সরু গলিটার ভেতরে গাড়ি তিনটা দাঁড়িয়ে আছে কিছু সময় ধরে৷ ঘড়িতে দশটা বাজতে আরও কয়েক মিনিট বাকি আছে। এই সময়ে পুরান ঢাকার এই গলির মাঝে এরকম দামি তিনটা গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকা কিছুটা বেমানান।
তিনটা গাড়ির মাঝের গাড়িতে বসে আছেন আরমান এইচ আহমেদ। এদেশের একজন নাম করা শিল্পপতি। তার সময়ের দাম অনেক তারপরও তিনি এখানে বসে অপেক্ষা করছেন। কারন তাকে বলা হয়েছে ঘড়িতে ঠিক দশটা বাজলেই কেবল দরজায় কড়া নাড়তে৷ এক মিনিট আগেও নয়৷ দশটা বাজতে এখনো কয়েক মিনিট বাকি আছে। তাই তিনি অপেক্ষা করছেন।
আরমান আহমেদ আপন মনে হঠাৎ হেসে উঠলেন। শেষ কবে তিনি কারো জন্য অপেক্ষা করেছেন সেটা মনে করার চেষ্টা করলেন কিন্তু মনে করতে পারলেন। তার জন্য সবাই অপেক্ষা করে আর আজকে তিনি কিনা অপেক্ষা করছেন একটা পুরানো ভাঙ্গা বাড়ির সামনে, এক ভুতের ওঝার সাথে দেখা করার জন্য।
একবার মনে হল এসবের কোন মানে নেই। এখনই তিনি ড্রাইভারকে বলেন গাড়ি ঘুরিয়ে চলে যেতে কিন্তু পরক্ষণেই কিছু মনে পড়ে গেল তার৷ তিনি তার সর্ব শক্তি লাগিয়েছেন গত সাত দিনে। ফলাফল একেবারে শূন্য। তিনি কিছু চাইবেন আর সেটা হবে না, এমনটা এই দেশে হতেই পারে না। শিল্পপতির পরিচয়ের আড়ালে তার আরও একটা পরিচয় আছে। তার চোখের আড়ালে কিছু হতেই পারে না কখনো। আর সেই আরমান আহমেদ কিছু করতে পারেন নি। পারছেন না। ব্যাপারটা স্বাভাবিক না। তিনি এটা পরিস্কার বুঝতে পেরেছেন। নয়তো তিনি নিজেই সমাধান করে ফেলতেন।
-স্যার, সময় হয়েছে।
পিএস রাকিবের কথায় আরমান আহমেদ বাস্তবে ফিরে এলেন । নিজেই দরজা খুলে বাইরে বের হলেন । তাকিয়ে দেখলেন অন্য গাড়ি থেকেও মানুষজন নেমে পড়েছে । তিনি হাতের ইশারায় সবাইকে গাড়িতেই বসে থাকতে বললেন। এতো মানুষ নিয়ে বাড়ির ভেতরে ঢোকা যাবে না৷
আরমান আহমেদ নিজেই বাড়ির কড়া নাড়লেন। সাথে সাথেই দরজাটা খুলে গেল। তিনি কিছুটা সময় দ্বিধা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। মনে মনে ভাবলেন এটা কি কারো চাল হতে পারে? দেখা গেল বাসার ভেতরে কেউ পিস্তল নিয়ে অপেক্ষা করছে। তিনি ঢুকলেন আর গুলি করে দিল৷ অবশ্য এতে তিনি ভয় পান না। তার সাথে যা ঘটে গেছে তাতে এখন তার কিছুই যায় আসে না। তিনি খানিকটা মরিয়া৷ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে যাবেন, এমন সময় পেছন থেকে তার সিকিউরিটি অফিসার বলল,
-স্যার, এভাবে ঢুকবেন?
তিনি ফিরে তাকালেন। রাকিব তার পেছনেই আছে৷ তিনি বললেন,
-তোমরা বাইরে থাকো। আমার কিছু হবে না।
সিকিউরিটি অফিসার কিছু বলল না আর। বাইরে পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আরমান আহমেদ ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন।
পুরো ঘরটা অন্ধকার হয়ে আছে। তিনি কোন দিকে যাবেন সেটা প্রথমে বুঝতে পারলেন না৷ হঠাৎ তার মনে হলে কিছু যেন তার শরীরের ভেতরে দিয়ে চলে গেল । একটু কেঁপে উঠলেন তিনি । তারপর নিজের মনকেই শান্ত করলেন । পেছন থেকে তার পিএ রাকিব বলল,
-স্যার, ডান দিকে।
আরমান আহমেদ ডান দিকে তাকিয়ে দেখেন বেশ খানিকটা দূরে একটা চার কোনা আলো দেখা যাচ্ছে। একটু অবাক হলেন তিনি । বাইরে থেকে দেখে বাসাটা এতো বড় মনে হয় নি। কিন্তু ভেতরে বেশ বড় মনে হচ্ছে৷ সেদিকেই হাটা দিলেন তারা। তারপর যেন হুট করেই অন্ধকার থেকে আলোতে চলে এলেন ৷ আধুনিক এক ড্রয়িং রুমে। পুরো ঘরের চারিদিকে সোফা দিয়ে ভর্তি। বেশ দামি সোফা গুলো। মাঝে একটা বড় টি টেবিল। একটা চল্লিশ ইঞ্চি এলইডি টিভি দেওয়ালে সেট করা৷ আর একটা বই ভর্তি বুকসেলফ।
আরমান আহমেদ দেখতে পেলেন ডান দিকের সোফাতে একজন যুবক বয়সের ছেলে চোখ বন্ধ করে বসে আছে ৷ কানে ইয়ারফোন লাগানো। সম্ভবত গান শুনছে। আস্তে আস্তে মাথা নাড়ছে ।
ছেলেটার পরনে কালো জিন্সের সাথে কালো শার্ট । হাতা গুটানো । হাতে বেশ দামি একটা ঘড়ি দেখা যাচ্ছে । মুখে খোঁচাখোঁঁচা দাড়ি।
আরমান আহমেদ কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। এভাবে আগ বাড়িয়ে কথা বলার অভ্যাস তার নেই। মানুষই তার কাছে ছুটে আসে কথা বলার জন্য। তিনি কখনও কারো কাছে যান না। আর আজকে তাকে আসতে হয়েছে। তার কাছে সবার প্রয়োজন হয় । কিন্তু আজকে ঘটনা উল্টে গেছে । আজকে তার দরকার হয়েছে ।
হঠাৎ ছেলেটা চোখ বন্ধ করেই বলল
-দাঁঁড়িয়ে কেন মিস্টার আহমেদ! বসুন।
আরমান আহমেদ বসলেন । তারপর বললেন,
-আমি আসলে রাফায়েলের সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম ।
ছেলেটা এবার চোখ মেলে তাকালো। সরাসরি তাকালো তার দিকে৷ ছেলেটার চোখের দিকে তাকাতেই আরমান আহমেদ অনেক দিন পর একটু চমকে উঠলেন। তার জীবনে তিনি অনেক মানুষকে দেখেছেন। ভাল খারাপ আর ভয়ংকর অপরাধীর মুখোমুখি হয়েছেন, কিন্তু এতো তীক্ষ্ণ চোখ তিনি এর আগে দেখেননি৷
সামনে বসা ছেলেটা বলল,
-আমিই রাফায়েল। আপনি আমার সাথেই দেখা করতে এসেছেন।
নিজেকে সামলে নিলেন আরমান আহমেদ৷ তারপর যথাসম্ভব গম্ভীর গলায় বললেন,
-ইউ আর এ টাফ ম্যান টু ফাইন্ড।
-উহু। ভুল বললেন। আই এম ইম্পসিবল টু বি ফাউন্ড ইফ আই ডোন্ট ওয়ান্ট । কেন, চেষ্টা করেন নি?
আরমান আহমেদ একটু চমকালেন। রাফায়েলের খোজ তিনি যখন পান তখনই তার সাথে দেখা করার ব্যবস্থা করতে বলেন। কিন্তু তার পিএ জানায় যে রাফায়েল নামের মানুষটা কারো বাসায় গিয়ে দেখা করে না। তাকে আসলে নিজেই যেতে হবে। কথাটা শুনে তার মাথায় আগুন ধরে গিয়েছিল। বেশ কিছু মানুষ পাঠিয়েছিলেন রাফায়েলকে ধরে নিয়ে আসার জন্য। অদ্ভুতভাবে সেই মানুষ গুলো আর ফিরে আসে নি। কোথায় হারিয়ে গেছে কেউ বলতেও পারে না৷
আরমান আহমেদ বললেন,
-দেখুন, যা হওয়ার , হয়েছে। আমি নিজের দরকারে এখানে এসেছি৷ আপনার কথা আমি শুনেছি অনেক।
-আমিও আপনার কথা শুনেছি। এখন বলেন কি সাহায্য করতে পারি?
আরমান আহমেদ একটু দম নিলেন। তারপর বললেন,
-কদিন আগে আমার বাসায় হামলার কথাটা তো শুনেছেনই। সব টিভি আর পত্রিকার হট নিউজ।
রাফায়েল বলল
-হ্যা, খানিকটা শুনেছি। আপনার দুজন সিকিউরিটি অফিসারকে কেউ মেরে ফেলেছে।
-হ্যা। আমি খুনিকে চাই।
-সেটার জন্য তো পুলিশ আছে। তারা ইনভেস্টিগেশন করছে ৷ আমার কাছে কেন?
-খুন গুলো ঠিক স্বাভাবিকভাবে হয় নি। এটা পুলিশ বের করতে পারবে না। আমি নিজের মত করে চেষ্টা করেছি কিন্তু আমিও কিছু বের করতে পারি নি। খুবই অবাক হওয়ার মত ব্যাপার । আমি কাউকে চাইলেই খুঁঁজে ফেলতে পারি । অন্তত আমার এই ক্ষমতাটুকু আছে । কিন্তু আমি কিছুই করতে পারি নি ।
রাফায়েল একটু হাসলো। তারপর বলল,
-ঠিকই বলেছেন৷ একজন আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডনের জন্য এটা অবাক হওয়ার মতই ঘটনা৷ পুলিশের থেকেও আপনার নেটওয়ার্ক স্ট্রং বেশি ৷ আর কার এতো বড় সাহস যে আপনার বাসায় ঢুকে আপনার গার্ডকে খুন করে আপনার মেয়েকে তুলে নিয়ে যাবে!!
আরমান আহমেদ এবার ছোট খাটো ধাক্কার মত খেলেন । তার গার্ডকে খুন করা হয়েছে এটা সবাই জানে কিন্তু নিনিনকে ধরে নিয়ে গেছে এই ব্যাপারটা খুব কম মানুষ জানে। অন্ততপক্ষে সামনের এই মানুষটার পক্ষে কিছুতেই জানা সম্ভব নয়। কিন্তু সামনে বসা এই মানুষটা সব জানে ! কিভাবে জানে সেটা আরমান আহমেদ বলতে পারবে না তবে জানে। আরমান আহমেদের হঠাৎ একটা অদ্ভুত অনুভূতি হল । তার মনে হল নিনিনকে এই মানুষটাই ফিরিয়ে আনতে পারবে। আরও আগে তার এখানে আসা দরকার ছিল৷
আরমান আহমেদ যখন বাসায় ফিরে এলেন তখন তাকে অনেকটাই ক্লান্ত দেখাচ্ছে । তিনি এতোদিন নিজেকে এই দেশের সব থেকে শক্তিশালী মানুষদের একজন মনে করতেন । তিনি ভাবতেন তার কারোর সাহায্যের দরকার নেই । বরং তিনিই সবাইকে সাহায্য করবেন । কিন্তু আজকে বুঝতে পেরেছেন যে মাঝে মাঝে এমন কিছু পরিস্থিতিতে পড়তে হয় যখন মানুষ খুব অসহায় বোধ করে । আজকে তিনি ঠিক সেই রকমই অনুভব করছেন ।
তার কাছে তার বাসাটা সব থেকে বেশি সুরক্ষিত জায়গা ছিল । তার বিশ্বাস ছিল তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে সেখানে কেউ ঢুকতে পারবে না । এমন কি ছোটখাটো একটা আর্মিকে তিনি ঘন্টা খানেকের বেশি সময় আটকে রাখতে পারবেন, এমন ভাবেই তার বাসাটা তৈরি করা হয়েছিলো । কিন্তু সেই বাসাতেই কেউ ঢুকে পড়েছে । এবং তার দুজন সিকিউরিটি অফিসারকে খুন করে তার মেয়েকে তুলে নিয়ে গেছে । কেউ টের পর্যন্ত পায় নি । এবং ঘটনা গুলো কিভাবে ঘটেছে সেটা তিনি নিজে জানেনও । নিজের চোখেই সব দেখেছেন, কিন্তু সেটা বিশ্বাস করতে পারেন নি ।
রাফায়েল নামের মানুষটা তখন তাকে অবাক করে দিয়েছে । তার সামনে তিনি সব কিছু স্বীকার করেও নিয়েছেন । অস্বীকার করার মত কিছু ছিলও না ।
তার পুরো বাসাটাই সিসিটিভি ক্যামেরার আওতাভুক্ত । কেবল মাত্র ব্যক্তিগত রুমগুলো ছাড়া আর সব কিছুর উপর চোখ রাখা হয় । সেই সিসিটিভি ক্যামেরাতে ধরা পড়েছে যে রাত তিনটার সময় বাড়ির ডান দিকে হঠাৎ করেই একটা গোল বৃত্ত তৈরি হল । বৃত্তটা যেন শূন্য থেকে সেখানে হাজির হল । আগুনের বৃত্ত । আরমান আহমেদ যখন প্রথমবার ফুটেজটা দেখলেন, তিনি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন । কিছুতেই তার বিশ্বাস হচ্ছিলো না যে এমন কিছু সত্যি সত্যিই হতে পারে । পৃথিবীতে অনেক ব্যাখ্যাতীত ব্যাপার ঘটে সেটা তিনি খুব ভাল করে জানেন । সব কিছুর ব্যাখ্যা সব সময় পাওয়া যায় না কিন্তু তাই বলে চোখের সামনে এই জিনিস তিনি দেখবেন সেটা কোনদিন আশা করেননি ।
বৃত্তটা মোটামুটি মানুষের মত বড় হল । তারপরই সেখান থেকে প্রথমে একটা মানুষ বের হয়ে এল । অন্তত মানুষের আকৃতির একজন । পুরো শরীর কালো আলখেল্লা দিয়ে ঢাকা, এমন কি মাথাটাও একটা কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা । সামনে একটু ফাঁক অবশ্য আছে তবে সেটা দিয়ে লোকটার চেহারা বোঝা যাচ্ছে না । লোকটার ঠিক পেছন পেছন দুইটা কুকুর জাতীয় প্রাণী বের হয়ে এল । তবে সাধারন কুকুরের চেয়ে এই কুকুরগুলো আকারে অনেক বড় । মানুষটার শরীরের প্রায় অর্ধেক । কুকুর দুইটার মুখ খানিকটা বাঘের মত আকৃতির তবে আরও কিছুটা বিকৃত । চেহারাতে কোন নাক নেই আর ঠিক মাঝ বরাবর একটা চোখ । সেটাও টকটকে লাল । আরমান সাহেব এমন কোন প্রাণীর কথা জীবনেও শোনেন নি । এমন কি কোন গল্প উপন্যাসেও না ।
দেখা গেল প্রাণী দুইটাসহ লোকটা অতি দ্রুত চলাফেরা করছে । হাটতে হাটতে একেবারে বাড়ির কাছে চলে এল । সেখানে হঠাৎ করেই এক গার্ডের সাথে তাদের দেখা হয়ে গেল । গার্ড বন্দুক উঠিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনই চোখের সামনে এক অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেল । বাঁ দিকের কুকুরের মত প্রাণীটার মুখ থেকে লম্বা কিছু একটা বের হয়ে এল এবং সেটা সরাসরি গার্ডের বুক বরাবর ভেদ করে চলে গেল । গার্ড টু শব্দটি পর্যন্ত করতে পারলো না । তারপর আর কিছু দেখা যায় নি । বারান্দায় তার সিকিউরিটির সেকেন্ড ইন চিফ জসিমকে পড়ে থাকতে দেখা গেল সকাল বেলা । এবং তার মেয়ে ঘরে ছিল না ।
ফুটেজ টুকু রাফায়েল খুব মনযোগ দিয়ে দেখলো । তারপর আরমান সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল,
-আপনার শত্রুর হাত দেখি অনেক লম্বা !
