিষেই গায়েব হয়ে গেল। কতই না আনন্দ নিয়ে আজকে এসেছিল বই মেলাতে অথচ এখন আর থাকতে ইচ্ছে করছে না।
মৌ সিদ্ধান্ত নিলো যে আর এখানে থাকবে না। এখনই মেলা ছেড়ে চলে যাবে। অন্য কোনদিন আসবে। কিন্তু বের হওয়ার সুযোগ পেল না। যে গেট দিয়ে মেলাতে ঢুকেছে সেই গেট দিয়ে বের হওয়ার উপায় নেই। অন্য গেট দিয়ে বের হতে হবে। মৌ একটু চুপ করে দাড়িয়ে রইলো। অপু এখনো ওকে দেখতে পায় নি। মৌ ঘুরে অন্য দিকে এগিয়ে গেল। অপুর মুখোমুখি না হলেই হল। ও নিজের জন্য বই কিনে নিজের মত চলে যাবে। যেদিকে অপু দাড়িয়েছিল মৌ তার বিপরীত দিকে হাটা দিল। মেলায় যখন এসেছে বরং একটু ঘুরেই দেখা যাক।
মৌ আপন মনে হাটতে লাগলো। মনের ভেতরের তোলপাড় টা আস্তে আস্তে কমে আসছে। সে চাইলো অপুর কথাটা একদমই ভাববে না। বইয়ের সাথে ওর সম্পর্ক টা অনেক পূরানো। যখন অপু ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল তখনও এই বই ই ওকে সঙ্গ দিয়েছে, নিজেকে আবার ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করেছে। আজকেও আবার বই ওকে সাহায্য করছে। কয়েকটা বই কিনেই ফেলল। অবশ্য খুব সাবধানে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ওড়না দিয়ে মাথাটা একটু পেঁচিয়ে নিয়েছে। যাতে সহজে ওকে চেনা না যায়। ও আর কোন ভাবেই অপুর সামনে পড়তে চায় না।
কিন্তু সেটা আর হল না। অপু ঠিকই ওর সামনে এসে দাড়ালো। মৌ ওর চোখের দিকেই তাকিয়ে বুঝলো যে অপু ওকে অনেক আগেই দেখেছে। এতো সময় নিশ্চয়ই ওর পিছু পিছু হাটতেছিল।
অপু কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে মৌয়ের দিকে। মেয়েটা এখানে দেখতে পাবে মোটেও ভাবতে পারি নি। ব্রেক আপের পর থেকেই মৌকে ও খুব করে মিস করতে শুরু করে। ওকে হারিয়েই বুঝতে পারে অপু তাকে কতখানি ভালবাসতো। এতোদিন নিজের ইগোর কারনে মৌয়ের সামনে গিয়ে দাড়াতে পারে নি কিন্তু আজকে এভাবে চোখের সামনে এভাবে হাজির হতে দেখে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না। সব কিছু এক পাশে সরিয়ে রেখে মৌয়ের পিছু নিল। আজকে যেন ওকে অন্য দিনের চেয়েও একটু বেশি সুন্দর লাগছে। গোলাপী রংয়ের একটা কামিজের সাথে একটা সাদা লেগিংস পরেছে মৌ আজ। ওকে দেখতে সত্যিই খুব চমৎকার লাগছে।
মৌ।
একেবার মৌয়ের সামনে গিয়েই দাড়ালো। মৌ খানিকটা ভড়কে গেলেও সামলে নিল। তারপর যথা সম্ভবত কড়া করে বলল, কি চাই?
অপু বলল, বাহ এতো কঠিন আচরণ?
-কি চান বলুন?
-যা চাই তাই দেবে বুঝি!
-দেখুন হেয়ালি ভাল লাগছে না আমার। পথ ছাড়ুন
-মোটেই ছাড়বো না। পথ ছাড়ার জন্য তো আটকাই নি।
-দেখুন, আপনার সাথে যা ছিল সব শেষ হয়ে গেছে।
অপু এই কথা শুনে মৌয়ের দিকে আরও একটু এগিয়ে গেল। মৌ একটু যেন পিছিয়ে যেতে গিয়েও গেল না। অপুর একেবারে মুখোমুখি দাড়িয়ে পড়লো।
অপুকে এতো কাছ থেকে সে কোনদিন দেখেনি। যখন সম্পর্ক ছিল তখনও এতো কাছে কোনদিন আসে নি। বুকের ভেতরে কেমন ধুপধাপ করতে থাকলো কিছু সময়ের জন্য। মৌ অপুর চেহারা দিকে ভাল করে তাকালো।
ইস ঠোঁট টা কালো হয়ে গেছে আগের থেকে। নিশ্চয়ই সিগারেট খাচ্ছে খুব! সেই খাড়া নাক আর গাঢ় চোখ। চোখের দিকে তাকাতেই মৌ চমকে উঠলো। অপুর চোখে আগে একটা অহংকারী ভাব ছিল কিন্তু এখন সেখানে অন্য কিছু দেখতে পাচ্ছে। সেখানে একটা অন্য ধরনের ব্যকুলতা দেখতে পাচ্ছে। এ ব্যকুলতা কার জন্য? ওর জন্য কি?
নাহ! ওর জন্য নয় মোটেও।
-চল এখান থেকে ।
-কোথায় ? আমি আপনার সাথে কোথাও যাবো না ।
মৌ বলতে গেল কিন্তু কোন কাজ হল না । ও কেবল অনুভব করলো যে অপু ওর হাত চেপে ধরেছে । তারপর এক প্রকার টানতে টানতেই নিয়ে যাচ্ছে । ওকে যখন সিএনজিতে ওঠালো মৌ চাইলেই চিৎকার করতে পারতো । আশে পাশের মানুষ নিশ্চয়ই এগিয়ে আসতো । ওকে নিয়ে যেতে দিতো না কিন্তু মৌ কোন চিৎকার করতে পারলো না । একটা অচেনা অনুভূতি ওকে চিৎকার করতে দিলো না । অপু ওকে তখনও ধরে রেখেছে ।
পুরো রাস্তায় মৌ একটা কথাও বলল না । অপুও চুপ করেই রইলো । যখন সিএনজিটা থেকে মৌ নামলো মুহুর্তেই অবাক হয়ে গেল । চরিদিকে কাশবন দেখা যাচ্ছে । মাঝ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে । যদিও কাশবনটা এখন শেষের দিকে । শীত পর্যন্ত ফুল টিকে থাকে না । তারপরেও জায়গাটা চমৎকার লাগলো ওর কাছ ।
একভাবে তাকিয়ে রইলো । কিছুটা সময় ।
পেছন থেকে অপু বলল, পছন্দ হয়েছে ?
-খুব । তবে কাশ ফুল যখন ফোটে তখন আসলে আরও ভাল হত !
-আচ্ছা তখনও নিয়ে আসবো তোমাকে চিন্তা কর না ।
-ইস আপনার সাথে কেন আসবো ? আর এরকম ঠোঁট কালো সিগারেট খাওয়া ছেলের সাথে আসবোই না !
-তাহলে আজকে এলে কেন ? চাইলেই চিৎকার করতে পারতে । মানুষজন ছুটে আসতো ।
মৌ কিছু বলতে গিয়েও বলল না । বলতে পারলো না । ও যে এখনও অপুকে ভালবাসে সেটা আর কেউ না জানলেও ও নিজে তো জানে ! আর এখন মনে হচ্ছে অপুও ব্যাপারটা জানে খুব ভাল করেই ।
মৌ বলল, আমি আসবো না আসবো আসবো না !
এই বলে সে একটু দরে যেতে চাইলো তবে কোন লাভ না । অপু ততক্ষনে ওর খুব কাছে চলে এসেছে । খুব কাছে এসে বলল,
- মৌ, আমি জানি আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি। অকারণে কষ্ট দিয়েছি। সবচেয়ে বড় অন্যায় করেছি তোমাকে ছেড়ে চলে গিয়ে ! আসলে তোমার অতীত আমি মেনে নিতে পারি নি। হয়তো তোমার আমাকে আরেকটু সময় দেয়া উচিত ছিল, আমার আরেকটু ম্যাচিউর হওয়ার দরকার ছিল । তুমি যোগাযোগ বন্ধ করাতে খুশিই হয়েছিলাম কিন্তু কয়েকমাস যাওয়ার পরই বুঝতে পারলাম যে আমি শান্তি পাচ্ছি না, তোমাকে ছাড়া থাকা অসম্ভব। ফিরে আসতেও পারছিলাম না, মেইল ইগো তো জানোই। আজ বইমেলাতে তোমাকে দেখে থাকতে পারলাম না। আমি জানি তুমি আমাকে এখনো ভালবাস। প্লিজ কাম ব্যাক ইন মাই লাইফ।
মৌ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অপুর দিকে। এই অপুকে ও চেনে না। রাগী, মুডি অপুর সাথেই ও পরিচিত। মৌ তাহলে ঠিকই শুনেছে, অপু আসলেই বদলে গেছে, ম্যাচিউর হয়ে গেছে অনেক অনেক বেশি।
কিন্তু মৌ ওর অনুভূতিগুলো এখনই বুঝতে দিতে চায়না। সময় নিতে চায়। তাই ও অন্য দিকে তাকিয়ে রাগ রাগ কন্ঠে বলল,
-সিগারেট খেয়ে খেয়ে গোলাপি ঠোঁটগুলার তো বারোটা বাজিয়েছেন । সিগারেট ছাড়, তারপর বিবেচনা করব।
অপু হেসে ফেলল। মেয়েটা আসলে একদমই বদলায় নি । অপু মৌয়ের কাঁধে হাত দিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
-তোমার ঠোঁট গোলাপি হয়ে গেছে অনেক। আমার এতেই চলবে।
মৌ অপুকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে চাইল কিন্তু পারল না। তার আগেই অপু শক্ত করে ওর কোমড় জরিয়ে ধরে ওর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরেছে।
গল্প নং চারঃ স্কেচ
-কি আঁকবা ?
মৌরি কি বলবে কিছু সময় সেটা বুঝতে পারলো না । সাধারনত এই ধরনের অনুরোধ রাখে না । আর ওর স্কেচ আকার ব্যাপারটা একেবারেই নিজ থেকে আসে । কেউ যদি ওকে বলে যে ওর একটা স্কেট এসে দিতে তাহলে কেন জানি সেটা ও মোটেও আঁকতে পারে না । আঁকতে পারে না সেটা বললে ভুল হবে । কথাটা হচ্ছে ওর নিজের মত মত হয় না । তাই এই কাজটা সে মোটেই কারতে চায় না ।
কিন্তু সামনের মানুষটাকে সে না বলতে পারছে না । কিভাবে বলবে ঠিক বুঝতেও পারছে না । অপু আবার বলল, আঁকবা একটা স্কেচ?
মৌরি বলল, আচ্ছা ! আপনার একটা ছবি দিয়েন । ফেসবুকে দিয়েন না । ফেসবুকে ছবি ভাল আসে না । মেইল করে দেন । তাহলে ভাল হবে !
মৌরি চুপ করে কিছু সময় বসে রইলো । কিছু যেন মাথায় কাজ করছে । পুরানো কিছু কথা মনে চলে এল ওর । তখন ও কোন ক্লাসে পড়ে ! মৌরি একটু মনে করার চেষ্টা করলো । তখন সবে মাত্র ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হয়েছে । পড়াশুনা ওর কাছে বেশ কঠিন মনে হত । ক্লাস কিংবা কোচিংয়ের পরীক্ষাগুলোতে সব সময়ই সবার থেকে কম নম্বর পেত । বাসা থেকে প্রায়ই বকাঝকা শুনতে হত ।
এই নিয়েই ওর মন খারাপ থাকতো । ঠিক সেই সময়ই ফেসবুকে অপু নামের এই মানুষটার খোজ পায় সে । সে তখন ফেসবুকে মোটিভেশনাল লেখা লিখতো । সেগুলো পড়েই তার বেশ ভাল লাগতো । লেখা গুলো পড়ে কেবল মনে হত যে বুঝি ওর কথাই কেউ লিখছে !
