বাসর রাত নিয়ে একটা মেয়ের কত রকম কল্পনা থাকে । যখন থেকে তার ভেতরে নারীত্বের ব্যাপারটা এসে হাজির হয় তখন থেকেই অন্য অনেক স্বপ্নের মত এই বাসররাত নিয়ে একটা স্বপ্ন এসে হাজির হয় তার মনে । এমন একটা স্বপ্ন যেটা মনে আসতেই তার মুখে আপনা আপনিই একটা হাসি চলে আসে । নিজের কাছেই নিজে লজ্জা পায় । এই স্বপ্নটার কোন শ্রেণী বিভাগ হয় না । সমাজের ধনী গরিব সুন্দর অসুন্দর সব মেয়েই এই স্বপ্নটা দেখতে ভালবাসে । নিজের মত করে সাজিয়ে নেয় ।
সাবরিনার কত রকম কল্পনা ছিল কিন্তু যখন সত্যি সত্যিই সে বাসর ঘরে বসে আছে তখন সে সবের কিছুই হচ্ছে না । সে চুপ করে বসে আছে নিজের বাসর ঘরে । যদিও এটাকে কোন ভাবেই বাসর ঘর বলা যাবে না । ঘরটা কোন ফুল দিয়ে সাজানো হয় নি । এমন কি খাটে একটা নতুন চাদর পর্যন্ত নেই । যখন এ বাড়িতে উঠে আসে তখন সাবরিনার মনে হয়েছিলো যেন ও কোন মৃত্যুপুরিতে এসে হাজির হয়েছে। পুরো বাড়িতে সম্ভবত ওর নতুন স্বামী সাফায়েত আর ও ছাড়া আর কেউ নেই । অবশ্য বিয়ের আগে থেকেই ও জানতো যে সাফায়েত এতিম, ঠিক ওর মতই । কেউ ওর বাসায় থাকবে না এটাই স্বাভাবিক ।
সাবরিনা চুপ করে অপেক্ষা করতে থাকে । ওকে বাসায় রেখেই সাফায়েত একটু আগে বাইরে গেছে । ওকে বলে গেছে যে ও বাইরে থেকে তালা দিয়ে যাচ্ছে । একটু পরেই ফিরে আসবে । ঘরে খাওয়ার মত কোন জিনিস পত্র নেই । সকালে উঠে কিছু রান্না করা লাগবে সেই জন্যই বাজার করতে হবে । সাবরিনা একবার বলার চেষ্টা করেছিলো যে রাতে কিছু আনা লাগবে না । সকালে আনলেই চলবে কিন্তু সেটা বলতে পারলো না । কেন বলতে পারলো না কে জানে । যাওয়ার আগে সাফায়েত আরও বলে গেল যে ও চাইলে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখতে পারে । নয়তো ওর জন্য অপেক্ষা করতে পারে । ওর আসতে খুব বেশি সময় লাগবে না ।
মফস্বলের ছোট্ট একটা এতিম খানাতে সাবরিনার বেড়ে ওঠা । এসএসসি পাশের পরপরই তাকে ঐ এতিমখানা ছেড়ে দিতে হয় । সেখান থেকে শহরের একটা খাবার রেস্টুরেন্টে কাজ নেয় ও । ওদের ঐ রেস্টুরেন্টের সব ওয়েটারই ছিল মেয়ে । এই জন্য রেস্টুরেন্ট টা বেশ জনপ্রিয় ছিল পুরো শহর জুড়ে । সাবরিনা দেখতে শুনতেও মোটামুটি ভালই ছিল । তাই একটু পড়াশুনা কম জানা থাকলেও রেস্টুরেন্টের মালিক তাকে কাজে নিয়ে নেয় । রেস্টুরেন্টের পেছনে একটা রুমে সব মেয়েদের সাথে থাকার একটা ব্যবস্থাও হয়ে গিয়েছিলো । মালিকই লোকটা ভাল ছিল ।
