-ম্যাডাম চেয়ারম্যান সাব আসছে !
মীরার সামনের রোগীটাকে পরীক্ষা করছিলো । কথা শুনে কম্পাউন্ডার লিয়াকতের দিকে ফিরে তাকালো । বলল,
-কোথায় ?
-বাইরে দাড়ায়া আছে !
-ভেতরে নিয়ে এসো !
-উনি আসবেন না । আপনেরে যাইতে বলছে !
মীরা একটু বিরক্ত হল । তবে সেটা প্রকাশ করলো না । চেয়ারম্যান লোকটার আচরন মাঝে মাঝে একটু বিরক্তি উৎপন্ন করলেও আসলে মানুষটা ভাল । বলতে গেলে এই একা মানুষটার জন্য পুরো এলাকাটা আরও একটু ভাবে বেঁচে আছে । সরকারি স্কুল সরকারি স্বাস্থ্য ক্লিনিস তিনি নিজের চেষ্টায় স্থাপন করেছেন । অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছে । সেই উপজেলা স্বাস্থ্য ক্লিনিকেই মীরা ডাক্তার হয়ে এসেছে । এখানে এসে প্রথমে যে বিপদে পড়েছিলো সেটারও সমাধান এই চেয়ারম্যানই করে দিয়েছে । সেই মানুষটার উপর মোটেই বিরক্ত হওয়া উচিৎ না !
মীরা হাতের হাতের রোগীটাটে বিদায় করে দিয়ে ক্লিনিক থেকে বাইরে বের হয়ে এল । বারান্দায় আসতেই দেখতে পেল চেয়ারম্যান সোলাইমান হোসেনকে দেখতে পেল । উচু লম্বা শক্ত শরীরের একজন মানুষ । বয়স আনুমানিক ষাটের কাছাকাছি । দেখলে আরও কম মনে হয় । মীরাকে বের হয়ে আসতে দেখেই সোলাইমান হোসেন মুখে বিস্তৃত হাসি নিয়ে এগিয়ে এল । বলল
-মা জননী ভাল আছো ?
-জি চাচা ভাল আছি ! আপনি ভাল আছে ?
-আমার আর ভাল থাকা ! নানান দিকে নানা ঝামেলা ! একটা সরকারী কলেজ জন্য খুব দৌড়াদৌড়ি করতেছি কিন্তু কাজ হচ্ছে না । তবে আমিও সহজে হাল ছাড়ার পাত্র না । এই গ্রামে আমি কলেজ আইনাই ছাড়বো !
মীরা বলল
-আমি জানি চাচা ! আপনি সেটা করবেনই ! তা কোন দরকার ছিল ?
সোলাইমান হোসেন একটু হিহ্বায় কামড় দিল । তারপর বলল
-আমি ভুইলাই গেছি তুমি কাজের মানুষ ! হ্যা একটু দরকার ছিল ! তোমার দাদীজানের শরীরের খুব খারাপ । বুঝোই তো বয়স হইছে । এমন অবস্থা নাই যে এই খানে নিয়ে আসবো ! নয়তো আমি তারে এই খানেই নিয়ে আসতাম কিন্তু মা জননী মায়ে আমার একদম নড়াচড়া করতে পারে না । তুমি কি একটু দেইখা আসবা !
মীরা এর আগেও সোলাইমান হোসেনের বাসায় গিয়েছে তার মাকে দেখে আসার জন্য । মহিলার শরীরে সবই বার্ধক্যজনিত রোগ । তার এমন বয়স হয়েছে এখন আর কোন কিছুই করার নেই আসলে । মীরা বলল
-আচ্ছা আমি সন্ধ্যার পরে একবার আসবো !
সন্ধ্যার কথা শুনে যেন সোলাইমান হোসেন হায়হায় করে উঠলো । বলল
-না না মা জননী ! কোন ভাবেই সন্ধ্যার পর না । আইজ আমাবস্যা । আজকে কোন ভাবেই তুমি সন্ধ্যার পরে বাইরে বের হবা না । মনে থাকবে তো কোন ভাবেই না । তুমি বিকালের দিকে একটু আইসো !
মীরা আর কথা বাড়ালো না । বলল
-আচ্ছা ।
-আচ্ছা তাহলে আমি আজকে আসি । নিজের দিকে খেয়াল রাইখো আর আবারও বলতেছি আইজ কাইল কোন ভাবেই সন্ধ্যার পরে বাইরে বাইর হইবা না !
মীরা সোলাইমান হোসেনকে বিদায় দিয়ে আবারও কেবিনের ভেতরে গিয়ে বসলো । মুখটা একটু চিন্তিত । আজকে তাহলে আরও একটা মেয়েকে নিয়ে যাওয়া হবে ! মীরা জানে গ্রামে পাহারা বসানো হবে এমন কি পুলিশও আসবে আজকে । তারপরও একজন কেউ গায়েব হয়ে যেতে পারে যদিও গত দুই মাসে এই ঘটনা ঘটে নি একটাও ! এই আজকেও আশা করা যাচ্ছে ঘটবে না !
এই গ্রামটা বাংলাদেশের একেবারে শেষ প্রান্তের দিকে অবস্থিত । গ্রামের মোটামুটি তিন দিকে ঘন জঙ্গল । আর সেই জঙ্গলের পরেই ভারতীয় বর্ডার । এদিকে এলাকা এতোই দুর্গম আর বিপদজনক যে এই বর্ডার দিকে কোন চোরাচালানীরাও যায় না । মীরা এখানে এসে শুনেছে অনেক আগে কেউ কেউ যেতে চেষ্টা করেছে কিন্তু কেউ আর ফিরে আসে নি । জঙ্গলের ভেতরে তাদের অদ্ভুদ ভাবে ক্ষতবিক্ষত লাশ পড়ে থাকতে দেখা গিয়েছে । তারপর থেকে সব আর কেউ সাহস করে নি ।
জঙ্গলের পাশ দিয়েই বয়ে চলে গেছে কুয়াশিয়া নদী। যদিও নদীটার উৎপত্তি ভারতের হিমালয় থেকে। নদীটার স্রোত এখনও খুব প্রবল। আর অন্য দিকটা যুক্ত খুলনা শহরের সাথে। এই হচ্ছে জনসারপুর গ্রাম। মীরার পোস্টিং এখানে আজ তিনমাস। প্রথমে ভেবেছিল টিকতে পারবে না কিন্তু সহজ মানুষ গুলোর আশে পাশে থাকতে খারাপ লাগছে না। কাজের পর বই পড়ে চমৎকার সময় কেটে যায় । আর এখানকার মানুষ গুলো সব সহজ সরল ।
কিন্তু এই এলাকার মুল সমস্যা হচ্ছে কিছু দিন পরপরই এখানে মানুষের ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায়৷ আর পরিস্কার ভাবে বললে, প্রতি অমাবস্যার রাতে একজন মেয়ে গায়েব হয়ে যায় গ্রাম থেকে৷ এমন কোন মেয়ে যে হয়তো রাতের বেলা বাইরে বের হয়েছিল একা একা। তারপর মেয়েটার কোন খোজ পাওয়া যায় না দুইচার দিন। পাঁচ কিংবা ছয় দিনের মাথায় মেয়েটার কাটা এবং ক্ষতবিক্ষত লাশ পাওয়া যায় জঙ্গলে কিংবা নদীর পাড়ে। মীরা আসার পর একজনকে এভাবে দেখেছে মারা যেতে। প্রথমে লাশটা দেখে ওর পুরো শরীর কেঁপে উঠেছিল। সামলাতে অনেক সময় লেগেছে। এই গ্রামের ক্লিনিকে পোস্ট মর্টেম করার উপায় নেই, তবুও লাশটা খানিকটা পরীক্ষার জন্য নিয়ে এসেছিল ও। দুই হাত আর পা আলাদা করা ছিল মেয়েটার। সেগুলোর বেশ কিছুটা অংশ খাওয়া। আরও একটু পরীক্ষা করে দেখতে মীরা চমকে গিয়েছিল। কারন খাওয়ার ধরন দেখে মীরা এটা বুঝতে পেরেছিল যে খাওয়ার কাজটা কোন বন্য প্রাণীর নয়, মানুষের। ব্যাপারটা কিছুতেই শান্তি দিচ্ছে না ওকে।
পুলিশ এর আগেও এসেছি এবারও এল। গ্রামের মানুষ জনের জবানবন্দি নিল কিছু খোজাখুজি করলো কিন্তু কিছুই বের করতে না পেরে চলে গেল।
এক
সব কাজ শেষ করে উঠতে উঠতে দুপুর হয়ে গেল । মীরার শরীর খুব ক্লান্ত লাগছে । এখন কিছুতেই চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না । মীরা নিজের ব্যাগটা নিয়ে সোজা নিজের কোয়ার্টারের দিকে হাটা দিল । স্বাস্থ্য কম্প্লেক্সের একটু দুরে মীরার থাকার জন্য কোয়াটার । এখানে মীরা সহ মোট দুইজন ডাক্তার থাকে । দুইজন মিলে সব কাজ কর্ম সামাল দিতে হয় । যদিও বড় কোন ঝামেলা তারা এখানে রাখে না । সদরে পাঠিয়ে দেয় । এখানে একটা সরকারি এম্বুলেন্সেরও ব্যবস্থা আছে ।
মীরার সাথে অন্য যে ডাক্তার আছে তার জন্ম এই এলাকাতেই হয়েছিলো । তবে সে বড় হয়েছে খুলনা শহরে । খুলনা মেডিক্যাল থেকেই ডাক্তারী শেষ করেছে । তারপর বিসিএস দিয়ে এখানে এসে কাজ শুরু করেছে । এখানকার স্থানীয় বলে এখানে থাকতে তার খুব বেশি আপত্তি নেই । সে বিবাহিত তবে বউ সব সময় এখানে থাকে না । তার নাম মিলন আহমেদ । মীরার ঠিক পাশের কোয়াটারে সে থাকে । খুবই কম কথা বলে তবে তার ব্যবহার ভাল । যতবার মীরার সাথে দেখা হয়েছে ততবারই মৃদু হেসে মাথা নাড়িয়ে বলেছে ভাল আছেন ! মীরারও এই উত্তর দিয়েছে । আজ তিন মাস তারা এখন ক্লিনিকে কাজ করছে কিন্তু অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে দুজনের মধ্যে এর থেকে বেশি আর কথা হয় নি খুব একটা !
আজও বাসায় ঢুকতে গিয়ে মিলন সাহেবের সাহেবের সাথে দেখা হয়ে গেল । মীরাকে দেখে একটু হেসে জানতে চাইলো সে কেমন আছে । মীরাও সেই একই ভাবে জানতে চাইলো কেমন আছে সে !
মিলন সাহেব হঠাৎ আজকে দাড়িয়ে মীরাকে বলল
-আপনি দয়াকে আজকে সন্ধ্যার পর বাইরে বের হবেন না !
মীরা একটু অবাক হয়ে গেল । তারপর বলল
-আপনি এই কথা বলছেন হঠাৎ !
-জানেন এই এলাকাতে কি হয় ! আজকে এমন কিছু হতে পারে !
মীরা হাসলো ! তারপর বলল
-আপনিও কুসংস্কারে বিশ্বাস করেন ? পিশাচ এসে ধরে নিয়ে যাবে আমাকে ?
-পিশাচ না হোক, ক্ষতি তো হতে পারে ! হচ্ছে তো ! আপনি বাইরের মানুষ, বিপদে পড়লে কেউ এগিয়ে আসবে না ।
মীরা হাসলো । তারপর বলল
-আচ্ছা সমস্যা নেই । সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবো !
-ধন্যবাদ !
মীরা বাসায় ফিরে ফ্রেশ হয়ে নিল । খুব ইচ্ছে করছিলো যে একটু বিশ্রাম নিতে কিন্তু এখন বিশ্রাম নিতে গেলে চেয়ারম্যান সাহেবের বাসায় যেতে দেরি হয়ে যাবে ! যতই ও ভুত পেত আর পিশাচে বিশ্বাস না করুক মানুষকে তো ঠিকই ভয় পায় । রাতের বেলার ঐ খুন গুলোর পেছনে যে মানুষের হাত হাতে সেই ব্যাপারে মীরার কোন সন্দেহ নেই ।
চেয়ারম্যান সাহেবের সাহেবের বাসায় যতই বিকেলের ভেতরে বের হয়ে আসতে চাইলো কিন্তু পারলো না । ও যাওয়ার আগেই চেয়ারম্যানের মায়ের শরীরের বেশ খারাপ হয়ে গিয়েছে । ঠিক মত শ্বাস নিতে পারছিলো না । সেই ক্লিনিক থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে এসে সব কিছু ব্যবস্থা করতে করতে ঠিকই রাত হয়ে গেল । যখন চেয়ারম্যানের বাসা থেকে বের হবে তখন বাইরে ঘুরঘুটে অন্ধকার ! মীরার একটু ভয় ভয় করছিলো তবে সেটা মুখে প্রকাশ করলো না । সোলাইমান হোসেন তাকে কিছুতেই যেতে দিবে না । বারবার বলল যে আজকের রাতটা যেন সে এখানেই থেকে যায় কিন্তু মীরা রাজি হল না । কেবল বলল যে সাথে একজনকে দিয়ে দিলেই হবে । সে এগিয়ে দিলেই হবে । কোন সমস্যা হবে না !
শেষে আর কোন পথ না পেয়ে সোলাইমান হোসেন ওর সাথে একজন ছেলেকে দিয়ে দিল । মীরা আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছিলো সামনে । ওর হাতে একটা ছোট পেন্সিল টর্চ লাইট জ্বালানো । গ্রামে প্রায়ই বিদ্যুৎ চলে যায় । এই একটা টর্চ সব সময় থাকে ওর কাছে । পেছন পেছনে যে আসছে সে চুপচাপ হাটছে ।
মীরার আপন মনে এগিয়ে চলেছে ! এমন সময় খুট করে একটা আওয়াজ হল । যেন কারো পায়ে নিচে কোন ডাল পরে ভেঙ্গে গেল । মীরা অনুভব করলো ওর পেছনের মানুষটা থেমে গেছে । আর খুট করে ডাল ভাঙ্গার আওয়াজটা পেছন থেকে নয় সামনে থেকে এসেছে । মীরার বুকের ভেতরটা ভয়ংকর ভাবে একটু দুলে উঠলো । এই ব্যাপারটা ওর আগেও হয়েছে । যখন সামনে কোন বিপদ এসে হাজির হবে ঠিক তার আগের মূহুর্তে মীরা সেটা বুঝতে পারে । অনেক আগে থেকেই । এই ইন্দ্রীয়টা ওর খুব বেশি সজাক !
