-আপনাকে কখনও ভূতে হুমকি দিয়েছে ?
আমি পাশ ফিরে ভদ্রলোককে দেখার চেষ্টা করলাম । চেহারা দেখে আমার বিশেষ কিছু মনে হল না । কিন্তু হঠাৎ ভদ্রলোক আমাকে এই কথা বললেন কেন ঠিক বুঝতে পারলাম না ।
আমার স্ত্রী খুলনা থেকে আসছে রাতের ট্রেনে । আমি ওকে নিতে এসে শুনি ট্রেন আরও ঘন্টা খানেক দেরিতে এসে পৌছাবে । তাই স্টেশনের ওয়েটিং রুমে বসে অপেক্ষা করছি । সময় কাটানোর জন্য মোবাইলে একটা বই পড়ছিলাম । তখনই পেছন থেকে এই ভদ্রলোকের কথার আওয়াজ শুনতে পেলাম । আমি কখনও ভুতের হুমকি শুনেছি কি না !
আমি ভদ্রলোকের দিকে আরও খানিকটা সময় মনযোগ দিয়ে তাকানোর চেষ্টা করলাম । চেহারা ছবি বেশ ভাল । বসে আছেন তবে বেশ উচু লম্বা আর চেহারাও বেশ ভাল । দেখে মনে হল কোন ভাল অফিসের চাকরি করে । চেহারাতে একটা চাকুরীজীবী চাকুরীজীবী ভাব আছে । সেই সাথে পরনের স্যুট টা বেশ দামি মনে হল । গুলিস্তান থেকে কেনা স্যুট নয় । আমি অপরিচিত মানুষের সাথে ঠিক কথা বলতে অভ্যস্ত না হলেও খানিকটা কৌতুহল থেকে বললাম
-ঠিক বুঝলাম না । পাড়ার মাস্তানের হুমকি শুনেছি কিন্তু ভূতের হুকমি শোনা হয় নি !
ভদ্রলোক বলল
-ভূতের মার খেয়েছেন ?
আমি খানিকটা হেসে বললাম
-নাহ । তাও খাওয়া হয় নি । আপনি খেয়েছেন নাকি ?
আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে লোকটা নিজের কোর্টের কলারটা খানিকটা সরিয়ে নিজের গলাতে দেখালেন । আমি আরও খানিকটা কাছে গিয়ে একটু চমকেই উঠলাম । ভদ্রলোকের গলাতে পুরু একটা লাল দাগ দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট । নিশ্চিত ভাবেই তাকে গলা টিপে মারতে চেয়েছে । আমি বললাম
-কি সর্বোনাশ ! আপনাকে কেউ গলা টিপে মারতে চেয়েছিল দেখছি ? থানাতে যান জলদি !
ভদ্রলোক শুকনো হাসি হেসে বলল
-লাভ নেই । সত্যি মানুষ হলে আমি থানাতেই রিপোর্ট করতাম । ধানমন্ডি থানার ওসি আমার বাল্যবন্ধু ! কিন্তু আমাকে কোন জ্যান্ত মানুষ এভাবে আক্রমন করে নি । করেছে আমার মৃত বন্ধু ।
এই কথা বলে লোকটা বেশ কিছু সময় চুপ করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে । তবে তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে অন্য কিছু ভাবছে । আমার দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখছে না । ভদ্রলোকের প্রথম কথা শুনে আমার যেমন অদ্ভুদ লেগেছে কিন্তু এখন আমার মনে একটা দারুন কৌতুহল জন্মেছে । আমি ঠিক জানি না লোকটা সত্য বলছে নাকি মিথ্যা বলছে কিন্তু একটা চমৎকার গল্পের সন্ধান পাবো বলে মনে হচ্ছে । আমি লোকটার দিকে তাকিয়ে বললাম
-তা আপনার বন্ধু মানে মৃত বন্ধু আপনাকে মারতে কেন চাইবে ? তার কি এমন ক্ষতি করেছিলেন শুনি যে মরার পরেও আপনাকে মারতে এসেছে !