তারপর ফেসবুকে তাকে ইণবক্স করা, সেখান থেকে ফোন নম্বরে কথা বলা । কন্ঠটা শুনতে বেশ লাগতো ওর । মৌরিকে খূব উৎসাহ দিত । মৌরির ভালই লাগতো অপুর সাথে কথা বলতে । কিন্তু তারপরই ঘটনাটা ঘটলো । অপু নামের মানুষের কিছু বিশ্রি স্ক্রিনশট বের হল । মৌরি জানলো যে এই ছেলে কেবল তার সাথেই নয় আরও অনেকের সাথেই কথা বলে । এবং সেই কথা গুলো খুব বেশি সুন্দর ছিল না ।
যাই হোক সীমটা বন্ধ করে দিয়েছিলো যাতে অপুর সাথে আর কথা না হয় । তারপর অনেক দিন এই অপুকে আর সে দেখেছি । কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর থেকে সে ফেসবুক ছেড়ে দিয়েছিলো । মৌরিও এই অপুর কথা ভুলেই গিয়েছিলো ।
তরপর কেটে গেছে কয়েকটা বছর । মৌরি এখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে । কয়েক মাসে আগে হঠাৎ একদিন একটা মেসেজ রিকোয়েস্ট আসলো । মেজেসটা বক্সটা খুলে দেখলো একটা অপরিচিত আইডি থেকে ওকে মেসেজ পাঠিয়েছে । আইডির নাম অপু রহমান । মৌরি নামটা ঠিক মনে করতে পারলো না ।
মেসেজ করে তাকে জানালো যে মৌরির এই নাম্বারটা নাকি তার ফোনবুকে সেভ ছিল । কিন্তু কিছুতেই সে তাকে চিনতে পারছে না । মৌরির তখনই অপুর কথা মনে পড়ে গেল ।
একবার মনে হল যে মেসেজটা ডিলিট করে দেয় । কিন্তু কেন জানি সেটা পারলো না । অন্য সবার সাথে যাই করুক না কেন মৌরির সাথে অপু ভাল ব্যবহার করেছে । ওর সাথে কখনই আজেবাজে কোন কথা বলে নি । তারপর অপুর সাথে বলা কথা, ওকে দেওয়া উৎসাহ গুলো মৌরির পরের জীবনে খুব কাজে লেগেছিলো । লিস্টে এড করে নিল । ব্যাস তারপর থেকেই কথা হতে শুরু করলো ।
মৌরি আস্তে আস্তে অপুকে সব কথা বলতে শুরু করলো । কেন জানি কথা বলতে ভাল লাগতো ওর । ওর পছন্দ অপছন্দ সব কিছু । অপুও ওকে সব কিছু বলতো । যদিও অপু তখনও ওকে ঠিক চিনতে পারে নি । অবশ্য পারার কথাও না । অপু নিশ্চয়ই অনেক মেয়ের সাথেই কথা বলতো । এতো মেয়েকে কি আর মনে রাখা সম্ভব ! সব চেয়ে ভাল লাগতো যে অপুও ওর সাথে নিজের পারিবারিক সমস্যা নিয়ে কথা বলতো । ওর বাবা মা আলাদা থাকে ছোট বেলা থেকেই । ছেলেটা নাকি কখনই তাদের কাছে পায় নি । কোন পারিবারিক সুখ ছিল না তার । এসব শুনে মৌরির খারাপ লাগতো ।
অপু মৌরির ছবি স্কেচ আঁকার কথাটাও জানতো। তাই একদিন মৌরিকে অনুরোধ করেই বসলো ।
মেইল চেক করে ছবিটা পেয়ে গেল সে । ছবির টার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো । একভাবে । ক্যামেরার দিকে মুখ করে ছবিটা তোলা । তাকিয়ে থাকলে মনে হয় যেন চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে । মৌরির কি হল যে ও বলতে পারবে না । কেবল মনে হল যে সে কিছুতেই আর চোখ সরাতে পারছে না । একভাবে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে । ছেলেটার চোখে কিছু একটা আছে যেটা সহজে বোঝা যায় না । নেশা ধরে যায় কেবল ।
মৌরির স্কেচটা শেষ করতে দিন সাতেক সময় লাগলো । স্কেচটা শেষ করে যখন সেটার দিকে তাকালো তখন মনে হল জীবনে এতো চমৎকার স্কেচ সে আর আঁকেই নি । একভাবে তাকিয়ে রইলো সেটার দিকে । মনে হল স্কেটটা সে নিজের দেওয়া টাঙ্গিয়ে রাখে । কিন্তু এই কাজটা মোটেই করা যাবে না । কাউকে এই জিনিস দেখানোই যাবে না ।
মৌরি জানে এই স্কেচ টা পেলে অপু খুব খুশি হবে । না জানি কি বলে ফেলে !
কিন্তু ভাগ্যে অন্য কিছু লেখা ছিল । ওর রুমমেট হঠাৎই স্কেচটা দেখে ফেলল । ও চট জলদি লুকাতে চাইলেও খুব একটা লাভ হল না । স্কেচ টার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। তারপর বলল, এই ছেলেকে তুমি কিভাবে চেনো?
মৌরি কি বলবে ঠিক বুঝলো না । বলল, এই চিনি !
-এই বদমাইশটা এখনও ঠিক হয় নি ।
মৌরি খানিকটা অবাক হয়ে বলল, মানে ?
-মানে হচ্ছে এ এখন তোমাকে ধরেছে ।
-কি বলছো ?
-সত্যিই বলছি । কদিন থেকে কথা চলছে ।
মৌরি কি বলবে খুজে পেল না । একবার ইচ্ছে হল বলে যে অনেক আগে থেকে তবে সেটা বলল না । বলল, বেশি না মাস দুয়েক ।
-শোন, যদি ভাল চাও এখনই এই ছেলের মেয়েদের সিম্প্যাথি পাওয়ার জন্য মেয়েদের কাছ বানিয়ে বানিয়ে পারিবারিক সমস্যা নিয়ে কথা বলে । কিন্তু বাস্তবে এমন কিছুই না । মেয়েদের খুব প্রসংশা করে । তাদের মন জয় করে রুমে নিয়ে যায় । তারপর বুঝতেই পারছো । তিন মাস আগে এমন কিছু হয়েছে আমার এক বন্ধুর কাছে । বুঝতে পারছি ব্যাটা এখন তোমার পিছু নিয়েছে । সাবধান করলাম । বাকিটা তোমার উপর !
মৌরি চুপ করে কেবল শুনে গেল । স্কেচের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । ছবিটা আঁকতে গিয়ে এই চোখের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো তার কষ্টটা একটু বুকে আটকে থাকলো । মৌরির রুমমেট বলল, এই স্কেচ দেখালে কি বলবে জানো সে বলবে তোমার সাথে দেখা করতে চায় । আরও কত । সাবধান !
রাতের বেলা মন খারাপ করে শুয়েই রইলো । বারোটার দিকে অপুর ফোন আসতেই একবার মনে হল ফোনটা ধরবে না । কিন্তু ধরলো শেষ পর্যন্ত । কঠিন ভাবে নিজেকে বুঝালো । এই ছেলের কাছ থেকে দুরে থাকতে হবে এটাই হচ্ছে শেষ কথা !
-আমার স্কেচটা কি হয়েছে ? আমি কি ঠিক করেছি জানো? তোমার শহরে আসবো স্কেচটা নিতে । দেখা করবে তো আমার সাথ !
মৌরি একটা বড় দম নিল । তারপর বলল, আপনার ছবি আঁকতে পারি নি ।
-সে কি ! কেন ?
-কেন মানে কি ! আসছে না । আর হ্যা আজকের পর থেকে কদিন কথা হবে না !
-কেন ? কি বলছো ? তোমার কন্ঠস্বর না শুনলে যে আমার ভাল লাগে না মোটেও । কি এমন হল হঠাৎ !
-আমার বিয়ে হয়ে গেছে !
একটা মিথ্যা কথা বলল মৌরি !
-কি !
-হ্যা গতকাল আমার বিয়ে হয়ে গেছে । অন্য পুরুষের সাথে আমি আর কথা বলতে চাই না । আচ্ছা রাখুন রাখুন আমার স্বামী ফোন দিচ্ছে ..।
আর কিছু না ভেবে মৌরি ফোনটা কেটে দিল। তারপর নাম্বারটা ব্লক করে দিল । বিছানা ছেড়ে উঠে সবার আগে স্কেচটা কুটিকুটি করে ছিড়ে ফেলল । এই বদ ছেলের কিছুই রাখবে না সে কাছে ।
গল্প নং পাঁচঃ অন্তহীন
লাবণ্য ফোনের ওপাশে জয়ের দীর্ঘ নিঃশ্বাসটা খুব ভাল করেই শুনতে পেল। এই দীর্ঘ শ্বাসটা এতো কঠিন ভাবে বুকে এসে লাগলো লাবণ্য সেটা বলে বোঝাতে পারবে না । একটা কথাও মুখ দিয়ে বের করতে পারলো না । অনেকটা সময় কেবল দুজন চুপ করে বসে রইলো । একে অন্যের নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনছে কেবল।
বাইরে হঠাৎ কোথায় যেন সাইরেন বেজে উঠল । লাবণ্য বিছানা ছেড়ে উঠে গিয়ে জানালার কাছে গিয়ে দাড়ালো । পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখতে পেল শহরের অন্য প্রান্তে আগুনের শিখা দেখা যাচ্ছে । আগুন লেগেছে । আগুন তো তার মনেও লেগেছে । কিন্তু সেই আগুন তো নেভানোর কোন উপায় নেই !
লাবণ্য নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলো । কিন্তু কিছুতেই মনটা শান্ত হল না । শান্ত করতে পারলো না । অথচ এমনটাই হবে সে জানতো । জয়ও খুব ভাল করে জানতো ওদের পরিনতিটা এমনই হবে । তবুও কেন এমন করে মন উতলা হচ্ছে ! কেন মনটা কিছুতেই বুঝতে চাচ্ছে না ।
আজকে লাবণ্যকে পাত্রপক্ষ দেখে গেছে । আংটিটাও পরিয়ে গেছে ওকে । লাবণ্যের মত একটা মিষ্টি মেয়েই নাকি তারা খুজতেছিলো অনেক দিন ধরে । এখন যখন পেয়ে গেছে আর তারা দেরি করতে চায় না ।
অবশ্য লাবণ্যের বাবা মা লাবন্যের উপর জোর জোবরদস্তি করে নি । তারা অনেক বার জিজ্ঞেস করেছে যে লাবণ্যের কোন পছন্দ আছে কি না । পছন্দ থাকলে তারা সেটাকেই আগে বিবেচনা করবে ।
কিন্তু লাবণ্য কিছু বলতে পারে নি । কিই বা বলার ছিল । বাবা মাকে বলতে তো পারতো না যে একটা হিন্দু ব্রাহ্মন ছেলে তার পছন্দ ! তাকে খুব ভালবাসে !
