ছবি গুগল
নিজের কাজের সময় আমি অন্য দিকে তাকানো মোটেই পছন্দ করি না । বিশেষ করে মেয়েদের দিকে তাকানোটা আমার স্বভাবের ভেতরে পড়ে না মোটেই । কিন্তু আজকে আমি কিছুতেই নিজেকে ধরে রাখতে পারছি না । বারবার কেবল মেয়েটার দিকে চোখ চলে যাচ্ছে । বেশ কয়েকবার নিজেকে ধমক দেওয়ার চেষ্টা করলাম কিন্তু কাজ হল না খুব একটা ।
নিজের কাজ থেকে মুখ সরিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম । কিন্তু মেয়েটাকে দেখতে পেলাম না কোথাও । একটু আগেই মেয়েটা ছিল ঐদিকে । ছেলে মেয়েদের ভিড়ের মাঝে বসে তাদেরকে ঔষধ দিচ্ছিলো । তাদের বলে দিচ্ছিলো কিভাবে সেগুলো খেতে হবে ! কোথায় গেল এখন ?
আমি পুরো ক্যাম্পের দিকে আবার চোখ বুলালাম । মেয়েটাকে দেখতে পেলাম না কোথায় ?
কোথায় গেল মেয়েটা ?
আমি নিজের আচরন দেখে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম । এমন কেন হচ্ছে ?
মেয়েটাকে আমি এর আগে কেবল একবার দেখেছি নিশিদের বাসায় !
আর মেয়েটাকে আমি দেখি নি । কেবল নাম আর মেয়েটা কোন প্রতিষ্ঠানে পড়ে সেটা ছাড়া আমি আর কিছুই জানি না । তাহলে মেয়েটার ব্যাপারে আমার এতো আগ্রহ কেন জন্মাচ্ছে ?
-আমাকে খুজছেন ?
আমি চমকে উঠলাম । আমার ঠিক ডান দিকে এসে দাড়িয়েছে কেউ । আমার বুঝতে মোটেও কষ্ট হল না কে দাড়িয়েছে । আমার বুকের ভেতরটা কেমন যেন একটু ঝিমঝিম করে উঠলো । নিজেকে শাসন করতে চেয়েও কেন যেন পারলাম না । মেয়েটা আবার বলল
-কি অপু সাহেব ? বললেন না ? আমাকে খুজছেন ?
-আসলে .....
মেয়েটা ততক্ষনে আমার মুখোমুখি এসে দাড়িয়েছে । উচ্চতায় মেয়েটা আমার নাক পর্যন্ত হবে । নিশিদের বাসায় ঐদিন দেখেছিলাম । আজকে অবশ্য মেয়েটাকে আরও একটু উচু মনে হচ্ছে । মেয়েটা আজকে ছেলেদের মত কেডস পরেছে । আর জিন্সের সাথে একটা কালো টিশার্ট । তার উপরে সাদা এপ্রোন ।
আমাদের অফিস থেকে মাঝে মাঝে জনকল্যার মূলক কাজ করা হয় । বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে আমরা মানুষদের কে ডাক্তারি সেবা, জন সচেতনতা মূল কাজ করে থাকি । প্রাইভেট কোম্পানী গুলো সমাজে নিজেদের নাম কে উচু করতে মাঝে মাঝেই এমন সেবা মূলক কাজ করে থাকে । এবারের ক্যাম্প পরিচালনা করার দায়িত্ব পড়েছে আমার উপর । আমরা ঢাকা মেডিক্যালে থেকে কিছু ইন্টার্ন ডাক্তারকে নিয়ে এসেছি এই ক্যাম্প পরিচালনা করতে । এই মেয়ে তাদের সাথে ।
আমি নওশাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম আরও কিছু সময় । কিছু বলতে গিয়েও যেন বলতে পারছি না । নওশাবা বলল
-থাক, আপনাকে মিথ্যা বলতে হবে না । আমি জানি আপনি আমাকে খুজছিলেন । কেন খুজছিলেন সেটাও আমি জানি ।
আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম
-জানেন ?
-হ্যা জানি । কিন্তু আপনি জানেন না, তাই না ?