-মানে ?
-মানে হচ্ছে এই যে প্রাণীটা দেখতে পাচ্ছেন এটা এই পৃথিবীর কোন প্রাণী না ।
আরমান আহমেদ কি বলবেন ঠিক বুঝতে পারলেন না । এই জিনিস যে স্বাভাবিক কোন ব্যাপার না সেটা তিনি খুব ভাল করেই জানেন । কিন্তু তাই বলে এমন কিছু তিনি আশা করেন নি । রাফায়েল বলল, এখন কালো জাদু করাটা বেশ সহজ একটা ব্যাপার । এই ব্যাপারে প্রচুর গবেষণা হয়েছে, অনেক ম্যাটেরিয়াল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারিপাশে । যে কেউ চাইলেই আপনার উপর কালো যাদু করতে পারবে । অন্য কোন জগত থেকে যে কোন প্রাণী ডেকে আনতে পারবে নিজের প্রয়োজনের জন্য ।
আরমান আহমেদ বললেন,
-তাহলে যে বললেন আমার শত্রুর হাত অনেক লম্বা !
-হ্যা । এখন যে কেউ চাইলেই কুকুর বেড়াল পুষতে পারে । কোন বড় ব্যাপার না । কিন্তু যদি দেখেন কেউ আফ্রিকান সাদা সিংহ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তখন ব্যাপারটা আপনার কাছে কেমন লাগবে ?
আরমান আহমেদ চুপ করে রইলেন । রাফায়েল বলল,
-খুব শক্তিশালী কেউ আপনার মেয়েকে নিয়ে গেছে । কেন নিয়ে গেছে সেটার ব্যাপার এখনও আমার পরিস্কার ধারনা নেই । আপনি এক কাজ করুন গত এক দেড় মাসে আপনার কিংবা আপনার মেয়ের সাথে অস্বাভাবিক যা যা হয়েছে তার একটা লিস্ট আমাকে দেন । এমন সব মানুষের নাম আমি চাই যাদের সাথে আপনার ঝামেলা হয়েছে সম্প্রতি । আগে সম্প্রতি দিয়ে শুরু করি । পরে অন্য কিছু দেখা যাবে !
রাফায়েল নামের মানুষটা ওকে যেন হুকুম করছে । আরমান আহমেদ বেশ খানিকটা সময় ধরে অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে রইলেন । তিনি এমন হুকুম শুনতে কিংবা কারো কাছ থেকে এমন কথা শুনতে অভ্যস্ত নন । সবাই তার কাছে এসে অনুরোধ করে । এমন কি ক্ষমতাসীন দলের প্রধানও তার সাথে মোলায়েম কন্ঠে কথা বলে । আর এই ছেলে কি না তাকে হুকুম করছে !
হঠাৎ রাফায়েল বলল, আরমান সাহেব, আমি মানুষের ক্ষতি করি না । কিন্তু কেউ যদি বিনা কারনে আমাকে তার শক্তি দেখাতে যায়, আমার পেছনে লাগে তাকে আমি ছেড়েও দেই না । দয়া করে অন্য চিন্তা , ইগো মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলুন আপাতত ! আগে নিনিনকে খুজে বের করি তারপর না হয় আবার লোক পাঠাবেন আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য ! ঠিক আছে ? এখন যা বলছি তাই করুন । গত এক মাসের আপনার বাসার সব সিসিটিভি ফুটেজ আমাকে পাঠাবেন । আর ঐ লিস্টটা ! ঠিক আছে !
আরমান আহমেদ আবারও খানিকটা অবাক হয়ে গেলেন । তিনি মনের মাঝে কি ভাবছিলেন সেটাও এই ছেলে টের পেয়ে গেছে । কিভাবে পেল কে জানে ! তার সাথে যা হচ্ছে সেসব চিন্তা করলে সবই এখন বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় । তিনি কেবল মাথা নাড়লেন । তারপর দেখলেন রাফায়েল আবারও কানে হেডফোন গুজে দিয়েছে । চোখ বন্ধ করে ফেলেছে । তার মানে হচ্ছে কথাবার্তা আপাতত এখানেই শেষ । তিনি খানিকক্ষণ ইতস্তত করে উঠে দাড়ালেন । তারপর যেদিক থেকে এসেছিলেন সেদিকেই হাটা দিলেন ।
তিন দিন হয়ে গেছে কিন্তু পুলিশ কোন খবর বের করতে পারে নি । পারবে না সেটা আরমান আহমেদ আগেই জানতেন । তিনি এখনও নিজের মত করেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে । তার শত্রুদের তালিকাটা তিনি আবারও খুঁঁজে দেখেছেন । সম্ভাভাব্য সবাইকে ধরে এনে জানতে চেয়েছেন । কেউ স্বীকার করে নি । তিনি জানেন এদের কেউ কাজটা করে নি । তাহলে কে করেছে? তিনি খুঁঁজে পাচ্ছেন না । নিজেকে তার খুব বেশি অসহায় লাগছে ! বারবার নিজের মেয়ের মুখটা ভেসে উঠছে । মেয়েটা এখন কোথায় আছে কে জানে ! কি করছে ! কিভাবে আছে !
-স্যার !
রাকিবের কন্ঠস্বর শুনে তিনি চোখ মেলে তাকালেন ।
-বল !
-স্যার রাফায়েল এসেছে ।
-হ্যা ? কে ? রাফায়েল?
-জি স্যার । আপনার স্টাডি রুমে বসে আছে।
আরমান সাহেব কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তবে থেমে গেলেন । তার স্টাডি রুমে কারো ঢোকার অনুমতি নেই । কিন্তু এই ছেলে কিভাবে সেখানে ঢুকে বসে আছে ! রাকিব হয়তো তাকে বাঁধা দিতে পারে নি । তিনি আস্তে আস্তে উঠে দাড়ালেন । রাফায়েল নিশ্চয়ই কিছু খুঁঁজে পেয়েছে । তিনি নিজের স্টাডি রুমের দিকে দ্রুত এগিয়ে গেলেন ।
আরমান আহমেদ নিজের স্টাডি রুমে গিয়ে দেখলেন রাফায়েল নামের মানুষটা সেখানে খুব আরাম করে বসে আছে । এতোটা আরাম করে তিনি নিজে কোন দিন এখানে বসেছেন কি না সেটা মনে করতে পারলেন না । অন্য কেউ হলে হয়তো তিনি খুব রেগে যেতেন । কিন্তু এই ছেলেটাকে তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না । কিছু বলতেও পারছেন না ।
আরমান সাহেবকে ঘরে ঢুকতে দেখেই রাফায়েল বলল, আসুন !
নিজের ঘরে নিজেকেই কেউ স্বাগতম জানাচ্ছে । ব্যাপারটা আরমান সাহেবের কাছে খানিকটা হাস্যকরই মনে হল । তবে তিনি চিন্তাটা মাথা থেকে দুর করে দিলেন । এখন এই সমস্ত ছোটখাটো ব্যাপার ভাবার সময় না । তিনি দেখলেন তার কাজ করার টেবিলের উপর একটা ল্যাপটপ খোলা অবস্থায় পড়ে আছে । সেখানে একটা ভিডিও পজ করে রাখা ।
আরমান আহমেদ পাশে পেতে রাখা চেয়ারেই গিয়ে বসলেন । রাফায়েল সামনের ল্যাপটপটা চালু করে দিল । আরমান আহমেদ সেদিকে তাকিয়ে রইলেন । তার বাসার সামনের গেটের ফুটেজ । সেখানে দেখা যাচ্ছে একটা কম বয়সী ছেলে তার গার্ডদের সাথে কথা বলছে । এক পর্যায়ে একজন তার সিকিউরিটির সেকেন্ড ইন চিফ জসিম বেরিয়ে এল দরজা দিয়ে । কিছু কথা বলে তারপর ছেলেটাকে একটা ধাক্কা দিয়ে রাস্তার উপর ফেলে দিল । হাত উঠিয়ে কিছু বলল । তারপর একজন গার্ড তাকে প্রায়ই টেনেই নিয়ে গেল । একসময় তারা সিসিটিভি ফুটেজের আওতার বাইরে চলে গেল ।
ভিডিও এখানেই শেষ ।
আরমান আহমেদ কি বলবেন বুঝতে পারলেন না । রাফায়েল বলল, আমি বলেছিলাম গত এক মাসে অস্বাভাবিক কিছু হয়েছে কি না সেটা আমাকে জানাতে । এইটা আপনাদের চোখ পড়ে নি ?
আরমান আহমেদ বলল, আমি তো নিজেই বুঝতে পারছি না ।
রাফায়েল বলল, এটা ঠিক ১১ দিন আগের ঘটনা । আপনার বাসার সামনেই ঘটেছে ।
-এই ছেলেটা কে সেটাও জানি না । এই খবর আমার কাছে পৌছায় নি । আচ্ছা আমি খবর নিচ্ছি ।
তিনি রাকিবকে ডাক দিল । রাকিব সব সময় তার আশে পাশেই থাকে । তাকে ডাকার প্রায় সাথে সাথেই সে সামনে এসে হাজির ।
-এই ছেলেটা কে? আমাকে এটার ব্যাপারে জানানো হয় নি কেন ?
রাকিব ভিডিওটার দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে বলল, স্যার আসলে তেমন কিছু না । ছেলেটা নিনিন ম্যামের সাথে পড়ে ।
-এখানে কি চায় সে ?
-ইয়ে মানে, স্যার, সে বাসায় আসতে চাইছিলো । নিনিন ম্যাডাম জসিমকে বলে দিয়েছিলেন যে ছেলেটাকে যেন বাসায় ঢুকতে না দেওয়া হয় । ছেলেটা নাকি তাকে জ্বালাতন করছে বেশ কিছু দিন ধরে । এমন কোন বড় কিছু নয় ।
রাফায়েল হঠাৎ বলল, আপনাদেের বাসার পেছনের দিকে একটা এটিএম বুথ আছে । সেটাতে যে সিসিটিভি ফুটেজ আছে সেটা আমার একটু দরকার । ছেলেটা যেদিন এসেছিলো সেই দিনের পরের সাত দিনের ফুটেজ । জোগাড় করুন !
আরমান আহমেদ আবারও লক্ষ্য করলেন রাফায়েল নামের ছেলেটা ওর কাছে কোন অনুরোধ করছে না । কেমন যেন ডিমান্ড করছে । এই ব্যাপারটা তার মোটেই পছন্দ হচ্ছে না । কিন্তু তিনি মুখ বুঝে সহ্য করে নিলেন । কারন সহ্য করা ছাড়া আসলে কিছুই করার নেই তার !
এটিএম বুথের সিসিটিভি ফুটেজ আসতে খুব বেশি সময় লাগলো না । রাফায়েল সেটা গভীর মনযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করলো । ঐ ঘটনার তিন দিনের দিনই সেই ছেলেটাকে আবার দেখা গেল । ছেলেটা এবার আর সদর দরজার দিকে যায় নি । পেছনের এই রাস্তায় বেশ কিছু সময় ঘোরাঘুরি করলো । তারপর হঠাৎ নিজের পকেট থেকে কিছু বের করলো । আরমান আহমেদ অবাক হয়ে দেখলেন! ছেলেটা তারপর সেটা দেওয়ালের উপর দিয়ে বাড়ির ভেতরে ছুড়ে মারলো । একই কাজ সে আরও দুইবার করলো !
আরমান আহমেদের মুখ দিয়ে আপনা আপনিই বের হয়ে এল, বদমাইশটা করছেটা কি !
রাফায়েল সেই প্রশ্নের জবাব দিল না । স্টাডি রুম থেকে সে বের হয়ে গেল । আধা ঘন্টা পরে ফিরে এল আবার । আরমান আহমেদ দেখলেন তার টেবিলের উপর রাফায়েল ছোট ছোট তিনটা হাড় জাতীয় কিছু রাখলো !
আরমান আহমেদ বললেন, কি এসব ?
-এসব হচ্ছে প্যাঁচার হাড় !
-মানে ?
-মানে হচ্ছে ঐ ছেলেটা আপনার বাসায় এই হাড়গুলো ছুড়ে দিয়েছে ।
-কেন ? মানুষ গ্রেনেড ছুড়ে দিতে পারে ! সেটাও একটা কথা কিন্তু শুকনো প্যাঁচার হাড় কেন ছুড়ে ফেলবে !
-মিস্টার আরমান আহমেদ, গ্রেনেড থেকে কম ভয়ংকর নয় এই হাড় গুলো !
-আমি ঠিক বুঝলাম না !
রাফায়েল কিছু সময় চুপ করে থাকলো । তারপর বলল, মনে করুন আপনি নদীর ওপারে যেতে যান, তাহলে চাইলেই কি সেখানে গিয়ে হাজির হতে পারবেন ?
আরমান আহমেদ আগেও লক্ষ্য করেছেন যে রাফায়েল নামের এই মানুষটা বেশ হেয়ালি করে কথা বলে । রাফায়েল বলল, ওপাশে যেতে হলে আপনাকে হয় নৌকা নয়তো একটা ব্রীজ তৈরি করতে হবে । আপনার সিসিটিভি ফুটেজে গোল গোল বৃত্তের মত যেটা দেখেছেন সেটাও খানিকটা এই ব্রীজের মত । এমন বেশ কিছু মানুষ আছে যারা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে এই ব্রীজের মাধ্যমে যেতে পারে !
আরমান আহমেদ বলল, তাহলে সে যে কোন স্থানেই নিমিষের ভেতরে চলে যেতে পারবে ?