তারপর মীরা জীবনের অন্যতম ভয়ের ব্যাপারটা দেখতে পেল ! প্রথমে আওয়াজ শুনলো । যেন খুব রাগত স্বরে কোন প্রাণী গড়গড় করছে । মীরা ওর থেকে ঠিক সামনে চার জোড়া চোখ দেখতে পেল । সম্ভবত দুই কুকুর ! কিন্তু স্বাভাবিক কুকুর থেকে এই কুকুর গুলো বেশ বড় । অন্তত দ্বিগুন আকারে । চোখ দুটো থেকে আগুন বের হচ্ছে । মীরার চোখের কোন ভুল নয় । সত্যিই সেগুলো কোন স্বাভাবিক প্রাণীর চোখ হতে পারে না । পেছনের ছেলেটা ওরে বাবা মা বলে চিৎকার করে পেছন দিক দিয়ে দৌড় দিয়েছে !
মীরা জানে দৌড় দিয়ে লাভ নেই । ওর হাতটা ব্যাগের ভেতরে চলে গেল । সেখান থেকে একটা নাইন এমএম পিস্তল বের হয়ে এল সাথে সাথে । পিস্তলটা সোজাসুজি তাক করলো কুকুর দুটোর দিকে ! ভয় যদিও কমে নি তবে নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছে । এখানে ভয় পেলে কেবল মরতে হবে । মীরা সেই ভয়ংকর লাশের কথা মনে করতে চাইলো না । তবুও মনে পড়ে গেল ঠিকই । ও কোন ভাবেই চায় না ওর নিজের অবস্থা ঐ রকম হোক !
কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল । কুকুর গুলোর গর্জন আস্তে আস্তে বেড়েই চলেছে । মীরা তখনই দেখতে পেল কুকুর গুলোর পেছন একটা কালো আয়বয় । মানুষটাকে ভাল করে দেখা যাচ্ছে তবে তার নিজের চোখও আগুনের মত জ্বলছে ! মীরা আর কোন চিন্তা করলো না । পরপর চারটা গুলি করলো কুকুর দুটোকে লক্ষ্য করে ।
মীরা ভেবে ছিলো এতেই কাজ হবে কিন্তু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো কুকুর গুলো তখনও একই ভাবে দাড়িয়ে আছে । এমন একটা ভাব যেন কিছুই হয়নি । তখনই পেছনের অন্ধকার অয়বয়বটার দিকে ওর চোখ গেল । মীরার মনে সেটা ওর দিকে তাকিয়ে বিদ্রুপের হাসি হাসছে । ওর বোকামী দেখে হাসছে যেন !
এবার কুকুর গুলোকে এগিয়ে আসতে দেখলো সে । মীরা সত্যিই সত্যিই ভেপ । পিস্তলে আর যতগুলো গুলি ছিল সব গুলো চালাতে লাগলো । জীবনে প্রথম বার ওর হাত কেঁপে উঠলো গুলি চালাতে গিয়ে । কুকুর গুলো যেন গুলির আওয়াজকে পাত্তাই দিল না । গুলি গুলো ওদের গায়ে লাগছে কি লাগছে না সেটা যেন ওদের কিছু যায়ই আসে না । ওরা ঠিকই ওর দিকে এগিয়ে আসছে ।
মীরার মুখ দিয়ে এবার আপনা আপানি একটা চিৎকার বেরিয়ে এল । এই তো কুকুর গুলো ওকে লক্ষ্য করে লাফ দিয়েছে । মীরা কেবল অবাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো ! কিছুই যেন করার নেই ওর কেবল চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া !
কিন্তু ঠিক শেষ মুহুর্তে কিছু পরিবর্তন হল । মীরা অনুভব করলো কেউ একজন ওর কোমর জড়িয়ে ধরে ডান দিকে লাফিয়ে পড়লো । ওর পুরো শরীরটা কেঁপে উঠলো সাথে সাথে । মানুষটা ঠিক ওর পাশে মাটিতে ডাইভ দিয়ে পড়লো । এবং ওকে রেখেই মাটি থেকে উঠে পড়লো সাথে সাথে । মীরার তখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না যে কুকুরের হামলা থেকে ও বেঁচে গিয়েছে ।
মীরার মানুষটাকে দেখার চেষ্টা করলো । টর্চটা এখনও ওর হাতেই আছে । সেটা একটু বাকা করে ধরতেই টর্চের আলো গিয়ে পড়লো ওকে বাঁচানোর মানুষটার উপর । সাথে সাথেই মানুষটাকে চিনে ফেলল সে । সেই সাথে একটু অবাকও হয়ে গেল ।
রাফায়েল !
এই মানুষটা এখানে কি করছে !
দুই
মীরা রাফায়েল নামের এই মানুষটার নাম শুনেছে ওর বাসার কাজের মহিলার কাছ থেকে । এখানকার হাসপাতালে কাজের চাপ খুব না থাকলেও বাসার সব কাজ করার জন্য গ্রামের এক মাঝ বয়সী মহিলাকে রাখা আছে । প্রতিদিন সকাল আর বিকালে এসে সব কাজ কর্ম করে দিয়ে যায় । মূলত এই মহিলার কাছ থেকেই সে গ্রামের নানান খবরাখবর পায় । এই মাঝ বয়সী কাজের মানুষটা কথা বলতে ভালবাসে । তার বাসায় সম্ভবত তার এই বকবকানী কেউ পছন্দ করে না । তাই সব কথা সে মীরাকে এসে বলে । মীরা হাসপাতাল ছাড়া আর কিছু করারও নেই । তাই মাঝে মাঝে কথা বার্তা শুনে । সময় কাটে ।
এই কুলির মায়ের কাছেই সে প্রথম রাফায়েল নামের লোকটার কথা শুনতে পায় !
সেদিন ওর হাসপাতালে ডিউটি ছিল না । বাসার পেছন দিককার বারান্দায় বসে বসে বই পড়ছিল । ভেতরে থেকে কুলির মায়ের কাজের আওয়াজ ভেসে আসছিলো । এমন সময় কুলির মা ওর বারান্দায় এসে হাজির । বারান্দাটা ভিজে কাপড় দিয়ে মুছতে মুছতে বলল
-আফা শুনছেন নাকি খবর ?
বই থেকে মুখ না তুলেই মীরা বলল
-কি খবর ?
-এক ভুতের ওঝা আইছে গ্রামে । চেয়ার সাব খবর দিয়ে নিয়া আসছে !
মীরা জানে গ্রামে এই খুন গুলোকে গ্রামের মানুষ জন কোন স্বাভাবিক মানুষের বলে মনে করছে না । তাদের ধারনা এই খুন হচ্ছে কোন অতিপ্রাকৃত প্রাণীর দ্বারা । কোন জ্বীন কিংবা ভুত এই কাজ গুলো করছে । তাই তো পুলিশ কিছু করতে পারছে না । এতো গুলো মানুষ মরে গেল অথচ পুলিশ কোন কুল কিনারা করতে পারলো না । গ্রামের সবার মনে বদ্ধমুল ধারনা হয়েছে এই খুনের পেছনে কোন ভুতের হাত ধরেছে ।
মীরা এই কুলির মায়ের কাছেই শুনেছে যে প্রথম কিছুদিন গ্রামের সব হুজুর দিয়ে পুরো গ্রামটাকে বন্ধ করানো হয়েছে যাতে করে কোন ভুত প্রেত এই গ্রামের ভেতড়ে ঢুকতে না পারে কিন্তু সেটাতে খুব বেশি কাজ হয় নি । তার পরেও খুন হয়েছে । মীরা খানিকটা বিরক্ত হয়েছে । কারন মীরা খুব ভাল করেই জানে যে কোন ভুত প্রেম এই মানুষ গুলোকে মারে নি । কোন বিকৃত মস্তিস্কের মানুষ এই খুন গুলো করছে । পুলিশ তাকে খুজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে । মানুষটা নিশ্চয়ই খুব চালাক কিন্তু একদিন না একদিন তাকে ধরা পড়তেই হবে !
মীরা কুলির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল
-ভুতের ওঝা ?
-হ ! আর দুইদিন পরেই না আমাবইস্যা । এইবার যাতে কাউরে না নিতে পারে এই জন্য তারে আনা হইছে !
-তোমার মনে হয় কাজ হবে !
-কি জানি । হইতে পারে ! আবার নাও পারে । তয় এই মানুষ কামের আছে । চেহারা দেখলেই বোঝা যায় !
-আচ্ছা । কাজ হলে তো ভালই !
মীরা আর বেশি গা করে নি । গ্রামের মানুষ গুলোর মনে কুসংস্কারে ভর্তি । এরই সুযোগ নিয়ে এই রকম ওঝা ফকিরেরা টিকে আছে ! তাদের বোকা বানিয়ে যা পারছে নিয়ে যাচ্ছে । মীরা আবারও বই পড়ায় মনযোগ দিল ।
তবে অবাক হওয়ার ব্যাপার হচ্ছে সেই আমাবশ্যায় সত্যিই সত্যিই কোন মেয়ে গ্রাম থেকে গায়েব হল না । এটা পুরো গ্রামের মানুষের উপর খুব প্রভাব ফেলল । সবাই ঐ ভুতের ওঝার খুব প্রসংশা করতে শুরু করলো । এটা জানার পরে মীরার কেন জানি মানুষটাকে দেখার একটু কৌতুহল হল । একটু দেখেই আসে । ঐ ওঝা নাকি সারাদিন কুয়াশিয়া নদীর ধারে বসে থাকে । তার জন্য চেয়ারম্যান সায়েব সেখানে একটা মাচা বানিয়ে দিয়েছে ।
একদিন বিকেল বেলা সেখানে হাটতে হাটতে নদীর ধারে চলে গেল । সেখানে গিয়ে খানিকটা অবাক হয়ে গেল । মীরা সেই ভুতের ওঝাকে দেখে সত্যিই সত্যিই অবাক হয়ে গেল । শার্ট প্যান্ট পরা একটা ছেলে । বয়স ওর মতই হবে । মাচার উপর বসে আপন মনে একটা বই পড়ছে । ওকে আসতে দেখে উঠে বসলো । তারপর খুব পরিচিত ভঙ্গিতে বলল
-ডাক্তার ম্যাম কেমন আছেন ?
মীরা ওঝার চোখের দিকে তাকিয়ে একটা বড় ধরনের ধাক্কা খেল । একটা মানুষের চোখ যে এতো তীব্র হতে পারে সেটা মীরার জানা ছিল না । কেবল কিছুটা সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । চোখ সরাতে পারলো না । মীরার মনে সামনের এই মানুষটা কোন সাধারন মানুষ না । অবশ্য এই লাইনে যারা থাকে তারা অনেক ছল চতুরী জানে । হিপনোটিজম তো তাদের খুবই সাধারন একটা বিদ্যা মানুষকে ঠকানোর জন্য !
মীরা বলল
-আপনি আমাকে চিনেন ?
মানুষটা হাসলো । তারপর বলল
-আপনি এখানে ডাক্তার হয়ে এসেছে । মানুষের উপকার করছেন । আপনার অনেক প্রসংশা শুনেছি ।
এই কথাটা বলে মানুষটা আবারও হাসলো । মীরার কেন জানি মানুষটাকে মোটেই ভাল লাগলো না । বারবার মনে হল মুখে যাই বলুক মানুষটার চোখ বলছে অন্য কথা । এই চোখ দিয়ে সে মানুষের সব কিছু জেনে নিচ্ছে । এটা মীরার কাছে মোটেই সুখকর কোন বিষয় না ! সে বলল
-কই বসুন এখানে । আমার সাথেই তো দেখা করতে এসেছেন নাকি ?
-কে বলল যে আপনার সাথে দেখা করতে এসেছি ?
-আসেন নি ?
-নাহ ! আমি এদিকে মাঝে মাঝে হাটতে আসি । আজকেও এসেছি !
সামনের মানুষটা আবারও হাসলো । মীরার মনে হল যে ও মিথ্যা কথা বলছে এটাও সামনের মানুষটা জেনে গেছে । ওর ছেলে মানুষী দেখে হাসলো । নিজের উপর খানিকটা বিরক্ত হল । সত্যিই কথাটা বললে কি এমন ক্ষতি হত । সে তো সত্যিই ওর সাথেই দেখা করতে এসেছিলো । কিন্তু যেমন একটা ছবি নিজের মনের চেহারাতে ফুটিতে তুলেছিলো তার সাথে কোন মিলই নেই এর । কথা বার্তা শুনে মনে হচ্ছে পড়া লেখা জানা ছেলে । শিক্ষিত মানুষ গুলো যখন সাধারন মানুষকে বোকা বানায় তখন মীরার খুব রাগ হয় । এই মানুষটাকে প্রথম দেখেই তাই বিরক্তি চলে এসেছে ।
সামনে বসা মানুষটা বলল
-আমি আপনার নাম জানি । আপনার নাম মীরা আহসান ! আপনি কি করেন আর কেন এসেছেন সেটাও আমি জানি ! কিভাবে জানি সেটা জানতে চাইবেন না । আমার নাম বলি, আমার নাম রাফায়েল । আমিও ঠিক একই উদ্দেশ্য নিয়ে এই খানে এসেছি । আপনি যে কাজে এসেছেন সেটাতে আপনি একা একা কোন ভাবেই পেরে উঠবেন না । আমার সাহায্য আপনার লাগবেই !
-মানে ? কি বলতে চাচ্ছেন ?
-কিছু বলতে চাচ্ছি না । তবে আরও একটু সময় এই গ্রামে থাকেন তাহলে বুঝতে পারবেন এই গ্রামে ভয়ংকর কিছু চলছে । আমি নিজেও এখনও পুরোটুকু বুঝতে পারছি না তবে চলছে খুব ভয়ংকর কিছু !