তারপরই একদিন সাফায়েত নামের মানুষটার সাথে দেখা হয় । ওদের রেস্টুরেন্টে নিয়মিত খেতে আসতো । সম্ভবত রেস্টুরেন্টের আশে পাশেই তার অফিস ছিল । এই জন্য তাদের এখানে খাওয়া দাওয়া করতে আসতো । তারপর একদিন হঠাৎ করেই তার মালিক তাকে ডেকে সাফায়েত নামের ছেলেটার কথা বলে । মালিক তাকে জানায় যে সাফায়েত তাকে বিয়ে করতে চায় । বিশেষ করে তার এই জগতে কেউ নেই, এই কথাটা জেনেই বিয়ের করতে আগ্রহী হয়েছে । সাফায়েত নামের মানুষটা নিজেও নাকি এতিম ।
প্রথম প্রথম সাবরিনা একটু দ্বিধার ভেতরে থাকলেও কয়েকদিন পরেই সে রাজি হয়ে যায় । সাফায়েতও বিয়ের জন্য একটু তাড়া দিচ্ছিলো কারন তার অফিস থেকে তাকে বদলি করে দিয়েছে । কদিন বাদের সে এই শহর ছেড়ে চলে যাবে । তাই সাবরিনা আর অমত করে নি । বিয়ের দুদিন আগেই সাফায়েত ওকে জানালো যে ওর নতুন বাসা সে নিয়ে নিয়েছে । বিয়ের পরই তাকে সেখানে নিয়ে যাবে । সেখান থেকেই তাদের নতুন জীবন শুরু হবে ।
কাজী অফিসে বিয়ে তারপর রেস্টুরেন্টে কাজ টা মেয়েদের সাথে একসাথে দুপুরের খাবার খেয়ে সাবরিনা একটা ভাড়া করা মাইক্রোতে উঠে বসলো । ওদের কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার সময় সাবরিনা র কেমন কান্না পাচ্ছিলো । বিয়ের সময় মেয়েরা তার মা বাব ভাইকে জড়িয়ে ধরে কান্না কাটি করে কিন্তু সাবরিনা র তো এমন কেউ নেই । এরাই হচ্ছে ওর সব থেকে কাছের মানুষ ।
যখন ওরা এই বাসাতে এসে হাজির হয় তখন প্রায় বিকেল হয়ে গেছে । মাইক্রোতে করে আসার সময় সাবরিনা চারিপাশে তাকিয়ে দেখছিলো । একটা সময় লক্ষ্য করলো লোকালয় ছেলে জায়গাটা বেশ ভেতরে যাচ্ছে । শাফায়েত যেন ওর মনের কথা ধরতে পেরেই বলল
-আমার এনজিও টা অনেকটা শহর ছেড়ে ভেতরে । আমি যেখানে থাকবো সেখান থেকে অফিসটা একটু কাছে হবে তাই কাছাকাছি বাসা নিয়েছি ।
সাবরিনা একটু হাসলো । সাফায়েত আবার বলল
-আসলে যেন অফিস থেকে এসে দ্রুত দুপুরের খাবারটা খেয়ে যেতে পারি এই জন্য ! যদি তোমার সেখানে মন না টেকে তাহলে সামনের মাসেই আবার নতুন বাসা খুজবো ।
সাবরিনা বলল
-আরে না না । আমি কি তাই বলেছি ? এখন আপনার যা সুবিধা হবে সেটাই করবেন । যখন আমাদের বাবু হবে তখন না হয় শহরের কাছে বাসা নেওয়া যাবে !