রাফায়েল হাসলো । তারপর বলল, এখানেই কিন্তু আছে । এমন ক্ষমতা কোন মানুষের থাকতে পারে না । চাইলেই যে কোন স্থানে সে যেতে পারবে না । কেবল সেই সমস্ত স্থানেই সে যেতে পারবে যেখানে এই ব্রীজ তৈরি করতে পারবে । আর ব্রীজ তৈরি করতে হল আগে থেকেই সেই স্থানে তার কোন খুটি স্থাপন করা লাগবে যার সাথে সে এই পাড়ের সংযোগ করতে পারবে !
আরমান আহমেদ ব্যাপারটা একটু একটু যেন বুঝতে পারছেন । বললেন, তার মানে কেউ যদি এই ভাবে এখান থেকে আমেরিকা যেতে চায় তাহলে আগে আমেরিকাতে তার সেই খুটি স্থাপন করতে হবে ?
রাফায়েল আবারও হাসলো । তারপর বলল, এই তো বুঝেছেন । আর এই তিনটা হাড় দেখছেন এই গুলোই হচ্ছে সেই খুটি ! ঐ ছেলে এখানে এই হাড়গুলো ফেলে গেছে । তারপর রাতে এখানে এসে হাজির হয়েছে !
তার মানে কি ঐ ছেলেই এই কাজটা করেছে ?
রাফায়েল একটু ভাবলো । তারপর বলল, এটার সম্ভাবনা কম । আমার যতদুর মনে হচ্ছে সেই ছেলেই আপনার মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পেছনে আছে । তবে ঐ কালো আলখেল্লা পরা লোকটা সে নয় । ছেলেটা হয়তো অন্য কাউকে ঠিক করেছে এই কাজটা করার জন্য । মানুষ যেমন গুন্ডা ভাড়া করে তেমনি এরকম মানুষ ভাড়া পাওয়া যায় যারা অর্থ কিংবা অন্য কোন কিছুর বিনিময়ে এমন কাজ করে থাকে । এই ছেলেকে খুঁজে বের করুন । আপনার মেয়েকেও পেয়ে যাবেন !
আরমান আহমেদ কিছু সময় চুপ করে রইলেন । রাফায়েল বলল, ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক । আছে না কিছু পাগল প্রেমিক যারা তার ভালবাসার মানুষকে পাওয়ার জন্য যেকোন কিছু করতে রাজি ! এই ছেলেও সম্ভবত সেরকমই । কিন্তু নিনিনকে স্বাভাবিক ভাবে কিডন্যাপ করার ক্ষমতা এর ছিল না । এর কেন, কারোই ছিল না । এই জন্য এই পথ বেছে নিয়েছে ।
আরমান আহমেদের কাছেও এই একটা ব্যাপারই মনে হচ্ছিলো । নিনিনকে কিডন্যাপ করার সাহস এই দেশে কারোরই নেই । সেই ছেলে চাইলেই এটা করতে পারতো না । এই জন্য ঐ অতিপ্রাকৃত পথ গ্রহন করেছে সে ! তার মুখটা শক্ত হয়ে এল !
রাফায়েল আরও কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল, আমার কাজ মোটামুটি শেষ । আমার আর কিছু করার নেই । ভাল থাকুন ! আর এর পর থেকে আমার সাথে দেখা করতে হলে দয়া করে অন্য কাউকে না পাঠিয়ে নিজে গিয়ে হাজির হবেন । ঠিক আছে !
আরমান আহমেদ ভেবেছিলো হয়তো এবার রাফায়েল তার কাছে তার পাওনা দাবি করবে কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে সে দরজার দিকে হাটা দিলো । একটাবার ফিরেও তাকালো না আর ! ছেলেটা আসলেই অদ্ভুত । মনে মনে একটু শান্তি পাচ্ছেন তিনি । সেই সাথে এই ছেলের উপর তার রাগটা আস্তে আস্তে বাড়ছে ।
রাকিবকে কিছু বলতে হলনা । সে আগে থেকেই খোঁঁজ খবর নেওয়া শুরু করে দিয়েছে । সন্ধ্যার আগেই ছেলেটার সব খবর বের হয়ে গেল । ছেলেটার নাম আকিব আহসান । নিনিনের সাথেই পড়াশুনা করে । নিনিন একটা সময়ে ছেলেটার সাথে নাকি বেশ মেলামেশা করেছে । তারপর হঠাৎ করে তাদের মাঝে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায় । এরপর থেকেই নাকি আকিব বেশ পাগলাটে আচরন শুরু করে । সারাদিন নিনিন নিনিন করতে শুরু করে । ছেলেটা ঝিগাতলায় থাকে । ছয়তলা একটা বাসার চিলেকোঠায় একটা রুম নিয়ে থাকে ।
আরমান আহমেদ ঠিক করলেন তিনি নিজে সেখানে গিয়ে হাজির হবেন । নিজ হাতে ছেলেটাকে ধরে আনবেন ।
রাতের বেলাতেই সেই বাড়ির সামনে গিয়ে হাজির হলেন তিনি । বাড়ির মালিককে ডেকে এনে পরিচয় দিতে না দিতেই তার অবস্থা খারাপ হয়ে গেল । তাকে বলা হল যে কেবল চিলেকোঠায় যেতে চায় তারা । আর কোন কিছু না ।
আরমান আহমেদ আরো চারজন গার্ডসহ সিড়ি দিয়ে উপরে উঠে গেলেন । সবাই চিলকোঠার সামনে এসে দাঁড়ালো । দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ । জোড়ে একটা দম নিয়ে তিনি বাড়িওয়ালাকে নির্দেশ দিলেন দরজা ধাক্কা দেওয়ার । সে তাই করলো । কিন্তু বেশ কয়েকবার ধাক্কা দেওয়ার পরেও ওপাশ থেকে কোন সাড়া শব্দ পাওয়া গেল না ।
চারজন বডিগার্ডের একজন আরমান আহমেদের দিকে তাকালো । তিনি চোখের ইশারাতে নির্দেশ দিলেন । বাড়িওয়ালাকে এক পাশে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হল । তারপর সর্বশক্তি দিয়ে গার্ডটা দরজায় লাথি মারলো । খুব বেশি সময় লাগলো না লকটা ভেঙ্গে পরতে । দরজাটা খুলতেই একটা তীব্র কটু গন্ধ এসে লাগলো সবার নাকে !
আরমান আহমেদ এই গন্ধটা চেনেন । সাথে সাথেই তার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো । নাকে হাত চেপে তিনি ঘরের ভেতরে প্রবেশ করলেন । ঘরটা অন্ধকার । একজন গার্ড সুইট বোর্ড খুঁঁজে আলো জ্বালিয়ে দিল। আরমান আহমেদ তাকিয়ে দেখলেন বিছানার উপর একটা মানুষ পড়ে আছে । মৃত । অন্তত দুই দিন আগেই তার মৃত্যু হয়েছে ।
একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তিনি । লাশটা নিনিনের নয় । মানুষ পঁচা গন্ধ তার চেনা । ভেবেছিলেন হয়তো তার মেয়েকেই মেরে এখানে ফেলে রাখা হয়েছে । তাই তিনি ভয় পেয়েছিলেন । তবে সেটা না দেখে স্বস্তি পেলেন খানিকটা ।
আরমান আহমেদ লাশের দিকে ভাল করে তাকিয়ে বুঝতে পারলেন যে এটা আকিবের দেহ !
আকিব যদি এখানে মরে পড়ে থাকে তাহলে তার মেয়ে কোথায় ?
আবারও সেই কানা গলিতে এসে পড়েলেন তিনি !
আরমান আহমেদ খানিকটা বিচলিত বোধ করছেন। তার মেয়ে আজকে হারিয়ে গেছে পনের দিন পার হয়ে গেল, অথচ তিনি কিছুই করতে পারছেন না। এতো ক্ষমতা তার, কিন্তু আজকে তিনি কতটা অসহায়বোধ করছেন। কিছুই করতে পারছেন না।
অবশ্য আজকে তার বিচলিত বোধ করার কারন ভিন্ন। আজকে তিনি বসে আছেন আকিবের ঘরে। কদিন আগেই এখানে আকিবের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। লাশের অবস্থা বেশ খারাপ ছিল। পচন ধরে তীব্র গন্ধ ছড়াতে শুরু করেছিল। আর আকিবের লাশের শরীরেও সেই একই গর্ত দেখা গিয়েছিল যেমনটা তার গার্ডের শরীরে ছিল৷ বুঝতে কষ্ট হয় না যে এদের মৃত্যুর জন্য একজনই দায়ী৷
আরমান সাহেব নিজেই আবার ছুটে গিয়েছিলেন রাফায়েলের কাছে। রাফায়েল বেশ কিছু সময় গম্ভীর মুখে বসে থেকে বলল, তার মানে আমার ধারনা সঠিক। আকিব এর সাথে জড়িত। হয়তো এমন হতে পারে যে আকিব নিনিনকে নিয়ে যাওয়ার জন্য কাউকে ঠিক করেছিল, লোকটা নিয়েও গিয়েছিল, কিন্তু তারপর এমন কিছু হয়েছে যেখানে লোকটা নিনিনকে ফেরত দিতে চায় নি। এটা আকিবের পছন্দ হয় নি। তাই তাকেও রাস্তা থেকে সরিয়ে দিয়েছে।
আরমান আহমেদ বললেন, এখন তাহলে কি করবো? আমার মেয়েটা কোথায় আছে, কে জানে? প্লিজ হেল্প মি।
আরমান আহমেদ সেদিন আর কোন ক্ষমতাবান ডন ছিলেন না, তিনি হয়ে গিয়েছিলেন অসহায় একজন পিতা যার মেয়েকে কেউ ধরে নিয়ে গেছে। রাফায়েল তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, সবার আগে আমাদের জানতে হবে যে আকিব কি জানে আর কাকে সে ঠিক করেছিল নিনিনকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য !
আরমান আহমেদ বলল, এটা কিভাবে সম্ভব হবে?
ঠিক সেই কাজটা করার জন্যই আজকে তারা এখানে এসে হাজির হয়েছে। এই আকিবের ঘরে৷ আকিবের ঘরের জিনিসপত্রগুলো সব আগের মতই আছে। পুলিশ কেবল লাশটা নিয়ে গিয়েছে। মেঝেটা ভাল করে পরিস্কার করা হয়েছে। ঘরে আপাতত কোন গন্ধ নেই। তবুও আরমান আহমেদের খানিকটা অস্বস্তি লাগছে। তিনি মেঝেতে আরাম করে বসেছেনন । তার ঠিক সামনেই রাফায়েল বসে আছে চোখ বন্ধ করে। রাফায়েলের হাতে একটা ক্যালকুলেটর ধরা। এটা আকিবের ক্যালকুলেটর। ওর টেবিল থেকে নেওয়া।
আরমান সাহেব চুপচাপ বসে আছে। একটা সময় তিনি হঠাৎ লক্ষ্য করলেন ঘরের আবহাওয়া একটু একটু যেন ঠান্ডা হচ্ছে। আরমান আহমেদ স্যুট পরে আছেন তবুও তার কেমন যেন শীত শীত করতে লাগলো। তারপর তার চোখ জুড়ে ঘুম আসতে লাগলো। তিনি অবাক হয়ে লক্ষ্য করতে শুরু করলেন যে তিনি চাইলেও আর জেগে থাকতে পারছেন না।
সত্যি সত্যিই তিনি ঘুমিয়ে গেলেন। কিন্তু সাথে সাথেই জেগে উঠলেন। এবং ঠিক তখনি জীবনের সব থেকে বড় বিস্ময়ের ঘটনাটা দেখতে পেলেন।
তিনি দেখতে পেলেন যে চিলেকোঠার ঐ মেঝেতে তিনি ঢলে পরেছেন ঘুমে। নিজেকে মেঝেতে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে তিনি সত্যিই অবাক হয়ে গেলেন। নিজের দিকে তাকালেন আরেকবার! তার হাত পা সবই তো দেখা যাচ্ছে। কি হচ্ছে এসব!
আরমান আহমেদ মেঝেতে শুয়ে থাকা নিজের শরীরে হাত দিতে যাবেন তার আগেই পেছন থেকে কেউ তার কাধ চেপে ধরলো।
খানিকটা চমকে গেলেন তিনি। রাফায়েল!
কিন্তু রাফায়েলও মেঝেতে চোখ বন্ধ করে বসে আছে!
-ভয় পাবেন না। আমরা মারা যাই নি। এমন কি আমাদের আত্মাও শরীর থেকে বের হয় নি।
আরমান আহমেদ বিস্ময়ভরা কন্ঠে বললেন, তাহলে আমরা কিভাবে এখানে আছি আর ওরাই বা কারা?
-এতো কিছু এখন বোঝানোর উপায় নেই। কেবল জেনে রাখুন যে আমরা একটা বিশেষ স্থানে আছি। এই স্থানটা এমন একটা স্থান যেখানে পৃথিবীর সব স্মৃতি জমা থাকে। দুনিয়াতে যত সব ঘটনা ঘটেছে সব এখানে জমা হচ্ছে আস্তে আস্তে। আমরা এখানে এসেছি আকিবের স্মৃতি দেখতে৷ আসুন আমার সাথে।
আরমান আহমেদ রাফায়েলের শরীরে স্পর্শ করলেন, সাথে সাথেই তিনি দেখলেন যে তারা হাজির হয়ে গেছে তার বাসার সামনে। আকিবকে দেখতে পেলেন তিনি। তার সিকিউরিটি গার্ড জসিমকেও দেখতে পেলেন। জসিম আকিবকে একটা ধাক্কা দিল। আকিব মাটিতে পড়ে গেল।
এই দৃশ্য তিনি আগেই দেখেছেন সিসিটিভি ফুটেজে। আকিব মাটিতেই পড়ে রইলো কিছু সময়। জসিমের কন্ঠস্বর শোনা গেল । জসিম বলল, হারামির পো, আবার যদি এইখানে দেখি একেবারে খুন করে ফেলবো।
আকিব উঠে দাঁঁড়ালো৷ তারপর মাথা নিচু করে হাটতে হাটতে চলে গেল৷ আরমান সাহেব দেখলেন যে তারাও আকিবের পেছন পেছন যাচ্ছেন । তাদের ঠিক হাটা লাগছে না। যেন ভেসে ভেসে যাচ্ছেন দুজনে।
আরমান আহমেদ বললেন, আপনি বলছেন এই জগৎটাতে সবার স্মৃতি জমা থাকে। তাহলে এতো স্মৃতির মাঝে আমরা স্পেসিফিক এই আকিবের স্মৃতি কিভাবে খুঁঁজে পাচ্ছি ?
রাফায়েল বলল, কারন আমার হাতে আকিবের ক্যালকুলেটরটা ধরা আছে। এটা আকিবের ব্যবহার্য জিনিস।
-তাহলে তো আমরা নিনিনের কোন জিনিস ধরে তার স্মৃতি লক্ষ্য করে বের করতে পারি সে কোথায় আছে।
রাফায়েল হাসল। তারপর বলল, আমি মহাশক্তিধর কেউ নই আরমান সাহেব৷ আমি সব কিছু পারি না। যারা এখনো বেঁচে আছে তাদের সাথে প্রতিনিয়ত ঘটনা ঘটতেই থাকে। তাদেরকে ট্রেস করা খুবই কঠিন। কিন্তু যারা মারা যায় তাদের স্মৃতি স্থির হয়ে যায়। নতুন কোন ঘটনা আর যুক্ত হয় না। তাই তাদের খুঁঁজে পাওয়া সহজ। বুঝেছেন?
