আরেকবার ঢোক গিলে আমি ঘরের চারিদিকে তাকালাম৷ ঠিক ঘর নয় এটা। বড় একটা হল রুম মনে হচ্ছে। একটা ফার্ম হাউজে নিয়ে আসা হয়েছে আমাকে। কেন নিয়ে আসা হয়েছে সেই বিষয়ে আমার কোন ধারনা নেই৷ তবে বুকের ভেতরে একটা ভয় অনুভব করছি। কারন আমাকে যারা তুলে নিয়ে এসেছে তারা নিজেদের পুলিশ বলে পরিচয় দিয়েছে। ভাব চক্করেও তাই ই মনে হয়েছে৷ কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না আমাকে কেন তুলে নিয়ে আসলো?
আমি এমন কোন কাজ কি করেছি?
নিজের মনকে জিজ্ঞেস করলাম?
হাজার চেষ্টা করেও এমন কিছু মনে করতে পারল না। আমি সাধারন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। ছাত্র ছাত্রীদের পড়ানো ছাড়া কোন কাজ করি না, রাজনীতি নিয়ে একটা কথাও বলি না। আর সরকারের বিরুদ্ধে কিছু বলার তো প্রশ্নই আসে না। তাহলে আমাকে তুলে আনলো কেন? আমাজে গুম করবে নাকি?
আমি ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। আর ভাবতে লাগলাম কি এমন কাজ করেছি যেটার কারনে আমাকে এখানে আনা হয়েছে । তখনই একটা কারন আমার মনে পড়লো । গত কয়েক দিন আগে আমি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র নেতার সাথে একটু ঝামেলা করেছিলাম । সেটার করনে কি এখানে আনা হয়েছে আমাকে ?
একবার কি উঠে পালানোর চেষ্টা করবো ? আমাকে যদিও ঠিক বন্দি করে রাখে নি এরা । আমি উঠতে যাবো এমন সময় একজন খানসামা মত লোক জুসের গ্লাস নিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকলো৷ আমার সামনেই রাখলো গ্লাসটা।
জুসের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলাম কাঁচা আমের জুস। কাঁচা আমের জুস আমার খুব পছন্দ। ক্রস ফায়ারে দেওয়ার আগে শুনেছি বন্দীকে পছন্দের খাবার খাওয়ানো হয়। আমার বেলাতেও কি তাই করা হচ্ছে?
খানসামা বলল, স্যার রাতে কি খাবেন? আপনার পছন্দের ইলিশ মাছ আর গরুর ভূনা করেছি আর কিছু কি লাগবে?
আমি আবারও খানিকটা দ্বিধায় পরে গেলাম। একে তো স্যার বলতেছে আবার আমার পছন্দের খাবারের কথাও জানে। তার মানে আমার ব্যাপারে বেশ খোজ খবর নিয়েছে এরা। প্রথমে মনে হয়েছিল এরা হয়তো ভুল করে নিয়ে এসেছে আমাকে কিন্তু এখন আর তা মনে হচ্ছে না। কিন্তু সেই প্রশ্ন তো থেকেই যাচ্ছে। আমাকে কেন উঠিয়ে নিয়ে আসছে এরা? আবারও সেই ছাত্রনেতার কথা মনে পড়লো । কিন্তু কিছু বুঝতে পারছিলাম না । আমি জুসের গ্লাসটা হাতে নিয়ে ছোট করে চুমুক দিলাম। তারপর চুপচাপ বসে অপেক্ষা করতে লাগলাম। মরবো যখন খেয়েই মরি।
কিন্তু আমার জন্য সত্যি অন্য কিছু অপেক্ষা করছি। আমের জুসটা যখন শেষ হয়েছে তখন একজন ঘরের ভেতরে ঢুকলো। চেহারাটা খুবই পরিচিত মনে হল আমার। মেয়েটাকে আমি চিনি। কিন্তু ঠিক চিনতে পারছি না।
মেয়েটির পরনে একট সাদা টিশার্ট আর নীল জিন্স। গলায় একটা লাল স্কার্ফ জড়ানো৷ চুল গুলো পনিটেইল করে বাঁধা পেছনে। আমার দিকে তাকিয়ে হাসলো। তারপর বলল, আমটা আমাদের নিজেস্ব বাগানের। কোন রকম ক্যামিক্যাল ছাড়া। জুস ভাল হয়েছে?
আমি বললান, হ্যা। ধন্যবাদ।
মেয়েটি ঠিক আমার সামনে এসে বসলো। তারপর বলল, আপনি মনে হচ্ছে আমাকে এখনো চিনতে পারেন নি। তাই না?
আমি বললান, জি ঠিক চিনতে পারছি না। কিন্তু কেমন যেন পরিচিত মনে হচ্ছে খুব।
মেয়ে হাসলো৷ তারপর ঘড়ির দিকে তাকালো৷ কয়েক মুহুর্ত পরে টি টেবিল থেকে রিমোট টা হাতে নিয়ে টিভি ছাড়লো। সময় টিভিতে সংবাদ শুরু হচ্ছে।
আমি ঠিম বুঝতে পারছি না। তবে সংবাদটার চ্যানেলের রেখে দিল সে৷ তার মানে আমাকে সংবাদ দেখার ইংগিত করছে সে। শিরোনাম শেষ হয়ে গেল। বিস্তারিত সংবাদের প্রথম সংবাদ টাই ছিল এক মন্ত্রী কে নিয়ে। সংবাদ পাঠিকা বলছে, আজ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকিতা আহমেদ ঢাকার পেট্রল পুলিশের এক নতুন উইনিট ভবনের উদ্ভোদন করেন।
টিভিতে নিকিতা সানগ্লাস পরা নিকিতা আহমেদ কে দেখা গেল। আর তখনই আমার বুকে বিস্ময়ের একটা তীব্র ধাক্কা লাগলো। আমি আরেকবার তাকালাম সামনে বসা মেয়েটির দিকে৷
নিজের চোখকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আমার সামনে স্বয়ং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিকিতা আহমেদ বসে আছে!
আমার সাথে কি হচ্ছে এসব!
