আজকে অফিসে আসতে মোটেই ইচ্ছে করছিলো না । আজকে আমার মন খারাপের একটা দিন । আমি জানি আজকে অফিস গেলেই মন খারাপের সেই সংবাদটা শুনতে পাবো । বুকের ভেতরে একটা তীব্র কষ্ট হবে । তার চেয়ে বরং আজকে পথে পথে ঘুরে বেড়াই কিছু সময়। নিঃসঙ্গ এই জীবনে একা একা হাটাহাটি করাই বরং ভাল ।
আচ্ছা শেষ বারের মত সুপ্রিয়ার মুখটা কি দেখতে যাবো ? অফিস থেকে ওর বাসার ঠিকানা বের করা খুব একটা কষ্ট হবে না নিশ্চয়ই । কিংবা এতো সময় অফিসে সবার কাছে খবর পৌছে গেছে । কেউ কেউ হয়তো ওকে দেখার জন্য ওদের বাসার দিকে রওনা দিয়ে দিয়েছে ।
আমার কি যাওয়া দরকার ?
নাহ ! আমার মৃত্যু দেখতে ভাল লাগে না । যদিও এই মৃত্যুর ছাঁয়া আমাকে কখনও ছাড়ে না তবুও আমার মৃত্যুর কাছে যেতে ইচ্ছে করে না । এর চেয়ে বরং কালকে প্রথমবার এবং শেষ বারের মত কথা বলা নিয়ে কিছুটা সময় চিন্তা করা যাক । মেয়েটা নিশ্চয়ই খুব অবাক হয়েছিলো ।
সুপ্রিয়ার সাথে আমি কাজ করছি বছর খানেকের উপরে । প্রতিদিনই ওকে আমি দেখি । মাঝে মাঝে ওর সাথে চোখাচোখি হয় কিন্তু কোন দিন কথা হয় নি । অফিসে অবশ্য মানুষজন আমাকে ঠিক পছন্দ করে না । আমিও তাদের সাথে ঠিক মেলামেশা করি না । করতে পছন্দ করি না । আমি জানি আমার সাথে চিন পরিচয় হলেই হয়তো তাদের নামের চিঠি একদিন আমার হাতে এসে পৌছাবে । হয়তো সেটা তাদের ভাগ্যে লেখা ছিল কিন্তু আমার কষ্ট হবে । এই জন্য যত কম মানুষ জানবে ততই আমার জন্য ভাল ।
কিন্তু গতদিন যখন সুপ্রিয়ার ছবিওয়ালা চিঠিটা এসে পৌছালো তখনই আমি অনুভব করলাম মেয়েটাকে আমি অসম্ভব পছন্দ করি । অনুভব করলাম আমার আসলেই কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার জন্য । বারবার কথা বলতে ইচ্ছে করছে । অফিস এসে বারবার সুপ্রিয়ার দিকে তাকাতে লাগলাম । আমার ডেস্ক থেকে মেয়েটার ডেস্কটা বেশ ভাল ভাবেই দেখা যায় । তারপর আর থাকতে না পেরে লাঞ্চ আওয়ারে আমি নিজেই এগিয়ে গেলাম ওর ডেস্কের দিকে ।
আমাকে সামনে দেখে স্বাভাবিক ভাবেই সুপ্রিয়া বেশ অবাক হল । তারপর আমি যা বললাম তা শুনে আরও বেশি অবাক হয়ে গেল । অন্তত আমার কাছ থেকে ও এমন কোন প্রস্তাব আশা করে নি । বিস্ময় নিয়ে সে রাজি হয়ে গেল । পুরো লাঞ্চ আওয়ারটা আমি কেবল ওর দিকেই তাকিয়ে রইলাম । ও কথা বলেই চলল । আমি ওর সাথে লাঞ্চ করতে চেয়েছি এটা ও একটু অবাক হয়েছে । বেশ কিছুটা খুশিও হয়েছে । আমি কেবলই তাকিয়ে ছিলাম । আমার খুব মন খারাপ লাগছিলো । কিন্তু ওকে তো আর বলতে পারছিলাম যে ওর সাথে কি হতে চলেছে ।
উপরওয়ালার কাছে বারবার কেবল প্রার্থনা করতে লাগলাম যে এইবারের এই চিঠিটা যেন মিথ্যা বার্তা দেয় ।
কিন্তু আমি জানি এ রকম হবে না । আজকেই সুপ্রিয়ার এই দুনিয়াতে শেষ দিন ! কালকের সূর্য ওঠার আগেই ও যে কোন ভাবে মারা যাবে । তবে আমার পাওয়া ছবি অনুযায়ী সেটা হবে কোন দুর্ঘটনা । মুখের একটা দিকে রক্তে ভেসে যাবে । চুল গুলো ডান লেপ্টে থাকবে রক্তে।