-তার মানে নিনিন এখনও বেঁচে আছে?
-হ্যা আছে। এখনো পর্যন্ত। আগে আসুন আমরা দেখি আকিব এরপর কি করে। সে কার সাথে দেখা করে আর কোথায় যায় সেটা বের করা দরকার!
আরমান আহমেদ আর রাফায়েল আকিবের পিছু পিছু চলতে শুরু করলো৷ আরও ভাল করে বললে আকিবের স্মৃতির পিছু পিছু চলতে শুরু করলো ওরা!
রাফায়েল বেশ খানিকটা সময় পনের নম্বর স্টাফ কোয়াটারের রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরমান আহমেদ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখছেন কেবল। তার কাছে মনে হচ্ছে যে তিনি কোন সিনেমার দৃশ্যের ভেতরে ঢুকে পরেছেন । এবং কয়েক দিন ধরে সেই দৃশ্যের ভেতরেই রয়েছেন । এখন তিনি রয়েছেন আকিবের জীবনের দৃশ্যে। আকিব কোথায় যাচ্ছে, কি করছে, কি খাচ্ছে, সব কিছু দেখতে পাচ্ছেন ওর পাশে থেকেই।
আরমান আহমেদ বললেন, কি ব্যাপার এখানে দাঁড়িয়ে পড়লে যে!
রাফায়েল বলল, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেন নি?
আরমান আহমেদ বললেন, কোনটা ?
ভিডিও ফুটেজ যেভাবে পেছনে টেনে দেখা যায় দৃশ্যটা আবারও পেছনের দিকে এগিয়ে গেল। তারপর আবারও চলতে শুরু করলো। আরমান আহমেদ এবার গভীর মনযোগ দিয়ে দেখতে শুরু করলেন। তারপরেই তার চোখে অসঙ্গতিটা দেখা দিল।
আরমান আহমেদ বললেন, আকিব ছেলেটা ঐ গলির ভেতরে ঢুকলো তারপর সাথে সাথেই বের হয়ে এল। কিন্তু ও তো ঐ লোকটার সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলো।
তিন দিন ধরে তারা আকিবের সাথেই আছে। ঐদিন জসিমের কাছ থেকে ধাক্কা খেয়ে এসে আকিব সোজা নিজের রুমে গিয়ে হাজির হয়। সেদিন রাতেই তার এক বন্ধুর সাথে সে ফোনে কথা বলে। আজকে সকালে আবারও তার সাথেই কথা বলে।এখন সে গলির ভেতরে ঢুকেই বের হয়ে এসেছে।
আরমান আহমেদ বলল, তার মানে কি দেখা হয় নি ?
রাফায়েল বলল, হয়েছে। ভাল করে দেখেন গলিতে প্রবেশের সময় আকিবের হাতে কালো প্যাকেট টা ছিল না, কিন্তু এখন আছে।
-তাহলে কিভাবে হল এটা?
রাফায়েলকে একটু চিন্তিত দেখালো। তারপর বলল
-কেউ এটা মুছে দিয়েছে।
-কিভাবে মুছে দিয়েছে? এটা সম্ভব নাকি?
-অনেক কিছুই সম্ভব। ভিডিও ফুটেজ যেভাবে মুছে দেওয়া যায় তেমনি এটা মুছে দেওয়া না গেলেও আড়াল করা তো যায়ই।
-তাহলে ! আমরা তো আবারও সেই কানাগলিতেই এসে পৌছালাম।
রাফায়েল বলল,
-যে এই কাজটা করেছে সে যথেষ্ট সাবধান। তবে সে একটা সূত্র রেখেই গেছে। সেটা মুছতে পারে নি।
-কোনটা?
-আকিব ওর বন্ধুর কাছে দুইবার ফোন দিয়েছিল, মনে আছে ? কথা বার্তা যদিও স্পষ্ট করে কিছু বলে নি তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে এই বন্ধুর কাছ থেকেই সে এই লোকের খোঁজ পেয়েছে। গতদিন যখন কথা বলছিল তখন নিশ্চয়ই শুনেছেন সে কেমন করে কথা বলছিল। আর কোনো পথ খোলা নেই ওর সামনে। আমাদের এখন সেই বন্ধুর কাছে যেতে হবে। সে যদি এই লোককে না-ও চেনে তবুও কিছু না কিছু সে জানবেই।
রাফায়েলের বুদ্ধি দেখে আরমান আহমেদ চমৎকৃত হয়ে গেলেন। ছেলেটা যে কেবল অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী সেটাই নয়, মাথায় বেশ বুদ্ধিও রাখে।
আরমান আহমেদ বললেন, আমরা কি সামনে যাবো ? মানে আকিবের সাথে আরও কয়দিন থাকবো?
-না। আপাতত আর কিছু দেখার নেই।
-তাহলে এই জগত থেকে বের হব কিভাবে?
কথাটা বলার সাথে সাথেই আরমান আহমেদ নিজেকে আবারও আকিবের ঘরের মেঝেতে আবিস্কার করলেনন । এতো সময় এখানেই শুয়ে ছিলেন যেন !
আরমান আহমেদ দেখলেন, রাফায়েল উঠে দাড়িয়েছে। তার দিকে না তাকিয়েই সে বলল, আকিবের ঐ বন্ধুর খোঁজ বের করেন। সে কিছু না কিছু জানবেই।
তিনি নিজেও দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, তিন দিন ধরে এখানে আছি! কেউ যদি আমাদের এই অবস্থায় দেখতো তাহলে ?
রাফায়েল বলল, তিন দিন!! নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখুন।
এই বলে রাফায়েল দরজা দিয়ে বাইরে বের হয়ে গেল।
আরমান আহমেদ তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আরেকটা ধাক্কা খেলেন। যখন এই রুমে ঢুকেছিলেন তখন একবার সময় দেখেছিলেন। বিকেল পাঁচটার মত বেজেছিল তখন। আঠারো তারিখ ছিল। ঘড়িতে দেখা যাচ্ছে ছয়টা এগারো বাজে। তারিখ সেই আঠারোই। মাত্র ঘন্টা খানেক সময় পার হয়েছে। অথচ পুরো তিনদিন তিনি আকিবের পেছন পেছন ঘুরে বেরিয়েছেন !
কিভাবে সম্ভব !
আরমান আহমেদ দরজা দিয়ে বের হয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন! আশে পাশে কেউ নেই। রাফায়েল চলে গেছে।
আরমান আহমেদের খুব বেশি সময় লাগলো না আকিবের ঐ বন্ধুর খোঁজ বের করতে। ছেলেটার নাম ফাহিম। আকিবের স্কুল জীবনের বন্ধু। ঢাকাতেই থাকে। তাকে একেবারে উড়িয়ে আরমান আহমেদের বাড়িতে এনে হাজির করা হল। তারপর একটু চাপ দিতেই সে সবকিছু পেট থেকে বের করে দিল।
হ্যা, আরমান আহমেদকে সে খুব ভাল করেই চেনে। নিনিনকেও চেনে। আকিবের সাথে নিনিনের একটা সম্পর্ক ছিল এটাও সে জানতো। এবং আকিবকে সে-ই সোবাহান উদ্দিনের খোঁজ দিয়েছিল !
লোকটার নাম তাহলে সোবাহান উদ্দিন। ঐ পনেরো নম্বরের গলির একেবারে শেষ মাথায় থাকে লোকটা!
আরমান আহমেদের মুখ এবার শক্ত হয়ে এল। এইবার তিনি তার শক্তি দেখাতে পারবেনন । এবার সে মজা বুঝবে !!
নিজের লোকজনদের প্রস্তুত হতে বললেন । কিন্তু তার যাওয়ার আগেই হামলা হল আবার। ঠিক যখন গাড়ি নিয়ে বের হতে যাবেন তার আগেই গাড়ির সামনে সেই আলোর বৃত্ত দেখা গেল। সেখান দিয়ে কালো আলখাল্লা পরা লোকটা বের হয়ে এল। সাথে দুই পাশে সেই কুকুরের মত দুই প্রাণী।
আরমান আহমেদ সহ তার সব লোকজন অবাক বিস্ময়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু যেন করতেও ভুলে গেছে সবাই । কালো আলখাল্লা পরা লোকটা তখন নিজের হাতের ভেতর থেকে কিছু ছুঁড়ে দিল। মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই সেগুলো থেকে বোমার মত আওয়াজ বের হল। তার লোকজনসহ তিনি উড়ে গিয়ে পড়লেন দূরে।
আরমান আহমেদের কানে তালা লেগে গেছে । চারিদিকে আরও কতগুলো আওয়াজ হল । চারিদিক থেকে যেন হামলা হচ্ছে ।
আরমান আহমেদ যখন উঠে দাঁড়ালেন , তাকিয়ে দেখলেন চারিদিকে তার লোকজন ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে৷ তার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। কালো আলখাল্লা পরা লোকটা তার পোষা প্রাণী দুইটাকে ইশারা করতেই ঐ দুটো সামনে এগিয়ে এল। তারপর ঠিক একই ভাবে তাদের মুখ দিয়ে সেই লম্বা শুঁড়ের মত অঙ্গটা বের হয়ে এগিয়ে আসতে লাগলো তার দিকে।
এগুলো তিনি সিসিটিভি ফুটেজে দেখেছেন। কিভাবে শুঁড়টা তার গার্ডের শরীরে ঢুকে গিয়েছিল ! এবার তার পালা ! তাহলে এভাবেই মৃত্যু হতে চলেছে তার!
আরমান আহমেদ সেই মৃত্যুকে এগিয়ে আসতে দেখতে লাগলেন। কেবল দেখা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই।
আরমান আহমেদের মনে হল যেন সময় থেমে গেছে । সব কিছু চলছে সুপার স্লো মোশনে । তিনি চোখ দিয়ে দেখতে পাচ্ছেন ঐ প্রাণী দুটোর শুড় এগিয়ে আসছে তার দিকে ।
কিন্তু নিজের অবস্থান তিনি থেকে নড়তে পারছেন না । তার পায়ে যেন শিকড় গজিয়ে গেছে । কেবল নিজের মৃত্যুকে সামনে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসতে দেখছেন !
তাহলে এভাবেই তার সমাপ্তি লেখা ছিল ?
তখনই তার নিনিনের কথা মনে হল ।মরার আগে যদি জানতে পারতেন যে নিনিন সুস্থ হয়ে ফিরে এসেছে, নিরাপদে আছে, তাহলে হয়তো মরেও শান্তি পেতেন । কিন্তু এখন তো তা-ও পাবেন না । এইভাবে অখ্যাত এক লোকের হাতে এভাবে তার মৃত্যু হবে সেটা কি তিনি কোন দিন ভেবেছিলেন ?
এই তো কাছে চলে এসেছে শুড় গুলো !
ঠিক তখনই ঘটনাটা ঘটলো । আরমান আহমেদ দেখলেন শুড় গুলো উড়ে এসে ঠিক তার সামনে কিছুর সাথে যেন ধাক্কা খেল । খানিকটা কুঁঁচকে গেল যেন । কেবল মনে হল যে তার সামনে একটা কাঁচের দেওয়াল এসে পরেছে । সেগুলো তাতেই আটকে গেছে ।
তারপরেই তার চোখ গেল বাম দিকের গেটের কাছে । অন্ধকারের মধ্যে সেখানে একটা অবয়ব এসে দাঁড়িয়েছে । নিকষ অন্ধকারে তার চেহারা দেখা না গেলেও তাকে চিনতে আরমান আহমেদের মোটেই কষ্ট হল না ।
রাফায়েল !
সাথে সাথে চাঞ্চল্য দেখা দিল সামনে দাঁড়ানো সেই কালো আলখেল্লা পরা লোকটার মাঝে । একটু আগে যে হাতের ভেতর থেকে ছোট ছোট বোমা জাতীয় বল গুলো সে ছুঁড়ে দিচ্ছিল আরমান আহমেদ এবং তার লোক জনের উপরে, ঠিক তেমনই কয়েকটা বল এবার ছুঁঁড়ে দিলো রাফায়েলের দিকে ।
কিন্তু সেগুলো আটকে গেল মাঝ পথেই ।
আরমান আহমেদ হা করে কিছু সময় তাকিয়ে রইলেন সেদিকে । রাফায়েল অন্ধকারের মধ্য থেকে আলোতে বেরিয়ে এসেছে । আরমান আহমেদ দেখলেন যে সামনে দাঁঁড়ানো লোকটার থেকে কিছু দুরেই সেই বল গুলো শূন্যে ভেসে রয়েছে । যেন সেগুলো ওখানে আটকে গেছে । আরমান আহমেদের মতই লোকটাও খানিকটা যেন চমকে গেছে । যদিও তার চেহারা দেখা যাচ্ছে না তবে তার অঙ্গভঙ্গি দেখেই সেটা বুঝা যাচ্ছে পরিস্কারভাবে । বলগুলো এবার ঘুরে গিয়ে ঠিক ঐ লোকটার সামনেই গিয়ে পড়লো । লোকটা চট জলদি হাত দিয়ে কিছু করতে গেল কিন্তু তার আগেই সেগুলো বিস্ফোরিত হয়ে গেল । লোকটা সহ তার দুই কুকুরের মত প্রাণী দুইটা তিন দিকে ছিটকে পড়লো । লোকটা উঠে দাঁঁড়ালো প্রায় সাথে সাথেই । একটা প্রাণীও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে পড়লো । কিন্তু অন্য একটা প্রাণী উঠতে পারলো না ।
যে প্রাণীটা উঠে দাঁঁড়িয়েছে সেটা সাথে সাথেই রাফায়েলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো । একটু সামনে গিয়েই নিজের শুঁঁড় বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে । আরমান আহমেদ দেখলেন রাফায়েল কেবল হাত দিয়ে শূন্যে যেন কিছু একটাতে বাড়ি মারার মত করলো । সাথে সাথেই প্রাণীটা এক দিকে ছিটকে পড়লো । আরমান আহমেদ কিছুই বুঝতে পারছেন না । নিজের চোখকে বিশ্বাস করতেও পারছেন না যেন ।
রাফায়েল নামের মানুষটা যে স্বাভাবিক কেউ না সেটা তিনি খুব ভাল করেই জানেন । কিন্তু তার কাছ থেকে এই রকম কিছু তিনি কোনভাবেই আশা করেন নি । এটা কিভাবে সম্ভব ? দুর থেকে কেবল হাতের ইশারাতে সে জিনিস পত্র নিয়ন্ত্রন করতে পারছে !
কিভাবে পারছে!
আরমান আহমেদ দেখলেন লোকটা যেন কিছু করছে হাত দিয়ে । তারপরই শূণ্যের মাঝে সেই গোল পোর্টালটা সৃষ্টি হল । লোকটা পালিয়ে যাচ্ছে !