জয়কে সে কেন ভালবেসেছে সেটা লাবন্য নিজেও বলতে পারবে না । কেবল ভালবেসেছে এটাই সে জানে । ঠিক একই ভাবে জয়ও ওকে ভালবেসেছে । আর কিছু ওদের মাথায় কাজ করে নি । অন্য কিছু তারা চিন্তা করে নি । ওদের সম্পর্কটা আস্তে আস্তে গড়ে উঠেছে । সেখানে প্রতিদিন দেখা হওয়ার দরকার নেই কিংবা ঘন্টার পর ঘন্টা কথাও বলে না ওরা । তবুও একে অন্যের জন্য একটা স্বর্গীয় টান অনুভব করে ।
জয়ের মত ছেলে হয় না । দেখতে শুনতে ভাল । পড়া শোনাতে এগিয়ে । নম্র ভদ্র । এই বয়সে ছেলেদের যে যে দোষ গুলো থাকে তার ভেতরে কিছু নেই । এমন ছেলেকে যে কেউ পছন্দ করবে । যদি ওদের ধর্মটা এক হত তাহলে বাবা মাকে বড় মুখ করে বললেও বলতে পারতো । কিন্তু লাবণ্য বলতে পারে নি । বলতে পারার কথাও না ।
লাবণ্য আরও কিছুটা সময় কানে ফোনটা চেপে ধরে রাখলো । জয় হঠাৎ বলল, বিয়ে কবে ?
লাবণ্য বলল, এতো নিশ্চিত কিভাবে হচ্ছো যে ওরা আমাকে পছন্দ করেই গেছে ?
-আমি জানি ! আমার লাবণ্যকে কেউ অপছন্দ করতেই পারে না ।
আমার লাবণ্য !
শব্দ দুটো ও কি জোর দিয়েই না বলল। লাবর্যের বুকের ভেতরটা একটু কেঁপে উঠলো । লাবণ্য বলল, আর কি কথা হবে না তাহলে ?
-সেটা কি ঠিক হবে বল?
-না ঠিক হবে না ।
জয় কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, শেষ একটা উপহার দিতে চাই । ওটার পর আর আমাদের মাঝে যোগাযোগ না হওয়াই ভাল !
-আচ্ছা !
লাবণ্যের আর কান্না চেপে রাখতে পারছে না । বুক ফেঁটে ওর কান্না আসতে থাকে । কোন মতে বলল, আচ্ছা রাখি আজকে ! কেমন !
তখনই শুনতে পেল আরও দুইটা দমকল বাহিনী সাইরেন বাজাতে বাজাতে চলে গেল ওদের বাসার পাশ দিয়ে । ভাল আগুন লেগেছে বোঝা যাচ্ছে । হয়তো এক সময় এই আগুনতা নিয়ন্ত্রনে চলে আসবে কিন্তু লাবণ্যের মনে যে আগুন জ্বলছে সেটা কিভাবে নিভবে !
গল্প নং ছয়ঃ সিনিয়র
সাইফুল আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোর মাথা ঠিক আছে ? ঐ মেয়ে তোর থেকে এক বছরের বড় !
আমি সাইফুলের দিকে তাকিয়ে বললাম, এক বছর চার মাস আর ষোল দিন !
-কি বললি ?
-বললাম বাঁধন আমার থেকে এক বছর চারমাস আর ষোল দিনের বড় !
-তারপরেও ওর প্রেম করতে চাস ? দেখ মামা বন্ধুত্ব ঠিক আছে । জাস্ট ফ্রেন্ড হও তাও ঠিক কিন্তু রিলেশনে যাওয়া মোটেও ঠিক না । তবে কেবল যদি টাইমপাস হয় তাহলে ঠিক আছে ।
-চুপ থাক ।
-আরে বাবা একটু সিরিয়াস হ ।
-আমি সিরিয়াসই ।
-কদিন পরে কি অবস্থা হবে ভেবে দেখেছিস ? তোর পাশে ঐ মেয়েকে আন্টি মনে হবে ।
আমি সাইফুলের দিকে চোখ গরম করে তাকালাম । ওকে বোঝাতে চাইলাম যে ওর কথা বার্তা আমার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না । আর আমি বাঁধনের ব্যাপারে একটু বেশি সিরিয়াস ।
আরে বাবা মেয়ে যদি আমার থেকে বছর খানেকের বড় হয় তাহলে সমস্যা কোথায় সেটা তো বুঝতে পারছি না । হোক বড় আমার আর বাঁধনের যদি সমস্যা না হয় তাহলে অন্য মানুষের এতো কেন সমস্যা সেটা তো বুঝতে পারছি না । ভাবনা আসতেই নিজের কাছে খানিকটা থমকে দাড়াতে হল । কারন হচ্ছে বাঁধনের আবার সমস্যা নেই তো ?
সে যে আমাকে পছন্দ করে সেই ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই । এবং সেই পছন্দের ব্যাপারটা যে কেবল বন্ধুত্বের ভেতরে সীমাবদ্ধ নেই সেটা আমি কালই বুঝতে পেরেছি । কাল যখন রিক্সার ভেতরে ওর ঠোঁট দুটো আমার ঠোঁটের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করছিলো তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি নিজেও যেমন ওকে ভালবাসি ঠিক বাঁধন নিজেও আমাকে ভালবাসে । বাসতে বাধ্য !
বাঁধন আমার থেকে এক ইয়ার সিনিয়ার হলেও আমাদের মেলামেশাটা মোটেও থেমে থাকে নি । ক্যাম্পাসে এসে আমার প্রথম ভাল লাগার মানুষটাই হচ্ছে বাঁধন । প্রথমে আমি ভেবেছিলাম ও হয়তো আমারই ক্লাসে ভর্তি হয়েছে । যদিও ডিপার্টমেন্ট একই ছিল তবে পরে জানলাম যে আমার থেকে এক বছর আগেই ভর্তি হয়েছে ।
তবে ওর সাথে বন্ধুত্ব্ করতে খুব বেশি দেরি হয় নি । প্রথমদিন আমাকে যে ঝাড়িটাই না দিয়েছিলো যখন ওর সাথে বন্ধুত্বের কথা বলতে গেলাম । খোজ খবর নিয়ে আগেই জানতে পেরেছিলাম যে এই মেয়ে সবাইকে সব সময় বকাঝকা করে বেড়ায় । আমি তাই মানসিক ভাবে প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিলাম । তারপর থেকে তার পিছু লেগেই থাকতাম । ঝাড়ি খেতাম প্রতিদিন । একদিন এক সিনিয়র ভাইকে দিয়েও ঝাড়ি খাওয়ালো । সেই ভাইয়ের নামও নাকি বাঁধন । আমি তো প্রথমে ভেবেছিলাম বুঝি এই ছেলে বাঁধন মেয়ে বাঁধনের বয়ফ্রেন্ড । তবে পরে বুঝতে পারলাম যে না বয়ফ্রেন্ড না । আমি পিছু ছাড়লাম না ।
একটা সময় ও হার মানলো । বলল যে আমার বন্ধু হতে সে রাজি । তবে এর বেশি কিছু যেন না আশা করি । আমি তখন কথা বলার সুযোগ পেয়েই খুশি । আমার আর কিছু দরকার ছিল না ।
প্রথমে আপনি তারপর তুমি এক সময় আমাদের সম্পর্ক তুইতে নেমে এল । ওর বাসায় আমার যাওয়া শুরু হয়ে গেল । বাঁধনের আম্মুও আমাকে বেশ আদর করতেন । একটা সময় আমি আবিস্কার করলাম যে বাঁধন বাইরে যেমন করে সবার সাথে আচরন করে আসলে বাস্তবে সে সেই রকম মোটেও নয় । একটা নরম মন রয়েছে ওর । আর মেয়েটা বুঝি খানিকটা একা । নিজের মনের কথা মানুষকে ঠিক মত বলে বোঝাতে পারে না ।
একদিন সন্ধ্যা বেলা কথাটা ওকে বলতেই আমার দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে রইলো কিছু সময় । যেন অনেক দিনের লুকিয়ে রাখা কিছু কথা আমি জেনে ফেলেছি । তবে সেটা সামলে নিল পরক্ষনেই । হেসেই উড়িয়ে দিল । আমরা প্রচুর গল্প করতাম । একে অন্যের সাথে অনেক কথা বলতাম । মাঝে মাঝে আমাদের সাথেই সেই বাঁধন ভাই এসে যুক্ত হত ।
কিন্তু সব কিছু বদলে গেল গত কালকের বৃষ্টিতে । অবশ্য বদলে গেল কথাটা বললে ভুল হবে । আমি বলবো গতকালকের বৃষ্টির কারনেই আসলে আমি আসল কথাটা জানতে পারলাম । ক্যাম্পাস থেকে ফিরছিলাম এক সাথে । এমন সময় ঝুম বৃষ্টি । রিক্সার হুড তুলে দিয়ে পলিথিন দিয়ে কোন মতে দুজন বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচার চেষ্টা করছিই তখনই বাঁধনের দিকে তাকাতেই বুঝলাম যে ও আমার দিকে তাকিয়ে আছে । কি দেখছিলো কে জানে ! তবে ওর ঘোলা দৃষ্টি আমার নিজের মাথাও খারাপ করে দিল । ওর ভেজা ঠোঁট দেখে আমার মাথা থেকে অন্য সব চিন্তা দুর হয়ে গেল । আপনা আপনি আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম । এগিয়ে এল ও নিজেও । কত সময় ধরে ওকে চুমু খেয়েছি আমি নিজেও বলতে পারবো না। ও নিজেও বলতে পারবে না । একটা সময় দেখলাম রিক্সাটা ওদের বাসার সামনে এসে থেমেছে । ও আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই নেমে গেল ।
সাইফুলকে বিদায় করে দিয়ে আমি ক্যাম্পাসে অপেক্ষা করতে লাগলাম বাঁধনের জন্য । এমন কি পরপর তিন দিন ও ক্যাম্পাসে এল না । আমি এর মাঝে ওকে কতবার যে ফোন দিলাম কিন্তু কোন লাভ হল না । ও ফোন ধরলো না । শেষে বাধ্য হয়ে আমি নিজেই হাজির হলাম ওর বাসায় । আন্টি বলল যে ওর নাকি জ্বর ।
আমি আর কিছু না জানতে চেয়ে ওর ঘরে গিয়ে হাজির হলাম ! গিয়ে দেখি ও বিছানাতে শুয়ে একটা বই পড়ছে । আমার দিকে চোখ পড়তেই কেমন সংকুচিত হয়ে গেল । কিছু বলতে গিয়েও বলল না । আমি ধীর পায়ে ওর বিছানার পাশে গিয়ে থামলাম । ওর কপালে হাত রাখলাম । জ্বর এখনও আছে তবে কম !
আমি ওর কপালে হাত রাখতেই ওর পুরো শরীর কেমন যেন কেঁপে উঠলো । এটা আমার চোখ এড়ালো না মোটেও । আমি এর আগে কতবার ওর হাত ধরেছি কিন্তু কখনও এমন হয় নি । কিন্তু আজকে হচ্ছে । আমার নিজের ভেতরেও একটা আলাদা অনুভূতি কাজ করছে ।
আমি বললাম, বাহ ! এক চুমু খেয়েই জ্বর চলে এল ?
আমি খানিকটা হাসার চেষ্টা করলাম । তবে বাঁধন হাসলো না । আমার দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল, দেখ ঐদিন যা হয়েছে আমাদের ভুলে যাওয়াই ভাল । লোকে কি ....
ও আর কিছু বলতে গেল কিন্তু আমি থামিয়ে দিলাম ওকে । আমার হাতের একটা আঙ্গুল দিয়ে ওর ঠোঁটের উপর হাত রাখলাম । বললাম, লোকে কি বলল তাকে কি যায় আসে ! আর আমি ঐদিনের কথা কোন দিন ভুলবো না । তোকে ভুলতেও দিবো না !
-প্লিজ এমন করিস না !
-চুপ করতে বলেছি !
