ঐদিন তুরানীর সাথে কথা বলার পরেই আমি ওকে খানিকটা এড়িয়ে চলা শুরু করি। যদিও ঐদিনই প্রথম ওর সাথে আমার কথা হয়েছিল। তবে একই অফিসে চাকরি করার জন্য আমাদের দেখা হত প্রায়ই।
আমি এখন সেটাও কমানোর চেষ্টা করতে লাগলাম। সব সময় এই চেষ্টা করতে লাগলাম যাতে ওর সাথে আমার দেখা কমকম দেয়৷ ওকে কথা দিয়েছিলাম যে আমার কারনে ওকে মোটেই অস্বস্তিতে পড়তে হবে না। সেই চেষ্টাই করছিলাম।
কিন্তু তুরানী যখন নিজ থেকেই আমার সামনে এসে হাজির হল তখন আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। লাঞ্চ আওয়ারের কিছু সময় আগে এসে আমাকে বলল
-কেমন আছেন অপু সাহেব?
আমি খানিকটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম,
-ভাল।
-আমি কেমন আছি জানতে চাইবেন না?
আমি তুরানীর আচরনে খানিকটা অবাকই হলাম বলা চলে। আমার সাথে তুরানীর সম্পর্ক এই রকম না। আমাকে পাত্তা দেওয়ার কোন কারন নেই ওর। আমরা একই অফিসে চাকরি করলেও আমার থেকে বেশ ভাল পজিশনে চাকরি করে ও। আমি সাধারন এইচ আরে চাকরি করি, অন্য দিকে সে বুয়েট থেকে পাশ করা আর্কিটেক্ট। আমাদের এই অফিস চলেই ওদের মত কয়েকজন আর্কিটেক্ট আর সিভিল ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে। অফিসে ওদের ওদের দামই আলাদা। আমার কত ইমপ্লোয়িদের সাথে ওদের একটা দুরুত্ব সব সময় থাকে।
আমি বললাম, কেমন আছেন আপনি?
তুরানী বলল, ভাল নেই। আসলে একটু বিপদে পড়েছি। আপনার সাহায্য দরকার৷
আমি আরও খানিকটা অবাক হয়ে বললাম
-আমি?
-হুম। আপনি। হাতের কাজ শেষ হলে আসুন ক্যাফেটেরিয়াতে। এক সাথে লাঞ্চ করি।
আর কিছু না বলে তুরানী হাটা দিল। আমি আরও খানিকটা সময় অবাক হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। তুরানীর আমাকে কি এমন দরকার হতে পারে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।
মাস আগে আমি তুরানীকে নিজের মনের কথাটা সাহস করে বলে ফেলেছি৷ ওকে যখন প্রথম দেখি তখন থেকেই পছন্দ করি। প্রথম প্রথম ভেবেছিলাম যে সাধারন ভাললাগা। দিন গেলেই কেটে যাবে। কিন্তু একটা সময় বুঝতে পারি যে ব্যাপারটা স্বাভাবিক না। আমি সত্যিই তুরানীর প্রেমে পড়েছি।
তবে প্রেমে পড়লেও আমি আমার গন্ডি জানি খুব ভাল ভাবেই৷ তুরানীর কোন কারন নেই আমাকে পছন্দ করার। সত্যিই নেই। আমার চেহারা এমন কোন রাজপুত্রের মত। এভারেজ মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে, দেখতেও সেই রকম। আর চাকরি যেটা করি সেটাও তুরানীর থেকে কমই। আমি আবার কবিও না৷ মেয়েরা যে দিক গুলো দেখে ছেলেদের প্রেমে পরে তার কিছুই আমার মাঝে নেই। তাই আমি খুব ভাল করেই জানতাম যে ওর সাথে আমার প্রেম তো থাকুক, সাধারণত বন্ধুত্ব হওয়ার সম্ভবনাও কম। কিন্তু নিজের এই কথা ওকে না জানিয়ে আমি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলাম না। কেন ওকে বলতে হবে এই কথাটা সেটা আমি নিজেও জানি না৷ তবে কেবল মনে হল যে বলতে হবে৷ তাই একদিন সাহস সঞ্চয় করে হাজির হলাম ওর সামনে। নিজের ডেস্কেই বসে ছিল। আমি গিয়ে দাড়ালাম ওর সামনে।
আমার মনে ক্ষণ ভয় ছিল যে হয়তো আমার নামই জানে না সে। কিন্তু আমাকে দাড়িয়ে থাকতে দেখে তুরানী বলল, কিছু বলবেন অপু সাহেব?