লোকটার চোখ দুটো হঠাৎ কেমন যেন জ্বলে উঠলো আনন্দে । আমার মনে হল মুহুর্তেই কোন আনন্দ স্মৃতি মনে পড়ে গেল তার । তারপর আবারও মুখটা শুকনো হয়ে গেল । লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে কাকে যেন খোজার চেষ্টা করলো । তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আসলে মরার আগে নয় মরার পরের কাজের জন্য সে আমার জানের দুশমন হয়ে উঠেছে । জীবিত থাকতে সাইদুর ছিল আমার সব থেকে কাছের বন্ধু !
-তাহলে কি এমন কাজ করলেন শুনি ?
লোকটা খানিক সময় যেন ইতস্তত করলো । আমাকে সব কথা বলা ঠিক হবে কি না সে ভেবে নিল আরেকবার ! তারপর বলা শুরু করলো ।
-আমার দিকে তাকিয়ে তো বুঝতেই পারছেন আমার চেহারা ছবি বেশ ভাল । উচু লম্বা সেই সাথে বাবার বেশ ভাল পরিমান টাকা পয়সা আছে । এসব সব এক সাথে থাকলে যা হয় আর কি ! কলেজ থেকেই আমার প্রেমিকার সংখ্যার অভাব ছিল না । প্রেম করে গেছি আজীবন । আসলে সত্যি বলতে কি আমার চেহারা আর টাকার কারনে মেয়েরাও আমার কাছে ধরা দিত খুব সহজেই । বুঝতেই পারছেন !
আমি মনযোগ দিয়ে শুনতে লাগলাম তার কথা । সে বলেই চলেছে ।
আমার একটা মনে হতে লাগলো যে আমি চাইলেই যে কোন মেয়েকে বিছানা পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতে পারি । মনে মনে একটা গর্বই হত বলা চলে । সাইদুরের সাথে আমার সেই স্কুল জীবন থেকে । মেয়েদের ব্যাপারে আমার ঠিক উল্টো । মেয়েদের থেকে দুরে থাকে । আমার সব কিছু ভাল লাগে তার কেবল এই প্লেবয় টাইপের মনভাবটা বাদ দিয়ে । প্রথমে বেশ কিছুদিন চেষ্টা করেছিলো তারপর হাল ছেড়ে দিয়েছে ।
আমরা স্কুল কলেজ এক সাথেই পার করেছি । একই ইউনিভার্সিতে ভর্তি হলেও আমাদের সাবজেক্ট ছিল আলাদা । একদিন হঠাৎ করে সাইদুর একটা মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল আমাকে । আমাকে অবাক করে দিয়েই জানালো যে ওরা বিয়ে করে ফেলেছে । আমি সত্যই অবাক না হয়ে পারলাম না । যে সাইদুর সারা জীবন মেয়েদের কাছ থেকে ১০০ হাত দুরে থেকেছে সেই কি না একেবারে বিয়ে করে ফেলেছে ।
আমাকে আড়ালে ডেকে খুব করে সাবধান করে দিল যেন আমি যেন তার বউয়ের সাথে উল্টাপাল্টা কিছু না করতে চাই । তাহলে কিন্তু ফল ভাল হবে না । আমার স্বভাব সে খুব ভাল করেই জানতো । যাই হোক আমি হেসে তার ভরশা দিলাম যে আমি এমন কিছুই করবো না । সে আমার বন্ধুর স্ত্রী । আমি আর যাই করি না কেন এতোটা নীচে নামি নি ।
এভাবেই দিন কেটে যাচ্ছিলো । তবে আমার মনের ভেরতে রিনির জন্য আলাদা একটা অনুভূতি কাজ করা শুরু করলো । রিনি হচ্ছে সাইদুরের বউয়ের নাম । আমি মাঝে মাঝে ওদের সাথে দেখা করতাম, আমার বুকের ভেতরে একটা আলাদা কষ্ট অনুভব করতে পারতাম । এটা যে রিনির জন্য সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । কিন্তু বন্ধুর সম্মানের জন্য আমি কিছু বলতেও পারতাম না । তাই ওদের কাছ থেকে যথা সম্ভব দুরে রাখতাম নিজেকে । এভাবেই খানিকটা দুরত্ব সৃষ্টি হল । সেটাও আমি মেনে নিয়েছিলাম । আমি অন্য সব কিছু নিয়ে মেতে থাকতাম ।