বাঁধন চুপ করলো । আমি ওর মাথায় একটা হাত বুলালাম । তারপর কপালে একটা চুমু খেয়ে বললাম, আমাদের মাঝে আর আগের সম্পর্ক তৈরি হওয়া সম্ভব না । আমি কোন ভাবেই তোকে হারাতে পারবো না । বুঝেছিস ? আর ঐদিনের ঘটনাটা এমনি এমনি ঘটে নি । আমাদের দুইজনের অনুভূতির প্রকাশ ঘটেছে কেবল । বুঝেছিস ! সংকোচের কারনে হয়তো আমরা কেউ কাউকে বলতে পারছিলাম না কিন্তু এটা মন থেকে আমরা দুইজন চাইতাম । বুঝলি ?
বাঁধন কোন কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কেবল । তবে ওর চোখে আমি আগের মত আর সংকোচ দেখতে পেলাম না । বরং সেখানে একটা আশ্চর্য দ্যুতি দেখতে পাচ্ছি । কোন প্রিয় কিছু কাছে পাওয়ার আনন্দ দেখতে পাচ্ছি !
গল্প নং সাতঃ অতীরের কথাগুলো
যে স্থান গুলো আমাদের পছন্দ না সেই সব স্থানে আমি বাধ্য না হলে যাই না। হাসপাতালও আমার কোন দিন ভাল লাগে নি । কিন্তু এমনটা খুব কম হয় যে হাসপাতালে আসতে হয় নি । মাঝে মধ্যেই বাধ্য হয়ঐ আসতে হয়েছে এখানে । আজকেও এখানে আসতে হল । আব্বুর কোন এক বন্ধু নাকি ডিএমসিতে এসেছে । খুবই বিপদে পড়ে আছে । কোন ভাবেই কেবিন কিংবা একটা বেড ম্যানেজ করতে পারছে না । ফ্লোরে বসে আছে ।
ঢাকার বে সরকারী হাসপাতাল গুলোতেই ভাল পরিমান টাকা আর লিংক না থাকলে বেড পাওয়া যায় না আর এটা তো সরকারি হাসপাতাল । আমি করিডোর দিয়ে খুজতে লাগলাম আব্বার সেই বন্ধুকে । আব্বা বললেন যে আমাকে দেখলেই নাকি সে চিনতে পারবে । কিভাবে চিনবে কে জানে ?
আমার কাছে অবশ্য কেবিন ওয়ার্ড নাম্বার আছে । এগারো নাম্বার ওয়ার্ডের দরকার আছে একটা বেড পেতে বসে আছে সে ! আমি আপন মনে মনে ওয়ার্ড খুজতে লাগলাম । চারি দিকে অসহায় মানুষের আহাযারি । এই জন্যই আমার হাসপাতাল কোন দিন ভাল লাগে না । মানুষের অসহায় ভাবটা এখানে পুরোপুরি বের হয়ে পড়ে । এটা আমার দেখতে মোটেও ভাল লাগে না ।
আমি এগারো নাম্বার ওয়ার্ডের সামনে এসে দাড়ালাম । এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম । বেশ কয়েকজন মানুষ রয়েছে । পুরো বারান্দায় মানুষ বেড পেতে বসে আছে । কিন্তু এদের কাউকেই পরিচিত মনে হল না । এখন ?
আব্বাকে ফোন দেওয়ার জন্য মোবাইল বের করতে যাবো তখনই পেছন থেকে ডাক শুনতে পেলাম !
-অপু !
এক ঝটকাতেই ঘুরে দাড়ালাম । নিশিকে দেখে সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম । অন্তত এখানে ওকে আশা করি নি ।
ওয়েট ! নিশির চেহারাটা কেমন যেন মলিন মনে হল। ওর কেউ কি এখানে ভর্তি হয়ে আছে ?
নিশি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, থ্যাংকস ফর কামিং !
ওয়েট ! নিশির আব্বাই কি তাহলে আব্বার সেই পরিচিত বন্ধু !
নো ওয়ে !
নিশি বলল, এদিকে এসো !
আমি কোন কথা না বলে নিশির পেছন পেছন হাটতে শুরু করলাম । একটু দুরে আরেকটা দরকার সামনে গিয়ে থামলাম । দরজার পাশে একটা বেড পাতা রয়েছে । সেখানই ভদ্রলোককে দেখতে পেলাম ! এই সেই ভদ্রলোক ! সেদিনকার সেই চেহারার সাথে আজকের চেহারার কোন মিলই নেই ।
আমি শুকনো কন্ঠে বললাম, কেমন আছেন চাচা ?
নিশির আব্বা আমার দিকে কেমন চোখে তাকালো । তারপর বলল, আর থাকা ! দেখতেই পাচ্ছো কেমন আছি !
আমার সত্যিই খারাপ লাগলো নিশির বাবার জন্য । আমি বললাম, আচ্ছা আমি একটু দেখি কিছু করা যায় কি না !
আমি পকেট থেকে মোবাইল বের করলাম । আমি ঠিকই জানি কাকে ফোন দিলে কাজ হবে । স্বপনভাইকে সব কিছু বলতেই কাজ হল । সে এই ডিএমসির কর্মচারি উইনিয়নের প্রেসিডেন্ট ! আমার সাথে সেই ভার্সিটি জীবন থেকে পরিচয় ! ঘন্টাখানেকের মধ্যেই নিশির বাবাকে কেবিনে ট্রান্সফার করা সম্ভব হল । সব কাজ শেষ করে আমি আবার নিজের অফিসের দিকে রওয়ানা দিতে যাবো তখনই নিশি পেছন থেকে আমাকে ডাকলো । তারপর বলল, তোমাকে কি বলে যে ধন্যবাদ দিবো বুঝতে পারছি না !
-ধন্যবাদ দিতে হবে না । আসি !
-অপু !
-হুম !
-আই এম সরি !
-কেন ? সরি কেন ?
-আমাদের মাঝে যা ছিল সেটা ভাল ভাবে শেষ হয় নি ।
আমি নিশির দিকে ভাল করে তাকালাম । নিশির সেই দাম্ভিক চেহারাটা আর নেই । হয়তো এভাবে বিপদে পরেছে এই জন্যই এমন মনে হচ্ছে । এই পরিস্থিতিতে না পরলে হয়তো এমনটা হত না !
আমি নিশির দিকে তাকিয়ে একটু হাসলাম । তারপর বলল, অনেক দিন আগের কথা । এসব আর মনে করে আর লাভ নেই এখন ! ভুলে যাও !
নিশি তারপর নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার ঐ নাম্বারটা কি এখনও আছে ?
-হ্যা ! ওটাই ব্যবহার করি !
-আমি মাঝে মধ্য ফোন দিতে পারি !
একবার মনে হল যে না করে দিই । কিন্তু কেন জানি না বলতে পারলাম না । বললাম, হ্যা দরকার দিও । কোন সমস্যা নেই ।
আর কিছু না বলে আমি হাটা দিলাম । হাটতে হাটতে পুরানো অনেক কিছু চোখের সামনে ভাসতে লাগলো । নিশির সাথে তখন আমার চুটিয়ে প্রেম চলছে । ওর সাথে আমার প্রেমটা বেশ আনন্দের ছিল । মেয়ে হিসাবে ও ছিল চমৎকার । একটু জেদি আর দাম্ভীক ছিল তবে আমি সেটা মেনে নিয়েছিলাম । কিন্তু একদিন ঝামেলা হয়ে গেল । নিশির সাথে দেখা করার সময় ওর বাবা আমাদের দেখে ফেললো ।
আমি হয়তো চলেই আসতাম কিন্তু এক পর্যায়ে তিনি আমাকে যাচ্ছে তাই ভাষায় গালাগাল দিতে শুরু করলো । একেবারে বাবা মা তুলে !
কেন জানি সহ্য হল না ! আমি তখন ইন্টার মিডিয়েট পরি । বেশ বড় হয়ে গেছি । দাড়িয়ে থেকে নিশির বাবার সাথে তর্ক জুড়ে দিলাম । তারপর বললাম যে আপনার মেয়ের সাথে প্রেম করার জন্য আমার বাবা মা যদি খারাপ হয় তাহলে আপনার মেয়েও তো আমার সাথে প্রেম করছে আপনি তাহলে !
উনি আমাকে মারতে এলেন তবে আমি সেটা ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত ছিলাম । রাগে শরীর জ্বলছিলো ! শেষ পর্যন্ত তিনি সামলে নিলেন এবং নিশিকে নিয়ে চলে গেলেন ।
তারপর এক সপ্তাহ পরে নিশি আমার সাথে দেখা করে সম্পর্ক শেষ করে দিল ।ও বলল যে ঐদিন আমি নাকি ওর বাবার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি। আমি বললাম তোমার বাবা কে আমার বাবা মা তুলে কথা বলছিলো সেটা দেখলে না ? নিশি কোন তর্কে গেল না । বলল যে সম্পর্ক রাখবে না ! আমিও আর কিছু বলি নি । তারপর পরীক্ষা শুরু হয়ে গেল । পরীক্ষা দিয়ে ঢাকাতে চলে এলাম । এখন পড়া শোনা শেষ করে চাকরি করছি ।
আমি সব কিছু ভুলে গিয়েছিলাম । আর নতুন করে কিছু মনে করতে চাই না । নিশির ফোন পেতাম মাঝে মধ্যে । ওর বাবা পরে আরও দুইবার ঢাকাতে এসেছিলো । নিশির অনুরোধে আমি দেখা করতে গিয়েছিলামও । কিন্তু ওর প্রতি আমি আগ্রহ দেখাতাম কম । মানে সেই অপমান টা আমার শরীরে এখনও লেগেছিলো । সেটা মনের ভেতরে পুষেই রেখেছিলাম আমি । তবে নিশির এই রকম নিজ থেকে এগিয়ে আসার ব্যাপারটা আমার কাছে ভাল লাগছিলো ।
সব কিছুর যেমন শেষ আছে এটারও শেষ হল । বাসা থেকে হঠাৎ আব্বার ফোন । সে আমাকে বিয়ে দিতে চায় । মেয়ে দেখেছে । আমি যেন বাসায় এসে একবার মেয়ে দেখি । পছন্দ হলে বিয়ের কথা বার্তা এগিয়ে নিয়ে যাবে । মনে হল যাই মেয়ে দেখেই আসি । কিন্তু আব্বা যখন আমাকে নিশিদের বাসায় নিয়ে গেলেন তখন সত্যিই আমি অবাক না হয়ে পারলাম না ।
আব্বা জানালেন যে নিশির বাবা নাকি খূব আগ্রহ নিয়ে আমার সাথে তার মেয়ের বিয়ের ব্যাপার কথা বলেছেন । আমার মনে একটা তীব্র ইচ্ছে জন্মালো যে নিশির বাবাকে এইবার তীব্রভাবে অপমান করি । আমার বাবা নিশির বাবার সেই আচরনের কথা কিছু জানে না । ব্যাপারটা আমাদের তিনজনের ভেতরেই সীমাবদ্ধ ছিলো । মনে মনে ঠিক করেই নিয়েছিলাম যে একটা কঠিন আঘাত দেব কিন্তু নিশি যখন মাথায় কাপড় দিয়ে আমাদের সামনে আসলো তখন আমার সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল । একবার মাত্র আমার দিকে চোখ তুলে তাকালো । আমি আর কিছু বলতে পারলাম না !
এই কি ছিল তাহলে কপালে !
গল্প নং আটঃ ক্ষণিকের পাওয়া
আমি অপুর কথা শুনে কেবল কিছু সময় পাথরের মূর্তি হয়ে বসে রইলাম । এখনও ঠিক নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছি না । একটা কথা পর্যন্ত মুখ দিয়ে বের হল না । অপু আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলল, আমার কথাটা কি বুঝতে পারছো আমি কি বলছি ?
আমি কেবল মাথা ঝাকালাম ! অপু বলল, কাল রাতে কি বলেছিলাম ভুলে যাও । ভেবে নাও যে কাল তুমি স্বপ্নে দেখেছো । আমি কিছু বলিই নি ! ঠিক আছে ?
