বেশ রাত। একটু আগেও রাতের যে কোলাহল ছিল সেটাও এখন থেমে গেছে । মাঝে মাঝে পাড়ার কুকুর গুলো ডেকে উঠছে কেবল । তাড়াছা আর কোন আওয়াজ আসছে না আপাতত ! ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো রাত দুইটা বেজে এগারো মিনিট । পাশের ঘরের সব মেয়ে গুলোও ঘুমিয়ে পড়েছে ।
এখনই সময় !
মিতু ফোনটার দিকে তাকালো আরেকবার । চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে । খুব ইচ্ছে করছিলো ওর বাবার সাথে শেষ বারের মত কথা বলতে । কিন্তু জানে যতবারই ও ফোন দিক না কেন ওর বাবা সেই ফোন ধরবে না । আজকে কতদিন মিতুর বাবা ওর সাথে কথা বলে না । আজকে ও সকল ধৈর্য্যের শেষ সীমানায় পৌছে গেছে । অনেক চেষ্টা করেছে নিজের মনকে শক্ত করতে কিন্তু পারে নি । আজকে তাই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে তার এই জীবন আর রাখবে না ।
একবার ভেবেছিলো অনেক বড় করে একটা চিঠি লিখবে । সেখানে সবার কথা লেখা থাকবে । সে তার বাবাকে কতখানি ভালবাসে, মাকে কিভাবে মিস করে কিংবা ফয়সালকে কিভাবে মনের ভেতরে বসিয়ে রেখেছে আর ওর ক্লাসের বন্ধুদের কত টুকু পছন্দ করে -সব কিছু কিন্তু পরে মনে হল এতো কথা লিখে কোন লাভ কি আছে ! ও তো মরেই যাবে তখন এইসব কথা মানুষকে জানিয়ে কি লাভ ! যারা জীবিত থাকতে ওর কথা বুঝতে পারে নি, মরে গিয়ে তাদের বুঝিয়ে কি লাভ !
সিলিং ফ্যানের সাথে নিজের ওড়নাটা ঝুলিয়ে রেখেছে অনেক সময় হল । আর দেরি না । এবার উঠতে হবে । মিতুর মনে হল এবার সময় হয়ে গেছে । এবারই ওর মরতে হবে ! এই পৃথিবীর সব কষ্ট থেকে নিজেকে সে মুক্ত করে ফেলবে । মিতু উঠে দাড়ালো । বিছানার উপর টুলটা উঠিয়ে নিল । তারপর সেটার উপর নিজে উঠে দাড়ালো ।
মিতু আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । তারপর ওড়নাটা হাত দিয়ে ধরলো । সেটা নিজের গলাতে পেঁচাতে যাবে ঠিক তখনই বিকট শব্দে ফোনটা বেজে উঠলো । মিতু খানিকটা চমকে উঠলো । এতোটাই চমকে উঠলো যে পুরো শরীরটা নড়ে উঠলো । আর বিছানার উপর টুলটাও নড়ে উঠলো সাথে সাথে । আর নিয়ন্ত্রন না রক্ষা করতে পেরে পড়ে গেল । তবে পড়লো বিছানার উপর ।
খানিকটা অবাক না হয়ে পারলো না । কারন ওর ফোন সব সময় সাইলেন্ট থাকে তাহলে এখন আওয়াজ হচ্ছে কিভাবে । ভাবতে ভাবতেই রিং হওয়া বন্ধ হয়ে গেল । মিতু ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলো অপরিচিত একটা নাম্বার । কি করবে বুঝতে পারলো না । খুব সাধারনত ওর কাছে অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসে না ।
নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আবারও কল চলে এল ঐ নাম্বার থেকে । তবে এবার অবাক করার মত ব্যাপার হল ফোনটা কেবল ভাইব্রেট করছে । রিং বাজছে না । তাহলে একটু আগে কিভাবে রিং হল ! মিতু কোন কিছু বুঝতে পারছিলো না । মনের ভেতরে খানিকটা ভয় ঢুকে গেল ।
কাঁপা কাঁপা হাতে সে ফোন টা রিসিভ করলো । হ্যালো বলার আগেই ওপাশ থেকে একটা ধমক শুনতে পেল ।
-কি করতে যাচ্ছিলে তুমি ? হ্যা কি করতে যাচ্ছিলে ?
মিতু কি বলবে বুঝতে পারলো না । ও কি করতে যাচ্ছিলো সেটা কারো বুঝতে পারার কথা না । দরজা জানালা সব বন্ধ করা । ঘরের ভেতরে কি হচ্ছে কারো জানার কথা না । মিতু বলল
-কে ? কে বলছেন ?
