ছবি গুগল
এপোয়েন্ট লেটারটা হাতে নিয়ে খানিকটা সময় বিষণ্ণ মুখে তাকিয়ে রইলো সেটার দিকে । যেন চাকরিটা পেয়ে নাদিয়া মোটেই খুশি হয় নি । নিজের মনের কাছে বারবার মনে হচ্ছে কি হত আর মাত্র কয়েকটা দিন এই খবরটা এলে । আবীরদেরকে গত সপ্তাহেই মানা করে দিয়েছে ওর বাবা । বলে দিয়েছে আপাতত নাদিয়ার বিয়ে করার কোন ইচ্ছে নেই । ওর এমবিএ করার ইচ্ছে । অথচ নাদিয়ার ইচ্ছেই ছিল আবীরকে সাথে নিয়েই সামনের দিন গুলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া !
সব কিছু শুরু হয়েছিলো খুব চমৎকার ভাবেই । নাদিয়ার বড় মামা আবীরের খবর এনেছিলো প্রথমে । ছেলে প্রাইভেট ব্যাংকে চাকরি করে । পরিবারও ভাল । সব কিছুতেই নাদিয়ার সাথে মানাবে ভাল । নাদিয়ার বাবাও খুব খুশি । পারিবারিক ভাবে সব কথা বার্তা এগিয়ে গেল । নাদিয়ারও আবীরকে খুব পছন্দ হল । কথা বার্তা চাল চলনে বেশ । বেশ কয়েকদিন তাদের ভেতরে যোগাযোগ হল । ফেসবুকে এড ছাড়াও কয়েক দিন দেখা সাক্ষাত হল আবীরের সাথে । নাদিয়ার কেবল মনে হতে লাগলো যে জীবনটা চমৎকার কাটবে আবীরের সাথে ।
কথা বার্তা যখন একেবারে পাকা হয়ে যাবে তখনই দুঃসংবাদটা এল । কোথা থেকে ওর বড় মামাই খবর আনলো যে আবীরের চাকরি চলে গেছে কোন কারনে । নাদিয়ার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল । ওর বাবা তখনই বলে দিলে যে ছেলের চাকরি নেই সেই ছেলের সাথে তিনি মেয়েকে বিয়ে দেবেন না । অথচ এই কদিন আগেও ওর বাবাই বলতো আবীরের মত নাকি ছেলেই হয় না ।
তারপরেও নাদিয়া আবীরের সাথে ঠিকই যোগাযোগ করতো । কথা বলতো রাতে । সেখান থেকেই ও জানতে পারলো যে আবীর ম্যানেজারের সাথে রাগারাগি করেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছে । নাদিয়া মন খারাপ করে বলল যে এমন ভাবে রাগ করলে কি চলে । জীবনে অনেক কিছু কম্প্রমাইজ করে নিতে হয় ।
আবীর তখন বলল
-কিছু কিছু বিষয় আমি কোন ভাবেই কম্প্রমাইজ করতে পারি না যে । তা এখন কি আমাদের আর বিয়ে হবে না ?
নাদিয়া অনেকটা সময় কোন জবাব দিতে পারে নি । তারপর বলল
-আমার হাতে কিছু নেই । বাবা যা বলবে আমাকে তাই করতে হবে !
ফোনের ওপাশ থেকে আবীরের দীর্ঘশ্বাসটা নাদিয়ার বুকে এসে লাগলো খুব । বারবার ইচ্ছে হল বাবাকে বলতে যে আবীরকেই সে বিয়ে করবে । কি হয়েছে এখন ওর চাকরি নেই তো । যদি বিয়ের পর চাকরিটা চলে যেত তখন কি করতো ওরা । তখন কি ডিভোর্স দিয়ে দিত ? মোটেই না । তাহলে এখন কেন আর বিয়ে হবে না ?