মীরা কি বলবে ঠিক বুঝে উঠছে পারে নি । রাফায়েল তখনই উঠে দাড়ালো । হাতের বইটা মীরার দিকে দিয়ে বলল
-নিন এটা আপনার জন্য ।
বইটা হাতে নিয়ে মীরা এবার সত্যিই সত্যিই অবাক হয়ে গেল । বইটা সায়ক আমানের । এক কোলকাতার লেখক । অনেক দিন ধরেই তার এই সে খুজতেছিলো কিন্তু পাচ্ছিলো না । এটা কোন কাকতালীয় ব্যাপার । একবার মনে হল বইটা ফেরৎ দিয়ে দেয় কিন্তু বইটা ফেরৎ দিতে ইচ্ছে করলো না । সেই সাথে প্রথম দেখায় যে বিরক্তিটা এসেছিলো রাফায়েল নামের মানুষটার উপর সেটা খানিকটা কমে গেল । রাফায়েল বলল
-বইটা ভাল তবে শেষ টা মন মত হয় নি । যাই হোক আমি আসি । আজই চলে যাবো তবে আবার আসবো । আমাদের আবার দেখা হবে । ভাল থাকেন !
মীরাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাফায়েল হাটা দিল । মীরা কেবল খানিকটা সময় বোকার মত দাড়িয়ে রইলো বইটা হাতে নিয়ে।
তারপর থেকে রাফায়েলের আর দেখা পায় নি সে । আজকে ই বিপদের সময় সে হাজির হয়েছে । একেবারে সঠিক সময়ে ।
মীরা সামনের দিকে তাকিয়ে দেখলো সেি বিশাল আকারের কুকুর গুলো এখও মুখ দিয়ে গড়গড় করেই যাচ্ছে । আরেকবার ঝাপ দিল রাফায়েলকে লক্ষ্য করে । মীরা সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল । রাফায়েল নিজের হাত দুটো সামনে দিয়ে কি যেন একটা কিছু বিড়বিড় করছিলো তারপর জোরে চিৎকার করে কিছু বলল ।
মীরা চোখ বড় বড় তাকিয়ে দেখলো এই অন্ধকারের ভেতরে রাফায়েলের হাতের ভেতরে থেকে আলো জাতীয় কিছু বের হয়ে এল । সেটা দিয়ে সে দুই কুকুরকে জোড়ে একটা ধা্ক্কা দিল । কুকুর দুটো সামনে ছিটকে পড়লো । তবে তারা উঠে দাড়ালো সাথে সাথেই । আবারও ওকে আক্রমন করতে প্রস্তুত !
রাফায়েল তখন মীরার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনার পিস্তলের গুলির কি অবস্থা । এক্সট্রা ম্যাগজিন আছে না ?
মীরা মাটি থেকে উঠতে উঠতে বলল
-গুলিতে ওদের কোন কাজ হচ্ছে না । আমি পুরো ম্যাগাজিন ওদের উপর খরচ করেছি !
-কাজ হবে ! রিলোড করেন !
মীরা কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু বলল না । দ্রুত পকেট থেকে এক্সট্রা ম্যাগাজিনটা বের করে রিলোড করে নিল । তাক করলো সামনের কুকুর দুটোর দিকে । মীরা তখন অবাক হয়ে দেখলো রাফায়েল নিজের হাত দিয়ে পিস্তলটা চেপে ধরলো । তারপর মুখ দিয়ে আবার সেই অদ্ভুদ ভাষার কিছুস শব্দ উচ্চারন করতে লাগলো ।
মীরা পিস্তলটা ধরেই ছিল । সে অনুভব করলো পিস্তলটা যেন ওর হাতের ভেতরেই কাঁপছে আর অনেক গরম হয়ে গেছে । মীরা যখন মনে ওর আর পিস্তলটা ধরে রাখতে রাখতে রাখতে পারবে না তখনই রাফায়েল পিস্তলটা ছেড়ে দিল । মীরার দিকে তাকিয়ে বলল
-এবার গুলি করুন !
মীরার মনে খানিকটা দ্বিধা কাজ করলো । কারন একটু আগেই সে দেখেছে এই গুলিতে সামনের প্রাণীর গুলোর কিছুই হয় নি । এবার কি হবে ?
কিন্তু এবার হল ! মীরা গুলি করলো । এবং অবাক হয়ে দেখলো গুলি লাগার সাথে সাথেই প্রথম কুকুরটা যেন ছিটকে দিয়ে পরলো তিন হাত দুরে । দ্বিতীয় কুকুরটার বেলাতেও ঠিক একই ঘটনা ঘটলো । মীরা কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় ।
কি হল কিছুই বুঝতে পারছে না ।
ওদের থেকে দুরে দাড়ানো সেই কালো আয়বয়টার তখনও তাকিয়ে আছেন । কেমন যেন একটা আওয়াজ করছে । রাফায়েল বলল
-একদম চোখ দুটোর মাঝবরাবর নিশানা করবেন ! পারবেন না ?
মীরা সেই জ্বলন্ত চোখের ঠিক মাঝ বরাবর নিশানা করলো । তারপর ঠিক যখন ট্রগার টিপতে যাবে তখনই জ্বলন্ত নিভে গেল । মীরা গুলি করলো ঠিকই তবে সেটা যে ফাঁকাই চলে গেছে সেটা বুঝতে কষ্ট হল না ।
মীরা আরও কয়েক কদম এগিয়ে গেল । তারপর বলল
-আমাদের ওটার পিছু নেওয়া উচিৎ !
-লাভ নেই । এতো সময়ে ওটা নাগালের বাইরে চলে গেছে ।
-কিন্তু কি ছিল ওটা ?
-মানুষ যে ছিল না এটা তো বুঝতে পেরেছেন !
-আর ঐ কুকুর গুলো .....
এটা বলেই মীরা মৃত কুকুর গুলোর দিকে ফিরলো । অবাক হয়ে দেখলো সেখানে কোন কুকুর নেই । বরং টর্চের আলো ফেলে দেখতে পেল সেখানে দুটো কাক মরে পড়ে আছে ! বিস্ময় ভাবটা সে গোপন করার চেষ্টা করলো না । রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে রইলো কেবল অবাক হয়ে । রাফায়েল বলল
-আজকের মত যথেষ্ঠ এডভেঞ্চার হয়েছে । বাসায় ফিরে যান । আর এটা সাথে রাখবেন সব সময় ! ওটার চোখ পরেছে আপনার উপর । আপনার পিছু সে ছাড়বে না !
মীরা হাত বাড়িতে জিনিসটা নিল । একটা ছোট্ট কয়েন । তবে কোন পরিচিত কয়েন না । পিতলের তৈরি হবে সম্ভবত । একটু বেশি ভারী । দুই পাশেই অদ্ভুদ সব নকশা আকা ! রাফায়েল বলল, এখন বাসায় যান । ভয় নেই আজকে আর পিছনে আসবে না । আমাদের পরে দেখা হবে । আর সম্ভব হলে আপনার হেড কোয়ার্টারে খবর পাঠান । একটা টিম পাঠাতে বলেন । জঙ্গলের ভেতরে একটা অভিযান চালাতে হবে । ওটার আস্তানা ওখানেই !
মীরা অবাক হয়ে বলল
-আপনি জানেন ?
রাফায়েল হাসলো । তারপর বলল
-আপনার নিশ্চয়ই বোঝা উচিৎ একজন ডাক্তার এতো নিখুত ভাবে পিস্তল চালাতে পারবে না যদি না তার এই ব্যাপারে ট্রেনিং নেওয়া থাকে । আপনি মেডিক্যাল থেকেই পড়েছেন সেটা সত্যিই কিন্তু বিসিএসে আপনার প্রথম চয়েজ ছিল পুলিশ । তাই নয় কি ?
মীরা কি বলবে খুজে পেল না । ওর কাভারটা এতো স হজে যে ধরা পরে যাবে সেটা ও ভাবতে পারে নি ।
তিন
জনসারপুরের খুন গুলো শুরু হয় প্রায় বছর দুই আগে থেকেই । হঠাৎ করে একদিন একটা মেয়ে গ্রাম থেকে গায়েব হয়ে গেল । মেয়েটার স্বভাব ঠিক ভাল ছিল না । সবাই ভেবেছিলো মেয়েটা হয়তো কোন ছেলের সাথে পালিয়ে গেছে । তাই কেউ এই গায়েব হয়ে যাওয়া নিয়ে তেমন কিছু মনে করলো না ।
ঠিক তার তিন পরে একটা বিভৎস লাশ পরে থাকতে দেখা গেল কুয়াশিয়া নদীর পাশে । সেই শুরু হল । তারপর পরপর কয়েকটা মেয়ে যখন গ্রাম থেকে গায়েব হতে শুরু করলো তখন সবাই একটু নড়েচড়ে বসলো । বুঝতে পারলো এই গ্রামে কিছু একটা হচ্ছে । পুলিশ প্রথমে কাউকেই ঠিক খুজে পেল না । পেল না কোন সুত্রও । খুনের ভিটটিমদের মাঝে কোন মিল নেই । কেবল একটা মিলই আছে যে সবাই অবিবাহিত মেয়ে ।
এই মিলটা থেকেই পুলিশ খোজ খবর করে জানতে পারে বছর বিশেষ আগেও ঠিক একই ভাবেই এই এলাকাতে বেশ খুন হয়েছিলো । কদিন পরপরই সেখান থেকে মানুষ গায়েব হয়ে যেত । বিশেষ করে ১৫ থেকে ২০ বছরের মেয়েরা হঠাৎ গায়েব হয়ে যেত । তারপর তাদএর লাশ পাওয়া যেত জঙ্গল কিংবা নদীর ধারে । ক্ষত বিক্ষত সেই সব লাশের কাছে যাওয়া যেত না । এমন কি পুলিশের সদস্যরাও সেই লাশ গুলোর সামনে যেতে পারতো না ।
তারপর হঠাৎ যেভাবে শুরু হয়েছিলো ঠিক সেই ভাবেই খুন গুলো শেষ হয়ে যায় । অনেক দিন এই এলাকার মানুষ শান্তিতে ছিল । এমন কি এখানে সাধারন চুরি পর্যন্ত হত না । এই গ্রামের বেশির ভাগ মানুষই কৃষি কাজ করতো, অল্প কিছু মানুষ অন্য পেশার সাথে জড়িত ছিল । সহজ সরল এদের জীবন । তারপর আবার শুরু হল এই খুন গুলো । পুলিশ অনেক ভেবে চিন্তেও কিছু করতে পারলো না । কাউকে সন্দেহ করতে পারলো না ।
এটা নিয়ে খুলনা পুলিশ বেশ চিন্তিত হয়ে পড়ে । দুই বছর ধরে নিয়ম করে এমন খুন হওয়াটা মোটেও মেনে নেওয়া যায় না । কিন্তু পুলিশের কিছু করার উপায় ছিল না । একে তো জনসারপুর এলাকাটা সাধারন লোকালয় থেকে অনেকটা দুরে । নিকটবর্তি থানাটাও ১৫ মাইল দুরে । তারা খুনের কথা শোনে কিছুদিন সেখানে গিয়ে খোজ খবর চালায় কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না । যা তাই রয়ে যায় । তার উপর গ্রামের মানুষের মুখে চালু হয়েছে এক নতুন গল্প । কোন মানুষ এই খুন করে না। খুন করে কোন পিশাচ । এখানে পুলিশের কিছু করার নেই । তারা কিছু করতেও পারবে না। তাই তারা এক সময়ে পুলিশকে খবর দেওয়াও বন্ধ করে দেয় । খুনি যেহেতু কেবল যুবতী মেয়েদেরকেই নিয়ে যায় তাই সবাই মিলে এই মেয়েদেরকে পাহারা দিতে শুরু করে । একটু কাজ কাজ হলেও মাঝে মাঝে ঠিকই হারিয়ে যেতে লাগলো কেউ কেউ ।
পুলিশ তখন বুঝতে এভাবে এই খুনিকে ধরা যাবে না । অন্য ভাবে চেষ্টা করতে হবে । এখানেই মীরা এসে হাজির । এমবিবিএস পাশ করেছে কিন্তু বিসিএস দিয়ে পুলিশ হয়েছে । ওকে আন্ডার কাভার অফিসার হিসাবে পাঠানো হল জনসারপুর গ্রামে । কিছুদিন ও ডাক্তারি করবে আর সব মানুষ জনের উপর নজর রাখবে । সময় মত হেডকোয়ার্টারে রিপোর্ট করবে । এতোদিন মীরারও ধারনা ছিল যে কোন উর্বর আর বিকৃত মস্তিস্কের মানুষ কাজটা করছে কিন্তু আজকে ওর সাথে যে ঘটনা ঘটে গেল সেটা দিয়ে ওর বিশ্বাস আমুল পরিবর্তন হয়ে গেল । কিন্তু এই কথা ও হেডকোয়ার্টারে কিভাবে জানাবে ?
কিভাবে বলবে যে ওকে সত্যি সত্যিই মানুষ নয়, কোন অশরীরি ধরেছিলো ! মীরা হাতের ভেতরে রাফায়েলের দেওয়া কয়েনটা নিয়ে নিজের বাসার দিকে রওয়ানা হাটতে লাগলো । নিজের মাথার ভেতরে তখন হাজারটা চিন্তা । এখনও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না ।
আচ্ছা এসবই কি ঐ রাফায়েল নামের মানুষটার কোন চাল হতে পারে ?
নাহ !
চিন্তাটা বাদ দিয়ে দিল । যা ও দেখেছে নিজের চোখেই দেখেই । এখানে ভুল হওয়ার কোন সম্ভবনা নেই । নিজে ও গুলি করেছিলো । ওর নিশানা কোন ভাবেই ভুল হওয়ার কথা না । কিন্তু প্রথমবার যেন গুলিতে কিছুই হয় নি প্রাণী গুলোর । কিছুই যেন আসে যায় নি । অথচ পরের বার যখন রাফায়েল নামের মানুষটা ওর পিস্তলে কিছু করলো, গুলি লাগার সাথে সাথে কেমন ছিটকে পড়লো সেগুলো । এসব ভাবতে ভাবতে মীরা এগিয়ে চললো নিজের বাসার দিকে ।
বাসার কাছে পৌছে গেছে এমন সময় পেছন থেকে পরিচিত একটা কন্ঠস্বর শুনতে পেল । তাকিয়ে দেখে কমপাউন্ডার লিয়াকত ওর দিকে দৌড়ে আসছে । ওর কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,
-ম্যাডাম জলদি চলেন, মিলন স্যারের পিচাশ ধরছে !
