ইরা কিছুটা সময় সল্টেজ বিস্কুটের দিকে শুকনো মুখে তাকিয়ে রইলো । আজকের পরিস্থিতি এমন হয়ে যাবে সে ভাবতে পারে নি । এই সল্টেজ বিস্কুট খেয়ে রাত পার করতে হবে, এটা ভাবতেই যেন আরেকটু ক্ষুধা বেড়ে গেল ওর । একটা ব্যাপার ইরা এর আগেও খেয়াল করে দেখেছে । যখন দেখা যাবে যে সামনে যে জিনিসটা নেই সেই জিনিসটার ক্ষধাই বেড়ে যায় । সেটা পওয়ার জন্যই মন আকুপাকু করে । আজ ওর সাথে সেই ব্যাপারটাই হচ্ছে ।
সকাল থেকে আজকে ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকাতে গ্যাস নেই । কোন রকম আগাম বার্তা না দিয়েই এই গ্যাস সরবারহ বন্ধ করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ । জানা গেছে গ্যাস পাইপ লাইনের কাজ চলতেছে । সেটা নিয়ে ইরার মাথা ব্যাথা নেই । ওর মাথা ব্যাথা হচ্ছে আজকে ওদের হোস্টেলে কোন রান্না হয় নি । সেই দুপুরে খেয়েছিলো ক্যাম্পাস থেকে । তারপর আর ভারী কিছু খাওয়া হয় নি ।
ইরা যে এলাকাতে থাকে সেই এলাকার গ্যাস বন্ধ সেই সকাল থেকে । তাই এলাকার খাবার দোকান গুলোতে চাপ পড়েছে অনেক বেশি । ইরা তবুও খুব একটা গা করে নি । ভেবেছিলো ধীরে সুস্থে গিয়ে খাবার কিনে আনলেই হবে । কিন্তু সন্ধ্যার সময় নিচে নেমে ওর চোখ কপালে উঠলো । প্রতিটা খাবার দোকানে প্রচুর ভীড় । সেই ভীড় ঠেলে সেখানে গিয়ে খাবার কেনা ওর পক্ষ কোন ভাবেই সম্ভব ছিল না । আর তাছাড়া কিছু সময়ের ভেতরে এলাকার প্রতিটা দোকানের সব খাবার দোকানের খাবার ফাঁকা হয়ে গেল । ইরা কিছু সময় এদিক ওদিক হাটাহাটি করলো অসহায়ের মত । শেষে ঠিক করলো স্টেশনারি দোকানে গিয়ে পাউরুটি কিনে নিয়ে যাবে । কিন্তু সেখানে গিয়েও তাকে হতাশই হতে হল । প্রতিটা স্টেশনারী দোকানেরও অবস্থা একই । বিস্কুট আর পাউরুটি অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে । শেষ কয়েকটা দোকান ঘুরে এই সল্টেজ বিস্কুট পেয়েছে । তাই সাথে করে কিনে নিয়ে এসেছে ।
একটু আগে রুমমেটকে একটা বড় সাইজের বার্গার খেতে দেখেছে । তার বয়ফ্রেন্ড তাকে দিয়ে গেছে । ইরার খানিকটা আফসোস হল । যদি ওর একটা বয়ফ্রেন্ড থাকতো তাহলে হয়তো আজকে ওর জন্য এমন কিছু করতো ।
ওর রুমমেট ওকে অবশ্য সেঁধেছিলো কিছুটা নেওয়ার জন্য, ইরা মানা করে দিয়েছে । আজকে সবারই ক্ষুধা লেগেছে । তাই তার রাজি হয়ে যাওয়া মোটেই ভাল দেখায় না । শুকনো মুখে বলেছে যে ওর ক্ষুধা নেই । ইরা একবার চেষ্টা করলো ফুড পান্ডা কিংবা পাঠাও ফুডে অর্ডার দেওয়ার । সেখানেও কাজ হল না । কোন অর্ডারই কনফার্ম হচ্ছে না । কেউ অর্ডার পিক করছে না । আজকে প্রচুর ভীড় এই জন্যই মনে হয় !
মনের দুঃখে ইরা ফেসবুকে স্টাটাস দিল একটা । খাবার নিয়ে স্টাটাস । বেশ কিছু লাইক পড়লো সেখানে। কয়েকজন কমেন্টও করলো । কেউ কেউ হা হা দিল । ইরা মোবাইলটা এক পাশে রেখে আবারও সল্টেজ বিস্কুটের দিকে মন দিল । আপাতত এটা খেয়ে বেশি করে পানি খেতে হবে । তাহলে আর ক্ষুধা লাগবে না আশা করা যায় । কাল সকালে ক্যাফে বাগদাদ থেকে ভরপেট নাস্তা করা যাবে ।
রাত দশটা বাজে তখন ইরার মনে সত্যিই আজকের রাতটা ওর জন্য বেশ দীর্ঘ হতে চলেছে । একটু আগে সে বিস্কুট খাওয়া বন্ধ করেছে । দুইপিচ মুখে দিয়ে আর খেতে ইচ্ছে করে নি । একবার মনে হল একটা বই পড়ার মন দেবে । মনযোগ দিয়ে বই পড়া শুরু করলে আর কিছু মনে হবে না । বইটা হাতে নিতে যাবে তখনই ওর মোবাইলে টুং করে আওয়াজ হল । কেউ ম্যাসেজ করেছে ।
একবার মনে হল এখন ম্যাসেজ টেসেজ না দেখে । কিছুই ভাল লাগছে না । কিন্তু কি মনে হয়ে দেখলো ।
মেসেজ করেছে ওর ক্লাসের একটা ছেলে । অপু নাম । ছেলেটাকে সে চেনে তবে কথা হয় নি খুব একটা ।
-হ্যালো !