-আমি অপু !
মিতু প্রথমে চিনতে পারলো না । আবারও সেই কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল
-কোন অপু ?
-কয়টা অপুকে চিনো তুমি ?
এবার মিতু সত্যিই অবাক হয়ে গেল । ও কেবল একজন অপুকেই চিনে । ওর ক্লাসে পড়ে । কিন্তু সেই অপুর সাথে ওর কোন দিন কথা হয় নি । খুবই অন্য রকম ছেলে এই অপু । ক্লাসের কেউ ই ঐ ছেলের সাথে কথা বলে না । ছেলেটা একটু কেমন অদ্ভুদ ধরনের । মিতু কয়েকবার অপুকে লক্ষ্য করেছে কিন্তু কোনদিন কথা হয় নি । সেই ছেলে ওকে ফোন দিয়েছে ?
মিতু ব্যাপারটা কোন ভাবেই ঠিক বুঝতে পারছে না । মিতু নিজেকে খানিকটা শান্ত করে বলল
-তুমি কি আমাদের ক্লাসের অপু ?
-হ্যা । এখন আমাকে বল তুমি কি করতে যাচ্ছিলেন ?
-কই কি-কিছু নাতো !
কথাটা বলতে বলতেই ওর চোখ আবারও সিলিংয়ের দিকে চলে গেল । কিছুতেই সে বিশ্বাস করতে পারছে না যে অপু ওর এই ব্যাপারটা জেনে গেছে । কিন্তু অপু যেভাবে কথা বলছে সেটা দেখে মিতুর কেবল এই কথাই মনে হচ্ছে যে অপু ওর সব কিছু জানে । কিন্তু কিভাবে জানে ?
অপু বলল
-দেখো আমি জানি তুমি কি করতে যাচ্ছিলে । জানতে চেয়ো না যে আমি কিভাবে জানি । তবে আমি জানি এটা বলে রাখলাম ।
মিতু কোন কথা না বলে কেবল চুপ করে রইলো । কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না । অপু কিভাবে সব কিছু জানলো সেটাও সে বুঝতে পারছে না । অপু বলল
-কাজটা তুমি মোটেই ঠিক করছিলে না ।
মিতু দেখলো অপুর কন্ঠস্বর বেশ মোলায়েম হয়ে এসেছে । সে নিজের মধ্যেই কেমন সিক্ত অনুভব করলো । ফোনের ওপাশের ছেলেটা ওকে নিয়ে চিন্তিত । মিতু বলল
-আমি আর পারছি না অপু !
-তুমি পারবে । আমি জানি ।
-তুমি কিভাবে জানো ?
ফোনের ওপাশ থেকে কোন কথা শোনা গেল না কিছু সময় । তারপর অপু বলল
-এক কাজ কর একটু বাইরে আসো তো ।
-মানে ?
-মানে দরজা খুলে তোমার বাসার সামনে আসো !
-কি বলছো এসব ?
-আমি এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করছি । তোমার বাসার সামনে ফুটপাতে বসে আছি ।
মিতুর এবার সত্যিই কেমন যেন ভয় করতে লাগলো । এই ছেলেটা ওর বাসার সামনে এসে হাজির হয়েছে । ব্যাপারটা ওর মাথায় আসছে না ।
অপু আবার বলল
-আসো প্লিজ ! ভাল লাগবে । আসো !
মিতু আর কিছু ভাবলো না । অপুর কন্ঠটা শুনতে ভাল লাগছে হঠাৎ করেই । বারবার মনে হচ্ছে ওর সাথে অনেক দিন এমন করে কেউ কথা বলে নি । মিতু সিলিং থেকে ওড়নাটা খুলে নিল । তারপর সেটা গায়ে জড়িয়েই বের হল রুম থেকে ।
বাসায় অন্য ঘরের রুমমেটরা সব ঘুমিয়ে গেছে । তবুও খুব সাবধানে দরজা খুললো । চাবির গোছাটা হাতে নিয়ে বের হল দরজা দিয়ে । তারপর চাবি দিয়ে সেটা বন্ধ করে সিড়ি দিয়ে পা টিপে টিপে বেরিয়ে এল মেইন গেটের কাছে । এই গেটও চাবি দিয়ে আটকানো তবে সব ভাড়াটিয়ার কাছেই একটা করে চাবি দেওয়া থাকে ।
মিতু কোন দিন এতো রাতে বাসার বাইরে বের হয় নি । চারিদিকে নিশ্চুপ নিরবতা দেখে মিতুর একটু ভয়ভয় করতে লাগলো । সামনের দিকে চোখ যেতেই দেখতে পেল ল্যাম্পপোস্টের আলো থেকে একটু দুরে অপু বসে আছে । কথা না বললেও প্রায় প্রতিদিনই অপুর সাথে ক্লাসে দেখা হয় ওর । চিনতে খুব একটা কষ্ট হল না । আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল সেদিকে । মনের ভেতরে ভয়টা তবুও কাজ করছে । এতো রাতে এভাবে চলে আসাটা কি খুব ঠিক হল ?
