প্রথম পর্ব
ছয়
আমি সারা জীবন সহজ সরল ঝামেলাহীন সময় কাটিয়ে এসেছি । যে মানুষ গুলো আমার জীবনে ঝামেলা পাকানোর চেষ্টা করেছে তাদের কাছ থেকে আমি সব সময় দুরে থেকেছি । কিন্তু এই সময়ে এসে আমার জীবনে এমন এক ঝামেলা তৈরি হবে সেটা আমি কোন ভাবতেও পারি নি ।
নিকিতা আর রিদি এই দুই মেয়ে আমার জীবনে এমন ভাবে আসন নিয়ে বসতে শুরু করলো যে আমি কোন দিকে যাবো বুঝতে পারছিলাম না । আমি সত্যিই কোনদিন ভাবি নি যে রিদি আমার প্রতি এমন আগ্রহবোধ করবে । বিশেষ করে আমাদের বাসায় আসার পর থেকে সে এমন একটা ভাব করতে শুরু করলো যেন আমি তার সত্যিকারের প্রেমিক । তবে একটা কথা বলতেই হবে রিদির ভেতরে আমি কোন ছলনার ভাব দেখতে পেলাম না । সে যে সত্যিই আমার প্রতি আগ্রহী হয়েছে সেটাও আমার বুঝতে বাকি রইলো না । আমি যে তাকে কিছু বলবো সেটাও পারছিলাম না কারন রিদি আমার মায়ের সাথে যুক্ত ছিল । মা ওকে খুব বেশি পছন্দ করা শুরু করে দিয়েছে । আমি সত্যিই এই কারনে কিছু বলতেও পারছিলাম না ।
কয়েক দিনের মাঝে রিদিদের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের ভাব হয়ে গেল খুব বেশি । নিয়মিত দেখা সাক্ষাত দাওয়াত চলতে থাকলো । আমাদের মাঝেও দেখা হতে লাগলো । ক্যাম্পাস থেকে আমরা এক সাথেই আসতে লাগলাম বাসার দিকে । ওর যদি আগে ক্লাস শেষ হয়ে যেত আমার জন্য অপেক্ষা করতো ।
একদিন আমি জানতে পারলাম যে প্রতি সোমবারে ওর কোন ক্লাস থাকে না । তবুও ক্যাম্পাসে আসে । এক সাথে আমরা লাঞ্চ করি তারপর এক সাথে ফেরৎ যাই বাসার দিকে । আমার বাসাটা ওর থেকে খানিকটা দুরে । ওকে মাঝপথে নামিয়ে দিয়ে আমি বাসার পথে যাই । এই ঘটনা জানার পরে আমার আরও খারাপ লাগতে শুরু করলো । আমি কিভাবে ওকে নিকিতার কথা বলবো !
আজকে ক্যাম্পাস থেকে একটু আগে আগে বের হয়ে পড়লাম । রিদি আমার সাথেই ছিল । সিএনজিটা বসুন্ধরার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ করেই রিদি সিএনজি থামাতে বলল । আমি বললাম
-কেন ? এখানে কেন ?
-আরে চল তো ! আজকে বাসায় গিয়ে কোন কাজ নেই । চল মুভি দেখা যাক !
রিদি আমার কোন কথা শুনলো না । এক প্রকার জোর করেই আমাকে নিয়ে আট তলায় । আমরা মুভির টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম হলে । রিদি মুভি দেখছিলো আর টুকটাক কথা বলেই যাচ্ছিলো । আমি তাই করছিলাম । এমন সময় আমার ফোন কেঁপে উঠলো । ফোন নাম্বারটা দেখেই খানিকটা অস্বস্থি শুরু হল । নিকিতা ফোন দিয়েছে ।
একবার মনে হোল ফোনটা না ধরি । তারপর মনে হল না ধরতেই হবে । রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আওয়াজ পেলাম নিকিতার ।
-বাহ মুভি দেখা হচ্ছে ! চমৎকার !
অবাক হওয়ার কথা তবে অবাক হলাম না । আমি যে এই সময়ে এখানে আছি সেটা ও ঠিকই জানে । আমি কিছু বললাম না । চুপ করে রইলাম । নিকিতা বলল
-মুভি দেখছো দেখো কিছু বলছি না । তবে পপকর্ন নেওয়ার সময় ওর হাতের সাথে যেন হাত না লাগে ! আগে দুইবার স্পর্শ লেগেছে !
আমি এবার একটু চমকে গেলাম । তার মানে আমার উপর নিকিতার তীব্র চোখ রাখছে । আমি কি করি না করি সব । অবশ্য এটা হতেই পারে । পুরো পুলিশ যখন তার হাতে আমার পেছনে স্পাই লাগানো তার পক্ষে অসম্ভব কিছু না । আমি কোন মতে বললাম
-তুমি জানো এসব অনিচ্ছাকৃত ।
-হ্যা হ্যা বুঝেছি । তুমি তো সাধু পুরুষ ! এখন মুভি দেখো !
আমি ফোন রেখে দিলাম কিন্তু আর শান্তি পেলাম না । এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম । রিদি বলল
-কি ব্যাপার এদিক ওদিক কি দেখছো ?
-না কিছু না !
রিদি বলল
-তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে আমরা লুকিয়ে মুভিয়ে দেখতে এসেছি । কেউ দেখে ফেলবে এই ভয় পাচ্ছি !
আমি খানিকটা শুকনো হাসি হাসলাম । সত্যিই আমরা লুকিয়েই মুভি দেখতে এসেছি এমন একটা অনুভূতি হচ্ছে । তবে কেবল এটা জানি যে যতই লুকাই সে ঠিকই জেনে যাবে !
এই সমস্যা যখন তীব্র হতে যাচ্ছিলো তখনই হঠাৎ করেই সমাধান হয়ে গেল । হঠাৎ করেই লক্ষ্য করলাম যে রিদি আর আমার সাথে যোগাযোগ করছে না । ওর ফেসবুকে গিয়ে দেখি সেটা ডিএকটিভেট । মানে কিছুই বুঝতে পারলাম না । একদিন কৌতুহল নিয়ে ওর ডিপার্টমেন্টে গিয়ে খোজ নিলাম । অবাক হতে হল । সেখান থেকে আমাকে জানানো হল যে রিদি নাকি অস্ট্রেলিয়া চলে গেছে স্কলারশীপ নিয়ে ।
সেটা যেতেই পারে । ওর বাইরে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল সেটা জানতাম কিন্তু এই ভাবে আমাকে কিছু না জানিয়ে কিভাবে চলে গেল । বাসায় এসে মাকে বলতে মা যেন আকাশ থেকে পড়লো । ওদের বাসায় যোগাযোগ করলো । শেষে যা জানা গেল যে হুট করেই চলে যেতে হয়েছে । মা একটু একটু রেগে গিয়েছিলো । তার কথা হচ্ছে যাবে না কেন ? অবশ্যই যাবে । কিন্তু কদিনের ভেতরে যেখানে আমাদের বিয়ের কথা বার্তা চলছিলো তখন সেটা না শেষ করেই যেত । তখন ওদের বাসা থেকে জানালো যে রিদি এখন বিয়ের কথা ভাবছে না !
