ছবি গুগল
-মিতু আপনি যাবেন নাকি ?
ক্যান্টিনে বসে লাঞ্চ করছিলো আর মোবাইলে ফেসবুকটা ব্রাউজ করছিলো মিতু । আওয়াজ শুনে মুখ তাকালো । ওর কলিগেরা বসে আছে ওর পাশেই । কিছু নিয়ে আলোচনা করছিলো । মিতুর লক্ষ্য মোবাইলের দিকে থাকায় সেটা সে বুঝতে পারে নি । ওদের দিকে তাকিয়ে বলল
-হ্যা কি বলছিলেন ?
-বলছিলে যে আপনি কি অফিসের পর ফ্রি ?
মিতু একটু চিন্তা করলো । তারপর বলল
-হ্যা তেমন কোন কাজ নেই বাসায় যাওয়া ছাড়া ।
-তাহলে চলুন আমাদের সাথে !
-কোথায় ?
-আমরা যাচ্ছি । চলুন ভাল লাগবে ।
মিতু কিছু আগেই চাকরিতে জয়েন করেছে । এখনও কলিগদের সাথে তেমন ভাল সম্পর্ক তৈরি হয়ে ওঠে নি । তাই রাজি হয়ে গেল বাইরে যাওয়ার জন্য । এক সাথে চাকরির বাইরেও যদি ঘোরাফেরা করে তাহলেই অফিসে একটা চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হবে সবার সাথে ।
অফিসের পরে ওরা কয়েক জায়গাতেই ঘুরে বেড়ালো এক সাথে । তারপর একটা সময়ে একটা আর্ট গ্যালারীর সামনে এসে হাজির হল । ওরা জানালো যে আজকে অনিক রায়হানের ছবি প্রদর্শনী চলছে এই আর্ট গ্যালারিতে । কথাটা শুনতেই মিতু যেন একদম জমে গেল । বারবার মনে হল এখানে এভাবে চলে আসাটা মোটেই উচিৎ হয় নি ওর । এখনই চলে যাওয়া উচিৎ !
কিন্তু যেতে পারলো না । যন্ত্রের মত এগিয়ে চলল আর্ট গ্যারালির দিকে । বুকের ভেতরে একটা ঢিপঢিপ আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলো ও । ওর কেন জানি মনে হল আজকে অনিকের সাথে ওর ঠিকই দেখা হয়ে যাবে । এই কয়টা বছর ও অনিকের কাছ থেকে নিজেকে একদমই লুকিয়ে রেখেছে । ওর আর অনিকের মধ্যে যা শেষ হয়ে গেছে তারপরেও যদি আবার ও অনিকের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতো তাহলে নিজের কাছেই ও ছোট হয়ে যেত । বিশেষ করে ও নিজেই যখন অনিকের সাথে সব সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছিলো ।
অনিকের ছবি তোলার হাত শুরু থেকেই খুব ভাল ছিল । মিতুর সাথে ওর প্রথম পরিচয়টাও এই ছবি তোলা নিয়েই হয়েছিলো । মিতু সেই বই মেলা চলছিলো । মিতু ঘুরে ঘুরে স্টলে বই দেখছিলো এমন হঠাৎ একটা অচেনা ছেলে ওর কাছে এসে বলল
-আচ্ছা দেখুন তো এই ছবিটা কেমন হয়েছে ?
মিতু খানিকটা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার দিকে । ছেলেটার মাথায় সম্ভবত কোন সমস্যা আছে । কিন্তু ক্যামেরার দিকে তাকাতেই ওর চোখ কপালে উঠলো । কারন ক্যামেরার স্ক্রিনে ওর নিজের ছবি দেখা যাচ্ছে । মিতুর মেজাজটা মুহুর্তেই খারাপ হয়ে গেল । ছেলেটা ওর অনুমতি না নিয়েই ছবি তুলেছে । মুখটা রাগান্বিত হয়ে ছেলেটার দিকে তাকালো । কিন্তু ছেলেটার সেদিকে কোন লক্ষ্য নেই । সে একের পর এক ছবি দেখিয়েই যাচ্ছে ।
মিতু বলল
-আপনার সাহস তো কম না ? আপনি আমার ছবি কেন তুলেছেন ?
-আরে আমি একজন ফটোগ্রাফার । যা দেখি, পছন্দ হলেই ছবি তুলি !
-তাই বলে আমার কাছে অনুমতি না নিয়ে ছবি তুলবেন ?
-আরে বাবা এখন অনুমূতি নিচ্ছি । যদি ছবি পছন্দ না হয় মুছে দেব । নো বিগ ডিল ! আগে আপনি দেখুন তো ! ঐ জায়গাতে বসে দেখুন ।
সামনে একটা বসার জায়গা দেখালো । মিতু কিছু বলতে গিয়েও বললো না । কারন ক্যামেরার স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে নিজের ছবিটা দেখতে পেল । ছবিটা বেশ ভাল হয়েছে । এক বার ছেলেটার দিকে তাকিয়ে তারপর হাত থেকে ক্যামেরাটা নিয়ে নিল । বেঞ্চটার উপর বসে ছবি গুলো দেখতে লাগলো ।
কম করে হলেও ছেলেটা ওর গোটা পঞ্চাশেক ছবি তুলেছে । এবং প্রায় সব গুলো ছবিই ওর পছন্দ হল । এতো চমৎকার ছবি ওর কেউ কোনদিন তুলে দেয় নি । যে রাগটা ছবি সেটা নিমিষের গায়েব হয়ে গেল । ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল
-এভাবে বিনা অনুমতি কারো ছবি তোলা উচিৎ নয় তবে ছবি খারাপ তুলেন না আপনি ।
-আমি জানি তো !
