পর্ব এক পর্ব দুই পর্ব তিন
সাত
অরিন কিছু সময় চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো নোরার দিকে । ওর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না নোরার কথা । অবশ্য এমন কথা যে কারো বিশ্বাস হওয়ার কথা না । অরিন নোরার দিকে তাকিয়ে বলল, তুই সত্যি বলছিস ?
নোরা নিজের ল্যাপটপের দিকে তাকিয়ে ছিল । ফেসবুকের টাইম লাইন চেক করছিলো । অরিনের দিকে না তাকিয়েই বলল, তোকে মিথ্যা বলে আমার কি লাভ ? আর আমি এতো বড় একটা মিথ্যা কেন বলবো শুনি ?
অরিন আরও কিছু সময় নোরার দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর একটা চিৎকার দিয়ে উঠলো জোরে ! এতো জোরে যে পাশের ঘর থেকে দু তিন জন মেয়ে ছুটে এল !
-কি হয়েছে কি হয়েছে ?
নোরা বিরক্ত হয়ে একবার অরিনের দিকে তাকালো । তারপর মেয়ে দুটোর দিকে তাকিয়ে বলল , আরে কিছু না । এই গাধাটা তেলাপোকা দেখে ভয় পেয়েছে । মেয়ে দুটো হাসতে হাসতে চলে গেল । অরিন এরপর নোরাকে চেপে ধরলো । তারপর বলল, বল বল ! কিভাবে হল এসব ! আমি তো কিছুই জানি না এসবের !
নোরা মনিরট থেকে মুখ তুলে অরিনের দিকে তাকালো । তারপর বলল, আমি নিজেই কিছু জানি ? আমার নিজেরই এখন বিশ্বাস হচ্ছে না যে আমার বিয়ে হয়ে গেছে তাও আবার আদনানের সাথে !
দুইদিন আগে নোরার সাথে আদনানের বিয়ে হয়েছে । নোরা এই ভাবে কারো বউ হয়ে যাবে সেটা নোরা কোন দিন ভাবে নি । তাও আবার আদনানের বউ যে হবে সেটা তো কোন দিন ভাবেই নি । কিন্তু বউ হয়ে গেছে এটাই হচ্ছে সব থেক বড় কথা । এটা এখন আর অস্বীকার করার কোন উপায় নেই । অবশ্য এতে নোরা যে অখুশি সেই কথা সে বলতে পারবে না । নিজের মনের কাছেই প্রশ্ন করে দেখেছে । কোন উত্তর সে পায় নি । তার মানে এই না যে সে আদনানকে বিয়ে করতে পেরে খুব আনন্দিত হয়েছে । আসলে ওর নিজের ভেতরে এমন কিছুই অনুভূত হচ্ছে না । কেবল অবাক হয়েছে খুব । এমন ভাবে কেন সে আদনানের বউ হয়ে গেল । কেবল মাত্র ঐদিন ওর মাকে সাহায্য করেছে বলেই । মায়ের প্রতি ছেলের এতো ভালবাসা ! এটা অবশ্য নোরাকে বেশ আনন্দ দিয়েছে । মা ভক্ত ছেলে !
কিন্তু সব থেকে অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে বাসর রাতে আদনান এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেল কেন ?
কি হাস্যকর একটা ব্যাপার !
এভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার কি কোন কারন আছে ?
নোরা একবার শুনেছিলো ওর এক বান্ধবীর বড় বোন নাকি এই ভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো বাসর রাতে । অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিলো । বর যখন কাছে আসতে যাচ্ছিলো তখন নাকি ভয় পেয়ে চিৎকার করেছিলো জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো । পরে সেটা নিয়ে কি হাসাহাসি । বেচারি সেই ঘটনা নিয়ে এখনও লজ্জায় লাল হয়ে যায় !