কথা বলতেই সাবরিনা দেখলো সাফায়েত কেমন যেন হাসলো । হাসির কারনটা একটু পরেই বুঝতে পারলো ও । সবে মাত্র ওদের বিয়েটা হয়েছে । এখনও ওদের বাসররাত পর্যন্ত হয় নি আর এখনই সাবরিনা ওদের বাচ্চার কথা তুলে ফেলেছে । কথাটা মনে হতেই সাবরিনা বেশ লজ্জা পেয়ে গেল । সাফায়েতের থেকে মুখ সরিয়ে আবারও বাইরের দিকে তাকালো ।
সাবরিনা নিজের বিছানার উপর থেকে নেমে এল । বিছানার চাদরটা একটু টেনেটুনে ঠিক করে নিল । তারপর পুরো ঘরময় হাটতে লাগলো । বাইরে সন্ধ্যা নেমে এসেছে । একটু পরেই ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসবে । সাবরিনার মনে হল এখনই একটা আলোর ব্যবস্থা করা ভাল । নয়তো এই একা বাড়িতে ওকে অন্ধকারের ভেতরে বসে থাকতে হবে । সাফায়েত বলে গেছে এই বাসাতে এখনও বিদ্যুৎের কোন ব্যবস্থা করা নি । তবে দুই একদিনের মাঝেই ও সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে ফেলবে । তা ছাড়া একটা ব্যাটারীও কথা চলছে । কাল পরশুর মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে । এই দুটো দিন ওকে একটা কষ্ট করতে হবে ।
পুরো ঘরে একবার চোখ বুলিয়েও সাবরিনা মোমবাতি কিংবা হ্যারিক্যান জাতীয় কিছু পেল না । বাইরের ঘরে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে । সাবরিনা বইরের ঘরে বেরিয়ে এল । এই ঘরটার একই সাথে ড্রয়িং আর খাবার ঘর হিসাবে ব্যব হার হবে । এটার ঠিক ডান দিকে আছে রান্না ঘর । আর ওদের ঘরের দরজার পাশেই আছে বাধরুম । তার পাশেই আরেকটা রুম আছে । ওটা এখনও ঠিক পরিস্কার করা হয় নি । আপাতত দুইটা ঘর ওদের ব্যবহারের জন্য ঠিক করা হয়েছে । সাবরিনা ঠিক করলো আগামীকালই সব ঘরদোর পরিস্কার পরিছন্ন করে ফেলবে । নিজের মত করে গুছিয়ে নেবে সব কিছু । এখন থেকে এটাই হচ্ছে তার নিজের সংসার ।
রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেল । সেখানে কিছু একটা পাওয়া যাবে । ওর হাতে কম দামি মোবাইল ফোনটা ধরা । সেটার ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে সে চারিদিক দেখতে লাগলো । চারিপাশটা এখনই কেমন অন্ধকার হয়ে এসেছে । কিন্তু রান্না ঘরেও কোন মোমবাতি কিংবা কুপি জাতীয় কিছু পেল না । ঠিক সেই সময়ে খুট করে আওয়াজ শুনতে পেল ও ! সারিনার মনে হল হয়তো সাফায়েত ফিরে এসেছে । রান্না ঘর থেকে চট জলদি বের হয়ে এল । কিন্তু দরজা খুলে কেউ বের হয়ে এল না । তার পরেই সে আবার আওয়াজটা শুনতে পেল ।
আওয়াজটা সদর দরজা থেকে আসছে না । আওয়াজটা আসছে বাথরুমের পাশের রুম থেকে । সাবরিনা পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল ঘরটার কাছে । সাফায়েত বলেছিলো এই ঘরটা অনেক দিন ধরেই খোলা হয় না । সাবরিনার মনে হল হয়তো ঐ বন্ধ ঘরের ভেতরে ইদুর ঘোরাফেরা করছে । তাই আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে কিন্তু তখনই আবার আওয়াজটা শুনতে পেল ।
সাবরিনার আর যাই মনে হোক না এইটা অন্তত পরিস্কার বুঝতে পারলো যে এই আওয়াজটা কোন ইদুর বেড়ালের করা নয় । আওয়াজটা শুনে মনে হচ্ছে কেউ যেন কাঁচে ধাক্কা দিচ্ছে । এবং সেটা আসছে ঐ ঘর থেকে । আস্ছা ঐ ঘরের জানালার কাঁচ ধরে কেউ ধা্ক্কা দিচ্ছে না তো ?