আমি আবারও কোন কথা না বলে কেবল মাথা ঝাকালাম । অপু বলল, আসলে আমাদের রিলেশনে যাওয়া ঠিকই হবে না । কোন ভাবেই না । এই সম্পর্ক কারো জন্যই ভাল হবে না না । না তোমার না আমার ! বুঝছো ?
আমি এবার একটু সামলে নিলাম নিজেকে । তারপর বলল, আসলে আমিও ঠিক এই কথাটাই ভাবছিলাম । রাতে এটাই ভেবেছিলাম ! কিভাবে বলবো বুঝতে পারছিলাম না । আপনি বলে আমার কাজটা সহজ করে দিলেন !
দেখতে পেলাম যে অপুর চেহারাটায় একটা আলো ফুটে উঠেছে । যেন ওর খুব অপরাধী অনুভব করছে । অবশ্য যে কথাটা ও এখন আমাকে বলেছে সেটাতে এমনটাই হওয়া উচিৎ ! আমি বললাম, আমি তাহলে যাই । ক্লাসের দেরি হয়ে যাচ্ছে !
-এখনই যাবে ?
-হ্যা যেতে হবে !
আমি আর কথা বলে সামনের দিকে পা বাড়ালাম । যদিও আমার ক্লাস এখনই শুরু হবে না । আরও কিছু সময় এখানে অপেক্ষা করলেও খুব বেশি সমস্যা হবে না । কিন্তু অপুর সামনে আমার একটুও থাকতে মন চাইছে না ! আমি দ্রুত হাটতে শুরু করলাম । একটা সময় কেবল অনুভব করলাম যে আমার চোখ দিয়ে পানি বের হচ্ছে । আমি সেটা আটকানোর চেষ্টাও করলাম না । পড়ুক একটু পানি !
যারা রাজনীতির সাথে যুক্ত তাদের আমার কোন দিনই ভাল লাগে নি । ছোট বেলা থেকে চোখের সামনে যা দেখে এসেছি তাদের এই দলের মানুষ গুলোকে আমার মোটেই ভাল লাগে নি । মনে হয়েছে এরা পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছে কেবল ঝামেলা সৃষ্টির জন্য, মানুষকে কষ্ট দেওয়ার জন্য আর মিথ্যা প্রতিশ্রুত দেওয়ার জন্য ।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমিই কিনা এমন একজনের প্রেমে পড়লাম যে কি না নিজে এই রাজনীতির সাথে যুক্ত । আমাদের জেলার বড় নেতার ছেলে । ভবিষ্যৎ নেতা ।
প্রথম এই নেতাকে দেখতে পাই ক্লাসের বাইরে । একটা মেয়ের সাথে যাচ্ছে তাই ভাষায় কথা বলছে । মেয়েটা নিশ্চুপ হয়ে শুনছে । কোন কিছু বলতে সাহস পাচ্ছ না । প্রথমে মনে হয়েছিলো যে হয়তো মেয়েটাকে কোন ভাবে জ্বালাতন করছে । কোন কু প্রাস্তাব দিয়েছিলো মেয়েটাকে । মেয়েটা না করে দেওয়াতে তাকে হুমকি দিচ্ছে । কিন্তু আরও ভাল করে শোনার পর একটু বুঝলাম যে আসলে মেয়েটাকে সে এই বলে ধমকাচ্ছে যাতে আর কখনও তাকে ফোন না দেয় ।
ঘটনাটা ঠিক আমার বিশ্বাস হল না । এমনও হয় নাকি ! একটা মেয়ে একটা ছেলেকে জ্বালাতন করছে । পরে ব্যাপারটার সম্পর্কে আরও পরিস্কার ধারনা পেলাম নিমার কাছ থেকে । এই নিমার চাচাতো ভাই হচ্ছে এই অপু রহমান । নিমা আমার বেশ ভাল বন্ধু । সেই বলল যে তার ভাইকে নাকি এই মেয়েটা অনেক দিন ধরেই জ্বালাতন করছে । তাই আজকে ধমকে গেল !
আমার অপুর ব্যাপার তখন থেকেই কৌতুহল হল । ভাবলাম এই ছেলে তো বেশ ! এ ছেলে মেয়েরা জ্বালাতন করে । সে কাউকে জ্বালাতন করে না !
কিছু দিন পরে এই ছেলে যখন আমার ইনবক্সে নক দিল আমি তখন আকাশ থেকে পড়লাম । প্রথমে ভাবলাম যে হয়তো ওর ভাইয়ের প্রোফাইল থেকে আমার সাথে ঠোট্টা করছে । নয়তো ওর ভাইয়ের তো আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই আমাকে নক দিবে ! কিন্তু একটা সময়ে আবিস্কার করলাম যে নিমা নয় বরং স্বয়ং অপুর সাথেই কথা বলছি ।
আমার কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছিলো । সেই সাথে একটু একটু ভালও লাগছিলো । কেন যে ভাল লাগছিলো সেটা আমি কোন ভাবেই বলতে পারবো না । এই অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা আমার কাছে নেই ।
তারপর দিন গুলো কিভাবে কেটে যেতে লাগলো আমি বুঝতেই পারলাম না । রাতে অনলাইনে কথা দিনের বেলা কলেজে দেখা হত প্রায়ই । চোখাচোখ হত । সেই চোখেই আমাদের কত কথা হয়ে যেত । আমি কেবল অপুর কথা ভাবতাম । আমার অপুর কথা ভাবতে ভাললাগতো ! এরই মাঝে জানতে পারলাম যে অপুর ব্রেক আপ হয়েছে । এটার জন্যই বোধহয় ও আমার সাথে কথা বলাটা আরও একটু বাড়িয়ে দিলো । যদি মেসেজের উত্তর দিতে একটু দেরি হত অভিমান কন্ঠে বলত এতো অপেক্ষা কেন করাও । তোমাকে মিস করছি তো !
লাইন গুলো দেখে এতো ভাল লাগতো ! আমি নিজেকের ভেতরেই হারিয়ে যেতাম ! আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমি ওর প্রতি অনেকটাই দূর্বল হয়ে গেছি । ওকে ছাড়া আর কিছু ভাল লাগতো না । কলেজে যখন ওর সাথে অন্য কোন মেয়েকে কথা বলতে দেখতাম তখন আমার শরীর জ্বলে উঠতো রাগে । সব কিছু ভেঙ্গে ফেলতে ইচ্ছে করতো । আমি সেটা লুকানোর চেষ্টা করতাম না । অপুর সাথে রাগ দেখাতাম । ও প্রথমে বুঝতে পারতো না । পরে অবশ্য বুঝতো । তখন রাগ ভাঙ্গাতো ।
মাঝে মধ্য নিমার হাত দিয়ে আমার জন্য চকলেট পাঠাতো । বেশির ভাগ চকলেটই আমি জমিয়ে রাখতাম । অপুর দেওয়া চকলেট । একবার খেলেই তো শেষ হয়ে যাবে । থাকুক আমার কাছে জমা !
আমার কেবল মনে হত এই ছেলেটা কবে নিজের মনের কথা আমাকে বলবে । ওর আচরন দেখে স্পষ্ট বুঝতে পাতাম যে সে নিজেও আমাকে পছন্দ করে । সেই সময়টা চলেও এল । গতকাল রাতেই সে আমাকে ভালবাসার কথা বলল । সরাসরি না বললেও বলল যে আমার সাথে কথা বলতে তার ভাল লাগে সে সম্ভবত আমাকে ভালবাসে । আমি সারারাত জেগেছিলাম । বারবার কেবল মনে হচ্ছিলো যদি ঘুমিয়ে পড়ি তাহলেই এই চমৎকার অনুভূতিটা অনুভব করা হবে না আর !
কিন্তু আমার সুখ বুঝি সইলো না । সকাল বেলা ক্লাসে আসার পথেই অপুকে দেখতে পেলাম । বাইক নিয়ে বসে ছিল রাস্তার পাশে । বুঝতেই পারছিলাম যে আমার সাথে দেখা করতেই এসেছে । আনন্দে আমার মনটা ভরে উঠলো । কিন্তু সেই আনন্দ বিষাদে রূপান্তরিত হতে খুব একটা সময় লাগলো না ।
সে জানালো যে কাল রাতে সে অনেক ভেবেছে আমাদের রিলেশনের কথা । আমাদের এই রিলেশনে যাওয়া ঠিক হবে না । আমরা বরং কথা বলি কেবল। বন্ধুত্বটাই থাকুক আমাদের মাঝে । অন্য কিছু নয় !
বাসায় ফিরে এসে কিছু সময় কেবল কান্নাকাটি করলাম । মন বোঝাতে চেষ্টা করলা কিন্তু জানি খুব বেশি লাভ হবে না । তার থেকে বরং কিছু সময় কান্না আসুন । অশ্রু দিয়েই আমার কষ্ট টুকু যদি প্রশমিত হয় !
গল্প নং নয়ঃ দ্য জার্নি
নীলিমা আপু আমি বি টুতে বসেন, অপু ভাইয়ের পাশে !
আমি আমার সিটের দিকে এগিয়ে গেলাম । জীবনে এই প্রথম একা একা আমি কোথায় বেড়াতে যাচ্ছি । ইদানিং কালে এই ব্যাপারটা খুব হচ্ছে । কিছু মানুষ ফেসবুকে কোন একটা গ্রুপের মাধ্যমে কোথায় ঘুরতে যাচ্ছে । গ্রুপে একজন টিম লিডার থাকে । তার দায়িত্ব থাকে সব কিছু সামাল দেওয়ার । আমার ক্লাসের পরিচিত অনেকেই এই ভাবে গ্রুপের মাধ্যমে ঘুরতে গিয়েছে । আমিও এইবার সাহস করে বের হয়ে গেলাম । দেখাই যাক না কি হয় !
আমি বি টুর সামনে আসতেও দেখতে পেলাম জানালার পাশে একজন বসে আছে । অন্য দিক মুখ করে ! আমি এসে দাড়িয়েছি বুঝতে পেরেই আমার দিকে ফিরে তাকালো । মুখে একটু হাসি নিয়ে বলল, বসুন !
চেহারাটার দিকে তাকাতেই আমি চমক উঠলাম । নিজের চোখকে ঠিক আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না ।
অপু !
এই ছেলেটা এখানে এভাবে থাকবে আমি কোন দিন আশা করি নি । আমি কেবল এক ভাবে তাকিয়ে রইলাম ছেলেটার দিকে । সেই চোখ সেই নাক ! চোখে চশমা ! ঘনকালো চুপ !
আমার মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না । আমি চুপচাপ নিজের সিটে বসে পড়লাম । মাথাটা কাজ করা বন্ধ করে দিল ।
এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না যে ছেলেটা আমার পাশে বসে আছে !
কি আশ্চর্য ব্যাপার !
কত বছর হবে ?
কম করেও হলেও ৫ বছর তো হবেই । আমি তখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি সবে মাত্র । হাতে কোন কাজ কর্ম নেই । মোবাইল ব্যবহার করতেও আর কোন বাঁধা নেই । মায়ের মোবাইলটা তাই সারাদিন আমার কাছেই থাকতো । সেই সময় একটা ফেসবুক গ্রুপে অপুর সাথে প্রথম পরিচয় ।
ঠিক অপুর সাথে তো নয়, ওর লেখার সাথে । কি এক মন্ত্রমুগ্ধতা নিয়ে আমি ওর লেখা পড়তাম । প্রতিটা লেখাই মনে হত যেন আমার নিজের মনের কথাই ছেলেটা বলছে । আমি কিভাবে চিন্তা করি, আমার মনের ভেতরে কি চলছে সব কিছুই যেন ছেলেটা জানে ! এই জন্যই আরও বেশি ভাল লাগতো ! মনে হত যেন এই ছেলেটা আমার ভেতরটা আরও বেশি ভাল করে চিনে !
