কাঠের বারান্দাটাতে হাটাহাটি করলেই আওয়াজ হতে থাকে । এই নিশ্চুপ রাতে সেই আওয়াজটা কানে বড় বেশি আওয়াজ তুলে চলেছে । শেষে হাটাহাটি বাদ দিয়ে অবনী বারান্দাতে রাখা একটা সোফাতে বসে পড়লো । শূন্য চোখে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে । সামনের কোন কিছুই সে দেখছে না ।
আজকে আকাশে চাঁদ না থাকলেও চারিপাশটা বেশ ভাল করেই দেখা যাচ্ছে । হয়তো রিসোর্টের চারিদিকে আলো জ্বালানো রয়েছে বলেই এমনটা মনে হচ্ছে । অবনী এক ভাবে অন্ধকারের দিকে তাকিয়েই রইলো । মাথাটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে । কিছুই ভাবতে পারছে না পরিস্কারভাবে । বারবার কেবল সাব্বিরের চেহারাটা মনে পড়ছে । ওর ভীত চোখটা সে কিছুতেই ভুলে থাকতে পারছে না । বারবার নিজের কাছেই প্রশ্ন করছে, কাকে কিংবা কি দেখে ও এতো ভয় পাচ্ছে ? এতো তীব্র ভাবে ভয় পেতে ও আর কাউকে দেখে নি ।
-আফা মনি !
অবনী তাকিয়ে দেখে বারান্দার নিচে কেয়ারটেকার গনি মিয়া দাঁঁড়িয়ে আছে । এতো রাতে গনি মিয়াকে জেগে থাকতে দেখে অবনী একটু অবাক হল । তাকিয়ে বলল,
-কি ব্যাপার চাচা এখনও ঘুমান নি ?
-আপনেও তো ঘুমান নাই !
-আমার ঘুম আসছে না ।
-ছোট সাহেবের কথা চিন্তা করতেছেন ?
অবনী কোন কথা বলল না । আবারও শূন্য অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । গনি মিয়া বলল,
-অনেক রাইত হইছে । আপনে এইবার ঘুমাইতে যান । এতো রাইত কইরা যাইগা থাইকেন না ।
অবনী জানে ঘুমাতে গেলেও ওর ঘুম ঠিক মত আসবে না । সাব্বিরের সাথে ঐ ঘটনা ঘটার পর থেকে ওর একটা রাতও ঘুম আসেনি শান্তিমত । বারবার কেবল সাব্বিরের সেই ভয়ে ভয়ে চিৎকার করে ওঠার আওয়াজটা ওর কানে ভাসতে থাকে । এমন কেন হচ্ছে ওর সাথে? কেন ও এতো ভয় পাচ্ছে? এতো ভয় পাওয়ার কি আছে ?
কত ডাক্তারের কাছে গিয়েছে ওকে । মনোরোগ ডাক্তারের কাছ থেকে মস্তিস্কের ডাক্তার পর্যন্ত সবার কাছেই সাব্বিরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে কিন্তু কোন কাজ হয় নি । ডাক্তারি চিকিৎসার পরে এবার হাজির হল অন্য চিকিৎসা । পীর ফকির থেকে শুরু করে যেখানে যে কবিরাজের কথা শোনা গেছে সাব্বিরের বাবা তাকেই এনে হাজির করেছে সাব্বিরের চিকিৎসার জন্য । কিন্তু কোন লাভ হয় নি । বরং দিন দিন সাব্বিরের অবস্থা খারাপের দিকেই যাচ্ছে ।
সাব্বিরের আব্বা যেখানে তাকে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবছে তখন অবনী ভাবছে অন্য কথা । ঘুরে ফিরে কেবল মনে করার চেষ্টা করছে সাব্বিরের জীবনে এমন কি হয়েছে যার ফলে সাব্বির এমনভাবে ভয় পেতে শুরু করলো । কিছু একটা তো ওর জীবনে হয়েছেই কিংবা ও এমন কোন কাজ করেছে যার ফলে সাব্বিরের এই সমস্যাটা হচ্ছে । কিন্তু কি করেছে সে ? সাব্বিরের জীবনের প্রায় সব কিছুই অবনী জানে । স্বামী হিসাবে সাব্বির একজন চমৎকার মানুষ, মানুষ হিসাবেও । মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ রেগে যায় বটে তবে সেটাও নিয়ন্ত্রন করে নেয় অল্প সময়ের মধ্যেই ।
অবনী ধীরে ধীরে সব কথা মনে করতে লাগলো । এমন কোন অস্বাভাবিক ঘটনা যার ফলে অন্য কারো কোন ক্ষতি হয়েছে । সাব্বিরের এমন কোন কাজ যেটাতে কারো কোন ক্ষতি হয়েছে । কিন্তু কি ক্ষতি হয়েছে ? কার ক্ষতি করেছে ও ?