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে আমাকে কেন ধরে নিয়ে এসে নিজের গাছের আমের জুস খাওয়াচ্ছে?
দুই
যদি এখন কাউকে প্রশ্ন করা হয় দেশের সব থেকে জনপ্রিয় মেয়েকে?
না, কোন অভিনেত্রী কিংবা গায়িকা নয়, সেটা হচ্ছে নিকিতা আহমেদ৷ আমাদের দেশের ইতিহাসের সব থেকে কম বয়সী স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগে কেউ এতো অল্প বয়সে এমপি পর্যন্ত হয় নি, সেখানে নিকিতা মন্ত্রী হয়ে গেছে। অবাক হওয়ার মত ব্যাপার৷ ইন্টারনেটে নিকিতাকে নিয়ে অনেক রকম গল্প প্রচলিত আছে। অনেক বড় বড় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ছেলে, ব্যবসায়ীরা নিকিতাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসে আছে কিন্তু নিকিতা কাউকে পাত্তা দেয় নি৷ তার একই বক্তব্য হচ্ছে আগে যে কাজে নেমেছে সেটা আগে ঠিক মত করে নিক, তারপর অন্য কিছু।
নিকিতা আহমেদের জীবনটা বড় বৈচিত্র্যময়। মাত্র ২২ বছরের অনার্স শেষ করে। তার পরের বছরই বিসিএস সিভিল সার্ভিসে যুক্ত হয় কিন্তু সেখানে গিয়ে লক্ষ্য করে চাইলেও আসলে সে কিছু করতে পারছে না৷ তার পথ বন্ধ। নানান দিক থেকে নানান বাঁধা। এতো বাঁধার মধ্যে নিকিতা নিজের কাজ ঠিক মত করতে পারছিলো না। অন্যদিজে নিকিতার বাবা আজাহার আহমেদ তখন বিরোধী দলের বড় নেতা। বাঁধাটা তাই একটু বেশিই ছিল ওর জন্য। একটা সময় সেটা অসহ্যকর হয়ে ওঠে ওর জন্য।
নিকিতা সিভিল সার্ভিস ছেড়ে দিয়ে পলিটিক্সে জয়েন করলো। বাপকে ছাড়িয়ে যেতে তার সময় লাগলো না। তার পার্টির প্রধান নিকিতার মধ্যকার পটেনশিয়ালিটিকে ধরতেও ভুল করলো না। সে তা প্রমানও করে দিল। যখন ক্ষমতাসীন দল তাদের উপর জোর জবরদস্তি করছিল নিকিতা সেগুলোর প্রতিবাদ করলো সবার সামনে থেকে। মাঠ পর্যায়ে নেমে কাজ করতে থাকে একটানা। টাইম লাইনে আসতেও সময় লাগলো না। পরের টার্মে যখন তারা ক্ষমতায় এল সবাইকে অবাক করে দিয়ে নিকিতা আহমেদ দায়িত্ব পেল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রনালয়ের। অনেকে ভেবেছিল নিকিতার মত কম বয়সী কেউ এই দায়িত্ব ঠিক ভাবে পালন করতে পারবে না। কিন্তু সেই ধারনাকেও ভুল প্রমাণিত করে শক্ত হাতে মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করে চলল৷ ধীরে ধীরে নিকিতা আহমেদের সুনাম ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। যে বদনাম স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ছিল সেটা আস্তে আস্তে কমতে লাগলো । সে সবার পরিচিত মুখ হতে লাগলো। ধীরে ধীরে সে ওয়ান্ডারওম্যান হতে শুরু করলো। অবিবাহিতো পুরুষদের ক্রাশে পরিনত লাগলো সে!
আজকে সেই মেয়ে আমার চোখের সামনে বসে আছে। আমি প্রথমে নিকিতাকে চিনতে পারি নি তার কারন হচ্ছে আমার মাথার মধ্যে এই ধারনা আসেই নি যে নিকিতার মত আমার সামনে আসতে পারে। দ্বিতীয় কারন হচ্ছে নিকিতাকে যখনই টিভিতে দেখেছি, সব সময় দেখেছি পরিপাটি শাড়িতে এবং সব সময় ওর চোখে একটা কালো সানগ্লাস থাকে আর চুল থাকে খোলা।
নিকিতাকে এভাবে শক্ত করে চুল বাঁধা আর টিশার্ট জিন্সে আমি একদমই চিনতে পারি নি। আমি তাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম নিকিতার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমার মাথার ভেতরে কিছুই ঢুকছে না। আমি নিকিতার দিকে তাকিয়ে বললাম
-আমি আসলে ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি কি কোন ভুল কিংবা অন্যায় করেছি যে আমাকে এভাবে ধরে আনা হল?
প্রশ্নটা করেই মনে হল, এটা কি বললাম! এমন প্রশ্ন করা কি ঠিক হল? নিকিতা বলল, অন্যায় তো করেছেনই!
-কি অন্যায়?
-আপনি কি জানেন না একজন সুন্দরী মেয়ের প্রতি প্রোপার এটেনশন না দেওয়া টা অন্যায়। আপনার কি মনে আছে গত মাসে আমি আপনাদের ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিলাম একটা ফাংসনে। মনে আছে?
আমি বললাম
-জি মনে আছে।
-আপনাদের ডিপার্টমেন্টের প্রোগ্রাম ছিল। মনে আছে?
-জি আছে।
-এটাও মনে আছে যে যখন আমি সেখানে হাজির হলাম সব অবিবাহিত শিক্ষকরা তো বটেই বিবাহিত প্রফেসরেরা পর্যন্ত আমার দিকে পূর্ন মনযোগ দিচ্ছিলো। মনে আছে?
আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। নিকিতা বলল, কেবল একজন বাদে।
আর আমি জানি সেই একজন হচ্ছি আমি। আমি ঐদিন সত্যিই নিকিতার আশে পাশে যায় নি। কেন যাই নি, এটা অবশ্য আমি নিজেও জানি না। কেবল কাছে গিয়ে হ্যাংলামি করতে ইচ্ছে হয়নি। আরেকটা কারন অবশ্য আছে। আমি খুব ভাল করেই জানতাম যে এই মেয়ের আগে পিছে ঘুরে কোন লাভ হবে না৷ খামোখা সময় নষ্ট করার মানে নেই। এর থেকে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের রিদি ম্যাডামের পিছনে ঘুরে লাভ আছে। আমার মনযোগ আপাতত সেই দিকেই।
নিকিতা বলল, কাজটা আপনি মোটেই ঠিক করেন নি৷ এর শাস্তি তো আপনাকে পেতেই হবে।
আমি খানিকটা ঢোক গিলে বললাম, কি শাস্তি?
সেটা রাতে বলবো। আপাতত আসুন বাইরে যাওয়া যাক। আকাশে মেঘ জমছে। বৃষ্টি আসবে সম্ভবত। এই বৃষ্টিতে ভিজে মজা আছে৷
আমি কেবল অভাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম৷ নিকিতা পুরো দেশের সামনে যে ইমেজ তৈরি করে রেখেছে সেটার সাথে এই নিকিতার কোন মিলই খুজে পাচ্ছি না। কি হচ্ছে এসব?
তিন
আমার খুব ইচ্ছে করছে পকেট থেকে মোবাইল বের করে নিকিতার ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট করে দিতে ৷ তার পর ক্যাপশনে লিখি, দেখো তোমাদের গুরুগম্ভীর মন্ত্রী আমার সামনে কিভাবে নাচানাচি করছে।
আমরা বারান্দায় এসে দাড়ানোর প্রায় সাথে সাথেই বৃষ্টি নেমে গেল। একেবারে ঝুম বৃষ্টি। নিকিতা আমাকে বারান্দায় রেখেই সামনের লনে নেমে পড়লো।
আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুরো জায়গাটা আরও ভাল করে দেখতে লাগলো৷ পুরো বাড়িট উচু দেওয়াল দিয়ে ঘেরা। দুই তলা ফার্ম হাউজের সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা৷ সেখানে সবুজ ঘাস দেখা যাচ্ছে। দেওয়ালের কাছে অনেক গাছ লাগানো লাইন ধরে৷
আমি নিকিতার দিকে তাকিয়েই রইলাম। আমার সামনে নিকিতাকে দেখে আমার এখনো ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। নিকিতা হঠাৎ আমার সামনে এসে বলল, কি ব্যাপার এসো!
তুমি!
একটু আগেই না এই মেয়ে আমাকে আপনি করে বলছিল। এখন তুমি করে বলছে। আমি কি বলবো বুঝতে পারলাম না। কি বলা উচিৎ সেটাও বুঝতে পারলাম না৷ আমাকে অবাক করে দিয়ে নিকিতা আমার হাত ধরে টান দিলো৷ আমাকে বৃষ্টির ভেতরে টেনে নিয়ে গেল৷ বৃষ্টির পানি শরীরে পড়তেই আমার মধ্যে অদ্ভুত আনন্দ অনুভূতি হল। ছোট বেলাতে বৃষ্টি হলেই আমি ভিজতাম। তারপর একদিন একটা ঘটনার পর থেকে আমি বৃষ্টিতে ভেজা বন্ধ করে দিয়েছি। এখন বৃষ্টি দেখলেই আমার বিরক্তি আসে। কিন্তু আজকে এল না। বরং ভাল লাগলো৷
নিকিতা জিজ্ঞেস করলো, কেমন লাগছে?
বললাম, ভাল লাগছে। আসলে বহুদিন আমি বৃষ্টিতে ভিজি নি।
নিকিতা বলল, আইরিনের চলে যাওয়ার পরে একদম বৃষ্টি পছন্দ কর না, তাই না?
আমি সত্যিই অবাক হয়ে গেলাম৷ আইরিনের কথাও জেনে গিয়েছে এই মেয়ে! তারমানে আমার ব্যাপারে আর কিছুই জানতে বাকি নেই। সেই ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় আমার কার সাথে প্রেম ছিল, সেটা ভেঙ্গে যাওয়ার পর আমার কোন জিনিসের উপর থেকে মন উঠে গেছে, এই সব যখন জেনে গেছে তখন সত্যি বলতে কি এই মেয়ের আর কিছুই জানতে বাকি নেই। আমার ব্যাপারে সব কিছুই জানে এই মেয়ে। আমি নিকিতার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ওকে দেখে মনে হচ্ছে এসএসসি দেওয়া কোন কিশোরী মেয়ে সে। আমার হঠাৎ করেই নিকিতাকে ভাল লেগে গেল।
একেবারে অন্ধকার পর্যন্ত বৃষ্টিতে ভিজলাম আমরা৷ যখন বৃষ্টি থেকে আবার বারান্দায় উঠলাম তখন আমরা দুইজনই শীতে কাঁপছি একটু একটু করে৷ আমার জন্য বাথরুমে নতুন ট্রাউজার আর টিশার্ট রাখা ছিল। আমার শরীরের মাপেরই। আমার সব কিছু সে আগে থেকেই খোজ নিয়েই রেখেছে। এটা জানা তার পক্ষে অসম্ভব কিছু না ।
রাতে খাবার সময় নিকিতা নিজেই খাবার এগিয়ে দিচ্ছিলো। যখন কথা বলছিল মনে হচ্ছিলো আমাকে সে কতদিন থেকে চেনে।
নিকিতা বলল, শুনো আজকে রাতে আর বাসায় গিয়ে লাভ নেই। কালকে আমার এখানে একটা প্রোগ্রাম আছে। সেখানে যেতে হবে। তুমি তারপর এখান থেকে বের হয়ে যেও।
আমি বললাম, আমি বাসায় একটা ফোন দিই। নয়তো আম্মু চিন্তা করবে।
-হু। ফোন দেও। তবে বলো না যে তুমি কার সাথে আছো।
-মাথা খারাপ!