যাক নামটা অন্তত জানে সে। বললাম, কয়েকটা কথা বলতে চাইছিলাম। যদি কিছু মনে না করেন।
তুরানী বলল, মনে করার মত কথা কি?
-খানিকটা। হয়তো কথা গুলো শোনার পর আপনি রেগে যেতে পারেন।
-আচ্ছা।
-তবুও আমার কেন জানি মনে হচ্ছে এই কথা না বললে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো।
তুরানী বলল
-তাহলে বলুন। শুনি আপনার কথা।
আমি বড় করে একটা দম নিলাম । জানি না এর পরে আমি যা বলবো তার ফল ভাল নাও হতে পারে । হয়তো দেখা যাবে তুরানী বসের কাছে রিপোর্ট করে দিবে । বস আমাকে চাকরি থেকে বের করে দিতে একটুও সময় নিবে না । তবুও আমার মনে হল যে এই সুযোগ আমি হয়তো আর পাবো না । আর এখন যদি না বলতে পারি তাহলে হয়তো আর কোন দিন বলতে পারবো না । আমি বলতে শুরু করলাম ।
-আমি যেদিন প্রথমে দেখি সেদিনই মনে হয়েছিলো আমার সামনের দিনে খবর আছে । খবর আছে বলতে বুঝাচ্ছি যে আমার মনের শান্তি চলে যাবে । হয়েছিলোও তাই । অবশ্য এটা নিয়ে আমি খুব একটা চিন্তা করি নি । মাঝে মাঝেই আমি এমন প্রেমে পড়ি । দিন কিংবা সপ্তাহ শেষ হওয়ার আগেই সেই প্রেম কোথায় গায়েব হয়ে যায় । আপনার ব্যাপারেও ভেবেছিলাম তেমনই হবে ।
এই লাইণ গুলো বলে চুপ করলাম কিছু সময় । তুরানী বলল
-এমন হয় নি ?
-জি না । হয় নি । আজকে আপনি এই অফিসে যোগ দিয়েছে এগারো মাস ধরে, এই এগারো মাস আমি শান্তিমত ঘুমাতে পারি নি । আমি সম্ভবত সত্যিই সত্যিই আপনার প্রেমে পড়েছি । এমন প্রেমে যে যেটার থেকে আমি কিছুতেই বের হতে পারছি না ।
এই লাইন গুলো বলে কিছু সময় আবারও চুপ করে রইলাম । আর কি বলবো খুজে পেলাম না । তারপরই মনে হল আরও কিছু বলা দরকার । আমি আবার বললাম
-দেখুন আমি ইচ্ছে করে কিছু করি নি কিন্তু আসলে আমি নিরুপায় । আমি আপনার প্রম ভালবাসা পাওয়ার আশা করি না । আমার কাছে মনে হল যে আপনাকে বলতে পারলে আমি শান্তি পাবো । আর কিছু না । এই সাথে আমি আপনাকে নিশ্চিত করছি এর পরে এরকম কিছু আপনাকে আর কখনও শুনতেও হবে না । আমি আসি !