আমি খানিকটা স্বস্তি পেলাম তবে মা খুব চেঁচামিচি করলো । আমি মাকে শান্ত করার চেষ্টা করলাম কিন্তু কাজ হল না । কিভাবে শান্ত করাবো সেটাও বুঝতে পারছিলাম না । এমন সময় বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো । আমি মাকে রেখে দরজা খুলতে গেলাম । দরজা খুলতেই আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । নিকিতা দাড়িয়ে আছে । হাসি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি খবর ?
-তুমি এখানে ?
-হ্যা ! আসলাম । অনেক দিন দেখা সাক্ষাত হয় না । আর তোমাকে একটা ঝামেলা থেকে মুক্ত করেছি । একটা পুরস্কার তো পেতেই পারি । তাই তোমার পরিবারের সাথে পরিচিত হতে এলাম !
আমি কেবল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম । এটা তো আমার মাথায় আসে নি । রিদির হঠাৎ করে স্কলারশীপ নিয়ে দেশের বাইরে চলে যাওয়ার পেছনে যে নিকিতার হাত থাকতে পারে সেটা তো আমার মাথায় আসে নি । কিন্তু এখন মাকে কি বলে পরিচয় করিয়ে দিবো ? অবশ্য মা নিকিতাকে চিনে কি না সেই বিষয়ে আমার সন্দেহ আছে ।
দেখা যাক কি হয় ! আমি নিকিতাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে এলাম !
সাত
আমার মা তখনও এক মনে কথা বলেই যাচ্ছে । কে তার কথা শুনছে কি শুনছে না সেটার দিকে লক্ষ্য নেই । আমি নিকিতাকে নিয়ে মায়ের সামনে এসে দাড়ালাম । মা আমার দিকে না তাকিয়েই বলল
-কে এসেছে ?
আমি কিছু বললাম না । এক সময় মা আমাদের দিকে ফিরে তাকালো । নিকিতাকে দেখে বলল
-এটা কে ?
আমি খানিকটা দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে তাকিয়ে রইলাম মায়ের দিকে । একটু বোঝার চেষ্টা করছি মা নিকিতাকে ঠিক চিনতে পেরেছে কি না । মা তখনও নিকিতার দিকে তাকিয়ে আছে । একটা পর্যায়ে আমার মনে হল মা নিকিতাকে চিনতে পারে নাই । আমি বলল
-ও নিকি ! আমার ফ্রেন্ড !
-ফ্রেন্ড ! কেমন ফ্রেন্ড ! আগে তো দেখি নি কোন দিন !
নিকিতা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলল
-আম্মু, ও আসলে লজ্জা পাচ্ছে । আমরা ফ্রেন্ড না । বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড ! এতোদিন আপনার ভয়ে আমাকে সামনে আনে নি । আমি কয়েকবার আসতে চেয়েছি ।
মা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নিকিতার দিকে । অবাক হওয়ার বেশ কারন আছে । প্রথমত নিকিতা মাকে খুব স্বাভাবিক ভাবে আম্মু ডেকেছে । একেবারে প্রথম দিনেই এভাবে আম্মু ডাকাটা সহজ নয় ! তারপর এখনও কোন মেয়ে এতো সহজে তার প্রেমিকের মায়ের কাছে এই কথা টা বলতে পারে এটা কেউই বিশ্বাস করবে না । ব্যাপারটা ঠিক স্বাভাবিক না আমাদের দেশের মেয়ের জন্য ।
আর মায়ের থেকে সম্ভবত আমি নিজেই সব বেশি অবাক হয়েছি । বলে কি এই মেয়ে ?
মা এবার আমার দিকে তাকিয়ে রইলো চোখ গরম করে ! তার চোখের ভাষা আমার পড়তে মোটেই কষ্ট হল না । মা যেন আমার কাছে জানতে চাইছে যে কদিন আগে তুই বললি রিদিকে পছন্দ আবার আজকে এই মেয়েকে নিয়ে এসেছিস ! এই মেয়ে আবার বলছে তোরা নাকি বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ড ! মানে কি এসবের !
আমি কিছু না বোঝার ভান করে তাকিয়ে রইলাম । নিকিতা বলল, আম্মু আপনি ওকে বকবেন না প্লিজ ! আসলে ও আপনাকে অনেক ভালবাসে তো, আমার থেকেও বেশি তাই আপনি অন্য কারো সাথে যখন ওর বিয়ে দিতে চাইলেন ও মানা করে নি । এমন কি আমিও ওকে বলেছি আম্মুর যদি পছন্দ হয় তাহলে তুমি আমাকে ছেড়ে ওকেই বিয়ে কর !
এই কথা শুনেই দেখলাম আম্মু খানিকটা গলে গেল । দেখলাম হাতের কাজটা এক পাশে সরিয়ে রেখে নিকিতার কাছে এগিয়ে এল । নিকিতাকে দেখতে শুরু করলো ভাল করে । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তা তুই ঐ মেয়ের কথা কেন বলেছিলি আমাকে ? আর প্রথমেই একে কেন নিয়ে আসিস নি ?
তাই তো এই প্রশ্নের জবাব আমি এখন কিভাবে দিবো ? আমি আমতা আমতা করে বললাম
-আসলে ....
নিকিতা আবারও আমাকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে এল । বলল, আসলে আম্মু আমার মধ্যে একটা কারন আছে যেটা আপনি পছন্দ করেন না । এই জন্য ও আপনাকে কষ্ট দিতে চায় নি ।
মা বলল, কি কারন ?
নিকিতা আমার দিকে একবার তাকালো । তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, আসলে আমি রাজনীতির সাথে যুক্ত ! আপনি তো রাজনীতি ঠিক পছন্দ করেন না । তাই ?