ঠিক তখনই ওর মাথায় সেদিনের ব্যাপারটা ফিরে এল ।
গার্মেন্টসের ব্যবসা বাদ দিয়েও গাজীপুরে সাব্বিরদের রিসোর্টের ব্যবসা আছে । বেশ কিছু স্থান নিয়ে রিসোর্টটা । রিসোর্টে বেশ বড় ধরনের একটা বিল আছে । ঋতুভেদে সেখানে ধানের চাষ থেকে শুরু করে মাছের চাষ পর্যন্ত হয় । তাছাড়া চারিপাশে গাছগাছালি তো আছেই । জায়গাটা একদম প্রাকৃতিক বনের মত হয়ে গেছে । কয়েকটা পুকুরও আছে আশে পাশে ।
সাব্বির সেখানে মাঝেই মাঝেই ঘুরতে যায় । অবনীও যায় সাব্বিরের সাথে । কেবল অবকাশযাপনই নয় সাব্বিরের সেখানে যাওয়ার পেছনে আরও একটা কারন আছে । ওদের রিসোর্ট থেকে খানিকটা দূরের ঐ বিল । সেখানেই সারাদিন রাতে অনেক পাখি এসে জড়ো হয় । তাছাড়াও ঘন গাছ গাছালি থাকার কারনে বেশ কিছু ছোটখাটো পশুও দেখা যায় আশে পাশে । কুকুর শিয়াল আর খরগোশ দেখা যায় সবচেয়ে বেশি । রাতের বেলা মাঝে মাঝেই রিসোর্ট থেকে শিয়ালের ডাক শোনা যায় । মনে হয় যেন একেবারে গ্রামে চলে এসেছে ।
সাব্বির সেখানে গিয়ে পাখি শিকার করতে খুব পছন্দ করে । অবনীর এই ব্যাপারটা মোটেই পছন্দ না কিন্তু সাব্বির এই কথাটা মোটেই শুনতে চায় না । মাস ছয়েক আগের ঘটনা অবনীর এখনও মনে আছে । সাব্বির সেবার ওকে ঢাকাতে রেখেই রিসোর্টে গিয়ে হাজির হয়েছিলো । সাত দিন থাকার কথা বলেই গিয়েছিলো ও । কিন্তু মাত্র তিন দিনের মাথায় ও এসে হাজির হয় । আসার পর থেকেই অবনী একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিলো যে সাব্বির যেন কোন একটা ব্যাপার নিয়ে বেশ চিন্তিত । বেশ কয়েকবার জানতে চাওয়ার পরেও সাব্বিরের মুখ থেকে কোন উত্তর পাওয়া যায় নি । তবে সেই ভাবটা খুব বেশি সময় থাকে নি । দুই তিন দিনের মাথায় সব আবার আগের মত স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছিলো বলে অবনী আর ব্যাপারটা নিয়ে মাথা ঘামায় নি । তার মাস খানেক পরেই সাব্বিরের এই ভয় পাওয়ার রোগটা শুরু হয় । প্রথমে অল্প অল্প হলেও দিন দিন সেটা বাড়তেই থাকে ।
তাহলে কি ঐ গাজীপুরেই ও কোন কাজ করে এসেছিলো ? যেখানে সাত দিন থাকার কথা সেখানে মাত্র তিন থেকেই ও চলে এসেছিলো কেন ? কেন ফিরে আসার পরে ওকে খানিকটা অস্থির লাগছিলো ? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর অবনীর জানা নেই । কিন্তু ওর কেন জানি মনে হল এই উত্তরগুলোর সাথেই সাব্বিরের এই ভয় পাওয়া রোগটা সম্পর্কিত । আগে এই প্রশ্নের উত্তর জানতে হবে । তখনই অবনী ঠিক করে ফেলল কাল সকালেই ও গাজীপুরের পথে রওনা দিবে । ওকে নিজেই জানতে হবে আসল কথা গুলো !
রেস্ট হাউজে ওর রুমটা একেবারে শেষের দিকে । একটু উঁঁচু কৃত্রিম টিলার উপরে । এটা ওদের ব্যবহারের জন্যই বানানো হয়েছে । ওরা যদি না থাকে তখন অন্য কাউকে ভাড়া দেওয়া হয় । অবনী হঠাৎ ঘন্টার আওয়াজ শুনতে পেল । তাকিয়ে দেখে নিচ থেকে সেই আওয়াজটা আসছে । কোন গেস্টের কোন কিছু দরকার হয়েছে সম্ভবত । গনি মিয়া একবার নিচের দিকে তাকালো । তারপর অবনীর দিকে তাকিয়ে বলল,
-রাবু কই গেল । বেল বাজতাছে শুনতাছে না ?
-আপনি গিয়ে দেখুন তো । রাবুর যা ঘুম !
