-সাত নাম্বার ওয়ার্ড টা কোন দিকে বলতে পারেন ?
আমি প্রশ্নটা শুনে বাঁ দিকে ঘুরে তাকালাম । ঘুরে তাকাতেই ধাক্কাটা খেলাম । আমার থেকে কয়েক হাত দুরে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে । মেয়েটির পরনে কালো রংয়ের একটা সেলোয়ার কামিজ । কালো ওড়না সব কিছুই কালো । টানা টানা চোখ, নাকটা খাড়া । পাতলা লাল ঠোঁটে মৃদু হাসি নিয়ে এমন ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছে যেন আমার সাথে তার আগে থেকেই পরিচয় আছে । অনেক দিন পরে দেখা এমন একটা ভাব । কিন্তু এই সু্ন্দরীকে আমি কিছুতেই চিনতে পারছি না । আমি মেয়েটির দিকে তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুটা সময় । এরকম নিখুঁত সুন্দরী আমি অনেক দিন দেখি নি ।
একটা সময় যখন অনলাইনে খুব বেশি সময় কাটাতাম, তখন রাস্তা ঘাটে প্রায় সব মেয়েকেই আমার পরিচিত মনে হত । মনে হত মেয়েটা নিশ্চয়ই আমার ফ্রেন্ড কিংবা ফলোয়ার লিস্টে আছে । চলতে পথে আমার সাথে দেখা হয়ে গেছে । এখনই ভাইয়া ভাইয়া বলে গদগদ করতে করতে এগিয়ে আসবে । কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে এমন করে কেউ কোন দিন এগিয়ে আসে নি ।
কিন্তু এই সুন্দরী এতো মানুষ রেখে হঠাৎ করে আমার কাছে সাত নাম্বার ওয়ার্ডে খোজ করতে লাগলো কেন ? আমাকে দেখে কি হাসপাতালের দারোয়ান কিংবা গার্ডদের কেউ মনে হচ্ছে কোন দিক দিয়ে ?
আমি নিজের পরিহিত কাপড়ের দিকে আরেকবার ভাল করে তাকিয়ে নিলাম চট করেই । নাহ, সেগুলো তো বেশ ভালই মনে হচ্ছে । নাকি ডাক্তার কিংবা হাসপাতালের অফিসার দের কেউ মনে করতেছে ?
আমি নিজেই এতো সময়ে গোবেচারা হিসাবে এই হাসপাতালে ঘুরে বেড়াচ্ছি । রাকিবকে দেখতে এসেছি । ও আট নাম্বার ওয়ার্ডের কোথাও আচে । আমি কয়েকবার এদিক ওদিক হাটা হাটি করলাম কিন্তু আট নাম্বার ওয়ার্ডটা কোথায় খুজে পেলাম না । আর এই মেয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করতেছে যে সাত নাম্বার ওয়ার্ডটা কোথায় ?
আমি খানিকটা লজ্জিত হাসি দিয়ে বললাম
-আসলে আমি নিজেই কত সময় ধরে আট নাম্বার ওয়ার্ডটা খুজে বেড়াচ্ছি । খুজে পাচ্ছি না । মনে হচ্ছে কোন হাসপাতালে না গোলক ধাঁধার ভেতরে ঢুকে পড়েছি ।
মেয়েটির মুখের হাসি এবার একটু বাড়লো যেন । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আচ্ছা সমস্যা নেই । আসুন দুজন মিলে খুজে বের করি ! ঐতো ঐদিকে মনে হয় !
এই বলেই মেয়েটি আমাকে সামনের ডান দিকে হাটার জন্য বলল । আমিও মন্ত্র মুগ্ধের মত মেয়েটির পাশে পাশে হাটতে লাগলাম । মেয়েটির শরীর থেকে একটা চমৎকার সুগন্ধ বের হচ্ছে । মেয়েটির সাথে দেখা হওয়ার আগে হাসপাতালের সেই চিরো পরিচিত গন্ধটাই কেবল নাকে এসে লাগছিলো কিন্তু এখন সেই হাসপাতালের গন্ধ বলতে কিছু নেই । মেয়েটির শরীরের সুগন্ধটা যেন চারিদিকে মওমও করছে ।
আমরা আবারও কিছু সময় এদিক ওদিক ঘুরাঘুরি করতে লাগলাম । মেয়েটি আমার পাশে পাশে হাটছে । আমি মাঝে মাঝে তার চেহারার দিকে ফিরে তাকাচ্ছি । কেমন একটা অদ্ভুদ অনুূভূতি হচ্ছে । নিজের ভেতরেই কেমন অন্য রকম লাগছে । বারবার মনে হচ্ছে এই মেয়েটি এতো মানুষ থাকতে এই মেয়েটি কেন আমার কাছেই জানতে চাইলো ওয়ার্ডটা কোন দিকে । এমন কি আমি যখন বললাম যে আমি নিজেও চিনি না তখনও অন্য কারো না গিয়ে আমাকে নিয়ে হাতে লাগলো ।
এর ভেতরে কি অন্য রকম কিছু আছে ? অন্য ঘটনা ?