আর কিছু না বলে আমি রুম থেকে বের হয়ে এলাম দ্রুত । আমার পুরো শরীর তখন কাঁপছিলো । তবে নিজের চেয়ারে আসতে দেখলাম যে আমার মন শান্ত হয়ে এসেছে । পুরো মন জুড়ে একটা শান্তি শান্তি ভাব বিরাজ করছে । তারপর থেকে আমি বেশ শান্তিতেই আছি । লুকিয়ে লুকিয়েই তুরানীর দিকে তাকাই । ওর ফেসবুকে গভীর মনযোগ দেই । ও কি করছে না করছে সেব লক্ষ্য রাখি । ব্যাস । এই নিয়েই আমি সুন্তুষ্ট কিন্তু আজকে আবার কি হয়ে গেল ঠিক বুঝতে পারলাম না । আমাকে ওর কি দরকার পড়লো !
দুই
লাঞ্চ আওয়ারে তুরানী আমাকে যা বলল তাতে আমি খানিকটা খাবিখেলাম । অন্তত ওর কাছ থেকে এমন প্রস্তাব আমি আশা করি নি । মূল কথা হচ্ছে তুরানী বাবা ওর জন্য এক ছেলে ঠিক করেছে । ছেলে তাকে লন্ডনে । দেশে এসেছে বিয়ে করার জন্য । বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে যাবে । এখন তুরানীর বাবা সেই ছেলের সাথে ওর বিয়ে দিবে । এটাই হচ্ছে কথা ।
কিন্তু তুরানী সেই ছেলেকে বিয়ে করতে চায় না । সে ছেলের সাথে কথা বলেছে । ছেলে ঘরে পোষার মত একটা বউ চায় । যখন তুরানী বলেছিলো যে বিয়ের পরেও সে চাকরী করতে চায় তখন নাকি সেই ছেলে বলেছিলো যে সে অনেক টাকা আয় করে তার চাকরি করার দরকার পড়বে না । সে ঘর সামলালেই চলবে । এই কথা তুরানীর মোটেই পছন্দ হয় নি । যদি কেবল ঘরই সামলাবে তাহলে এত কষ্ট করে পড়া শুনা করেছে কি জন্য ।
কিন্তু তার বাবা এসব শুনতে চায় না । তার কথা হচ্ছে মেয়ে মানুষের এতো চাকরির দরকার কি । একটা চমৎকার ভবিষ্যৎ তার জন্য অপেক্ষা করছে সেটাই অনেক কিছু ! এখন তুরানী বিয়ে ভেঙ্গে দিতে চায় । এখানেই আমার ভূমিকা । আমাকে সে নিয়ে যাবে তার বাবার সামনে । তার বয়ফ্রেন্ড হিসাবে । বলবে যে আমাকেই সে পছন্দ করে আমাকেই বিয়ে করবে । সুতরাং লন্ডনে থাকা ছেলেকে সে বিয়ে করবে না ।
আমি সব শুনে চুপ করে কিছু বসে রইলাম । মনের ভেতরে একটা তীব্র আনন্দবোধ কাজ করছিলো । আমি বললাম
-আমাকেই কেন ?
তুরানী বলল
-কারন আমার বাবা আপনাকে চেনে না । আমার ফ্রেন্ড সার্কেলও আপনাকে চেনে না । আমি আমার পরিচিত বন্ধুদের বলতে পারতাম সেখানে সত্য প্রকাশ পেয়ে যেত । কারন আমি ঠিক সরাসরি মিথ্যা বলতে পারি না । কিন্তু আপনার ব্যাপারে কেউ জানে না । আর এক দিক দিয়ে ঘটনা তো খানিকটা সত্যই । আপনি তো আমাকে .......
তুরানী লাইনটা শেষ করলো না । আমি খানিকটা লজ্জা পেয়ে গেলাম । বললাম
-আমি রাজি । কিন্তু আরেকটা সমস্যা আছে । যদি আমার সাথে আপনার বাবা বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যায় ? তখন কি হবে ?
তুরানী খানিকটা চিন্তা করলো । তারপর বলল
-এটা পরে ভেবে দেখা যাবে । মাস ছয়েক মত আটকে রাখলেই হবে । আপনি বলবে যে আপনি আরেকটু গুছিয়ে নিয়ে তারপর বিয়ের দিকে এগোবেন !