হয়তো ঐদিকে কেউ এসেছে । কাছেই কোন গ্রাম আছে সাফায়েত বলেছিলো । সাবরিনা আর কিছু না চিন্তা করে ঐ দরজার সামনে চলে গল । দরজাতে কোন তালা মারা নেই । কেবল হুক দিয়ে আটকানো রয়েছে । সেটা খুলতে সাবরিনার খুব একটা কষ্ট হল না ।
দরজা খুলতেই মোবাইলের আলোটা সামনের দিকে এঘিয়ে ধরলো । এবং সাথে সাথেই বেশ অবাক হয়ে গেল । সাবরিনা ঘরটাকে বেশ বড় মনে করেছিলো । ওদের শোবার ঘরটা আর এই ঘরটা পাশাপাশি । মাঝে একটা বাথরুম আছে । সেই হিসাবে ওর শোবার ঘরটা যত ভেতরে যত খানি জায়গা থাকা দরকার । প্রস্থে ঘর দুটোর আয়তন প্রায় একই রকম কিন্তু লম্বাতে এতো কম মনে হচ্ছে কেন ? ঘরটা যেন শুরু হতেই শেষ হয়ে গেছে । মোবাইলের ফ্ল্যাশ আলোতেই সামনের দিকে তাকালো । ঘরটাকে বেশ পরিস্কার পরিচ্ছন্নই মনে হল ওর কাছে । দেওয়ালে ঠিক মাঝে একটা বড় আয়না সেট করা আছে । তা ছাড়া এই ঘরে আর কিছু নেই । এমন কি একটা জানালাও নেই !
জানালা নেই কথাটা মনে হতেই সাবরিনা খানিকটা দ্বিধান্বিত হয়ে পড়লো । যদি জানলা না থাকবে তাহলে কাঁচে টোকার দেওয়ার আওয়াজ টা কোথা থেকে আসবে ? তাহলে কি অন্য কোথা থেকে আওয়াজটা আসছে ? ওর শোবার ঘর থেকে আসছে আওয়াজটা ?
ওর প্রশ্নের জবাব দিতেই যেন আবারও আওয়াজটা শুনতে পেল ও । এবার বেশ জোড়ে । আওয়াজটা যে কাঁচে টোকা দেওয়ার সেই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই । এবং আওয়াজটা এতোই কাছে মনে হচ্ছে যে সাবরিনার মনের ভেতরে এবার একটু ভয় জন্মাতে শুরু করলো । সে তাকিয়ে রইলো দেওয়ালের মাঝে বসানো ঐ কাঁচের আয়নার দিকে । সাবরিনার কোন সন্দেহ রইলো না যে আওয়াজটা আসছে আয়নার ওপাশ থেকে । চিন্তাটা মনের ভেতরে আসতেই শিরদাড় দিয়ে একটা ঠান্ডা বাতাশ বয়ে গেল ।
সাবরিনা এক ভাবে তাকিয়ে রইলো আয়নাটার দিকে । হাতে ধরা মোবাইলের ফ্ল্যাশ আলোতে নিজের চেহারাটা আয়নাতে খুব ভাল করেই দেখা যাচ্ছে । এখন ওর কি করা উচিৎ ?
এই ঘরের দরজা বন্ধ করে বাইরে চলে যাবে ? নাকি দেখার চেষ্টা করবে আয়নার ওপাশ থেকে আওয়াজটা কিভাবে আসছে । নাকি সব টুকুই ওর মনের ভুল ।
নাহ মনের ভুল হতে পারে না । এখনও আওয়াজটা আসছে পরিস্কার ভাবেই । সাবরিনার মনে হল কেউ যেন আয়নাতে মাথা ঠুকছে ।
আচ্ছা আয়নার ওপাশে কেউ নেই তো ? কাউকে আটকে রাখা হয় নি তো । কোন একটা মুভিতে সাবরিনা দেখে ছিল । বাড়ির ভেতরে একটা গুপ্ত কক্ষ থাকে সেখানে মেয়েটা আটকে যায় । তারপর আস্তে আস্তে সেখানেই মারা যায় ।
সাবরিনা আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় । আয়নার উপর হাত রাখলো । হাত রাখার সাথে সাথে আওয়াজটা কমে গেল । সাবরিনা অনেকটা সময় অপেক্ষা করলো । কিন্তু কোন আওয়াজ এল না আর । যখন এক পা পিছিয়ে এসেছে তখনই আরেকটা নতুন আওয়াজ শুনতে পেল । কেউ যেন হাহাকার করছে । ছাড়া পাওয়ার জন্য চিৎকার করছে । এবং এই আওয়াজ গুলো যে আয়নার ভেতর থেকে আসছে সেই বিষয়ে সাবরিনার কোন সন্দেহ নেই । মনে মনে ঠিক করেই ফেলল । আয়নার ওপাশে কি আসে সেটা ওকে দেখতেই হবে । সাফায়েত আসা পর্যন্ত কি অপেক্ষা করবে ?