একদিন সাহস করে অপুকে ইনবক্স করে ফেললাম । ভেবেছিলাম হয়তো জবাব আসবে না কিন্তু জবাব এল একটু পরেই। সেই থেকে একটু একটু করে আমাদের কথা শুরু । আমার সব থেকে ভাল লাগতো এই ব্যাপারটা যে অপু কখনই আমাকে দেখতে চাইতো, কিংবা আমার কাছে কোন ছবির জন্য কোন আবদার করে নি । আমাদের মাঝে কেবল কথা হত । অনেক কথা । ও মাঝে মাঝেই ওর প্রেমিকার কথা বলতো । কিভাবে ওকে ছেড়ে চলে গেছে, অন্য একটা ছেলের সাথে কিভাবে সংসার করছে সেই সব কথা । আমার কেন জানি খুব কষ্ট হত । ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে ইচ্ছে করতো । ওর ভরশা দিতে ইচ্ছে করতো ! একটা সময়ে আমি নিজেই আবিস্কার করি যে আমি অপুর প্রেমে পরেগেছি । কিন্তু এই কথা বলতে সাহস হত না । কারন অপুর কথায় একটা ব্যাপার পরিস্কার ধরতে পেরেছিলাম যে আর কোন মেয়ের সাথে সে রিলেশনে যাবে না । সেই সাহস আর নেই তার ! তাই আমি নিজেও ওকে কথাটা বলতে পারছিলাম না । তবে একদিন সে ঠিকই বুঝে গেল ।
তারপর থেকে আমার সাথে সেই যে যোগাযোগ বন্ধ করলো আর কোন দিন আমাদের মাঝে কথা হয় নি । প্রথম প্রথম আমার খুব খারাপ লাগতো । তবে সময়ের সাথে সাথে সব কিছু সয়ে গেল । আমিও আস্তে আস্তে ওকে ভুলে গেলাম । কিন্তু এই ছেলেটাকে যে আবার আমি দেখতে পাবো সেটা আমি কোন দিন ভাবতেও পারি নি ।
অপু যে বেশ গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ সেটা আমি ভাল করেই জানতাম । সহজে কারো সাথে মেলামেশা করতে পারে না । তবে একবার যদি মিশতে শুরু করে তাহলে সে একেবারে মাটির মানুষ । আমাদের ট্যুরটা মাত্র এক দিনের । সকালে গিয়ে বান্দরবান পৌছাবো । তারপর সারাদিন নীলগীরি নীলাচল এই সব দেখে রাতেই ফেরৎ ! এই সময়ের ভেতরে আমি হয়তো ওর সাথে একটা কথাও বলতে পারবো না ।
আমি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না । অপুর কানে এয়ারফোন লাগানো ছিলো । আমিও কিছু সময় হাসফাঁস করে নিজের মোবাইলটা বের করে নিলাম । গান শোনা যাক ! অপুর কথা এখন আর ভেবে কি হবে ! এই ছেলে আমাকে পাত্তা দিবে না মোটেও । খামোখা কষ্ট পেতে হবে আবার ! আমি চোখ বন্ধ করলাম । একটু ঘুমানো দরকার । কাল সারাটা দিন আবার বেশ ধকল যাবে ।
সত্যিই বলতে কি দিনটা কিভাবে কেটে গেল আমি টের পেলাম না । এখান থেকে ওখানে ঘুরতেই আমাদের দিন পার হয়ে গেল । তবে একা এখানে ঘুরতে এসে নিজের মত করে উপভোগ করলাম । অবশ্য অপুর সঙ্গটাও আমার বেশ চমৎকার লেগেছে । ভেবেছিলাম হয়তো ছেলেটা আমার সাথে কথাই বলবে না । কিন্তু বলেছিলো । বেশ সহজ ভাষাতেই কথা বলেছিলো । বোঝাই যাচ্ছিলো যে আগেও সে এসেছে । এবং প্রায়ই আসে । এই গ্রুপের অর্গানাইজারের সাথে তার ভাল সম্পর্ক !
এই পুরোটা সময়ে আমার খুব করে ইচ্ছে করছিলো অপুকে বলে দিই যে আমিই তোমার সেই নীলিমা যার সাথে তুমি কথা বলতে । আচ্ছা এই কথাটা জানার পরে ওর মনের ভাবটা কেমন হবে ?
ও কি খুশি হবে নাকি ?
আর অপুর কি নতুন কোন গার্লফ্রেন্ড হয়েছে ?
নাকি ও বিয়ে করেছে ?
এই প্রশ্ন গুলো আমার মাথার ভেতরে ঘুর পাক খেতে থাকলো পুরো সময় জুড়ে । কিন্তু আমি একটা কথাও জিজ্ঞেস করতে পারলাম না । এমন কি ঢাকাতে ফেরার বাসে যখন উঠলাম তখনও না । তবে এবার আর আমি অপুর পাশে বসার সুযোগ পেলাম না । আমার থেকে ডুই সিট পেছনে বসলো ও । ঘাড় ঘুরিয়ে যে দেখবো সেটারও উপায় ছিল না । আমার মন খারাপ হয়ে রইলো ।
তবে আমার সকল প্রশ্নের জবাব আমি পেয়ে গেলাম ঢাকাতে নেমে । বাস থেকে নামার পর গ্রুপের টিম লিডার সবাইকে ধন্যবাদ দিলো তাদের সাথে ট্যুর করার জন্য । সামনে আরও ট্যুর হবে এটাও জানিয়ে দিল । তখনই দেখতে পেলাম একটা গাড়ি এসে থামলো আমাদের পাশে । সেখান থেকে একটা জন নামলো । একটা মেয়ে ! মেয়েটাই ড্রাইভ করছিলো । অপুর দিকেই এগিয়ে গেল । তারপর আমাদের সবার সামনেই অপুকে জড়িয়ে ধরলো ।
আমাদেরৎিম লিডারকে এগিয়ে যেতে দেখলাম তাদের দিকে । টিম লিডার মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিয়ে বলল, এই দেখেন আপু আপনার হাসব্যান্ডকে একেবারে অক্ষত অবস্থায় ফেরৎ নিয়ে এসেছি !
মেয়েটা বলল, দেখতেই পাচ্ছি ! আচ্ছা .....
তিনজনেই খুব হাসছিলো । আমার কেন জানি চোখে পানি চলে এল । এতোদিন পরেও আমি অপুকে একদম ভুলতে পারি নি। ওর জন্য বুকের মাঝে একটা খাঁখাঁ করা অনুভূতি কাজ করছে। ভালই তো ছিলাম, বুকের ক্ষতটা শুকিয়ে গিয়েছিলো । আবার নতুন করে রক্ত ঝরানোর কি দরকার ছিল !
আমি আর কিছু না ভেবে হাটা দিলাম । এখানে থেকে আর লাভ নেই । কেবল কষ্টই বাড়বে !!
গল্প নং দশঃ প্রোপোজ
মোবাইলের মেসেজ টোনটা কানে যেতেই নিশির মনটা আনন্দে ভরে উঠলো । ঠিক ঠিক রাত বারোটার সময় মেসেজটা এসে হাজির হয়েছে । নিশি এখনও জানে না যে মেসেজটা কে পাঠিয়েছে তবে সে নিশ্চিত ভাবেই জানে যে কে পাঠিয়েছে মেসেজটা । কিছু সময় নিশি ভাবলো যে মেসেজটা সে দেখবে না । দেখলেই তো শেষ হয়ে যাবে । তার চেয়ে বরং কিছু সময় থাকুক এভাবে । এই ভাবনাটা ভাবতে ভাল লাগছে । কি লেখা আছে কে জানে !
নিশি নিজের আচরনটার সম্পর্কে খুব ভাল করেই জানে । অপু কথা আসলেই ওর চিন্তা ভাবনাটা এমন হয়ে যায় । ছেলেটার মাঝে কি যেন আছে একটা । এই ভাবনা অন্য কোন ছেলের বেলাতে হয় না । কত ছেলের সাথেই ওর দেখা হয়, কথা হয় । কিন্তু অপুর বেলাতে সব কিছু আলাদা !
শুরুটা হয়েছিলো ওর অফিসে । একদিন রাকিব স্যারের কেবিনে গিয়ে দেখে একটা ছেলে সেখানে বসে আছে । স্যারের কাছে অনেক মানুষই আসে প্রতিদিন । নিশি সেটা ভেবেই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল । কিন্তু কাজের একটা পর্যায়ে সে লক্ষ্য করলো যে ছেলেটা ওর দিকে কেমন চোখে তাকিয়ে আছে ।
নিশির অনুভূতির সাথে পরিচিত । অনেকেই ওর দিকে তাকিয়ে থাকে । তবে এই ছেলেটার তাকানোর মাঝে একটা অন্য ভাব লুকিয়ে আছে । যার কোন তুলনা নেই । সত্যিই নেই ।
রাকিব স্যারই পরিচয় করিয়ে দিল ছেলেটার সাথে । ছেলেটা নাম অপু । রাকিব স্যারের বড় ছেলে ।
নিশি কেবল হ্যালো বলেছিলো সেদিন । তারপর বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছিলো । হঠাৎ একটা ফেসবুক আইডি থেকে নিশির রিকোয়েস্ট আসলো । সে নাকি নিশিকে চিনে । একটু কথা বলতে চায় । প্রথমে নিশি ভাবলো যে কথা বলে কি হবে । বরং ডিলিট করে দেয় কিন্তু খানিকটা কৌতুহল নিয়ে কথা বলল । ছেলেটা এমন কিছু কথা বলল যে নিশি বিশ্বাস করতে বাধ্য হল যে ছেলেটা ওকে চিনে । যদি সে আসলে কে সেটা বলল না । নিশি কিছু সময় জোড়াজুড়ি করলো বটে কিন্তু কাজ হল না ।
এভাবে বেশ কিছুদিন কথা বলার পরেই নিশি জেনে গেল যে ছেলেটা আর কেউ নয়, সেদিনের সেই ছেলেটা । অপু নাম । রাকিব স্যারের বড় ছেলে । নিশির সেদিন কি মনে হয়েছিলো সেটা সে নিজেও বলতে পারবে না । মনের মাঝে কেবল একটা আনন্দ কাজ করছিলো এটোটুকুই সে কেবল বলতে পারবে । আর কিছু না ।
তারপর থেকে টুকটাক কথা হতে থাকে । দিনের একটা নির্দিষ্ট সময় অপুর সাথে কথা বলতো । তারপর আস্তে আস্তে কথা বলার পরিমানটা বাড়তে লাগলো । নিশি একটা ব্যাপার বুঝতে পারলো যে অপু ওর প্রতি খুব বেশি আগ্রহী । নানান ভাবে ওকে বোঝানোর চেষ্টা করতো সে নিশিকে পছন্দ করে । নিশি মনে মনে হাসতো । তবে বুঝেও না বোঝার ভান করতো । ওর কেবল একটাই কথা । আগে মুখ ফুটে বলতে হবে । নয়তো কোন কাজ হবে না ।
কয়েক দিন আগেই অপু ওকে বলেছিলো যে ওর জন্মদিনের দিন কিছু বিশেষ কথা বলার আছে ওকে । কি বলার আছে সেটা অপু ওকে বলে নি । তবে নিশি ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো যে কি বলার আছে ।হয়তো সেই কথাটাই বলে ফেলেছে মেসেজে ! এই জন্যই মেসেজটা খুলে দেখতে মন চাইছে না । একবার দেখলেই তো শেষ হয়ে যাবে ।
তবে খুব বেশি সময় নিশি নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না । মেসেজটা পড়তে শুরু করলো ।
একটা মাত্র লাইন লেখা । "তোমার বাকি জন্মদিন গুলো কি তুমি আমার সাথে কাটাবে নিশি?"