তবে এখন আর এতো চিন্তা করে লাভ নেই । ছেলেটার মাঝে কিছু একটা অস্বাভাবিকত্ব আছে । এটা ক্লাসের সবাই জানে । কিন্তু আজকে মিতু সেটা নিজের চোখে দেখেছে ।
মিতু ঠিক অপুর পাশে গিয়ে বসলো । একটু একটু ঠান্ডা বাতাস দিচ্ছে । মিতুর হঠাৎই মনে হল একটু আগে ও কি করতে যাচ্ছিলো ? কেন করতে যাচ্ছিলো ? এতো চমৎকার একটা পৃথিবী থেকে ও চলে যেতে চাইছিলো । যদি অপু ওকে ফোন না করতো তাহলে হয়তো এতো সময়ে ও মারাই যেত ।
অনেকটা সময় কেউ কোন কথা বলল না । তারপর মিতু বলল
-আমি জানি না তুমি কিভাবে জানলে তবে থ্যাংকস ! তুমি না হলে হয়তো আমি এতো সময়ে মারা যেতাম !
অপু বলল
-আমি জানি ।
-কিভাবে জানলে বলবে ?
-নাহ ! থাকুক । সেটা তোমার না জানলেও চলবে । তবে তোমার কি জানা উচিৎ জানো ?
-কি ?
-জানা উচিৎ যে জীবনটা কখনই অন্যের উপর নির্ভর করে কাটিয়ে দেওয়া উচিৎ না ।
-কিন্তু ভালবাসার মানুষ গুলো যদি এমন করে চলে যায় তাহলে কিভাবে একা একা বেঁচে থাকা যায় ?
-তবুও বেঁচে থাকতে হয় । চমৎকার ভাবে বেঁচে থাকা যায় ! একটা কথা কি জানো ?
-কি ?
-ঝড়কে কখনই আটকানো যায় না, ঝড়কে শান্ত করাও যায় না । এই কাজটা চেষ্টা করাও বোকামী । কিন্তু ঝড়ের সময় যথাযত সুরক্ষা নিয়ে নিজেকে শান্ত করে রাখতে হয় । এই কাজটা করা সম্ভব । নিজেকে শান্ত রাখা । ঝড় এক সময় শেষ হবে ! আবার মেঘ কেটে গিয়ে সূর্য উঠবে ।
মিতু কথাটা শুনে বেশ কিছুটা সময় চুপ করে ইলো । সত্যিই কি ওর জীবনে আবার সূর্য উঠবে ? সেটা কবে ? কিন্তু ও জীবনে অনেক ভুল করেছে । সেই ভুল গুলোর জন্য ওর জীবন বদলে গেছে একদম । মিতু বলল
-আমি জীবনে অনেক ভুল করেছি ।
-স্বাভাবিক ! তুমি মানুষ । মানুষ ভুল করবেই ।
-কিন্তু তাহলে আমার বাবা আমার সাথে কথা কেন বলে না ? আমি মানছি ঐ ছেলেটার সাথে পালিয়ে যাওয়া আমার মোটেই উচিৎ হয় নি । আমি ভুল করেছিলাম । কিন্তু বাবা কি আমাকে ক্ষমা করে দিতে পারে না ?
-অবশ্যই পারে । এবং সে দিবেও । তুমি কি জানো তোমার বাবা লুকিয়ে লুকিয়ে তোমার ফেসবুক প্রোফাইল দেখে নিয়মিত । আজকে যে স্টাটাস টা তুমি দিয়েছো, সেটা পড়ে তিনি রাতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে ।
মিতু কি বলবে বুঝতে পারলো না । এক ভাবে অপুর দিকে তাকিয়ে রইলো । তারপর বলল
-তুমি কিভাবে জানলে ?
অপু কেবল হাসলো । তবে এই প্রশ্নের উত্তর দিলো না । তার বদলে বলল
-তবে তোমার ঐ প্রেমিক কিন্তু ভুল করে নি । সে তোমার সাথে অন্যায় করেছে । তোমার সাথে সে রিলেশনে গিয়েই ছিল তোমাকে শরীরটার জন্য । যখন সেটা সে পাচ্ছিলো না তখনই তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার শুরু করে । তুমি কি জানো তোমার সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থাতেই ও আরও দুইটা মেয়ের সাথে রাত কাটিয়েছে ।
-কি ? তুমি এসব কি বলছো ? আর কিভাবে জানো এসব ?