তার পরের সপ্তাহে আমাকে তুরানী ওদের বাসায় নিয়ে গেল । ওর বাবা নাকি আমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে । দুপুরে দাওয়াত দিয়েছে । আমাকে ও ভাল ভাবেই শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়ে গেল । বলল যে যথা সম্ভব কম কথা বলতে হবে । যা বলার ও ই বলবে । আমাকে কেবল ওর হ্যা তে হ্যা মেলাতে হবে । আর এও বলে দিলো যে ওর বাবার সামনে যেন আমি ওকে তুমি করেই বলি । আপনি করে বলতে গেলে সব কিছু ফাঁস হয়ে যাবে ।
তিন
তুরানীর ইশাক সাহেব আমাকে প্রথম দর্শনে ঠিক পছন্দ করলেন না । আমার ব্যাপারে সে শুনেছে । তারপরেও আমার মুখ থেকে আরও কথা বের করলেন । আমি কোথায় পড়ালেখা করেছি এখন কোথায় থাকি । বাবা কি করে এই সব । আমি যথা সম্ভব অল্প কথায় জবাব দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি । কিন্তু খাবার টেবিলে একটা ঝামেলা বেঁধে গেল । ইসাক সাহেব খাবার এক পর্যায়ে বললেন
-তুমি যে আমার মেয়েকে বিয়ে করতে চাও তা আমার মেয়ের ভরণ পেষণ করতে পারবে ?
আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই তুরানী বলল
-তোমার মেয়ের ভরণ পেষণ যদি অন্য ছেলেই করবে তাহলে আমাকে পড়ালেখা শিখিয়েছো কেন ? তোমরা কি ভাবো যে মেয়েরা নিজেদের পায়ে দাড়াতে পারবে না ? তুমি তোমার বউকে যেভাবে দাবিয়ে রেখেছো সারা জীবন তুমি চাও যে তোমার মেয়েকেও সেই একই ভাবে তার স্বামী দাবিয়ে রাখুক !
ইসাক সাহেব বললেন
-তুই রেখে যাচ্ছিস কেন ?
-রেগে যাবো না ? আমার সামনে তুমি অন্য মানুষের কাছে জিজ্ঞেস করছো সে আমার ভরণ পেষণ করতে পারবে কি না । আমার কাছে কেন জানতে চাইছো না ? শোন আমাকে দেখে শুনে রাখতে হবে না । ওকে যখন বিয়ে করবো সংসার করবো আমর দুজন মিলে । কাউকে কারো টেনে নিতে হবে না কিংবা ভার বহন করতে হবে না । দুজনের মিলিত চেষ্টায় চলবে সেটা ! বুঝেছো ?
-তাই বলে আমাদের ভাল মন্দ কিছু বলার থাকবে না ?
-দেখলাম কোন এক গোয়ারকে নিয়ে এসেছিলে যে বউ চায় শিক্ষিত কিন্তু বউকে দিয়ে কেবল বুয়াগিরি করাবে । শুনো আমার বিয়ে আমি নিজে ভাল বুঝবো । তোমার থেকেও আমার মতামতের দাম বেশি ।
-তুই এতো বেয়াদম কবে থেকে হলি ?
-তুমি বাধ্য করেছো আমাকে ! আমি অপুকেই বিয়ে করবো তোমার পছন্দ হোক না হোক কিছু যায় আসে না !