আমি অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে এসে চুপ করে দাড়িয়ে রইলাম । আজকে যেন পা আমার সামনে এগিয়ে যাচ্ছে না । ঠিক তখনই কেউ একজন আমার কাধে এসে মৃদু ধাক্কা মারলো । আমি মিষ্টি একটা পরিচিত সুগন্ধ পেলাম । ডান দিকে তাকাতেই তীব্র একটা বিস্ময় অনুভব করলাম । সুপ্রিয়া দাড়িয়ে আছে হাসি মুখে ।
আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না কিছু সময় । আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে পারলাম না । কি যে আমি আনন্দে ওকে জড়িয়ে ধরলাম । বেশ কিছুটা সময় আমার ধাতস্থ হতে সময় লাগলো । ওকে ছেড়ে দিয়ে সরি বলতে লাগলাম বেশ কয়েকবার । চারিপাশে তাকিয়ে দেখলাম যে আশে পাশে কেউ ছিল না ।
সুপ্রিয়া নিজেও খানিকটা অবাক হয়ে গিয়েছিলো । বিশেষ করে ওকে এখানে এভাবে দেখে আমি এরকম কেন করলাম ।
সুপ্রিয়া বলল
-আবিদ সাহেব, আপনি কি ঠিক আছেন ?
-হ্যা আমি ঠিক আছি । আসলে আমি খুবই সরি খুব ! আপনি কিছু মনে করবেন না ।
-আচ্ছা ঠিক আছে । সেটা না হয় না করলাম কিন্তু আপনি কি ব্যাখ্যা করবেন আপনার আচরনের ! নিশ্চয়ই কোন কারন আছে ? আছে না? দেখুন কাল থেকেই আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আপনি কিছু যেন আমার কাছ থেকে লুকাচ্ছেন !
আমি কিছুটা সময় চুপ করে তাকিয়ে রইলাম ওর দিকে । তারপর বললাম
-আসলে আমি যা বলবো তা আপনার বিশ্বাস হবে না ।
-ট্রাই করে দেখেন । বিশ্বাস হতেও পারে !
আমি এই কথাটা এতোদিন কাউকে কোন দিন বলি নি । এটা সম্পূর্ন আমার নিজের ভেতরেই রেখেছি । কারন এমন একটা মানুষকে বললে মানুষ আমাকে পাগল ভাববে । কি দরকার বলার ! কিন্তু এখন কেন জানি মনে হল সুপ্রিয়াকে কথাটা বলা যায় ।
আমি বললাম
-আমি আপনাকে বলতে পারি । তবে কথা দিতে হবে যে আপনি এই কথা গুলো কাউকে বলতে পারবেন না । ঠিক আছে ?
সুপ্রিয়া রাজি হল । আমি ওকে নিয়ে আর অফিসের দিকে গেলাম না । পাশের একটা রেস্টুরেন্ট বিল্ডিংয়ে গিয়ে হাজির হলাম । এখন অফিস আওয়ার হওয়ার কারনে রেস্টুরেন্ট বলতে গেলে একদম ফাঁকাই বলা চলে । একটা কোনার দিককার টেবিল গিয়ে বসলাম ।
সু্প্রিয়া বলল
-এবার বলুন আপনার এই অস্বাভাবিক আচরনের কারন কি ?
আমি তখনও ঠিক বুঝতে পারছি না ওকে কি বলবো । তারপর মনে হল ওকে কিছু বলার আগে আগে সেই চিঠিটা দেখাই । এই বলে ব্যাগের ভেতর থেকে সেই খাম টা বের করে দিলাম । সুপ্রিয়া কৌতুহল নিয়ে তাকালো আমার দিকে । আমি বললাম
-খুলে দেখুন !
খামটা খুলে একটা ফটোগ্রাফ বের হল । সেটার দিকে তাকিয়ে সুপ্রিয়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেল কিছুটা সময় জন্য । তীব্র চোখে তাকিয়ে রইলো সেটার দিকে । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এসবের মানে কি ?
