-আপু, ম্যাডাম ফোন দিছে।
নীতু এক মনে জানালার কাঁচ নামিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়েছিল। সন্ধ্যা নেমে গেছে অনেক আগেই। এই সময়টাতে ঢাকার রাস্তা গুলোতে একটা অসহ্য রকমের গুমট ভাব থাকে। রাস্তা ঘাটে গাড়ির ভীড় আর যানযট। আজও রাস্তায় গাড়ির চাপ বেশ ভাল রকমেই আছেই তবে সেই গুমট ভাবটা নেই। এই জন্যই সম্ভবত নীতুর ভালই লাগছে। সেই সাথে একটা সুক্ষ্ম টেনশনও কাজ করছে। সেটা মন থেকে দূর করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। আনমনা হয়েই ছিল তখনই ড্রাইভার সবিরের কথায় বাস্তবে ফিরে এল। বলল
-কি বললেন সবির ভাই?
-ম্যাডাম ফোন দিছে। আপনে ভুল কইরা ফোন বাসাতেই রাইখা আইসেন। চিল্লাইতাছে ।
-ও। কই দেন।
বলে ফোনটা হাতে নিল। ফোন কানে নিয়ে হ্যালো বলতেই নীতুর মায়ের এতো গুলো বকা কানে এল। যার কিছুই নীতু বুঝতে পারলো না। একটা সময় পরে নীতু বলল
-আম্মু একটু চুপ করবা! একটা শুভ কাজে যাচ্ছি, কই তুমি একটু মিষ্টি কথা বলবা, তা না চিৎকার চেঁচামিচি করছো!
এই কথায় কাজ হল। নীতুর আম্মু চুপ করে গেলেন। তার পরই মোলায়েম কন্ঠে বললেন
-তুই যে মোবাইল রেখে গেছিস এখন মিনহাজকে চিনবি কিভাবে?
-আম্মু চিন্তা কর না তো। আমি তো জানি সে আমার জন্য অপেক্ষা করছে। একবার চোখ বুলালেই চিনে ফেলবো। তুমি চিন্তা করছো কেন?
নীতুর আম্মু কি বলবে আর খুজে পেল না। আবারও কিছু সময়ের বিরতি। তারপর বললেন
-শোন, এইবার কিন্তু আর কোন অযুহাত নয়। তোর বাবার খুব পছন্দ হয়েছে। আমাদের সবারই খুব পছন্দ হয়েছে ছেলেকে।
নীতু খানিকটা হতাশ কন্ঠে বলল
-বুঝতে পারছি । এবারই আমাকে ঝুলে পড়তে হবে । চিন্তা কর না । তোমাদের পছন্দমত ছেলের সাথে ঝুলে পড়বো ।
ফোন রেখে নীতুর মনটা আরও খানিকটা খারাপ হয়ে গেল । কত কিছু করতে চেয়েছিলো জীবনে কিন্তু আর বুঝি কিছুই করা হবে না । বিয়ে করে বাঙালী নারীর মত গৃহিণী হয়ে যেতে হবে ।
সাতাশ নাম্বারের ফোর সিজন রেস্টুরেন্টে ছেলের সাথে দেখা করার কথা নীতুর । ছেলের নাম মিনহাজ । বুয়েট থেকে পাশ করা মস্ত বড় ইঞ্জিনিয়ার । এই তথ্য ছাড়া নীতুর কাছে আপাতত আর কিছু নেই । অবশ্য সেটা নিয়ে নীতু খুব একটা চিন্তিত হল না । রেস্টুরেন্টের দুই তলাতে গিয়ে হাজির হল । পুরো রেস্টুরেন্টে একবার চোখ বুলিয়ে নিল ।
প্রায় সব টেবিলই দখল হয়ে আছে । এদের ভেতরে প্রায়ই সবাই কাপল নয়তো ফ্যামিলি । কেবল এক কোনার দিকে একটা ছেলে চুপ করে বসে আছে । নীল রংয়ের একটা শার্ট পরে আছে ।
নীতু পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেদিকে । টেবিলের সামনে গিয়ে দাড়াতেই ছেলেটা নীতুর দিকে তাকালো । ছেলেটার চোখে চোখ পড়তেই নীতুর বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো !
কোন মতে বলল
-মিনহাজ ?