এই বলে তুরানী টেবিল ছেড়ে উঠে গেল । এতো সময় আমি কেবল বোকার মত চেয়ে ছিলাম । ও চলে যেতেই সবার চোখ এসে পড়লো আমার উপর । ইসাক সাহেব আমার দিকে এমন ভাবে তাকালেন যেন তার মেয়ের এমন কথা বার্তার জন্য আমিও দায়ী । আমি ওকে এই কথা বলতে বলেছি ।
আমি কি করবো বুঝতে পারলাম না । খাওয়া অর্ধেক হয়েছে । রান্না বেশ ভালও হয়েছে । অর্ধেক রেখে উঠে যেতে মন বলছে না । আবার বসে বসে খাওয়াটাও সমীচিন মনে হচ্ছে না । হাত ধুয়ে উঠবো কি উঠবো না এই সিদ্ধান্ত যখন নিতে পারছি না তখন দেখলাম তুরানী ঘর থেকে বের হয়ে এল । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি এখনও বসে আছো কেন ? হাত ধুয়ে ওঠো জলদি ।
আমি হাত ধুয়ে উঠে পড়লাম । তারপর তুরানীর পেছন পেছন বাইরে বের হয়ে এলাম ।
ওকে নিয়ে যখন রিক্সাতে চেপে বসেছি তখন আমি বললাম
-ওটা কি ছিল ?
-জানি না ।
-মানে কি ?
তুরানী বেশ কিছু সময় চুপ করে থেকে বললাম
-আসলে কদিন থেকে মনের ভেতরে এমন রাগ কাজ করছিলো ! সেটা বের হওয়ার পথ খুজছিলো । আজকে পেয়ে গেল । আশা করি এবার শান্ত হবে সব ।
আমি বললাম ! আমারও তাই মনে হয় । এবার অন্তত আপনার বাবা বেশ কয়েকদিন বিয়ে নিয়ে কিছু বলবে না ।
তুরানী হাসলো । তারপর বলল
-না বললেই ভাল । আর আপনি আর বলার দরকার নেই । তুমি বললেই বরং ভাল ।
আমি একটু হাসলাম । যাক যেটা ভেবেছিলাম সেটা না হোক, ওর সাথে কথা বলার একটা সুযোগ আমার সৃষ্টি হয়েছে । প্রেমিকা না হোক বন্ধু সুলভ একটা সম্পর্ক ঠিকই সৃষ্টি হবে আশা করছি । কিন্তু তখনও কি জানি আমাদের দুজনের ভাগ্য আর কি লেখা ছিল ! না ও জানতো না আমি জানতাম !
চার
এই ঘটনার আরও মাস খানেক পরের ঘটনা । এক ছুটির দিনের বিকালে আমি শুয়ে শুয়ে বই পড়ছি । ছুটির দিন গুলো আমার বই পড়েই কাটে কেবল । এমন সময় আমার মা এসে আমাকে বসার ঘরে ডেকে নিয়ে গেলেন । গিয়েই আমার চোখ কপালে উঠলো । আমি তাকিয়ে দেখি সোফার উপর ইসাক সাহেব বসে আছেন । আমার বাবার সাথে গল্প করছেন । আমাকে দেখে হাসলেন ।
আমার বুকের মাঝে ধিপধিপ শুরু হয়ে গেল । এই লোক এখানে কি করে এল ! আমার দিকে তাকিয়ে ইসাক সাহেব বলল
-আরে এসো এসো ! বস !
আমি মনের ভেতরে দুপুর ভাব নিয়ে তাদের পাশে বসে পড়লাম । ইসাক সাহেব আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
-কেমন আছো তুমি ?
-জি ভাল ।
-ঐদিনের ব্যবহারের জন্য আমি আসলে সরি । তুমি কিছু মনে কর না ।
-না না আমি কিছু মনে করি নি ।
-আমার আসলে ঐ ব্যাপারটা গুলো বিশেষ করে তোমার দিকটা তুরানীর দিকটা আরও ভাল করে ভেবে দেখার দরকার ছিল । আমি তখন বুঝতে পারি নি কিন্তু এখন বুঝি কিছু না । বুঝোই তো আমরা ঠিক তোমাদের মত করে ভাবি না । জেনারেশন গ্যাপ বলে একটা কথা আছে তো !