না । এতো সময় ও অপেক্ষা করতে পারবে না । আর সাফায়েত কখন আসবে কোন ঠিক নেই । এই সময়ে সে কি করবে ? তার থেকে এই কাজটা করলে হয়তো খানিকটা সময় কাটবে । সাবরিনা আয়নাটাকে উপর থেকে নিচে পরীক্ষা করে দেখলো । দেওয়ালের সাথে চার কোনে চারটা স্ক্রু দিয়ে আটকাবো ।
একবার মনে হল আয়নাকে ভেঙ্গে ফেলে সে কিন্তু সেটা করলো না । রান্না ঘরে গিয়ে হাজির হল । যা খুজছিলো সেটা পেয়ে গেল মুহুর্তের ভেতরে । একটা খুন্তি । এটা দিয়ে বড় বড় স্ক্রু খুলতে মোটেই কষ্ট হবে না ।
সাবরিনা মনে মনে উত্তেজনা বোধ করতে লাগলো । আয়নার ওপাশে সে কি দেখতে পাবে এখনও জানে না । এই বাড়িটা অনেক পূরানো । কি আছে কে জানে !
আয়না খুলতে ওর খুব বেশি সমস্যা হল না । সাবরিনা মনে হল এই আয়নাটা মাঝে মাঝেই দেওয়াল থেকে খুলে আনা হয় । নয়তো এতো সহজে খুলে আসার কথা না ।
আয়নাটা সাবধানে খুলে আনতেই একটা তীব্র দুর্গন্ধ এসে নাকে লাগলো । গন্ধটা এতোটাই তীব্র যে সাবরিনার বমি চেপে গেল । কয়েকবার চেষ্টা করেও সেটা আটকাতে পারলো না ।
আয়নাটা এক পাশে সরিয়ে রেখে কিছু ধরে ও বমি করলো । তারপরও আরও কিছুটা সময় লাগলো নিজেকে সুস্থির করতে । সত্যি সত্যি আয়নার পেছনে একটা ঘর দেখা যাচ্ছে । সাবরিনা ভেতরে ঢুকতে চাইলো কিন্তু একটা তীব্র কৌতুহল ওকে ঘরটার ভেতরে টানতে লাগলো । যখন ভেতরে প্রবেশ করলো তখন মনে হল যে এই ঘরে হয়তো না আসাটাই ওর ভাল ছিল । এসব না দেখাই ভাল ছিল ।
মোবাইলের ফ্ল্যাশের আলোতে সাবরিনা দেখতে পেল পুরো ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বেশ কয়েকটা মৃত দেহ । লাশ গুলোর বিভিন্ন স্থানে কেউ যেন খুবলে খুবলে খেয়েছে । কি ভয়ংকর দেখাচ্ছে সেগুলো । সব গুলোই যে মেয়ের সেটা চিনতে ওর কষ্ট হল না । পঁচা গলা লাশ গুলোর দিকে সাবরিনা তাকিয়ে রইলো অপলক চোখে । বারবার মনে হচ্ছে খুব অশুভ কিছুর ভেতরে ও চলে এসেছে । কেবল এই ঘরে নয় পুরো বাড়িটাই একটা মৃত্যু পরি ।
ঠিক তখনই পেছনে আওয়াজ শুনতে পেল । চরকির মত পেছনে ঘুরে তাকিয়ে দেখে সাফায়েত দাড়িয়ে আছে । সাফায়েত কে দেখে ওর মনে সাহস ফিরে আসার কথা কিন্তু সাফায়েত কে দেখে ওর মনের ভয়টা যেন আরও বেড়ে গেল । সাফায়েতের চোখে যেন আগুন জ্বলছে । ওর দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে । সাবরিনা হঠাৎ বলল
-এই বাসাটা তোমার নিজের, তুমি এটা ভাড়া নাও নি । তাই না ?