রাফায়েলও যেন এটা বুঝতে পেরেছে । বুঝতে পেরেই সে দৌড় দিতে লাগলো লোকটাকে লক্ষ্য করে । কিন্তু মাঝ পথেই তাকে থেমে যেতে হল । যাওয়ার আগে লোকটা অনেকগুলো বল ছুঁড়ে দিয়েছে । তবে সেগুলো রাফায়েলের দিকে নয়, ছুঁঁড়েছে আরমান আহমেদের দিকে । রাফায়েল এটা আশা করে নি । সে ভেবেছিল আক্রমনটা তার দিকে আসবে । সেটার জন্য সে তৈরিই ছিল । কিন্তু আরমান আহমেদের দিকে বল গুলো ছুড়ে দেওয়াতে সে খানিকটা সময় দিশেহারা বোধ করলো । এখন যদি সে লোকটাকে ধরতে যায় তাহলে বলগুলো সোজা গিয়ে পড়বে আরমান আহমেদের কাছে । তিনি হয়তো উড়ে যাবেন । হয়তো মারাও যেতে পারেন !
রাফায়েল সাথে সাথেই দিক পরিবর্তন করলো । বল গুলো আরমান আহমেদের দিকে যাওয়ার আগেই সেগুলো থেমে গেল । তারপর তড়িৎ গতিতে সেগুলো আবারও ফিরে যেতে লাগলো সেই পোর্টালের দিকে । কিন্তু ততক্ষণে একটু দেরি হয়ে গেছে । লোকটা ঢুকে গেছে পোর্টালে । সাথে একটা প্রাণীও । পোর্টালটা বন্ধ হয়ে গেল সাথে সাথেই । বল গুলো গিয়ে পড়লো বাগানের ভেতরে ।
আরমান আহমেদ তখন জীবনের আরেকটা বিস্ময়কর ঘটনা দেখতে পেলেন । তিনি দেখতে পেলেন বল গুলো বাগানের মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই রাফায়েল ঘুরে দাঁঁড়ালো । একটা পাজেরো গাড়ি দাঁঁড়িয়ে ছিল লনের উপরে । রাফায়েল সেদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে দুই হাত দিয়ে কিছু যেন ধরার চেষ্টা করলো । আরমান আহমেদ দেখতে পেলেন তার গাড়িটা যেন লন থেকে উড়ে এসে ঠিক পড়লো ঐ বলগুলোর উপর । সাথে সাথেই একটা তীব্র বিস্ফোরনের আওয়াজ হল । তবে গাড়িটা উড়ে গেল না । রাফায়েলের ভঙ্গি দেখে মনে হল সে যেন কিছু একটা জিনিস ধরে রেখেছে । বোমাটা বিস্ফোরিত হতেই যেন ছেড়ে দিলো । তার পেশীও কিছুটা শান্ত হয়ে এল ।
আরমান আহমেদ কেবল বোকার মত কিছু সময় দাঁড়িয়ে রইলেন । এতো সময় তার সামনে কি হল সে তিনি কিছুতেই বুঝতে পারছেন না, বিশ্বাস করতে পারছে না । কিন্তু নিজের চোখকে ঠিক যেন অবিশ্বাসও করতে পারছে না !
রাফায়েল বলল, আপনি ঠিক আছেন ?
-হ্যা ! কিন্তু কিন্তু .........
আরমান আহমেদ কিছু বলতে গেলেন । তার জানতে ইচ্ছে হচ্ছে যে রাফায়েল কিভাবে এইসব করলো । কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা জানতে চাইলেন না ।
রাফায়েল বলল, ডাক্তার ডাকুন, আপনার লোকেদের অবস্থা ভাল নয় খুব একটা । এই বল গুলো একটা বিশেষ ধরনের স্পেল দিয়ে বানানো । ম্যাজিক্যাল গ্রেনেড বলতে পারেন ।
তখনই পেছন থেকে একজনের কন্ঠস্বর শুনতে পেল ওরা ।
-স্যার !
তারা দুজনেই ঘুরে তাকালো । একজন গার্ড উঠে দাঁড়িয়েছে । হাতের ইশারা করে দেখাচ্ছে কোন কিছুর দিকে । তখনই তাদের চোখ গেল প্রাণীটার উপর । একটা প্রাণী মাটিতে পড়ে গিয়ে আর উঠে নি । তাকে রেখেই ঐ লোকটা পালিয়ে গেছে । সেই প্রাণীটা এখন সেখানেই পড়ে আছে ।
রাফায়েল এগিয়ে গেল সেটার দিকে । হাত দিয়ে শরীর স্পর্শ করতেই বলল, মরে নি । বেঁচে আছে !
-তাহলে ?
-সমস্যা নেই । এটার ব্যবস্থা আমি করছি ।
আরমান আহমেদ কিছু সময় নিজের বাড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন অবাক হয়ে । এই বাড়ি নিয়ে তার কত গর্ব ছিল । তিনি ভাবতেন এই বাড়িটা একটা দুর্ভেদ্য দূর্গ, এখানে চাইলেও যে কেউ ঢুকতে পারবে না । তার হুকুম ছাড়া একটা পাখিও এখানে আসতে পারবে না । অথচ দুই দুই বার তার বাড়ি আক্রান্ত হল । একবার তার মেয়েকে তুলে নিয়ে গেল । সেবার তো চুপিসারে এসে চলে গিয়েছিলো কিন্তু এইবার তো একেবারে সবার চোখের সামনে এসে হামলা চালানো হল । মাত্র একজন মানুষ কিভাবে তাকে নাস্তানাবুদ করে দিয়ে চলে গেল !
সামনে বসা এই মানুষটা যদি না থাকতো তাহলে হয়তো আজকে তিনি এখানে জীবিত থাকতে পারতেন না । কি অদ্ভুত এই ব্যাপারটা !
আরমান আহমেদ সামনে এগিয়ে আসলেন । রাফায়েল তখনও প্রাণীটার দিকে তাকিয়ে আছে । একটা খাঁচা আনা হয়েছে । সেখানে প্রাণীটাকে ভরা হচ্ছে ।
আরমান আহমেদ বলল, এই খাঁচা কি আটকাতে পারবে একে ?
রাফায়েল বলল, সেটার ব্যবস্থা করা হবে ।
আরমান আহমেদ বলল, আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না ।
-কোন ব্যাপারটা ?
-ঐ লোকটা কিভাবে আবার চলে এল আমার বাসায় ? আপনি বলেছিলেন যে চাইলেও যে কেউ এভাবে পোর্টাল তৈরি করে চলে আসতে পারে না । আগে একটা ব্রীজ তৈরি করতে হয় । মানে আকিব যেমন করে ঐ হাড়গুলো ছুড়ে দিয়ে ব্রীজের খুটি তৈরি করেছিল । সেগুলো আপনি নিয়ে গিয়েছিলেন । তাহলে আবার কিভাবে তৈরি হল !
রাফায়েল বলল, আবারও হয়তো কেউ এই কাজটা করেছে ।
-জি না । এটা সম্ভব না । কারন এই সময়ে আমি পুরো বাড়ির উপর খুব ভাল করে লক্ষ্য রাখিয়েছি । কেউ যাতে বাড়ির আশে পাশে ঘুরঘুর না করতে পারে কিংবা অন্য কিছু না করতে পারে সেই দিকে বিশেষ নজর ছিল । তাহলে কিভাবে এল?
রাফায়েল বলল, কোন না কোন ভাবে তো এসেছে । তা না হলে এইভাবে সে আসতে পারতো না কোনভাবেই । আপনি নিশ্চিত .........
রাফায়েল কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেল । আরমান আহমেদেরও তখন একটা কথা মনে পড়ে গেল । একজন তার বাসায় এসেছে । মানে তাকে আনা হয়েছে !
আকিবের ঐ বন্ধু ! ফাহিম !
রাফায়েল যেন আরমান আহমেদের কথা বুঝতে পারল । আরমান আহমেদ কে বলল, আকিবের ঐ বন্ধু কোথায় এখন ?
-এই বাসায়ই আছে !
আর কিছু বলতে হল না । আরমান আহমেদ দ্রুত সেই ঘরের দিকে হাটা দিলেন ।
ফাহিম চুপ করে নিজের রুমে বসে ছিল । তাকে নিচ তলার একটা রুমেই আটকে রাখা হয়েছিল । আরমান আহমেদের ইচ্ছে ছিল যে সোবাহান উদ্দিন নামের ঐ মানুষটার কাছ থেকে নিনিনকে উদ্ধার করেই এই ফাহিমকে ছেড়ে দিবেন । যদি আবারও কোন দরকার পড়ে সেটার জন্য ছাড়েন নি ।
রাফায়েল আর আরমান আহমেদ দরজা খুলে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করতেই ফাহিম ছেলেটা একটু যেন চমকে উঠলো । একটু ভীত হয়ে তাকিয়ে আছে সে । বিশেষ করে রাফায়েলের দিকে চোখ পড়তেই ছেলেটা বেশ ভয় পেয়ে গেল । কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই ফাহিম বলল, আমাকে কিছু করবেন না প্লিজ । আমার কোন দোষ নেই । ঐ সোবাহান চাচা আমাকে এই কাজটা করতে বাধ্য করেছে !
আরমান আহমেদ কিছু বলতে যাবেন তার আছেই রাফায়েল বলল, কি করতে বাধ্য করেছে ?
ফাহিম কিছু না বলে পকেট থেকে একটা ছোট হাড় বের করে আনলো । যখন আপনারা আমার বাসায় আসছিলেন তার আগেই সোবাহান চাচা আমার কাছে এসে হাজির হয় । আমাকে এই হাড় দিয়ে বলে যে আপনি কিংবা আপনার লোক আমাকে নিতে আসবে । তখন যেন সুযোগ বুঝে এগুলো আপনার বাসায় ছড়িয়ে দেই । তাহলে সে এসে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যেতে পারবে ।
রাফায়েল বলল, তুমি জানতে যে সোবাহান উদ্দিন তোমার বন্ধু আকিবকে মেরে ফেলেছে ?
ফাহিম কিছু না বলে মাথা নিচু করে রইলো । আরমান আহমেদ এবার ধমক দিয়ে বলল, কথার জবাব দাও । নয়তো এখনই কিন্তু তোমাকে আমি কুকুর দিয়ে খাওয়াবো !
ফাহিম এটা শুনে তাড়াতাড়ি বলল, হ্যা, আমি জানতাম ।
-তারপরেও তুমি তার সাহায্য করছো ?
-আমার আর কোন উপায় ছিল না । সোবাহান উদ্দিন আমার আপন চাচা হয় । পরিবার থেকে তার সাথে কোন যোগাযোগ করতে মানা করেছে । কিন্তু ঢাকাতে এসে আমি যখন বিপদে পড়তাম এই চাচাই আমাকে সাহায্য করতো নানান ভাবে । তিনি আমাকে বেশ আদরই করতেন । বদলে ......
-বদলে ?
-বদলে তার কিছু কাজ করে দিতে হত আমার । আমি জানতাম যে উনি ব্ল্যাক ম্যাজিক চর্চা করতেন । এই জন্যই আমার বাবা আর অন্য চাচারা তার সাথে কোন সম্পর্ক রাখতো না । কিন্তু আমার নিজের এই দিকে খানিকটা আগ্রহ ছিল । তাই আমি চাচার কাছ থেকে কিছু শেখার চেষ্টা করতাম ।
-এসব যে ভাল কিছু না সেটা নিশ্চয়ই জানো । তবুও করতে চাও ?
ফাহিম কোন কথা না বলে চুপ করে রইলো !
রাফায়েল বলল, এটা বুঝলাম যে তোমার বন্ধু আকিব তোমার চাচার কাছে গিয়ে হেল্প চেয়েছিলো । নিনিনকে উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য । কিন্তু আকিবকে কেন মেরে ফেললেন তিনি ।
ফাহিম আবারও কিছু সময় ইতস্তত করে বলল, আসলে চাচা নিনিনকে হাতে পাওয়ার পরে আর দিতে চাইছিলো না । আকিব এতে খুব খেপে যায় । চাচার উপর হামলা করতে যায় !
-কেন দিতে চাচ্ছিলো না ?
-আ-আমি ঠিক জানি না । আমি সত্যিই জানিনা ।
আরমান আহমেদ কি বলবেন ঠিক বুঝতে পারলেন না । দেখলেন রাফায়েল এগিয়ে এল । তারপর ফাহিমের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল । তার পর শান্ত কন্ঠে বলল, সত্যিই জানো না ? আমার কাছে কিন্তু অন্য উপায় আছে কথা বের করার !
ফাহিম এই কন্ঠটা শুনে এতোই ভয় পেল যে আবারও গড়গড় করে বলতে শুরু করলো ! ফাহিম বলল, চাচা অনেক দিন থেকেই একটা দেহ খুজতেছিল । বিশেষ সময়ে জন্মামো একটা মানুষ । আমি সব কিছু পরিস্কার জানি না । তবে চাচা আমাকে বলেছে যে এই বিশেষ সময়ে জন্মানো মানুষটার দেহের ভেতরেই কেবল সে আসতে পারবে ।
-সে টা কে?
-এটা আমি সত্যিই জানি না । তবে চাচা তাকে এই দুনিয়াতে আবার নিয়ে আসতে চায় ! চাচা অনেক দিন থেকেই এমন মানুষ খুজতেছে । যখন দেখল যে নিনিনই সেই মানুষ তখন চাচা আর নিনিনকে দিতে চায় নি ।
আরমান আহমেদ বলল, তার মানে নিনিন সেই বিশেষ সময়ে জন্মানো মানুষ ?
-নিনিন একেবারে সঠিক সেই সময়েই জন্মানো মানুষ সেটা না । তবে খুব কাছাকাছি জন্মেছে সে । চাচা বলেছে যে এতেই হবে !
আরমান আহমেদ বলল, আমাকে নিয়ে যাক । আমার জন্মদিন আর নিনিনের জন্মদিন প্রায় কাছাকাছি । চার দিনের পার্থক্য কেবল । আমাকে নিয়ে যাক । ওকে ছেড়ে দিক !
ফাহিম বলল, চাচা এটা জানে !
রাফায়েল আর আরমান আহমেদ এক সাথেই বলল, জানে ?
-হ্যা । আজকে সে আপনাকে নিয়ে যেতেই এসেছিল । চাচা প্রথমে ভেবেছিল যে নিনিন হয়তো ধারন করতে পারবে কিন্তু একবারের চেষ্টাতে বিফল হয়েছে । আজকে সে আপনাকে নিতে এসেছিল ।
এই কথা শুনে দুজনেই চুপ করে গেল । রাফায়েল কিছু সময় চুপ করে থেকে পকেট থেকে একটা লেবুর মত ফল আরমান আহমেদের হাতে দিল । তারপর বলল, বুঝতে পারছি যে আপনার জীবন এখন বিপদে আছে । এই ফলটা কাছে রাখুন । কখনই হাত ছাড়া করবেন না । ঠিক আছে । নিনিনকে আমরা ঠিকই খুজে নিয়ে আসবো । এখন আমরা জানি সে কে এবং কি চায় !