বলেই ছেলেটা হাত বাড়িয়ে দিল । বলল
-আমার নাম অনিক রায়হান । আপনি ?
-মিতু । আমি ছবি গুলো কিভাবে পাবো ?
-আপনার ফেসবুক আইডি দেন । আমি পাঠিয়ে দেব ?
তারপর থেকেই মিতুর সাথে ঘন ঘন দেখা হতে লাগলো । মিতু আস্তে আস্তে বুঝতে শুরু করলো অনিক ওকে পছন্ড করতে শুরু করেছে । এবং ও নিজেও ওকে পছন্দ করতে শুরু করেছে । এভাবেই আস্তে আস্তে ওদের সম্পর্কটা চমৎকার ভাবে এগিয়ে চলছিলো । দেখতে দেখতে অনিকের গ্রাজুয়েশন শেষ হয়ে গেল । মিতু তখন আশা করেছিলো এবার অনিক চাকরির জন্য চেষ্টা করবে । একটা চাকরি হয়ে গেলেই বাসায় ওর কথা বলতে পারবে ।
কিন্তু মিতু অবাক হয়ে জানতে পারলো যে অনিকের চাকরি বাকি করার কোন ইচ্ছে নেই । ও ফটোগ্রাফিকে নিজের পেশা হিসাবে নিতে আগ্রহী । এটা জানার পরে ও যেন আকাশ থেকে পড়লো । মিতু কেবল ভেবেছিলো যে অনিক কেবল শখ থেকে ছবি তোলে কিন্তু এমন একটা পাগলামো সে করতে পারে সেটা মিতুর মাথাতেই আসে নি ।
মিতুর সিদ্ধান্ত নিতে খুব একটা সময় লাগে নি । একটা সময় ও অনিককে বলেছিলো ও যদি নিজের সিদ্ধান্ত না বদলায় তাহলে ওর পক্ষে কিছুতেই আর সম্পর্ক রাখা সম্ভব না । কথাটা শোনার পরে অনিক খানিকটা আহত চোখে তাকিয়ে রইলো । মিতুর সেই চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে খানিকটা ছোট মনে হয়েছিলো । ছবি তোলার পেছনে অনিকের আবেগটা কত সেটা সে জানে আর নিজের ভবিষ্যতের জন্য সে অনিকের স্বপ্নটাকে ও কত সহজেই না ছেড়ে দিতে বলল । তারপর আর অনিকের সাথে ওর দেখা হয় নি । কেবল জানতে পেরেছিলো অনিক বাইরে গিয়েছে ফটোগ্রাফির কোন একটা কোর্স করতে ।
কদিন একটু কষ্ট হয়েছিলো কিন্তু তারপর মিতু ভুলে গিয়েছিলো । ভুলে যেতে হয়েছিলো । তারপর মিতু নিজের পড়াশুনা শেষ করলো । এভাবেই দিন কারছিলো । তারপর একদিন হঠাৎ জানতে পারলো অনিক রায়হান নামের একজন ফটোগ্রাফার শহরে খুব বিখ্যাত হয়েছে । কয়েকটা প্রদর্শনীও হয়েছে । প্রত্যেকবারই সব গুলো ছবি বিক্রি হয়ে যায় প্রথম দিনই । এই অনিক যে কোন অনিক সেটা চিনতে খুব একটা কষ্ট হয় নি ।
মিতু আর্ট গ্যালারির ভেতরে ঘুরতে লাগলো । ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলো এমন সময় একটা ছবির দিকে ওর চোখে চলে গেল । ছবিটার দিকে তাকিয়ে ওর আবারও বুকের ভেতরে অন্য রকম একটা অনুভূতি হল হল । কারন ছবিটা ওর নিজের ছবি । কিন্তু এতো ইফেক্ট ব্যবহার করা হয়েছে ভাল করে না তাকালে চেনা যাচ্ছে না । ছবিটা অনেক দিন আগে তোলা । ছবিটার দিকে একভাবে তাকিয়ে রইলো ও । মিতুর হঠাৎ কেন যেন কান্না এল খুব । কি করবে ঠিক মত বুঝতেও পারলো না । এখনই কি চলে যাবে এখান থেকে?
সেই সময়ই দেখতে পেল অনিককে । কি হাস্যোজ্জল চেহারা অনিকের । সবার দিকে তাকিয়ে আছে আত্মবিশ্বাস নিয়ে । ওকে ঘিরে ধরেছে ওর ভক্তরা । ভেতরে ওর কলিগরাও আছে ।
মিতু কেবল তাকিয়ে রইলো সেদিকে । সেদিন যদি অনিককে ওভাবে দুরে ঠেলে না দিত তাহলে আজকে হয়তো এই ভীড়ের দিকে নিশ্চিন্তে এগিয়ে যেতে পারতো ও । নিজের ভবিষ্যতের চিন্তা নিয়ে এতোই যে চিন্তিত ছিল যে অন্য কিছু তার চোখেই পড়ে নি ।
ভালোবাসার গল্প গুলো এভাবেই অসমাপ্ত রয়ে যায় হয়তো !
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে অক্টোবর, ২০১৮ রাত ১০:২০