সাফায়েত অস্বীকার করার কোন চেষ্টাই করলো না । সাফায়েত বুঝতে পেরেছে এই সাবরিনার কাছে এখন লুকিয়ে রাখার কোন দরকার নেই । মেয়েটা এখনওর হাতে বন্দি । চাইলেও মেয়েটা এখান থেকে পালাতে পারবে না । সাফায়েত বলল
-তুমি ঠিকই ধরেছো । এই বাড়ি আমারই ।
-এই মেয়ে গুলোকেও তুমিই মেরেছো ?
সাফায়েত এই প্রশ্নের জবাব দিল না । কেবল হাসলো । তারপর বলল
-তোমাকে আমার আরও কয়েকদিন বাঁচিয়ে রাখার ইচ্ছে ছিল । অন্তত আজকের বাসরটা তো হতেই পারতো আমাদের । কিন্তু বেশি কৌতুহল দেখিয়ে ফেলেছো তুমি !
এই বলে সাফায়েত তার মাথার চুলের একটা অংশ ধরে টান দিতেই সেটা খুলে চলে এল । সাবরিনা দেখলো সাফায়েতের মাথাটা চকচকে টাক । তবে এই টাক মাথাটা যেন আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে । সাবরিনা ভয় পেতে ভুলে গেছে । কেবল অবাক হতে থাকিয়ে আছে । সাফায়েত নামের মানুষটার কান দুটো আরও একটু লম্বা হয়ে গেছে । খানিকটা খাড়া খরগোসের মত ।
সাবরিনার হাতের মোবাইলের ফ্ল্যাশটা এখনও ধরা রয়েছে । একটু একটু কাঁপছে ওর হাতটা । এতোক্ষনে ওর বিশ্ময়টা বেড়ে ভয়ে রূপান্তর হচ্ছে । সামনে দাড়ানো সাফায়েত নামের প্রাণীটা আবার বলল
-অন্য ভাবে নিও না প্লিজ কিন্তু আমার আর কিছু করার নেই । আমাকে বেঁচে থাকার জন্য তোমার মত কাউকে দরকার হয় । বুঝতেই পারছো !
সাবরিনা দেখতে পেল এবার প্রাণীটা ওর দিকে এগিয়ে আসছে । আস্তে আস্তে যেন গতি বাড়াচ্ছে । এখনই ওর উপর ঝাপিয়ে পড়বে । যখনই একদম কাছে চলে এল সে সাবরিনা মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইট টা চট করে বন্ধ করে দিল । সাথে সাথে ঘরটা একেবারে অন্ধকার হয়ে গেল । সাবরিনা আগেই দেখে রেখেছিলো কোন দিন দিকে পালাতে হবে । এক ডান দিকে সরে এসে সে সাফায়েতকে কাটিয়ে সোজা দৌড় দিল গুপ্ত ঘরের দরজার দিকে । সেটা দিয়ে বের হতে পর সময় লাগলো না । তারপরেই সামনের ঘরের দরজা । কিন্তু সেটা পার হওয়ার আগেও পেছন থেকে ওর উপর কেউ ঝাপিয়ে পড়লো যেন । কে ঝাপিয়ে পড়লো সেটা বুঝতে কষ্ট হল না ।
সাবরিনা উপুর হয়ে পড়ে গলে । তারপরই অনুভব করলো সাফায়েত ওর শরীরের পেছন থেকে ঝাপতে ধরেছে । আস্তে আস্তে ওর শরীরের উপরে উঠছে । সাবরিনার হাত দিয়ে কিছু একটা খুজতে শুরু করলো । কিছু যদি বাধে তাই হবে । যখন সাফায়েত ওর মুখটা সাবরিনার মুখের কাছে নিয়ে এসেছে তখনই সাবরিনার হাতে কিছু বাঁধলো । রান্নাঘর থেকে আনা সেই খুন্তিটা ।