রাতেও নিকিতা বেশ রাত পর্যন্তই গল্প করলো আমার সাথে। আমি এখনো নিকিতার মনভাব ঠিক বুঝতে পারছি না। কেবল একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি যে নিকিতা আমার প্রতি আগ্রহবোধ করছে। সম্ভবত ঐদিন আমি অন্য সবার মত ওর প্রতি আগ্রহবোধ করি নি এই জন্য। শুনেছি মেয়েরা সেই সব ছেলেদের প্রতি আগ্রহবোধ করে যারা তাদের প্রতি আগ্রহ দেখায় না। হয়তো এই কারনেই নিকিতা আমার প্রতি আগ্রহ বোধ করছে।
সকালবেলা একটু বেলা করে ঘুম ভাঙ্গলো। বাইরে বের হয়ে দেখি নিকিতা বের হয়ে গেছে। খানসামার কাছে আমার জন্য একটা চিরকুট রেখে গেছে।
চিরকুট খুললাম। সেখানে লেখা
অপু সাহেব,
সকাল বেলা ঘুমিয়েছিলেন বলে আর ডাক দেয়নি৷ সকাল সকালই বের হয়ে হচ্ছে। দেখা হল না। তবে আমাদের দেখা আর কথা হতেই থাকবে। আমি যখন একবার তোমার জীবনে ঢুকেছি তখন তোমার জীবনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সহ সকল মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আমি নিয়ে নিবো।
ইতি
তোমার ব্যক্তিগত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
বিঃদ্রঃ তোমার জন্য গাড়ি রেড়ি থাকবে। তোমাকে ঢাকায় পৌছে দিবে।
চিরকুট পড়ে কিছু সময় চুপ করে বসে রইলাম। বুঝতে পারছি আমার জীবনে সত্যি সত্যিই বড় রকমের পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে৷
চার
আমি খুব অবাক হয়ে আমার ছাত্রের দিকে তাকিয়ে থাকলাম । আমার আসলে এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না এই ছেলে সত্যি সত্যিই তার বড় ভাইকে ডেকে নিয়ে এসেছে । বড় ভাই আবার যে কেউ না । বর্তমান ক্ষমতাশীন দলের ছাত্র অঙ্গ সংগঠনের বড় নেতা । তার ভাই আমার ছাত্র । পুরো সেমিস্টার জুড়ে কোন পরীক্ষা দেয় নি । কোন ক্লাস করে নি । এখন এসেছে আমার কাছে ক্লাস এটেনডেন্স আর পারফরমেন্সের নাম্বার নিতে ।
কামাল আফসার হচ্ছে সেই বড় নেতা । আমার দিকে তাকিয়ে শান্ত কন্ঠে বলল, তাহলে আপনি নাম্বার দিবেন না ?
-না । আমি ওকে কেন নাম্বার দিবো ? দেখো তোমার ভাই কোন পরীক্ষা দেয় নি । আমি এটা ওর জন্য কনসিডার করতে পারি । কাল পরশু ওর জন্য আলাদা একটা পরীক্ষা নিতে পারি । সেই নাম্বার যোগ হবে । কিন্তু ও যে ক্লাসে উপস্থিত হয় নি সেখানে ওকে আমি কোন নাম্বার দিবো না । মোট ২৬টা ক্লাস নিয়েছি । তোমার ভাই একটাতেও উপস্থিত ছিল না ।
কামাল আফসার বলল, আপনি জানেন আমি কে ? আর আমার ভাই হিসাবে ওর নিজের অনেক কাজ থাকে । অনেক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় ওকে ।
এবার আমি কামাল আফসারের চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, স্টুডেন্টের সব থেকে গুরুত্বপূর্ন কাজ হচ্ছে পড়াশুনা করা । তারপর অন্য কাজ ! আমার কাছ থেকে যদি নাম্বার পেতে হয় তাহলে ওকে এই কাজই করতে হবে । ফ্রিতে আমি ওকে কোন নাম্বার দিবো না ।
-কাজটা কিন্তু আপনি ভাল করছেন না !
-আমি ভাল করছি কি করছি না সেটা আমার উপরে ছেড়ে দাও । আমাকে আমার কাজ শেখাতে এসো না । এখন তোমরা আসতে পারো । আমার ক্লাস নেওয়ার সময় হয়েছে ।
আমি আর ওদের দিকে মনযোগ দিলাম না । একটু যে অস্বস্থি লাগছিলো না, সেটা বলবো না । শুনেছি অন্য সব স্যারেরা নাকি এই ছেলেকে ঠিকই নাম্বার দিয়ে দিয়েছে । কেবল আমি দিচ্ছি না । আমি অফিস রুম থেকে বের হতে যাবো তার আগে কামাল আফসার বলল
-আমি আপনাকে আরও দুইদিন সময় দিলাম ।
-তুমি আমাকে দুইদিন যেন ২০০ দিন সময় দিলেও আমার কথার নড়চড় হবে না । তা তুমি যাই কর না কেন ?
-আপনি কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আর চাকরি করতে পারবেন না ।
-না পারলে পারবো না । কোন সমস্যা নেই । তুমি এখন আসো !
আমার দিকে আরও কিছু সময় কঠিন চোখ তাকিয়ে রইলো কামাল আফসার । তারপর রুম থেকে বের হয়ে গেল ।
এই ঘটনা প্রায় মাস খানেক আগের । তারপর থেকে আমার উপর আরও কয়েকবার হুমকি ধামকি এসেছে । এমন কি আমাদের চেয়ারম্যান স্যার আমাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বলেছে আমি যেন ঝামালে না করে নাম্বার টা দিয়ে দেই । কি দরকার এমন উটকো ঝামেলায় জড়ানো । আমি সেই কথা গুলো শুনেও না শোনার ভান করেছি । এমন কি একদিন ফিজিস ডিপার্টমেন্টের সেই রিদি ম্যাডামও আমাকে বলল, যেন আমি ঝামেলা এড়িয়ে চলি । কিন্তু ঝামেলা এড়িয়ে চলতে পারলাম না ।
তারপর গত সপ্তাহের ঘটনা ঘটলো । সত্যিই বলতে কি ওরা যখন আমাকে প্রথম তুলে নিয়ে গেল তখন আমার সবার আগে এই মনে হয়েছে যে হয়তো কামাল আফসারের লোকই আমাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে । তখন আমি খানিকটা ভয়ই পেয়েছিলাম ।
আজকে ক্লাস নিয়ে এসে অফিস রুমে বসে আছি তখনই হইচই শুনতে পেলাম । তার কিছু সময় পরেই পিয়ন ছুটে এল আমার রুমে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-স্যার আপনি আজকে চলে যান । পেছনের দরজা দিয়ে বের হয়ে যান !
