শেফার মনের ভেতরে একটা ভয় কাজ করছে । মোটেই সামনে এগিয়ে যেতে মনে চাচ্ছে না । বারবার মনে হচ্ছে এখনই এখান থেকে চলে যেতে । কিন্তু পারছে না সামনের মানুষটার জন্য ।
সাদিক আবারও বাসার কলিংবেলটা বাজালো । শেফার বারবার মনে হচ্ছে জাকির যেন বাসায় না থাকে । বাসায় থাকলেই সমস্যা সৃষ্টি হবে । না থাকলে এখনকার মত বিপদ কেটে যাবে । কিন্তু ওর ধারনা কে ভুল প্রমান করে দিয়ে স্বয়ং জাকিরই দরজা খুলল । প্রথমে সাদিকের দিকে তারপর ওর দিকে তাকিয়ে রইলো খানিকটা অবাক চোখে । অন্তত এই সকাল বেলা জাকির ওদেরকে এখানে আশা করে নি ।
গতকাল রাতেই জাকিরের সাথে দেখা হয়েছিলো ওর । সাদিকের সাথে রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়েছিলো ও । সাদিক ওকে রেখে একটু ওয়াশ রুমে যেতেই কোথা থেকে যেন জাকির এসে হাজির । ওকে উদ্দেশ্য করে নানান কথা বলতে শুরু করে দিল । ওর চোখে পানি চলে আসছিলো তখনই সাদিক এসে হাজির । শেফার চেহারার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারছিলো কিছু হয়েছে ।
জাকির দিকে এগিয়ে যেতেই শেফা ওকে আটকালো । এক প্রকার জোর করেই সাদিককে রেস্টুরেন্ট থেকে বের করে আনলো । সাদিককে বেশ কয়েকদিন থেকেই সাদিকের সাথে কথা বলছে ও । যেই ধারনাটা ঠিক করে রেখেছিলো যে আর কখনও কোন ছেলের সাথে নিজেকে জড়াবে না সেই ধারনা থেকে বের হয়ে এল সাদিকের সাথে পরিচয় হওয়ার পরেই । একবার সে ভুল করেছে । তবুও আরেকবার সাদিকের সাথে জড়াতে ইচ্ছে করছে ওর । বারবার কেবল মনে হচ্ছে যে সাদিক ওর আগের স্বামীর জাকিরের মত নয় মোটেই ।
জাকির ওদের দুজনের দিকেই তাকিয়ে রইলো বেশ কিছুটা সময় । তারপর রুক্ষ গলাতে বলল
-কি চাই এখানে ?
শেফা কি বলবে খুজে পেল না । ওর কিছু বলতে ইচ্ছেও করছে না । ওরা যে ফ্ল্যাটে থাকছে এটা শেফার নিজের ফ্ল্যাট । বিয়ের পর থেকে ও এখানেই ছিল । কিন্তু বিয়ের পর পরই জাকির ওকে সব সময় চাপ দিত এই ফ্ল্যাট টা ওর নাকে লিখে দিতে । শেফা সেটা করতে চাই নি বলেই ঝামেলা শুরু । একটা সময় জাকিরের আসল রূপটা বের হয়ে এল । শেফা স হ্য করতে না পেরে বাসা ছেড়ে চলে গেল । সেটাই ওর জন্য ভুল ছিল । জাকির এই ফ্ল্যাটের উপর কবজা করে নিলো । শেফা সেই ছোট বেলা থেকে এতিম ছিল । ওর একার পক্ষ্যে এই ফ্ল্যাট উদ্ধার করা কোন ভাবেই সম্ভব ছিল না । পুলিশের কাছে নালিশ করেও কোন লাভ হয় নি । জাকিরের এক বন্ধু এই থানার ওসি হয়ে আছে । সেই সব কিছু সামাল দিয়ে রেখেছে । শেফার কিছুই করার ছিল না এতোদিন ।
কিন্তু গতকাল রাতের পর সাদিক খুব রেগে আছে । আজকে এসেছে এই ফ্ল্যাট টা উদ্ধার করতে । সাদিক বলল
-এই যে ফ্ল্যাটের কাগজ পত্র । আপনি এই ফ্ল্যাট টা ছেড়ে দেন এখনই ।
জাকির এমন একটা ভাব করলো যেন এর থেকে হাসির কথা ও আর শোনেই নি কোন দিন । ওদের দিকে তাকিয়ে বলল
-আরে যা । সকাল বেলা ডিস্টার্ব করিস না !
সাদিক আবারও বলল
-আমি ভদ্র ভাবে বলছি, দয়া করে বাসা থেকে এখনই বের হয়ে যান ।
-না গেলে ?
