গত বছর যখন আলাউদ্দীন সাহেবের ছেলে গলু পরীক্ষায় পাশ করে দেখালো তখন সবারই অবাক হওয়ার কথা ছিল । কারন গলুর পড়াশুনার যে অবস্থা ছিল তাতে তার সব বিষয়ে পাশ করা তো দুরে থাকুক টেনেটুনে সব থেকে সহজ বিষয়েও পাশ করাটা একেবারে অসম্ভব একটা ব্যাপার ছিল । এমন কি পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন জোগার করেও তার পক্ষে পাশ করা সম্ভব ছিল না । কিন্তু আলাউদ্দীন সাহেব সেই কাজটাই করে দেখালেন । এবং এটা গ্রামের সবারই জানা ছিল । তাই তারা অবাক হয় নি ।
কিন্তু এইবার আলাউদ্দীন সাহেবের মনে ইচ্ছে জেগেছে যে তার ছেলেকে সে পরীক্ষাতে প্রথম স্থান অধিকার করাবে । সবার কাছে গর্ব করে বলবে যে তার ছেলে পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়েছে । এই কথা স্কুলের প্রধান শিক্ষক রফিক মিয়ার কাছে বলতেই সে হাত জোর করে বলল
-স্যার, গতবারের কথাটা তো আপনি জানেন ! এই কথা এমনিতেও বাইরে চলে গিয়েছে । এইবারও যদি এমন কিছু হয় তাহলে হয়তো আমার চাকরি চলে যাবে । বোর্ড থেকে এই স্কুলের এমপিও বাতিল হয়ে যেতে পারে । আর হচ্ছে পরীক্ষায় পাশ করানোটা খুব একটা কঠিন হবে না কিন্তু ফার্স্ট বানানো একটু কঠিন স্যার !
আলাউদ্দীন সাহেব বললেন, তুমি সেটা নিয়ে চিন্তা কর না । ওর ক্লাসের অন্যান্য ছেলে মেয়েরা যাতে ওকে সাহায্য করে সেটা আমি দেখবো । তুমি কেবল স্কুলের পরীক্ষা দেওয়া আর খাতা দেখার ব্যাপারটা দেখবা !
রফিক মিয়া কেবল দাঁত বের করে হাসলো । সে এটা সামলে নিতে পারবে । যদি কয়েকজন শিক্ষক আছে যারা গতবারও ঝামেলা করেছিলো তবে এবার তিনি আগে থেকেই সব প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন । বছরের শুরু থেকে তার অনুগত শিক্ষকদেরই কেবল গলুর ক্লাসে পাঠিয়েছেন । এবং পরীক্ষার গার্ডেও এমন ব্যবস্থা করবেন যাতে অন্যরা ঝামেলা না করতে পারে ।
যথারীতি পরীক্ষার দিন এল । গলু পরীক্ষা দিতে হলে উপস্থিত হয়ে গেল । সেখানে গিয়ে দেখে পুরো হলে সে কেবল একা । আর কেউ নেই। এদিকে গলুর ক্লাস মেটটা যেই পরীক্ষা দিতে আসছে, আলাউদ্দীন সাহেবের চামচারা তাদের গেট থেকেই বাসায় ফেরৎ পাঠাচ্ছে । আর তাদের বলতেছে, যাও তোমরা বাসায় । তোমাদের পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেছে ।
জলে বাস করে কুমিরের সাথে লড়াই করা চলে না । তারপরেও কারো কারো বাবারা এটার প্রতিবাদ করতে গেলে তাদের কপালে কি জুটছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখতেছে না ।
রেজাল্টের দিন দেখা গেল যে গলু পুরো ক্লাসের ভেতরে কেবল একজন যে সব বিষয়ে পাশ করেছে । আর সবাই এক দুই বিষয়ে ফেইল করেছে ।
আলাউদ্দীন সাহেবের আনন্দ আর ধরে না । তিনি সবার কাছে বুক ফুলিয়ে বলতে লাগলেন যে দেখো দেখো আমার ছেলে পাশ করেছে । কেবল পাশই করে নি সে হয়েছে ফার্স্ট । আমার মেধাবী ছেলে । গ্রামের ভেতরে সব থেকে মেধাবী ছেলে !
সাথেই সাথে কিছু মানুষ বলা শুরু করলো যে গলুর মত মেধাবী ছাত্র আমাদের গ্রামে এই প্রথম । এমন ছাত্র আর জন্মাই নি এই গ্রামে । এই গ্রামের জন্য গলু হচ্ছে একটা রত্ন । তাকে তো ক্যাম্ব্রিজে পড়াশুনা করা উচিৎ । কেউ কেউ আবার গলুকে সরাসরি অক্সফোর্ডে সরাসরি ভর্তির জন্য দাবী জানালো !
আলাউদ্দীন সাহেব ঠিক করলেন এইবার তিনি একটা আনন্দ অনুষ্ঠান করবেন । সারা গ্রামের সব মানুষকে সে দাওয়াত দিয়ে খাওয়াবে । সারা দিন আনন্দ মিছিল হবে । কিন্তু তবুও সবার মুখ তো আর বন্ধ করা গেল না । গ্রামে আলাউদ্দীন সাহেবের চামচাদের সংখ্যাও নেহত কম ছিল না। এদের ভেতরে আবার দুই গ্রুপ ছিল । প্রথম গ্রুপ এমন ছিল যে তারা মনে প্রাণে বিশ্বাস করতো যে গলু সত্যিই সত্যিই পরীক্ষা দিতেই পাশ করেছে । আছে একদল যারা প্রভু ভক্ত । প্রভু যা বলে তাই বিশ্বাস করে । আগে পিছে কিছুই ভাবে না । আরেকদল ছিল তুলনা মূলক ভাবে কম প্রভুভক্ত । এদের কিছুটা বোধ বুদ্ধি ছিল । কিন্তু প্রভুর প্রতিও তো এদের আনুগত্য প্রকাশ করতে হবে । তাই এরা বলতে লাগলো যে গলু এবার সত্যিই পরিশ্রম করেছে । যদি এসব কাজ আলাউদ্দীন সাহেব নাও করতো তাহলেও গলুই প্রথম হত ।
এদের মধ্যে আবার দুই বিশেষ চামচা ব্লগ লিখতো সামহোয়্যান ইন ব্লগে । তারা দুই জন সারা দিন গলু আর আলাউদ্দীন সাহেবের জয়গান গাইতেই লাগলো । তারা বলতে লাগলো একজন বাবা তার ছেলের জন্য কত ত্যাগই না স্বীকার করে । এমন বাবাই যুগে যুগে দরকার আবাদের । মাঝে মাঝে এরা যখন আয়নায় নিজেদের চেহারা দেখতো কেমন নিজের কাছেই মনে হত যে তাদের চেহারাটা এক বিশেষ প্রাণীর মত হয়ে গেছে ।
অতি সাধারন গল্প । এর ভেতরে কেউ আবার কোন কিছু খুজতে যাবেন না ।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ২:২২