বাসটা ছুটে চলছে রাজধানীর দিকে । জানলার দিকের একটা সিটে বসে রয়েছে জিনাত । মনটা সামনের রাস্তার দিকে নেই । ওর পাশেই ওর দুজন কলিগ বসে আছে । আপন মনে নিজেদের ঘর সংসারের গল্প করায় ব্যস্ত । জিনাতের মনে পড়ে আছে বহুদুরে জাহাজে । নিজেকে মাঝে মাঝে ও সারেং বউয়ের মত হয় । যার প্রিয়জন রয়েছে দুর সমুদ্রে ! পথে পানে সে তাকিয়ে আছে !
মানুষটা এখন কি করছে কে জানে ?
ওর কথা ভাবতে নিশ্চয়ই ?
জিনাত ব্যাপারটা বুঝতে পারে । মাঝে মাঝে জিনাতের মন খুব বেশি অস্থির হয়ে ওঠে । জিনাত জানে তখন রিয়াজ ওর কথা ভেবে মন খারাপ করে । আর আজকে তো মন খারাপ করবেই । আজকে এই বিশেষ দিনে দুজন পৃথিবীর দুই প্রান্তে । মন খারাপ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ।
সকাল থেকেই জিনাতের মন খারাপ । ঘুম ভেঙ্গে যখন হাত দিয়ে রিয়াজ খুজছিলো তখন থেকে ওর মন খারাপের শুরু । শূন্য বিছানার পাশে কিছু সময় বসে বসে ছিল চুপচাপ । একবার মনে হল আজকে কোথা না যায় । সারা দিন বাসায় শুয়ে থাকে । তারপর মনে হল এই কাজটা করলেই বরং মন খারাপের ভাবটা আরও জেকে বসবে । এর থেকে কাজের ভেতরে থাকলে মন খারাপের ভাবটা কমবে !
ঠিক মত নাস্তা করতে ইচ্ছে করে নি । জোর করে কিছু মুখে নিয়েছে । মন খারাপের ভাবটা নিয়েই বাসা থেকে বের হল । তারপর বাসা থেকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত আসতেই জিনাতের মন খারাপের ব্যাপারটা বেড়ে গেল অনেক বেশি । এই ঘটনা এখন প্রায়ই ঘটে । সকালে অফিস যাওয়ার সময় হলেই রিয়াজের কথা সব থেকে বেশি মনে পড়ে । রিয়াজ যখন বাসায় থাকে তখন প্রতিদিন তার কাজই হচ্ছে ওর সাথে ঘুম থেকে উঠা । সকালে এক সাথে নাস্তা খাওয়ার পর ওরা এক সাথেই রিক্সা করে বাস স্টান্ড পর্যন্ত আসতো । তারপর এখানে রমিজ মামার দোকান থেকে এক সাথে চা খেয়ে জিনাত ধরনো অফিসের পথ আর রিয়াজ তখন বন্ধুদের আড্ডায় । কি চমৎকার ভাবে প্রতিদিনের সকাল শুরু হত !
কিন্তু এখন ? রিয়াজ সমুদ্রে চলে যাওয়ার পরে জিনাত থেকে একা একাই ঘুম থেকে উঠতে হয় । নাস্তা খাওয়ার সময় মনে হয় রিয়াজ বুঝি এখনও ওর পাশে বসে আছে । একটা ছেলে মানুষী সে এখনও করে । একা জেনেও রিয়াজের জন্য আলাদা একটা প্লেট ডাইনিং টেবিলে রাখে । নিজের মনের কাছেই একটা খেলা করে যে এখনই বুঝি রিয়াজ এসে এখানে বসবে । তারপর নাস্তা খেতে শুরু করবে । প্রতিদিন ভাবে এই কাজটা সে আর করবে না কিন্তু পারে না ।
রিক্সা করে বাস স্ট্যান্ড পর্যন্ত আসতে আজকে সত্যি সত্যিই জিনাতের মন খুব খারাপ হয়ে গেল । কম করে হলেও আসার পথে গোটা বিশেষ কাপল দেখতে পেল । অন্যান্য দিনও তার চোখে কাপলরা পড়ে কিন্তু আজকে সেই পরিমানটা অনেক বেশি । ছেলে গুলো সব পাঞ্জাবী পরে আছে অন্য দিকে মেয়েরা পরেছে শাড়ী । আজকে সেও শাড়ি পড়েই অফিস যাচ্ছে । এতো লম্বা পথে শাড়ি পড়ে যাতাযাত করাটা একটু ঝামেলার । সেলোয়ার কামিজে বেশি স্বাছন্দবোধ করে কিন্তু আজকে কি মনে করে ও শাড়ি পরলো ।