শেফা আবারও ভয়ে ভয়ে তাকিয়ে তাকিয়ে দুজনের কথা শুনছিলো । শেফার কেবল মনে হচ্ছে এখনই ওদের এখান থেকে চলে যাওয়া উচিৎ । এখনই নয়তো কোন ঝামেলা শুরু হয়ে যাবে । শেফার মনের চিন্তা মনেই রয়ে গেল, সে দেখতে পেল সাদিক ওর বাঁ হাত দিয়ে জাকিরের মাথাটা ধরে দরজার সাথে জোড়ে ধাক্কা মারলো । ঘটনা এতোই দ্রুত ঘটলো যে জাকির কিছু বুঝতেই পারলো না । শেফা কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো সামনের দিকে ।
জাকির প্রথমে কয়েক সেকেন্ড কিছু বুঝতেই পারলো না ওর সাথে কি হল । মাথাটা কেবল ঝিমঝিম করতে লাগলো । খানিকটা সুস্থির হতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো । মাথায় হাত দিয়ে বুঝতে পারলো ওর মাথাটা বেশ ব্যাথা করছে । মুখ দিয়ে একটা কঠিন গালি বের হওয়ার আগেই আরেকটা থাপ্পড় এসে লাগলো ওর গালে । এসে খানিকটা বাসার ভেতরে গিয়েই পড়লো ।
শেফা তখনই দেখলো ভেতরে থেকে একটা মেয়ের মুখ উকি দিচ্ছে । ওদের তাকিয়ে আছে ভিত চোখে । সাদিকের দিকে তাকিয়ে বলল
-ওকে মারছেন কেন ?
সাদিক বলল
-আপনি কে ?
মেয়েটি বলল
-আমি ওর স্ত্রী ?
সাদিক একটু হাসলো । তারপর বলল
-বাহ ভাল । এই যে এই মেয়েটিকে দেখছেন না এই হচ্ছে প্রথম স্ত্রী । এই ফ্ল্যাট টার মালিক এই মেয়েটি । আপনার স্বামীর সাথে ওর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে কিন্তু আপনার গুনধর স্বামী এই ফ্ল্যাট টা নিজের বাপের সম্পত্তি মনে করে রেখে দিয়েছে । বুঝলেন ?
মেয়েটি অবাক হয়ে একবার সাদিকের দিকে আরেকবার জাকিরের দিকে তাকাচ্ছেন । স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে এসবই তার কাছে নতুন লাগছে । জাকির ততক্ষনে উঠে দাড়িয়েছে । সে শেফা আর সাদিকের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে বলল
-তোদের আমি দেখে নেব । দাড়া তুই ।
সে এক প্রকার দৌড়েই চলে গেল ঘরের ভেতরে । একটু পরেই শেফা শুনতে পেল সে ফোন করে কাকে যেন আসতে বলছে । শেফার বুঝতে কষ্ট হল না কাকে ফোন করে আসতে বলছে । জাকিরের সেই পুলিশ বন্ধুকে । সাদিকের অবশ্য সেদিকে কোন ভাবান্তর হল না । সে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লো । তারপর শোফার উপর আরাম করে বসে পড়লো ।
শেফা ভয়ে ভয়ে ভেতরে ঢুকে চারিদিকে তাকাতে লাগলো । পুলিশ এসে সাদিককে নিয়ে যাবে এটা ভাবতেই ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে । কি দরকার ছিল এই ঝামেলা করার ! জাকির এই ফ্ল্যাট নিয়ে থাকছিলো, থাকুক ! কি এমন দরকার ছিল ও সাথে ঝামেলা করার !
১০ মিনিটের মাথায় জাকিরের সেই পুলিশ বন্ধু এসে হাজির । নামটা শেফা ভুলে গিয়েছিলো । নেম প্লেট দেখে আবার মনে পড়লো । হেদায়েত । হেদায়েত আসতেই জাকির যেন শরীরে শক্তি পেয়ে গেল বহুগুণে । সাদিকের তাকিয়ে বলল
-এবার তোর খবর আছে ।
তারপর হেদায়েতের দিকে তাকিয়ে বলল
-এই গুন্ডাটা আমাকে মারধোর করেছে । তুই এখনই এর নামে কেস লিখবি । এমন কেস লিখবি ....।
জাকিরকে থামিয়ে দিয়ে হেদায়েদ সাদিকের দিকে এগিয়ে এল । তারপর বলল
-আমার এলাকাতে এসে মাস্তানী ? চল থানায় চল ....
সাদিককে খুব বেশি চিন্তিত মনে হল না । উঠে দাড়িয়ে হেদায়েতের মুখোমুখি হয়ে বলল
-কোন জোনের আন্ডারে আপনি ?
-মানে ?
-মানে আপনাদের ডিআইজি রফিকুল ইসলামের নাম্বার আছে না আপনার কাছে ?
হেদায়েতকে এবার খানিকটা দ্বিধান্বিত মনে হল । ঠিক বুঝতে পারছে না যেন কি করবে ?
হেদায়েতকে চুপ থাকতে দেখে সাদিক নিজেই মোবাইল বের করলো । তারপর একটা নাম্বার টেপাটেপি করে কাকে যেন ফোন দিল । কয়েক মুহুর্ত পরেই লাইন পেয়ে গেল ।
-হ্যা মামা ? হ্যা আমি ।
শেফা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সাদিকের দিকে । হেদায়েতের দিকে তাকিয়ে দেখে তারও মুখ শুকিয়ে গেছে । সাদিক তখন বলেই চলেছে ।
-তোমাকে তো বলেছিলাম বিয়ে করছি । ওর একটা ফ্ল্যাট এক বদমাইস দখল করে রেখেছে । আর সেই দখলে সাহায্য করছে তোমার এক অফিসার ! নাম ?