ঘরের ভেতরে খানিকটা নিরবতা বিরাজ করলো । কেউ কোন কথা বলল না কিছু সময়ে । নিকিতা নিজের মুখকে করুণ করে রেখেছে । কিন্তু মাকে দেখে মনে হচ্ছে সে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে । সে কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না । আমি বললাম
-মা একটু বোঝার চেষ্টা কর । যারা রাজনীতির সাথে যুক্ত তারা তো সবাই খারাপ না । নিকিতাকে দেখো তোমার কি মনে হচ্ছে ..... মা
আমাকে মাঝ পথেই থামিয়ে দিল । তারপর বলল
-আমাকে বুঝাতে হবে না ।
তারপর নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল
-দেখো মেয়ে, আমি কিছু বলছি না তোমাকে কিংবা তোমাদের । তবে তুমি যদি আমার ছেলেকে পছন্দ কর আর ওর ও যদি একই ইচ্ছে থাকে তাহলে তুমি নিজেকে ঐ লাইণ থেকে আস্তে আস্তে সরিয়ে আনো । আমি জানি একেবারে সহজ হবে না তবে সম্ভব ! তোমার সহজ সোজা সত্য কথা আমার পছন্দ হয়েছে । আর আমি তোমার বাবা মায়ের সাথে কথা বলতে চাই !
দেখলাম নিকিতা হাসলো । আপাতত মা যে পটে গেছে সেটা আমার কিংবা নিকিতার কারোই বুঝতে বাকি রইলো না । নিকিতা হঠাৎ করেই মা জড়িয়ে ধরলো । এইবার মায়ের মুখে হাসি দেখতে পেলাম । যাক আপাতত মা পটে গেছে । এবং মা নিকিতাকে মোটেই চিন্তে পারে নি । কিন্তু বাবা মোটেই চিনতে ভুল করলেন না । রাতে বাবা একটু হাটতে যান । ফিরে এসে নিকিতাকে দেখে চোখ কপালে তুলে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । মায়ের সাথে নিকিতা তখন টেবিল সাজাচ্ছিলো ।
মা বাবার দিকে তাকিয়ে বলল
-দেখো তোমার ছেলের কান্ড ! তোমার ছেলে নাকি এই নিকিকে পছন্দ করে । অথচ দেখো আমরা কি করতে যাচ্ছিলাম । যা হয় ভালর জন্য হয় !
বাবার মুখের কথা তখন হারিয়ে গেছে । আর হারাবে না কেন ! দেশের হোম মিনিস্টারকে যদি নিজের ঘরে দেখা যায় হঠাৎ করে যে কারো মুখের কথা হারিয়ে যাবে । কিছু বলতে যাবে তখনই আমি সেখানে হাজির । বাবাকে অন্য রুমে নিয়ে এলাম । বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এই মেয়ে এখানে কেন ? আর তোর মা কি বলছ ?
আমি একটু শুকনো হাসি হেসে বললাম
-আমি কিছুই জানি না বাবা । আমার হাতে কিছুই নেই ।
-এই মেয়েকে কিভাবে পটালি ?
-আমি পটাই নি বাবা !
-তাহলে ?
-কিভাবে যে কি হয়েছে সেটা আমি নিজেই জানি না । এখন কেবল জানি যে এই মেয়ে খুব জলদি আমাকে বিয়ে করবে !
বাবা তখনও আমার দিকে অবাক চোখেই তাকিয়ে রয়েছে । তার এখনও কথাটা ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না । অবশ্য আমি হলেও আমার ঠিক বিশ্বাস হত না এই সব কথা । বাবা বলল
-তো মা তো চিনতে পারে নি মনে হচ্ছে !
-হ্যা । চিনতে পারে নি ।
-চিনতে পারলে কি হবে বুঝতে পারছিস ?
-না । তবে এমন কিছু করতে হবে যাতে চিনতে না পারে ?
-কত দিন ?
-যতদিন পারা যায় ।
বাবা তখনও আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে অবিশ্বাসের চোখে । তার ছেলের প্রেমিকা যে দেশের হোম মিনিস্টার সেটা তার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ।
রাতের খাবার সময়ও বাবা ঠিক স্বাভাবিক হতে পারছিলো না । নিকিতার সাথে কথা বলার সময় বাবার মুখ দিয়ে বারবার আপনি বের হয়ে যাচ্ছিলো । মা শুনে বিরক্ত হয়ে বলল, কি ব্যাপার বলতো ! তোমার কি বুদ্ধি শুদ্ধি লোপ পেয়ে গেল ! ছেলের বন্ধুকে কেউ আপনি করে বলে !
রাতের খাবারের পর মা নিকিতার সাথে আরও কিছু সময় গল্প করলো । তারপর আমার উপর দায়িত্ব পরলো ওকে বাসায় পৌছে দিয়ে আসার জন্য । রুম থেকে বের হতেই নিকিতা নিজের ওড়না বের করে সেটা মুখে পেঁচিয়ে নিল । যে কেউ ওকে দেখে ফেলতে পারে । তখন চিনে ফেললে ঝামেলা হয়ে যাবে । আমি কেবল ওর চোখের তাকিয়ে রইলাম । নিকিতা বলল
-কি দেখো !
-তোমাকে দেখছি । মাঝে মাঝে মনে হয় যে স্বপ্নে দেখছি ! এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না ।
-হবে হবে ! আরও সময় যেতে দাও ! সব ঠিক হয়ে যাবে । দেখছো না তোমার আম্মুকে কিভাবে নিজের দলে নিয়ে এলাম !
-দেখলাম ! সত্যিই তোমার বুদ্ধির তারিফ না করে পারছি না । অবশ্য যেভাবে তুমি তোমার মন্ত্রনালয় চালাও তোমার অসম্ভব কিছু নেই ।
-তাহলেই বুঝো ! সাবধান !
আমি হেসে ফেললাম !
কথা বলতে বলতেই আমরা বাসার বাইরে চলে এলাম । দেখলাম সাথে সাথেই একটা গাড়ি এসে থামলো । নিকিতা দরজা খুলে উঠতে উঠতে বলল, উই হ্যাভ এ লং ওয়ে টু গো ! টেক কেয়ার !
নিকিতা গাড়িতে উঠে বসলো । আমি অনেকটা সময় ধরে ওর গাড়ির দিকে চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো । কেন জানি মনের ভেতরে আশ্চর্য রকম আনন্দ অনুভূতি হল আমার ! সত্যিই তাহলে হোম মিনিস্টারের প্রেমে পড়ে গেলাম !