রিয়াজ আজকে দেশে থাকলে ও নিশ্চয়ই শাড়ি পড়তে বলতো । নিজেও পাঞ্জাবী পরতো হয়তো । তারপর এই বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এক সাথে রিক্সা করে আসতো ওরা ! নিজের হাতের দিকে তাকালো ও । রিক্সা করে আসার পুরোটা সময় রিয়াজ ওর হাত ধরে থাকতো সব সময় । একটা মুহুর্তের জন্যও হাত ছাড়তো । কি অদ্ভুদ একটা আনন্দময় অনুভূতি যে কাজ করতো ওর ভেতরে ।
একবার রিয়াজের সাথে কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছে । দুজনের কথা বলা বন্ধ । রাতের বেলা দুজন ঘুমিয়েছেও দুদিক মুখ করে । কেউ কারো সাথে কথা বলবে না এমন একটা ভাব । সকাল বেলা জিনাত ঠিক করলো আজকে ও একা একাই অফিস যাবে । যত সময় না রিয়াজ ওকে সরি না বলবে তত সময় কোন কথা নাই । ঠিকই একই টেবিলে দুজন নাস্তা খেল । কিন্তু কোন কথা ছাড়া । বাইরে বের হওয়ার সময়ও রিয়াজ ঠিকই ওর সাথে বেরিয়ে এল বাসা থেকে । রিক্সাও ডাক দিলো । যখনই জিনাত রিক্সাতে উঠে বলসো অনুভব করলো রিয়াজ ঠিকই ওর হাত ধরেছে । রাতের রাগ কোথায় ধুয়ে মুছে চলে গেল ।
আর আজকে কতটা দিন রিয়াজের হাত ধরে না । জিনাতের মনটা আবারও সিক্ত হয়ে ওঠে । মোবাইল বের হোয়াটসএপ চালু করে । গতকালকের পাঠানো মেসেজটা এখনও ডেলিভারি হয় নি । সব স্থানে নেটওয়ার্ক থাকে না । যত সময় না কোন দেশের নেটওয়ার্কের ভেতরে আসবে তত সময় এই হ্যাপি ভ্যালেনটাইনের মেসেজ ওর কাছে পৌছাবে না । এমন হতে পারে হয়তো ভ্যালেনটাইন পার হয়ে যাবে তারপর এই মেসেজ ওর কাছে পৌছাবে ।
অফিসের বাসে উঠে মন খারাপ ভাবটা দুর করার চেষ্টা করলো । ওর জীবনটা এমন হবে এটা তো ও আগে থেকেই জানতো । ওদের দুজনের জীবনের গতিপথ অন্য রকম । কোন ভাবেই বছরের সারাটা সময় ওরা এক সাথে থাকতে পারবে না । বছরে ছয় সাত মাস রিয়াজ জাহাজের চাকরি নিয়ে সমুদ্রে কাটায় । আর তিনচার মাস থাকে বাসা । অবশ্য এই ছুটির সময়ও রিয়াজ পুরোটা সময় জিনাতকে কাছে পায় না । তাট চাকরির সময় প্রতিদিন নয়টা পাঁচটা । সপ্তাহে পাঁচদিন ।
তবুও জিনাত রিয়াজেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । যাকে ভালবাসে তার সাথে সংসার বাঁধাটাই সে সব থেকে জরুরী মনে করেছে । কি লাভ এমন মানুষের সাথে সারা বছর এক সাথে থেকে যাকে সে ভালবাসে না । অন্য কাউকে বিয়ে করলে হয়তো জীবন আরও সহজ হয়ে যেত, সব সময় তাকে কাছে পেত কিন্তু তাকে ভালবাসতে পারতো কি না সেটা জিনাত জানে না । রিয়াজকে ছাড়া আর কাউকে ভালবাসার কথা ভাবতেও পারে না সে ।
ওর অফিসের লোকজনের তো চিন্তার শেষ নেই ওদের এই সংসার নিয়ে । কিভাবে সামনের দিন যাবে ! একা একা থাকতে হবে বছরের বেশির ভাগ সময়টা কিভাবে জিনাত সামলাবে এসব ! জিনাত এই সব কথা বেশি চিন্তা করে না । ওর কেবল মনে হয় রিয়াজ ওর থেকে দুরে থাকলেও সব সময় ওর কাছেই আছে । যে কোন বিপদ কিংবা কঠিন সময় আসলে সে ঠিক ঠিক সব সামলে নিতে পারবে ! কোন সমস্যা হবে না ।
কিন্তু এই বিশেষ বিশেষ দিন গুলোর সময় জিনার মত মানতে চায় না । তখন বারবার মনে হয় রিয়াজ যেন সব সময় ওর কাছেই থাকুক আর কিছু চাওয়ার নেই ও ।
আরেকবার মোবাইলটা বের করলো । খেয়াল করে দেখলো মেসেজটা ডেলিভারি হয়েছে । নিশ্চয় নেটওয়ার্কের মধ্যে চলে এসেছে ।সাথে সাথেই মেসেজ লিখলো ও
-কই তুমি ?