ছেলেটা একটু যেন অপ্রস্তুত হাসি হেসে বলল
-হ্যা !
নীতু আর কিছু জানতে না চেয়ে সামনের চেয়ার চেনে বসে পড়লো । ও নিশ্চিত জানতো যে ছেলেকে সে খুজে পাবেই । ও মা ওকে আগে থেকেই মিনহাজের ছবি দেখাতে চেয়েছিলো কিন্তু নীতু দেখতে চায় নি । ওর কথা হচ্ছে যখন এখানে আমাকে জোর করে তোমরা বিয়ে দিবাই তখনই দেখে কি লাভ ! এর থেকে একেবারে স্টেজে গিয়েই দেখলে হবে ।
তবে মিনহাজ কে দেখে নিতুর ধারনা একদমই ভুল প্রমানিত হল। ও ভেবেছিলো ছেলে আসবে স্যুট পরে । একেবারে পুরোপুরি ফরমাল হয়ে । বুয়েট থেকে পাশ একটা বেসরকারি সংস্থায় চাকরিতে ঢুকেছে । কদিনের মাঝেই আবার বাইরে যাবে পিএইচডি করতে । যাওয়ার আগে বিয়েটা সেরে ফেলতে চাইছে ।
অবশ্য এতে নিতু মোটেই দুঃখিত নয়। বরং মনে মনে মনে খুশিই হল। যাক মানুষটা যেমন ভেবেছিলো প্রথম দর্শনে তেমন কেউ না । সব থেকে ভয়ে ছিল ছেলের মোঁচ । নীতুর এমনি বিয়ের ব্যাপারে তেমন কোন চাওয়া ছিল না । কেবল চাইতো কিছু দিন পরে যেন বিয়েটা হোক । সেটা যখন আর হল না তখন আপাতত এই চাওয়ার ছিল যেন ছেলের মোঁচ না থাকে । মিনহাজের মোঁচ নেই দেখে খুবই খুশি হল ।
নীতুর সব চেয়ে ভাল লাগছে ছেলেটার চোখের দৃষ্টি ! কি নমনীয় আর মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছে । চোখে একটা ভাল লাগা রয়েছে বুঝতে পারছে । নীতুর নিজের কাছেই হাসি চলে এল । মেয়ে দেখতে এসেই দেখি এই ছেলে এখনই ওর প্রেমে পরে যাচ্ছে !
নীতু বলল
-আপনি কিছু জিজ্ঞেস করবেন না ?
মিনহাজ বলল
-সব জানিই । আর কি জানতে চাইবো ?
-কিছুই জানার নেই ?
-না । আপনি চাইলে কিছু বলতে পারেন ।
-আসলে আমার কিছু জানার নেই । জানতে চেয়ে লাভও নেই । আপনার সাথে আমার বিয়ে হবেই । মানে বাবা দিবেই !
মিনহান যেন ওর কথা শুনে একটু কষ্ট পেল । তারপর বলল
-কেন আপনার ইচ্ছে নেই ? দেখুন আপনি রাজি না থাকেন আমাকে বলতে পারেন । আমি বিয়েটা আটকানোর ব্যবস্থা করবো !
নীতু বলল
-এটা হয়তো পারবেন কিন্তু এর পরেরটা ? সেটা আটকাবেন ?
-ও !
-তবে একটা কাজ করতে পারেন ? করবেন ?
-বলুন
-আপনি কি বিয়েটা বছর খানেক আটকাতে পারবেন ?
-বছর খানেক ?
-হ্যা !
মিনহাজ কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলল
-যদি এমন হয় আমাদের এঙ্গেইজমেন্ট হয়ে থাকলো । ডেট টা পরে ফেললাম । চলবে ?
নীতু খানিকটা অবাক হয়ে বললাম
-আপনি করবেন এটা ?
-কেন করবো না ? আর এই সময়ের মাঝে আমরা একে অন্যের সাথে বেশি মিশতে পারবো । তাই না ?
সত্যিই সত্যিই নীতুর মনটা ভাল হয়ে গেল । এতো যে আনন্দ লাগছে যে বলে বোঝাতে পারবে না ।
মিনহাজের সাথে দেখা শেষ করে যখন আবার গাড়িতে এসে বসলো তখন ওর মনটা সত্যিই খুব ভাল । এখানে আসার আগে মনের ভেতরে একটা মন খারাপের অনুভুতি ছিল । সেটা একেবারেই চলে গেছে । এখন মনে হচ্ছে বিয়ে করাটা আসলে অতটা খারাপ কোন ব্যাপার না । একটা ভাল নিয়েই গাড়িতে উঠে বসলো ।
গাড়িতে উঠে বসতেই ড্রাইভার সবির বলল
-ম্যাডাম ফোন দিছিলো কয়েকবার !