রাফায়েল চলে যেতেই তিনি খানিকটা সময় একা নিজের স্টাডি রুমে বসলেন । আজকে তার অনেক বেশি ক্লান্তি লাগছে । তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না । কিভাবে নিনিনকে বাঁচাবেন সেটাও তিনি জানেন না । একেবারে হাত গুটিয়ে বসেও থাকতে পারছেন না । আবার কিছু করতেও পারছেন না । পেশী শক্তির সাথে লড়াই করা যায় কিন্তু এই শক্তির সাথে তিনি কিভাবে লড়াই করবেন !
এই সবই যখন ভাবছেন তখনই তার ফোন বেজে উঠলো ।
নাম্বারটা দেখে খানিকটা ভুরু কুচকে উঠলো তার । অপরিচিত নাম্বার । এই ফোনে অপরিচিত কোন নাম্বার থেকে ফোন আসে না খুব একটা ! এটা তার একেবারে বক্তিগত নাম্বার !
-হ্যালো !
ওপাশ থেকে খানিক সময় নিরবতা ! তারপর একটা খসখসে কন্ঠ বলে উঠলো, মেয়ের জীবনের জন্য কি দিতে চান ?আরমান আহমেদ সাথে সাথেই বুঝে গেলেন কে ফোন দিয়েছে । প্রচন্ড রাগ হলেও তিনি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে নিলেন । তারপর শান্ত কন্ঠে বললেন, কি চাই তোমার ? যা চাইবে তাই পাবে ।
একটু হাসির শব্দ ভেসে এল । তারপর ওপাশ থেকে বলল, আপনাকে চাই । আর কিছু না । নিনিনকে দিয়েও আমার কাজ হবে তবে আপনাকে দিয়ে বেশি ভাল কাজ হবে । একে তো আপনি পুরুষ মানুষ, যদিও বয়সটা একটু বেশি তবে সেটা কোণ ব্যাপার না । আপনি নিজের বিনিময়ে মেয়েকে ছাড়িয়ে নিতে পারেন । আপনি যখন আসবেন নিনিনকে তখনই ছেড়ে দেব ! রাজি ?
কিছু সময় চুপ করে থেকে আরমান আহমেদ বললেন, আমি আসলেই যে নিনিন কে ছেড়ে দিবেন তার গ্যারান্টি কি ?
আবারও হাসির শব্দ । তারপর সে বলল, ডন সাহেব, আপনি যেমন এক কথার মানুষ তেমনি আমিও এক কথার মানুষ ।
-আচ্ছা আমি রাজি ।
-কোন চালাকি করবেন না । কারন দেখেছেনই আমি কি করতে পারি ।
-কোন চালাকি করবো না ।
-আর ঐ মানুষটা কে দূরে রাখবেন ! সে যেন না জানে, না আসে । তাহলে কিন্তু নিনিন মারা যাবে । ঠিক আছে ?
-আচ্ছা ! তাই হবে ।
খুট করে ফোন কেটে গেল । আরমান আহমেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন । নিজের জীবনের বিনিময়েও যদি নিনিনকে বাঁচানো যায়, তিনি তাতেও রাজি ! কিন্তু রাফায়েল কে কি বলবেন ?
দুইদিন ধরে একটানা বৃষ্টি হচ্ছে। সোবাহান উদ্দিন বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে । খুব একটা দরকার না পড়লে সে বাইরে বের হয় না৷
-চাচা !
সোবাহান উদ্দিন ফিরে তাকালো। পাশের বাসার আকবর আলীর ছোট ছেলে।
-কি ব্যাপার রিপন!
রিপন বারান্দায় পা রাখলো। তবে ছাতা বন্ধ করল না।
-বাবা পাঠালেন আপনার জন্য। আজকে আমাদের বাসায় খিচুড়ি রান্না হয়েছে।
সোবাহান উদ্দিন রিপনের হাতের টিফিন ক্যারিয়ারের দিকে তাকালো। বলল, আরে, এটার আবার কি দরকার ছিল।
রিপন হাসলো। তারপর বলল, আপনি একা মানুষ! এমন দিনে আবার কষ্ট করে রান্না করবেন, তাই বাবা পাঠালেন ।
টিফিন ক্যারিয়ারটা হাতে নিতে নিতে সোবাহান উদ্দিন বলল, তোমার বাবাকে ধন্যবাদ দিও।
-আচ্ছা। এখনই খেয়ে নিন। খিচুড়ি গরম আছে। ঠান্ডা হয়ে গেলে আর ভাল লাগবে না।
এই বলে রিপন আবার ছাতা নিয়ে বৃষ্টির ভেতরে বের হয়ে গেল। সোবহান উদ্দিন টিফিন ক্যারিয়ারের দিকে কিছু সময় তাকিয়ে রইলো। তার মনের ভেতরে খিচুড়িটা একটু খেয়ে দেখার ইচ্ছে হল। কিন্তু পরক্ষণেই সেটার চিন্তা বাদ দিয়ে দিল। আজ ছয়দিন পৃথিবীর কোন দানা পানি সে মুখে নেয় না। যে প্রক্রিয়ার ভেতরে সে আছে, সেটার জন্য এই পৃথিবীর কিছু খাওয়া যাবে না। অবশ্য তার সেটার দরকারও পড়ে না৷ একটানা একুশ দিন পর্যন্ত সে কোন প্রকার খাবার না খেয়েই অতিবাহিত করতে পারে । যখন থেকে এই পথে এসেছে, তখন থেকেই নিজের দেহকে সে এমন ভাবেই তৈরি করেছে ৷
সে আরেকবার বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারিপাশটা দেখল । তার বাড়িটা এই এলাকার সব থেকে শেষ মাথায়। এরপর থেকেই বেড়িবাধ শুরু হয়েছে। বেশ কিছু পুরানো গোডাউন রয়েছে এখানে, যার প্রায় সবগুলোই বন্ধ হয়ে আছে অনেক দিন থেকে।
সোবাহান উদ্দিন টিফিন ক্যারিয়ারটা নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল। এরপর দরজাটা বন্ধ করে দিল। এগিয়ে চলল রান্না ঘরের দিকে। তবে রান্না ঘরের দরজা না খুলে ডান দিকের ছোট লাল দরজাটা খুলল। দরজাটা তার বাথরুমের। তবে এটা ব্যবহার করা হয় না। দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ করে দিতেই ডান দিকে আরেকটা দরজা দেখা গেল। সেটা খুলতেই একটা সিড়ি দেখা গেল। সিড়িটা নিচে নেমে গেছে। নিচের বেজমেন্টে। এই বাসায় যে একটা বেজমেন্ট আছে, এটা সে ছাড়া আর কেউ জানে না।
আস্তে আস্তে সিড়ি দিয়ে নিচে নামল সে। ঘরটা খালিই বলা চলে। এক পাশে তার কিছু কাজের জিনিসপত্র। বাঁ দিকে একটা ছোট চৌকি পাতা। সেখানে মেয়েটা শুয়ে আছে। কিছু সময় সে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কি নিষ্পাপভাবে মেয়েটা ঘুমিয়ে আছে !
কি ভাগ্য গুণেই না এই মেয়েটাকে সে পেয়ে গিয়েছে ! নয়তো আরও কতোদিন তাকে অপেক্ষা করতে হত কে জানে!
এখন এই মেয়েটার বদৌলতে ওর সব স্বপ্নই সত্যি হতে চলেছে।
অবশেষে নিজের গুরুকে সে আবারও পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনতে পারবে ! আবারও জীবিত করে তুলতে পারবে !
সোবাহান উদ্দিন একটা মন্ত্র পড়ে মেয়েটার শরীরে হাত দিল ৷ সাথে সাথেই মেয়েটা জেগে উঠলো। মেয়েটা ওর দিকে তাকিয়েই ভয়ে চুপ হয়ে গেল। প্রথম যখন ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হয়েছিল সেই দিন মেয়েটা খুব চিৎকার চেঁচামেচি করতে যাচ্ছিলো। তখনই সে তার লেমুটটাকে মেয়েটার সামনে নিয়ে আসে ।
লেমুটটাকে দেখে মেয়েটা এতোই ভয় পায় যে অজ্ঞান হয়ে যায় সাথে সাথে। তারপর আবার যখন তার জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হল তখন সোবহান উদ্দিন তাকে ভয় দেখিয়েছিলো এই বলে যে কথা না শুনলে লেমুটটাকে সে আবার ডেকে আনবে।
আজকেও মেয়েটি চুপ করে মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। সোবহান উদ্দিন টিফিন ক্যারিয়ারটা তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল , খেয়ে নাও।
টিফিন ক্যারিয়ারটা হাতে নিল মেয়েটি। সোবহান উদ্দিন বলল, তোমার জন্য একটা সুসংবাদ আছে ।
মেয়েটি টিফিন ক্যারিয়ার থেকে মুখ তুলে তাকালো। সোবহান উদ্দিন বলল, তোমার বাবা আসছে।
বাবার নামটা শোনার সাথে সাথেই মেয়েটির মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেল৷ সোবহান উদ্দিন বলল, ভাবলাম শেষ বারের মত তাকে দেখে নাও৷ আর দেখতে পাবে না৷ তোমার বাবা ভাবছে নিজের বিনিময়ে সে তোমাকে রক্ষা করবে। কিন্তু সে আসলে জানেও না যে সে নিজেই তোমাকে বলি দিতে চলেছে, নিজেই তোমাকে ভোগ করতে চলেছে!!
এই কথা শুনে মেয়েটি চোখ বড় বড় করে তাকালো৷ তার যেন কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না কিছু । এমন কিছু হতে পারে না!!
অনেকদিন পর আরমান আহমেদ আজকে নিজে গাড়ি চালাচ্ছেন । মনের ভেতরে একটা ভয় কাজ করছে । শেষ কবে তিনি ভয় পেয়েছিলেন সেটা তিনি বলতে পারবেন না । আজকে তার সত্যিই একটু ভয় লাগছে। গাড়িটা চলছে মুন্সিগঞ্জের দিকে । অনেকটা পথ তিনি পার হয়ে এসেছেন । শহরের বাড়িঘর শেষ হয়ে গেছে অনেক আগেই । এক পাশে খোলা জায়গা দেখা যাচ্ছে । সেখানে নতুনভাবে শহর গড়ে ওঠার জন্য জায়গা বরাদ্দ করা হচ্ছে । নানান বিজ্ঞাপন দেখা যায় টিভিতে । এর ভেতরে তার নিজের একটা হাউজিং প্রজেক্টও আছে । আরমান আহমেদ আবারও সামনের দিকে তাকালেন ।
দিনের বেলাতেই এই স্থানে মানুষ থাকে না খুব একটা । কেবল রাস্তা দিয়ে চলা বাস কিংবা প্রাইভেট কার ছাড়া । আর এখন তো রাত হয়েছে অনেক বেশি । চারিদিকে আর কেউ নেই । তাকে কেবল বলা হয়েছে এই রাস্তা দিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে । কোথায় যেতে হবে সেটা আপনা আপনিই চলে আসবে সামনে । আরমান আহমেদ সামনের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন একভাবে, যদি কিছু দেখা যায় এই মনে করে !
কত সময় তিনি গাড়ি চালিয়েছেন সেটা আরমান আহমেদ বলতে পারবেন না । তার কেবল মনে হচ্ছে তিনি যেন অনন্তকাল ধরে গাড়ি চালিয়েই যাচ্ছেন । একটু যেন ঘুম ঘুম ভাব চলে আসছে ! ঠিক এমন সময়ে রাস্তার ঠিক মাঝে কাউকে দাঁঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন । সাথে সাথেই চোখ থেকে ঘুম চলে গেল । তিনি সজোরে গাড়ির ব্রেক চাপলেন । গাড়িটা একদম লোকটার সামনে গিয়েই থামলো । গাড়ির আলোতে লোকটার চেহারা স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে । চোখ দুটো দিয়ে শান্তভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে । আরমান আহমেদকে বলে দিতে হল না যে সামনে দাঁঁড়ানো এই মানুষটার নামই সোবাহান উদ্দিন, এই লোকটার সাথেই তার ফোনে কথা হয়েছে । এই লোকটাই তার মেয়েকে ধরে নিয়ে গেছে । তিনি এই মানুষটাকেই এতোদিন ধরে খুঁঁজে যাচ্ছেন । আজকে সে তার সামনে চলে এসেছে অথচ তিনি কিছুই বলতে পারছেন না । আরমান আহমেদের মাথায় কেবল একটাই চিন্তা যে তার মেয়ে এখনও এই লোকটার হাতে রয়েছে ।
সোবাহান উদ্দিন তাকে গাড়ি থেকে নামতে ইশারা করলো । আরমান আহমেদ কিছুটা সময় শান্ত ভাবে এদিক ওদিক তাকালেন। এখনও ঠিক বুঝতে পারছেন না যে এখানে চলে এসে তিনি সঠিক কাজ করেছেন কি না ! পকেটে একটা পিস্তল তিনি সাথে করে নিয়ে এসেছেন । কিন্তু জানেন যে এই পিস্তলটা সামনে দাঁঁড়ানো এই লোকটার কাছে কিছুই না । তিনি কিছুই করতে পারবেন না । তবুও সাথে করে নিয়ে এসেছেন এই পিস্তল ।
গাড়ি থেকে বের হয়ে এলেন তিনি । রাস্তার একটু ডান দিকে এসে দাঁঁড়ালেন । সোবাহান উদ্দিন কোন কথা না বলে ডান দিকেই হাটা শুরু করলো । আরমান আহমেদ কি করবেন ঠিক বুঝতে পারলেন না । তারপর পেছন পেছন হাটতে লাগলেন । রাতের অন্ধকারেই হেটে চললেন । প্রথমে খোলা স্থান, তারপর ক্রমেই বন জঙ্গল আসতে লাগলো । মাঝে মাঝে কাদা পানি মাড়িয়ে এগিয়ে যেতে হল । সামনে অন্ধকারের ভেতরে তিনি কিছুই দেখতে পাচ্ছেন না । তবে তার সামনে যে সোবাহান উদ্দিন হেটে চলেছে সেটা ঠিকই বুঝতে পারছেন । একটা অবয়ব ঠিকই দেখতে পাচ্ছেন যেটা তার সামনে সামনে হাটছে।
একটা সময় সামনের অবয়বটা থেমে গেল । তিনিও থেমে গেলেন । ঠিক এই সময় আকাশে মেঘের আড়াল থেকে চাঁঁদ দেখা গেল। চারিদিকটা আলোকিত হয়ে গেল আরও একটু । আরমান আহমেদ লক্ষ্য করলেন যে তিনি ঘন বন-জঙ্গলওয়ালা স্থানে চলে এসেছেন । চারিদিক তাকিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করলেন । বোঝার চেষ্টা করলেন তিনি ঠিক কোথায় এসে পড়েছেন ! কিছু সময় তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ আবিস্কার করলেন তিনি আসলে একটা কবরস্থানে এসে পৌঁঁছেছেন ! চারিদিকে তাকিয়ে পুরানো করবস্থানগুলো খুব ভাল করেই বোঝা যাচ্ছে !
এই লোকটা তাকে কবরস্থানে কেন নিয়ে এসেছে ?
