একটু আগে বৃষ্টি হয়েছে । প্রতিবার বৃষ্টির পরেই এখানকার পরিবেশটা যেন আরও একটু বেশি সজিব হয়ে যায় । শহরের খুব কাছে হলেও এখানে শহরের কোলাহল আর ইটকাঠের জঙ্গল নেই । আমি বেলকনিতে এসে দাড়ালাম । পুরো একালাটা অন্ধকারে ডুবে আছে । বৃষ্টি হলেই এখানে বিদ্যুৎ থাকে না । আজকে কখন আসবে কে জানে ! অবশ্য তাতে খুব একটা সমস্যা নেই । ঘরে আইপিএস আছে । সেটা দিয়ে রাত পার হয়ে যাবে !
বেলকনির মেঝেতে পানি এসে ভিজে গেছে । পায়ে কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা লাগলো । আমি গ্রিলটা ধরে দাড়ালাম কিছুটা সময় ! বাইরের অন্ধকা শান্ত পরিবেশটার দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগছে !
" কুত্তার বাচ্চা টাকা তুই কোথ থেকে দিবি জানিনা, তোর বাপের কাছ থেকে নে, ভাইরের কাছ থেকে নে কিন্তু আমার টাকা লাগবে "
বাইরের পরিবেশ বেশ শান্ত তাই সামনের বেলকনির মেয়েটা কি বলছে সেটা পরিস্কার শুনতে পেলাম । মেয়েটা সম্ভবত তার বয়ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছে ফোনে । মেয়েটা আবার বলল "আমি কিছু জানি না । তুই যদি না দিস তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন"
আমি অবাক হয়ে মন দিয়ে শুনতেছি, হঠাৎ মনে হলো অন্য কারো ব্যাক্তিগত কথা চুপিচুপি শোনা তো ছোটলোকি। তাছাড়া পাপও হয়। মরার পর কানে গরম কি একটা ঢেলে দেবে...
হেডফোনে গান শুনতে শুরু করলাম তারপর আবার মনে হলো গান শোনাও তো পাপ। তারচেয়ে বরং মেয়েটার কথাগুলোই শুনি । পরে এ নিয়ে ফেসবুকে স্টাটাস দেওয়া যাবে ।
আরও কিছুটা সময় কানতে পেতে রইলাম । কিন্তু কোন আওয়াজ শোনা গেল না । একবার মনে হল মেয়েটা সম্ভবত বুঝে ফেলেছে আমি তার কথা শুনতেছে তাই ঘরের ভেতরে চলে গেছে । কিন্তু পরক্ষনেই মেয়েটার গলার আওয়াজ শুনতে পেলাম আবার ! মেয়েটা আবার বলল
-আমি কি এমন তুমি বল ? তুমি কেন ঐ কথা বললা !
একটু আগে মেয়েটার কন্ঠে যে রাগ আর তেজ শুনতে পেয়েছিলাম এখন সেটার বদলে খানিকটা অভিমান শুনতে পেলাম । ওপাশের ছেলেটা সম্ভবত মেয়েটাকে মানিয়ে ফেলেছে কিংবা টাকা দিয়ে রাজি হয়ে গেছে !
-তুমি কোন দিন আমার সামনে ঐ সাদিয়ার কথা তুল বা না বললাম ! ও আর আমি কি এক ? বল এক !
-(নিরবতা)
-হ্যা হ্যা আমি জানি । কিন্তু তবুও ওর কথা শুনলে আমার মাথা ঠিক থাকে না । তুমি জানো এটা !
-(নিরবতা)
-তাহলে এমন কেন করো ? আমি কি কেবল আমার জন্যই এসব করি ! আমাদের সামনের ভবিষ্যতের জন্যই তো !
-(নিরবতা)
এর পরেই মেয়েটার হাসি শুনতে পেলাম । মেেয়টা খিলখিল করে হাসছে । একটু আগে মেয়েটার কথা শুনে মনে হয়েছিলো আজকে সত্যিই বুঝি এদের মাঝে একটা কিছু হয়ে যাবে আর এখন মেয়েটা কেমন খিলখিল করে হাসছে !
আচ্ছা ভালবাসার সম্পর্ক গুলো কি এই রকম হয় ?
আমি যখন কারো সাথে প্রেম করবে আমিও কি এরকম আচরন করবো ?
কি জানি করতেও পারি ! হয়তো দেখা যাবে যাকে ভালবাসছি তার এই কুত্তার বাচ্চার বলে গালি দিচ্ছি আবার পরক্ষনেই তাকে বাবুটাবু বলে একাকার করে ফেলছি ।
এসব ভাবছি যখন তখনই ফোনটা বেজে উঠলো । ফোনের স্ক্রিনে নামটা দেখে খানিকটা অবাক হয়ে গেলাম ।
এই ছেলে এখন ফোন দিয়েছে কেন ?