আদনান যখন জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলো নোরা প্রথমে ভেবে পায় নি কি করবে ! প্রথমেই মনে হয়েছিলো তখনই দৌড়ে যায় বাইরে । কাউকে ডেকে নিয়ে আসে ! কিন্তু দরজার কাছে গিয়ে থেমে গেল । এই ঘটনা যদি বাইরে কেউ জানে তখন বেচারা সারা জীবন লজ্জা পেয়েই কাটাবে । এতো বড় কোম্পানীর মালিক এতো মানুষ তাকে চেনে । যদি এই ব্যাপারটা কোন ভাবে মানুষের সামনে প্রকাশ পেয়ে যায় তাহলে আদনান লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না কাউকে ।
এটা ভেবেই আবার দরজা থেকে ফিরে এল । কিছু সময় আদনানের দেহটা বিছানায় তোলার চেষ্টা করলো । কিন্তু কোন লাভ হল না । ওর নিজের এতো শক্তি নেই যে আদনান কে খাটের উপর তুলবে । অবশ্য যেখানে ও ছিল সেখানে নরম কার্পেট দিয়ে মোড়া । তাই খুব বেশি চিন্তিত হল না । বিছানা থেকে একটা বালিশ নিয়ে এসে আদনানের মাথার নিচে দিয়ে দিল । তারপর নিজেও আদনানের পাশে বসে পড়লো । কিছু সময় তাকিয়ে রইলো আদনানের ঘুমন্ত চেহারার দিকে ।
নিজেও ভেবে পাচ্ছিলো না যে এই সুদর্শন মানুষটা ওর স্বামী হয়ে গেছে !
কিভাবে স্বামী হয়ে গেল !
এটাই বুঝি লেখা থাকে কপালে ! কিভাবে আর কার সাথে যে মানুষের বিয়ে হয়ে যায় সেটা কেউ বলতে পারে না । নোরা কি সত্যিই কোন ভেবেছিলো এই মানুষটার সাথে ওর বিয়ে হবে ?
নাহ কোন দিন ভাবে নি !
এই সব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলো সেটা নিজেও জানে না । সকালবেলা যখন ঘুম ভাঞ্গলো অবাক হয়ে দেখলো ও খাটের উপর শুয়ে আছে । ওর স্পষ্ট মনে আছে যে আদনানের পাশেই বসে ছিল সে । কোন ভাবেই খাটের উপরে আসে নি । আদনানকে নিচে রেখে ও কোন ভাবেই খাটের উপর এসে ঘুমাতে পারে না ! তার মানে আদনান নিজে ওকে এখানে নিয়ে এসেছে ?
এই অনুভূতিটা মনে আসতেই একটা লজ্জা লজ্জা অনুভব হল । ঘরে অবশ্য তখন কেউ ছিল না । আদনান ওকে ঘুমন্ত অবস্থায় রেখে চলে গেছে ।
সকালে নাস্তার টেবিলে অন্য সবাই হাজির থাকলেও আদনান ছিল না । জানা গেল সে নাকি সকাল বেলাতেই বেরিয়ে গেছে । তার অফিসে জরুরী কাজ আছে । সোবাহান চৌধুরী খানিকটা বকাবকি করলেন এই ভাবে সকালে চলে যাওয়ার জন্য । সকালের নাস্তাটা অন্তত এক সাথে খাওয়ার দরজার ছিল । তবে নোরার বাবা বলল যে সকালে যাওয়ার আগে নাকি তার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে গেছে । এটা শুনে সোবাহান চৌধুরী খানিকটা শান্ত হলেন । তবে নোরার মনে তখন চলছে অন্য কথা । নোরা নিশ্চিত ভাবেই জানে যে আদনান ওর সামনে না পড়ার জন্য ওভাবে সকাল বেলাতেই বেরিয়ে গেছে । মনে মনে হাসলো কেবল ।
নোরার বাবা মা আরও একদিন ছিল আদনানদের বাসায় । তারপর ওকে রেখে ওরা বিদায় নিল । নোরা তারপরের দিন হলে ফিরে এল । এই দুইদিনে আদনান একবারও বাসায় আসে নি । ওর নাকি বিশেষ কাজ পরে গেছে । ঐদিন রাতেই চট্টগ্রাম যেতে হয়েছে ওকে ! নোরা এবার নিশ্চিত হয়ে গেল যে আদনান লজ্জায় নোরার সামনে আসছে না। নোরা যত সময় আদনানদের বাসায় থাকবে তত সময় আদনান বাসায় আসবে না । নিজের হলে ফেরৎ চলে এল !