গনি মিয়া আর দাঁড়ালো না । যাওয়ার আগে ওকে রুমে গিয়ে শুয়ে পড়তে বলল । রাতের বেলা বেশিক্ষণ জেগে থাকা ঠিক না ।
গনি মিয়া চলে যাওয়ার পরেও আবনী নিজের রুমের ভেতরে গেল না । বরং কাঠের বারান্দা থেকে নিচে নেমে এল । এই বাংলোটার ঠিক পেছনেই এক চিলতে জায়গা আছে । সেখানে চাইলে বসে থাকা যায় । আবার অনেকটা দূর নিচেও নেমে যাওয়া যায় । সাব্বিরের সাথে যখনই এখানে আসতো রাতে প্রায়ই দুজনে এখানে এসে বসতো । আজেকেও সে এখানে এসে দাঁঁড়ালো ।
রাতটা একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে আছে । কোথাও একটু ঝিঁঝিঁঁ পোকাও ডাকছে না । অবনীর কাছে কেমন যেন পরিবেশটা একটু অস্বস্তিকর মনে হল । একটু আগেও চারিদিক থেকে বিভিন্ন পোকামাকড়ের গুঞ্জনের আওয়াজ ভেসে আসছিলো কিন্তু এখন আর সেসব আসছে না । সব কিছু যেন থেমে গেছে ।
গনি মিয়ার কথাটা আবার মনে হল ওর । তারপরই মনে হল ওর এখনই এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ । কিন্তু কি একটা অদ্ভুত কারনে অবনী জায়গাটা ছেড়ে যেতে পারছে না । ওখানেই দাঁঁড়িয়ে থেকে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । তারপরই সে জিনিসটাকে দেখতে পেল । অন্ধকারের ভেতরেও একটা গাঢ় অন্ধকার ধীরে ধীরে সিঁঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আসছে । একটু কুঁঁজো হয়ে হাটছে সে । হাতে একটা লাঠির অস্তিত্বও ঠিক টের পাচ্ছে অবনী ।
চিৎকার দিতে যাবে তখনই সামনের লোকটাকে সে চিনতে পারলো । লোকটার নাম নূর আলী । লোকটা এর আগেও বেশ কয়েকবার ওর কাছে এসেছে আবদার নিয়ে । অবনীকে খানিকটা বিভ্রান্ত দেখালো । কারন রিসোর্টের এই দিকে কারোর আসার কথা না । বেশ ভাল রকমের তারকাঁটা দিয়ে পুরো এলাকাটা আটকানো । একটা দরজা অবশ্য আছে কিন্তু সেটা সব সময় বন্ধ থাকে । সেই গেট টপকানো এই কুঁজো শরীরের কর্ম নয় ।
অবনীর মাথায় তখন আরেকটা ব্যাপার এল । হয়তো নূর আলী এই পথ দিয়েই নিচে নেমে গিয়েছিলো কোন সময় । এখন ফিরে আসছে । অবনী তাই আর কিছু চিন্তা করলো না । বলল,
-আপনি তো আমাকে ভয়ই পাইয়ে দিয়েছিলেন !
লোকটা কেমন দাঁত বের করে হাসলো । তবে কোন কথা বলল না । অবনীর মনে হল লোকটা এখন হয়তো আবারও সেই একই কথা তুলবে । অন্তত ওর সাথে লোকটার যতবার দেখা হয়েছে লোকটা এই একই কথা তুলেছে । বারবার ও সাব্বিরের নামে বিচার দিয়েছে ওর কাছে ।
আসলে কাজটা অবনীর নিজেরও পছন্দ ছিল না । সাব্বিরের সব কিছুই অবনীর ভাল লাগতো কেবল এই একটা ব্যাপার ছাড়া । সাব্বির একদমই পশুপাখি পছন্দ করতো না । তবে পাখি শিকার করতে খুব পছন্দ করতো । এমন সুন্দর সুন্দর পাখি গুলো একজন মানুষ কিভাবে মেরে ফেলতে পারে সেটা অবনীর মাথায় আসে নি কখনো ।
সাব্বিরের এখানে আসার অন্যতম আরেকটা কারনই হচ্ছে এই পাখি শিকার করা । রিসোর্টের পাশের বিলটাতে প্রচুর পাখি আসে সব সময় । দিন আর রাতে যখন ইচ্ছে যাওয়া যায় । স্থানীয়ভাবে প্রশাসন এই পাখি শিকার করতে মানা করলেও সাব্বির এই নিষেধাজ্ঞাকে মোটেই পাত্তা দিত না । তার যে কিছু হবে না সেটা সে খুব ভাল করেই জানতো ।
এই নূর আলীই প্রথমে এই পাখি মারার কথাটা স্থানীয় থানায় জানায় কিন্তু সেখানে কোন লাভ হচ্ছে না দেখে সে অবনীকে এসে জানায় । তাকে বলে যেন সাব্বির এই কাজটা না করে । পাখিদের এই ভাবে মেরে ফেলা ঠিক না । অবনী যে মানা করে নি তা নয় কিন্তু সাব্বির সে কথায় কান দেয় নি । তারপর থেকে যতবাই নূর আলীর সাথে দেখা হয়েছে ততবারই সে একই অভিযোগ করেছে ।
অবনী আজকেও মনে করলো নূর আলী হয়তো সেই একই অভিযোগ করবে কিন্তু আজকে কোন কথা বলল না । কেবল অবনীর দিকে তাকিয়ে রইলো একভাবে । তারপর বলল,
-ভালা আছেন আম্মাজান ?