আমি আরও একটু দ্বিধায় পরে গেলাম । আমি আসলেই জানি না আমি কেন নওশাবাকে খুজছিলাম । কেবল ওকে দেখতে মন বলছিলো । নওশাবা বলল
-একটা কথা কি জানেন ?
-কি কথা ?
-যদিও এই কথার কোন মেডিক্যাল ব্যাখ্যা নেই তবুও কথাটা সত্যি !
আমি চুপ করে রইলাম । নওশাবা বলল
-মানুষের হাসি হচ্ছে তার হৃদয়ের প্রতিফলন ! হাসি দেখেই তার হৃদয়টা অনুভব করা যায় !
আমি ঠিক বুঝলাম না মেয়েটা হঠাৎ আমাকে এই কথা কেন বলল । এমন কথা বলার পেছনের কোন কারনও খুজে পেলাম না ।
আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম তখনই দেখি মেয়েটার চেহারার ভাবটা বদলে গেল । একটু আগে যেখানে আনন্দ ছিল সেখানে একটা বিষাদের ছায়া দেখতে পেলাম । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আমি একটু আসছি ।
এই বলে মেয়েটা সামনের দিকে হাটা দিল । দেখতে পেলাম নওশাবা একটা ছেলের দিকে হেটে যাচ্ছে । একটু আগেই ছেলেটা গাড়িতে করে এসেছে । কেন জানি ছেলেটাকে দেখে আমার মোটেই পছন্দ হল না । নওশাবা ছেলেটার সামনে দাড়িয়ে কিছু কথা বলতে লাগলো । ছেলেটার ভাব ভঙ্গি দেখেই আমার বুঝতে কষ্ট হল না যে ছেলেটার সাথে নওশাবার খুব ভাল সম্পর্ক । নওশাবা যেহেতু ইন্টার্ন করছে সেই হিসাবে ছেলেটা নওশাবার স্বামী হওয়াটাও খুব একটা অস্বাভাবিক নয় । প্রেমি নয়তো ফিয়ন্সে তো হবেই ।
আমার বুকের ভেততে হঠাৎ করেই কষ্ট হতে লাগলো । সত্যিই কষ্ট হতে লাগলো নওশাবার জন্য ।
কি অদ্ভুদ ! এমন তো মোটেই হওয়ার কথা না !
মোটেই হওয়ার কথা না !
নিশি ছাড়া আমি কারো প্রতি এমন কিছু অনুভব করবো এটা আমি ভাবতেই পারি না । এমনটা তো কোন দিন হয় নি ।
নওশাবাকে আমি প্রথম দেখি নিশিদের বাসাতেই । নিশির রুমে এখনও আমি মাঝে মাঝেই যাই । নিলয় আমার ছোট বেলার বন্ধু । আগে আমাদের বাসা পাশা পাশিই ছিল । তারপর এলাকা বদলাতেও নিয়মিত যাওয়া আসাটা রয়েই গেছে । তাই মাঝে মাঝেই অফিস শেষ করে আমি ওদের বাসাতেই গিয়ে হাজির হই । নিলয় আসে অফিস থেকে ওর মাও থাকে সব সময় । আন্টি আমাকে খুব আদর করেন । তাই নিশির রুমে ঢুকতে আমার খুব একটা সমস্যা হয় না ।
ওর রুমটা এখনও আগের মত করেই সাজিয়ে রাখা হয়েছে । সব জিনিস পত্র ওর ব্যবহারের সব কিছু আগে যেমন ছিল তেমনই আছে সব । কোন কিছু বদলানো হয় নি । আমি রুমের ভেতরে যাই বসে থাকি । ওকে অনুভব করার চেষ্টা করি । ও যে টেবিলে বসে পড়তো সেখাে গিয়ে বসে থাকি । ওর পড়ার বই গুলো হাত দিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখি । অদ্ভুদ লাগে নিজের কাছে ! মনে হয় যেন মেয়েটা এখনও আমার পাশেই আছে । হয়তো এখনই দরজা খুলে ঢুকবে । তারপর আমার দিকে চোখ পাঁকিয়ে বলবে, কি ব্যাপার অপু ভাই তুমি আমার রুমে কি কর ? যাও বের হও ! বের হও !