***
-স্যার বাসায় যাবেন তো ?
কামালের কথা শুনে আদনান যেন বাস্তবে ফিরে এল । তাকিয়ে দেখলো গাড়িটা ওদের বাসার পথ ধরেছে । সকাল বেলা সব গাড়ি গুলো অফিস পাড়ার দিকে যাচ্ছে । আদনান বলল, না আগে অফিসে চল ! ওখানে কিছু কাজ আছে !
তারপর খানিকটা ইতস্ততঃ ভাবে কামালকে জিজ্ঞেস করলো, বাসায় কি নোরা আছে এখন ?
কামাল সাথে সাথেই বলল, না স্যার ! ম্যাডাম গতকালকে তার হলে ফেরৎ গেছে । তার নাকি কি একটা পরীক্ষা আছে ।
-আচ্ছা ।
আদনান কি যেন ভাবলো । তারপর বলল, আচ্ছা আগে তাহলে বাসার দিকে চল । তারপর না হয় অফিস যাওয়া যাবে ।
কামালের দিকে তাকিয়ে আদনানের মনে হল কামাল হয়তো কিছু আচ করতে পেরেছে । একটা অস্বস্তি বোধ কাজ করতে শুরু করলো । কালাম কি জেনে যাবে সব ! বাড়ির অন্য সব মানুষ যদি জেনে যায় ?
আর নোরা যদি রাতের কথা ওর বন্ধুদের কাছে বলে ?
এই ব্যাপারটা ভাবতেই ওর মুখটা খানিকটা লাল হয়ে গেল । এই চিন্তাতে ওর গত দুই দিন ঠিক মত ঘুম হয়নি । ওর বাবা ওকে বেশ কয়েকবার ফোন দিয়ে বকাবকি করেছে । বারবাই আদনানের মনে হচ্ছিলো যে ওর বাবা হয়তো এখন বলবে যে তুই গাধা বাসর রাতে ঐভাবে অজ্ঞান কেন হয়ে গেলি !
সত্যিই কেন এভাবে অজ্ঞান হয়ে গেল ?
নোরার ঐভাবে বসে থাকতে থেকে অতীতের ঐদিনের কথাটা এইভাবে মনে পড়ে যাবে সেটা আদনান বুঝতে পারে নি । সে কোন দিন এমন একটা দিনের সম্মুখীন হবে সেটাও সম্ভবত ওর ধারনা ছিল না । অন্য কেউ তার বউ হবে এটা ওর অবচেতন মন ঠিকঠাক মেনে নিটে পারে নি । তাই হয়তো এভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ।
সকাল বেলা যখন আদনানের ঘুম ভেঙ্গেছিলো দেখেছিল যে ও সেই নিচেই শুয়ে আছে । ওর মাথার নিচে একটা বালিশ দেওয়া । ঠিক ওর পাশেই গুটুসুটি মেরে নোরা শুয়ে আছে । নোরার দিকে তাকিয়ে আদনানের একটা অন্য রকম অনুভূতি হল । দশ এগারো বছর পরে কারো জন্য এই অনুভূতি সে অনুভব করলো । খুব সাবধানে নোরাকে কোলে তুলে নিয়ে সে বিছানাতে শুইয়ে দিল । তারপরই ঘর ছেড়ে পালিয়ে গেল ! আজকে ফেরৎ আসছে ।
বাসায় এসে আদনান আরেকটা কথা জানতে পারলো । সোবাহান চৌধুরী প্রথমে ওকে একটু বকাবকি করলো বটে । তবে শেষে যে কথাটা বলল সেটাতে ওর মনটা আসলেই ভাল হয়ে গেল । এই দুইদিন নোরা নাকি প্রায় পুরোটা সময়ই ওর মায়ের কাছে ছিল । মায়ের ঘরেই সময় কাটিয়েছে । নিজে হাতে আদনানের মা কে গোসল করিয়েছে, খাইয়ে দিয়েছে । এবং সব থেকে অবাক করার ব্যাপার যে ও খুব শান্ত ভাবেই নোরার প্রতিটি কথা শুনেছে ।
এতোদিন আদনানের মা রেবেকাকে তার ঘরের ভেতরেই খাওয়ানো হত । এই দুইদিনে রেবেকাকে নোরা ডাইনিং রুমে এনে খাইয়েছে । বিকেলে তাকে নিয়ে লনে হাটাহাটি করেছে । সারাটা সময় নোরার হাত ধরেছিল সে ।
সোবাহান চৌধুরী হঠাৎ বলল, তুই কি রাগ করেছিস আমার উপরে ?