পড়াশুনা শেষ করে চাকরিতে ঢুকলাম । বাবা মা বাসা থেকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো ঠিকই কিন্তু আমার মন চাইলো না । আমার স্বভাব তখনই রয়ে গেছে আগের মতই । একজনে আমার মনে ভরতো না ।
তারপর হঠাৎ একদিন সাইদুর মারা গেল সড়ক দুর্ঘটনাতে । সেদিন সত্যিই আমি বড় কষ্ট পেয়েছিলাম । সে আমার সত্যিই কাছের বন্ধু ছিল । সাইদুরের মরারও আর দুই বছর পরে আমি একদিন রিনিকে নিউমার্কেটে দেখতে পেলাম হঠাৎ করেই । আমার মত রিনিও আমাকে দেখে এগিয়ে এল । সেই থেকে আমাদের যোগাযোগ শুরু । রিনি তখন একটা চাকরিতে ঢুকেছে । আমার অফিস থেকে খানিকটা কাছেই । আমাদের মেলামেশা হঠাৎ করেই বেড়ে গেল ।
একটা সময় আমি টের পেলাম রিনির প্রতি আমার যে রকম অনুভূতি রিনিও ঠিক সেই রকম অনুভব করে । ব্যাস আর আমাকে পায় কে । একদিন লিফটের ভেতরে ওকে চেপে ধরে খুব চুমু খেলাম । ওর চোখে মুখে আমার জন্য যে কামনা দেখেছিলাম সেদিন সেদিনই মনে হচ্ছিলো ওকে বিছানাতে নিয়ে যাই । কিন্তু এতো দিনের কাঙ্খিত রিনিকে এতো সহজে কিছু করতে ইচ্ছে করলো না । মনে হল একটু সয়ে শয়ে ওর সাথে খেলা করা যাবে ।
তারপর থেকেই ঝামেলা শুরু হল । আমার মনে হতে লাগলো কেউ যেন সব সময় আমার পেছন পেছন ঘুরে বেড়ায় । আমি একটু একা হলেই একটা ছায়া মুর্তিকে দেখতে পাই । রাত কিংবা দিন যে সময়ই আমি একা হতাম সেই সময়েই আমি সেই ছায়া মুর্তিটাকে দেখতে পেতাম । খুব চেনা চেনা মতে হত কিন্তু চিনতে পারতাম না কিছুতেই ।
তারপরই সেই দিন এল । রিনি নিজেই আমাকে ওদের বাসায় আমন্ত্রন জানালো । সাইদুর মারা যাওয়ার পরেও রিনি ওদের দুই বছরের ছেলেকে নিয়ে সাইদুরদের বাসাতেই থাকতো । সাইদুরের বাবা মা দুজনেই সেদিক গিয়েছিলো ওদের গ্রামের বাসাতে। সাথে করে ওর বাচ্চাটাকেও নিয়ে গিয়েছিলো । পুরো বাসা ছিল ফাঁকা । ব্যাস সুযোগ পেয়ে ও আমাকে নিজের বাসাতেই ডেকে নিয়ে গেল ।
সন্ধ্যা থেকেই আমাদের খেলা শুরু হল । একটা সময় আমি ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম । যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন হঠাৎ আমি আবিস্কার কারলাম যে যে ঘরে আমি শুয়ে আছি সেটা অনেক বেশি ঠান্ডা হয়ে গেছে । আমার শীত লাগছে । কিন্তু এখন গরম কাল । শীত লাগার তো প্রশ্নই আসে না । আমি চোখ খুলে কিছু দেখার চেষ্টা করলাম । চারিদিকে অন্ধকার মনে হল । কেমন যেন নিশ্চুপ হয়ে আছে সব কিছু । কিছু সময় পরে অন্ধকার চোখে সয়ে আসতেই আমি আমার খাটের সামনেই সেই ছায়া মুর্তিকে দেখতে পেলাম । এবং আমি তখনই তাকে চিনতে পারলাম ।
সাইদুর ! আমার মৃত বন্ধু সাইদুর ।
আমার দিকে জ্বলন্ত চোখে তাকিয়ে আছে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল ফয়সাল তোকে বলেছিলাম রিনির সাথে কিছু করলে ফল ভাল হবে না ! আমি বলেছিলাম !