নীতু সেদিকে বেশি খেয়াল দিল না । ওর মনে তখন মিনহাজের কথাই ঘুরে বেড়াচ্ছে । ফোনটা না এনে মনে হচ্ছে একটু ভুলই করেছে । বাসায় গিয়ে সবার আগে মিনহাজকে ফোন দিতে হবে । ওর সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে এখনই !
কিন্তু বাসায় গিয়ে একটা বড় রকমের ধাক্কা খেল । নীতুর মা তো ওকে ধমকের পর ধকম দিতে লাগলো । নীতু নাকি মিনহাজের সাথে দেখাই করে নি । নীতু যতই বোঝানোর চেষ্টা করে যে সে করেছে দেখা করেছে । তারপর নীতুর মা তখন মিনহাজের ছবি দেখালো । নীতু কেবল অবাক হয়ে দেখলো ও একটু আগে যে মিনহাজের সাথে দেখা করে এসেছে সেই মিনহাজের সাথে এই ছবির মানুষের কোন মিলই নেই । সব চেয়ে বড় কথা এই ছবির মানুষের একটা বড় মোঁচ আছে । নীতুর মা ওর উপর চিৎকার করতেই থাকলো । মিনহাজ নাকি ফোর সিজনের তিন তলাতে বসে ছিল । নীতু গিয়ে হাজির হয় নি ।
নীতু মায়ের দিকে কেবল অবাক তাকিয়ে রইলো । ওর স্পষ্ট মনে আছে ওর মা বলেছিলো মিনহান দুই তলায় বসে থাকবে । ভুল টা হয়েছে সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । তবে সেটা ঠিক হতেও সময় লাগলো না । ওর বাবা এবার আর কোন ঝামেলাতে গেলেন না । আসল মিনহাজ এবং তার পরিবারকে সরাসরি বাসাতেই ডাক দিলেন । কথা বার্তা দেখা শুনে সব চোখের সামনে হল ।
কিন্তু নীতুর কিছুই ভাল লাগছিলো না । যে মিনহাজের সাথে তার দেখা হয়েছিলো তাকে কিছুতেই মন থেকে ভুলতে পারছিলো না । নমনীয় হাসি ওর দিকে ভাল লাগার চোখে চেয়ে থাকা কিছুতেই ভুলতে পারছিলো না ।
নীতু কিছু বলতে চেয়েছিলো কিন্তু বাবার জন্য কিছু বলার সযোগ পেল না । ঠিক হল সামনের মাসের নীতু এঙ্গেইজমেন্ট হবে ফোর সিজন হোটেলে । তার মাস খানেক পরেই বিয়ে । নীতুর কেবল কান্না আসতে লাগলো । কাউকে কোন কথা বলতে পারলো না । সেই মানুষটার যোগাযোগের কোন উপায়ও রইলো না । কোন দিন হয়তো সেই মানুষটার সাথে দেখাও হবে না ।
দেখতে দেখতে বাকদানের দিন চলে এল । সবাই মিলে হাজির হল ফোর সিজন হোটেলের তিন তলাতে । অনুষ্ঠান শুরুই হবে তার আগেই নীতু ওর মাকে বলে একটু বাথরুমের দিকে পা বাড়ালো । ওর এক বুক ফেঁটে কান্না আসছে । এখন সবার সামনে কান্না করা যাবে না । তাই বাথরুমে গিয়ে কিছুটা সময় কান্না করে আসবে ।
ওয়াশ রুমের দিকে পা বাড়াতেই দরজাতে এক ওয়েটারকে দেখতে পেল । ওয়েটার ওকে বলল
-ম্যাম আমরা খুবই সরি । আসলে একজন গেস্ট লেডিস ওয়াশ রুমে বমি করে ভাসিয়ে ফেলেছে । আপনাকে একটু কষ্ট করে দুই তলার ওয়াশ রুমে যেতে হবে ।
নীতুর মনে হল যাবেই না ওয়াশ রুমে কিন্তু না গিয়েও পারলো না । খানিকটা বিরক্ত নিয়েই দুই তলার ওয়াশ রুমের দিকে রওনা দিল । নারী আর পুরুষ ওয়াশরুম পাশাপাশি । যখনই ওয়াশ রুমের দিকে যেতে যাবে তখনই অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো পুরুষ ওয়াশ থেকে একজন বের হয়ে আসছে । সে আর কেউ নয়, সেই দিনের সেই মিনহাজ ! ওর দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় !