-জি !
অবনীর জি বলা শুনে লোকটা এবার কেমন অদ্ভুতভাবে হেসে ফেলল । যেন অবনীর ভেতরের সব কথা সে জানে ।
অবনী অবাক হয়ে বলল,
-কি ব্যাপার আপনি হাসলেন কেন ? আমি হাসির কথা বলেছি ?
-না । তবুও হাসি পাইলো ।
-কেন ?
-কইতে পারি না ।
অবনী কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই সময়ই পেছন থেকে কেউ ওর নাম ধর ডেকে উঠলো । তাকিয়ে দেখে গনি মিয়া দাঁঁড়িয়ে আছে । সেখান থেকেই ওর নাম ধরে ডাকছে । অবনী চলে যাওয়ার আগে আবার নূর আলীর দিকে তাকাতে যাবে ঠিক তখনই চমকে উঠলো । কারন ও যেখানে দাঁঁড়িয়ে আছে সেখানে ও ছাড়া আর কেউ নেই ।
অবনীর বুকের ভেতর এবার কেমন যেন করে উঠলো । ও পেছনে থেকে মুখ ঘুরিয়ে আবারও সামনের দিকে তাকানোর মাঝে খুব বেশি হলে দশ পনের সেকেন্ডের মত গিয়েছে । এই সময়ের মাঝে একজনের গায়েব হয়ে যাওয়া মোটেই সম্ভব না । অন্তত নূর আলীর মত একজন কুঁজোর মানুষের ক্ষেত্রে তো নয়-ই । অবনী ভয় পেয়ে গেল । একটু আগে যার সাথে দেখা হল সে তাহলে কি ? আর কিছু না ভেবে সে দ্রুত গনি মিয়ার দিকে হেটে গেল । গনি মিয়ার সাথে সেখানে আরও একজন দাঁঁড়িয়ে ছিল । ও কাছে যেতেই গনি মিয়া বলল,
-আফা মনি আপনের চেহারা এমন ক্যান লাগতাছে ?
-নাহ কিছু না ।
-আর বাইরে থাইকেন না । ঘুমায়া পড়েন ।
আরেকবার পেছনের দিকে তাকিয়ে অবনী নিজের রুমের দিকে হাটা দিল । এখনও ওর মাথা ঠিকমতো কাজ করছে না । নূর আলীর মত মানুষটা কিভাবে চোখের নিমিষে গায়েব হয়ে গেল ! আচ্ছা ঝোপের আড়ালে চলে গেছে যায় নি ? কিন্তু আশে পাশে এমন কোন ঝোপও ছিল না যে এই কুঁঁজো লোকটা এতো দ্রুত চলে যেতে পারবে। আর যদি যায়ও তাহলে তো আওয়াজ শোনা যাবে ?
অবনী কিছুতেই নিজের মনকে বুঝ দিতে পারলো না । একটা সুক্ষ্ণণ ভয় ওর ভেতরে কাজ করতে লাগলো । পেছনে আর না তাকিয়ে নিজের রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল । তবে মনের ভেতরে শান্তি পেল না কিছুতেই । এই রুমে সে এর আগেও অনেক বার এসেছে । প্রতিবারই যে সাব্বিরের সাথেই এসেছে তাই না, মাঝে মাঝে একাও এসেছে সে । কিন্তু আজকের মত এমন অস্বস্তি কোনদিন লাগে নি ।
এই অনুভূতিটাকে সে কিছুতেই ব্যাখ্যা করতে পারবে না । তবে বারবার মনে হচ্ছে কিছু যেন ঠিক নেই আশেপাশে । একবার মনে হল আজকে গানি মিয়াকে ডাক দিয়ে গেস্টদের আশে পাশেই একটা রুম ঠিক করে দিতে বলবে । সবার থেকে দূরে থাকতে একটু যেন ভয়ভয় করছে । লাইটটা বন্ধ করে মোবাইলে কিছু সময় ব্রাউজ করলো । কিন্তু কিছুতেই মন টেকাতে পারলো না । তারপর যখন মোবাইলের স্ক্রিনটা বন্ধ করে শুয়ে পড়লো তখনই আওয়াজটা শুনতে পেল । কেউ যেন পা টেনে টেনে হাটছে ওর রুমের চারিপাশে । সাথে মাটিতে একটা লাঠির থপথপ আওয়াজ হচ্ছে । আওয়াজটা প্রথমে কিছু সময়ে ওর রুমের চারিপাশে ঘোরাফেরা করলো । একবার ডান থেকে বামে আরেকবার বাম থেকে ডানে ।
অবনীর বুকের ভেতরেটা একটু একটু কাঁপতে লাগলো ভয়ে । হাতের কাছের সুইচটা খুঁঁজে বের করে টিপ দিল । কিন্তু আলো জ্বললো না । তখন সেই ভয়টা আরেকটু বেশি করে জেঁকে বসলো ওর মাঝে । এমন তো হওয়ার কথা না ?