আমি নিজের চোখ সরিয়ে নিলাম । নওসাবার দিকে তাকিয়ে থাকতে আমার কষ্ট হচ্ছে । মেয়েটা ঐ ছেলেটার সাথে কথা বলছে এটা আমার মোটেই সহ্য হচ্ছে না । নিশির বেলাতেও এমন হয়েছিলো । আমার থেকে কয়েক বছর জুনিয়ার ছিল ও । আমাড় উইনিভার্সিটিতেই পড়তো । একদিন ক্লাস শেষ করে নিশির ডিপার্টমেন্টের সামনে গিয়ে দেখি ও একটা ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে । ব্যাপারটা দেখে আমার খুব বেশি রাগ হয়েছিলো ।
এতোই রাগ করেছিলাম যে নিশির সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিলাম । এমন কি ওদের বাসাতে গেলেও দেখা করি নি ওর সাথে । ও ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই আমার সাথে নিজ থেকে দেখা করতে এল । ঐদিন নিলয় আসে নি ক্লাসে । আমি ক্লাস থেকে বের হতেই দেখলাম নিশি দাড়িয়ে আছে । আমি এড়িয়ে চলে যেতে চাইলেও পারলাম না । নিশি ঐদিনই আমার হাত ধরলো । তারপর এক প্রকার টানতে টানতে নিয়ে গেল ক্যাম্পাসের পুকুর পাড়ের দিকে । ওখানে ক্লাসের সময় খুব একটা মানুষ থাকে না ।
আমি সেখানে গিয়েও মুখ গোমড়া করে বসে থাকলাম । নিশি আমার সামনে দাড়িয়ে বলল
-আচ্ছা আমি কি কোন ভুল করেছি ? কোন অপরাধ ?
-কেন ? এই কথা কেন জিজ্ঞেস করছিস ?
-তাহলে আমার সাথে এমন কেন করছো ?
-কি করছি ?
-তুমি জানো না কি করছো ? দেখো অপু ভাই আমি কষ্ট পাচ্ছি । যদি আমি ভুল করে থাকি আমাকে বল প্লিজ । তোমার ইগ্নোর আমার সহ্য হচ্ছে না ।
আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । নিশির চেহারা দেখে আমার সব কিছু ওলট পালট হয়ে গেল । আমার সাথে কথা না বলতে পেরে ও যে কষ্টে আছে সেটা আমার বুঝতে মোটেই কষ্ট হচ্ছে না । কেন জানি এই অনুভূতিটা আমার কাছে খুব বেশি ভাল লাগলো । আমি বললাম
-ঐ ছেলেটা কে শুনি ?
নিশি যেন আকাশ থেকে পড়লো । তারপর বলল
-কোন ছেলেটা ?
-ঐদিন যে যার সাথে কথা বলছিলি ?
নিশি অনেকটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-একটা কাজ কর আমার বুকে কান পেতে শোন তো !
-মানে ?
আমি খানিকটা অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম । মেয়েটা হঠাৎ করে এমন কথা বলবে আমি বুঝতে পারি নি । নিশি বলল
-কথা কম বলে যা বলছি তাই কর !
তারপর নিজেই এগিয়ে এল । আমি প্রথমে কি করবো বুঝতে পারলাম না । নিশিকে সত্যি সত্যি বেশ গম্ভীর মনে হল । সে সত্যিই সত্যিই এগিয়ে এল একদম আমার কাছে । কাছে আসতেই ওর শরীরের একটা মিষ্টি গন্ধ পেলাম আমি । আমি খুব আস্তে করে ওর বুকে মাথা রাখলাম । প্রথমে কিছু না শুনতে পেলেও পরে ওর হৃদয়ের ধুকধুকানি শুনতে পেলাম । নিশি মৃদ্যু স্বরে বলল
-শুনতে পাচ্ছো ?
-হু
নিশির নিঃশ্বাস তখন আরও গাঢ় হয়ে উঠেছে । তখনই আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম যে ওর বুকের ভেতর থেকে যেন আমার নাম ভেসে আসছে । ব্যাপারটা হাস্যকর শোনালেও আমার মনে হল আমি সত্যিই শব্দ গুলো শুনতে পাচ্ছি !