আট
নিকিতার সাথে আমার প্রেমটা চলতে থাকলো অনেকটা নাইট টেনেরর স্কুলে পড়া ছেলে মেয়েদের মত । কিশোর বয়সের প্রেমে যেমন সব সময় এই ভয়ে থাকতে হয় যদি কেউ দেখে ফেলে আমাদের অবস্থাও হয়েছে তেমন । মাসের বেশির ভাগ সময়ই নিকিতাকে নানান কাজকে ব্যস্ত থাকতে হয় । আমি ওকে দেখতে পাই না । যখন দেখা করি তবুও লুকিয়ে ঝুকিয়ে । বেশির ভাগ সময়ই ও একেবারে মুখ ওড়না পেঁচিয়ে আসে ।
আমি ওকে নিয়মিত টিভিতেই দেখতে পাই । কিন্তু ও আমাকে দেখতে পায় না । মাঝে মাঝে তাই হাজির হই ওর বলা স্থানে । কাজের কারনেই ওকে মাঝে মাঝেই সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে হয় । আমাকে একটা পাস এনে দিয়েছে সে । আমি সময় পেয়ে সেই সাংবাদিক সেজে চলে যাই । ভীড়ের মাঝে ওর চোখ আমার উপরে থাকে । মুখে হাসি হাসি নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেয় সে । এই ভাবেই আমাদের বেশির ভাগ দেখা হয় ।
তবে এসবের মাঝেও আমার দিকে ওর সজাগ দৃষ্টি থাকে সব সময় । বিশেষ করে আমি কি করি না করি সব জানে । একদিন এই কথা জানতে চাইলে ও বলল, শুনো পৃথীবীর সব মেয়ের এই একটাি ইচ্ছে যে সে তার প্রেমিক স্বামীর ব্যাপারে সব কিছু জানে । আমার কাছে ওয়ে আছে আমি কেন করবো না ?
-তাই বলে সব সময় আমার পেছনে লোক লাগিয়ে রাখবে ?
নিকিতা হাসলো । তারপর বলল
-মনে করো তোমার কোন বিপদ হল । যেকোন বিপদ আর তোমার একা একা সেটা সাফার করতে হল আমি এই ব্যাপারটা কোন দিন মেনে নিতে পারবো না । তোমার সাথে যাই হোক ভাল খারাপ আমি চাইবো সবার আগে আমি জানবো আমি ষবার আগে ব্যবস্থা নিবো ! বুঝতে পেরেছো ? তুমি কি জানো আমাদের মেয়েদের হাতে যদি ক্ষমতা থাকতো তাহলে তারা তাদের ভালবাসার মানুষের জন্য সব কিছু করে ফেলতো সকল আঘাত আগে নিজের শরীর দিয়ে ঠেকিয়ে দিতো । কিন্তু আমাদের সব সময় তা থাকে না । কিন্তু আমার অনেকটাই আছে আমি সেটার ব্যবহার করবো না ?
আমি কোন কিছু বলতে পারলাম না । এই কথার বিপরীতে আর কিছু বলাও যায় না ।
আমাদের প্রেম চলতে থাকে । নিকিতা মাঝে মাঝে খুব গোপনে আমাদের বাসায় আসে । তারপর মায়ের সাথে কিছু সময় গল্প করে । বাবা এই সময় খুব অস্বস্থির ভেতরে থাকে । তার কাছে ব্যাপারটা এখনও ঠিক স্বাভাবিক না ।
তবে আমার মাঝে মাঝে মন খারাপ হয় । আমি এতো অস্বাভাবিক জীবন চাই নি । আমি যেমন সাধারন মানুষ আমি চেয়েছিলাম আমার প্রেমিকা/বউও আমার মতই সাধারন কেউ হয় । হয়তো হাউজওয়াইফ নয়তো আমার মত জব করবে । আমরা অফিস শেষে এক সাথে ঘুরতে যাবো । রেস্টুরেন্টে খাওয়া দাওয়া করবো । বৃষ্টি হলে রিক্সা করে ঘুরবো । কিন্তু নিকিতার সাথে কোন দিন সেটা সম্ভব না ।
নিকিতা নিজেও এটা জানতো । আমার যে মাঝে মাঝে মন খারাপ হয় সেটা সেও জানে । সেদিন ছুটির দিন ছিল । প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে । আমি শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম । এমন সময় নিকিতার ফোন এসে হাজির ।
-কি করছেন পড়ছেন প্রোফেসর সাহেব ?
-এই সময়ে আর কি করবো !
-শুনো এখনই বাইরে বের হও তো !
-মানে ?
-তোমার বাসার সামনে দেখো গাড়ি চলে গেছে । কালো রংয়ের পাঞ্জাবীটা পরে এসো ।
-কেন ? আমি তো বুঝতে পারছি না ।
-এতো কিছু বুঝতে হবে না । আসতে বলছি আসো !
আমি কথা না বাড়িয়ে পাঞ্জাবী পরে নিলাম । কয়েক দিন আগে নিকিতাই এটা আমাকে উপহার দিয়েছে । বাসার গেটের কাছে আসতেই দেখলাম কালো রংয়ের গাড়ি এসে হাজির হয়েছে বাসার সামনে । আমাকে দেখে সেটার দরজারও খুলে গেল । আমি কোন কিছু চিন্তা না করে ভেতরে ঢুকে পড়লাম । গাড়ি কিছু সময় চলার পরে একটা স্থানে এসে থামলো । বেশ কিছু সময় ধরে গাড়িটা চলে থেমে গেল । আমি তাকিয়ে ঠিক রাস্তাটা চিনতে পারলাম না । রাস্তাটার দুইপাশে সারি সারি গাছ । বিশেষ করে কদম আর কৃষ্ণচুড়া গাছই বেশি দেখা যাচ্ছে । রাস্তায় গাড়ির চলাচল নেই বললেই চলে । আমি তাকিয়ে দেখি আমাদের গাড়ির ঠিক সামনে আরেকটা গাড় দাড়িয়ে রয়েছে ।
কিছু সময় পরেই গাড়িটা থেকে হাতে ছাতা নিয়ে একজন কালো রংয়ের শাড়ি পরা এক মেয়ে বের হয়ে এল । আমাদের গাড়ির দিকে হাটতে লাগলো । আরেকটু ভাল করে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে দেখলাম মেয়েটা আর কেউ নয়, নিকিতা ! আমার গাড়ির সামনে এসে বলল গাড়ির দরজা খুলতে ইশারা করলো । আমি দরজাটা খুলতেই ও ছাতা নিয়ে দরজার কাছে চলে এল ।
এক ছাতার নিচে আমরা দাড়িয়ে আছি । নিকিতা হাতের ইশারা করতেই গাড়ি দুটো চলে গেল । তাকিয়ে দেখি পুরো রাস্তা জুড়ে কেবল আমরা দুজন । একটা গাড়িও দেখা যাচ্ছে না । আমি বললাম
-যদি কেউ এখানে আমাদের দেখে ফেলে ?
নিকিতা হাসলো । বলল
-দেখবে না । সেরকম ব্যবস্থা করা হয়েছে !
-কি রকম ?