সাফায়েতের গরম নাকের নিঃশ্বাস ওর কাধের কাছে পড়ছে । সে সাবরিনার নিচের পায়জা খোলার চেষ্টা করছে । তাই এদিকে সাবরিনার কি করছে সেদিকে তার খুব একটা লক্ষ্য নেই । তখনই সুযোগটা এল । সাবরিনা অনুমানের উপর ভিত্তি করেই খুন্তিটা সাফায়েতের মুখের বরাবর চালিয়ে দিলো উল্টো হাতে । হাতে একটু মোচড় লাগলো বটে কিন্তু সাথে সাথেই একটা তীব্র চিৎকার শুনতে পেল সে । তারপরেরই শরীর উপর থেকে ভারটা সরে গেল । সাবরিনা চট করে উঠে দাড়ালো । তারপর আর দেরি করলো না । দরজা দিয়ে বেরিয়ে চলে এল । ড্রয়িং রুমে । মনের ভেতরে একটু ভয় ছিল যে হয়তো সদর দরজাটা বন্ধ থাকবে । অন্ধকারের ভেতরে দরজা খুজে পেতে কষ্ট হল না । সেটা বন্ধই ছিল তবে তালা দেওয়া ছিল না । সেটা খুলে সাবরিনা বাইরে চলে এল । তারপর বুদ্ধি করে বাইরে থেকে হুকটা আটকে দিয়েই দৌড় শুরু করলো । কোন দিকে যাবে সাবরিনা জানে না । তবে মনে হল ওকে পালাতে হবে । যেদিকে দুচোখ যায় কেবল ওকে পালাতে হবে এই পিশাচ পুরি থেকে ।
দৌড়াতে দৌড়াতেই সাবরিনা শুনতে পেল পেছন থেকে কেউ যেন চিৎকার করছে । তবে আশার কথা হচ্ছে সেই চিৎকারটা আস্তে আস্তে কমে আসছে । ওর পিছু পিছু আসছে না ।
পরিশিষ্টঃ
-আরে আরে ব্রেক কর ব্রেক !
কথাটা কানে যেতে আরিফা সর্ব শক্তি দিয়ে গাড়ির ব্রেকে পা দিল । টায়ারের তীব্র আর্তনাদ শুনতে পেল ওরা দুজনেই । সেই সাথে টায়ার পোড়া গন্ধ এসে নাকে লাগলো । তবে গাড়িটা এক সময় থেকে গেল । আরিফা পাশে বসা ওর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল
-প্লিজ বল যে আমি কাউকে ধাক্কা দেই নি !
-আমি ধাক্কা খাওয়ার আওয়াজ পাই নি । চলে বাইরে বের হয়ে দেখি ।
ওরা দুজনেই বাইরে বের হয়ে এল । গাড়ির হেডলাইটের আলোতেই দেখতে পেল যে ওদের গাড়ির থেকে হাত দুয়েক দুরে একটা মেয়ে পড়ে আছে । মেয়েটা চোখ বন্ধ করে আছে তবে মেয়েটার জোড়ে জোড়ে নিঃশ্বাস নিচ্ছে । আরিফা দৌড়ে গেল কাছে । মেয়েটাকে পরীক্ষা করে জানে পানি এল । ওর গাড়ি মেয়েটাকে ঢাক্কা মারে নি । মেয়ে হাপাচ্ছে, তার মানে দৌড়ে এসেছে । কিন্তু এই নির্জন রাস্তায়, এমন রাতের বেলা এমন একটা মেয়ে এল কোথা থেকে ।
হঠাৎ মেয়েটা চোখ মেলে তাকালো । তৃষার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমাকে বাঁচান প্লিজ !
এই বলেই মেয়েটা জ্ঞান হারিয়ে ফেলল । আরিফা ওর স্বামীর দিকে তাকিয়ে বলল
-মেয়েটা এই রাতের বেলা এখানে কি করছে বল তো ?
-ভূত প্রেত নয়তো !
-তুমি না !
আরিফা বিরক্ত হল । তারপর বলল
-একে একটু ধর তো । কাছেই কোন হাসপাতালে নিয়ে যাই । এসো এসো ।
মেয়েটাকে গাড়িতে তুলে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সময়ও তারা খেয়াল করে দেখলো না দুটো লাল চোখ তাদের দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে ।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা আগস্ট, ২০১৯ সকাল ১০:৫৬