অপু অপু অপু অপু .....
সত্যি সত্যিই শুনতে পেলাম শব্দটা ! কিন্তু এটা তো অসম্ভব একটা ব্যাপার !
কত সময় ধরে নিশির বুকে কান পেতে ছিলাম আমি জানি না । মনে হল যেন সব থেমে গেছে । একটা সময় নিশি নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বলল
-এর থেকে আর এমন করে আমাকে কষ্ট দিবা না, কেমন !
আমি কিছু বলতে পারলাম না । তারপর নিশি খুব আলতো করে আমার ঠোঁটে চুমু খেল ।
নওশাবা ফিরে এল একটু পরেই । আমি তাকিয়ে দেখি সেই ছেলেটা এখনও রয়েছে ক্যাম্পে । নওশাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-অপু সাহেব, আমাকে একটু আগে আগে চলে যেতে হচ্ছে । কিছু মনে করবেন না আশা করি ।
-না না ঠিক আছে । সমস্যা নেই । কাজ তো প্রায় শেষ !
কিন্তু আমার কেন জানি খুব রাগ হতে লাগলো । বারবার মনে হতে লাগলো তুমি কেন যাবে ওর সাথে । খুব বলতে ইচ্ছে হল ওকে বলি যেন যে তুমি কিছুতেই যেতে পারবে না । এখানেই থাকতে হবে ।
আমার মনের কথা যেন নওশাবা বুঝতে পারলো । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি রাগ করছেন ?
-আরে না না । রাগ কেন করবো ?
নওশাবা অদ্ভুদ ভাবে হাসলো । তারপর বলল
-রাগ করবেন না । মানুষ অনেক কিছু চাইলেও করতে পারে না ।
-মানে ?
-মানে কিছু না । রিয়াদের সাথে আমার সামনে মাসে বিয়ে । বাইশ তারিখ !
-ও !
আমি আর কিছু বলতে পারলাম না । পা দুটো যেন একটু বেশি অবস মনে হল । মনে হল যেন এই মেয়েটা আমার কাছ থেকে হারিয়ে গেছে । অথচ এই মেয়েটাকে আমি এই নিচে মাত্র দুইদিন দেখছি । সপ্তাহ খানেক আগে নওশাবাকে আমি প্রথম দেখি নিশির ঘরে । মাঝে মাঝে নিশিদের বাসায় আমি যাই নিশির ঘরে কিছুটা সময় একা একা কাটানোর জন্য । সেদিন অফিস থেকে ওদের বাসায় যেতেই লক্ষ্য করলাম ওদের বাসার সোফার ঘরে এক ভদ্রলোক বসে কথা বলছে । লোকটা কে আমি ঠিক চিনতে পারলাম না । নিশির মায়ের সাথে বসে কথা বলছে । আমি আন্টির দিকে একটু তাকিয়ে ঘরের দিকে হাটা দিলাম । নিলয়ের রুমটা ছাড়িয়ে নিশির রুমটা । আগে সেদিকেই যাবো বলে ঠিক করলাম ।
নিশির রুমে ঢুকেই অবাক হয়ে গেলাম । সেখানে একটা মেয়ে ঘুরে ঘুরে সব দেখছে । আমি নিঃশব্দে ঘরে ঢুকেছি বলে ও আমাকে ঠিক খেয়াল করে নি । একটু পরেই লক্ষ্য করলো আমাকে । সাথে সাথে চমকে উঠলো । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে রইলো এক ভাবে । মেয়েটার চোখে দৃষ্টি রয়েছে বিস্ময় আর বিস্ময় মিশ্রিত আনন্দ । আমাকে দেখে মেয়েটা যেমন বিস্মিত হয়েছে সেই সাথে আনন্দিত হয়েছে । ব্যাপারটা আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না ।
আমি বললাম
-ও সরি ! আমি বরং আসি !
-না না ঠিক আছে ! এটা নিশির ঘর !
-আপনি নিশিকে চিনেন কিভাবে ?
মেয়েটা এই প্রশ্নের জবাব দিল না । কেবল হাসলো । তারপর বলল
-আপনি কিভাবে ওকে চিনেন ?
