ছবি গুগল
হাসপাতাল ব্যাপারটা আমার কোনদিনই ঠিক পছন্দ ছিল না কিন্তু ডাক্তার কন্যা বেশ পছন্দ ছিল সব সময় । আমার প্রেমিকা একজন ডাক্তার হবে এটা ভাবতেই মুখে একটা আনন্দের হাসি চলে আসতো । তবে আমি জানতাম যে আমার দ্বারা কোন ডাক্তা মেয়ে পটবে না কোন দিন । সেই হিসাবে খুব বেশি দরকার না হলে আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে না । এটা একটা স্বস্তির ব্যাপার ছিল ।
কিন্তু কপালে থাকে সেটা কোন ভাবেই এড়ানো যায় না । আমার প্রেমিকা না একেবারে ডাক্তারের সাথে বিয়ে হয়ে গেল । কিভাবে সেই বিয়ে হল সেই গল্পে না যাই, সেটা শেষ করতে গিয়ে রাত পার হয়ে যাবে । আজকের ব্যাপারটা অন্য কিছু নিয়ে
যাই হোক তৃষার তখনও ঠিক ডাক্তারী পড়া শেষ হয় নি । মাঝে ওর পা ভাঙ্গার কারনে ও একটা বছর গ্যাপ দিয়েছিলো । এখন ওর ইন্টার্নশীপ চলছে ডিএমসিতে । মাঝে মাঝেই ওর নাইট ডিউটি পড়ে । তখন আমার ডাক পড়ে । যদিও খানিকটা নিয়ম নীতি বহির্ভূত তবুও খুব একটা সমস্যা হয় না । এই সময় গুলোর বেশির ভাগই আমরা তৃষার অফিস রুমে কাটাই । মাঝে মাঝেই ওর রাতে রাউন্ড দিতে যায় । কোন কোন সময় আমি ওর সাথে সাথে যাই, মানুষজন দেখি । রাতের নিরব হাসপাতলে করিডোরে ওর হাত ধরে হাটতে বেশ লাগে । তখন আর আমার হাসপাতাল খারাপ লাগার ব্যাপারটা মাথায় থাকে না । অবশ্য তৃষা সাথে থাকলে আমার কাছে আমার কাছে সব কিছুই চমৎকার মনে হয় ।
সেদিনও আমি রাতে হাজির হয়ে গেলাম হাসপাতালে । হাসপাতালের স্টাফদের প্রায়ই সবাই আমাকে ততদিনে বেশ ভাল করে চিনে ফেলেছে । তাই হাসপাতালে ঢুকতে খুব একটা সমস্যা হল না । তৃষাকে ফোন দিতেই ও লাইণ কেটে দিল । এর মানে হচ্ছে ও এখন ব্যস্ত আছে । আমি ওকে আর বিরক্ত করলাম না । একটা ছোট মেসেজ করে রাখলাম যে আমি চলে এসেছি ।
তারপরেই আস্তে আস্তে হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হাটতে লাগলাম । ততক্ষনে প্রতিটা ওয়ার্ডের লাইট প্রায় অফ হয়ে গেছে । সব রোগীরা ঘুমিয়ে পড়েছে । তবে কেউ কেউ তখনও জেগে আছে । হাটার পথে আমার সাথে দুজন নার্সের সাথে দেখা হল । একজন আমাকে দেখে একটু হাসলো । একটু জানতে চাইছে যে আমার একা একা হাটতে কোন সমস্যা হচ্ছে কি না । আমিও প্রতি উত্তরে একটু হাসলাম ।
একটা সময় হাটতে হাটতে বেশ ভেতরে চলে এলাম । কেমন যেন অপরিচিত মনে হল । একটু যেন ঠান্ডা ঠান্ডাও লাগতে লাগলো । আসলে হাসপাতালটা আমার মাঝে মাঝে গোলক ধাঁধা মনে হয় ঠিক মত চিনতে পারি না । আমি আবার পেছনে ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করলাম তখনই আমার চোখ গেল করিডোরের একেবারে শেষ মাথায় । একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ে চুপচাপ বসে আছে । করিডোরের মাথার উপরে একটা ৮০ পাওয়ারের লাইট জ্বলছে । সেই আলোতে মেয়েটার বিষণ্ণ মুখ দেখা যাচ্ছে
আমি খানিকটা অবাক না হয়ে পারলাম না । এই বাচ্চাটা এখানে কি করছে ?