আমি তখনও অবাক হয়ে তাকিয়েই আছি সামনের ছায়া মুর্তির দিকে । আমার তীব্র ভয় করতে লাগলো । আমি পালিয়ে যেতে লাগলাম কিন্তু পারলাম না । সাইদুর আমাকে চেপে ধরলো । তারপর আমার গলা চেপে ধরলো । আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু একটা সময়ে আমার পক্ষে বাঁধা দেওয়া সম্ভব হল না । আমার কেবল মনে হল আমি মারা যাচ্ছি । একটা সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম । যখন জ্ঞান ফিরলো তখন তাকিয়ে দেখি আমি রাস্তায় পড়ে আছি । কোন মতে আমি বাসায় ফিরে এলাম । তারপর থেকেই সাইদুরের কাছে আমি পালিয়ে বেড়াচ্ছি ।
কথা গুলো বলে ফয়সাল সাহেব চুপ করে রইলাম । আমি তাকিয়ে রইলাম । আরও কিছু শোনার আশায় । অনেক কিছু প্রশ্ন আমার মনে ভেতরে ঘুকপাক খাচ্ছে । কিন্তু আমি আরও কিছু বলবো তার আগেই ট্রেন ঢুকে পড়লো স্টেশনে । ফয়সাল সাহেব উঠে দাড়ালো । তারপর বলল
-আমাকে পালাতে হবে । এখনই পালাতে হবে । সাইদুরের কাছ থেকে পালাতে হবে !
ফয়সাল সাহেব আর দাড়ালো না । এক দৌড় দিয়ে ওয়েটিং রুম থেকে বের হয়ে গেল । আমি ডাকতে গিয়েও ডাক দিলাম না । তার পেছন পেছনে ওয়েটিং রুম থেকে বের হয়ে এলাম । দেখতে পেলাম ফয়সাল সাহেব কেবল এলোমেলো পা ফেলে ট্রেনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ।
আমার তার পেছনে যাওয়া ঠিক হবে না এমন টা ভাবছি এমন সময় আমি তৃষাকে দেখতে পেলাম । ট্রেন থেকে নামতেছে । ফয়সাল সাহেব আমার মাথা থেকে দুর হয়ে গেল । আমি দ্রুত এগিয়ে গেলাম ওর দিকে । আমাকে দেখতে পেয়ে তৃষার মুখে হাসি দেখতে পেলাম ।
আমি হয়তো ভুলেই যেতাম ফয়সাল সাহেবের কথা কিন্তু দুইদিন পরে একটা নিউজ আমার চোখে না পড়তো । খবরটা ফায়সাল আহমেদ নামের একজনের মৃত্যু সংবাদ । তাকে খুলনা স্টেশনে ট্রেন যখন থামে তখন ফার্স্ট ক্লাসের এক কামড়া থেকে একজন ৩৫/৩৬ বছরের পুরুষ মানুষের মৃত দেহ পাওয়া গেছে । কেউ তাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়েছে । হত্যা কারীর খোজ করা হচ্ছে ।
তৃষাকে সব বলতেই ও হেসে উড়িয়ে দিল । এমনটা কোন দিন হতেই পারে না । মৃত্যুর পরে কেউ ফেরৎ আসতে পারে না । ফয়সাল সাহেবকে হয়তো তার কোন শত্রু মেরে ফেলেছে ।
আমার আর কিছু বলার ছিল না । আমার কথা প্রমানের কোন উপায় ছিল না । হয়তো ফয়সাল সাহেবের পেছনে তার শুত্রু লেগেছিলো । সেই শুত্রুই তাকে মেরে ফেলেছে । আবার হয়তো সত্যিই সাইদুর সাহেব ফিরে এসে তার বন্ধুকে শাস্তি দিয়েছিলো । আমার কিছুই জানার উপায় নেই ।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে নভেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৪৭