এই কথা বাবাকে বলতেই নাদিয়ার বাবা একেবারে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠলো । পারলে তো নাদিয়া ধরে চিবিয়ে খেয়ে ফেলে । অনেকটা সময় ধরে বকাবকি করলো ওকে । এমন কি শক্ত ভাবে শাসন করে বলল যে আবীরের সাথে যেন কোন ভাবেই যোগাযোগ না করে আর । সে এটা মোটেই পছন্দ করবে না ।
নাদিয়ার সারা জীবন বাবার বাধ্য মেয়ে হিসাবেই কাটিয়ে এসেছে কিন্তু এতো দিন পরে এসে ওর কেন জানি বাবার অবাধ্য হতে মন চাচ্ছে । কিন্তু সেই সাহস সে জোগার করতে পারে নি ।
তারপর তাই হতে শুরু করলো । নাদিয়ার বাবা আবারও নতুন করে ছেলে দেখতে শুরু করলো কিন্তু নাদিয়ার মন পড়ে রইলো আবীরের দিকেই । কিছুতেই আবীরকে মন থেকে বের করতে পারলো না সে । বারবার মনে হতে লাগলো যে এমন কিছু একটা হোক যাতে সে আবীরকে বিয়ে করতে পারে ।
গত সপ্তাহে যখন ওর বাবা সরাসরি ওদেরকে মানা করে দিলো তখন ওর মনের সব আশা দপ করে নিভে গেল । আজকে চাকরির লেটারটা হাতে পেয়েও তাই মোটেই খুশি হতে পারলো না । মন মরা হয়ে বসে রইলো বেশ কিছুটা সময় । ঠিক সেই সময়েই আবীরের ফোন এসে হাজির । হ্যালো বলতেই আবীর ওপাশ থেকে বলল
-কি ব্যাপার মন খারাপ নাকি ?
নাদিয়া কি বলবে খুজে পেল না । ওর খুব বেশি কান্না আসতে লাগলো । ওপাশ থেকে আবীর বলল
-কি হয়েছে ? আমাকে বল ?
নাদিয়ার এবার সত্যিই সত্যিই কান্না আসতে লাগলো । ছেলেটা কন্ঠই বলে দিচ্ছে নাদিয়ার জন্য তার মনের বেকুলতা । হঠাৎ নাদিয়ার ভেতরে কি হল সে আবীরকে বলল
-তুমি কোথায় এখন ?
-কেন ?
-কোথায় আছো ?
-বাসাতেই । কি হয়েছে ?
-এখনই বাংলামোটর আসতে পারবে ?
-এখনই ?
-হ্যা ।
-আচ্ছা আসছি ।
-আসো এখনই !
বলেই নাদিয়া ফোন রেখে দিল বড় করে একটা দম নিলো । ওর মনে হঠাৎ করে এই চিন্তাটা কিভাবে এল ও কিছুতেই বলতে পারবে না তবে যা চলে এসেছে সেটা যদি আজকে ও না করতে পারে তাহলে হয়তো আর কোন দিন করতে পারবে না । আর হয়তো সারা জীবনই এই আফসোস টা ওর রয়েই যাবে !
নাদিয়া আরও কয়েক জায়গাতে ফোন দিল । যে কাজটা করতে যাচ্ছে সেটা ও একা করতে পারবে না । ওর আরও কয়েকজনের সাহায্য লাগবে ।
ঘন্টা খানেক পরেই আবীর এসে হাজির হল । ওর দিকে তাকিয়ে নাদিয়ার বুকের ভেতরে কেমন যেন একটা শক্তি এসে হাজির হল । এতো সময় যে অস্তিরতা বিরাজ করছিলো ওর মন জুড়ে সেটা কমে এল অনেকটাই । মনে হল যে কাজটা ও করতে যাচ্ছে সেটাই সঠিক কাজ ।
ওকে নিয়ে রিক্সাতে চড়ে বসলো । আবীর বসতে বসতেই বলল
-কি ব্যাপার এতো জরুরী তলব ? তোমার বাবা তো আমার সাথে মিশতে মানা করে দিয়েছে ।
-আমি ছোট খুকি না যে বাবা যা বলবে তাই শুনবো !