-আসলে এসবের মানে আমি নিজেও জানি না । আমার সাথে এসব কেন ঘটে সেটাও জানি না । কেবল ঘটে এটাই জানি ।
আমি আরও জোরে করে একটা দম নিলাম । তারপর বলা শুরু করলাম
-আমার কাছে মাঝে মাঝে এই খাম এসে হাজির হয় । এই খামে কোন প্রেরকের ঠিকানা থাকে না । কেবল আমার ঠিকানা থাকে । সেখানে কোন চিঠি থাকে না । কেবল একটা ছবি থাকে । আর অবশ্যই সেই ছবিটা আমার পরিচিত কারো হয়ে থাকে । ছবিতে তাদের কে বিভিন্ন অবস্থাতে দেখা যায় । ছবিতে তারা যে অবস্থাতে দেখা যায় সেই অবস্থাতেই তারা ....
-তারা কি ?
আমি খানিকটা ইতস্তত করে বললাম
-সেই অবস্থাতেই তারা মারা যায় ।
-মানে ?
-আপনার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে কিন্তু এটাই সত্যি । আমি যেদিন সকালে এই চিঠি পাই ঠিক তার পরদিনই ছবির মালিক মারা যায় । এবং এই ছবিতে যে অবস্থায় থাকে তার মৃত্যুটাও সেই ভাবেই হয় !
-আপনি আমার সাথে ইয়ার্কি মারছেন ?
আমি এবার গম্বীর কন্ঠে বললাম
-আমার দিকে তাকিয়ে কি আপনার মনে হচ্ছে আমি আপনার সাথে ঠাট্টা করছি ? বলেন মনে হচ্ছে ? আমি যদি ঠাট্টাই করতাম তাহলে আপনাকে দেখে এতো খুশি হলাম কেন ? আপনি হয়তো লক্ষ্য করেন আমার চোখে কি পরিমান আনন্দ ছিল আপনাকে দেখে !
সুপ্রিয়া আমার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো বেশ কিছু সময় । আমি বললাম
-আমি যখন একেবারে ছোট, ক্লাস সিক্সে পড়ি তখন প্রথম আমি এই এরকম একটা খাম পাই । আমার বাংলা ২য় পত্র বইয়ের মধ্যে কে বা কারা এই খাম রেখে এসেছে । আমার ঠিকানা লেখা । টিচিটা খুলে দেখি সেখানে আমার বড় মামা শান্ত ভাবে শুয়ে আছে । আমি তখনও ঠিক বুঝে ওঠার মত বয়স হয় নি কিন্তু ছবি দেখে আমার বুঝতে কষ্ট হয় নি যে বড় মামা মারা গেছেন । আমি কেন জানি ভয় পেয়ে গেলাম খুব । কাউকে কিছু বললাম না । ঠিক পরদিনই আমাদের বাসায় খবর এল যে বড় মামা খুব অসুস্থ । আমার আম্মু যেন তখনই রওনা দেয় । আম্মু আমাকে নিয়ে হাজির হলেন মামার বাসায় । ততক্ষনে মামা মারা গেছেন । আমি মামার ঘরে ঢুকে দেখি খাটের উপর মামা শান্ত ভাবে শুয়ে আছে । ঠিক ছবিতে মামাকে যেভাবে দেখেছি । আমি মামার চেহারা দেখে এতো ভয় পেলা যে অজ্ঞান হয়ে গেলাম । তারপর থেকেই শুরু । এভাবে পরিচিত সব মানুষ গুলোর যখনই মারা যাওয়ার সময় হয় ঠিক তার একদিন আগে আমার কাছে এমন একটা খাম এসে হাজির হয় ! আমি জানি এটা বিশ্বাস করার কোন কারন নেই কিন্তু এর থেকে সত্য কথা আমার জীবনে আর কিছু নেই ।
সুপ্রিয়া বেশ কিছুটা সময় চুপ করে বসে রইলো । তারপর বলল
-কাল আপনার কাছে এই খাম এসে হাজির হয়েছে । এর অর্থ হচ্ছে আমার এখন মারা যাওয়ার কথা !
-হ্যা । এরকম টা গত ১৭ বছরে একবারও হয় নি । আমার কাছে কারো চিঠি এসেছে এবং সে মারা যায় নি সেটা হয় নি ।
-তারমানে আমি মারা যেতে পারি ?