লাইনটা দেখে নিশির দম বন্ধ হয়ে এল । কি চমৎকার ভাবে লেখা লাইনটা ! বাকি জন্মদিন গুলো এক সাথে কাটানো ! নিশি জানে এই মেসেজর রিপ্লাই না পেয়ে অপু এতো সময়ে নিশ্চয়ই পাগল প্রায় হয়ে গেছে । নিশ্চয়ই ভেবে বসে আছে যে ওকে পছন্দ না বলেই হয়তো সে কোন জবাব দেয় নি । নিশি আবারও মনে মনে হাসলো । ভাবলো জবাবটা আরও কিছু সময় পরে দিবে । আরেকটু জ্বলুক ! এতোদিন লাগিয়েছে কথাটা বলতে ! একটু মজা বুঝবে না !!
গল্প নং এগারোঃ আমি তো তোমার ছিলাম না
-তুমি আসবা ?
ফোনের ওপাশ থেকে খুকু ওর কান্না থামানোর চেষ্টা করছে । আমি বুঝতে পারছিলাম সেটা । নিজেকে খানিটকা সামলে নিলাম । আমার চোখটা খানিকটা সিক্ত হয়ে এসেছে । এমনটা কেন হল আমার সাথে ! আমাদের সাথে এমনটা কেন হল ?
খুকু কি বুঝতো না আমার মনে কথা ?
তাহলে কেন এভাবে কাজটা করতে পারলো ?
আর কাজটা যখন করবেই তাহলে আবার এখন কাঁদছে কেন ?
আমি নিজেকে আরও একটু শান্ত করে বললাম, না আসলে আমি বিয়ের দাওয়াতে যাই না । আমার বোরিং লাগে !
-এটাই কারন ?
-হ্যা এটাই কারন ! আমি আসলে কারো বিয়েতেই কখনও যাই না !
খুকু আর কিছু বলল না । বেশ কিছু সময় চুপ করে রইলো । আমিও কেন জানি ফোনটা রাখতে পারছিলাম না । বারবার মনে হচ্ছিলো যে এখন ফোন রেখে দিলে হয়তো আর কোন দিন ওর সাথে কথা বলতে পারবো না । এরপর থেকে সে অন্য কারো বউ হয়ে যাবে ! তখন কি হবে ?
খুকুকে আমার প্রথমে খুব একটা ভাল লাগে নি । ওর আচরনে একটা অহংকারী ভাব ছিল সেই শুরু থেকে । অবশ্য ওর বাবা গ্রামের প্রভাবশালী মানুষ । সে ছোট বেলা থেকেই জানতো যে সে সবার থেকে একটু আলাদা । সবাই তাকে সমীহ করেই কথা বলবে । সবাই বলতোও তাই । আমি অবশ্য তার থেকে দুরে দুরে থাকতাম সব সময় । অবশ্য কয়েক বছরের পরেই বাবা ওদের এলাকা থেকে বদলি হয়ে গেল । খুকুর সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেল ! ভেবেছিলাম হয়তো আর কোন দিন দেখা হবে না ওর সাথে ।
তবে যখন পড়াশুনার জন্য ঢাকায় এলাম তখন ঘটনা খানিকটা অন্য দিকে মোড় নিল । একবার এক একুশের বই মেলাতে খুকুর সাথে আমার দেখা হয়ে গেল । আমি ওকে দেখেও না দেখার ভান করে চলে যাচ্ছিলাম তবে খুকু সেটা হতে দিলো না । নিজ থেকে এগিয়ে এসে কথা বলল। এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার নাম্বার নিয়ে গেল ।
তারপর থেকেই আমাদের মাঝে নিয়মিত কথা হতে শুরু করলো । একটা সময়ে আমি যেমন বুঝতে শুরু করলাম যে খুকুর সাথে কথা বলতে আমার ভাল লাগছে । আমার নিজেরও বুঝতে কষ্ট হল না যে খুকুরও আমার সাথে কথা বলতে ভাল লাগছে । আমাদের প্রায়ই দেখা হত, আমরা রেস্টুরেন্টে খেতে যেতাম, ঘুরতে যেতাম এদিক সেদিক অথবা মাঝে মাঝে কেবল রিক্সা করে ঘুরতাম ।
কিন্তু মাস খানেক আগে যখন খুকু আমাকে বলল যে তার বিয়ে ঠিক হয়েছে আমি সতয়িই অবাক হয়ে গেলাম ! আমি ভেবে বসেছিলাম যে খুতু আমাকে পছন্দ করে । কিন্তু এভাবে বিয়েতে রাজি হয়ে যাওয়াটা আমি ঠিক মেনে নিতে পারলাম না । চুপ করে গেলাম । আর কোন কথা বললাম না ।
তারপর আজকে খুকু আমাকে তার বিয়েতে দাওয়াত দিলো ।
পরের দিন গুলো আমার জন্য ভাল কাটলো না । মোটেও ভাল কাটলো না । একটা সময়ে মনে হল ওকে যদি বলতাম কথাটা যে আমি ওকে পছন্দ করি তাহলে কি হত ? কিন্তু ও কি বুঝতে পারে নি যে আমি ওকে পছন্দ করি ?
বুঝেও যখন খুশি মনে বিয়েতে রাজি হয়ে গেছে তখন আমার মনে হয় না যে সে আমাকে পছন্দ করে ! আমি ওর সাথে একেবারেই যোাগযোগ বন্ধ করে দিলাম । খুকু আমার জীবন থেকে হারিয়ে গেল । কিন্তু মনের ভেতরে রয়ে গেল সে । বুঝি সারা জীবনই রয়ে যাবে ।
গল্প নং বারোঃ শামা
শামা এতোটা সাহস কোথায় পেলো সে নিজেও জানে না । এমন একটা কাজ যে সে আসলেই করতে পারবে সেটা কোন দিন ভাবে নি । কিন্তু কাজটা সে করে ফেলেছে । ঠিকই চলে এসেছে বই মেলায় । তার পছন্দের স্থানে ।
শামার জীবনের কোন দিনই কোন ইচ্ছে পূরন হয় নি । সব সময় সে যা চেয়েছে সেটা ওরই সামনে অন্য কেউ পেয়ে গেছে কিন্তু ওর কপালে সেটা জোটে নি । একটা সময় মন খারাপ হত খুব । কিছুতেই নিজের মনকে সে বুঝ দিতে পারতো না । বারবার কেবল মনে হত যে ওর সাথেই কেন বারবার এমন হচ্ছে ? কেন ওর সাথে এমন হয় !!
জীবনের অন্যতম বড় ইচ্ছে ছিল যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বে । কিন্তু ইন্টারমিডিয়ে রেজাল্ট টা কিভাবে খারাপ হয়ে গেল সেটা সে নিজেও জানে না । সে তো পরিশ্রম কম কে নি ! এমন কি তার পরীক্ষাও ভাল হয়েছে কিন্তু রেজাল্ট ভাল হল না । চোখের সামনে দেখতে পেল বাসার লোকজন কিভাবে তার বিরুদ্ধে চলে গেল । সব কিছু যেন চোখের সামনে অন্ধকার হয়ে এল । সব কিছু অপরিচিত মনে হতে লাগলো ।
তারপরেও শামার জীবন চলতে থাকলো । ঢাবিতে চান্স না পেলেও তার বর্তমান বিশ্ববিদ্যালে সে বেশ ভাল আছে । বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা মনে হতেই তার অপুর কথা মনে হল । এই ছেলেটা ওর সাথে ওর ক্লাসেই পড়ে । ছেলেটার সাথে ওর বেশ ভাব হয়েছে। প্রায়ই কথা বলে ওর সাথে । অপুকে পছন্দ করার প্রধান কারন হচ্ছে অপুর জীবনের কাহিনীটাও ঠিক ওর মত । ওর কিছু স্বপ্ন ছিল যার কিছুই পূরন হয় নি । অপুর পরিস্থিতিটাও ঠিক ওর মতই । তাই এটা জানার পর থেকে শামার মনের ভেতরে অপুর প্রতি আলাদা একটা অনুভূতি সৃষ্টি হয়েছে । ওর সাথে সম্পর্কটা তাই আস্তে আস্তে ভালর দিকে যাচ্ছে ।
সেটা অন্য একটা গল্প । শামা কোন দিন ভাবেনি যে সে এই কাজটা করতে পারবে না । শামার পছন্দের একজন লেখক আছে । যদিও খুব বেশি বিখ্যাত নয় তবে মোটামুটি চেনে সবাই তাকে । প্রতি বইমেলায় তার দুই তিনটা বই বের হয় । বেশ লেখে সে । শামার অনেক দিনের শখ সেই লেখার সাথে দেখা করবে । একটা অটোগ্রাফ নিবে । সেটার জন্যই এই সাহসের কাজটা সে করে ফেলেছে । দুইদিন আগেই ফেসবুকের মাধ্যমে সে জানতে পেরেছিলো যে লেখক সাহেব আজকে মেলাতে আসবে । সেই লেখাটা দেখেই শামার মাথায় এই ভয়ংকর চিন্তাটা আসে ।
ওর জমানো কিছু টাকা ছিল । আর বন্ধুর কাছ থেকে আরও কিছু টাকা নিয়ে সে গতকালকে ঢাকার গাড়িতে উঠে বসেছে । একা একা । একটু একটু গা কাঁপছিলো ওর তবে আর কিছু ভাবে নি । কেবল মনে হয়েছে যে চলে আসবে । এবং চলেও এসেছে । শামার অনেক বন্ধুই ঢাকাতে থাকে । এক বন্ধুর হোস্টেলেই উঠেছ । বিকেলে এসে হাজির হয়েছে এই বই মেলাতে ।
কিন্তু মেলায় প্রচুর মানুষ । এতো মানুষ সে আশা করে নি । এবং এই ভীড় বাড়ছেই । শামা একা একা কিছুটা সময় অস হায়বোধ করলো । কি করবে ঠিক বুঝতে পারলো না । এতো মানুষের ভেতরে সেই লেখককে সে কিভাবে খুজে পাবে ? স্টল নম্বরটা সে জানে । কিন্তু সেটা খুজে পাচ্ছে না । কিছু সময় এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করলো কেবল । একটা সময় মনে হল যে সময় চলে যাচ্ছে । লেখক সাহেব হয়তো এখনই চলে যাবে । ছয়টা পর্যন্ত থাকবে বলেছিলো । শামার কান্না আসতে লাগলো । এতো দুর আসাটা বৃথা হল । কাউকে জিজ্ঞেস করতেও কেমন যেন সংকোচ লাগছে ওর ! এখন কি করবে ও !
ঠিক সেই সময়েই একজন ওর কাধে হাত রাখলো । পেছন ফিরে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল । তাকিয়ে দেখলো অপু দাড়িয়ে আছে । অপুকে এখানে সে কিছুতেই আশা করে নি । ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, তুমি এখানে ?
অপু একটু হেসে বলল, তুমি যেখানে আমি সেখানে ।
-মানে ?
-মানে কিছু না । আসো তোমার লেখকের কাছে যাই ।
শামার মাথায় কিছু ঢুকছিলো না । অপু তাকে বলল, আমি তোমার সাথেই এসেছি ।
-সত্যি?
-হ্যা । তোমার বাসেই ।
-মানে কি ? কেন?
-আসলে তুমি একা একা আসছো এটা আমার জেনে শান্তি লাগছিলো না । বারবার মনে হচ্ছিলো যদি তোমার কোন বিপদ হয় । তাই তোমার পিছু নিয়েছিলাম ।
শামা কি বলবে খুজে পেল না । একভাবে কেবল কিছু সময় অপুর দিকে তাকিয়ে রইলো । অপু বলল, চল ঐদিকে । ঐ যে স্টল !