তাহলে কি বিদ্যুৎ চলে গেছে ?
নাহ সেটাও তো হওয়ার কথা না । কারণ বিদ্যুৎ যদি চলেও যায় তাহলে জেনারেটর চালু হওয়ার কথা সাথে সাথেই । তাহলে আলো জ্বলছে না কেন ?
অবনীর মনে হল সেই আওয়াজটা আরও কাছে চলে এসেছে । কাঠের বারান্দার উপর হাটাচলা করছে । অবনী মোবাইলটা খোঁঁজার চেষ্টা করলো কিন্তু সেটাও পেল না । হাতড়ে হাতড়ে বিছানার পাশে রাখা দড়িটা খোঁঁজার চেষ্টা করলো । এটা মেইন ঘন্টার সাথে আটকানো । রিসোর্টের সব রুমের সাথেই এমন একটা দড়ি ঝুলানো আছে । কোন গেস্টের কিছু দরকার হলেই এরকম একটা দড়ি ধরে টান দেয় । তখন গনি মিয়া বুঝতে পারে কারোর কিছু দরকার পড়েছে ।
অবনী দড়িটা ধরে টান দিতেই বুঝতে পারলো কেউ যেন বাইরে থেকে দড়িটা ধরে রেখেছে । অবনীর টান দেওয়ার ফলেও কোন আওয়াজ বের হচ্ছে না ঘন্টাটা থেকে । এবার সত্যি সত্যিই একটা তীব্র ভয়ের স্রোত বয়ে গেল ওর পুরো শরীর জুড়ে । ওর ঘরের দরজার বাইরেই কেউ দাঁড়িয়ে আছে । সে-ই দড়িটা ধরে আছে ।
এমন সময় দরজায় মৃদু স্বরে টোকা দেওয়ার আওয়াজ শুনতে পেল । কেউ যেন ওপাশ থেকে অবনীকে ডাকছে ।
-আম্মা ! দরজাডা খুলেন আম্মা !
আবারও দরজায় টোকা !
অবনীর কন্ঠস্বরটা চিনতে মোটেই কষ্ট হল না । কে ওকে ডাকছে সে বুঝতে পারছে কিন্তু ভয়ে ওর গলা শুকিয়ে যাচ্ছে ।
-আম্মা আমার পাখিগুলান মাইরেন না ! আম্মা গো ......
সেই সাথে দরজায় আঘাতের আওয়াজটা বাড়ছেই ।
এমনভাবেই আকুতি করতো নূর আলী । দরজার ওপাশে দাঁঁড়িয়ে এখন ঠিক তেমনভাবেই আকুতি করছে লোকটা । কিন্তু সেই আকুতির মাঝে একটা তীব্র অশুভ কিছু আছে । অবনীর মুখ থেকে আপনা আপনি একটা ভয়ের চিৎকার ভেসে এল । সে নিজের সব শক্তি দিয়ে দাড়িটা ধরে টানা টানি করতে লাগলো ।
কতটা সময় এমন করে ছিল অবনী বুঝতে পারবে না কিন্তু একটা সময় বুঝতে পারলো দরজাতে অন্য রকম একটা আওয়াজ আসছে ।
-আফা মনি । আফা মনি দরজা খুলেন !
সেই সাথে দরজা ঝাকানোর আওয়াজ । অবনী বাস্তবে ফিরে এল । হাতড়ে এবার সুইচটা খুঁঁজে বের করে টিপতেই আলো জ্বলে উঠলো । জলদি করে দরজা খুলে দিতেই দেখলো ওপাশে গনি মিয়া আর রাবু দাড়িয়ে আছে । গনি মিয়ার বুঝতে কষ্ট হল না যে অবনী ভয় পেয়েছে । টেবিল থেকে পানি ঢেলে খেতে দিলো অবনীকে ।
অবনী এক ঢোকেই খেয়ে ফেলল পুরোটা । একটু ধীর স্থির হতেই অবনী বলল,
-নূর আলী এসেছিলো !
-কে আসছিলো ?
গনি মিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে অবনীর দিকে । ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ।
অবনী আবার বলল,
-একটু আগে যখন বাইরে ছিলাম তখনও সে এসেছিলো । তারপর আপনি ডাক দেওয়ার সাথে সাথেই চলে গেল । আবার একটু আগে ...
গনি মিয়া রাবুর দিকে তাকিয়ে বলল,
-তুই চাইলা যা । আর দরকার নাই তোর ।
রাবু কিছুটা সময় ইতস্তত করে বাইরে বের হয়ে গেল । গনি মিয়া অবনীর পাশে বসতে বসতে বলল,
-আপনে ঠিক দেখছেন আফা মনি ?