-আমার মনে হচ্ছে না । কারন সময় টা ২৪ ঘন্টা । প্রতিবার হিসাব করে আমি দেখেছি । গতকাল সকাল ছয়টায় এই চিঠি আমার কাছে এসেছে । সেই হিসাবে আপনার সকাল ছয়টার আগে মারা যাওয়ার কথা ছিল কিন্তু দেখতেই পাচ্ছি আপনি মারা যান নি ।
-এর মানে কি ? আপনি ......
আমি মাথা নাড়ালাম । এমনটা হয় নি কোন দিন । কোন দিন হতে পারে না । এতো গুলো বছর আমার সাথে যা ঘটে চলেছে সেটা কি তাহলে সত্যি সত্যিই শেষ হতে চলেছে । আমি বললাম
-যাক ! সত্যিই যদি এটা আমার সাথে আর ঘটে তাহলে আমি সত্যিই এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হয়ে যাই ।
সুপ্রিয়া বলল
-আমার এখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না । তবে আপনাকে আমি অবিশ্বাসও করছি না । এই জন্যই কি আপনি মানুষের সাথে কম মিশেন ? --হ্যা ।
-আচ্ছা এখন বুঝতে পারছেন তো ? আর এসব সত্য হবে না ।
-হুম । তাই মনে হচ্ছে ।
আমি হাসলাম । সুপ্রিয়াও হাসলো ।
আমরা আরও বেশ কিছুটা সময় গল্প করলাম । আজকে সত্যিই ওর সাথে গল্প করতে খুব বেশি ভাল লাগছে । মনে হচ্ছে সারাটা দিন ওর সাথে এভাবেই কথা বলে কাটিয়ে দেই । কথা বলতে বলতেই বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল । তারপরই আমার ফোনে ফোন এসে হাজির হল । আমাদের বসের ফোন । সে ফোন করে জানালো, সে জানে যে আমরা দুজনই আমাদের অফিসের সামনের রেস্টুরেন্টে বসে গল্প করছি । তবে সে এই জন্য আমাদের বকা দিবে না যদি এখনই আমরা ফিরে যাই ।
সুপ্রিয়াকে বলতেই ও হেসে ফেলল । তারপর বলল
-চলুন অফিস যাওয়া যাক । কি জানি এতো সময় অফিসে আমাদের নিয়ে কি গল্প শুরু হয়ে গেছে !
আমি খানিকটা হেসে বললাম
-আই এম গোয়িং টু ইনজয় দিস !
-ও রিয়েলী !
সুপ্রিয়া এমন ভাবে হাসলো আমার মনটা আনন্দে ভরে উঠলো । আমার পুরো জীবনের এতো দিন পরে আজকে কেন জানি আমার নিজেকে মুক্ত মনে হল । মনে হল আমার সাথে কোন প্রকার অভিশাপ লেগে নেই ।
আমরা দুজনই এক সাথে রেস্টুরেন্ট থেকে বের হলাম । অফিসে পা দিতেই আমার ফোনটা আবারও বেজে উঠলো । আবারও বসের ফোন । তিনি বললেন আমি যেন অফিসে আসার আগে একটু অফিস বিল্ডিংয়ের নিচ তলার ব্যাংক থেকে একটা চেক সংগ্রহ করে আনি ।
আমি সুপ্রিয়ার দিকে তাকিয়ে বললাম ও যেন আগে অফিসে চলে যায় । আমি আসছি একটু পরেই ।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে একটু হাসি দিলাম । প্রতি উত্তরে ও একটু হাসি দিল । তারপর লিফ্টে উঠে গেল ।
আমি ব্যাংকের দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই একটা তীব্র আওয়াজ শুনতে পেলাম । পেছনে তাকাতেই তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখলাম লিফটের দরজাটা ভেঙ্গে গেছে । সেখান থেকে আগুনের একটা ফুলকি দেখা যাচ্ছে । লিফটের তার ছিড়ে পড়েছে ।
আমি তাকিয়ে রইলাম । আমার পা যেন জমে গেছে । একটু দেরি হলেও চিঠির ভবিষ্যৎবানী সত্য হয়েছে ।
স্টোরি প্রোম্ট থেকে আইডিয়া প্রাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে মে, ২০১৯ রাত ১২:০৫