-আচ্ছা বুঝলাম । এখন বল হঠাৎ এভাবে ডাক দিলে কেন ? বিয়ে টিয়ে করে ফেলবে নাকি আমাকে ?
নাদিয়া আবীরের কথার জবাব না দিয়ে সরাসরি ওর দিকে তাকালো । আবীর ওর চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝলো যে ও ঠিক এই কাজটাই করতে যাচ্ছে । আবীর খানিকটা অবাক হয়ে বলল
-তুমি কি সত্যিই আমাকে বিয়ে করার জন্য নিয়ে যাচ্ছো ?
-কেন তোমার আপত্তি আছে ?
নাদিয়ার দিকে তাকিয়ে আবীর সত্যিই অবাক হয়ে গেল । এই মেয়ের কাছ থেকে অন্তত এই ব্যাপারটা আশা করে নি সে । আবীর বলল
-আমার যে চাকরি...
-তোমার কি মনে হয় আমি সেই সমস্ত মেয়েদের মত যে যারা কেবল ছেলের চাকরি টাকা পয়সা দেখে পছন্দ করে ?
আবীর আমতা আমতা করে বলল
-আসলে সেটা মিন করিনি !!
-যাই মিন কর না কেন আমি যদি এমনটা করতাম যেটা কিনা করতেই যাচ্ছিলাম তাহলে আমিও তেমন হতাম । তুমি সারা জীবন ভাবতে যে আমি বুঝি সেই সমস্ত লোভী মেয়েদের মতই । কিন্তু না । আমি নিজেকে এমন করে প্রমান করতে চাই না ।
আবীরের মুখে একটা হাসি দেখে গল । নাদিয়া বলল
-শোনো আপাতত কোন চিন্তা নেই । আজকে আমি চাকরি পেয়েছি । বেতন মোটামুটি খারাপ না । যতদিন না তুমি যতদিন আবার কিছু না করবে ততদিন আমি চালিয়ে নিতে পারবো আশা করি ! একটু কষ্ট হবে তবে হবে !
আবীর বলল
-আর যদি চাকরি না পাই আর !
নাদিয়া কিছুটা সময় দ্বিধা নিয়ে তাকিয়ে রইলো আবীরের দিকে । তারপর দৃঢ় কন্ঠে বলল
-তাহলে আমিই চালিয়ে নেব । তুমি আমার জন্য রান্না করবে । পারবে না ?
আবীর হেসে ফেলল । তারপর বলল
-খুব পারবো । আমি কিন্তু খুব ভাল রান্না করতে পারি !
-তাহলে তো হয়েই গেল । সমস্যার সমাধান ।
নাদিয়া হঠাৎ লক্ষ্য করলো আবীর ওর হাত চেপে ধরেছে । উষ্ণ স্পর্শে নাদিয়ার মনটা হঠাৎই ভাল হয়ে গেল । বারবার মনে হল ও যে কাজটা করতে যাচ্ছে সেটা মোটেই ভুল কিছু না । আবীর হঠাৎ করে বলল
-তোমাকে আমি একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে ?
-কোন কথাটা ?
-এই যে আমি কিছু কিছু ব্যাপারে মোটেই ছাড় দিতে চাই না । মনে আছে ?
-হ্যা । ঐযে তোমার চাকরি ছাড়ার ব্যাপারে তো ?
-না ব্যাপারটা অন্য কিছু !
নাদিয়া বলল
-কি সেটা !
-আমি ছোট বেলা থেকে সব সময় একটা ব্যাপারই দেখে এসেছি যে মানুষ কেবল মুখেই ভালবাসার কথা বলে অন্য কিছু না । যদি আমি তার জন্য কিছু করতে পারি তাহলেই ভালবাসা নয়তো ফুট্টুস !
-মানে ? বুঝলাম !