অপু আবারও সেই রহস্যময় হাসি দিল । তারপর বলল
-যাক সেসব কথা । দেখি তোমার হাত দুটো !
-মানে ?
-মানে তোমার হাত দুটো আমার দিকে বাড়িয়ে দাও ।
মিতু খানিকটা দ্বিধা হয়েই তাকিয়ে রইলো অপুর দিকে । তারপর নিজের হাত বাড়িয়ে দিল ওর দিকে । অপু আলতো করে ওর দুই হাত দিয়ে মিতুর দুই হাত ধরলো । মিতু প্রথমে কিছু বুঝতে পারলো না তবে একটা সময় অবাক হয়ে আবিস্কার করলো আপুর হাত টা ওর কাছে খানিকটা উষ্ণ ঠেকছে । আস্তে আস্তে মিতু যেন ঘোরের মধ্যে চলে গেল । ওর সামনে কত কিছু এসে হাজির হতে লাগলো । সেই শৈশব থেকে সব ঘটনা আস্তে আস্তে সব কিছু মনে পড়তে লাগলো । ওর কাছে কেবল মনে হল কেউ যেন ওর উপর কেউ মুভি বানিয়েছে এবং সেটা ওর সামনে ছেড়ে দিয়েছে । সে সেটাই দেখতে শুরু করলো ।
ক্লাস নাইনে থাকতে ও একটা ভুল করেছিলো । একটা ছেলের হাত ধরে পালিয়ে গিয়েছিলো । মিতুর ফ্লাশ ব্যাকে যখন সেই ঘটনাটা এল মিতু অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো সে সেদিন বাইরে বের হল না । মিতুর স্পষ্ট মনে আছে ঐদিন কিভাবে সে ঘর থেকে পালিয়েছিলো । তবে অপুর হাত ধরে যে ঘটনা সে দেখছে সেটাতে কিছুই হচ্ছে না । সেই ঘটনা ঘটনা না দেখে পরবর্তিতে অনেক কিছু ওর জীবনে নতুন করে ঘটতে শুরু করলো । ক্লাস নাইনের পর ওর জীবনের কোন অংশে বাবা ছিল না কিন্তু এই খানে অনেক দৃশ্যেই ওর বাবা ছিল । ওর বাবার সাথে মধুর ঘটনা গুলো চোখের সামনে আসতেই যেন ওর চোখ দিয়ে অঝরে পানি পড়তে লাগলো ।
তারপর এল ফয়সালের ব্যাপারে । মানসিক ভাবে মিতু অশান্তিতে ছিল বলেই ফায়সালের সাথে ওর সম্পর্কটা হয়েছিলো । ওর কেবল মনে হয়েছিল যে ফয়সাল হয়তো ওকে শক্ত করে ধরে রাখবে । কিন্তু এই ফ্ল্যাশ ব্যাকে সেটাও ঘটলো না । কেবল ঐ পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাটা না ঘটনার কারনে ওর জীবনে অনেক কিছু বদলে গেল এই ফ্রাস ব্যাকে ।
যখন মিতু অপুর হাত ছেড়ে দিল তখন প্রায় ভোর হয়ে গেছে । অপু বলল, তুমি বরং এখন বাসায় ফিরে যাও । কেমন ? ক্যাম্পাসে দেখা হবে !
মিতু চুপ করে উঠে দাড়ালো । তারপর আস্তে আস্তে হাটা দিল বাসার দিকে । কিন্তু একটু পরে আবার ঘুরে দাড়ালো । তারপর অপু জড়িয়ে ধরলো । অনেকটা সময় পরে অপুকে ছেড়ে দিয়ে বলল
-তুমি আজকে না থাকলে সত্যিই আমি আজকে কোথায় যেতাম কে জানে ? আর এই চমৎকার স্বপ্নটা দেখানোর জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ । অনেক !
অপু কোন কথা বলল না । কেবল হাসলো ।
মিতু আবার যখন নিজের রুমে ফিরে এসেছে তখনই ভোরের আযান দিল । নিজের মোবাইল হাতে নিতে অবাক হয়ে দেখলো সেখানে ওর বাবার নাম্বার থেকে মিসকল এসেছে । তাও একটা না চারটা !