-কেন ?
-স্যার আজকে ঝামেলা হবে । কালাম মামার লোকজন আসতেছে । তাদের মাথা হট আছে ।
একটু পরে দেখলাম চেয়ারম্যান স্যার রুমে ঢুকলো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-অপু একটা ঝামেলা হয়ে গেছে ।
-কি হয়েছে স্যার ।
-আজকে ওরা তোমাকে সম্ভবত আটকে দিবে । আমি পুলিশে খবর দিয়েছি কিন্তু কি কারনে যেন ওরা ঠিক গা করছে না । সম্ভবত এখানে আসার আগে পুলিশে বলে এসেছে । আমি প্রোক্টর স্যারকে ফোন দিচ্ছি কিন্তু তিনি ফোন ধরছেন না ।
তারপর আমার সামনে বসে পড়লেন । কি করবে ঠিক যেন বুঝতে পারছে না । তারপর আবারও বলল
-এই জন্য আমি ঝামেলা এড়াতে বলেছিলাম । ওদের মত আমরা না তুমি জানো !
-কিন্তু তাই বলে অনৈতিক কাজ করবো !
-সব সময় নৈতিকতা ধরতে গেলে চলে ! বাস্তব কত কঠিন বুঝতে পারছো না । আমাদের সব সময় কম্পমাইজ করতেই হয় !
পুরো দুপুর আমি রুম থেকে বের হতে পারলাম না । বেশ কিছু ছাত্র/অছাত্র আমাদের ডিপার্টমেন্টের সামনে আমার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো । এরই মাঝে একবার পুলিশ এল তবে এসে তারা আমার সাথে কথা না বলেই চলে গেল । এর জন্য অবশ্য ডিপার্টমেন্টের সামনে থেকে ওরা চলে গেল । তবে আমি খবর পেলাম যে ওরা ক্যাম্পাসের গেটের সামনে অপেক্ষা করছে । আমাকে দেখা মাত্রই হামলা করবে !
যখন বিকেল হয়ে গেল তখন আস্তে আস্তে ক্যাম্পাস ফাঁকা হতে লাগলো । আমি বাইরে বের হতে পারলাম না । একটু ভয় সত্যিই করছিলো । একবার ভাবছি প্রধান গেট দিয়ে না বের হয়ে পেছনের দেওয়াল টপকে যাবো । কিন্তু সেখানেো কেউ থাকতে পারে । এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠলো ।
অপরিচিত নাম্বার !
রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পরিচিত আওয়াজটা শুনতে ।
-আমাকে একবার ফোন করা যেত না ?
-না মানে !!
-না মানে কি ? আমি নানান কাজে ব্যস্ত থাকি তোমার উপর কি ঝামেলা হচ্ছে সেটা কিভাবে জানবো ! একবার জানাবে না আমাকে ?
আমি চুপ করে রইলাম । আসলে নিকিতা ফোন করার কথা মনে এসেছিল কিন্তু কেন জানি করতে ইচ্ছে করে নি । মেয়েটির সাথে সেদিনের পরে আর দেখা হয় নি । মাঝে অবশ্য দুইবার কথা হয়েছিলো । ও বলেছিলো যে কটাদিন নাকি ও একটু বেশি ব্যস্ত থাকবে । একটু ফ্রি হলেই আমাকে ফোন দিবে । তাই আমি আর ওকে ফোন দেই নি ।
নিকিতা বলল
-তুমি এখনই বের হও অফিস থেকে ।
আমি ফোন রেখে ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হলাম । হাটতে লাগলাম প্রধান গেটের দিকে । সামনে কয়েকজন ছেলেকে দেখতে পেলাম । ওরা যে কামাল আফসারের লোক সেটা বুঝতেও কষ্ট হল না । দেখলাম কয়েকজন আমার সাথে সাথেই হাটতে লাগলো । কেউ কেউ আবার ফোন দিচ্ছে । সামনে মানুষকে প্রস্তুত থাকতে বলছে ।
আমি বুকে ঢিপঢিপ ভয় নিয়ে এগিয়ে চলছি । যখন গেট থেকে আর মিনিট খানেকের পথ তখনই পুলিশের গাড়িটা দেখতে পেলাম । একটা নয় পরপর তিনটা । একেবারে সামনে এসে থামলো আমার । তারপর সেই গাড়ি তিনটা থেকে হুরমুর করে পুলিশ নামতে শুরু করলো । আমাকে ঘিরে কম করে হলেও ৫০ জন পুলিশ দাড়িয়ে গেল । ওরা আমার দুই পাশে চলে এল । কারো মুখ দিয়ে কোন কথা বের হল না । কেবল ওরা আমাকে দুইপাশ থেকে গার্ড দিয়ে হাটতে লাগলো । আমাদের দলটা বের হয়ে এল গেটের কাছে । আমি কামাল আফসারকে দেখতে পেলাম । আমার দিকে তাকিয়ে আছি খানিকটা অবাক চোখ । সম্ভবত বুঝতে পারছে না কিংবা হিসাব মেলাতে পারছে না । আমাকে কেন এতো পুলিশ গার্ড দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ।
সিএনজিতে ওঠার আগ পর্যন্ত পুলিশ আমাকে ঘিরেই রাখলো । আমি যখন সিএনজিতে উঠলাম তখন একজন অফিসার গোছের পুলিশ আমার কাছে এসে বলল
-একটা গাড়ি আপনার সিএনজির পেছন পেছন যাবে আপবার বাড়ি পর্যন্ত !