আরমান আহমেদ লক্ষ্য করলেন সোবাহান উদ্দিন একটা বিশেষ কবরের সামনে দাঁঁড়িয়ে আছে । কবরটা অন্য সবগুলো কবর থেকে একটু পরিস্কার । কোন এক সময়ে এর আশেপাশের জঙ্গলগুলো পরিস্কার করা হয়েছে । পাশে একটা শাবল আর কোদাল জাতীয় কিছু পড়ে আছে । সোবাহান উদ্দিন সেই কবর খুঁঁড়তে শুরু করলো । আরমান আহমেদ কি করবেন ঠিক বুঝতে পারছেন না ।
তার কি করা উচিৎ ?
কি করবেন সেটা সত্যিই বুঝতে পারছেন না ।
একবার মনে হল পকেট থেকে পিস্তলটা বের করেই গুলি করে দেন সামনের মানুষটাকে । কিন্তু সেটা মনে হতেই মনে পড়ল যে তাহলে তার মেয়ের কি হবে ! চারিদিকে কোন আওয়াজ শোনা যাচ্ছে না । কেবল কোদালের থপথপ আওয়াজ ছাড়া !
কবরটা খোড়া শেষ হলে তিনি দেখলেন যে সোবাহান উদ্দিন কবরে নেমে পড়লো । তারপরই সেখান থেকে একটা লাশ তুলে নিয়ে আসলো । চাঁদের আলোতে আরমান আহমেদ খানিকটা অবাক হয়েই দেখলেন যে লাশটা কোন সাদা কাপড়ে জড়ানো নেই । বরং সেটা কালো কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখা । লাশটা সামনে রাখলো সে !
এতো সময় পর এই প্রথম সোবাহান উদ্দিন কথা বলে উঠলো । সে বলল, লাশটা এখানে কতদিন ধরে আছে জানেন কি?
আরমান আহমেদ উত্তর দিলেন না । সোবাহান উদ্দিন অবশ্য উত্তরের জন্য অপেক্ষা করলোও না । সে বলতে লাগলো, এখানে সে অপেক্ষা করে আছে! এই স্থানে ! একা ! এইবার সময় এসেছে । তাকে উঠতে হবে ! এইবার সময় এসেছে ! আমি এইবার তার দেখা পাবো !
এই বলে সে অপার্থিবভাবে হাসলো কিছু সময় । তারপর কিছু অদ্ভুত মন্ত্র পড়তে লাগলো । আরমান আহমেদ অবাক হয়ে দেখলেন যে কালো কাপড়ে মোড়ানো লাশটা শূন্যে ভেসে উঠলো । এখান থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন মাথা আর পায়ের দিক দিয়ে সেটাকে দুজন মানুষ সেটা ধরে রেখেছে ।
এরপর ওদের সামনে আবারও সেই গোল বৃত্ত দেখা গেল । সোবাহান উদ্দিন আগে লাশটাকে বৃত্তের ভেতরে যেতে দিল । তারপর নিজে ঢুকলো সেটার ভেতরে । পেছনে ফিরে তাকালো আরমান আহমেদের দিকে । আরমান আহমেদ বুঝলেন তাকে ঢুকতে বলা হচ্ছে । ধীরে পায়ে এগিয়ে গেলেন তিনি । কোথায় যাবেন সেটা তিনি নিজেও জানেন না ।
কয়েকজন মানুষকে তিনি পেছন পেছন আসতে বলেছিলেন । বলেছিলেন এমনভাবে তার উপর নজর রাখতে যাতে তিনি নিজেও যেন টের না পান । কিন্তু এখন তারা আর কোনো খোঁঁজ পাবে না । এবার সত্যি সত্যিই তিনি খানিকটা অসহায় বোধ করলেন !
খোলা আকাশের নীচ থেকে তারা হঠাৎ করে একেবারে একটা বদ্ধ ঘরে এসে পৌঁঁছালেন। আরমান আহমেদ ঘরের এদিক ওদিক তাকাতে লাগলেন । দেওয়ালে দুইটা মশাল জ্বলছে । সেই মশালের আলোতে চারিদিকটা বেশ আলোকিত হয়ে গেছে । ঘরটা তার কাছে অনেক বড় মনে হল । কোন জানালা নেই । একদিকে একটা সিড়ি উঠে গেছে উপরে । সেখানে একটা দরজা দেখা যাচ্ছে । স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে ঘরটা মাটির নিচে । কোন বাড়ির বেজমেন্টে আছেন তিনি । ঘরের ডানদিকের এক কোনে তাকাতেই তিনি একটা চৌকি দেখতে পেলেন । সেটার উপরে কেউ শুয়ে আছে । আরও ভাল করে তাকাতেই দেখতে পেলেন সেখানে নিনিন শুয়ে আছে। নিনিনকে দেখেই সেদিকে দৌঁড়ে গেলেন তিনি ।
চৌকির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন । কতটা দিন পরে নিজের মেয়েকে দেখতে পাচ্ছেন ! চোখ দিয়ে আপনা আপনিই পানি বের হয়ে এল । নিনিনের নাম ধরে ডাক দিলেন বেশ কয়েকবার । কিন্তু তার ঘুম ভাঙ্গলো না । যেমন করে শুয়ে ছিল ঠিক তেমন ভাবেই শুয়ে রইলো সে । তারপর তিনি তার কাধ ধরে ঝাকি দিলেন বেশ কয়েকবার, কিন্তু নিনিন কিছুতেই চোখ খুলে তাকালো না ! এই ঘুম তো স্বাভাবিক না !
আরমান আহমেদ ফিরে তাকালেন সোবাহান উদ্দিনের দিকে । সে তখন কি সব জিনিসপত্র সাজাতে ব্যস্ত । আরমান আহমেদ বললেন, নিনিন আমার ডাক শুনতে পাচ্ছে না কেন ?
সোবাহান উদ্দিন তার দিকে না তাকিয়েই বলল, শুনতে পাবে না । ওকে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে ।
-জাগিয়ে তুলুন ওকে !
আরমান আহমেদ দেখলেন সোবাহান উদ্দিন যে কাজ করছিলো সেটা থামিয়ে দিল । তারপর তার দিকে তাকালো । তার চোখে যেন একটা জ্বলন্ত মশাল দেখতে পেলেন তিনি । সোবাহান উদ্দিন বলল, আমাকে একমাত্র হুকুম করবে আমার গুরুজি। আর কেউ না । আপনি কি করেন না করেন সেটা আপনার নিজের কাছে রাখেন । আর একটা বার যদি উচু গলাতে কথা বলেন তাহলে লেমুটটাকে দিয়ে এখনই আপনার মেয়েকে জ্যান্ত খাইয়ে দিবো !
আরমান আহমেদের পুরো শরীর কেমন যেন দুলে উঠলো । তার পুরো জীবনে এমন করে কেউ কোন দিন তার সাথে কথা বলে নি । বরং তিনিই সবার সাথে এমন করে কথা বলে গিয়েছেন, সবাইকে নিজের ক্ষমতা দেখিয়ে গিয়েছেন, তার আশেপাশের সবাই তাকে ভয় করে গেছে । আর আজকে তিনি ভয় পাচ্ছেন ! তিনি দেখতে পেলেন সেই কুকুরের মত বড় প্রাণীটা তাদের সামনে এসে বসলো । কুকুর যেমন করে বসে ঠিক তেমন ভাবেই । এটার নাম তাহলে লেমুট ! ভাবলেন তিনি ।
সোবাহান উদ্দিন বলল, কই আসুন, বসুন এখানে !
আরমান আহমেদ দেখতে পেলেন যে কালো কাপড়ে মোড়া লাশটার ঠিক পেছনেই তাকে বসতে বলা হচ্ছে । সোবাহান উদ্দিন বলল, বসার আগে উপরের শার্টটা খুলে ফেলুন । পকেটে যে পিস্তল আর মানিব্যাগটা রেখেছেন সেগুলো এক পাশে সরিয়ে রাখুন ।
আরমান আহমেদ কোন প্রতিবাদ না করে তাই করলেন । তারপর বসে পড়লেন ঠিক সেখানেই, যেখানে তাকে বসতে বলা হয়েছে । সোবাহান উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন যে তার চোখ উত্তেজনায় কাঁপছে । তার দিকে তাকিয়ে সে বলল, আমি আপনাকে কত খুঁজেছি ! যখন ভেবেছি হয়তো আপনাকে আর খুঁঁজেই পাবো না তখনই আপনার মেয়ে আমার হাতে এসে পড়ল । এটাকেই বলে নিয়তি । সব কিছু আগে থেকেই লেখা থাকে !
আরমান আহমেদ কোন কথা বললেন না । সোবাহান উদ্দিন বলেই চলল, আপনার কি মনে হয় নি আপনি কিভাবে এতো ক্ষমতার অধিকারী হলেন ? কিভাবে পারলেন এতো কিছু করতে ? যদি ভেবে থাকেন যে কেবল নিজের চেষ্টায় এত কিছু করেছেন তবে ভুল ভাবছেন । এটা আপনার নিয়তিতে লেখা ছিল । প্রতি ১০০ বছরে এমন অল্প কয়েকজন মানুষ জন্ম নেয় যাদের হাতে সব ক্ষমতা এসে জড়ো হয় ।
কিছু সময় সে দম নিলো । তারপর আবার বলল, এতোদিন আমি কেবল আপনার মত কাউকে খুঁঁজেছি । কিন্তু কাউকে খুঁঁজে পাই নি । আপনার মেয়েকে হাতে পেয়েই মনে হয়েছিলো সে-ই বুঝি সেই কাঙ্খিত মানুষ যার ভেতরে আবারও আমার গুরু নতুন ভাবে জন্মাতে পারবে, কিন্তু সে তা ছিল না । সে খুব কাছাকাছি ছিল । তারপরই আমার মাথায় আপনার কথা আসে । আপনার জন্মসাল আর সময়টা আপনার মেয়ের কাছ থেকে জেনে নিতে আমার খুব একটা কষ্ট হয় নি । বুঝতে আর বাকি রইলো না যে আপনিই আসলে সেই মানুষ ।
আরমান আহমেদ চুপ করে তাকিয়ে রইলেন কেবল । কদিন আগে এই সব কথা তার কাছে গাজাখুঁঁড়িই মনে হত কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না । এই কয়দিনে তিনি যা দেখেছেন, যা জানতে পেরেছেন, তাতে করে সত্যিই তার কাছে আর কিছুই অসম্ভব মনে হচ্ছে না । সোবাহান উদ্দিনকে বললেন, আমার মেয়েকে বাসায় পৌঁঁছে দিন । আমি তো চলে এসেছি ।
সোবাহান উদ্দিন হাসলো । তারপর বলল, কেউ কোথাও যাবে না । কেউ না !
আরমান আহমেদ কিছু বলতে যাবেন তখনই অনুভব করলেন যে তার মুখ দিয়ে যেন কোন কথা বের হচ্ছে না । হাতটা আপনা আপনি উঠে চলে এল কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা লাশটার উপরে । সেটার উপরে হাত পড়তেই চমকে উঠলেন তিনি । তার কাছে মনে হল কাপড়ের নিচে একটা জীবন্ত মানুষ রয়েছে । লাশটার শরীরের উষ্ণতা তিনি অনুভব করতে পারছেন !
সোবাহান উদ্দিন নিজের ভেতরের উত্তেজনা অনুভব করতে পারছিল । এতোদিন পরে তার কাজটা শেষ হতে চলেছে । এতো দিনের খোঁঁজ, এতো দিনের অপেক্ষার পরে তার গুরু আবার এই পৃথিবীতে আসতে যাচ্ছে ।
সোবাহান উদ্দিন তার গুরুর আসল নাম কি সেটা কোন দিন জানতে পারে নি । যখন সোবাহান উদ্দিনের সাথে তার দেখা হয় তখন তার অনেক বয়স । শেষ সময় । খুব যত্ন সহকারে তিনি সোবাহান উদ্দিনকে তার ভেতরের সব জ্ঞান শেখাতে শুরু করেন । তারপর তাকে বলে দিতে থাকেন যে তার মৃত্যুর পরে সোবাহান উদ্দিনকে ঠিক কি কি করতে হবে ।
এতোদিন ধরে তাই সে এমন একটা মানুষকেই খুঁজে গেছে । তার গুরু ঠিক যে তিথিতে এই পৃথিবীতে এসেছিলো, আরমান আহমেদের জন্ম ঠিক সেই একই তিথিতে হয়েছিল । এমন একজন মানুষই তার দরকার ছিল ।
সোবাহান উদ্দিন আরমান আহমেদের দিকে তাকালো । তার চোখে মুখে একটা ভয় দেখা যাচ্ছে । সে অনুভব করতে শুরু করেছে । বিড় বিড় করে সোবাহান উদ্দিন মন্ত্র পড়তেই থাকলো । এই তো আস্তে আস্তে সব লক্ষণ ফুটে উঠছে । তিনি আসছেন ! তিনি আসছেন !
তখনই সোবাহান উদ্দিন আরেকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করল ঘরের ভেতরে । একটু যেন আগুনের ফুলকি দেখতে পেল । সেটা মিশে যেতেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো দেওয়ালে একটা বড় বৃত্ত সৃষ্টি হচ্ছে । তীব্র একটা বিস্ময় দেখা দিল তার মনে ।
কেউ তার আস্তানায় ঢোকার চেষ্টা করছে !
কিন্তু কিভাবে ? এটা সম্ভব না ?
এভাবে কেউ চলে আসতে পারে না ! যদি না .....
কিন্তু সে আরমান আহমেদকে ভাল করে সার্চ করে দেখেছে । কোন ব্রিজ এলিমেন্ট তো ছিল না । এমন কিছু সে পায় নি যাতে এমন ভাবে তার আস্তানায় চলে আসতে পারে কেউ। তাহলে কিভাবে আসবে !
সোবাহান উদ্দিন যাকে দেখতে চাইছিলো না সেই মানুষটাই বের হয়ে এল বৃত্তটা থেকে !
রাফায়েল !
জীবনে সে অনেক অতিপ্রাকৃত জন্তু, প্রাণী, অনেক তান্ত্রিকের মুখোমুখি হয়েছে । কিন্তু ঐদিন এই মানুষটার মুখোমুখি হয়ে তীব্র বিস্ময় অনুভব করেছে সে ! এ যেন এই পৃথিবীর বাইরের কেউ ! একে ধারণ করার ক্ষমতা তার নেই !
সোবাহান উদ্দিন এখন কি করবে ?
সামনে দাঁঁড়ানো এই মানুষটার সাথে সে শক্তিতে পারবে না । এটা সে পরিস্কারভাবেই জানে ! এখান থেকেই সে মানুষটার শরীরের শক্তির একটা ধারনা পাচ্ছে । পুরো শরীর ভর্তি অদ্ভুত একটা শক্তি বিকিরন ছড়াচ্ছে ! এমন শক্তির বিচ্ছুরন সে আর কারো মধ্যে দেখে নি !
সোবাহান উদ্দিন আরেকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করলো । কালো কাপড়ে মোড়া তার গুরুর শরীরটা কেমনভাবে যেন নড়ে উঠলো । সেও যেন বুঝতে পেরেছে রাফায়েল নামের মানুষটার উপস্থিতি !