আমি কিছু না বলে কেবল চুপচাপ শুনে যাই । মনে মনে একটা ভয়ংকর সম্ভবনা উকি দিচ্ছে । যদি সেটা হয় তাহলে কি হবে কে জানে !
আমি আব্বা আর ইসাক সাহেব কে কথা বলতে দিয়ে নিজের ঘরের দিকে দ্রুত গিয়ে হাজির হলাম । সাথে সাথে তুরানীকে ফোন দিলাম ।
প্রথম কথাা শুনেই সে বলে উঠলো
-কি বললে ?
-হ্যা । তোমার বাবা আমাদের বাসায় !
-কেন ?
-সেটা আমি কিভাবে বলবো ? তিনি আমার সাথে অত্যন্ত সুমধুর ব্যবহার করলেন । তার ভাব দেখে মনে হচ্ছে যে .....
আমি কথা শেষ করলাম না । তুরানী চিৎকারে করে বলল
-কি মনে হচ্ছে ?
-মনে হচ্ছে যে সে আমাদের বাসায় বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে ।
-মানে কি ?
-তুমি খুব ভাল করেই জানো মানে কি ! আর সে যদি আমার বাবাকে কনভিন্স করে ফেলে তাহলে .....
আমি এইবারও কথা শেষ করলাম না । না জানি তুরানী এখন কি মনে করছে । আমি আর কিছু না বলে ফোন রেখে দিলাম । এক দিকে মনে হচ্ছে ওকে বিয়ে করে ফেললে ব্যাপারটা চমৎকার হবে । আমি চুপচাপ বসে থাকি আর দেখি কোন দিকে কি হচ্ছে । কিন্তু আবার মনে হচ্ছে তুরানীকে কথা দিয়েছিলাম যে আমার কারনে তাকে কোন ভাবেই বিব্রত হতে হবে না । কিন্তু এই যে পরিস্থিতির ভেতরে আমরা দুজন পরেছি সেটার জন্য তো আমি দায়ি না । তুরানী নিজেই নিজেকে এই অবস্থার মাঝে নিয়ে এসেছে ।
যে ভয়টা পেয়েছিলাম সেটাই হল । রাতেই বাবা আমাকে খাবার টেবিলে বললেন
-মেয়ে পছন্দ করেছো ভাল কথা, একবার আমাদের জানাবা না ?
আমি কি বলবো কিছু খুজে পেলাম না । চুপচাপ মাথা নিচু করে খেতে লাগলাম । আব্বা আবার বলল
-এদিক দিয়ে আমাদের বলে এসেছো যে বিয়ে করার ইচ্ছে নেই আবার তলে তলে মেয়ের বাসায় গিয়ে দেখা করে এসেছে । এটা কেমন কথা ? আমাদের বললে কি আমরা না করতাম ? আমিই না হয় প্রস্তাব নিয়ে যেতাম ! শুনো তুমি কালকে মেয়েকে নিয়ে আসবে আমাদের বাসায় । মেয়ের বাবা এক প্রকার কথা দিয়েই গেছে । কিন্তু আমি মেয়েকে দেখতে চাই আগে । বুঝতে পেরেছো আমার কথা ?
আমি চুপচাপ মাথা ঝাকালাম । আমি পরিস্কার বুঝতে পেরেছি তার কথা । কিন্তু এখন তুরানী বুঝতে পারলেই হয়
আমি ভেবেছিলাম কথাটা বলার পরেই হয়তো তুরানী খুব রেগে যাবে । কিন্তু খুব শান্ত ভাবেই দেখলাম সে রাজি হয়ে গেল । বলল যে আমি যেমন ওর কথাতে ওদের বাসায় গিয়ে হাজির হয়েছিলাম । ওরও উচিৎ হচ্ছে আমার বাসায় আসা । কেবল আসলেই তো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে না । বিয়ে কিভাবে আটকাবে ও সেটা জানে !