উত্তর এল সাথে সাথেই
-আমি যেখানে থাকি !
জিনাত লিখলো
-তোমাকে মিস করছি খুব ।
-আমিও !
-চলে এসো !
-চলে আসবো ?
-হুম । আমার কাছে !
-সত্যি আসবো কিন্তু ! দেখবা যে জাহাজ থেকে ঝাপ দিয়ে সাঁতরেই চলে এসেছি তোমার কাছে ! তুমি তো জানো আমি কত চমৎকার সাঁতরাতে পারি ।
-জি আমার জানা আছে !
-আজকে শাড়ি পরেছো না ?
-হুম । কপালে টিপটা ?
-হ্যা দিয়েছি । দেখি একটা ছবি তুলে পাঠাও দেখি !
জিনাত তাই করলো । তারপর বলল
-তোমাকে দেখতে মন চাইছে । তুমি একটা ছবি তুলে দাও ।
মেসেজটা ডেলিভারি হল না । নিশ্চয়ই আবার চলে গেছে নেটওয়ার্কের বাইরে ! কিছু সময় তাকিয়ে রইলো সেদিকে । ওর মনটা আবারও খারাপ হয়ে এল । এখন রিয়াজকে আবার দেখতে ইচ্ছে করছে । সকালেই সেই মন খারাপের ভাবটা ফিরে আসছে আবারও ।
গন্তব্যে চলে এল আর কিচু সময় পরেই । আজকের মত কাজ শেষ । বাসাতে গেলে আবার সেই মন খারাপের ভাবটা জেগে বসবে । রিয়াজ যদি আবারও নেটওয়ার্কের ভেতরে আসে তাহলে হয়তো কথা হবে নয়তো না । বাস থেকে নামতে যাবে এমন সময় ওর মেসেজ টোনটা বেজে উঠলো । মেসেজ চেক করে দেখ রিয়াজ একটা ছবি পাঠিয়েছে । রাল রঙয়ের একটা পাঞ্জাবী পরে হাসি মুখে ছবি তুলে পাঠিয়েছে ।
বাস থেকে নামতেই ছবির দিকে আরেকবার তাকালো সে । সাথে সাথে বুকের ভেতড়ে ধক করে উঠলো । ছবিটা কোন জাহাজের ভেতড়ে তোলা না । ছবিটা তো ...... জিনাতের মনে হল ওর দম বন্ধ আসবে এখনই । ওর চোখ মুহুর্তের ভেতরে ঝাপসা হয়ে এল । রিয়াজ যে ছবিটা তুলে দিয়েছে সেটা এই বাসস্ট্যান্ডের তোলা । রমিজ মামার চায়ের দোকানের সামনে !
জিনাতের তত সময়ে চোখ দিয়ে পানি পরতে শুরু করেছে । ঝাপসা চোখেই সে রমিজ মামার দোকানের দিকে তাকালো । ঝাপসা দৃষ্টিতেও রিয়াজকে চিনতে অসুবিধা হল না ।
বদ টা এতো দুর থেকে এসে কিন্তু ওকে কিচু জানাই নি !
কাছে আসতেই রিয়াজ সেই হাসি নিয়ে বলল, তোমার জন্য সাঁতরে চলে এসেছি জানেমন !
কাঁদতে কাঁদতেই জিনাত বলল, আজকে বাসায় চল, তোমাকে মজা দেখাবো ! আমাকে কাঁদাতে মজা লাগে, তাই না ?
রিয়াজ হো হো করে হসে বলল
-আগে চল কিছু সময় রিক্সা করে ঘুরে বেড়াই । বাসায় তো যাবোই ! আজকে কতদিন তোমাকে ঠিকমত চুমু খাই না হিসাব আছে !!
-চুপ অসভ্য !
পরিশিষ্টঃ
রিক্সা চলছে আপন গতিতে । রিয়াজ সেই আগের মত জিনাতের হাত ধরে আছে । এদিকে জিনাত সেই কখন থেকে কেঁদেই চলেছে । শত চেষ্টা করেও সে নিজের কান্না আটকাতে পারছে না । রিয়াজ প্রথমে কিছু সময় চেষ্টা করেছিলো তারপর আর চেষ্টা করে নি ।
পথের মধ্যে যারা এদের দুজনকে দেখতে পাচ্ছে খানিটকা অবাক চোখে তাকিয়ে রয়েছে ।
এই মেয়েটা এভাবে কাঁদছে কেন !!
ওরা কেউ জানে না আজকে সারেং বউ কাঁদছে আনন্দে । এই আনন্দ প্রিয় মানুষ কে কাছের পাওয়ার আনন্দ !
ভালবাসার মানুষ গুলো সব সময় কাছাকাছি থাকুক । ব্লগার "জাহাজী পোলা"র জীবন হয়ে উঠুক ভালবাসাময় !
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৩:১৬