-এই রাস্তার দুই মাথায় ডাইব্রেশন করা হয়েছে । একটু ঘুরে যাবে । তাছাড়া পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে । কেউ আসবে না !
এই বলে নিকিতা হাতের ছাতাটা রাস্তায় ফেলে দিলো । সাথে সাথে এক ঝাক বৃষ্টির পানি আমাদের ভিজিয়ে দিতে লাগলো । আমি অবাক নিকিতার দিকে তাকিয়ে রইলাম । এই মেয়ে আমার ইচ্ছে পুরনের জন্য পুরো রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে । খাইছে আমারে !
মুষল ধারে বৃষ্টি পড়তে থাকলো আর আমরা দুজন বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম এক সাথে । মাঝে মাঝে হাটি রাস্তার উপর বসে থাকি । জীবনে এর থেকে চমৎকার বৃষ্টিময় সময় আমি কাটিয়েছি কি না আমার জানা নেই ।
আমার মনের সেই সাধারন প্রেমিকার আফসোস টা একেবারে চলে গেল । মনে হল এর থেকে ভালা আর কিছু হতেই পারে না । আমার প্রেমিকা আমার সাথে বৃষ্টিতে ভেজার জন্য পুরো একটা রাস্তা বন্ধ দিয়েছে । এটা আমি কোথায় পেতাম !
বাসায় ফেরার পরেও অনেকটা সময় এই আনন্দ নিয়েই সময় কাটাতে লাগলাম । কিন্তু সুখের পর ঝামেলা এসে হাজির । আমার বেলাতেও ঠিক তাই এসে হাজির হল । ফেসবুকে কয়েকটা ছবি মুহুর্তের ভেতরে ভাইরাল হয়ে গেল । এবং সেই ছবিটা আর কারো নয় আমার আর নিকিতার বৃষ্টিতে ভেজার ছবি । রাত দশটা বাজতে বাজতে সব গুলো নিউজ পোর্টালের লিড নিউজ হয়ে গেল সেটা । দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কোন ছেলের সাথে বৃষ্টিতে ভিজছে ।
ফেসবুকে খুব ঝড় উঠলো । অনেকে এটার বিপরীতে অবস্থান নিচ্ছে আবার অনেকে এটার পক্ষে । কেউ বলছে এতো গুরুত্বপূর্ন পদে থেকে কেউ এমন কাজ কিভাবে করে আবার কেউ বলছে সে তার দায়িত্ব পালনে কখনও অবহেলা করে নি । তার কি ব্যক্তিগত জীবন থাকতে পারে না । সে হোম মিনিস্টার হয়েছে বলে কি সে কাউকে ভালবাসতে পারে না । জল্পনা কল্পনা চলতে লাগলো । নিকিতার সাথের ছেলেটা আসলে কে ?
কেউ বলছে অনেক ব্যবসায়ী কেউ বলছে ফ্যামিলি ফ্রেন্ড কিংবা বাইরে থেকে ! কিন্তু আমার আসল পরিচয় কেউ তখন বের করতে পারে নি ।
আমি কি করবো ঠিক বুঝতে পারছিলাম না । যে কয়টা ছবি পোস্ট হয়েছে সেখানে আমার চেহারা খুব স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না । যারা আমাকে চেনে তারা হয়তো ভাল করে তাকালে বুঝতে পারবে যে নিকিতার সাথের ছেলেটা আমি ।
সামনে কি হবে কে জানে ?
ওর ক্যারিয়ারে নিশ্চয়ই একটা বড় রকমের দাগ সৃষ্টি হয়ে গেল আমার জন্য !
ইস! যদি ওকে আমার ঐ ইচ্ছের কথা না বলতাম তাহলে হয়তো এসব কিছুই হত না !
নয়
রাতের বেলা কয়েকবার ফোন দিতে গিয়েও ফোন দিতে পারলাম না । বারবার কেবল মনে হচ্ছিলো যে আমার কারনেই নিকিতার এতো বড় সমস্যা হয়ে গেল । আমার কারনেই ওর ক্যারিয়ারে একটা বড় দাগ হয়তো লেগে গেল । আমি যদি আমার ইচ্ছের কথাটা না বলতাম তাহলে হয়তো কোন দিন এই ব্যাপারটা হত না ।
রাত বারোটার দিকে নিকিতা নিজেই ফোন দিল আমাকে । আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । নিকিতা বলল
-মন খারাপ মনে হচ্ছে ?
-আই এম সরি !
-সেকি কেন ? সরি কেন ?
-আমার কারনে তোমার এতো বড় ক্ষতি হয়ে গেল !
-কিসের ক্ষতি !! শুনো এই সব ব্যাপার নিয়ে তোমার চিন্তা করার কোন কারন দেখি না আমি । এইসব নিয়ে ভাববেও না মোটেও । মনে থাকবে !
-কিন্তু .....
-কোন কিন্তু না । আমি সামলাবো ! তোমার কেবল কাজ হবে আমার বয়ফ্রেন্ড হওয়া আর আমাকে নিজের গার্লফ্রেন্ড মনে করা !
-বয়ফ্রেন্ড গার্লফ্রেন্ডের জন্য আমরা খানিকটা বেশি বড় হয়ে গেছি না ! এর থেকে হাসব্যন্ড ওয়াইফ বেশি ভাল শোনায় !
ওপাশ থেকে বেশ কিছু সময় কোন কথা শোনা গেল না । আমি বললাম
-কি হল ?
নিকিতা খুব নরম গলায় বলল
-না কিছু না । আমি বাবাকে বলব । যদিও আমি যতদুর জানি বাবা এই ব্যাপারটা জেনে গেছে এরই ভেতরে ।
-তো এখন কি করবো ? তোমার বাবা কাছে প্রস্তাব পাঠাবো ?
-না না না ! এখন না । আমি বলবো কি করতে হবে আর কখন করতে হবে । আর তুমি এখন ঘুম দাও । অন্য কিছু এখন ভাবতে হবে না । বুঝতে পেরেছো ! আমি এদিকটা সমলাবো !
যদিও ও আমাকে চিন্তা করতে মানা করলো তবুও আমি চিন্তা করা থেকে নিজেকে দুরে রাখতে পারলাম না । আমাদের এই ব্যাপারটা জেনে যাওয়ার ফলে ওর ক্যারিয়ারে কি হবে এই চিন্তাটা মাথা থেকে দুর করতে পারলাাম না । নিশ্চয়ই ওর বিরোধী পক্ষ এটা নিয়ে অনেক ঝামেলা করবে ।
ঝামেলা অবশ্য তারা করতেও চাইলো কিন্তু নিকিতা যে ব্যাপারটা এই ভাবে সামাল দেবে আমি ভাবতেই পারি নি । দুদিন পরে ওর এক সংবাদ সম্মেলনে হঠাৎ এক সাংবাদিক এই প্রশ্ন করে ফেলল । ম্যাডাম আপনার সাথে ঐ ছেলেটি আসলে কে ?