আমি এই প্রশ্নের জবাব দিবো বুঝতে পারলাম না । তার থেকেও বড় কথা মেয়েটা আমাকে এই প্রশ্ন কেন করলো ঠিক বুঝতে পারলাম না । মেয়েটা তখন আবারও বলল
-আপনাকে দেখে ভাল লাগছে । আপনি মাঝে মাঝেই এই ঘরে আসেন । তাই না ?
-হ্যা ।
-কেন আসেন ?
আমি সত্যিই মেয়েটাকে চিনতে পারছি না । মেয়েটা কি নিশির বন্ধু ছিল নাকি আত্মীয় ! কিন্তু ওদেরকে এতো দিন ধরে চিনি । কোন দিন এদেরকে দেখতে পাই নি আমি । মেয়েটা আমার দিকে কেবল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলো বেশ কিছুটা সময় । মুখে এটা চমৎকার হাসি লেগে আছে । আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে যেন মেয়েটার ভাল লাগছে ।
ঐদিন আরও কিছুটা সময় মেয়েটা আমার সাথেই ঘরের ভেতরে ছিল । আমি ঘরের বিভিন্ন জাগয়া ঘুরতেছিলাম । মেয়েটা সেসব দেখছিলো হাসি মুখে ।
তারপর মেয়েটার সাথে আবার আজকে দেখা হল । লিস্ট থেকে মেয়েটার নাম জানতে পারলাম নওশাবা জারিন । মেডিক্যাল স্টুডেন্ট ! আর কিছুই জানি না মেয়েটা সম্পর্কে । অথচ আমার ওর প্রতি কি অদ্ভুদ অনুভূতি হচ্ছে ।
কি আশ্চর্য !
তারপরের দিন গুলো আমার কেন জানি আরও বেশি খারাপ কাটতে লাগলো । নওশাবাকে কিছুতেই মন থেকে বের করতে পারছিলাম না । নিউইয়র্ক থেকে যখন নিলয় আমাকে ফোন করে নিশির মারা যাওয়ার সংবাদটা জানিয়েছিলো তখন আমার পুরো পৃথিবীটা যেন থেকে গিয়েছিলো । আমার মনে আছে আমি মাস খানেক একেবারে ঘোরের ভেতরে ছিলাম । শরীর শুকিয়ে গিয়েছিলো না খেয়ে থাকার কারনে । আমি নিশির লাশ দেখতেো যাই নি । যেতে পারি নি । এমন কি ওর কবরের সামনেও যেতে পারি নি এখনও । সেই সাহস আমার হয়ে ওঠে নি ।
আমি ভেবেছিলাম হয়তো আর কোন দিন আমি কোন মেয়েকে ভাল বাসতে পারবো না । কিন্তু কি হচ্ছে আমার সাথে ? আর কেনই বা হচ্ছে ? আমি কিছু বুঝতে পারছি না ।
পরের মাসের বাইশ তারিখ নওশাবার বিয়ের হওয়ার কথা । আমি চাইলে মেয়েটার সাথে দেখা করে নিজের মনের অনুভূতির কথা বলতে পারতাম কিন্তু তাকে এসবের পেছনের কারন কি বলতাম ? কোন কিছুই বলার ছিল না আমার ! তাই নিজের কাছেই ঠিক করলাম যে কোন কথা বলবো না । বারবার নিজেকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম যে নওশাবা আমার কিছু হয় না । মেয়েটার যদি অন্য কারো সাথে বিয়েও হয়ে যায় তাহলে কিছু যায় আসে না আমার !
বাইশ তারিখে সন্ধ্যা বেলা হঠাৎ নিলয় আমাকে ফোন করে ওদের বাসায় আসতে বলল । আমি বললাম
-হঠাৎ ?
-আরে আয় তো । দরকার আছে !
আমি কিছু না বুঝে নিলয়দের বাসায় গিয়ে হাজির হলাম । তখনও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে । সেটা বুঝতে পারলাম নিশির ঘরে ঢুকে । সেখানে নওশাবা বসে আছে বউ সেজে ! আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম কিছুটা সময় । কিছুই যেন মাথায় ঢুকছে না । এই মেয়ে এখানে কেন ?