-হ্যা । কেন আপনি দেখেন নি ?
গনি মিয়া কিছুটা সময় অবনীর দিকে তাকিয়ে তারপর বলল,
-আমি বলছিলাম বড় সাহেবরে ! সে শুনে নাই ।
-কি শুনে নি ?
-নূর আলী বাইচ্চা নাই । সে ছয় মাস আগেই মারা গেছে !
-কি !
অবনী ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না । একটু আগে যার সাথে দেখা হয়েছিলো সে কি না মারা গেছে ছয় মাস আগে । গনি মিয়ার দিকে তাকিয়ে অবনীর মনে হল আরও কিছু কথা তার বলার আছে । গনি মিয়ার দিকে তাকিয়ে অবনী বলল,
-আপনি আমার কাছে কিছু লুকাচ্ছেন ?
গনি মিয়া আরও কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলল,
-নূর আলী মারা গেছে ছোট সাহেবের গুলিতে !
-কি বলছেন এসব ?
-সত্য বলতাছি আফামনি।
তারপর গনি মিয়া আস্তে আস্তে ঐদিনের সব ঘটনা বলতে শুরু করলো । অবনী কেবল চোখ বড় বড় তাকিয়ে রইলো সেদিকে । ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ।
পাখি শিকারের নেশা সাব্বিরের অনেক আগে থেকেই ছিল । একটা সময় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সে ঘুরে বেড়িয়েছে এই পাখি শিকার করার জন্যই । এই কাজ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে সে ঝামেলাতেও পড়েছে । ওর বাবার এই রিসোর্টটা বানানোর পেছনেও এই শিকারের নেশাটা ছিল একটা বড় কারন । এখানে রিসোর্ট তৈরি হওয়ার পরে সাব্বির আর অন্য কোথাও যেত না । মাঝে মাঝেই এখানে আসতো । স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে ওর বাবার একটা ভাল সম্পর্ক থাকায় আর কোন সমস্যা দেখা দিত না ।
কিন্তু নূর আলী নামের এই কুঁজো লোকটা বাঁধা হয়ে দাড়ালো । সে কিছুতেই পাখিগুলো মারতে দিবে না । মাঝে মাঝেই সাব্বিরের সাথে তার কথা কাটাকাটি হয়েছে । লোকটা অনেক চেষ্টা করেছে সাব্বিরকে আটকানোর কিন্তু পারে নি । তারপরই সে এক নতুন পদ্ধতি আবিস্কার করে । যখনই সাব্বির এসে পাখি মারতে হাজির হত নূর আলীও হাজির হত সেখানে । গুলি করার আগে সে বিস্তর শব্দ করতো । ফলে পাখিগুলো গুলি করার আগেই উড়ে যেত । এইভাবেই সে বাধা দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যায় ।
ঘটনার দিনও সে এই একই কাজই করেছিল । রাত ছিল আর সাব্বির একা ছিল বিধায় একটা সময় সাব্বিরের মেজাজ খুব বেশি খারাপ হয়ে যায় । কয়েকবার চেষ্টা করেও যখন পাখি মারতে পারলো না নূর আলীর শব্দের জন্য, তখন এয়ারগানটা সে নূর আলীর দিকে তাক করে ট্রিগার টিপে দেয় । ধুপ করে একটা আওয়াজ হয় আর নূর আলী পড়ে যায় !
সাব্বির ভেবেছিলো এয়ারগানের গুলিতে নূর আলী খুব বেশি হলে ব্যথা পাবে । এর বেশি কিছু হবে না । কিন্তু কিছু সময় পরেও যখন লোকটা উঠছিল না কিংবা কোন আওয়াজ হচ্ছিল না তখন সে এগিয়ে গেল । দেখলো মুখ হা করে নূর আলী মাটিতে পড়ে আছে । বুকের কাছে একটা ক্ষত সৃষ্টি হয়ে আছে । সাব্বিরের বুঝতে মোটেই কষ্ট হল না কি হয়েছে । যে কোন ভাবেই হোক এয়ারগানের গুলিটা নূর আলীর শীর্ণ দেহের ভেতরে ঢুকে গেছে । ভীত চোখে সেদিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে সাব্বির পড়িমরি করে দৌড় দিল রিসোর্টের দিকে ।
গনি মিয়া সাব্বিরের এই অবস্থা দেখে বুঝতে পেরেছিলো কিছু একটা হয়েছে । কিন্তু প্রথমদিন সাব্বির কিছুই বলল না । নিজের ঘরের ভেতরেই আটকে রাখলো নিজেকে । তার পরদিন সে গনি মিয়াকে সব খুলে বলল । সেখান থেকে জানানো হল সাব্বিরের আব্বাকে । সাব্বিরের আব্বাই সব ব্যবস্থা করলেন । ঢাকা থেকে দুজন লোক পাঠালেন সব ব্যবস্থা করতে ।