আমি তখন ওর এই অনুষ্ঠানটা টিভিতে দেখছিলাম । প্রশ্নটা শুনে মুহুর্তের ভেতরে নিকিতার চেহারার রং বদলে গেল । নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করলো কিছু সময় ধরে । তারপর বলল
-এখানে আপনাদের ডাকা হয়েছে আমাকে আমার কাজের ব্যাপারে প্রশ্ন করার জন্য । আমাদের দেশে সামনের কয়েক দিনে একটা হামলা হওয়ার কথা আশংকার করা হচ্ছে, ইনটেলিজেসন্স থেকে তাই জানানো হয়েছে । আমি আপনাদেরকে এই ব্যাপারে সাবধান করতে ডেকেছি । আর আপনি বলছেন আমার সাথের ঐ ছেলেটি কে ? আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি সে এই হামলার সাথে যুক্ত নয় । কিংবা সে হুমকিও নয় দেশের জন্য ! বুঝতে পেরেছেন কি ?
-কিন্তু ম্যাডাম আমাদের কি জানার অধিকার নেই ?
নিকিতা এবার সত্যিই সত্যিই রেগে গেল । খানিকটা রাগত কন্ঠেই বলল, আমি এই দেশের একটা গুরুত্বপূর্ন পদে আছি । আপনারা আমার কাজের ব্যাপারে প্রশ্ন করুন । আমি যদি কোন ভুল করি সেটা আমাকে মনে করিয়ে দিন । কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হওয়ার সাথে সাথেও আমি একজন মানুষ । আমার একটা ব্যক্তিগত জীবন আছে । সবার যেমন আছে । এখন আমি ঐ ছেলের সাথে যদি বৃষ্টিতে ভিজেও থাকি সেটা কি অন্যায় কিংবা খারাপ কাজ হয়েছে ? আমি কোন আইন ভেঙ্গে কাজটা করেছি ? এমন কোন আইন কি আমাদের দেশে আছে যে যেখানে লেখা আছে প্রশাসনের মানুষদের কোন ব্যক্তিগত জীবন থাকতে পারবে না ? আছে কি ?
কেউ কোন কথা বলল না । নিকিতা বলল,
-যদি আপনাদের এই ইচ্ছে থাকে তাহলে এই বার আপনাদের জনপ্রতিনিধিদের বলুন । আমরা একটা আইন বানাই যেখানে এমপি মন্ত্রীরা কেউ বিয়ে করতে পারবে না কাউকে পছন্দ করতে পারবে না। ঠিক আছে বানাবো এমন আইন ? তাই কি চান ? বলুন তাই কি চান ?
সেই সাংবাদিক মিন মিন করে বলল
-জি না !
-তাললে অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন করা বন্ধ করুন ! আমার ব্যক্তিগত জীবন ব্যক্তিগতই রাখতে দিন । যে ছবিটা ফেসবুকে ছাড়া হয়েছে সেটা যে তুলেছে তাকে আমি খুজতেছি । অন্যের ছবি লুকিয়ে তোলা অন্যায় এবং সেটা পাব্লিক্যারি প্রকাশ করাও অন্যায় । ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন আপনারা !
দৈনিক দ্বিতীয় আলোর একজন সিনিয়ির সাংবাদিক উঠে দাড়ালো । ম্যাডাম রাগ করবেন না । আসলে আমাদের মাঝে সাংবাদিকতার জ্ঞানে অবাব আছে এটা আমরা সবাই জানি । আসলে সিস্টেমটাই এমন হয়ে গেছে ।
-হ্যা সব দোষ এখন সিস্টেমের ! এটা বলেই সবাই খালাশ পেয়ে যায় । কেউ এগিয়ে এসে সেটা ঠিক করার কথা চিন্তা করে না ।
-কিন্তু আপনি করছেন । এই জন্য দেশের সব মানুষ আপনাকে খুব বেশি পরিমান পছন্দ করে । আপনার ব্যাপারে খুব বেশি আগ্রহী ! আমরা আসলে আপনার দিকেই চেয়ে আছি । আপনি যখন চাইবেন তখনই বলবেন । এটাই আমাদের কাম্য ! তবে দেশের মানুষ এখন সত্যিই আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে । যদি আপনার কোন রকম আপত্তি না থাকে তাহলে বলতে পারেন তার ব্যাপারে ।
নিকিতা খানিকটা হাসলো । তারপর বলল
-রমুন সাহেব আপনি খুবই বুদ্ধিমান । দেশের উপর হামলার সংবাদ থেকেও যখন মানুষ আমার বৃষ্টিতে ভেজার গল্প শুনতেই বেশি আগ্রহী তখন বলি ----- হ্যা সেদিন একজনের সাথে আমি বৃষ্টিতে ভিজেছিলাম । গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম এক সাথে বৃষ্টি নামলো কি মনে হল নেমে পরলাম । তাকে আমার পছন্দ । তারও তাই । খুব জলদিই সম্ভবত পারিবারিক ভাবে কিছু হবে । চেষ্টা করবো এটা পরিবারের ভেতরেই রাখতে । আর কিছু জানতে চান ?
-যদি তার পরিচয় টা জানাতেন !
-দেখুন আমি পাব্লিক ফিগার । সে না । সে শান্তিপ্রিয় মানুষ । তাকে সেই রকম ভাবেই থাকতে দিন । আমি তার পরিচয় দিতে চাই না কারন সেটা দেওয়ার সাথে সাথে আপনারা গিয়ে হাজির হবে তার কাছে । এটা আমি পছন্দ করবো না । আরেকটা কথা যদি তবুও আপনাদের মাঝে কেউ তার পরিচয় জেনেও ফেলেন এবং তাকে গিয়ে বিরক্ত করেন তাহলে আমি ব্যাপারটা পছন্দ করবো না !