আদনান বলল, কেন রাগ করবো কেন ?
-এই যে এই ভাবে তোকে বিয়ে দিলাম !
আদনান কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল । কি যেন ভাবলো । সোবাহান চৌধুরী বলল, আমি জানি তুই নীতুকে খুব বেশি ভালবাসতি । এখনও বাসিস কিন্তু এইভাবে আর কতদিন! তোকে মা কে দেখ নোরাকে কিভাবে আপন কে নিয়েছে এক নিমিশেই । আমার কি মনে হয় জানি ? তোর মা খুব জলদি স্বাভাবিক হয়ে উঠবে !
আদনান বলল, নোরাকে সব কিছু বলেছো কি ?
-না কিছুই বলি নি !
-এটা তাকে বলা দরকার ছিল না কি ?
-হয়তো ছিল ?
-এখন সব শুনে যদি সে চলে যায় ? তখন ?
-যাবে না । দেখিস এই মেয়ে যাবে না ! ওকে ঠিকঠাক মত বুঝিয়ে বলতে পারলে এই মেয়ে ঠিকই বুঝবে !
আদনান আর কিছু বলল না । নিজের ঘরের দিকে রওয়ানা দিল ।
আট
নোরার ইনকোর্স পরীক্ষা শেষ হল বিকেল বেলা । হল থেকে বের হয়েই কামালকে দেখতে পেল ডিপার্টমেন্টের সামনে দাড়িয়ে থাকতে । ওকে দেখার সাথে সাথে মুখে ৬০ পাওয়ারের আলো জ্বলে উঠলো । দ্রুত এগিয়ে এল ওর দিকে ।
-পরীক্ষা ভাল হয়েছে ম্যাম ?
কামালের বলার ভঙ্গিটাই এমন ছিল যে নোরা হেসে ফেলল । তারপর বলল, এটা কে জানতে চাচ্ছে ? আপনি নাকি আপনার স্যার ?
কামাল বলল, স্যার আসলে কিছুই জানতে চাচ্ছেন না । না মানে আপনি এমন করে বিয়ের পরদিনই হলে চলে এলেন পরীক্ষার কারনে । আমি ভাবলাম যে নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ন কোন পরীক্ষা হবে । তাই নিজ থেকে জানতে চাইলাম আর কি ?
নোরা বলল, এমন কোন গুরুত্বপূর্ন পরীক্ষা না । না দিলেও কোন সমস্যা হত না ।
-তবুও চলে এলেন !
-হ্যা । আমি যে চলে এসেছি শক দুর করার জন্য !
নোরার কথা শুনে কামাল বেশ অবাক হল । তারপর বলল, শক মানে ? আপনি কি বলছেন ? বিয়ে করে আপনি শকে আছেন ?
নোরা আবারও হাসলো । তারপর বলল, আমি না, আপনার বস !
কামাল যেন এবার আকাশ থেকে পড়ল । অবাক চোখে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো নোরার দিকে । নোরা সেদিকে লক্ষ্য না করে বলল, কেন আপনি খেয়াল করে নি ? আমি নিশ্চত জানি যে আপনার বস আমার কাছ থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে । দেখলেন না বিয়ের পরদিন সকালেই কেমন করে চট্টগ্রাম পালিয়ে গেল । আমি যদি তার বাসা থেকে না আসতাম তাহলে বাসাতেই আসতো না ।
কামাল প্রতিবাদ করতে গিয়েও করলো না । কিছু যেন তার মনে পড়ে গেল । সত্যিই কিছু সময় সে ভেবে ভেবে দেখলো । আদনান চৌধুরী জরূরী ভিত্তিতে যে চট্রগ্রাম চলে গেল সেই কাজটাতে তার না গেলেও চলতো । কামালকেই পাঠানো যেত । কিংবা জিএম সাহেব কে পাঠালেই কাজ হয়ে যেত । কিন্তু তার বস নিজে নিজে চলে গেল । এমন কি কামাল নিজেও জানতো না । একটু য অবাক হয় নি সেটা সে বলতে পারবে না !