এদিকে নূর আলীর লাশ সেইখানেই পড়ে ছিল । বন জঙ্গল বিধায় সেখানে মানুষজনের আনাগোনা ছিল না একদম । গনি মিয়া যখন সেই লাশ খুঁজে পায় তখন লাশের অবস্থা একেবারে বিভৎস হয়ে গেছে । আশে পাশে অনেক শিয়ালের বাস । তারা লাশের বেশ খাননিকটা অংশ খেয়ে ফেলেছে । কোটর থেকে চোখ খুবলে খেয়েছে শকুনের দল । কোন রকমে লাশটা তুলে নিয়ে এসে রিসোর্টের পেছনেই গর্ত খুড়ে সেখানে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে ।
কি একটা ভয়ংকর কাজ তারা করেছে অবনী বুঝতে পারলো । যতই দুর্ঘটনা থেকে হোক, কাজটা যে অন্যায় হয়েছে সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । আর সাব্বিরের এই ভয় পাওয়া রোগটাও যে এই অপরাধ থেকেই হয়েছে সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । মানুষটা যে কাজটা জীবিত থাকতে করতে পারে নি, মৃত্যুর পরে সেই কাজটাই করছে । অবনী ঠিক করে নিল তার কি করতে হবে । এটা ছাড়া হয়তো আর কোন উপায় নেই । আগে বুঝতে পারলো হয়তো কাজটা আরও আগেই করে ফেলতো ।
পরদিন সন্ধ্যাবেলাতেই সব ব্যবস্থা করা হল । সাব্বিরের বাবাকে সব কিছু জানানো হল । তিনিই আবার কয়েকজন মানুষ পাঠালেন । কবর থেকে আবারও লাশটা তোলা হল । অবশ্য এখন আর লাশ বলে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না । কেবল কঙ্কাল । সেই কঙ্কালটাকেই ঠিক ভাবে গোসল করানো হল । জানাজা পড়ানো হল । তারপর সঠিক ভাবে কবর খুঁঁড়ে আবারও নূর আলীকে সমাহিত করা হল । অবনীর মনে হল এববার হয়তো সব কিছুর একটা হিল্লে হবে ।
সারা দিনের পরিশ্রমের পর অবনীর শরীরটা বেশ ক্লান্ত ছিল । বিছানাতে শোয়ার সাথে সাথেই প্রায় ঘুম চলে এল । কত সময় ঘুমিয়েছিলো সে বলতে পরবে না তবে একটা সময় তার ঘুম ভেঙ্গে গেল । গত দিনের সেই আওয়াজটা শুনেই । ওর রুমের চারিপাশে কেউ যেন হাটছে । থপথপ করা সেই আওয়াজটা শুনতে পাচ্ছে ও । একবার ডান থেকে বামে আবার বাম থেকে ডানে । অবনীর মনের ভেতরে সেই ভয়টা আবারও ফিরে এলো চট করেই । নিজের মনকে শক্ত করে সে বিছানা থেকে উঠে বসলো । তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল দরজার দিকে । বুকের ভেতরে সেই ভয়টা যেন আস্তে আস্তে বাড়ছেই । তবুও অবনীর মনে হচ্ছে তাকে দরজা খুলে বের হতেই হবে । সামনে হয়তো ভয়ংকর কিছু দেখতে পাবে তবুও সে বাইরে বের হবে ।
খুট করে আওয়াজ তুলে ঘরের সিটকানিটা খুলে গেল । দরজার পাল্লা টেনে খুলে ফেলল ও । বাইরে আবছা অন্ধকার । দূরের ঘরগুলোর সামনে কয়েকটা আলো জ্বালানো রয়েছে তবে ওর রুমের সামনে কোন আলো নেই । সব যেন বন্ধ হয়ে আছে । আবছা অন্ধকারটা চোখে সয়ে আসতেই অয়বয়টা দেখতে পেল সে । এক হাতে লাঠি নিয়ে কুঁজো হয়ে দাঁঁড়িয়ে আছে একজন । মুখ না দেখা গেলেও চিনতে কষ্ট হল না অবনীর । ওর বুক চিরে একটা চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাইলো তবে অনেক কষ্টে সেটা আটকে নিল । তাকিয়ে রইলো একভাবে । অনেকটা সময় সে অন্ধকারে সেই অয়বয়টার দিকে তাকিয়ে রইলো । যদিও চোখ দেখা যাচ্ছে না তবুও অবনীর মনে হল সেই অয়বয়টাও তার দিকেই তাকিয়ে আছে একভাবে ।
দুরুদুরু ভয়টা আস্তে আস্তে কমে এল অবনীর । হঠাৎ মনে হল ওর কিছু বলা উচিৎ । সামনে দাঁড়ানো মানুষটার কোন অস্তিত্ব নেই এই পৃথিবীতে । ছয় মাস আগেই সে মারা গেছে । তবুও সে এখন ওর সামনে দাঁঁড়িয়ে । আজকে দ্বিতীয়বারের মত তাকে সমাহিত করা হয়েছে । এই দুনিয়া থেকে তার সব সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু সে কোন কারনে যাচ্ছে না । হঠাৎ অবনী বলল,
-সাব্বিরকে মাফ করে দেওয়া যায় না ?