রোগীদের ওয়ার্ড আমি বেশ পেছনে ফেলে এসেছি । এদিকে কি আছে আমার ঠিক মত জানা নেই । বাচ্চাটাও কি আমার মত হাটতে হাটতে এখানে চলে এসেছে । হয়তো বাচ্চাটার মা এখানে ভর্তি আছে । রাতের বেলা ঘুম ভেঙ্গে গিয়ে একা একা বের হয়ে গেছে ।
আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলাম বাচ্চা মেয়েটার কাছে ।
আমার উপস্থিতি পেয়েও মেয়েটা মাথা তুলে তাকালো না । সামনের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে রইলো একভাবে । আমি ডাক দিলাম
-এই যে বাবু ! এখানে কি ?
মেয়েটা তবুও কোন কথা বলল না । চুপ করে বসেই রইলো নিজের যেখানে বসে ছিল । তৃষা সব সময় আমাকে বকাবকি করে এই নিয়ে যে আমি বাচ্চাদের সাথে ঠিক মত মিশতে পারি না । বাচ্চাদের সাথে তৃষা খুব সহজেই মিশতে পারে । প্রথম বার দেখেও তাদের এমন মোলায়েম ভাবে ডাক দিবে যে মনে হবে বাচ্চাটাকে সে কতদিন ধরেই না চিনে । আমি এমন করে ডাকতে পারি না । তবুও যথা সম্ভব গলা নমনীয় করে বললাম
-এই বাবু তোমার নাম কি ?
এবার মনে হল ডাকে একটু কাজ হল । মেয়েটা আমার দিকে মুখ তুলে তাকালো । তারপর বলল
-নিমু ।
-তো নিমু মামনি, তুমি এখানে একা একা কি করছো ? তোমার আম্মু কোথায় ?
আমার প্রশ্ন শুনে নিমুর মুখটা আবারও কালো হয়ে গেল । সে কোন উ্ত্তর দিল না । আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম যে মেয়েটা নিশ্চিত ভাবে হারিয়ে গেছে । ওর মা কোন ওয়ার্ডে আছে এটা আর খুজে পাচ্ছে না । আমি একটু হেসে বললাম
-তোমার কোন ভয় নেই । আমরা দুজন মিলে তোমার আম্মুকে খুজে বের করবো । কেমন ! এমন চল এখান থেকে !
এবারও মেয়েটা আমার কথায় উঠে দাড়ালো । মুখে যেন একটু হাসিও দেখা গেল । তবে সেটা ওর বিষণ্ণতাকে ঠিক কাটিয়ে উঠতে পারলো না । আমরা আবারও ওয়ার্ডের দিকে হাটা দিলাম । তৃষার কাছে বললেই সে কোন না কোন ব্যবস্থা করে ফেলবে । চলতে চলতেই আমি নিমুকে নানান প্রশ্ন করতে লাগলাম । মেয়েটা কেমন টুকটুক করে সেই সব প্রশ্নের জবাব দিতে লাগলো । বুঝতেই পারছি মেয়েটা স্বাভাবিক অবস্থায় প্রচুর কথা বলে । এখন অচেনা পরিবেশ বলেই হয়তো বেশি কথা বলছে না ।
মেয়েটা সম্পর্কে অনেক কথাই জানা গেল । সে আজিমপুরে থাকে, আজিমপুর সরকারী কলনী । তার বাবার নাম সেলিম আর মায়ের নাম রাবেয়া । মেয়েটা স্কুলে পড়ে আর প্রতিবারই সে ফার্স্ট হয় । কিন্তু এইবার সে পরীক্ষায় ফার্স্ট হতে পারে নি । তাই তার মা তাকে বকা দিয়েছে । এই জন্য তার মন খারাপ !