মেয়েটি কি আমাকে চিনে ?
আমি তো মেয়েটিকে কোন ভাবেই চিনতে পারলাম না । এই মেয়েটিকে এর আগে কোন দিন দেখেছি কি না আমার মনে পড়ে না । হঠাৎ করেই আমরা সাত নাম্বার ওয়ার্ড পেয়ে গেলাম । মেয়েটি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এই তো পেয়ে গেছি । আপনাকে ধন্যবাদ !
আমি বললাম
-আরে আমি কি করলাম ? আপনিই তো খুজে পেয়ে গেলেন । আর ধন্যবাদ তো আমার দেওয়া উচিৎ ! ঐ দেখুন আট নাম্বার ওয়ার্ডটা !
আমি সত্যিই এতোটা সময় এই করিদর দিয়ে কত বার হাটাহাটি করেছি সেটা আমি নিজেই বলতে পারবো না । কিন্তু এই ওয়ার্ডটা এতো সময়ে এখানে ছিল না ।মেয়েটি আমার দিকে আমার কথাতে যেন খুব মজা পেল । তারপর বলল
-আচ্ছা আসি । ভাল থাকবেন !
এই বলে মেয়েটি সাত নাম্বার ওয়ার্ডে ঢুকে গেল । আমি সেদিকে কিছু সময় তাকিয়ে থকে রাকিবের খোজ করতে লাগলাম । রাকিব হচ্ছে আমার সম্পর্কে মামাতো ভাই । আমরা একই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করি । তবে বিষয় আলাদা । আজকে সকালে আমাকে রাজিবের বাবা মানে আমার বড় মামা ফোন করে বলল যে রাজিব হাসপাতে ভর্তি হোয়ে আছে আমি যেন তাকে দেখতে আসি ।
আমি হাসপাতাল জিনিসটা সারা জীবনই এড়িয়ে চলি । কখনই সেখানে যেতে চাই না । তবে রাকিব আমার কাছ মানুষদের একজন ।ওকে দেখতে না আসাটা খুবই খারাপ দেখায় । তাই এখানে হাজির হতে হল । এখন মনে হচ্ছে এখানে না এলে মেয়েটির সাথে দেখাই হত না ।
দরজার কাছে দাড়িয়েই আমি রাকিবকে দেখতে পেলাম । মোবাইলে কি যেন টেপাটেপি করে যাচ্ছে । এখান থেকে দেখে ওকে আর যাই হোক অসুস্থ মনে হচ্ছে না । আমি ওর বেডের কাছে গিয়ে দাড়াতেই ও আমার দিকে চোখে তুলে তাকালো । তারপর একটু মুচকি হেসে বলল
-এতো সময় লাগলো ?
-ওয়ার্ড খুজে পাচ্ছিলাম না ।
-কই কিছু আনিস নি ?
আমি কিছু না বুঝতে না পেরে বলল
-কিছু কি আনার কথা ছিল ? তুই তো কিছু আনতে বলিস নি ।
রাকিব কপট রাগ দেখিয়ে বলল
-আমি কিছু আনতে বলি নি বলে আনবি না ? তুই না রুগী দেখতে এসেছিস ?
আমি বললাম
-হায়রে আমার রোগী ! তোকে দেখে তো অসুস্থ মনে হচ্ছে না । এখন আবার মোবাইল টিপছিস । আসল কাহিনী কি বলতো ? আমার তো মনে হচ্ছে কাহিনী অন্য । সত্য করে বল ।
রাজিব একবার চারিপাশে তাকালো । কাকে যেন খুজতেছে । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আব্বা আমাকে জোর করে বিয়ে দিতে যাচ্ছিলো । বাসায় বন্দী করে রেখেছিলো । কোন ভাবেই বের হতে পারছিলাম না । তাই এই ঢং করে বের হয়েছি !