কালাম কোন কথা খুজে পেল না । কি বলবে বুঝতে পারছে না । নোরা বলল, এখন কি জন্য এসেছেন বলুন দেখি ।
কামাল আর কথা না বলে হাতের ছোট প্যাকেট টা নোরার দিকে বাড়িয়ে দিল । নোরা বলল, এটা কি ?
-স্যার পাঠিয়েছে আপনার জন্য ।
-আপনার স্যার কোথায় ?
-স্যার অফিসে !
নোরার একবার মনে হল প্যাকেট টা কামালকে ফেরৎ পাঠিয়ে বলে যে একজনের উপহার সে অন্যের কাত থেকে নেয় না । কিন্তু কি মনে হল সেটা করলো না । হাত বাড়িয়ে প্যাকেট টা নিল । ভেতরে কি আছে সেটা আন্দাদ করতে ওর খুব একটা অসুবিধা হল না । সেটা হাতে নিয়ে নিজের হলের দিকে হাটা দিল ।
কামাল ওর পিছু পিছু আসতে লাগলো । নোরা যখন বুঝতে পারলো যে কামাল পেছন পেছন আসছে নোরা দাড়িয়ে বলল, আরও কিছু বলতে চান ?
-জি।
-স্যার আপনার ব্যবহারের জন্য একটা গাড়ি পাঠিয়েছে !
-কি ?
-হ্যা । ঐ যে লাল রংয়ের প্রিমিও গাড়িটা দেখছেন গেটের সামনে ওটা আপনার জন্য !
নোরা অন্তত এটা আশা করে নি । নোরা বলল, আমি গাড়ি নিয়ে কি করবো ? আমি গাড়ি চালাতে জানি নাকি ?
কামাল সাথে সাথে বলল, গাড়ির সাথে ড্রাইভার আছএ । সে ২৪ ঘন্টা থাকবে ।
-২৪ ঘন্টা কিভাবে থাকবে । তার খাওয়া ঘুম লাগবে না ।
কামালের চেহারা দেখে মনে হল এটা যেন সে ভেবে দেখে নি । কিছু সময় ভাবলো । তারপর বলল, সেটার সমাধান করা যাবে । দুইজন ড্রাইভার রেখে দিবো তাহলে । ওরা সিফট অনুয়ায়ী ডিউটি দিবে । ১২ ঘন্টা ১২ ঘন্টা !
নোরা বলল, তো ওরা কোথায় থাকবে ? আমার হলের সামনে ? আমি যখন ফোন দিবো এসে হাজির হবে !
-জি । আপনার এক ফোনেই হাজির হবে । এক মিনিটের বেশি সময় নিলে চাকরি নট !
নোরা বলল, শুনুন চাকরি নট করতে হবে না । আপনার বসকে বলে দিন যে গাড়ি লাগবে না । ওটাকে নিয়ে যান ।
-কিন্তু ম্যাডাম .....
-কোন কিন্তু এই গাড়ি নিয়ে যান । আমার গাড়ি পছন্দ হয় নি । লাল রং আমার পছন্দ না !