হাটতে হাটতে তৃষার কেবিনের সামনে এসে দাড়ালাম । ভেতরে ঢুকে দেখি সেখানে কেউ নেই । তৃষা সম্ভবত এখনও রাউন্ড থেকে বের হয় নি । আমি ওকে চেয়ারের উপর বসিয়ে বললাম
-তুমি কিছু খাবে ? ক্ষুধা লেগেছে ?
নিমু কোন কথা না বলে কেবল তাকিয়ে রইলো । আমি তৃষার ব্যাগ খুজতে লাগলাম । হাসপাতালে আসার সময়ে হ্যান্ড ব্যাগ ছাড়াও আরও একটা বড় ব্যাগ নিয়ে আসে । সেখানে রাজ্যের জিনিস পত্র থাকে । বিশেষ করে আমার জন্য নানান ধরনের খাবারে ভর্তি থাকে । টেবিলের এক পাশে ব্যাগটা খুজে পেলাম । সেটা খুলতেই একটা জুসপ্যাক খুজে পেলাম । সেটঐ নিমুর সামনে দিয়ে বললাম
-আগে এটা শেষ কর । তারপর অন্য কিছুর ব্যবস্থা করছি । আর একদমই চিন্তা করবা না । আমি তোমার আম্মুকে ঠিকই খুজে বের করবো !
এমন সময় তৃষার ফোন এসে হাজির । কেবিন নাম্বার ৬ এর সামনে আসতে বলল । আমি কিছু বলতে যাবো তার আগেই লাইণ কেটে গেল । একবার মনে হল নিমুকে সাথে নিয়ে যাই কিন্তু তারপর মনে হল দরকার নেই । ও এখানে বসে জুস খেতে থাকুক । আমি তৃষাকে বরং এখানে ডেকে নিয়ে আসি । বের হওয়ার আগে নিমুকে ভাল করে বলে গেলাম যে ও যেন কোন ভাবেই কেবিন থেকে না বের হয় । আমি এখনই আসছি ।
তৃষাকে খুজে পেতে খুব একটা সময় লাগলো না । ওর মুখের দিকে তাকিয়েই মনে হল ওর মন খারাপ । আমি বললাম
-কি ব্যাপার মন খারাপ কেন ?
-কিছু না ।
-আরে বলবা তো !
-তোমাকে একটা ছবি ইনবক্স করেছি দেখো ।
-কিসের ছবি ?
-এক্সিডেন্ট কেস ! মারা গেছে ।
-এই জন্য মন খারাপ ?
-হুম !
আমি তৃষাকে জড়িয়ে ধরলাম । আমি জানি আমার জড়িয়ে ধরাটাই কেবল ওর মন খানিকটা ভাল করে তুলতে পারে । এই মেয়েটার বাইরে বাইরে এমন শক্ত একটা ভাব দেখাবে অথচ ভেতরে ভেতড়ে এমন নরম মনের মানুষ । আমার মনে আছে ওর সামনে প্রথম যে রোগীটা মারা গিয়েছিলো সেদিন আমাকে জড়িয়ে ধরে ও সে কি কান্না ! মনে হচ্ছিলো যেন ওর নিজের কাছের কেউ মারা গেছে ।
অনেকটা সময় পরে তৃষা নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে বলল
-একটু চেষ্টা করে দেখো দেখি মেয়েটার পরিচয় জানতে পারো কি না । এক্সিডেন্ট কেস । পথচারিরা হাসপাতালে নিয়ে এসেছে । কেউ চেনে না ।
আমি মোবাইল বের করে ইন্টারনেট ডাটা অন করতেই হোয়াটসএপ নোটিফিকেশন আসলো । ছবিতে ক্লিক করতেই আমি বড় রকমের একটা ধাক্কা খেলাম । চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলাম কেবল ছবিটার দিকে ।
সাদা কাপড় দিয়ে জড়িয়ে রাখা হয়েছে মেয়েটাকে । কেবল মুখটা দেখা যাচ্ছে । তবে নিমুর চেহারাটা আমার চিন্তে মোটেই কষ্ট হল না । আমার চেহারা দেখেই তৃষা ঠিক বুঝতে পেরেছে যে কিছু একটা সমস্যা হয়েছে । ও বলল
-এই কি হয়েছে ? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন ছবিটার দিকে !