নাওশাবা আমাকে ওর পাশে বসতে ইশারা করলো । আমি চুপচাপ বসে পড়লাম । তারপর বলল
-তোমার কানটা আমার বুকে পাতো তো !
-কি ! কি বললে ?
-যা বলছি করতো !
তারপর সত্যিই নিজেকে খানিকটা আমার দিকে এগিয়ে আনলো । আমি দ্বিধা নিয়ে কান পাতলাম । প্রথমে কিছু শুনতে পেলাম না । তারপর শুনতে পেলাম ওর হৃদ স্পন্দন ! এবং আরও কিছুটা সময় পরেই ......।
আমার দম বন্ধ হয়ে এল যেন !
এটা তো সম্ভব না । কোন ভাবেই সম্ভব না !
আমি আবার শুনতে পেলাম নিজের নামটা ।
অপু অপু অপু ..... অপু অপু !!
নওশাবা বলল
-শুনতে পাচ্ছো ?
-হুম !
-নিশির বুকে শুনতে না এইটা ?
-হুম !
আমি তখনও কান পেতেই রয়েছি । আমার চোখ দিয়ে পানি পরা শুরু করেছে কখন আমি টেরও পাই নি । নওশাবা বলল
-নিশি যখন নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল হাসপাতালে মারা যায় ঠিক সেই সময়ে আমিও ওখানে ছিলাম । আমার হার্ট টা বারবার রিসপন্ড করা বন্ধ করে দিচ্ছিলো । যখন নিশির ব্যাপারে ডাক্তারেরা জানতে পারলো তখন তারাই রিকোয়েস্ট টা করে নিশির ভাইকে । কি মনে করে নিশির ভাই রাজিও হয়ে যায় !
আমি মাথা তুলে নওশাবার দিকে তাকিয়ে রইলাম । নওশাবা বলল
-আমি বেঁচে আছি নিশির হৃদয় নিয়ে । আর নিশির পুরোটা হৃদয়টা জুড়ে ছিলে তুমি !
আমি তাকিয়েই রইলাম নওশাবার দিকে । সেদিন নওশাবা বলেছিলো মানুষের হাসি হচ্ছে তার হৃদয়ের প্রতিফলন । এই জন্যই হয়তো নওশাবার হাসি আমার কাছে এতো পরিচিত মনে হচ্ছিলো, এতো আপন মনে হচ্ছিলো । আমি নওশাবাকে বললাম
-আমি কি আরেকবার কান পাততে পারি ?
নওশাবা হাসলো । তারপর বলল
-পারো ! এখন থেকে সারা জীবন আমার হৃদয় তোমারই !
আমি আবারো নিশির হৃদয়ে কান পাতলাম । সেখান থেকে এখনও আমার নামই ভেসে আসছে !
অপু অপু অপু অপু .....
পরিশিষ্টঃ
রাত দশটায় কাজী এসে হাজির হল নিলয়দের বাসায় । আমার বাবা মা কেও ডেকে পাঠানো হয়েছিলো । তারা প্রথমে কিছু সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো আমার দিকে । তারা ধরেই নিয়েছিলো আমি কোন দিন বিয়ে করবো না । বিয়ে যে করছি এটাতেই তারা খুশি । নওশাবা বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে এসেছে বিধায় আপাতত তার পরিবারকে জানানো হয় নি । সেটা পরে জানানো হবে । কেবল নওশাবার বাবার মোবাইলে একটা মেসেজ পাঠিয়ে জানানো হল যে সে বিয়ে করতে না । সে অন্য কাউকে বিয়ে করবে ! নিলয় মনে হচ্ছিলো সব থেকে বেশি খুশি । সে যেন নিজের বোনেরই বিয়ে দিচ্ছে ।
বিয়ের পর আমাদের বাসর রাত নিশির ঘরেই সাজানো হল । আমি কোন দিন ভাবতেও পারি নি নিশিরকে হারানোর পর আবারও এভাবে ওকে ফেরৎ পাবো !
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই জানুয়ারি, ২০১৯ বিকাল ৩:০৫