মীরা বলল
-কি বললে ?
-জে ম্যাডাম ! স্যারের পায়ে কামড় দিয়ে । জলদি চলেন !
মীরা আর কিছু না ভেবে ক্লিনিকের দিকে দৌড় দিল লিয়াকতের পেছন পেছন । এমন টা সাধারনত হয় না । এখনও পর্যন্ত গ্রামের পুরুষ ঐ জন্তুটার আক্রমনের শিকার হয় নি । যা হয়েছে সবই মেয়ে তাহলে মিলন সাহেবকে কেন ধরলো ?
নাকি কদিন ধরে কাউকে পাচ্ছে বলে এখন পুরুষের উপরেও আক্রমন করা শুরু করেছে !
ক্লিনিকে পৌছে সরাসরি ইমার্জেন্সী রুমে চলে গেল । সেখানেই ডাক্তার মিলনকে রাখা হয়েছে । মীরা ঘরে ঢুকতেই দেখলো ডাক্তার মিলন ঘর একটা বেডের উপর শুয়ে আছে । দুজন নার্স তার পা পরীক্ষা করার চেষ্টা করছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না । তারা ঠিক সাহস পাচ্ছে না ।
মীরা জলদি কাজে নেমে গেল । পা টা পরীক্ষা করে দেখলো । বেশ ধরনের ক্ষত । তবে এটাও কোন পশুর কামড়ানোর ক্ষত নয় । সেই মানুষের দাঁতের ছাপটা এখনও পরিস্কার বুঝতে পারছে ও । সত্যিই সত্যিই কোন মানুষই কামড়েছে ! মিলন ডাহেব চোখ বন্ধ করে বেডের উপর শুনে আছে । মুখটা ব্যাথায় নীল হয়ে আছে । মীরা চিন্তিত মুখে ক্ষত পরিস্কার করে সেলাই করলো তারপর সেখানে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিল ।
মিলন সাহেব কথা বলার পরিস্থিতে ছিল না । লিয়াকতের কাছে শুনতে পেল যে হঠাৎ করেই সে মিলনের চিৎকারের আওয়াজ শুনতে পায় । একটু আগেই নাকি মিলন ক্লিনের ডিউটি শেষ করে বাসার দিকে রওয়ানা দিয়েছিলো । মাঝপথে তাকে আক্রমন করেছে । লিয়াকত সেই চিৎকার শুনেই দৌড়ে যায় । কিছুদুর যাওয়ার পরেও দেখতে পায় অন্ধকারের মধ্য ডাক্তার মিলন পড়ে আছে । লিয়াকতের মনে হয় যেন ওর আসার ঠিক আগেই কোন কিছু একটা অন্ধকারের ভেতরে মিলিয়ে গেল । লিয়াকতই তারপর মিলনকে ধরে আবার ক্লিনিকে নিয়ে আসে তারপর মীরার খোজে বের হয় !
মীরার শরীর ক্লান্ত লাগছিলো । এখানে আপাতত আর কিছু করার নেই । নিজের বাসার দিকে রওয়ানা দিল । হেডকোয়াটারে একটা জরুরী মেসেজ পাঠিয়ে দিল । একটা জরুরী ফোর্স দরকার । জঙ্গলের ভেতরে একটা জরুরী অভিযান পরিচালোনা করা দরকার । যা হচ্ছে ওটার ভেতরেই হচ্ছে ! ওটার ভেতরেই কিছু একটা আছে । এর আগেও জঙ্গলের ভেতরে ফোর্স ঢুকেছে কিন্তু কিছু খুজে পায় নি । বেশ কিছুটা ভেতরে সেখানে একটা পুরানো মন্দির আছে । সেটা ছাড়া আর কিছুই সেখানে নেই । তবুও এবার আরও ভাল করে খোজ খবর করতে হবে । মীরা মনে মনে ঠিক করেই নিল এর শেষ না দেখে আর ছাড়বে না !
চোখ বন্ধ করলেও মীরার ঠিক ঘুম এল না । বারবার সেই আগুনের মত চোখ গুলোর কথা ওর মনে হতে লাগলো । চোখ গুলো যেন ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল । রাফায়েল নামের মানুষটা ওকে বলেছে ও যেন সাবধানে থাকে । কারন ওটার চোখ নাকি ওর উপর পরেছে । তাহলে কি এবার ওর পালা ? ওকে ধরে নিয়ে যাবে ? ওর লাশও ঠিক ঐভাবে পরে থাকবে কুয়াশিয়া নদীর ধানে । ওভাবে আধ খাওয়া অবস্থায় !
এসব ভাবতে ভাবতে মীরার চোখ লেগে এল । ঘুমের ভেতরেই যেন সে জঙ্গলের ভেতরে গিয়ে হাজির হল । অন্ধকারের ভেতরে মীরা একা একা দৌড়াচ্ছে । পেছন থেকে কেউ যেন ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে । মীরা জানে সেই আগুন চোখের প্রাণীটা ওর পিছু নিয়েছে । তার পেছনের থপথপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে ও । ও প্রাণ ভয়ে দৌড়াচ্ছে কেবল !
জঙ্গলের ডাল পালা এসে ওর শরীরে লাগছে তবে ও কিছুতেই গায়ে মাখছে না । ওর কেবল মনে হচ্ছে ওকে সামনে পালাতে হবে । নয়তো এই প্রাণীটা ওকে ঠিকই ধরে ফেলবে ! মীরা কেবল দৌড়াচ্ছে । অন্ধাকারে সামনে কিছু সে দেখতে পাচ্ছে না । পেছনের পায়ের আওয়াজটা ঠিকই পাচ্ছে । প্রতি মুহুর্তে সেটা যেন আও কাছে চলে আসছে ।
হঠাৎ পায়ে গাছের শিকড় আটকে পড়ে গেল । মীরার সামনে একেবারে উপুর হয়ে পড়লো । কোন মতে হাত দিয়ে মুখের সরাসরি ব্যাথা পাওয়া থেকে নিজেকে বাঁচালো । যখন আবারও মুখ তুলে তাকালো দেখতে পেল সামনে একটা ভাঙ্গা মন্দির । একটু আগে চারিপাশ যেমন অন্ধকার মনে হচ্ছিলো এখন তেমন অন্ধকার লাগছে না । বরং মনে হচ্ছে মন্দির থেকে একটা আলো বের হয়ে আসছে যেটা চারিপাশটা আলোকিত করে রেখেছে । মীরা কোন মতে উঠে দাড়ালো । তখনই বুঝতে পারলো ওর পেছনে কেউ এসে দাড়িয়েছে । পেছন ফিরে তাকাতেই সেই অন্ধকারের ভেতরে লাল চোখ দুটো দেখতে পেল । আর কিছু দেখতে পাচ্ছে না সে কেবল চোখ দুটো ছাড়া । তবে মীরার মনে হল ঐ অন্ধকার প্রাণীটা ওকে দেখে যেন হাসছে । এতো সময়ে পরে ওকে হাতের মুঠোই পেয়েছে এটা ভেবে সে হাসছে ।
মীরা কি করবে বুঝতে পারছে না । ওর ঠিক তখনই ওর রাফায়েলের দেওয়া কয়েনটার কথা মনে পড়লো । বাম পকেটে হাত দিতেই সেটার অস্ত্বিত টের পেল । সেটা বের করে শক্ত করে হাতের মুঠোর ভেতরে ধরতেই ম্যাজিকের মত কাজ হল । মীরা দেখতে পেল সামনের সেই অন্ধকারটা নিমিষের ভেতরে গায়েব হয়ে গেল । সেই সাথে সাথেই ওর ঘুম ভেঙ্গে গেল । মীরা চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে ভোর হয়ে গেছে । ওর হাতের ভেতরে কয়েনটা দেখতে পেয়ে খানিকটা অবাক হল । ঘুমের ভেতরে ও কখন কয়েনটা হাতে নিয়েছে বুঝতে পারলো না । ভোরের আলোর দিকে তাকিয়ে ওর মনটা শান্ত হয়ে এল ।
চার
বিকেল বেলা ক্লিনিকের কাজ শেষ করে বের হতে যাবে তখনই সোলাইমান হোসেন এসে হাজির । আজকে আর বাইরে না দাড়িয়ে থেকে সরাসরি মীরার কেবিনে ঢুকে পড়লো । মীরা তাকিয়ে দেখলো সোলাইমান হোসেন আজকে একা আসে নি । গতকাল রাতে যে ছেলেটা ওর সাথে দিয়েছিলো সেই ছেলেটাকে চুলের মুঠি ধরে নিয়ে এসেছে ।
মীরা সেদিকে তাকিয়ে বলল
-আরে কি করছেন ? ও ব্যাথা পাচ্ছে তো !
সোলাইমান হোসেন যেন আরও একটু রেগে গেল । বলল
-এই হারামজাদা কাইল তোমারে বিপদের মাঝে ফালাইয়া ভাগছে !
-আরে তো কি হয়েছে ! বেচারা ভয় পেয়েছে !
-তাও আমারে কিছু কয় নাই । সারা রাত গেল সারা দিন গেল কিছু কয় না ! আমি জানছি অন্য মানুষের কাছ থেইকা ! আমি তো চিন্তাই বাঁচি না । তোমার যদি কিছু হয়ে যাইতো তখন ! ভাগ্য ভাল কিছু হয় নাই । আইজকা আমি এরে মাইরাই ফালামু !
মীরা উঠে গিয়ে ছেলেটাকে ছাড়িয়ে নিল । তারপর চলে যেতে বলল । সোলাইমান হোসেন তখনও রাগে ফুসছে । সেই সাথে খানিকটা লজ্জিতবোধ করছে । মীরা সোলাইমান হোসেনকে শান্ত হতে বলল । তারপর সামনের চেয়ারে বসতে বলল । সোলাইমান হোসেন বলল
-তুমি ঠিক আছো মা জননী ? তোমার কোন ক্ষতি হয় নাই তো ?
-না চাচাজি কিছু হয় নি । দেখছেন না সুস্থ আছি !
-ডাক্তার সাহেব রে নাকি কাইল পিচাশে ধরছিলো । হের পা থেইকা মাংশ নিয়া গেছে ? সকাল উইঠাই এই খবর পাইছি । অবাকও হইছি । তাইলে কি আমরাও এখন আর নিরাপদ না ?
মীরা খানিকটা চিন্তিত কন্ঠে বলল
-কি জানি ! আমি নিজেও খানিকটা অবাক হয়েছি ! এমন তো হয় নি এর আগে । তাই না ?
-হ । তা হয় নাই । দেখি সবাইরে সাবধান করতে হইবো । আইজ আবার দেখলাম পুলিশের গাড়ি আইছে । জঙ্গলের ভেতরে ঢুকছে । এর আগেই আইছিলো কি জানি খুজছে কিন্তু কোন কাম হই নাই !
গত রাতেই ও স্পেশাল একটা রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলো হেড কোয়ার্টারে । তার ভিত্তিতেই আজকে সকালে এসে পৌছিয়েছে টিমটা । তাদের কাজ হচ্ছে জঙ্গলের ভেতরে খুজে দেখা । যদি আলাদা কিছু পাওয়া যায় । ওর যাওয়ার ইচ্ছে তাদের সাথে কিন্তু উপর থেকে খবর এসেছে যে নিজের পরিচয় এখনই প্রকাশ করা যাবে না । যদি জঙ্গলের ভেতরে কিছু খুজে না পাওয়া যায় তাহলে তো কাজের কাজ কিছুই হবে না । মীরারও তাই মনে হয়েছে । এবং শেষ খবর পর্যন্ত পাওয়া পর্যন্ত তাই হয়েছে । ওরা অনেক গভীর জঙ্গলে গিয়েছিলো কিন্তু কিছুই খুজে পায় নি । একটা ভাঙ্গা মন্দির পেয়েছে । ওটা পুরোটা খুজেছে ওরা কিন্তু তাতেই কিছু পাওয়া যায় নি ।
পুরো অভিযানের একজটা ভিডিও করা হয়েছে । সেটা ওকে পাঠানো হয়েছে এখনও পুরো টুকু দেখে উঠতে পারে নি । ক্লিনিকের কাজ শেষ করে দেখবে ঠিক করেছিলো । সোলাইমান হোসেন বলল
-দেখি আমি কি করতে পারি । তুমি কিন্তু আর বের হবা রাতে । মনে থাকবে !
-জি চাচাজি মনে থাকবে ! আপনি চিন্তা করবেন না !
সোলাইমান হোসেন যেমন দ্রুত এসেছিলো তেমনই দ্রুত চলে গেল । সোলাইমান হোসেন চলে যেতেই মীরা মনে একটা কথা ধাক্কা মারলো । গতরাতে ওর উপর যে হামলা হয়েছে সেটা ও ঐ পালিয়ে যাওয়া ছেলেটা আর রাফায়েল ছাড়া আর কেউ জানে না । সোলাইমান হোসেন বলল যে ছেলেটা নাকি তাকে ভয়তে বলে নি । সে জেনেছে অন্য কারো কাছ থেকে ! কার কাছ থেকে জেনেছে ? রাফায়েলের কাছ থেকে ?