সাদিক সামনে দাড়ানো হেদায়েতের নেম প্লেট । বুঝতে পারছে যে সাদিক ওর নেম প্লেট পড়ার চেষ্টা করছে । সে সাথে সাথেই নিজের হাত দিয়ে নেম প্লেট টা ঢাকার চেষ্টা করলো কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে । সাদিক নামটা খুব ভাল করেই পড়ে ফেলেছে ।
সে নামটা বলে দিল ফোনে । তারপরই ফোনটা বাড়িয়ে দিল হেদায়েতের দিকে । বলল
-নেন কথা বলেন
হেদায়েত প্রথমে কথা বলতে চাইলো না । কিন্তু মানাও করতেও সাহস হল না । ফোনটা কানে নিয়ে বেশ কিছুটা চুপ করে দাড়িয়ে রইলো । হু হা বলল বেশ কয়েকবার ! বুঝতেই পারছে ওপাশ থেকে ধমক শুনতে পাচ্ছে । ফোনটা বাড়িয়ে গোমড়া মুখে তাকিয়ে রইলো সবার দিকে । হেদায়েতকে অবশ্য আর থাকতে দেখা গেল না । সে জাকিরের দিকে তাকিয়ে বলল
-দোস্ত নিজে বাঁচলে বাপের নাম । তোর সমস্যা তুই বুঝো আমি আর নাই ।
হেদায়েত চলে যাওয়ার পরপরই জাকিরের চেহারা বেশ বদলে গেল । গলার স্বরও বদলে গেল বেশ । সাদিক খুব শান্ত কন্ঠে বলল
-এখনই বাসা ছেড়ে চলে যাবে । এই মুহুর্তে । আমি আধা ঘন্টা সময় দিলাম ।
জাকির কোন মতে বলল
-আমি কোথায় যাবো এখন ? এই মাসের মাঝে ?
-সেটা আমার সমস্যা না । জিনিস পত্র এখানে থাকবে । তিন বছর বাসা কবজা করে রেখেছো, তিন বছরের বাসা ভাড়া দিয়ে নিয়ে যাবা সব । না হলে কিছু নিতে পারবে না ।
জাকির কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই শেফা দেখতে পেল সাদিক আবারও খুব দ্রুত ওর সামনে গিয়ে হাজির হল । জাকির নিজের মুখটা এবার ঠেকানোর ভঙ্গি করে আটকালো । সাদিক সোজা ওর কলার চেপে ধরে এক প্রকার টানতে টানতেই ঘর থেকে বের করে দিল । যে মেয়েটি এতো সময় পেছনে ভীত মুখে দাড়িয়ে ছিল সে তখনও চুপ করে দাড়িয়ে আছে । সাদিক সেদিকে তাকিয়ে বলল
-কি ব্যাপার আপনি কেন দাড়িয়ে আছেন ? এটা আপনার বাসা না বুঝতে পারছেন না । বের হন ।
মেয়েটা এবার আর দেরী করলো না । বলতে গেলে এক কাপড়েই জাকিরের পাশে গিয়ে দাড়ালো । জাকির তখনও দাড়িয়ে আছে দরজাতে । অসহায় মুখে তাকিয়ে আছে শেফার দিকে । শেফার দিকে করুণ কন্ঠে বলল
-প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করো ! আমি এখন কোথায় যাবো । এই মাসটা সময় দাও !
শেফা তাকিয়ে আছে জাকিরের দিকে । একটা সময় এই ঘর থেকেই ওকে এক প্রকার বের করে দিয়েছিলো । কেবল গায়ের শক্তি দেখিয়ে ওর সম্পদ দখল করে রেখেছিলো । আর আজকে ওর কাছে কেমন করুণা চাচ্ছে । শেফা কিছু বলবে তার আগেই সাদিক বলল
-এখনও দাড়িয়ে ! এবার কিন্তু ঐ হেদায়েতকে ডেকেই পেছনে বাঁশের দান্ডা চালাবো । গেলি !
শেফা কিছু বলতে গিয়েও বলল না । কেবল তাকিয়ে রইলো সাদিকের দিকে । কেন জানি জাকিরের এই পরিনতি দেখে ওর মোটেই খারাপ লাগছে না । বরং বেশ আনন্দ হচ্ছে । সেই সাথে এও খুশি লাগছে যে সাদিকের মত একজনের সাথে ওর বিয়ে হতে যাচ্ছে দেখে । সব বিপদ থেকে এই ছেলে তাকে ঠিক ঠিক রক্ষা করে রাখবে ।
দরজাটা সাদিককে বন্ধ করতে হল না । জাকিরের মুখের উপর শেফাই বন্ধ করে দিল ঠাশ করে । মনের ভেতরে একটা আনন্দ হল । এই আনন্দের কোন শেষ নেই ।
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:১৭