আবীর কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলল
-জানো আমার আগেও একটা বিয়ে ঠিক হয়েছিলো । মেয়েটার সাথে আমি বেশ ভাল ভাবে কথা বার্তা বলতাম । সব কিছু ঠিক হওয়ার পরেও আমি কিছু দিন সময় নিয়েছিলাম । বলেছিলাম যে বিয়ের আগে আমাদের মাঝে আন্ডারস্ট্যান্ডিংটা একটু ভাল হোক । মেয়েটা আমাকে পছন্দ করতে শুরু করলো । একটা সময় মনে হল মেয়েটা আমাকে সত্যিই পছন্দ করেছে । তারপর হঠাৎ একদিন আমার চাকরি চলে গেল । তারপর কি হল জানো ? সেই মেয়ে যেন আমাকে চেনেই না এমন একটা ভাব ! মানে হচ্ছে আমার ভবিষ্যৎ খানিকটা অনিশ্চিত কি হয়েছে আর মেয়ে আমার হাত ছেড়ে দিল মুহুর্তেই । এমন মেয়েকে আমি কিভাবে বিয়ে করবো বল ?
নাদিয়া খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো আবীরের দিকে । আবীর আবারও বলল
-তোমার বেলাতেও ঠিক একই ঘটনা ঘটলো । আমি ইচ্ছে করেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছি । চাইলেই চুপচাপ বিয়ে করতে পারতাম । একবার মনে হয়েছিল তাই করি । তোমার সাথে কথা বলে তোমাকে আসলেই আমার খুব বেশি মনে ধরেছিলো । কিন্তু ঐ ব্যাপারটা ছাড় দিতে পারলাম না । মনের ভেতর থেকে বলছিলো তুমি আসবেই আমার কাছে । গত সপ্তাহে তোমার বাবা সরাসরি মানা করে দেওয়ার পরেও মনে হয়েছিলো তুমি ঠিকই আসবে ! সি ! তুমি ঠিকই চলে আসতে !
নাদিয়া বলল
-যদি না আসতাম ?
-তাহলে আর বিয়ের দিকে যেতামই না আমি । ধরে নিতাম যে এমন মেয়ের জন্মই হয় নি । আর এই ব্যাপারটা কম্প্রমাইজ করার ছেলে আমি নই ।
নাদিয়া আবীরের বুকে জোড়ে একটা ঘুসি মারলো । তারপর বলল
-তোমাকে আমি বিয়ে করবো না যাও ! এই কটা দিন আমাকে কি পরিমান মানসিক কষ্টে রেখেছো তুমি ?
-আমি কোথায় রাখলাম । তোমার বাবা রেখেছে !
-কারন তো তুমি ?
আবীর হাসলো । তারপর বলল
-হতে পারি ! কিন্তু কি আর করবো বল !
নাদিয়া কিছু না বলে কেবল তাকিয়ে রইলো । এই ছেলেকে নিয়ে সে কি করবে বুঝতে পারছে না । নাদিয়া বলল
-আর যদি কোন দিন যদি এমন করেছো তোমার ....
এই বলে আবারও আবীরের বুকে আরেকটা ঘুশি মারতে গেল তবে এবার আবীর নাদিয়ার হাত ধরে ফেলল । তারপর বলল
-আরে বিয়ের আগেই যদি পুরুষ নির্যাতন শুরু করে দাও তাহলে কিভাবে হবে ?
-তোমার সত্যিই খবর আছে । আগে বিয়ে করি !
দেখতে দেখতে রিক্সা এসে থামলো মগবাজার কাজী অফিসের সামনে এসে থেমেছে । নাদিয়া যাদেরকে ফোন করে আসতে বলেছে তারাও এসে হাজির । রিক্সা থেকে নেমে আবীরের হাত ধরেই কাজী অফিসের দিকে দৃঢ় পায়ে এগিয়ে গেল সে । তখনও তার কেবল মনে হল যে সিদ্ধান্তটা সে নিয়েছে সেটা মোটেই ভুল সিদ্ধান্ত না ।
বিঃদ্রঃ ইহা একটি রূপকথার গল্প । বাস্তবে এমন মেয়ে কোথাও খুজে পাবেন না ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:২৯