মীরা খানিকটা চিন্তা করলো । তারপর মনে হল রাফায়েলের কাছ থেকেই জেনেছে হয়তো । তারপর নিজের ট্যাব টা বের করলো । এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক খুব স্লো । সেই কখন ভিডিওটা পাঠিয়েছে তখনও ঠিক মত ডাউণলোড হয় নি । মীরা আরও কিছু সময় অপেক্ষা করলো পুরো টুকু ডাউনলোড হওয়ার জন্য । আরও ঘন্টা খানেক পরে পুরো অভিযানের ভিডিও টা ডাউনলোড হল । সে এবার মনযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো ।
মোট ১৫ জনের একটা টিম গিয়েছিলো । ধীরে তারা ঢুকে গেছে জঙ্গলের ভেতরে । সম্ভব সব দিকে খোজ খবর নিয়ে দেখেছে । শেষ গিয়ে হাজির হয়েছে মন্দিরের কাছে । পুরো মন্দিরটা একবার চক্কর দিয়েছে তারা । এমন ভাবে ঢুরেছে যেন যেন ভিডিওতে সব টুকু পরিস্কার ভাবে আসে । মীরা সেসবই মনযোগ দিয়ে দেখলো । এবার কয়েকজনকে বাইরে রেখে সবাই ভেতরে প্রবেশ করলো ।
বাইরে থেকে যতখানি বড় মনে হয় ভেতরে মন্দিরটা আরও ছোট । কোন মুর্তি কিংবা প্রতিমা নেই । প্রতিমার একটা বেদি অবশ্য আছে তবে সেখানে কিছু নেই । অনেক বছর আগে হয়তো এখানে কোন মুর্তি ছিল । কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে । একজন পুলিশ সদস্যকে বলতে শুনলো যে সে নাকি কিছু অদ্ভুদ গন্ধ পাচ্ছে । পচা গন্ধ । ওরা আরও কিছু সময় খোজাখুজি করলো কিন্তু কিছুই খুজে পেল না । তারপর আর কিছু না পেয়ে ফিরে চলে এল । মীরা খানিকটা হতাশই হল পুরো ভিডিও দেখে । এখন কি করবে বুঝতে পারছে না ।
বিকেলে বাসায় ফেরার পথে হঠাৎ মীরা মনে রাফায়েল নামের মানুষটার সাথে কথা বলা দরকার । গতকাল সে বলেছিলো মন্দিরে কিছু পাওয়া যাবে । মূলত কাল রাতে তার কাজ কর্ম দেখেই অনেকটাই ভড়কে গিয়েছিলো । মনে হয়েছিলো সে সত্যি কথাই বলছে । তাই জন্য হঠাৎ করেই সে বলেছি হেড কোয়াটারে । কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হল না ।
রাফায়েলের সাথে তার আগে দেখা হয়েছিলো নদীর পাশে । আজও আর কিছু না ভেবে সে নদীর দিকেই হাটা দিল । যদিও কোন নিশ্চয়তা নেই তবুও তার মনে হল যে ঐখানেই তার সাথে দেখা হবে । এবং সত্যিই দেখা হল সেখানে । রাফায়েল ঠিক সেই মাচার উপরেই আধ শোয়া অবস্থায় বই পড়ছিলো । ওকে আসতে দেখেই উঠে বসলো । তারপর বলল
-কেমন আছেন ডাক্তার ম্যাডাম !
মীরা কোন উত্তর দিল না । মাচার উপর বসতে বসতে বলল
-ওরা মন্দিরের ভেতরে কিছু পায় নি ।
-সত্যি পায় নি ? কিন্তু পাওয়ার কথা ছিল ।
-এই দেখুন ভিডিও !
বলে ব্যাগ থেকে ট্যাবটা ওর হাতে দিল । রাফায়েল কিছু সময় ভিডিওটার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা স্থানে পজ করে রাখলো । মীরা তাকিয়ে দেখলো ঠিক মন্দিরের সামনের অংশটাতে ভিডিওটা পজ করে রাখা হয়েছে । মীরাও দেখলো সেটা । রাফায়েল বলল
-যত ঝামেলা এই মন্দিরেই !
-আপনি কিভাবে এতো নিশ্চিত কন্ঠে বলছেন ?
-আপনার কাছে মোবাইল আছে না ? ওটা বের করেন । তারপর হাউরেস লিখে সার্চ দেন ।
মীরা খানিকটা বিরক্ত হলেও কিছু বলল না । এখানে মোবাইলের নেটওয়ার্ক খুবই স্লো । তবুও মোবাইলে ইন্টারনেট চালু করে হাউরেস লিখে সার্চ দিল । বেশ খানিকটা সময় পরে কিছু লিংক আসলো সেখানে । প্রথম লিংকটা ওপেন করতেই একটা ছবি আটকে গেল ওর চোখে । একটা দোঁপেও মানুষ আকৃতি প্রাণী দেখা যাচ্ছে । সব থেকে লক্ষনীয় হচ্ছে তার চোখ । মীরার পুরো শরীর যেন কেঁপে উঠলো সাথে সাথে । তার নিচেই আরেকটা সিম্বল দেখতে পেল সে ।
রাফায়েল বলল
-সিম্বল দেখুন এই খানে ।
বলে ট্যাবটা এগিয়ে দিল মীরার দিকে । মন্দিনের ঠিক মাথার উপর একটা গোল সিম্বল দেখা যাচ্ছে খোদাই করা । মোট চারটা ক্রস দেখা যাচ্ছে । দুইটা পাখা চলে গেছে দুই দিকে ।
রাফায়েল বলল
-এটা হচ্ছে হাউরেসের চিহ্ন । ওটা হাউরেসের মন্দির । কেউ ওখানে বানিয়েছে । ওখানেই হাউরেসকে ডাকা হয় । হাউরেজ একজন হেল জেনারেল । লেপার্ড হিউম্যান শেইপে থাকে । মানুষের বিশেষ করে মেয়েদের রক্ত আর বিশেষ কিছু অঙ্গ খায় সে । তাকে ডেকে আনলে আনলে এই অঙ্গ খেতে দিতে হয় ভেট হিসাবে । তারপর তার কাছে অনেক কিছু চাওয়া সম্ভব । খুবই শক্তিশালী সে । তার সাথে সম্মুখ যুদ্ধে জেতা অসম্ভব তবে জীবন্ত মেয়েদেরকে ভয় পায় সে । এইজন্য মেয়েদের শরীরের রক্ত সে পছন্দ করে । তার যে অনুসারী আছে তারাও ঠিক একই কাজ করে । মেয়েদের রক্ত আর শরীরের মাংস খায় ।
মীরা কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । ওর ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না । মীরা বলল
-আপনি যা বলছেন তার কিছুই বিশ্বাস হচ্ছে না আমার !
-কারো হওয়ার কথা না । কিন্তু যেটা আপনার বিশ্বাস করা উচিৎ সেটা হচ্ছে কেউ এই মন্দিরটা বানিয়েছিলো অনেক দিন আগে । এবং এখানে বসেই সে এই অপদেবতার উপসনা করে । দেবতা আসুক কিংবা না আসুক সে ঠিকই মেয়েদের কে ধরে নিয়ে যায়, দেবতার সামনে ভেট হিসাবে হাজির করে তাদের শরীরের মাংশ খায় । এটা তো বিশ্বাস করার মত । নাকি ?
মীরা মাথা ঝাকালো । হ্যা এটা বিশ্বাস করার মত । কারন মস্তিস্ক বিকৃত মানুষের অভাব নেই এই জগতে । অনেক অন্ধবিশ্বাস এই পৃথিবীর মানুষের ভেতরে আছে । তারা এই অন্ধ বিশ্বাস থেকে অনেক কাজ করে । মীরা বলল
-এখন আমাদের কি করা উচিৎ ? পুলিশ তো কিছুই খুজে পায় নি সেখানে !
-পায় নি কারন তারা গাধা । একটু ভাল করে লক্ষ্য করলেই বুঝতে পারতো যে ঐ মন্দিরটা মোটেই পরিত্যাক্ত নয় । এই দেখুন !
বলে ট্যাবটা আবারও মীরার হাতে দিল । মন্দিরে যাওয়ার পথেই একটা সুক্ষ পায়ে হাটা পথের অস্তিত্ব দেখা যাচ্ছে । রাফায়েল বলল
-পায়ে হাটা পথটা প্রমান করে এই রাস্তা দিয়ে মানুষ যাতায়াত করে ।
মীরা বলল
-অন্য যে কেউ যেতে পারে । জঙ্গলে কাঠ কাটতে ।
-আপনি ভুলে যাচ্ছে এই জঙ্গলে ভয়ে কেউ ঢোকে না । তবুও মেনে নিলান । হয়তো দল বেধে যায় । কিন্তু মন্দিরের ভেতরটা দেখুন । পরিত্যাক্ত মন্দিরের অবস্থা এমন হয় নি । মন্দিরের ভেতরটা একেবারে পরিস্কার মনে হচ্ছে । অন্তত কেউ এটা নিয়মিত পরিস্কার এটা একেবারে নিশ্চিত ।
মীরার মনেও ঠিক এই কথাটা মনে হয়েছে । পরিত্যাক্ত মন্দিরের মত না । এখানে কেউ আসে এবং সেটা পরিস্কার পরিছন্ন রাখে । কিন্তু এমন খোলা স্থানে কি মেয়ে গুলোকে মেরে ফেলে ? এখানেই সব আচার ব্যবস্থা চলে । তাহলে রক্তের কোন ছাপ থাকবে । যে টিমটা গিয়েছিলো ওরা সব দেওয়া ভাল করে পরীক্ষা করে দেখেছে । কিছুই পায় নি তারা । তাহলে কি অন্য কোথায় মেয়ে গুলোকে হত্যা করে ?
মীরার মাথাটা ধরে এল । কিছুই বুঝতে পারছে না । এখন কি করবে ? হঠাৎ রাফায়েলকে বলল
-আপনার সাথে কি চেয়ারম্যান সাহেবের দেখা হয়েছছিল ?
-না । আমি এখানে আছি, আপনি ছাড়া আর কেউ জানে না !
-তাই ?
-কেন ?
-না মানে আপনি যদি না বলেন তাহলে কালকে যে আমার উপর ঐ হামলা হয়েছিলো এটা চেয়ারম্যান সাহেব কিভাবে জানলো ?
কে বলেছে তাকে ?
মীরার বুকের ভেতরটা দুরুদুরু করছে । এর আগেও বেশ কয়েকটা অভিযানে সে অংশ নিয়েছে তবে এটার ব্যাপারটা একেবারেই আলাদা । মীরা জঙ্গলের ভেতরে ঐ মন্দিরের এক পাশে লুকিয়ে আছে । ওর ঠিক পাশেই রাফায়েল নামের মানুষটা বসে আছে চুপ করে । চোখ সামনের মন্দিরের দিকে । ওদের বিশ্বাস আজকে ওদের খুনি এখানে এসে হাজির হবে !
মীরা সন্ধ্যা হতেই বাসা থেকে বের হয়ে এসেছে । আজকে আর সেলোয়ার কামি পরে আসে নি । কালো একটা প্যান্টের সাথে পরে কালো টিশার্ট । তার উপর জড়িয়েছে কালো জ্যাকেট । জ্যাকেটের নিচে দুই পাশে দুটো পিস্তল রয়েছে । ডাক দিকের পকেটে একটা শক্তিশালী টর্চ । হাতে গ্লোভ আর মুখে একটা কালো মাস্কও পরেছে । অন্ধকারে যাতে ওকে একদম চেনা না যায় । সে একাই লুকিয়ে জঙ্গলে ঢুকেছে । রাফায়েল আগে থেকেই ওর জন্য অপেক্ষা করছিলো ওর জন্য । দুজন তারপর এসে হাজির হয়েছে এই মন্দিরের কাছে । অপেক্ষা করছে ।
রাফায়েল যখন বলল যে সে চেয়ারম্যানকে ওর উপরের হামলার কথা বলে নি তখনই ওর মনে খানিকটা সন্দেহ জাগলো । প্রথম গিয়ে ওর সন্দেহটা পরেছে স্বয়ং চেয়ারম্যানের উপরেই । এই জন্যই হয়তো হামলার কথাটা নিজ মুখে বলে ফেলেছে ভুল করে । হয়তো এই খুন গুলোর সাথে চেয়ারম্যান নিজেই জড়িত । উপরে ভাল মানুষের লেবাস পরে থাকলেও ভেতরে ভেতরে এই কাজ গুলো করে থাকতেও পারে । আজকে আমাবস্যার দ্বিতীয় দিন । কালকে ওদের কাজ ঠিক মত হয়নি । মীরাকে ওরা উঠিয়ে নিয়ে যেতে পারে নি । তাই আজকেও আবারও আসার সম্ভবনা আছে । এখান থেকে আবার ওরা নতুন কাউকে ধরে নিয়ে যাওয়ার জন্য বের হবে নয়তো এখানে ধরে নিয়ে আসবে । তাই মীরা আর রাফায়েল এখানে অপেক্ষা করতে লাগলো ।
বেশি সময় ওদের অপেক্ষা করতে হল না । ঘন্টা দুয়েক পরেই ওরা দেখতে পেল একটা কালো অয়বয় আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে মন্দিরের দিকে । ওরা দুজন একেবারে মাটির সাথে মিশে রইলো । তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে । লোকটা ওদের একটা সামনে দিয়েই মন্দিরের ভেতরে গিয়ে ঢুকলো । বেশ কিছুটা সময় পার হয়ে যেতেই ওরা দুজন পা টিপে টিপে উঠে দাড়ালো । তারপর হেটে চলল মন্দিরের দিকে । মন্দিরের দরজার কাছে গিয়ে ভেতরে দিকে তাকাতেই খানিকটা অবাক হয়ে গেল ।
ভিডিওতে দেখেছিলো পুরো মন্দিরের ভেতরটা আসলে কিছুই নেই । কেবল বেদি আছে একটা । তার উপর কোন মুর্তি নেই । এখন দেখা যাচ্ছে সেই বেদিটা নিজের স্থান থেকে খানিটকা সরে গিয়েছে । ভেতরে একটা ফাঁকা স্থান । নিচে সিড়ি নেমে গিয়েয়ে । সেখান থেকে আলো আসছে । মীরা আর রাফায়েল দুজন দুজনের দিকে তাকালো । তাপরর মীরা নিজের মোবাইল বের করে একটা নির্দিষ্ট স্থানে মেসেজ পাঠালো ।
রাফায়েলকে বলল
-এখন কি করবো ? ফোর্স আসতে কিছুটা সময় লাগবে !
-চলেন ভেতরে !