আমি চোখ বড় বড় করে বললাম
-সত্যি নাকি ?
-হুম । আব্বা কারো সাথে যোগাযোগও করতে দিচ্ছি না । এই ফোন দেখছিস এখানে কোন সিম নেই ।
আমি বড় মামাকে খুব ভাল করেই চিনি । একবার যদি ঠিক করে থাকে যে রাকিবকে সে বিয়ে দিবে তাহলে সেটা হবেই । রাকিব কোন ভাবেই সেটা আটকাতে পারবে না । রাকিব আমার দিকে তাকিয়ে বললাম
-তুই এখন আমাকে পালাতে সাহায্য করবি ।
আমি চিৎকার করে উৎলাম । তারপর বললাম
-মাথা খারাপ ! বড় মামা আমাকে আস্তে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে !
-কোন কথা শুনতে চাই না । যদি না সাহায্য করিস তাহলে ফুফা কে কিন্তু বলে দিল ঐ কথা !
আমি বিরক্ত নিয়ে রাকিবের দিকে তাকালাম । বন্ধুবান্ধবের মধ্যে অনেক সিক্রেট থাকে । আর রাকিব তো বলতে গেলে ছোট বেলা থেকেই আমাদের বাসাতেই মানুষ হয়েছে । আমার ব্যাপারে এমন কিছু নেই ও জানে না । ওর ব্যাপারে এমন কিছু নেই যা আমি জানি না । এমন কিছু সিক্রেট ও জানে ! আমি বললাম
-দেখ ব্লাকমেইল করবি না !
-আরে বাবা কি বিপদে পরেছি দেখছিস না কেন ? তুই কেমন ভাই ?
-আচ্ছা দাড়া । দেখি করি করা যায় ! আগেই এতো উতলা হস কেন ?
আমি আরও কিছু বলতে যাবো তখনই একটা তীব্র হাহকারের আওয়াজ পেলাম । একজন মহিলা চিৎকার দিয়ে কান্না করছে । তার কি হবে এই জাতীয় কথা । আওয়াজটা আসছে দেওয়ালের ওপাশ থেকে । ওয়ার্ডে আর সবাই কান্নার চিৎকারটা লক্ষ্য করতে লাগলো । কেউ কেউ আবার উঠে গিয়ে দেখতে গেল কি হয়েছে ।
এমন সময় দেখলাম বড় মামা আমাদের সামনে এসে হাজির হল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এসেছিস ? যাক ভাল ।
রাকিব বড় মামার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি হয়েছে ? এভাবে কাঁদছে কে ?
বড় মামা বলল
-এটা হাসপাতাল তো ! এখানে মানুষ মারা যায় প্রায়ই । সাত নাম্বার ওয়ার্ডের একজন রোগী মারা গেল একটু আগে । তারই মা কাঁদছে ।
আমার মনটা খানিকটা বিষণ্ণ হয়ে গেল সাথে সাথেই । এই জন্যই আমার এই হাসপাতাল ভাল লাগে না । এখানে মানুষ যেমন সুস্থ হয়ে ফিরে যায়, তেমনি অনেকে এখান থেকেই চলে যায় না ফেরার দেশে । সেই হাহাকার অনেকটা সময় আটকে থাকে এই হাসপাতালের বাতাসে ।
হাসপাতাল থেকে ফিরে আস্তে আস্তে বেশ সময় লেগে গেল । হল থেকে বের হওয়ার সময়ই ঠিক করে রেখেছিলাম যে হাসপাতাল থেকেই আমি টিউশনীতে যাবো । স্টুডেন্টেদের বাসার লিফটে উঠতে গিয়ে আমাকে আবার চমকাতে হল । লিফট থেকে সেই মেয়েটা নামছে ! আমার দিকে তাকিয়ে মেয়েটাও খানিকটা চমকে উঠলো । তারপর মুখে একটু হাসি ফুটে উঠলো । আমি বলল
-আপনি !
-আপনি এখানে ?
আমি একটু হাসলাম । তারপর বললাম
-আমি এখানে পড়াই ।
-ও আচ্ছা ।
-আপনি ?