আমি ফোন রিসিভ করতেই ফোনের ওপাশ থেকে অর্ক বলল
-বৃষ্টি কেমন উপভোগ করছেন ?
আমি বললাম
-বৃষ্টি আর কই ! শেষ হয়ে গেছে !
-তাহলে বলতে হয় যে বেলকুনিতে বসে বৃষ্টি পরবর্তি প্রকৃতি কেমন উপভোগ করছেন ?
আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম । আমি এখন বেলকনিতে বসে দাড়িয়ে আছে এটা এই ছেলে কিভাবে জানলো ! কোন ভাবেই জানার কথা না । নাকি আন্দাজে ঢুল ছুড়েছে ? আমার মনের কথাই যেন বুঝতে পেরে অর্ক বলল
-ভাবছেন আমি কিভাবে জানি যে আপনি বেলকনিতে !
-হ্যা ! কিভাবে জানেন ?
-এতো সময় তো বুঝে ফেলার কথা !
-কিভাবে জানেন ?
-বেলকনির ডান দিকে তাকান ।
আমি তীব্র বিস্ময় ভাব নিয়ে ডান দিকে ফিরে তাকালাম ! তাকিয়ে দেখি আমার বাসার সামনের রাস্তার একটা ছায়া মূর্তি দাড়িয়ে ! অন্ধকারের ভেতরেও ছায়া মুর্তিটাকে চিনতে আমার কষ্ট হল না । এর আগে অর্কের সাথে আমার কয়েকবার দেখা হয়েছে । যদিও প্রতিবারই কেউ না কেউ আমাদের সাথে ছিল । অর্ক আসলে নাজনীনের ফ্রেন্ড । ওর মাধ্যমেই আমাদের প্রথম পরিচয় । মাঝে মাঝে ফেসবুকে নক কিংবা কমেন্টে হাসি ঠাট্টা চলে । তবে এভাবে এই রাতের বেলা কোন দিন দেখা হয় নি আমাদের । বলতে গেলে এই প্রথম অর্ক একা একা দেখা করতে এসেছে ।
আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম
-এতো রাতে !
-আসলে আপনি আইসক্রিম খেতে চাইলেন না !
-আইসক্রিম !
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম । যখন বৃষ্টি হচ্ছিলো তখন সত্যিই আমার আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছিলো । এটা নিয়ে ফেসবুকে একটা স্টাটাস দিয়েছিলাম । কিন্তু তাই বলে অর্ক এটা নিয়ে আমার বাসার সামনে চলে আসবে সেটা ভাবতেও পারি নি !
আমি বললাম
-আপনি আমার জন্য আইসক্রিম নিয়ে এসেছেন ?
-হ্যা ! আসলে আপনাকে হঠাৎ কেন যেন দেখতে মন চাইলো ।
আমি সত্যি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম অন্ধকারে দাড়িয়ে থাকা ছেলেটার দিকে । ছেলেটার কন্ঠস্বরের ভেতরে কি একটা ছিল । আমাকে দেখতে মন চাইছে ! কি আজিব একটা কথা ! কি চমৎকার একটা কথা !
আমি কেবল অনুভব করলাম যে আমার মনের ভেতরে একটা অদ্ভুদ অনুভূতি হচ্ছে ! এটার কোন ব্যাখ্যা নেই । অর্ক আবার বললাম
-আপনাকে নামতে হবে না । বাসায় দড়ি আছে ?
-দড়ি কেন ?
-বেলকনি দিয়ে নিচে ফেলতেন । আমি আইসক্রিমটা বেঁধে দিতাম !
আমি হঠাৎ বললাম
-আমি দাড়ান আমি নিচে আসছি !
-আরে না না এতো রাতে নিচে আসতে হবে না ।
-শুনুন বেশি কথা বলবেন না ।
আমি কেন এই কথাটা বললাম আমি নিজেই জানি না । দাড়ি ফেলে আইসক্রিমের বাটিটা নিলেই ঝামেলা শেষ হত কিন্তু আমার কেন জানি মনে হল এখন এই ছেলেটার সাথে যদি আমি দেখা না করি তাহলে আজকে রাতে আমি একটু ঘুমাতে পারবো না । কিন্তু সাথে সাথে আমার এটাও বুঝতে বাকি রইলো না যে এই ছেলেটা ইতোমধ্যে আমার ঘুম কেড়ে নেওয়ার একটা ব্যবস্থা করে ফেলেছে ।
একটু আগে আমি নিজে বেলকনির মেয়েটার ব্যাপারে কি ভাবছিলাম । আর এখন আমি কি করছি !
আমি দ্রুত সিড়ির দিকে পা বাড়ালাম ! বেশি সময় অপেক্ষা করলে আইসক্রিম গলে যেতে পারে !
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মার্চ, ২০১৯ দুপুর ২:২৫