আমি তৃষার দিকে তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুটা সময় । কোন কথা বলতে পারলাম না । তারপর ওর হাত ধরে বলতে গেলে এক প্রকার টানতে টানতেই নিয়ে এলাম ওর অফিসে ।
টেবিলের উপর সেই জুসের প্যাকেট টা রয়েছে । আর কেউ নেই । তৃষা তখনও আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । কিছুই বুঝতে পারছে না । আমি জুসের প্যাকেট টা হাতে নিয়ে দেখলাম সেটা প্রায় খালি । তৃষা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি হয়েছে বলবা প্লিজ ! এমন কেন করছো ?
আমি কিছুটা সময় চুপ করে থেকে সব কিছু খুলে বললাম । ও কেবল চুপ করে তাকিয়ে রইলো । আমি যে ওর সাথে কোন প্রকার মজা করছি না সেটা আমার চেহারার ভাব দেখেই বুঝতে পেরেছে । তৃষা বলল
-তুমি কি বলছো বুঝতে পারছো তো ?
-হ্যা । কিভাবে আমি জানি না । তবে আমার মনে হচ্ছে যে এটা সত্য হবে । এক কাজ করো কাউকে আজিমপুর সরকারী কলনীতে পাঠাও । মেয়ের নাম নিমু, বাবার নাম সেলিম আর মায়ের নাম রাবেয়া । মনে হয় খুজে পেতে সমস্যা হবে না ।
তৃষা তাই করলো । আমি এই ফাঁকে নিমুর বডিটা দেখে আসলাম । আমার কোন সন্দেহ নেই যে এই মেয়ের সাথেই আমি কথা বলেছি ।
ঘন্টা খানেক পরেই নিমুর বাবা মা এসে হাজির হল । আমার চোখের সামনেই মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো । তৃষা আমার দিকে তখনও অবাক হয়ে তাকিয়ে রয়েছে । আমি নিজে কি কম অবাক হয়েছি ।
নিমুকে ছাড়িয়ে নিতে নিতে সকাল হয়ে গেল । শেষ বারের মত নিমুকে দেখে ওর বাবা মায়ের কাছে তুলে দিয়ে এলাম । খোজ নিয়ে জানতে পারলাম যে ওর মা ওকে রেজাল্টর জন্য বকা দিয়েছিলো । তাই দুপুর বেলা যখন ওর মা ঘুমিয়ে ছিল তখন রাগ করে মেয়েটা বাসা থেকে একা একা বের হয়ে যায় । তারপরই রাস্তায় এক্সিডেন্ট করে ! আহা রে বাচ্চা মেয়েটা !
তৃষার তখন ডিউটি শেষ হয়ে গেছে । গাড়ির ভেতরে ও আমার কোলে মাথা রেখেই খানিকটা শুয়ে পড়লো । চোখ বন্ধ করেই তৃষা বলল
-আমাদের মেয়েকে কিন্তু আমরা কোনদিন বকবো না । বুঝেছো !
আমি বললাম
-আমি তো বকবো না , তবে তুমি নাকি বকবা । তুমিই তো বলেছিলে ?
-নাহ । কোন দিন বকবো না । ওর যা জেদ হবে ! আর কোন দিন যদি ও একা একা বাসা থেকে বের হয়ে যায় তাহলে তোমার কিন্তু খবর আছে !
আমি হাসলাম । তারপর বলল
-আচ্ছা খবর আছে ! এখন একটু ঘুম দাও ।
ওর মাথায় হাত বুলাতে বুলাতেই মনে মনে বললাম যে আমাদের মেয়েকে আমি কোন দিন চোখের আড়াল করবো না, কোন দিন না ।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:১৯