কামাল বলল, তাহলে কি অন্য .....।
নোরা হাতের ইশারায় কামালকে চুপ করতে বলল। তারপর হাতের ইশারায় গেটের দিকে যাওয়ার নির্দেশ দিল । তারপর নিজে হাটতে লাগলো হলের দিকে । কামাল খানিকটা বোকা আর অসহায়ের মত দাড়িয়ে রইলো । কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না । আদনান ওকে খুব ভাল করে বলে দিয়েছে গাড়িটা যেন নোরা নেয় এই ব্যবস্থা করতে । এর অর্থ হচ্ছে যে কোন ভাবেই হোক তাকে রাজি করাতে হবে । কিন্তু সে তো সেই সুযোগই পেল না । ও তো ভেবেছিলো গাড়ির কথা শুনে নোরা ম্যাডাম লাফাতে লাফাতে রাজি হয়ে যাবে নিতে । আস্ত একটা গাড়ি আবার কে না নিতে চায় ! আজিব এই মেয়ে গুলো ! এমন কেউ করে নাকি !
এখন সে কি করবে !
কামালের মতই অরিন যেন আকাশ থেকে পড়লো যখন শুনলো যে নোরা আদনানের দেওয়া গাড়িটা ফিরিয়ে দিয়েছে । রাতের বেলা দূজন বসে গল্প করছিলো । নোরার হাতে নতুন ফোনটা দেখেই জানতে চাইলো কবে কিনলো ! নোরা জানালো যে কিনে নি । আদনান পাঠিয়েছে । সেই সাথে যখন বলল একটা গাড়িও পাঠিয়েছিলো । সে ফেরৎ পাঠিয়েছে !
অরিন কিছু সময় চিৎকার চেঁচামিচি করলো । তারপর বলল, শোন এখন আদনান হচ্ছে তোর স্বামী । তার সব কিছুর উপর তোর অধিকার রয়েছে । ক্ষেত্র বিশেষে আদনানের থেকে বেশি রয়েছে !
নোরা বলল, তার জিনিসের উপরে তার থেকে বেশি অধিকার ?
-অবশ্যই । তোর কিছু দরকার হলে সে দিতে বাধ্য ! নিজের জন্য না কিনলেও তোর জন্য সেটা সে কিনে দিবে । বুঝেছিস ?
-না বুঝি নি । বুঝতে চাই ও না !
অরিন বলল, ইস ! এখন গাড়িটা থাকলে কত ভাল হত । আমি গাড়িতে করে এই রাতের বেলা ঘুরে বেড়াতে পারতাম !
-তা কিভাবে বের হতাম শুনি !
-সেটা শুনে আর লাভ কি ! গাড়ি তো নাই ।
নোরার হঠাৎ কি মনে হল । সে বলল, আমি গাড়ির ব্যবস্থা করতে পারি । তুই বল কিভাবে হল থেকে বের হব !
অরিন বলল, তুই গাড়িটা আনা । আমি বের করছি তোকে !
নোরার নিজের মোবাইল বের করে আদনানকে ফোন দিল । একটু যে সংকোচ লাগছিলো না সেটা বলবে না । তবে এই রাতের বেলা গাড়িতে করে করে ঘুরে বেড়ানোটা আসলে অন্য রকম একটা ব্যাপার হবে ।
ওদের ক্লাসে আরিয়ানা নামে একটা মেয়ে পড়ে । প্রায়ই দেখা যায় রাত দুই টা কি তিনটার সময় সে গাড়ি নিয়ে ড্রাইভে বের হয়েছে । ঢাকা শহরের বেশ কিছুদিন সে আছে তার পরেও কখনও রাত করে বের হয় নি । এমন কোন সুযোগই আসে নি ।
ওপাশ থেকে ফোন রিসিভ হল । কিন্তু কোন আওয়াজ হল না । নোরাও কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল, গাড়িটা কি আমার হলের সামনে পাঠানো যাবে এখন ?
নোরা ফোনের ভেতরে একটা নিঃশ্বাস পড়ার আওয়াজ শুনলো । আদনান বলল, আমি বলে দিচ্ছি !
ফোন রেখে অরিনের দিকে তাকিয়ে বলল, গাড়ি আসছে ! চল দেখি কিভাবে বের হস !