সোবাহান উদ্দিন আর কোন পথ না দেখে লেমুটটার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো । সাথে সাথেই আর দেরি না করে সেটা উঠে দাঁঁড়ালো । রাফায়েলের উপর হামলে পড়তে প্রস্তুত সেটা । এখন তার দরকার সময় । যে কোন ভাবেই রাফায়েল নামের মানুষটাকে আটকে রাখতেই হবে । অন্তত যত সময় না তার গুরু আরমান আহমেদের শরীরে পরিপূর্ণ ভাবে চলে আসতে পারছে ঠিক ততটা সময় !
লেমুটটা একটু পিছিয়ে এসেছে । রাফায়েলের উপর হামলে পড়বে । তাকে লক্ষ্য করে ঝাপ দিল সেটা । সোবাহান উদ্দিল অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে সেটা রাফায়েল পর্যন্ত পৌঁছাতেই পারলো না । মাঝপথেই কিছু একটার সাথে ধাক্কা খেল ।
দেওয়ালের বৃত্ত থেকে অন্য কিছু একটা ছুটে বেরিয়ে এসেছে । হামলে পড়েছে লেমুটটার উপর ।
সোবাহান উদ্দিন অবাক হয়ে দেখলো যে সেটা আর কিছু নয়, আরমান আহমেদের বাসায় ফেলে আসা অন্য লেমুটটা ! দুটো লেমুট এখন একে অন্যের সাথে লড়াই করছে । এতো দিন লেমুটটা তার নিয়ন্ত্রনে ছিল কিন্তু এখন তার বিরুদ্ধেই কাজ করছে ! কেন কাজ করছে সেটা বুঝতে সোবাহান উদ্দিনের খুব একটা কষ্ট হল না ।
সোবাহান উদ্দিন এবার উঠে দাঁঁড়ালো । আর পিছিয়ে যাওয়ার উপায় নেই । এবার হামলা করতেই হবে ! নিজের সমস্ত শক্তি নিয়েই হামলা করতে হবে ।
কিন্তু কিভাবে হামলা করবে সে । শক্তিতে সে পারবে না কিছুতেই । ঝড়ের গতিতে ভাবনা চলছে তার মনে । তখনই চোখ গেল ঘুমন্ত মেয়েটার দিকে । সাথে সাথেই তার মাথায় একটা বুদ্ধি চলে এল । পকেট থেকে দ্রুত দুটো গোল বল বের করলো । সেগুলো দ্রুত ছুড়ে দিল । তবে সেগুলো রাফায়েলের দিকে ছুঁঁড়ে দিল না । ছুঁঁড়ে দিল ঘুমন্ত মেয়েটার দিকে । বলগুলো গিয়ে পড়লো মেয়েটার ঠিক সামনে । রাফায়েল একটু অবাক হয়ে গেল । সে ভেবেছিলো হয়তো তার উপর হামলা করবে । সে সেই ভাবেই প্রস্তুতি নিয়েছিলো । এখন মেয়েটার দিকে বলগুলো ছুঁড়ে দেওয়ায় খানিকটা বিভ্রান্ত হয়ে পড়লো ।
তবে সেটা সামলে নিল মুহুর্তেই । বলগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজের হাতটা দ্রুত নাড়ালো । বলগুলো শূন্যে ভেসে উঠলো । এগুলোকে দুরে সরিয়ে দিতে হবে । তবে তার জন্য পর্যাপ্ত সময় রাফায়েল পেল না । তার আগেই সেগুলো বিস্ফোরিত হয়ে গেল ।
বদ্ধ ঘরের ভেতরে বিস্ফোরনটা খুব বেশি জোড়ে মনে হল । পুরো ঘরটা নড়ে উঠলো যেন ! সোবাহান উদ্দিন দেখতে পেল বিস্ফোরনের আঘাতে রাফায়েল নিজে খানিকটা দুরে গিয়ে ছিটকে পড়েছে । চৌকির উপর শুয়ে থাকা মেয়েটাও উড়ে গিয়ে দেওয়ালের সাথে ধাক্কা খেল । তবে মেয়েটার জ্ঞান ফিরলো না । সোবাহান উদ্দিন যে মন্ত্র পড়ে তাকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছে তাতে কিছুতেই মেয়েটার ঘুম ভাঙ্গবে না !
সোবাহান উদ্দিনের মুখে হাসি ফুটলো । যাক, ঘায়েল করা গেছে । এবার আরও জোড়ে হামলা করতে হবে বেটার উপর ! নিজের মুখ খুলে কিছু পড়তে যাবে তার আগেই লক্ষ্য করলো সে কিছু পড়তেই পারছে না । মুখ যেন আটকে গেছে । তার কাছে মনে হল কেউ যেন সেটা আটকে ধরেছে । একটুও নড়াতে পারছে না । তারপরই বুকে কিছু একটা এসে লাগলো । কেউ যেন লোহার বিম দিয়ে তার বুকে আঘাত করেছে ! সে একেবারে উড়ে গিয়ে পড়লো পেছনের দেওয়ালে । দম বন্ধ হয়ে গেল যেন তার । নিঃশ্বাস নিতে পারলো না কিছু সময় । বুকের উপর ভারি কিছু একটার চাপ অনুভব করলো । যেন বড় একটা পাথর সেখানে চেপে বসেছে । সে কিছুতেই সেটা নড়াতে পারলো না ।
সোবাহান উদ্দিন চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো রাফায়েল নামের মানুষটা এক টান দিয়ে আরমান আহমেদকে পেছনে সরিয়ে নিয়ে এল । লাশের উপর থেকে হাত সরিয়ে ফেলেছে সে !
সোবাহান উদ্দিনের মুখ দিয়ে একটা চিৎকার বেরিয়ে এল কেবল । এতোদিনের পরিশ্রম সব শেষ হয়ে গেল । রাফায়েল লাশটার সামনে এসে দাঁঁড়ালো । কিছু যেন দেখছে । তারপর জ্বলতে থাকা আগুনটা তুলে নিয়ে সরাসরি লাশের উপর ফেলে দিল । মুহুর্তের ভেতরেই তাতে আগুন লেগে গেল । সোবাহান উদ্দিন কেবল চেয়ে চেয়ে দেখলো সেদিকে !
রাফায়েল এবার ধীরে পায়ে এগিয়ে এল তার দিকে । তারপর সোবাহান উদ্দিনের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার গুরু "এফিস্টাকাস" আর কোন দিন এই পৃথিবীতে আসবে না । বুঝেছো ? কোন ভাবেই না ! এখন যদি বাঁচতে চাও তাহলে নিনিনের জ্ঞান ফেরাও !
সোবাহান উদ্দিন জানে সে যদি এভাবেই মারা যায় তাহলে নিনিনের জ্ঞান ফেরানো প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে ! তার একবার মনে হল যে এই কাজটা সে করবে না, কিন্তু বুকের ভেতরে চাপ অনুভব করতেই সেই চিন্তা বাদ দিয়ে দিল । ঠিক তখনই তার কানে কানে কেউ যেন কিছু বলে গেল, কয়েকটা মাত্র শব্দ, "এখন নয়, পরে । সময় আবারও আসবে" ।
তার গুরু আবারও তার সাথে যোগাযোগ করেছে !
কিভাবে ?
লাশটা তো পুড়ে গেছে ! ওটাই তো একমাত্র পথ ছিল ! সোবাহান উদ্দিন কিছু বুঝতে পারছিলো না । তবে এই টুকু বুঝতে পারলো যে এই যুদ্ধে সে পরাজিত হয়েছে ।
সোবাহান উদ্দিন সাথে সাথেই বলল, আমি এখনই ওর জ্ঞান ফিরিয়ে দিচ্ছি !
-আর কোন দিন এদের পেছনে আসবে ?
-না না ! আর কোন দিন আসবো না !
-আবার যদি জানতে পারি, তাহলে ....
-আমি আর আসবো না । আর না ! আমাকে ছেড়ে দাও !
আরমান আহমেদের এতো সময় হুস ছিল না । যখন তার হুস ফিরে এল তখন দেখতে পেলেন যে সোবাহান উদ্দিন নামের মানুষটা মাটিতে শুয়ে আছে । রাফায়েল দাঁঁড়িয়ে রয়েছে তার সামনে । তিনি কিছুই বুঝতে পারছিলেন না । কিভাবে এসব হল ! রাফায়েল কিভাবে এখানে আসলো ?
কিন্তু অন্য কিছু একটা তার মনযোগ আকর্ষণ করে নিল ।
-বাবা !
নিনিন তাকে ডাকছে কাতর স্বরে ।
আরমান আহমেদ দৌঁড়ে গেলেন সেদিকে !
-তুই ঠিক আছিস মা !
রাফায়েল বলল,
-একটু আহত হয়েছে । সম্ভবত হাড় ভেঙ্গেছে ! বিস্ফোরণটা আমি সময় মত আটকাতে পারি নি ।
আরমান আহমেদ তীব্র একটা ক্রোধ অনূভব করলেন । ঐ সোবাহান উদ্দিনকে তিনি মেরে ফেলবেন ।
-আরমান সাহেব !
পেছন থেকে রাফায়েলের আওয়াজ শুনতে পেলেন তিনি ।
-এখন এসবের সময় না । আসুন, সবার আগে নিনিনকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে !
আরমান আহমেদ তার রাগটাকে দমন করে নিলেন । তারপর নিনিনকে কোলে তুলে নিলেন । আরমান আহমেদ দেখলেন দেওয়ালের মাঝে সেই গোল বৃত্ত দেখা যাচ্ছে । রাফায়েল চোখের ইশারাতে সেটার ভেতরে ঢুকতে বলল । তিনি সেই বৃত্তের ভেতরে প্রবেশ করলেন । কয়েক মুহূর্ত পরেই নিজেকে আবারও সেই গাড়ির কাছে আবিস্কার করলেন । ঠিক যেখানে তার গাড়িটা রেখে তিনি সোবাহান উদ্দিনের পিছু নিয়েছিলেন ।
-আপনি তাহলে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যান ! আমাদের হয়তো আর দেখা হবে না, দরকারও হয়তো পড়বে না !
গাড়িতে উঠতে উঠতে আরমান আহমেদ রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমি সরি, আপনাকে না বলেই গিয়েছিলাম ! আসলে বাবার মন তো ! অন্য কিছু ভাবতে পারি নি ।
-সমস্যা নেই ।
-একটা প্রশ্ন করতে পারি ?
-হ্যা ।
-আপনি কিভাবে গিয়ে হাজির হলেন সেখানে ? আই মিন এই পোর্টালটা তৈরির জন্য যে একটা ব্রিজ এলিমেন্ট লাগে, পেঁচার হাড়, ওটা তো ছিল না !
রাফায়েল হাসলো । বলল, পেঁচার হাড়টা তো প্রধান এলিমেন্ট না ।
-তাহলে ?
-হাতের ভেতরে ঢুকিয়ে দেওয়া স্পেলটাই হচ্ছে আসল ! আর আমি হাড়ের ভেতরে কোন স্পেল ঢুকাই নি । অন্য কিছুর ভেতরে ঢুকিয়েছি !
-কিসের ভেতরে ?
রাফায়েল আবারও হাসলো ! তারপর বলল, আপনার শরীরের ভেতরে ! এবং এটা আজকে না, যেদিন আপনি আমার বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছিলেন সেদিনই । মনে আছে, আপনি আমার ঘরের ভেতরে কিছুটা সময় অন্ধকার একটা এড়িয়া পার হয়ে এসেছিলেন ? ঠিক ওই সময়ে ।
-তার মানে আমি যেখানে যাবো আপনি সেখানে গিয়েই হাজির হতে পারবেন ?
রাফায়েল হাসলো আবারও । আর কোন কথা না বলে হাটতে লাগলো । আরমান আহমেদ দেখতে পেলেন লেমুট নামের প্রাণীটা রাফায়েলের পেছন পেছন হাটছে । অন্ধকারের ভেতরে সেটা হারিয়ে গেল !
পরিশিষ্টঃ
সোবাহান উদ্দিন সেই নির্দিষ্ট কবরের সামনে এসে বসে আছে । চারিদিকে একটা বৃত্তের মত চক্র একেঁছে সে । কোন অতিপ্রাকৃত শক্তি এখন তাকে স্পর্শ করতে পারবে না । তার গুরুর ভস্ম হয়ে যাওয়া ছাইটুকু তার সামনে রাখা । সেটা সামনে রেখেই সে মন্ত্র পাঠ শুরু করেছে ।
কিছু একটা পথ এখনই বের হবে । সে শুনতে পেয়েছে ।
তাকে বলা হয়েছে সময় পরে আসবে !
কিন্তু কিভাবে আসবে !
সে এক মনে মন্ত্র জপ করতে থাকলো । কোন না কোন নির্দেশনা ঠিকই পাওয়া যাবে !
আরমান আহমেদ ডাক্তারের দিকে ফিরে তাকালেন । এতো সময় তিনি আইসিইউতে শুয়ে থাকা তার মেয়ের দিকে তাকিয়ে ছিলেন । ডাক্তার বলল, স্যার, সুসংবাদ আছে ! আমরা ভেবেছিলাম হয়তো বুকের হাড় ভেঙ্গেছে তবে এখন মনে হচ্ছে ভাঙ্গে নি । একটু ফ্র্যাকচার হয়েছে মাত্র । মাস খানেকের মধ্যেই নিনিন ঠিক হয়ে যাবে !
আরমান আহমেদ সেই কথার জবাব দিলেন না । আবারও ফিরে তাকালেন মেয়ের দিকে । কিছুটা স্বস্তিবোধ করছেন তিনি । অনেক দিন পরে তার মনের ভেতরের সেই অসহায়ত্ব বোধটা কেটে গেছে । এখন আবারও নিজেকে খানিকটা ক্ষমতাধর ভাবতে শুরু করেছেন ।
হাসপাতালের পার্কিংলটে গাড়ির কাছে যেতেই তার ফোনে একটা ফোন এসে হাজির হল ।
-হ্যা বল !
-স্যার আমরা রেডি ! টারগেট কবর স্থানে বসে আছে । আগুন জ্বেলে কিছু করছে । একেবারে খোলা স্থান ।
-ক্লিয়ার শট !
-জি, স্যার ! আমরা মোট পাঁচ জন পাঁচ দিক থেকে কাভার করছি । শ্যাল উই গো !
-টেক ইট ! টেক দ্য শট !
ফোনের ভেতরেই তিনি গুলির আওয়াজ শুনতে পেলেন । তার কিছু সময় পরেই ফোনের ওপাশ থেকে আওয়াজ শোনা গেল । স্যার, টার্গেট ডাউন !
-জ্বালিয়ে দাও ! একটু ছাইও যেন না থাকে !
-ওকে স্যার !
তিনি গাড়ির ভেতরে উঠে বসলেন । এখন একটু শান্তি লাগছে । তার উপর আঘাত করা মানুষকে তিনি জীবিত রাখতে পারেন না ।
রাফায়েল সিরিজ ১৪
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে আগস্ট, ২০১৯ রাত ১০:২৩