আমি বললাম
-কোন দরকার নেই । আমার মনে হয় না ওরা পেছন পেছন আসবে !
-আমরা সরি স্যার । আমাদের আও আগে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার ছিল ।
কিছু বলতে গিয়েও বললাম না । সিএনজি ওয়ালাকে সামনে চালাতে বললাম ।
নিকিতার ফোন এসে হাজির হল আবারও । বলল
-সব কিছু ওকে ?
-হ্যা । এমন একজন পাওয়ারফুল পরিচিত মানুষ থাকলে সব কিছু ওকে না হয়ে পারে !
নিকিতা হাসলো । তারপর বলল
-আমি এরপর থেকে খেয়াল রাখবো । তুমি বাসায় যাও ।
পরদিন যখন আবার ক্যাম্পাসে এলাম দেখলাম সব কিছু কেমন বদলে গেছে । কালকের ঘটনা ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে । স্যারেরা আমাকে অন্য চোখে দেখা শুরু করছে । আমার কোন ক্ষমতাবান পরিচিত আছে এটা জেনে গেছে তারা । আমাকে এখন একটু সমীহ করে চলতেই হবে তাদের ।
কিন্তু সব থেকে মজার ঘটনা ঘটলো যখন কামাল আফসার এসে হাজির হল । আমি ক্লাস নিয়ে বের হচ্ছি তখনই তাকে দেখতে পেলাম । সাথে অবশ্য আজকে কেউ নেই । সে একদম একা । আমি বের হতেই আমার সামনে এসে হাজির ! বলল
-স্যার আমি আসলে খুব লজ্জিত ।
আমি না বুঝার ভান করে বললাম
-লজ্জিত কেন ?
-কালকের আচরনের জন্য । আমি আসলে বুঝতে পারি নি ।
-তুমি কোনটা বুঝতে পারো নি ?
কামাল আফসার খানিকটা দ্বিধায় পড়ে গেল । আমি বললাম
-এখানে দুইটা ব্যাপার আছে । তুমি কোনটা বুঝতে পারো নি ! তোমার ভাইকে অনৈতিক ভাবে নাম্বার দেওয়ার অনুরোধ পরে হুমকি দেওয়াটা ঠিক হয় নি এটা বুঝতে পারো নি নাকি আমার একজন ক্ষমতাবান পরিচিত মানুষ আছে বুঝতে পারো নি ?
কামাল আফসার আবারও চুপ করে রইলো । আমি বললাম
-যদি প্রথমটা হয়ে থাকে তাহলে ইউ আর ফরগিভেন কিন্তু দ্বিতীয় কারনে যদি তুমি লজ্জিত হও তাহলে সামনে থেকে চলে যাও । তোমার মুখ আমি দেখতে চাই না !
দেখতে পেলাম কামাল আফসারের মুখ লাল হয়ে গেছে । তার সাথে এই ভাবে কথা বলার সাহস হয়তো কারো নেই । কেউ হয়তো বলেও নি । আমার কাছ থেকে শুনে অমানিত বোধ করছে কিন্তু সে নিশ্চয়ই এতো সময়ে টের পেয়ে গেছে যে আমার পেছনে যে মানুষটা আছে সে তার থেকেও অনেক ক্ষমতাবান । আমাকে কিছু বলার সাহস তার নেই ।
আমি বললাম, তুমি আমাকে সেদিন হুমকি দিয়েছিলে যে আমি এখানে চাকরি করতে পারবো না । এখন আই গেস আমি এমন কিছু করতে পারি । সত্যিই পারি ! তুমি দেখতে চাও ?
তাররপই নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে নিলাম । এই কাজটা করা মোটেও ঠিক হল না । ক্ষুদ্র ক্ষমতাবান মানুষ গুলো তাদের ক্ষমতা মানুষকে দেখাতে পছন্দ করে অন্য দিকে প্রকৃত ক্ষমতাবানেরা কেবল প্রয়োজনে পদক্ষেপ নেয় । আমি আর কিছু না বলে নিজের অফিসের দিকে হাটা দিলাম ।
গতকয়েক দিন আমি নিকিতার ব্যাপারে খানিকটা দ্বিধান্বিত ছিলাম । মেয়েটা কেন হঠাৎ করে আমার প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠলো সেটা আমি বুঝতে পারছিলাম না । তবে আজকে কেন জানি সেসব আর কিছু মনে হচ্ছে না । বারবার মনে হচ্ছে মেয়েটা আমাকে পছন্দ করে এবং আমার নিজের কাছে যথেষ্ঠ কারন আছে তাকে পছন্দ করার !
পাঁচ
ক্যাম্পাস থেকে বাসায় যাওয়ার সময়ে আমি কেবল নিকিতার কথা ভাবছিলাম । কদিনের ভেতরে আমার সাথে কি হয়ে গেল । গত কয়েক দিন আগেও প্রবল ক্ষমতাধর ছাত্র নেতা কিভাবে আজকে আমার সামনে কাচুমুচু হয়ে দাড়িয়ে ছিল । ক্ষমতার বুঝি এই দাপট ! আমি নিজেও এখন সেটা টের পাচ্ছি । নিজেকে অন্য রকম লাগছে ।
বাসার কলিংবের চাপতে যাবো তখনই মনে হল ভেতরে পরিবেশ ঠিক স্বাভাবিক না । আমাদের বাসার মানুষ বলতে তিনজন । আমি বাবা আর মা । বাবা সব সময় বই নিয়েই সময় কাটান । আর মা নিজের কাজ বাদ দিয়ে টিভি দেখেন, নামাজ পড়েন । কথা বার্তা হলেও এতো জোরে আড্ডা টাইপের কথা বার্তা হয় না । তাহলে বাসায় কে এল ?
আগে থেকে কেউ আসলে হয়তো আমি জানতাম । আমাকে না জানিয়ে চলে এসেছে ?
এই রকম আত্মীয় কিংবা বন্ধুবান্ধব খুব একটা নেই আমাদের এখানে ?