অরিন বলল, চল দেখাচ্ছি ।
বারান্দায় বের হল নোরার মনে হল যেন পুরো হলটা ঘুমিয়ে পড়েছে । তবে ও জানে যে বলতে গেলে প্রায় সবাই জেগে আছে । কেউ কেউ পড়াশুনা করছে নয়তো বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে । এদের ঘুমাতে ঘুমাতে ভোর হয়ে যাবে । তার কোন আওয়াজ না করেই ওরা হাটতে শুরু করলো সিড়ি দিকে । প্রধান গেটের কাছে আসতেই দেখলো গেটের দারোয়ান নিজের মোবাইল কি যেন দেখছে গভীর মনযোগ দিয়ে ।
নোরা অবাক হয়ে দেখলো অরিক একটা ১০০ টাকার নোট দারোয়ানের পকেটে ঢুকিয়ে দিল । দারোয়ানের সামনেই একটা ছোট টেবিলের উপরে চাবির গোছা ছিল । সেটা নিয়ে ছোট গেট টার তালা খুলে ফেলল । তারপর চাবিগোছাটা আবার আগের স্থানে রেখে দিল । দারোয়ান তখনও মনযোগ দিয়ে মোবাইলে ভিডিও দেখছে । ওরা সামনে দিয়ে পার হল সেটা যেন দেখলোই না ।
গেটের বাইরে বের হতেই নোরার মনে হল যেন অন্য জগতে চলে এসেছে । রাতের ঢাকা এরকম লাগে ?
প্রতিদিন এই গেট দিয়ে যে ভেতরে ঢোকে । এই রাস্তায় হাটে অথচ এখন এই রাস্তাটা কেমন অপরিচিত মনে হচ্ছে । আশ্চর্য !
অরিন বলল, গাড়ি কোথায় ?
নোরার কিছু বলতে হল না । দেখতে পেল একই সাথে তিনটা গাড়িটা সারি বেধে ঠিক ওদের সামনে এসে থামলো ।
নোরা আর অরিন কিছু সময় একে অন্যের দিকে মুখ চাওয়া চাওয়ী করলো । একজন ড্রাইভার দরজা খুলে হয়ে বের হয়ে বলল, ম্যাডাম, আপনি বলেছিলেন লাল রং পছন্দ নয় তাই এই তিনটা রংয়ের গাড়ি পাঠিয়েছে । নীল, কালো আর সাদা ! আপনি যেটা পছন্দ হবে সেটা আপনার জন্য রাখা হবে !
নোরা কিছু বলতে যাবে তার আগে অরিন বলল, আর যদি তিন টাই পছন্দ হয় ।
ড্রাইভার দাঁত বের করে বলল, তাহলে তিনটাই আপনার ! এখানেই থাকবে !
অরিন বলল, চল এখন কালোটাতে উঠি । কাল সকালে নীলটা চড়া যাবে । আর দুপুর বেলা আমরা চড়বো সাদাতে । আরেকটা গাড়ি থাকলে ভাল হত । বিকেলে চড়তে পারতাম !
নোরা অরিনকে বলল, চুপ থাক তো !
তবে অরিনের ইচ্ছে অনুযায়ী ঠিকই কালো গাড়িতেই উঠলো ।
নোরার কেন জানি অদ্ভুত একটা অনুভূতি হতে শুরু করলো । ওর জীবনটা কি আসলেই এমন হওয়ার কথা ছিল ? এতো সৌভাগ্য ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো ?
এতো এতো ভাল ভাল সব কিছু ঘটছে এরপরই খারাপ কিছু ঘটবে না তো ? নোরা জানে না । তবে নোরা এসব নিয়ে আর ভাবার সময় পেল না । অরিন ততক্ষণের ছাদের উপরের কাঁচ খুলে ফেলেছে । নিজের শরীরের অর্ধেকটা বাইরে বের করে দিয়ে চিৎকার করা শুরু করেছে । গাড়ি চলছে খুব দ্রুত ! নোরা কাঁচ নামিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইলো । ঢাকা শহরটা ওর কাছে অন্য রকম লাগছে । ওর পুরো জীবনটাই অন্য রকম হয়ে গেছে । সামনে হয়তো আরও অন্য রকম হবে !
মোবাইল লিংকঃ
পর্ব এক পর্ব দুই পর্ব তিন
ছবি উৎস
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই জুন, ২০২১ রাত ২:২৫