মীরা আর রাফায়েল দুজনেই ভেতরে সিড়িতে পা দিল ধীরে ধীরে নিচে নামতে লাগলো । নিচে নামতেই একটা বিশ্রী গন্ধ ওদের দুজনের নাকে এসে লাগলো । মীরা এই গন্ধটা ঠিকই চেনে । মানুষের মাংশ পচা গন্ধ । দুজন গন্ধটা চেপে ধরে চারিদিকে তাকাতে লাগলো ।
বিশাল বড় একটা ঘর । ঠিক মন্দিরের নিচে এতো বড় একটা ঘর থাকতে পারে সেটা মীরা ভাবতেও পারে নি । পুরো ঘরটা মশালের আগুনে আলোকিত হয়ে আছে । সবার আগে চোখ যায় বড় মুর্তিটার দিকে । দুই পেও একটা মানুষের মত জন্তু তবে তার মাথাটা একটা লোপার্ডের মত । পুরো শরীরটা কালো । চোখের ওখানে লাল পাথর সবানো । যেন চোখ আগুনের মত জ্বলছে । মাথার উপর থেকে দুটো শিং বের হয়ে গেছে ।
রাফায়েল বলল
-হাউরেসের মুর্তি !
মুর্তিটার ঠিক সামনেই একটা চার কোনা বেদি দেখা যাচ্ছে । সেখান থেকে বিকট দুর্গন্ধ আসছে । সেখানে রক্তের কালচে দাগ চিনতে কষ্ট হল না । মীরা বলল
-এখানেই মেয়ে গুলোকে মেরে ফেলা হয় ।
-এখন থেকে রক্ত যায় এই মুর্তিট কাছে !
-মানুষ কতটা বিকৃত হতে পারে !
মীরা নিজের ভেতরে একটা তীব্র রাগ অনুভব করলো । কিছু বলতে যাবে তখনই পাশের একটা অন্ধকার ঘর থেকে একটা মানুষ বের হয়ে এল । ওদের কে দেখে থমকে দাড়ালো । এখানে ওদেরকে মানুষটা মোটেই আশা করে নি । মীরার মুখে এখনও কমান্ড মাস্ক পরানো রয়েছে । তাই মীরাকে মানুষটা চিনতে পারলো না । কিন্তু মীরা তাকে ঠিকই চিন্তে পারলো !
ওদের ক্লিনিকের কমপাউন্ডার লিয়াকত !
মীরা দেখতে পেল লিয়াকতের চেহারা মুহুর্তের ভেতরে বদলাতে শুরু করলো । খানিকটা কেঁপে উঠে সে যেন আরও একটু লম্বা হয়ে উঠলো । তারপর মুখের মানুষের আকৃতিটা বদলে খানিকটা কুকুরের মত হয়ে উঠলো । হাত আর পা দুটো একটু বাঁকা হয়ে উঠলো । একটু বাকা হয়ে চার পায়ে ভয় দিয়ে দাড়ালো লিয়াকত । তারপর হুংকার দিয়ে উঠলো । মীরা পুরোটা দৃশ্য নিজের চোখে দেখেও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছিলো না । নিজের স্থানে জমে দাড়িয়ে রইলো ।
লিয়াকত এবার ওদের লক্ষ্য করে ঝাপ দিল মীরা একেবারে শেষ মুহুর্তে নিজের বিহবল অবস্থাটা কাটিয়ে উঠলো । কিন্তু ততক্ষনে দেরি হয়ে গেছে । লিয়াকত ওদের একেবারে কাছে চলে এসেছে । মীরা নিজের পিস্তলটা বের করতে গিয়েও থেমে গেল । তাকিয়ে দেখলো লিয়াকত যেন শূন্য কিছুটা সময় থেমে গেল । মীরার মনে হল কেউ শূন্যকে ওকে আটকে দিল ।
সেই মানুষটা যে আর কেউ নয় ওর পাশে দাড়ানো রাফায়েল সেটা বুঝতে মীরার আরও কয়েক সেকেন্ড দেরি হল । মীরা দেখলো রাফায়েল নিজের হাত দুটো সামনে নিয়ে এসেছে । তারপর কোন জিনিস ছুড়ে দেওয়ার মত করে বা দিকে হাত দুরো নাড়ালো । সেই সাথে শূন্য ভেসে থাকা লিয়াকত বাম দিকে ছিটকে পড়লো । লিয়াকত পড়ার সাথে সাথে আবারও উঠে দাড়ালো । আবারও আক্রমন করবে এমন একটা ভাব ।
রাফায়েল আবারও এগিয়ে এল । তারপর দুই হাত সামনে দিকে এক সাথে ধরে । কিছু যেন ছুরে দেবে এমন একটা ভাব ! এরপর আবার নিজের মুখ দিকে সে অদ্ভুদ কয়েকটা শব্দ উচ্চারন করলো । মীরা দেখতে পেল রাফায়েলের হাতের ভেতরে থেকে একটা তীব্র আলো বের হল । এবং সেটা সোজা গিয়ে আঘাত করলো লিয়াকত নামের জন্তুটাকে । আঘাতটা এতোই মারাত্বক হল হল সে সরাসরি গিয়ে পেছনে দেওয়ালে গিয়ে আছড়ে পড়লো । আর উঠতে পারলো না । চোখের সামনেই লিয়াকত আবারও মানুষের রূপ ফিরে আসতে লাগলো !
মীরা তখনই রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে আছে । সামনের এই মানুষটাকে যতই জানছে ততই অবাক হচ্ছে । কিছু বলতে যাবে তার আগেই পেছন থেকে পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল । ফোর্স চলে এসেছে । এই ঘরটা পরীক্ষা করলেই অনেক কিছু পাওয়া যাবে আশা করা যায় । সেই সাথে লিয়াকতকেও ধরা গেল হাতেনাতে ।
পাঁচ
মীরার কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে এখানে । যে মানুষটা মেয়েদের ধরে নিয়ে খুন করছিলো, কোন এক অপদেবতার উদ্দেশ্য বলি দিচ্ছিলো সেই মানুষটাকে ও ধরে ফেলেছে । অবশ্য এখানে রাফায়েল নামের মানুষটা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে । সেটা শিকার করতে মীরার কোন আপত্তি নেই । কিন্তু ঐ রাতের ঘটনার পরে মানুষটা আবারও গায়েব হয়ে গেছে । সে যে কোথা আসে আর কোথায় চলে যায় মীরা ব্যাপারটা বুঝতে পারে না ।
আপাতত সেটা নিয়ে চিন্তা করতে চাচ্ছে না । পুরো মন্দিরটা সিল করে দেওয়া হয়েছে । ফরেনসিক টিম কাজ করেছে সারা দিন । খোজ পরীক্ষা করে দেখেছে সেখানে কম করেও হলেও ১১টা জননাঙ্গ পাওয়া গেছে । বলাই বাহুল্য সবই আলাদা আলাদা মেয়েদের । আরও কত গুলো পাওয়া যাবে কে জানে । কাজ চলছে । পুরো মন্দির টা যেন ছিল একটা আলাদা কসাই খানা । মানুষ যে এতো বিকৃত মস্তিস্কের হতে পারে সেটা মীরার ধারনার বাইরে ছিল ।
খুলনা থেকে ডেপুটি কমিশনার এসেছে । মীরাকে ব্যক্তিগত ভাবে অভিনন্দন জানিয়েছে । সেই সাথে এও জানিয়েছে এই মিশন সফল ভাবে পরিচালনা করার জন্য তার জন্য আলাদা ভাবে পুরস্কার অপেক্ষা করছে । সব কিছু সফল ভাবে শেষ হলেও মীরার কেন জানি মনে হচ্ছে এখনও কিছু একটা ঠিক হচ্ছে না ।
লিয়াকতের পক্ষে কি এতো কিছু করা সম্ভব ? কিন্তু ও নিজের চোখের সামনে লিয়াকতকে ঐ দানবে পরিবর্তিত হয়ে দেখেছে । এই ব্যাপারটা অবশ্য মীরা কাউকে বলতে পারে নি । এই কথা রিপোর্টে লেখাও যাবে না । লেখা সম্ভব না । কেবল লেখা হবে যে লিয়াকত একজন খুনি । সে এই মেয়ে গুলোকে মেরে ফেলে তাদের শরীরের অঙ্গ খেত । সে কিসের উপাসনা করতো, কেন করতো সেসব কিছু কাগজে কলমে লেখা যাবে না । এমন কি এই কেস সমাধান করতে গিয়ে মীরা সত্যি সত্যি কিসের সম্মুখীন হয়েছে সেটাও লিখতে পারবে না ও ।
চেয়ারম্যান সোলাইমান অনেক সময় মীরার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিলো । ডেপুটি কমিশনার চলে যেতে সোলাইমান হোসেন মীরার সামনে এসে হাজির হল !
-আপনে এতো বড় অফিসার ! আমি বুঝতে পারি নাই ।
মীরা হাসলো । গতকালকেও সোলাইমান হোসেন তাকে তুমি তুমি করে বলছিলো কিন্তু আজকে আপনি করে বলছে । মীরা ডাক্তার হলেও আসলে যে সে একজন পুলিশ এটা জানার পরে আর মীরাকে তুমি করে বলতে সাহস পাচ্ছে না । মীরা বলল
-চাচা আমি আগের মীরাই আছি । আপনি আমাকে তুমি করেই বলতে পারেন । আপনি করে বলতে হবে না ।
-না মানে .....
-কোন মানে টানে নেই । আমি এখানে ডাক্তারী করেছি সত্যিই সত্যিই । সেই সাথে আলাদা এই কাজ করে গেছি । আর কিছু না । আমি সেই আগের মীরাই আছি । তা আপনার মায়ের শরীর এখন কেমন ?
-আগের মতই আছে মা জননী । তা তুমি কি চলে যাইবা ?
-হ্যা তা তো যেতে হবেই । এখানে কাজ শেষ । তবে দেখি আপনাদের এলাকার প্রেমে পড়ে গেছি । আরও কটাদিন ছুটি কাটাই এখানে !
-শুনে খুশি হইলাম । এইবার কিন্তু আমার বাসায় দাওয়াত খাওয়া নিয়ে কোন আপত্তি করতে পারবা না । আমি কোন আপত্তি শুনবো না !
-আচ্ছা চাচা । চিন্তা নেই । যাওয়ার আগে আপনার বাসা থেকে ভরপেট খেয়েই যাবো !
মীরা এবার ক্লিনিকের দিকে হাটা দিল । নতুন ডাক্তার চলে আসবে কদিনের ভেতরেই । মীরা ঠিক করেছে নতুন জন আসার আগ পর্যন্ত এখানে আগের মতই ডিউটি করে যাবে । সে চলে গেলে ডাক্তার মিলনের পক্ষে একা সামলানো মুশকিল হয়ে যাবে ।
ক্লিনিকে পা দিতে মীরা লক্ষ্য করলো সবাই ওর দিকে অন্য চোখে তাকাচ্ছে । সে যে আসলে এখানে পুলিশি দায়িত্ব পালন করতে এসেছিলো এটা জানার পরে তাকে আর আগের চোখে দেখার কোন কারন নেই । রোগী গুলোকে দেখতে গিয়ে দেখলো ডাক্তার মিলন তাদের পরীক্ষা করছে । মীরা এগিয়ে গিয়ে বলল
-আরে আপনার শরীর খারাপ তো ! আপনি কি করছেন ?
ডাক্তার মিলন হাসলো । তারপর বলল
-নাহ ঠিক আছি । ঠিক হয়ে গেছে প্রায় !
-আরে আমি রয়েছি তো । আমি দেখছি !
-তাহলে আপনি এখানে এসেছিলেন খুনি ধরতে, ডাক্তারি করতে নয় !
মীরা হাসলো । তারপর বলল
-কিন্তু আমি তো ডাক্তারই নাকি । আমি কিন্তু মাঝে মাঝে প্রাকটিস করি । এখানে সেটাই করেছি । কেস নিয়ে কাজ করলেও আমি কিন্তু মনপ্রাণ দিয়ে এখানে কাজ করেছি ।
মিলন হাসলো । তারপর বলল
-তা ঠিক । যে রাধে সে চুলও বাঁধে । আপনি সবই করেছেন । তা যাবেন কবে ?
-দেখি এখনও ঠিক হয় নি । অন্তত নতুন ডাক্তার আসার আগ পর্যন্ত আছি এখানে !
-গুড ! দায়িত্ব যখন নিয়েছেন পুরোপুরি পালন করেই যান । আমিও দায়িত্ব নিলে পুরোপুসি সেটা পালন করি !
মিলনকে বেডে বসিয়ে দিয়ে তার পায়ের ক্ষত পরীক্ষা করতে গেল । বেশ খানিকটা অবাক হয়ে গেল । ক্ষত সত্যিই প্রায় একেবারে শুকিয়ে গেছে । এতো দ্রুত সেড়ে যাবে মীরা ভাবতে পারে নি । মিলনের দিকে তাকিয়ে দেখে সে ওর দিকে তাকিয়ে আছে এক ভাবে । মীরার কেন যেন এই চোখের দৃষ্টিটা ভাল লাগলো না । এর আগেও মীরা এই দৃষ্টিটা লক্ষ্য করেছে । চোখে কি একটা ললুপ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে থাকে । কেবল যে ওর দিকে তাকায় সেটা না, আশে পাশের যে নার্স গুলো আছে তাদের দিকেও তাকায় সে । একজন নার্স তাকে এই কথা বলেছে । তবে কোন সরাসরি কিছু করে নি কিংবা বলে নি বলে মীরা কিছু বলতে পারে নি ।
মিলন বলল, আজকে এক কাজ করা যায় ?
-কি কাজ ?
-আপনি এতো এতো বড় একটা কাজ করলেন দুএকদিন পরে হয়তো চলে যাবেন, আসুন আজকে আমার পক্ষে থেকে আপনাকে ট্রিট দেই ।
-ট্রিট ?
-হুম । আমি কিন্তু বেশ ভাল রান্না করি । আজকে আমার বাসায় আপনার দাওয়াত । রাতে খাবেন ! ঠিক আছে ?
-আরে আপনি অসুস্থ শরীর নিয়ে কেন কষ্ট করবেন ?
-কোন সমস্যা নেই । আপনিও দেখতে পাচ্ছেন যে আমার পায়ের ক্ষত একদম ভাল হয়ে গেছে । কোন সমস্যা হবে না । আমি বরং যাই এখনই ব্যবস্থা শুরু করে দেই । আপনি কাজ শেষ করে আসুন !