অফিসের পরে তাকে নিয়ে হাজির হলাম বাসায় । আমি ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে আসলে কি হচ্ছে আমার সাথে ! একবার মনে হচ্ছে সব কিছু স্বপ্নই দেখছি আমি । তুরানীকে দেখে মা আর বাবা দুজনেই খুব পছন্দ করলো । এবং অবাক হয়ে দেখলাম তুরানীও খুব চমৎকার ভাবে তাদের সাথে হেসে কথা বলল । ছেলে প্রথমবারের মত তার পছন্দের প্রেমিকাকে বাসায় নিয়ে এসেছে । প্রেমিকার মুখের ভাব ঠিক যেমনটা হওয়া দরকার তুরানীর মুখে তেমন একটা লজ্জা লজ্জা ভাব দেখতে পাচ্ছিলাম । আমার বেশ ভাল লাগছিলো । সেই সাথে খানিকটা মন খারাপ লাগছিলো । ভাবছিলাম যখন এই স্বপ্নটা ভেঙ্গে যাবে তখন কেবল আমারই যে কষ্ট হবে সেটা না, মা বাবারও হবে ।
পাঁচ
তুরানীর নিজের উপর বেশ ভরশা ছিল । বিয়ে যে সে ভেঙ্গে দিবে সেটা সে প্রায় একেবারে নিশ্চিত ছিল । কিন্তু তার জানায় খানিকটা ভুল ছিল । দেখতে দেখতে আমাদের বিয়ের দিন সত্যিই সত্যিই এগিয়ে এল । আমি কোন চেষ্টা করি নি বিয়ে আটকানোর । চুপচাপ কেবল দেখে গেছি । তুরানী নাকি চেষ্টা চালিয়ে গেছে । কি কি চেষ্টা করেছে সেটা অবশ্য আমি জানি না । আমি কেবল একটা জানি যে সে আমার মায়ে ফোন করে বলেছিলো তার আমার আগেও একটা ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিল । মা আমার কাছে এসে জিজ্ঞেস করলে আমি কেবল বললাম যে জানি । আমার যেহেতু কোন সমস্যা নেই সেখানে মাও তেমন কিছু বলল না । এখনকার দিনে নাকি এমনটা স্বাভাবিক । এই ছিল তার চেষ্টা ! আরও কত কিছু সে করেছে সেটা সে জানে আমি জানি না ।
বিয়ের যখন আর দুইদিন বাকি তখন তুরানী আমাদের হঠাৎ একদিন রাতের বেলা আমার সাথে দেখা করতে চাইলো । আমি হাজির হলাম । এবং খানিকটা অবাকই হয়ে গেলাম । দেখতে পেলাম ওর সাথে একটা ছোট ট্রাভেল ব্যাগ । আমি বললাম
-ব্যাগ কিসের জন্য ?
তুরানী বলল
-বাসা থেকে পালাচ্ছি । আমি বিয়ে করবো না ।
-ওকে ! কোথায় যাবা পালিয়ে ?
-জানি না । কোন প্লান নেই । কেবল বিয়ে করতে চাই না । কোন ভাবেই না ।
-একা একা যাবা ?
-হ্যা ।
-আমি আসি সাথে ?
-কেন ?