শেষের লাইনটা যে নিকিতা সবাইকে হুমকি দিল সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । ব্যাপারটা এই ভাবে মিটে যাবে ভাবি নি । নিকিতার এই ভাবে বলাতে অন্য কারো কিছু বলারই রইলো না । যদিও বিরোধী পক্ষের কেউ বলার চেষ্টা করলো যে এই ভাবে একজন মন্ত্রী প্রকাশ্যে বৃষ্টিতে ভিজতে পারেন না কিন্তু সেসব কথা হালে পানি পেলো না ।
এরফলে আরেকটা কাজ হল । আগে থেকে ইয়াং জেনারেশনের মধ্যে নিকিতা তুমুল জনপ্রিয় ছিল । এই ঘটনার ফলে সেটা আরও বৃদ্ধি পেয়ে গেল । একে তো নিকিতা ছিল সব থেকে ইয়াং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তারপর তার কাজ কর্ম একদম পরিস্কার । সে কাউকেই ছাড় দিয়ে কাজ করে না । নিকিতার ক্ষমতায় আসার পরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রনালয়ের ইজেম অনেক ঊন্নতি হয়েছে । আর এখন তারা তাদের পছন্দের মন্ত্রী প্রেমও করে এবং সেটা বলতে দ্বিধাও বোধ করে না !
কিন্তু কদিন পরে ও যা করলো সেটা আমি কোন দিন কল্পনা করি নি । নিকিতা যে এমন কিছু করতে পারে সেটা আসলেই আমার ধানার বাইরে ছিল । কেবল আমার কেন অন্য কারো মনেই এমন কথা আসে নি । নিকিতার মত পদে থাকা কেউ যে এমন একটা কাজ করতে পারে সেটা এই দেশের ইতিহাসে এই প্রথম ।
দশ
মাঝে মাঝেই ক্লাস শেষ করেও আমার ক্যাম্পাসে আরও কাজ থাকে । সেদিনও ক্লাসের শেষে আমাদের স্যারদের একটা মিটিং ছিল । সামনে আমরা একটা সেমিনার করতে যাচ্ছি সেই ব্যাপারেই চেয়ারম্যান স্যার আমাদের সাথে আলোচনা করছিলো । মিটিং শেষ হতে হতে প্রায় বিকেল হয়ে গেল । আমি আরও কিছুটা সময় রুমে কাটিয়ে যখন বের হতে যাবো তখনই নিকিতার ফোন এসে হাজির ।
স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে একটু অবাক হলাম । কারন এই সময়ে নিকিতা খুব দরকার না হলে ফোন করে না । ওর সাথে আমার বেশির ভাগ দিনেই কথা হয় রাতের বেলা । সকল শেষ করে ও ফোন দেয় । মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে ও আমাকে মেসেজ করে । আমিও তাই করি । আমি জানি ও কি পরিমান ব্যস্ত থাকে সারা দিন । ওকে বিরক্ত করি না তাই । কিন্তু এই বিকেল বেলা ওর ফোন পেয়ে খানিকটা অবাক না হয়ে পারলাম না । এর আগেরবার অসময়ে ফোন করে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিলো তারপর কি হুলস্থুল ব্যাপার ঘটে গেছে । যদিও ব্যাপারটা এখন খানিকটা শান্ত । আজকে আবার কি হবে কে জানে !
আমি ফোন রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে নিকিতা বলল
-কি খবর মাই ডিয়ার বয়ফ্রেন্ড ! এখন ক্যাম্পাসে ?
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম । আমি যে এখন ক্যাম্পাসে আছি এটা ও জানে । এমন কি আমি কোন রংয়ের শার্ট পরে আছি এই খবরও ওর কাছে আছে । আমি মাঝে মাঝেি ভুলে যাই যে আমার প্রেমিকা সাধারন কেউ নয় । আমি বলল
-হ্যা । তুমি কোথায় ?
-তুমি যেখানে আমি সেখানে !
-মানে কি !
-কোন মানে ফানে নাই । তোমাদের ক্যাম্পাসের বটতলায় আসো !
-তুমি এখানে !!
একটু অবাক হলাম যদিও এর আগে নিকিতা কয়েকবার এসেছে আমার ক্যাম্পাসে । আমার অফিসেই এসেছে । মুখে ওড়না দিয়ে পর্দা করে এসেছে । কেউ ওকে চিনতে পারে নি । আকজেও নিশ্চয়ও সেভাবেই এসেছে । মাঝে মাঝে এই মেয়ের সাহস দেখে আমি অবাক না হয়ে পারি না । অবশ্য তার পরেই নিজের মনকে বুঝ দেই যে এই মেয়ে পারে না এমন কোন কাজ নেই ।
আমি কাজ কর্ম দ্রুত শেষ করে বটতলার দিকে হাটা দিলাম । কিন্তু বটতলার কাছে গিয়ে বেশ বড় রকমের একট ধাক্কা খেলাম । নিকিতা আসলেই সেখানে একটা টুল পেতে বসে আছে । আমার অবাক হওয়ার কারন হচ্ছে নিকিতা আজকে তার মুখ ঢাকে নি । আশে পাশে সবাই তাকে দেখতে পাচ্ছে । কিন্তু কাছে আসার সাহস পাচ্ছে না । নিকিতার আশে পাশে ওর সিকিউরিটিকেও দেখতে পেলাম ।
এখন ক্যাম্পাসে ভীড় অনেকটা কম । সবাই ক্লাস করে চলে গেছে । কিছু রাজনৈতিক ছেলে মেয়েরা আছে । আর অল্প কিছু সাধারন ছেলে মেয়েরা । সেই অল্প ভীড়ের মাঝে সেই ছাত্র নেতা কামাল আফসারকে দেখতে পেলাম । আমাকে দেখে সে যেন আরও অবাক হয়ে গেছে ।
আমি কি করবো বুঝতে পারছিলাম না । এই মেয়ের মাথায় এখন কি চলছে কে জানে ! আমি ধীর পায়ে এগিয়ে গেলাম ওর দিকে । আমাকে দেখতেই ওর মুখে হাসি দেখা গেল । ওর পাশে বসে থাকা একটা টুল এগিয়ে দিল । আমি চুপচাপ বসলাম । নিকিতা বলল
-কি ব্যাপার এমন মুখ করে রেখেছো কেন ?
-সিরিয়াস লি ? এই ভাবে ?
-হোয়াট ! কি হয়েছে ? আর কত লুকাবো বল ! আর ভাল লাগছে না । মন্ত্রী হয়েছি তো কি হয়েছে ! আমার পছন্দ অপছন্দ নেই?
আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । নিকিতা বটতলার ফুচকা মামার দিকে তাকিয়ে বলল
-মামা দুইটা ফুচকা দিবেন ! একটাতে ঝাল দিবেন বেশি আরেকটা তে একদম কম । মাস্টার সাহেব আবার ঝালে খেতে পারে না !
দেখতে পেলাম ফুচকাওয়ালা আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসলো । যেন ঝাল খেতে না পারাটা কত মজার একটা ব্যাপার ! আমি কেবল তাকিয়ে আছি আশে পাশে । নিকিতা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি ব্যাপার অন্য দিকে তাকিয়ে আছো কেন ? আমার চেহারা পছন্দ হচ্ছে না !