-আমি একটা কাজে এসেছিলাম । কাজটা শেষ হয়ে গেছে । এখন চলে যাচ্ছি ।
এই বলে মেয়েটা হাটতে যাবে তখনই আমার কেন জানি মনে হল কিছু একটা বলা দরকার । আমি বললাম
-এই যে শুনুন !
মেয়েটা দাড়িয়ে পড়লো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কিছু বলবেন ?
-একই দিনে দুই দুইবার আমাদের দেখা হল । আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আবারও আমাদের দেখা হবে ।
-দেখা তো হতেই পারে ?
-নাহ ! আমার সাথে এই রকম একদমই হয় না । এই ঢাকা শহরে রাস্তা খাটে চলাচলের সময়ে আমার একদমই কারো সাথে দেখা হয় না । আপনার সাথে পরপর দুইদিন দেখা হল তার মানে অন্য কিছু !
মেয়েটা এবার হেসে ফেলল । পাতলা লাল টুকটুকে ঠোঁটে মেয়েটার হাসির দিকে আমি বেশ কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলাম । মেয়েটি বলল
-আচ্ছা এর পরে যদি আমাদের দেখা হয় তাহলে সত্যিই ভেবে নিবো যে আমাদের মধ্যে কিছু একটা রয়েছে । ঠিক আছে ?
আমি হাসলাম । তারপর বলল
-আচ্ছা ।
মেয়েটি আবারও বিদায় নিয়ে নিল । আমি তাকিয়ে রইলাম মেয়েটির চলে যাওয়া পথের দিকে । মেয়েটি গেট দিয়ে বের হওয়ার আগ পর্যন্ত সেদিকে তাকিয়েই রইলাম । মনের ভেতরে একটা আশ্চর্য আনন্দ অনুভব হতে লাগলাম । কেন হতে লাগলো আমার জানা নেই । স্টুটেন্টের বাসার ঢুকতে গিয়ে দেখি তাদের বাসার দরজা আগে থেকেই খোলা, পাশের ফ্ল্যাটটার দরজার খোলা । আমি অবশ্য খুব একটা চিন্তিত হলাম না । সম্ভবত কোন একটা সমস্যা হয়েছে । আমার অবশ্য এতো চিন্তা নেই । আমি দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম । আমার মাথায় তখনও মেয়েটির সেই হাসি মাখা মুখের চেহারা ভাসছে ।
আমি পুরো সময়টা মেয়েটার কথাই ভাবছিলাম । এমন কি যখন হলে ফিরে যাচ্ছি তখনও কেমন মেয়েটির কথাই আমার মনে পড়ছে । রিক্সার উপর বসে বসে থাকতে একটা সময় অনুভব করলাম যে রিক্সা আর সামনে এগোচ্ছে না অনেকটা সময় । একটু অবাক হতে হল কারন এই রাতের বেলা করে এই রাস্তায় এতো জ্যাম থাকার কথা না । তারপরই শুনতে পেলাম সামনে নাকি এক্সিডেন্ট হয়েছে । পুরো রাস্তা জ্যাম ।
আগত্যা রিক্সা থেকে নেমে এলাম । এই জ্যামের পথ টুকু হেটে আবার রিক্সায় উঠতে হবে । হাটতে হাটতেই জানতে পারলাম না একটা বাস নাকি একটা রিক্সার উপর তুলে দিয়েছে । অবশ্য ঢাকা শহরে এই সব খুব স্বাভাবিক ঘটনা । প্রায়ই এসব ঘটে । আমি কোন দিন আগ্রহ নিয়ে সেদিকে যাওয়ার চেষ্টা করি নি । মানুষের মৃত্যু আমার একদমই ভাল লাগে না ।
আমি ভীড় থেকে বের হয়ে এলাম । দাড়িয়ে আছি রিক্সার অপেক্ষায় । তখনই আমার নাকে সেই সুগন্ধটা এসে লাগলো । তারপর আমার কাধে মৃদু স্পর্শ পেলাম । তাকানোর আগেই আমি টের পেয়ে গেলাম আমার পাশে কে এসে দাড়িয়েছে । আমার সত্যিই খানিকটা অবাক লাগছিলো । আমার বিশ্বাস ছিল যে মেয়েটার সাথে আবারও আমার দেখা হবে তবে আজকে রাতেই যে আবার দেখা হয়ে যাবে সেটা আমি মোটেই ভাবতে পারি নি ।
মেয়েটা আমার সামনে এসে দাড়ালো । মেয়েটার মুখে আমি কেমন যেন প্রশ্রয়ের হাসি দেখতে পেলাম । সে বলল
-তো দেখা যাচ্ছে যে সত্যিই আমাদের মাঝে কিছু একটা আছে । আজকে দিনে তিনবার আমাদের দেখা হল ।
আমি বললাম
-আমি আপনাকে আগেই বলেছি ! বলি নি !