-না মানে এই রাতের বেলা একা একা যাওয়াটা তোমার জন্য টাফ হয়ে যাবে । বিপদজনকও বটে । আমি আসি সাথে । তোমাকে পৌছে দিয়ে আবার ফেরৎ চলে আসবো ! ওকে ? আর ভয় নেই কাউকে বলবোও না তুমি কোথায় আসো ? বিয়ের দিন চলে গেলে আর সমস্যা নেই ।
তুরানী কি যেন ভাবলো । তারপর বলল
-আচ্ছা চল । তার আগে ফোন বন্ধ কর ।
আমি ফোনটা বন্ধ করে ওর কাছে দিয়ে দিলাম ।
যখন কক্সবাজারের গাড়িতে উঠছিলাম তখন একই সাথে আমার মন খারাপ লাগছিলো আবার ভাল লাগছিলো । মন ভাল লাগার কারন হচ্ছে তুরানী সাথে সমুদ্র দেখতে যাচ্ছি আর মন খারাপ লাগার কারন হচ্ছে মনের ভেতরে একটা ক্ষণ ইচ্ছে ছিল যে তুরানীর সাথে আমার বিয়েটা হয়েই যাবে ভেবেছিলাম কিন্তু সেটা আর হল না । এখন পালিয়ে গেলে আর হয়তো বিয়েটা হবে না ।
সকাল বেলাতেই কক্সবাজারে পৌছে গেলাম । কিন্তু সেখানে পৌছে আমাদের জন্য সব থেকে বড় সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিলো । অন্তত আমি এটা মোটেই আশা করি নি । আমরা যখন কলাতলী বিচে নামলাম তখন দেখি আমাদের রিসিভ করার জন্য আমার বাবা আর তুরানীর বাবা অপেক্ষা করছে । আমি জীবনে এতো অবাক হয়েছি কি না আমি জানি না । বারবার মনে হচ্ছিলো এরা এখানে কি করছে ? আর কেমন করে এখানে এসে হাজির হল ?
পরিশিষ্টঃ
আসলে কপালে যদি লেখা থাকে তাহলে সেটা কোন ভাবেই খন্ডানো যায় না । তুরানীর সাথেই আমার বিয়ে লেখা ছিল । সেটা সত্যিই সত্যিই হয়েও গেল । ভাগ্য ছিল বিয়ের পক্ষে । তাই সেটা যেকোন ভাবেই হোক ঠিকই সময় সঠিক স্থানে পৌছে গেল ।
ঐদিন যখন আমি তুরানীকে নিয়ে বাসে উঠছিলাম তখন ওর বাবার পরিচিত এক আঙ্কেলও যাচ্ছিলো কক্সবাজারে । সে আমাদের দেখে সাথে সাথেই ফোন দেয় ওর বাবাকে । ইসাক সাহেব ফোন দেয় আমাকে কিন্তু আমার ফোন বন্ধ পেয়ে ফোন দেয় বাবাকে । আমাদের দুজনের ফোন বন্ধ পেয়ে তাদের মনে খানিকটা ধারনা হয় যে আমরা হয়তো এক সাথেই পালিয়েছি । তবুও নিশ্চিত হওয়ার জন্য ইসাক সাহেব তার ঐ পরিচিতকে বলে যেন কোন ভাবে আমাদের একটা ছবি তুলে পাঠায় ।
যখন ছবি তুলে পাঠালো দেখলো আসলে আমার সাথে আছে তখন দুজনেই প্লেনে করে আমাদের আগেই হাজির হয় কক্সবাজারে । তারপর আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে ।
ঐদিনই আবার ফিরে আসি আমরা এবং ঐদিন সোজা আমাদের নিয়ে যাওয়া হয় কাজী অফিসে । আগে বিয়ে দিবে তারপর অন্য কিছু । তুরানী কিছু বলতে পারছিলো না কারন নিজের ফাঁদেই সে পা দিয়েছে । আর এভাবে ধরা পরে যাবে সেটা ও ভাবতেও পারে নি । দেখলাম কেবল চুপচাপ ও বিয়েতে রাজি হয়ে গেল ।
আমার মনে আনন্দ আর ধরে না । বারবার মনে হতে লাগলো ঐদিন যদি সত্যিই মনের কথাটা তুরানীকে না বলতাম তাহলে হয়তো কোন দিন আজকেই ঘটনা ঘটতো না । ভালবাসার ঐ ক্ষুদ্র পদক্ষেপটার কারনে আজকে তুরানী আমার বউ হয়ে গেল । তাই ভালবাসলে অবশ্যই তাকে জানানো উচিৎ । বলা তো যায় না কোন ভাবে আর কোন দিক দিয়ে তার সাথে তোমার মিল হয়ে যাবে !
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মে, ২০১৯ দুপুর ১:২৭