একেবারে শেষ মুহুর্তে লেখককে পাওয়া গেল । তার কাছ থেকে অটোগ্রাম নেওয়া গেল । একটা ছবিও তুলল ওরা ।
মেলা থেকে বের হয়ে ওরা আরও কিছু সময় এদিক ওদিক ঘুরলো । শামার কেন জানি খুব বেশি খুশি খুশি লাগছিলো । প্রিয় লেখকের সাথে দেখা হওয়া নাকি অপুকে এখানে পাওয়াটা সেটা ও বুঝতে পারলো না । তবে এটা ঠিকই বুঝতে পারলো যে এরপর অপুর সাথে ওর সম্পর্কটা আরও একটু ভাল হবে । আরও একটু গাঢ় হবে হয়তো ।
গল্প নং তেরঃ দ্য হলি লাভ
তানহা নিজেকে আয়নায় আরও একটু ভাল করে দেখলো । নিজেকে ওর কেমন যেন লাগছে । একটু যেন অচেনা মনে হচ্ছে । সে তো এমন ছিল না কোন ভাবেই । এই কাজটা সে কেন করছে ? কেন এমন পোশাক পরছে?
তানহা বোরকা ছাড়া এক সময় বাইরে যাওয়ার কথা চিন্তাও করতো না । ধর্মের নিয়ম গুলো পালন করতো সঠিক ভাবে । আল্লাহকে যত গভীর ভাবে ভালবাসতো আর কাউকে ভালবাসে নি কোন দিন । সে ভাবতো তার এক আল্লাহ থাকলেই হবে আর কাউকে দরকার নেই । কিন্তু একটা সময়ে তানহার জীবনটা এমন ভাবে উল্টে পাল্টে গেল যে সব কিছুর উপর থেকে তার বিশ্বাস উঠে যেতে শুরু করলো । তার মনে মনে কেবল এই কথাটাই আসতে থাকলো যে এতো ধর্মে মেনে সে জীবনে কি পেল ?
তার কেবলই মনে হতে লাগলো যে কেন তার সাথেই এই সব হবে। কই যারা কোনদিন কোন ধর্ম মানে নি, আল্লাহকে ভালবাসে নি তাদের জীবন তো চলছে খুব সুন্দর তাহলে তার জীবন কেন এমন হবে?
কেন সে এমন কষ্ট পাবে।
তারপর থেকেই সে ধর্মের সব নিয়ম গুলো ভাঙ্গতে শুরু করলো। কোনদিন যা করে নি তাই করতে শুরু করলো। নামাজ পডা বাদ দিয়ে দিল। ঠিকঠাক মত পর্দা করে ছেড়ে দিল। ঠিক করলো যে অজানা কারো সাথে কথা বলবে। দরকার হলে আরও বেশি করবে। কি হবে এতো ধর্মের নীতি মেনে?
সেই জন্যই আজকে প্রস্তুত করেছে। আজকে নিজেকে আয়নায় ওর সত্যিই অপরিচিত মনে হচ্ছিলো। একটা কামিজের সাথে টাইট লেগিংস পরেছে। নিজেকে বেশ আকর্ষণীয় করস সেজেছে। আজকে একজনের সাথে দেখা করার কথা তার। তাই বারবার আয়নায় নিজেএ দিকে তাকাচ্ছে। মনের ভেতরে একটা সঙ্কা কাজ করছে।
বারবার মনে হচ্ছে কাজটা সে ঠিক করছে না। কিছু একটা ঠিক করছে না।
এমন চিন্তা তার আগেও হয়েছে। যখনই সে নামাজ পড়তো না তখনই মনের ভেতর থেকে কারো আওয়াজ পেত সে। কেউ যেন তাকে ডাকছে নামাজের জন্য। আল্লাহকে মিস করছে সে। সে সেউ সব চিন্তা বাদ দিয়ে দিল। এসব আর ভাববে না।
আহকেই কঠিক কিছু করে ফেলবে। যা হবার হবে। পরিনতির কথা আর ভাববে না ।
নিজেকে আরেকবার আয়নাতে দেখে নিয়ে ঘর থেকে বের হতে যাবে তখনই আজান দিয়ে উঠলো । আযানের ধ্বনি কানে যেতেই তানহার মনের ভেতরটা কেমন যেন উতলা হয়ে উঠলো । বারবার মনে হল সে অন্যায় করতে যাচ্ছে । তানহা যখন আবার নিজের দিকে তাকালো তখন খুব লজ্জা করতে শুরু করলো । দ্রুত ঘরের ভেতরে চলে গেল সে । তারপর পোশাক বদলে ফেলল সাথে সাথেই । ওযু করে নামাযে দাড়িয়ে গেল । উপরওয়ালার উপর রাগ করে সে ভুল করেছে সেটা বুঝতে পারছে না । জায়নামাজে অনেকটা সময় কান্নাকাটি করতে শুরু করলো আর নিজের কৃত কর্মের জন্য ক্ষমা চাইলো বারবার ।
ঐদিন রাতেই শেষ বারের মত অপুকে নক দিল সে । এই ছেলেটার সাথে সে অনেক কথা বলেছে । ছেলেটাকে বলল, আজকেই আমাদের শেষ কথা । আমি দুঃখিত আমাদের আজকে দেখা হওয়ার কথা ছিল কিন্তু দেখা হল না ।
-কি হয়েছে বলবা?
-আমি আসলে ভুল করতে যাচ্ছিলাম । আমার আল্লাহকে আমি ত্যাগ করতে যাচ্ছিলাম । মানুষ যখন উপরওয়ালাকে ত্যাগ করে তখন তার কাছে কিছুই থাকে না আর । আমি তোমাকে কথা দিয়েছিলাম কথাটা রাখতে পারি নি । তাই ক্ষমা প্রার্থী । আমাদের মাঝে আর কথা হবে না ।
-আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না ।
তানহা একটা লম্বা দম নিল । তারপর অপুকে সব কিছু গুছিয়ে বলল। সে আগে কেমন ছিল । তারপর তার জীবনে কি কারনে তার উপরওয়ালার প্রতি রাগ হয়েছিলো । কিন্তু সে ভুল করেছে । আল্লাহ তাদেরকেই বেশি বেশি বিপদে ফেলেন যাদেরকে সে ভালবাসে । এইজন্যই হয়তো তার জীবনে এতো ঝামেলা । এই জন্য তো কোন ভাবেই আল্লাহকে ত্যাগ করা যাবে না । সে তাই করতে চলেছিলো । নিজে ভুল করতে চলেছিলো । তবে নিজেকে সে শুদ্ধ করে নিয়েছে ।
অপুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই লাইনটা কেটে দিলো । ফোনটা বন্ধ করার আগে নিজের ফেসবুক আইডিটা স্থায়ী ভাবে মুছে দিল ।
কিন্তু মনের ভেতরে ছেলেটার একটা আভা রয়েই গেল । নিজের খারাপ সময়ে কিছু সময়ের জন্যও হলেও ছেলেটার সাথে কথা বলে সে শান্তি পেয়েছিলো ।
এভাবেই কতদিন পার হয়ে গেল তানহা বলতে পারবে না । সেদিন থেকে উপরওয়ালার প্রতি আরও বেশি নিমগ্ন হয়ে পড়লো সে । তার জীবনে যেন অন্য আর কিছু নেই ।
আরও ছয় মাস পরে । এক সন্ধ্যায় । তানহা নামাজ শেষ করে উঠেছে । এমন সময় তার মা এসে হাজির হল । তানহা আজকে অবশ্য একটু অস্থির হয়ে আছে । কারন আজকে পাত্রপক্ষ তাকে দেখতে আসবে । তানহার কেবল ইচ্ছে যার সাথে ওর বিয়ে হবে সে যেন তারই মত হয় !
তানহাকে দেখে পাত্র পক্ষ এতোই পছন্দ করে ফেলল যে একটুও দেরি করতে চাইলো না । সেইদিনই বিয়ে করতে চাইলো । তানহার আব্বা একটু নিম রাজি ছিল তবে ছেলে পক্ষের এতো আগ্রহ দেখে রাজি না হয়ে পারলো না । তানহাও রাজি হয়ে গেল কারন ছেলে নাকি আল্লাহ ভক্ত । আর কিছু জানার ছিল না তার ।
ঠিক হল যে আপাতত বিয়েটা হবে । অনুষ্ঠান সময় সুযোগ মত হবে । রাতে যখন পাত্রপক্ষের চলে যাওয়ার সময় এল তানহার সাথে ছেলে একান্তে কিছু কথা বলতে চাইলো । তানহা কোন আপত্তি করলো না ।
তানহার স্বামী ঘরে ঢুকে কিছু সময় কোন কথা বলল না । ওর দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো কেবল । হঠাৎ বলল, মাথার কাপড়টা কি সরাবে একটু ।
এমন একটা কথা শোনার জন্য তানহা একটু প্রস্তুত ছিল না । একটু চমকে উঠলেও সামলে নিল । সামনের মানুষটা এখন তার স্বামী । তার সামনে চুল খোলাই যায় । তানহা স্কার্ফটা খুলে ফেলল ।
-আমার পাশে এসে বস ।
তানহা তখনও ছেলেটার দিকে তাকায় নি । ছেলেটার সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না সে । নামটা জানে । মোস্তাফিজুর রহমান । ব্যাংকার । তানহা মোস্তাফিজুরের পাশেই বসল । একটু পরে অনুভব করলো মোস্তাফিজুর তার চুলে হাত দিয়েছে । ওর পুরো শরীরটা যেন একটু কেঁপে উঠলো । মোস্তাফিজুর বলল, জানো তুমি আমার জীবনটা অনেকটাই বদলে দিয়েছে ?
তানহা বলল, মানে ?
-তোমার সাথে মেশার আগে আমার আসলে উপরওয়ালার উপরে ঠিক এতো খানি বিশ্বাস ছিল না । কিন্তু কেউ যে এতোখানি আল্লাহ ভক্ত হতে পারে সেটা তোমাকে দেখে বুঝেছি আমি ।
তানহা এবার মোস্তাফিজুরের দিকে তাকালো ।
-আপনি কি বলছেন আমি বুঝি নি !
মোস্তাফিজুর বলল, মনে আছে অপু নামের এক ছেলের সাথে কথা বলতে তুমি ?
নামটা শুনেই তানহার পুরো শরীর কেঁপে উঠলো । মোস্তাফিজুর বলল, ছেলেটা আমিই ছিলাম । ঐদিন তোমার ঐভাবে ফোনটা রেখে দেওয়াটা আমার পুরো জীবন বদলে দিয়েছে । উপরওয়ালা সব সময় তোমার জন্য সব থেকে বেস্ট টাই নির্বাচন করেন । এই জন্যই তো তোমাকে আমার করে পাঠিয়েছেন ।
তানহার অনুভব হল ওর বুকের ভেতরে একটা আন্দোলন শুরু হয়েছে । তীব্র আনন্দের আন্দোলন ।
মোস্তাফিজুর বলল, উপরওয়ালার রহমতে আমাদের জীবনটা সামনে নিশ্চয়ই খুব সুন্দর হবে ।
-ইনশাল্লাহ, সুন্দর হবে ।
-আমি খুব দ্রতই তোমাকে আমাদের বাসায় নিয়ে যাবো । আর এর মাঝে তো আসবোই । আমার ভালবাসার মানুষকে ছেড়ে কি থাকা যাবে বল !
যখন বরের বাড়ির লোকজন চলে গেল তানহা আবারও জায়নামাজ নিয়ে নামাজে দাড়িয়ে গেল । উপরওয়ালার কাছে শুক্রিয়া আদায় করতে হবে । সেই সাথে আবারও তার কাছে ক্ষমা চাইতে হবে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২১ রাত ২:৩৬