-তাই তো দেখছি ! তো আমার মনে হয় .....
মেয়েটা কথাটা শেষ করলো না । আমি বললাম
-কি মনে হয় ?
মেয়েটি হাসলো । তারপর বলল
-থাকুক মনের কথা মনেই । আপনি কোন দিকে যাচ্ছেন ?
-এই তো যাবো কাটাবনের দিকে ।
-চলুন আপনার সাথে যাওয়া যাক ।
তারপর মেয়েটির সাথে রিক্সায় চড়ে বসলাম । সত্যিই বলতে কি আজকের দিনে এমন একটা ঘটনা ঘটবে আমি ভাবতেও পারি নি । সকালে প্রথমবারের মত দেখা মেয়েটি যে রাতের বেলা আমার সাথে রিক্সাতে উঠে বসবে সেটা আমার ধারনার বাইরে ছিল । রিক্সাতে চলার পথে আমাদের মাঝে অনেক কথা হল । মেয়েটি আগ্রহ নিয়ে আমার কথা শুনতে লাগলো । তবে নিজের কথা খুব একটা বলল না । কেবল বলল যে তার নাম লাইমা । একটা কোম্পানীতে চাকরি করে । সেই চাকরির জন্য বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ণ স্থানে তাকে যেতে হয় । অনেক মানুষের সাথে দেখা করতে হয় । আজকে অনেক গুলো এপোয়েন্টমেন্ট ছিল । এমন তিনটা এপোয়েন্টমেন্টের জায়গাতে আমার সাথে লাইমার দেখা হয়ে গেছে । এরকম নাকি তার সাথেও আগে হয় নি আগে । দিনে কখনও একজনের সাথে একবারের বেশি দেখা হয় নি ।
আমাকে হলের সামনে নামিয়ে দিয়ে ও রিক্সা নিয়ে চলে গেল । আর বলে গেল আমাদের যোগাযোগ হবে নিয়মিত ।
তারপর থেকেই লাইমার সাথে আমাদের নিয়মিতই যোগযোগ হতে লাগলো । আমরা পার্কের বেঞ্চ থেকে শুরু করে রেস্টুরেন্টের আবছায়া টেবিলের পাশে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে গল্প করতাম । কত কথা মেয়েটার যে জানতো । আমার মাঝে মাঝে মনে হত মেয়েটা হয়তো আগে কোন দিন কারো সাথে এতো কথা বলার সুযোগ পায় নি কিংবা বলতে পারে নি । বেশির ভাগ সময়ই ও বলতো ওর কত মানুষের সাথে দেখা করে । যদিও ও কখনই আমাকে বলে নি আসলে ওর কোম্পানীর কাজটা কি ? ও কেবল বলেছে ও বিভিন্ন মানুষের সাথে দেখা করে তারপর তাদের কাছ থেকে একটা জিনিস সংগ্রহ করে অফিসে পৌছে দেয় । এটাই হচ্ছে ওর কাজ । আমি আর গভীরে যাই নি ।
তবে মাঝে মাঝে বেশ কয়েকদিন ওর খোজ পাওয়া যেত না । পরে যখন ফিরে আসতো তখন বলতো কাজের চাপে ও আসতে পারে নি । একদিন একটা অদ্ভুদ কাজ করে ফেললাম । সেদিন আমার জন্মদিন ছিল । সন্ধ্যাবেলা লাইমার সাথে দেখা হয়েছে । ও আমাকে আগেই বলেছিলো যে ওর হাতে সময় খুবই অল্প । দেখা করলেও খুব বেশি সময় ও আমার সাথে থাকতে পারবে না । তবে আমার ইচ্ছে ছিল পুরোটা সন্ধ্যা ও আমার সাথেই কাটাবো । এমনই ইচ্ছে ।
কিন্তু ও যখন চলে যেতে চাইলো আমি মন খারাপ করে বসে রইলাম । তখনও কেক কাটা হয় নি । আমি ঠোঁট ফুলিয়ে রইলাম । ও খুব অস্থির হয়ে গেল যাওয়ার জন্য কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর যেতে পারলো না । পুরো সন্ধ্যা ও আমার সাথে কাটালো । যখন যাওয়ার সময় হল ও আমাকে বলল যে এই কাজটা আমি মোটেই ভাল করি নি । ও ভাগ্যে এরপর কি আছে সেটা ও নিজেই জানে না ।
পরদিন আবার যখন দেখা হল তখন দেখলাম ও মুখ খানিকটা সুপ্রসণ্ণ । আমার দিকে তাকিয়ে আমাকে সাবধান করে দিয়ে বলল
-এরকম কাজ যেন আমি আর না করি । ও ভুলটা ও করেছিলো সেটা আজকে সকালে ঠিক করে নিয়েছে । কিন্তু আমি যেন এই কাজ আর না করি । কারন ওর কাজে সময়নুবর্তিতা ব্যাপারটা খুবই জরুরী !