-না মানে ....
-কোন মানে ফানে করবা না তো ! লোকে কি ভাবলো এতো কিছু ভাবলে হবে !
আমরা যখন ফুচকা খেতে শুরু করলাম তখন দেখলাম আমার ডিপার্টমেন্টের একটা মেয়ে এগিয়ে এল ধীর পায়ে । মেয়েটা একটু ভয়ে ভয়ে এগিয়ে আসছে । ভেবেছিলাম সিরিউরিটি ওকে আটকাবে তবে আটকালো না । আমাদের সামনে এসে নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল
-ম্যাম, আপনার অনেক বড় ফ্যান আমি । সত্যি বলতে আপনাকে দেখেই মনে হয়েছে আমরা যদি রাজনীতিতে আসি তাহলে দেশের অবস্থা চাইলেই বদলানো সম্ভব ! আপনার সাথে কি একটা ছবি তুলতে পারি প্লিজ !
নিকিতা হসলো ! তারপর বলল
-আরে এতো ভয় পাচ্ছো কেন ? আজকে আমি এই মন্ত্রী নই বরং তোমাদের স্যারের উমম.... তোমরা কি বল যেন হ্যা জিএফ হয়ে এখানে এসেছি ।
মেয়েটির মুখের হাসি এবার বিস্তৃত হল । মেয়েটি বলল
-আমি সত্যিই আপনার মত হতে চাই । আপনার মত কাজ করতে চাই ।
-ভেরি গুড । কই ছবি তুলবে না ? আসো !
মেয়েটা ছবি তুলে চলে গেল । দেখতে পেলাম তারপর আরও অনেকেই এগিয়ে এল । এমন কি সেই ছাত্রনেতা কামাল সাহেবেও এগিয়ে এল।
পুরো বিকেলটা নিকিতা ওখানেই কাটালো । রাতে অনলাইনে আবারও ঝড় বয়ে গেল । তবে এবার দেখলাম মানুষ সমালোচনা করছে না । বরং প্রসংশা করছে । একজন এতো ক্ষমতাবান মানুষ হয়ে একটা বিকেল সাধারন ভাবে তার পছন্দের মানুষের সাথে গাছের নিচে বসে ফুচকা খাচ্ছে গল্প করছে ! এটা এর আগে কেউ ভাবতে পেরেছিলো !! কেউ পারে নি । নিকিতা সেই কাজটাই করেছে । সত্যিই বলতে কি এর ফলেই ওর জনপ্রিয়তা যেন আরও বাড়তে লাগলো । সেই সাথে আমিও বিখ্যাত হয়ে গেলাম । আমার ফেসবুকে ফলোয়ারের সংখ্যা বাড়তে লাগলো হুহু করে ! পথে ঘাটে অফিসে সবাই এখন আমার দিকে অন্য চোখে তাকাতে লাগলো । আমার কাছে সব কিছু যেন অন্য রকম লাগছিলো । সত্যি বলতে কি এই হঠাৎ করে টক অব দ্য টাউন হতে পেরে আমার খারাপ লাগছিলো না ।
কিন্তু এতো সবার মাঝে একজন মানুষ ঠিক খুশি ছিল না । সেটা হচ্ছে আমার মা । সে রাজনীতিবীদদের একজন পছন্দ করে না । তবুও নিকিতার আচরন আর আমার নিকিতার প্রতি আগ্রহ দেখে সে চুপ করে ছিলো । কিন্তু নিকিতার আসল পরিচয় জানতে পেরে সে খানিকটা হপ করে রয়েছে । সরাসরি না করছে না তবে ঠিক হ্যাও করছে না ।
নিকিতা মাঝে দুবার এসেছে আমাদের বাসায় । তবে আমার আশা আছে যে মায়ের মন আমি আর নিকিতা মিলে গলিয়ে ফেলবো । নিকিতার খুব জলদিই বিয়ে করার ইচ্ছে । আগামী ইলেকশনের কাজে নামার আগেই সে চাচ্ছে যে বিয়েটা করে ফেলতে । আমারও কোন আপত্তি নেই ।
সব কিছু ঠিকই চলছিলো । এর মাঝে একটা অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটলো । একদিন কুরিয়ারের মাধ্যমে আমার কাছে একটা বক্স এসে হাজির । বক্সটা খুলতেই দেখি তারপর ভেতরে একটা ছোট সেলফোন । চাইনিজ মোবাইল । কম দামী । একটা সীম ভরা আছে ওতে । কিছু সময় খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম সেটার দিকে । আমাকে ফোন গিফট করবে কে ? তাই আবার এই ভাবে ?
ফোনের ভেতরে একটাই মাত্র নাম্বার সেভ দেখেলাম । সেখানে লেখা "কল মি"
কোন কিছু না ভেবে ডায়াল বাটনে চাপ দিলাম । কয়েকবার রিং হতেই ওপাশ থেকে রিসিভ হল । আমি হ্যালো বললাম । কিছু সময় নিরবতার পরে ওপাশ থেকে শুনতে পেলাম
-আপনার জীবন হুমকির মুখে ।
নিশ্চিত ভাবেই একটা মেয়ে কন্ঠ । তবে মেয়েটা সম্ভবত নিজের কন্ঠ লুকাতে চাইছে । আমি বললাম
-মানে ? কি বলছেন !
-শুরুন বেশি কথা বলা যাবে না । হয়তো ট্টেস করে ফেলবে । কেবল এই কথা বলছি খুব সাবধানে থাকবেন । এই ফোনটার কথা কাউকে বলবেন না । আপনার আসল ফোনে আড়িপাতা হয় তাই এই ভাবে আপনাকে সাবধান করলাম । আমি আবার ফোন করবো ! সাবধান !
আর কাউকে বলবেন না এই ফোনের কথা । কাউকে না !
বলেই ফোনটা কেটে গেল । আমি আবার ফোন দিলাম । কিন্তু ফোনটা বন্ধ পেলাম । কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । নিকিতাকে কি জানাবো এই ফোনের কথা ?
কিন্তু তখনই মনে হল ফোনকারী কাউকে না জানাতে বলেছে । অবশ্য নিকিতা আমাকে আগেই সাবধান করেছে । আমি যেহেতু নিকিতার সাথে আছি তাই বিরোধী দলের কাছে আমি এখন একটা টার্গেটে পরিনত হয়েছি । আমার পেছনে সব সময় চর লাগিয়ে রাখার পেছনেও এই একটা কারন আছে । আমি খানিকটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগতে লাগলাম । আমার কি বিপদ হতে পারে ! বুঝতে পারছি না !
চলবে.......
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৯ দুপুর ১২:৪৮