আমি দ্বিধা নিয়েই কলিংবের চাপলাম । প্রায় সাথে সাথেই দরজা খুলে গেল । দরজার সামনে যাকে দেখতে পেলাম তাকে আমি এই সময়ে মোটেই আশা করি নি । এই মেয়ে এখানে কি করছে ?
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের লেকচারার রিদি হক !
মেয়েটাকে আমি খুব ভাল করে চিনি । আমরা একই সাথে এবং একই দিনে ক্যাম্পাসে জয়েন করেছিলাম । সত্যি সলতে কি নিকিতার সাথে পরিচয় হওয়ার আগে মেয়েটার সাথে আমি টুকটাক কথা বলটাম । ক্যাম্পাসের ক্যান্টিনে কয়েকবার আমরা এক সাথে চাও খেয়েছি । তাকে খানিকটা বোঝানোর চেষ্টাও করেছি যে আমি তার প্রতি আগ্রহী । সে যদি সবুজ বাতি দেয় তাহলে তার বাসায় আমি কথা বলতে পারি ।
অবশ্য মুখ ফুটে আমি কিছু বলি নি । লজ্জার কারনে বলতেও পারি নি ।
আমি রিদিকে দেখে বললাম
-আপনি ?
রিদি হাসলো । তারপর বলল
-হ্যা । এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম ভাবলাম আপনার সাথে একটু দেখা করে যাই । আসুন আমার বাবা মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই ।
আমি খানিকটা দ্বিধান্বিত দাড়িয়ে রইলাম । রিদির কথা আমি মাকে বলেছিলাম । মা যখন আমার বিয়ের জন্য পাগল হয়ে পরেছিলো আমি তাকে বলেছিলাম যে আমাদের ক্যাম্পাসের একটা লেকচারারকে আমি পছন্দ করি । সে যদি রাজি হয় তাহলে তুমি কথা বলতে বলতে পারো ।
রিদি খুব স্বাভাবিক ভাবে ওর বাবা মায়ের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিল । সবার দিকে তাকিয়ে মনে হল এই ঘরের ভেতরে কেবল আমিই অস্বাভবিক । ঠিক যেন মেনে নিতে পারছি না কিংবা খাপ খাওয়াতে পারছি না নিজেকে ।
আমি কোন মতে বললাম
-আমি ফ্রেস হয়ে আসি !
বাবা বলল
-হ্যা যা । আজকে সবাই মিলে ভাল করে আড্ডা দেওয়া যাবে । তোর সাথে এখানে চলে আসার পরে তো মন খুলে কারো সাথে ঠিক মত কথা বলতে পারি না ।
তারপর রিদির বাবার সাতে গল্প জুড়ে দিলেন । দেখলাম রিদির মা মায়ের সাথে রান্না ঘরের দিকে চলে গেল । আমি নিজের ঘরের দিকে দ্রুত রওয়ানা দিলাম । আসলে কি হচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না । এই মেয়ে ঠিক মত আমার দিকে তখন আগ্রহ দেখায় নি । আমার কাছে তখন কেবল মনে হয়েছে ভদ্রতার খাতিরে আমাকে তখন না বলে নি । কিন্তু আজকে একেবারে নিজের বাবা মাকে নিয়ে হাজির হয়েছে আমার বাসাতে !
ওয়াশরুমে বসে আমি নিকিতার কথা ভাবতে লাগলাম । এই ব্যাপারটা আমি নিকিতাকে কিভাবে বলবো ?
ঐদিন অবশ্য বিয়ের কথা বার্তা হল না । তবে রিদির বাবা মায়ের আচরনে এটা পরিস্কার হয়ে গেল যে আমাকে তাদের পছন্দ হয়েছে । এমন ছিমছাপ পরিবারে তারা তাদের মেয়ের বিয়ে দিতে ইচ্ছুক । অন্য দিকে আমার মায়ের ভাব ভঙ্গি দেখে মনে হল যে সে রিদিকে নিজের পুত্রবধু হিসাবে একেবারে বরন করেই নিয়েছেন ।
পরদিন ক্যাম্পাসে রিদি আমার অফিস রুমে এসে হাজির হল । এমন ভঙ্গিতে কথা বলতে লাগলো যেন আমরা কতদিনের প্রেমিক প্রেমিকা । আমি চুপচাপ ভাবতে লাগলাম এখন আমি কি করবো ? এই ব্যাপারটা নিকিতাকে কিভাবে জানাবো ? আর আমি যদি না জানাই তাহলে ও ঠিক ঠিক কোন না কোন ভাবে জেনেই যাবে । আর অন্য কারো কাছ থেকে জানতে কি হবে সেটা আমার বুঝতে বাকি রইলো না ।
আমার মনের কথা মনেই রয়ে গেল । পিয়ন এসে বসে বলল যে একজন মেয়ে আমার সাথে দেখা করতে চায় । আমি বললাম
-নাম কি ?
পিয়ন বলল
-নাম বলছে নিকিতা । আর বলেছে নাম বললেই হবে ।
আমার চোখ কপালে উঠলো । নিকিতা যদি এই ক্যাম্পাসে আসে তাহলে চারিদিকে হুলস্হুল পড়ে যাবে । কিন্তু সে রকম তো কিছু হয় নি । তাহলে কি অন্য কোন নিকিতা ?
এমনিতেও এক নিকিতা নিয়ে আমি ঠিক শান্তিতে নেই, এ আবার কোন নিকিতা ?
আমি বললাম আচ্ছা পাঠাও ভেতরে ।
রিদি আমর সামনেই বসেছিল । ঠিক সেই সময়ে আমি দরজাতে একটা মেয়েকে দেখলাম । সে যে নিকিতা আহমেদই সেটা বুঝতে আমার মোটেই কষ্ট হল না । নিকিতা একটা সেলোয়ার কামিজের পরে এসেছে । তবে ওড়না দিয়ে নিজের চেহারা খুব করে ঢেকে এসেছে । কেবল চোখ ছাড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছে না । নিশ্চয়ই কোন কিসিউরিটি নিয়ে আসে নি । কেউ জানেও না । আর কেউ ভাবতেও পারবে না হোম মিনিস্টার এই ভাবে কারো সাথে দেখা করতে আসতে পারে ।
আমার থেকে রিদিকে বসে থাকতে দেখে ও খানিকটা সরু চোখ তাকালো । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি ব্যস্ত থাকলে আমি পরে আসি ?