আমি অবশ্য কেবল হাসলাম । তারপর বললাম যে আমি ওকে আমার ফ্যামিলির সাথে পরিচিয় করিয়ে দিতে চাই । এবং সেটা করতে চাই খুব জলদিই । কথাটা শুনে ওর মুখ থেকে হাসি মুছে গেল । আমি বললাম
-সামনের সপ্তাহেই আমার মামাতো ভাইয়ের বিয়ে । সেখানে আমার মা বাবা সবাই আসবে । আমি সেখানেই তোমাকে পরিচয় করিবে দেব !
লাইমা আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । কিছু যেন বলতে গিয়েও বলল না । তারপর কোন মতে বলল
-আচ্ছা, বিয়ে আগে হোক তারপরে না হয় !
-কেন সমস্যা কি ? তুমি যাবে না আমার সাথে ?
-আমি উপস্থিত থাকবো । এটা বলতেছি । ঠিক আছে । তবে আগে থেকে তোমার বাবা মাকে কিছু বলার দরকার নেই । কেমন !
আমি লাইমাকে কিছুটা চিন্তিত দেখলাম । কিছু একটা নিয়ে ও যেন একেবারে চিন্তিত । তবে কি ও আমার বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে ইচ্ছুক নয় । আমাকে বিয়ে করতে চায় না ?
তারপরের দিন গুলো খুব দ্রুতই কাটতে লাগলো । আমি রাকিবের বিয়ে নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়লাম । যদিও রাকিবের সামনে ঠিক পড়ি না । ও কাছে পেলে আমাকে একেবারে চিবিয়ে খাবে । আমাকে ও দায়িত্ব দিয়েছিলো বিয়ে টা যেন না হয় আর আমি ওকে বিয়ের দেওয়ার জন্য তোড়জোড় শুরু করেছি । ওর বিয়েটা হলে আমার বিয়ের ব্যাপারে বাড়িতে বলতে পারি ।
বিয়ের দিন চলে এল । বর যাত্রী নিয়ে আমরা যাওয়ার জন্য তৈরি । বেশ কয়েকটা মাইক্রো ভাড়া করা হয়েছে । বেশ খানিকটা পথও যেতে হবে । সবার সমানে থাকবে আমাদের গাড়িটা । বরের গাড়িতে কেবল আমি আর রাকিব থাকবো । আমাদের পেছনে সব গুলো থাকবে ।
আমি তখনও লাইমার আসার অপেক্ষা করছি । এদিক ওদিক খোজ করছি । কয়েকবার ফোন দেওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু ফোনই ঢুকলো না । এদিকে গাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে যাচ্ছে । তবে একেবারে শেষ সময়ে লাইমা এসে হাজির হল । ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হল ওর মনটা কোন কারনে খারাপ । আমি ওর কাছে গিয়ে বললাম
-এতো দেরী !
লাইমা কোন কথা বলল না । আমাকে সবার থেকে একটু আড়ালে নিয়ে গেল । তারপর হঠাৎ করেই আমাকে জড়িয়ে ধরলো । আমি কিছু বুঝতে পারছিলাম না । মনে মনে একটু ভয় হল । আমি ওকে বলল
-কি হয়েছে ? এমন কেন করছো ?
ও আমাকে না ছেড়ে দিয়েই বলল
-কিছু হয় নি । তুমি ভাল থাকবে সব সময় । কেমন ?
-কি বলছো এসব ?