মিতু কিছুই বুঝতে পারলো না কিছু সময় । ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না । তারপর মনে হল হয়তো ওর মায়ের মোবাইলে ব্যালেন্স নেই দেখে বাবার মোবাইল দিয়ে ফোন দিয়ে থাকতে পারে । মনের ভেতরে অপুর দেখানো সেই স্বপ্নটার কথা ঘুর পাক খেতে লাগলো । বারবার মনে হল ইস যদি স্বপ্নটা সত্যি হত !
মনের কথা মনেই রয়ে গেল । আবার ওর বাবার নাম্বার থেকে ফোন এসে হাজির । বুকের দমটা আটকে নিয়ে ফোনটা রিসিভ করলো ।
-হ্যালো ? ঘুমিয়েছিলি ? কতবার ফোন দিয়েছি ! তোকে না বলেছি সকালে উঠে নামাজ পড়তে !
মিতু নিজের কানকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না । ওর বাবার সাথে কম করেও ছয় বছর পরে কথা হচ্ছে কিন্তু ওর বাবার কন্ঠস্বর শুনে মনে হচ্ছে যেন ওর বাবা ওর সাথে নিয়মিত কথা বলেন । তাহলে কি ......
মিতু আর কিছু ভাবতে পারলো না ।
ওর দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগলো । মিতু কোন মতে বলল
-বাবা !
ফোনের ওপাশ থেকে সাথে সাথেই শোনা গেল
-বল মা । তোর কন্ঠস্বর এমন কেন রে শোনাচ্ছে ? সব কিছু ঠিক আছে তো ?
মিতু নিজের চোখের পানি আটকে রাখতে পারছিলো না । কোন মতে বলল
-বাবা তুমি কি আজকে একটু ঢাকাতে আসতে পারবা ?
-হ্যা পারবো ? আমি নামাজ পড়েই রওনা দিচ্ছি । তুই কোন চিন্তা করিস না । আর কোন কান্না কাটি করিস না । কেমন ! আমি আসছি এখনই রওনা দিচ্ছি !
মিতুদের বাসাটা ঢাকা থেকে খুব দুরে নয় । মুন্সিগঞ্জ জেলাতে । গাড়িতে করে ঢাকাতে আসতে খুব বেশি হলে ঘন্টা খানেক সময় লাগে ! আর মিতুদের নিজেদের গাড়ি আছে তাই খুব আরও দ্রুত পৌছে যাওয়ার কথা !
পরিশিষ্টঃ
মিতুর জীবনটা এখন সত্যিই অন্য রকম । ঐদিন সত্যিই ওর বাবা সকাল সাতটার ভেতরেই ওর বাসার সামনে গিয়ে হাজির হয়েছিলো । ওর বাবার আচরন দেখে মিতুর কেবল মনে হয়েছে ওদের সম্পর্ক একেবারে স্বাভাবিক । তবুও মিতুর বারবার মনে হচ্ছিলো সব যেন স্বপ্ন । এখনই ওর ঘুম ভেঙ্গে যাবে । দেখবো সব আগের মত হয়ে গেছে ।
ঐ রাতের বেলা অপু যখন ওর হাত ধরে ওর জীবনের ফ্লাশ ব্যাক দেখাচ্ছিলো তখন কোন ভাবেই অপু সব কিছু বদলে দিয়েছে । ওর অতীতটা বদলে দিয়েছে । কিভাবে করেছে সেটা মিতু জানে না তবে এটাই হয়েছে । ওর জীবনটা সত্যি একবারে বদলে গেছে । এখন ওর কাছে এই জীবনটাই ওর সত্যিই মনে হচ্ছে আর যেটা আগে ছিল সেটাকে কেবলই একটা দুঃস্বপ্ন মনে হয় ! অপু ঠিকই বলেছিলো একদিন নতুন সূর্য উঠবে । তবে সেটা যে এমন ভাবে আসবে সেটা বুঝতে পারে নি ।
কিন্তু এত কিছু পরেও মিতুর জীবনে একটা অপূর্ণতা রয়েই গেছে । ঐদিনের পর সে আর অপুকে দেখে নি । ঐদিনের পর অপু আর ক্লাসে আসে নি । ফোন দিয়েছে সেই নাম্বারে কিন্তু সেই নাম্বারটা ইনভ্যালিড দেখাচ্ছে ! অনেক খোজ খবর করেও সে আর অপুর কোন খোজ পায় নি । যার জন্য ওর জীবনটা এভাবে আবার ট্রাকে ফিরে এল সেই মানুষটাকে একটা ধন্যবাদ দিতে পারছে না জেনে মাঝে মাঝে ওর খারাপ লাগে । তবে ওর বিশ্বাস একদিন আবারও অপুর সাথে ওর দেখা হয়েই যাবে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই ডিসেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৪৮