আমি কোন মতে বললাম,
-না না ঠিক আছে । আমি ঠিক ব্যস্ত না । রিদি ম্যাডান আমার পরিচিত । এমনি কথা বলছিলাম ।
রিদির দিকে তাকিয়ে বললাম
-আমি খুবই দুঃখিত । আসলে ওনার সাথে এপোয়েন্টমেন্ট ছিল আমার । আমি ভুলে গিয়েছিলাম ।
রিদি হাসলো তারপর আবার কবে দেখা হবে সেটা বলে বেরিয়ে গেল । যাওয়ার আগে বলে গেল যে আবারো সে এবং তারপর পরিবার বাসায় আসবে আমাদের ।
রিদি চলে যেতেই নিকিতা এসে বসলো আমার সামনে ! তারপর বলল
-এই মেয়ে কি বলে গেল ?
-আসলে ....
-কি আসলে ? বল বল বল !
আমার কাছে মনে হল সব স্বীকার করে নেওয়াই ভাল । আমি শুরু থেকে সব বললাম । নিকিতা গম্ভীর হয়ে শুনলো । তারপর বলল
-এই কথা আমাকে কাল বলা যাই নি ?
-আসলে আমি বলতে সাহস হয় নি । দেখ আমি ভাবতেই পারি নি । ওকেও দোষ দেওয়া যায় না । তোমার সাথে পরিচয় হওয়ার আগে আমি রিদির প্রতি খানিকটা আগ্রহী ছিলাম । ঠিক প্রেম ভালবাসা না । মা বাসা থেকে বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছিলো তাই ...
-ও আমিই আসলে উড়ে এসে জুড়ে বসেছি । থাক আর কি আমি চলে যাই । ঝামেলা চলে যাক !
এই বলেই নিকিতা উঠে দাড়ালো । তারপর ঘুরে হাটা দিল । আমার কি করা দরকার ঠিক বুঝলাম না । আমি নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম । তারপর এক প্রকার দৌড়েই ওর কাছে চলে গেলাম । ততক্ষনে ও প্রায় দরজার কাছে চলে গেছে । আমি খুব সাহস করে ওর হাত চেপে ধরলাম । তারপর ওকে টান দিয়ে রুমে ঢুকালাম ।
দেখলাম নিকিতা এবার জোর করলো না ।
নিকিতা বলল
-কাল কেন তোমার বাবা মা কে বলতে পারো নি এ কথা ?
-প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা কর !
-আমি তোমার জন্য আামর পুরো রাজনৈতিক ক্যারিয়ার রিস্কের ভেতরে ফেলতে পারছি এমন কি আজকে এভাবে এসেছি জানলে কি হবে বুঝতে পারছো ? আর তুমি সামান্য এই কথাটা বলতে পারো নি ?
-আই এম সরি ! প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা কর !
নিকিতাকে আবারও চেহারে বসালাম । তারপর ওর পাশে বসে ওকে বোঝাতে লাগলাম । একে মেয়ে তার উপর হোম মিনিস্টার, এই মেয়েকে কি সহজে কিছু বুঝানো যায় ! তবে একটা পর্যায়ে সে বুঝলো খানিকটা । তারপর বলল
-ঠিক আছে বুঝলাম এই পরিস্থিতির জন্য তুমি দায়ী না । তবুও এটা সমাধান করার দায়িত্ব তোমার । আমি কিছু জানি না । বাসায় জানাবা তুমি ! ঠিক আছে ?
-আচ্ছা !
যদিও বললাম আচ্ছা ঠিক বুঝতে পারলাম না আসলে আমি কিভাবে জানাবো এই কথা ? মাকে গিয়ে বলবো যে শুনো এখন আর ঐ লেডি লেকচারারকে পছন্দ না । আমি এখন দেশের হোম মিনিস্টার কে বিয়ে করতে চাই । আমার মা শুরু থেকে রাজনীতি একদম পছন্দ করে না । তার ধারনা এর সাথে যুক্ত সবাই খারাপ । এদের থেকে দুরে থাকতে হবে । কোন রাজনৈতিকের মেয়ে হলেও মা রাজি হবে কি না সন্দেহ আছে । সেখানে স্বয়ং হোম মিনিস্টার শুনলে মায়ের মনভাব কেমন হবে আমি বলতে পারছি না !
আমি নিকিতাকে বললাম
-সে সব না হয় বুঝলাম কিন্তু তুমি এভাবে কেন এসেছো ? যদি কেউ দেখে ফেলতো ?
নিকিতা এবার হাসলো । এতো সময়ে পরে তার মুখের গাম্ভীর্য ভাব চলে গিয়ে হাসতে দেখলাম । বলল
-কি করবো তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিলো । তাই খানিকটা রিস্ক নিয়ে চলে এলাম । কেউ টের পায় নি । কেউ আসলে ভাবতেও পারে নি আমি এভবে বের হতে পারি !
-তাই তো দেখছি ।
-আচ্ছা আমাকে এখন যেতে হবে । রাতে কথা হবে । তুমি কি করলে আমাকে জানাবে !
-আচ্ছা !
নিকিতা আমার হাত ছেড়ে দিলো । এতো সময়ে ধরে আমি ওর হাত ধরে বসে ছিলাম সেটা আমি নিজেও টের পায় নি । ওকে গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম । হাটার সময় আবারও সেই ছাত্রনেতাকে দেখতে পেলাম । আমার দিকে তাকিয়ে আছে । আমি মনে মনে হাসলাম । এই ছেলে যদি জানতে পারতো আমার পাশের মেয়েটা কে তাহলে এখন কি করতো কে জানে ! যাক সেটা এখন চিন্তার ব্যাপার না । চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে বাসায় কিভাবে জানাবো এই কথা !
চলবে......
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুন, ২০১৯ দুপুর ১২:১৫