আমার কথায় কান না দিয়ে লাইমা আবার বলল
-আচ্ছা তোমার কি আমাদের প্রথম দেখার কথা মনে আছে ?
-হ্যা । ঐ তো হাসপাতালে ! ঐদিন আমার সাথে দেখা হওয়ার পরপর কি হয়েছিলো মনে আছে ?
আমি একটু মনে করার চেষ্টা করলাম । আমি ওয়ার্ড খুজে পাচ্ছিলাম না । লাইমাও তাই । তারপর আমরা দুজন মিলে খুজে পাই । ও চলে যায় সাত নম্বর ওয়ার্ডের ভেতরে । আমি চলে আসি আট নাম্বারে রাকিবের কাছে ।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুটা সময় । লাইমা বলল
-আমি যে কাজটা করি সেটা আমি ইচ্ছে করি না । প্রত্যেকের একটা সময় আছে । সেই সময়েই তার সাথে আমার দেখা করতে হয় !
আমি এবার খানিকটা ধৈর্য্য হারা ভাবে বললাম
-তুমি এসব কি বলছো ?
-সব বুঝতে পারবে । তারপর আমাকে আর আমি আগের মত থাকবো না ।
-আমি কিন্তু সত্যিই কিছু বুঝতে পারছি না ।
-আমার নামের অর্থটা খুজে নিও । তাহলেই বুঝতে পারবে । তারপর আমাদের প্রথম দেখা সেটার সাথে সম্পর্ক যুক্ত ! কেমন !
আমি কিছুটা সময় বোকার মত তাকিয়ে রইলাম । লাইমা বলল
-যাও । দেরি হয়ে যাচ্ছে ।
-তুমি আসবা না ?
-তোমাদের সাথে না । তবে আসবো ।
আমার মাথায় কিছু ঢুকছিলো না । লাইমা এসব কি বলছে । রাকিবের সাথে গাড়িতে উঠতেই গাড়ি ছেড়ে দিলো । একেবারে শেষের গাড়িতে আমার বড় মা,মা বাবা আর আম্মু বসেছে । আর সবার প্রথমেরটাতে যাচ্ছি আমি আর রাকিব ।
আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে রাকিব বলল
-বিয়ে হচ্ছে আমার তুই এমন চুপ করে বসে আছিস কেন ?
-লাইমা আজকে কেমন যেন অদ্ভুদ আচরন করলো ।
রাকিব বিরক্ত হয়ে বলল
-তোর এই প্রেমিকাকে আমার সব সময়ই অদ্ভদ মনে হয়েছে । যখনই তোর সাথে দেখা হয় কেউ না কেউ মারা যায় । মনে আছে ঐ হাসপাতালে ....
ব্যাপারটা তখনই আমার মাথায় ধাক্কা মারলো । সত্যিই তো । ঐদিন হাসপাতালে লাইমা সাত নম্বর ওয়ার্ডে পরপরই একজন রোগী মারা গেল । তারপর যখন স্টুডেন্টের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম, ঐদিন দরজা খোলা দেখেছিলাম । পরে শুনেছি ঐদিন সন্ধ্যায় ওদের পাশের বাসার আঙ্কেল মারা গেছে । রাতে এক্সিডেন্টে মারা গিয়েছিল দুই জন । আমার বুকের ভেতরে কাঁপতে থাকলো ।
আমি চট জলদি মোবাইল বের করলাম । তারপর গুললে লাইমা লিখে সার্চ দিতেই লাইমা নামের সাথে উইকি লিংক আসলো । লাইমা হচ্ছে ভাগ্যের দেবী । জন্ম মৃত্যু আর বিয়ের নির্ধারন করে সে !
আমার বুকের ভেতরটা হঠাৎ করেই কাঁপতে লাগলো । সেই সময়েই পেছন থেকে একটা তীব্র সংঘর্ষের আওয়াজ পেলাম । আমাদের ড্রাইভার সাথে সাথেই গাড়ি দাড় করি ফেলল । আমাদের পেছনের একটা গাড়ি নিয়ন্ত্রন হারিয়ে একটা গাছের সাথে ধাক্কা মেরেছে ।
আমাকে বলে দিতে হল না । তবে আমি ঠিকই বুঝতে পারলাম কোন গাড়িটা ধাক্কা মেয়েছে । আমি কাঁপতে কাঁপতে গাড়ি থেকে বের হয়ে এলাম ।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৯ রাত ৯:৪২