কেন বলল কথাটা ও নিজেই জানে না । কিন্তু কথাটা শুনেই সামনের অয়বয়টা কেঁপে উঠলো । তারপর পেছনে ঘুরে আস্তে আস্তে আরও অন্ধকারে মিলিয়ে গেল । অবনী কেবল তাকিয়ে রইলো সেদিকে । ততক্ষনে ওর ভয় কেটে গেছে পুরোপুরি । একটু যেন আলো ফুটে উঠেছে চারিদিকে । তারপরই আযানের আওয়াজ ভেসে এল দূর থেকে ।
পরিশিষ্টঃ
আরও মাস ছয়েক কেটে গেছে । আজকে আবারও অবনী আর সাব্বির এসেছে রিসোর্টে । সেই ঘটনার পর এই প্রথম সাব্বির এখানে এসেছে । সাব্বির অবস্থা সেই দিনের পর থেকেই ধীরে ধীরে ভাল হয়েছে । কদিন আগে একেবারে ভাল হয়ে গেছে ও । এখন আবারও স্বাভাবিক কাজ কর্ম শুরু করেছে ।
সেই সাথে ওর বন্দুক হাতে শিকারের নেশাটাও চলে গেছে একদম । অবশ্য না গেলেও অবনী তাকে আর এই কাজটা করতে দিতো না কোন দিন । সুস্থ হওয়ার পরে একদিনও ও বন্দুক হাতে নেওয়ার কথা মুখে আনে নি ।
রিসোর্টের বারান্দায় দাঁড়িয়ে অনেকটা সময় সে পেছনের পথটার দিকে তাকিয়ে রইলো । ও ভুলতে চাইলেও ওর মনে নূর আলীর চেহারাটা ভেসে উঠছিলো বারবার । নিজেকে সে এখনও ঠিক মত ক্ষমা করতে পারে নি । যতই দুর্ঘটনা কিংবা রাগের মাথায় কাজটা হয়ে থাকুক না কেন এই অপরাধবোধ থেকে কিছুতেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না । নিজেকে ক্ষমা করতে পারছে না ।
অবনী পাশে দাঁড়াতেই সাব্বির ওর দিকে ফিরে তাকালো । দূরে তখন সুর্য অস্ত যাচ্ছে । অবনী সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল,
-এখনও ভাবছো সেই কথা ?
-হুম ।
-এতো ভেবো না । যা হয়ে গেছে সেটা তুমি বদলাতে পারবে না । তাই না ?
আরও কিছু বলতে যাবে তখনই অবনীর নাম ধরে কেউ ডাক দিল ।
পেছনে তাকিয়ে দেখলো গনি মিয়া এগিয়ে আসছে । ওর দিকে তাকিয়ে বলল যে ওকে ম্যানেজার সাহেব ডাকছে । রিসোর্টের আরও কয়েকটা ঘর তৈরি হবে । সেটার ডিজাইন অবনী করেছে । সেটার ব্যাপারে কথা বলতে চায় একটু । অবনী সাব্বিরের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলো সে যেতে চায় কি না । সাব্বির বলল ও এখানেই কিছু সময় থাকতে চায় । ওকে আবারও বেশি চিন্তা না করতে বলে অবনী চলে গেল । সাব্বির দাঁঁড়িয়েই রইলো বারান্দাতে ।
হঠাৎ নিচের পথে একটু নড়াচড়া লক্ষ্য করলো সে । কৌতুহল থেকেই সামনে এগিয়ে গেল । এদিকটাতে কারোর আসার কথা না । পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল বেশ কিছুটা দূর । যতই এগিয়ে যাচ্ছে ততই বুঝতে পারছে কেউ যেন সামনে রয়েছে ।
আরও কিছুটা দূরে যেতেই সাব্বিরের বুকের ভেতরটা লাফিয়ে উঠলো । সামনে দাঁঁড়ানো মানুষটাকে সে ঠিকই চিনতে পেরেছে ।
বছর খানেক আগে যাকে সে এয়ারগান দিয়ে গুলি করে মেরে ফেলেছিল ।
সাব্বির নড়তে পারছে না । কেবল সন্ধ্যার আবছায়া অন্ধকারে সামনের কুঁঁজো মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে । মানুষটার চোখের কোটরে মনি বলে কিছু নেই । তবে সাব্বিরের মনে হল সেখানে তীব্র একটা রাগের আগুন জ্বলছে । সে আগুনে ও নিজে জ্বলে পুড়ে ছাড়খাড় হয়ে যাবে । এতো দিন ধরে সে অপেক্ষা করেছে । আজকে তার প্রতিশোধের দিন এসেছে ।
কেবল একটাই চিৎকার দিতে পারলো সাব্বির ।
তারপর সব শান্ত !
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১৯ রাত ১০:০৪