মীরা কিছু মানা করতে গিয়েও করলো না । মিলন আর ওর নিজের কোয়াটারটা কাছাকাছিই । রাতে এক ফাঁকে তার বাসা থেকে খেয়ে আসা কোন সমস্যা হবেনা ! একটু হেসে মীরা আবার নিজের কেবিনের দিকে পা বাড়ালো !
সোলাইমান হোসেন যেদিন প্রথম রাফায়েলকে ডেকে নিয়ে এল সেদিনই কেবল প্রথম রাফায়েলের চোখের দিকে একবার তাকিয়েছিলো । তারপর আর তাকাতে পারে নি । তার কাছে মনে হয়েছে সামনের এই মানুষটার মাঝে কোন না কোন অস্বাভাবিকত্ব আছে । চোখের দিকে তাকালে সেটা আরও পরিস্কার বুঝতে পেরেছিলো সে । তার কেবল বারবার মনে হয়েছিলো এই সামনের মানুষটার চোখের দিকে সরাসরি তাকানো যাবে না । তাকালে সে সব কিছু বুঝে যাবে ।
আজকে রাফায়েল বসে আছে সোলাইমান হোসেনের বৈঠক খানায় । মানুষটা চুপ করে বসে আছে । কি যেন ভাবছে । সোলাইন হোসেন বিকেল বেলাতে জেনেছে ক্লিনিকের ঐ ডাক্তার আপা আসলে ঠিক ডাক্তার না । সে একজন পুলিশ অফিসার । এতোদিন এই এলাকাতে ছিল আসল খুনীকে ধরার জন্য । লিয়াকতকে সে ধরেছে এই কাজের জন্য । তবে সোলাইমান হোসেন জানে এই কাজে তাকে সাহায্য করে এই মানুষটা । এই মানুষটা গ্রামে আসার পরে একটা খুনও হয় নি । কি দিয়ে সে কি করেছে সেটা সোলাইমান সেটা জানে না তবে যা কিছু করেছে এই সামনে বসা মানুষটাই করেছে ।
সোলাইমান হোসেন বললেন, বাবাজী কি নিয়া চিন্তিত আপনে ? লিয়াকত বদমাইশ তো ধরা পড়ছে !
রাফায়েল মুখ না তুলেই বলল, সেটা বুঝতে পারছি কিন্তু কেন জানি মনে হচ্ছে এখনও আসল মানুষটা চোখের আড়ালেই রয়ে গেছে । লিয়াকত সাথে ছিল কিন্তু আসল মানুষ না ।
-তাইলে আসল মানুষ কে ?
-জানি না কে ! তবে জানতে হবে ! আচ্ছা বছর বিশেষ আগে যে এই গ্রামে এমন খুন হয়েছিলো কয়েকটা তখনকার খবর কিছু বলতে পারেন ?
সোলাইমান হোসেন কিছু যেন ভাবলেন । তারপর বললেন, তেমন কিছুই কেউ বলতে পারে না । এমন কইরাই খুন হইছিলো কয়েকটা । আমার আপন ছোট ফুফুও তার ভেতরে ছিল । আমরা কিছুই করতে পারি নাই । তারপর সব কিছু বন্ধ হইয়া গেল একদিন হঠাৎ কইরা ।
রাফায়েল বলল
-সেই সময় লিয়াকত কোথায় ছিল ?
-গ্রামেই ছিল । ছোট ছিল । বয়স কত হইবো দশ বারো বছর ! সেই খুন যে সে করে নাই সেইটা নিশ্চিত !
-আর কোন ঘটনা যেটা স্বাভাবিক না ! মানে এমন কিছু যেটা খুনের সাথে শুরু হয়েছিলো অথবা খুনের সাথেই শেষ হয় গেল ! এমন কেউ যে এসেছিলো বা চলে গেছে সেই সময়ে !
সোলাইমান হোসেন মাথা নাড়ালো । এমন কিছু তার মনে পড়ছে না । তারপর হঠাৎ বললেন
-না এমন কেউ ছিল না তবে একটা ব্যাপার !
-কি ?
-আমাদের মিলন ডাক্তার ও তার পরিবার তখন এই গ্রামেই থাকতো । একদিন হঠাৎ করেই মিলন ডাক্তার বাবা আসগর মিয়ারে আমরা আর কেউ দেখতে পাই নাই । তার কয়েকদিন পরেই তারা এই গ্রাম ছেড়ে দিয়ে খুলনা শহরে চলে যায় ! বলা যায় সেই সময়েই পর থেইকার আর খুন হয় নাই । আমরা অবশ্য তখন কিছু ভাবি নাই !
রাফায়েল কি যেন ভাবলো । তারপর উঠে দাড়ালো । মুখে তার চিন্তার ঝড় চলছে । সে সোলাইমান হোসেনের দিকে তাকিয়ে বলল
-শুনেন আপনি কিছু গ্রামের লোকজন জোগার করেন । শক্ত সমর্থ মানুষ । আমি যদি ঘন্টা খানেকের ভেতরে না ফিরে আসি তাহলে লোকজন নিয়ে মন্দিরের দিকে যাবেন । সবাই এক সাথে যাবেন ।
তারপর পকেট থেকে একটা লেবুর মত ফল বের করে দিল সোলাইমান হোসেনের হাতে । তারপর বলল, এটা সাথে রাখবেন । তাহলে কোন অশরীরি আপনাদের ক্ষতি করতে পারবে না । আর সাথে করে লবন আর চায়ের গুড়া নিয়ে নিবেন ।
সোলাইমান হোসেন কিছু বুঝতে পারলেন না । তারপর বললেন, কি হইছে বলবেন ? আপনেরে এতো চিন্তিত কেন মনে হইতাছে ।
রাফায়েল বলল, আপনাদের ডাক্তার আপার বিপদ সামনে !
ছয়
মীরা চোখ মেলে তাকাতেই একটা কটু দুর্গন্ধ লাগলো নাকে । গন্ধটা চিনতে ওর একটু সময় লাগলো । তারপরই সে চিনতে পারলো । গতকাল রাতেই সে এই গন্ধটা তীব্র ভাবে পেয়েছে ! মানুষের মাংস পচা গন্ধ ।
সে কোথায় আছে ?
চারি দিকে কেমন কাঁপা কাঁপা আলো দেখা যাচ্ছে । মীরা একটু নড়াচড়া করতে গিয়েই টের পেল ওর হাত পেছন দিক দিয়ে শক্ত করে বাঁধা । পা দুটো ঠিক একই ভাবে বাঁধা ! মীরা চোখ তারপরই সেই মূর্তিরার দিকে গেল । ঠিক তার নিচেই ওকে শুইয়ে রাখা হয়েছে ।
হাউরাসের মূর্তি !
ও আবার সেই মন্দিরে চলে এসেছে ! মন্দিরের সব কিছু পরীক্ষা করে পুলিশের লোকজন সেটা সীল করে দিয়ে চলে গিয়েছে । এটা মীরার জানা । কিন্তু ও কিভাবে এখানে এল !
কথা মনে হতেই ওর আস্তে আস্তে সব মনে পড়তে লাগলো । কাজ শেষ করে ও রাতে হাজির হয়েছিলো ডাক্তার মিলনের বাসায় দাওয়াতের জন্য । খাওয়া দাওয়া হয়েছিল ভাল কিন্তু তারপরই ঝামেলা শুরু হয় । ওর মাথাটা কেমন করে যেন একটু চক্কর দিয়ে ওঠে । ডাক্তার মিলনই ওকে বসে যে সে বাসায় পৌছে দিবে । তারপর আর কিছু মনে নেই । চোখ খুলে সে এখন এখানে পড়ে আছে । কিছুই মেলাতে পারছে না । এমন তো হওয়ার কথা না ।
মীরা হঠাৎ কারো আসার আওয়াজ শুনতে পেল । চোখ মেলে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল । ডাক্তার মিলন দাড়িয়ে । তবে তার চেহারাটা কেমন যেন অপরিচিত মনে হচ্ছে । আগের থেকেও যেন আরও একটু বেশি লম্বা মনে হচ্ছে । চেহারার যেন মাংস একটু বেশি বেশি মনে হচ্ছে ! মীরার দিকে তাকিয়ে রইলো সেই বিদঘুতে চাহনী দিয়ে ! তারপর বলল
-কেমন লাগছে ?
-আমি এখানে কেন ?
-এখনও বুঝতে পারছো না ? এতো কিছু সমাধান করলে আর এটার পেছনে আসলে কে আছে সেটা জানতে পারলে না ?
-আপনি ? সব কিছুর পেছনে আপনি রয়েছেন ? তাহলে লিয়াকত !!
মিলন আবারও হাসলো । মীরা যেন খুব বাচ্চাদের মত প্রশ্ন করেছে এমন একটা মুখের ভাব করলো । তারপর বলল
-তোমাকে অবশ্য বলাই যায় । আজকেই আমার কাজ শেষ হয়ে যাবে এখানে । তোমাকে দিয়ে দেবতা হাউরেসকে ভেট এর সার্কেলটা শেষ হবে । আমার দায়িত্ব শেষ হবে ।
-দায়িত্ব !
মিলন বলল
-হ্যা দায়িত্ব ! আমার বাবা শুরু করেছিলেন । আজকে তোমাকে দিয়ে শেষ হবে ! তোমাকে বলেছিলাম কোন দায়িত্ব হাতে নিলে সেটা শেষ করতে হয় । আমি যদিও এই দায়িত্ব নেই নি তবুও আমার উপর এসে পড়েছে । আমাকে এটা শেষ করতেই হবে ।
মীরা তাকিয়ে আছে সামনের মানুষটার দিকে । গত দিন মাস ধরে এই শান্ত স্বভাবের মানুষটাকে সে চেনে । এই মানুষটা কারো ক্ষতি করতে পারে সেটা কোন দিন মীরার মাথাতেও আসে নি । সব কিছুর পেছনে এই মানুষটা রয়েছে সেটা ভাবতে মীরার কষ্ট হচ্ছে । মিলন ওর সামনে বসে পড়লো । ঠিক ওর সামনে একটা আগুনের কুন্ডলি সাজাচ্ছে । আর আপন মনেই যেন কথা বলছে ।
-এটা শুরু করেছিল আমার বাবা । আগে এই অঞ্চলটা খুবই প্রত্যন্ত ছিল । কে কারা এই মন্দিরটা আবিস্কার করে সেটা কেউ জানে না । আমি তখন ছোট ছিলাম । আমার সাথেই একদিন বনের ভেতরে ঘুরতে গিয়ে এই মন্দিরটা আবিস্কার করে ফেলে বাবা । তারপর প্রায়ই দিনই দেখতাম রাতে সে বাসার বাইরে চলে যেত । আমি কিংবা আমার মা এসবের কিছুই জানতাম না । সে দেবতা হাউরাসের সন্তুষ্টির জন্য এই গ্রাম আর গ্রামের আসে পাশে থেকে মেয়েদের ধরে নিয়ে আসতো তারপর তাদের বলি দিত ঠিক এই খানে ।
এই বলে মীরার শুয়ে থাকার স্থানটা দেখালো । মীরার মনে একটা তীব্র ভয় কাজ করতে শুরু করলো । ও এখন পুরোপুরি এই বিকৃত মানুষটার হাতে বন্দী । ওর কিছুই করার নেই । কেবল বাইরে থেকে সাহায্যের অপেক্ষা করা ছাড়া কিন্তু বাইরে থেকে কি কোন সাহায্য আসবে আদৌও । মীরা জানে না । কেউ হয়তো জানেই জানে ও এখানে আছে । সবাই ভেবে নেবে ও কাজ শেষ করে নিজের ঘরে ঘুমাচ্ছে শান্তিমত !
মিলন আবার বলল
-তারপর একদিন বাবা আর ফিরে এল না । আমরা কোন খোজ পেলাম না তার । দুই দিন পরে আমি নিজেই এই মন্দিরের ভেতরে গিয়ে হাজির হলাম । এদিক ওদিক খুজতে গিয়ে ভেতরে আসার পথটা আবিস্কার করলাম । সেখানেই প্রথমে বাবার লাশ টা দেখতে পাই । কোন যন্তু যেন তাকে খুবলে খুবলে খেয়েছে । মাকে ডেকে নিয়ে আসি । মায়ের বুঝতে বাকি ছিল না আমার বাবা আসলে এখানে কি করতো । কাউকে কিছু না বলে বাবাকে এখানে মাটি চাপা দিয়ে দেই আমি আর আমার মা মিলে । তারপর এই এলাকা ছেড়ে চলে যাই ।
মিলন একটু থামলো । উঠে চলে গেল কিছু একটা আনতে । ফিরে এল একটু পরেই । তারপর আবার আপন মনেই কথা শুরু করলো ।
-তারপর এই দায়িত্বটা আবার আমার উপর এসে পড়লো । এই হাউরাসকে সন্তুষ্ট করার দায়িত্ব । আমি অনেক পড়াশুনা করে জানতে পেরেছিলাম সেদিন কেন আবার বাবা মারা গিয়েছিলো । কোন ভেট যদি হাউরেজের সামনে এনে তাকে ঠিকঠাক মত উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হয় তাহলে দেবতার সমস্ত রাগ গিয়ে পড়ে উপাসকের উপর । বাবার বেলাতেও তাই হয়েছিলো । মনে আছে সেদিন তোমাকে ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছিলো হাউরাস । সেটার ফল পেয়েছিলাম আমি । আমাকে কামড় দিয়ে মাংশ নিয়ে গিয়েছিলো । হয়তো সেদিনই আমার জীবনের শেষ দিন হত কিন্তু আমার উপর কেন দয়া করলো আমি জানি না । দেবতার তোমাকে দরকার ছিল । সে আমাকে তাই আরেকটা সুযোগ দিল । বলল যেন তোমাকে যেকোন ভাবেই তার সামনে হাজির করি । সব কিছু ঠিকই চলছিলো কিন্তু মাঝ দিয়ে সব কিছু খুজে পেয়ে গেল । ভাগ্য ভাল যে আমাকে চিনতে পারো নি । লিয়াকতের উপর দিয়ে গিয়েছে সব !
মীরা বলল
-লিয়াকতকে কিভাবে পেলে এসবের ভেতরে ?