-হাই !
-কি খবর ?
ইরার খানিকটা মেজাজ গরম হল । এখন ওর হাই হ্যালো করতে ইচ্ছে করছে না । মনে হল মেসেজটা আর সিন না করে রেহে দেয় । অপু আবার লিখলো
-বিরক্ত করছি হয়তো । একটা কথা বলতে নক দিলাম ।
ইরা একটু ভেবে বলল
-বল ।
-তুমি মোহাম্মাপুরের এনএন টাওয়ারের সারোমিতা হোস্টেলে থাকো না ?
ইরা আরও একটু বিরক্ত হল । একবার মনে হল কঠিন কিছু লেখে । লেখার জন্য প্রস্তুঈ হচ্ছিলো তখনই অপু আবার মেসেজ করলো
-আমিও এই এলাকাতে থাকি । আজকে আমাদের এখানে গ্যাস নেই । তাই রান্না হয় নি বলতে গেলে কারো ঘরেই । আমি টিউশনী থেকে ফেরৎ আসার সময় সায়েন্সল্যাব থেকে এক প্যাকেট বিরিয়ানী নিয়ে আসছিলাম । তখনই তোমার স্টাটাস দেখলাম ।
ইরা তাকিয়ে রইলো মেসেজটার দিকে । কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছে না । অপু বলল
-আমি তোমার হোস্টেলের নিচে । তুমি কি একটু নিচে আসবে ?
-না না ঠিক আছে !
-প্লিজ নিচে আসো ।
-আমাকে দিয়ে দিলে তুমি কি খাবে ?
-তুমি না খেয়ে আছো এটা জেনে আমার খাবার নামবে গলা দিয়ে !
ইরা একটা বড় রকমের ধাক্কা খেল লাইনটা দেখে । অপু এমন কথা কেন লিখলো ? তাহলে কি..... ?
ইরা আর কিছু ভাবলো না । ধীর পায়ে নিচে নেমে এল । গেটের কাছে আসতেই দেখলো রাস্তার ওপাশে অপু দাড়িয়ে আছে । ওকে দেখেই হাসলো । তারপর এগিয়ে এল ওর কাছে । ইরা তাকিয়ে আছে অপু দিকে । এর আগে কোন দিন ভাল করে অপুকে লক্ষ্য করে নি কিন্তু আজকে অপুর চোখের দিকে তাকিয়ে ইরার বুকের ভেতরে কেমন যেন করতে লাগলো !
তখনই মনে হল এই ছেলেটা ওকে অসম্ভব পছন্দ করে !
ইরার কথা জড়িয়ে গেল । কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । কোন মতে বলল
-আমাকে খাবার দিয়ে দিলে তুমি কি খাবে ?
অপু হেসে বলল
-আমি আরেকটা নিয়ে আসবো কিনে !
-এলাকার কোথাও খাবার নেই ।
-সমস্যা নেই । আমার বাসায় বিস্কুট আছে । আর আমি এমনিতেও কম খাই । দেখছো না কেমন চিকন আমি !
ইরা কিছু সময় কি বলবে ভেবে পেল না । তারপর ওর হাত থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট টা নিল । তারপর অপুর দিকে তাকিয়ে বলল
-ঐ স্টেশনারি দোকান থেকে একটা পানির বোতল কিনে আনো তো দেখি !
-আচ্ছা !
বলেই অপু বিরিয়ানির প্যাকেট টা ইরার হাতে দিয়ে দোকানের দিকে রওয়ানা দিল । ফিরে এল একটু পরেই । ইরা তখন ওদের হোস্টেলের সামনের ফুটপাতে বসেছে । এখানে মাঝে মাঝেই ওরা বসে বসে গল্প করে । বসার জন্য ছাউনির মত আছে ।
অপু ওকে ফুটপাতে বসতে দেখে খানিকটা অবাক হল । পানির বোতলটা পাশে রাখলো । তারপর পাশেই দাড়িয়ে রইলো কিছুটা সময় । ইরা বলল
-কই বসো !
অপু চুপ করে বসলো । ইরা বিরিয়ানীর প্যাকেট খুলে দেখলো অনেকটা বিরিয়ানি । ও এতোটা খেয়ে শেষ করতে পারবে না । অপুর দিকে তাকিয়ে বলল
-আমার হাতে খেতে সমস্যা নেই তো !
অপুর দিকে তাকিয়ে ইরার মনে হল ও খুব বেশি অবাক হয়েছে । এমনটা সে মোটেই আশা করেনি । ইরা প্রথম লোকমাটা অপুর মুখেই দিল । অপু কেবল ওর চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো এক ভাবে । ইরার বুঝতে কষ্ট হচ্ছে ছেলেটা মনে মনে প্রচন্ড খুশি হয়েছে । তারপর ইরা মুখে আরেকটা লোকমা নিতে নিতে বলল
-ঐ কথাটা কেন বললেন তুমি ?
-কোনটা ?
-আমি না খেলে গলা দিয়ে খাবার নামবে না !
অপু কিছু না বলে মাথা নিচু করলো । ইরা হঠাৎ বলল
-আমার জন্যই কি তুমি এই এলাকাতে বাসা নিয়েছো ?
অপু এবারও কিছু না বলে চুপ করে রইলো । ইরা আবারও অপুর মুখে খাবার তুলে দিল !
মানুষ যখন রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলো তখন দেখলো একটা মেয়ে একটা ছেলেকে পরম মমতায় খাইয়ে দিচ্ছে । ছেলেটা খানিকটা লজ্জা আর আনন্দমাখা মুখে সেই খাবার খাচ্ছে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১১:২২