-সে একদিন দেখে ফেলেছিলো আমাকে রাতের বেলা । আমি তখন একটা মেয়েকে ধরে নিয়ে যাচ্ছিলাম । ওকে ধরলাম । বললাম ও কি কি পেতে পারে যদি আমাকে সাহায্য করে । ও রাজি হয়ে গেল । তখন আমরা দুজন মিলে এই কাজ শুরু করলাম ! যাক ও গেছে আমার চিন্তা নেই । আজই আমি মুক্তি পাবো । তারপর আমি যা চাইবো সবই পাবো !
এই বলে মিলন আগুনের কুন্ডলি জ্বালিয়ে দিল । তারপর অদ্ভুদ মন্ত্র পড়তে শুরু করলো । মীরা নিজে আবারও খানিকটা ছাড়ানোর চেষ্ট করলো কাজ হল না । ওর হাতের বাঁধনটা বেশ শক্ত হয়ে আছে । এভাবে ছাড়ানো সম্ভব না ।
মন্ত্র পড়ে চলেছেই মিলন । মীরা নিজেকে ছাড়ানোর কথা ভাবছে ঠিক সেই সময়ই অদ্ভুদ ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো । ওর সামনের যে মুর্তিটা রয়েছে সেটা যেন একটু নড়ে উঠলো । মিলনের মন্ত্র পড়ার আওয়াজ যেন আরও একটু বাড়তে শুরু করলো । মীরা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো সেদিকে । ওর চোখের সামনে যা হচ্ছে সেটা যেন ও ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না । সামনের মুর্তিরা ধীরে ধীরে জীবন্ত হতে শুরু করলো । তারপর একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠলো ।
চোখ গুলো জ্বলে উঠলো মুর্তিটা ।
দেবতা হাউরেস জেগে উঠেছে । মীরা পাশে তাকিয়ে দেখলো মিলন উপুর হয়ে দেবতাকে কুর্নিশ করছে । তারপর অদ্ভুদ ভাষায় কি যে বলছে । কথা শেষ হতেই সেই অদ্ভুদ জন্তুটা মীরার দিকে তাকালো । সেই চোখের উপর চোখ পড়তেই মীরার বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠলো । মীরার মনে জন্তুটা ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে । তারপর ধীরে এগিয়ে আসতে লাগলো কিন্তু মাঝে পথে থেমে গেল । কিছু একটা তীব্র আলোর মত যেন তার গায়ে এসে আঘাত করলো ।
জন্তুটা একটু পিছিয়ে গেল তবে সামলে নিল সাথে সাথে !
মীরা অন্য দিকে ঘুরে তাকালো । মনটা সাথে সাথে একটা আশার আলো দেখতে পেল ।
রাফায়েল !
মিলনও ফিরে তাকিয়ে রাফায়েলের দিকে ।
-তুই ! তুই অনেক ঝামেলা পাকিয়েছিস । আজকে তোকে আর ছাড়বো না ।
মীরা দেখতে পেল সেদিনের লিয়াকতের মতই মিলনের শরীরটা কেমন পরিবর্তিত হতে শুরু করলো । এদিকে ওর পেছনে দাড়ালো জন্তুটাও এক লাফে ওকে ডিঙ্গিয়ে সামনে মিলনের পাশে গিয়ে দাড়ালো । দুইজন মিলে রাফায়েলের মোকাবেলা করবে ।
মীরা কি করবে !
ওর হাতে কি কিছুই নেই !
মীরার মনে পড়লো হাউরেসকে সম্মুখ যুদ্ধে হারানো অসম্ভব একটা ব্যাপার । কেবল মেয়েরা ওকে হারাতে পারে যদি সাহস করে সামনে এগিয়ে যায় । মীরা দেখতে পেল দুজন এক সাথে রাফায়েলের উপর উপর হামলে করছে । মিলন সরাসরি ঝাপিয়ে পড়লো রাফায়লের উপর । সেটা কোন ভাবে দুই হাত দিয়ে প্রতিহত করতেই জন্তুতা সরাসরি গিয়ে আঘাত করলো রাফায়েলের উপর । সেটা ওর ঠিকঠাক মত ঠেকাতে পারলো । ছিটকে গিয়ে পড়লে পেছনে । তবে সাথে সাথেই উঠে দাড়ালো । মীরা পরিস্কার বুঝতে পারলো রাফায়েল এই দুজনের সাথে পেরে উঠবে না কিছুতেই ।
সেদিনও যখন এই জন্তুটা ওর উপর হামলা করতে এসেছিলো রাফায়েল সরাসরি এটার উপর হামলা করে নি । ওকে দিয়ে হামলা করিয়েছিলো । প্রথমে ভয় পেলেও সাহস ফিরে পেয়েছিলো । কিন্তু এখন কি করবে ও ! ওর হাত তো বাঁধা । কিভাবে সাহায্য করলো রাফায়েল কে ? ওকে শেষ করার পরেই ওরা ফিরে আসবে ওর নিজের দিকে ।
কি করবে ভাবছে তখনই চোখ গেল সামনের আগুনের দিকে । আর কিছু না ভেবে কোন মতে উঠে বসলো সে । তারপর হাতটা আগুনের ভেতরে ঢুকিয়ে দিল । তীব্র একটা যন্ত্রনা অনুভব করলো সে । কিন্তু সেটা সহ্য করে নিল । ওর কাছে মনে ও যেন অনন্ত কাল ধরেই আগুনের ভেতরে হাত দিয়ে বসে আছে । মাথার ভেতরে তীব্র যন্ত্রনা অনুভব করতে পারছে কিন্তু ও জানে জীবন বাঁচাতে হলে ওকে এই কষ্টটুকু সহ্য করতেই হবে । একটা সময় হাতের বাঁধনটা ছিড়ে এল । হাতের দিকে তাকিয়ে দেখে ওর হাতটা কালো হয়ে এসেছে । সেখান থেকে তীব্র যন্ত্রনা হচ্ছে । সেটার দিকে পাত্তা দিল না ।
সামনে তাকিয়ে দেখলো রাফায়েলকে ওরা দুজন মিলে প্রায় কাবু করে ফেলেছে । মাটিতে পড়ে গিয়েছে সে । মীরার তখন রাফায়েলের দেওয়া সেই কয়েনের কথা মনে পড়লো । সেটা আছে ওর পকেটেই । হাত দিতেই সেটার অস্তিত্ব অনুভব করলো । সেটা হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো । মীরা তারপর উঠে দাড়ালো ।
দুজন তখন রাফায়েলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে । মীরা হাতের ভেতরে শক্ত করে কয়েকটা চেপে ধরে । হাতের ভেতরে উষ্ণতার অনুভব করতে পারছে । মনের ভেতরে হঠাৎ করেই সাহস ফিরে এসেছে ওর ! মীরার মনে হচ্ছে ওর পারবে !
রাফায়েল বুঝতে পারছে দুজনের সাথে ও কোন ভাবেই পেরে উঠবে না । হাউরেসকে সম্মুখ যুদ্ধে কোন ভাবেই ওর পক্ষে হারানো সম্ভব না । লুসিফারের সরাসরি যোদ্ধা এই হাউরেস । লুসিফারের কাছাকাছি শক্তি রাখে । যদিও এই পৃথিবীতে ওদের শক্তি অতটা তীব্র নয় । তবে যদি সঠিক ভাবে ওদেরকে এখানে ডেকে আনা হয় তাহলে প্রচুর ক্ষমতা নিয়ে আসে ওরা । আর মিলন সম্ভবত রিচু্য়ালের শেষ পর্যায়ে চলে এসেছে । এই জন্য এতোটা শক্তির অধিকারী ।
হাউরেস ওর সামনে এসে দাড়ালো । তীব্র চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । প্রাচীন ভাষায় ওর দিকে তাকিয়ে বলল, তুমিই তাহলে সেই অবাধ্য সৃষ্টি ! তোমাকে কি কারনে এখানে পাঠানো হয়েছিলো আর তুমি করছো ?
রাফায়েল কিছু বলল না । মনের ভেতরে ঝড় চলছে । সামনে এখন কি করবে সে ! হাউরেস আবার বলল
-আজকে সব কিছুই সমাপ্তি হবে । সে খুশিই হবে !
সে বলতে হাউরেস কাকে বুঝাচ্ছে রাফায়েলের বুঝতে কষ্ট হল না । রাফায়েল বুঝতে পারছে এখানে থাকলে তার পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হবে না কিন্তু পালিয়ে যেতে তার ইচ্ছে করলো না । যদি মরন হয় তাহলে শেষ চেষ্টা করেই মরবে ।
সে উঠে দাড়াতে যাবে তখনই মীরাকে দেখতে পেল । মীরা নিজের হাতটা আগুনের ভেতরে দিয়ে দিয়েছে । সেটা খুলে ফেলল কিছু সময় পরেই । তারপরেই পকেট থেকে কিছু বের করে হাতের মুঠোর ভেতরে নিল । রাফায়লের মুখে হাসি দেখা গেল ।
এই হাসিটা দেখতে পেয়েছে হাউরেসও । সেও বুঝতে পেরেছে কিন্তু ততক্ষনে দেরি হয়েছে । মীরা চলে এসেছে খুব কাছে ।
মীরা তীব্র গতিতে দৌড়ে চলে গেল জন্তুটার কাছে । হাতটা শক্ত করে মুঠি করে আছে । সেটা দিয়ে নিজের সর্ব শক্তি দিয়ে জন্তুটার পিঠের মেরুদন্ড বরাবর ঘুসি চালালো । মীরা কেবল ভেবেছিলো হয়তো ঘুসিটা খেয়ে জন্তুটা ছিটকে পড়বে কিন্তু ফল হল আরও ভয়য়ভয় । মীরার হাত শুদ্ধ ঢুকে গেল জন্তুটার পিঠ দিয়ে । সেটার বের হয়ে এল জন্তুটার বুক দিয়ে । তোলোয়ার যেমন পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক দিয়ে বের হয়ে আসে ঠিক তেমনি ভাবে মীরার হাতটা জন্তুটার পিঠ দিয়ে ঢুকে বুক দিয়ে বের হয়ে এসেছে ।
মীরা নিজেই খানিকটা সময় অবাক হয়ে গেছে । এমনটা সে আশা করে নি । মিলন কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সেদিকে । সে নিজেও ভড়কে গেছে । তবে বুঝতে পেরে এখানে থাকা আর নিরাপদ নয় । যার ভরশাতে সে ছিল তারই যখন এই অবস্থা হল তখন তার কি অবস্থা হবে । সে দ্রুত সিড়ির দিকে পা চালালো । তবে তার ভাগ্যও খুব একটা প্রসন্ন হল না । দরজার মুখেই সোলাইমান হোসেন সহ বেশ কিছু মানুষকে দেখা গেল । মিলন তখনও সেই জন্তুর আকারই ধারন করেছে । তারা সবাই মিলে মুহুর্তের ভেতরে মিলনের উপর হামলা করলো । লাঠি বৈঠা রড দিয়ে যে যেভাবে পারলো মিলনকে পিটিয়েই মেরে ফেলল সেখানেই ।
রাফায়েল ততক্ষনে মীরার কাছে চলে এসেছে । মীরার হাত তখনই হাউরেসের বুকের ভেতরে ধরা । সেটা বের করে আনলো । মাটিড়ে দেহটা পড়ার আগেই কেমন ধুলোতে পরিনত হয়ে গেল সেটা । মীরা নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুটা সময় । ওর শরীরে এতোটা শক্তি থাকতে পারে সেটা ভাবতে পারে নি !
রাফায়েল বলল, আপনি ছাড়া আজকে আমার খবরই ছিল ।
মীরা বলল, একই কথা আমার ক্ষেত্রেও খাটে ।
সোালইমান হোসেন ওদের সামনে এসে দাড়ালো । মীরার দিকে তাকিয়ে বলল,
-আম্মা জি তুমি ঠিক আছো তো ?
-হ্যা চাচা । এখন ভাল । হাত টা একটু পুড়ে গেছে ।
-দাড়াও দাড়াও আমি দেখতাছি !
এই সোলাইমান হোসেন চিৎকার করে একজনের নাম ধরে ডাকলো ।
মীরা তখনও খানিকটা অবাক হয়ে আছে । রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার ভেতরে এতো শক্তি কিভাবে এল বুঝতে পারলাম না । আমি ভাবতেও পারি নি এমন কিছু হবে ।
রাফায়েল হাসলো । তারপর বলল, ইউমেন এমপাওয়ারমেন্ট ! নারী শক্তি জিন্দাবাদ !
মীরা হাসলো । রাফায়েল বলল, প্রতিটি সৃষ্টির কিছু না কিছু দুর্বলতা থাকবেই । এই জগতে এই ভাবেই সবাইকে তৈরি করা হয়েছে । যদি কারো কোন দুর্বলতা না থাকে তাহলে সে নিজেকে সৃষ্টিকর্তার সাথে তূলনা করে ফেলবে ।
পরিশিষ্টঃ
মীরা জনসারপুর গ্রাম ছেড়ে যখন চলে আসছিলো তখন অদ্ভুদ ভাবে ওর চোখে কোন পানির একটু সুক্ষ বিন্দু দেখা দিল । এই কদিনে এই এলাকাটা ওর কাছে কতটা প্রিয় হয়ে উঠেছিলো সেটা ওর বুঝতেও পারে নি । আর এই গ্রাম থেকেই ও জীবনের সব থেকে অদ্ভুদ অভিজ্ঞতাটা অর্জন করে যাচ্ছে ।
এই কথা গুলো কাউকে বললে হয়তো বিশ্বাস করবে না । সবাই ওকে পাগল ভাববে তবে ও জানে ওর কিসের সামনা সামনি হয়েছে ।
সবার কথা মনে থাকবে ওর । বিশেষ করে অদ্ভদ চরিত্রের ঐ মানুষটাকে সে তো কোন ভাবেই ভুলতে পারবে না । রাফায়েল আবারও কোন কিছু না বলেই গায়েব হয়ে গেছে । তবে যাওয়ার একটা চিরকুট দিয়ে গেছে । সেখানে লেখা ছিল, দরকার হলেই দেখা হবে আবার ।
মীরা জানে যদি জীবনে আবারও এরকম প্রয়োজন পড়ে, রাফায়েল নামের অদ্ভুদ মানুষটা ঠিক ঠিক হাজির হয়ে যাবে !
রাফায়েল সিরিজ ১৩
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১৯ দুপুর ১:৪৪