নীতু কি বলবে খুজে পেল না । দেখা হবে তো আজকেই ! আর সময় পেল না ?
মিনহাজ এগিয়ে এসে দাড়ালো ওর দিকে । কোন কথা খুজে পাচ্ছে না । কি বলবে !
নীতু কেবল বলল
আজকেইকেন দেখা হতে হবে ? কেন আগে এলেন না আমি !
মিনহাজ কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলল
-বাসায় গিয়ে বুঝতে পারলাম যে আমি ভুল মেয়েকে দেখে এসেছি কিন্তু আমার আর সঠিক মেয়ের সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হয় নি ।
নীতু বলল
-আমি বাধ্য হয়েছি সঠিক মিনহাজের সাথে দেখা করতে । আজকে আমার বাগদান !
-ও !
মিনহাজ কি বলবে খুজে পেল না । নীতু বলল
-আর একটা দিন আগে দেখা হতে পারতো না ?
-কোন কি উপায় ছিল ? শেষে আমি প্রতিদিন ঐ একটা স্থানে বসে থেকেছি যদি আপনি আসেন ! ঐদিনের পর থেকে প্রতিদিন !
নীতুর বুকটা হুহু করে উঠলো । কি বলবে খুজে পেল না । ছেলেটা কেমন বেদনা ভরা চোখ নিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে । মাত্র একটা দিন ওদের কথা হয়েছে অথচ মনে হয়েছে যেন ছেলেটাকে কতদিন ধরে চেনে । ওর একটা বারও মনে হয় নি যে ছেলেটা ওর জন্য এখানে অপেক্ষা করতে পারে !
মিনহাজ বলল
-তাহলে এটাই শেষ দেখা !
মিনহাজ চোখের দিকে তাকিয়ে নীতুর মনে হল এই ছেলেটার মত ভাল ওকে আর কেউ বাসতে পারবে না । অন্তত ঐ মোঁচওয়ালা ইঞ্জিনিয়ার তো নয়ই । নীতু খুব সাহসী একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সাথে সাথেই । বলল
-আপনার কাছে কোন যান বাহন আছে ! নয়তো চট জলদি একটা ট্যাক্সির ব্যবস্থা করতে পারবেন ?
-কোথায় যাবেন ?
-গাধা ! আমি আপনার সাথে পালানোর কথা বলছি !
মিনহাজ কেবল অবাক হয়ে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো । যেন বিশ্বাস করতে পারছে না নীতু কি বলছে । কোন মতে বলল
-আমার কাছে বাইক আছে !
নীতু বলল
-আমি জানি না কি করতে যাচ্ছি কিন্তু যদি কাজটা না করি তাহলে সারা জীবন আমার আফসোস থেকে যাবে ।
এই বলে মিনহাজের হাত ধরলো । তারপর বলল
-চলুন !
ওরা কিভাবে রেস্টুরেন্টের বাইরে এল কেউ বলতে পারবে না । নীতু তাকিয়ে দেখছিলো মিনহাজ ছেলেটা সত্যিই একটা এফজেড ফাইফ নিয়ে হাজির হল ওর সামনে । যখন বাইকে চড়ে বসলো তখন ওর চোখ গেল তিনতলার গ্লাস দিয়ে অবাক হয়ে সেই মোঁচওয়ালা মিনহাজ অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে । এখনও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না ।
মিনহাজ বাইক স্টার্ট দিল । নীতু বাইকে উঠে বসতে বসতে ভাবলো ও জীবনে এতো সাহসের কাজ কোন দিন করে নি । তবে ওর ভয় লাগছে না । এতোদিন ধরে যে অনুভুতিটা কাজ করছিলো যে কিছু একটা যেন ঠিক হচ্ছে না সেটা মিলিয়ে যাচ্ছে । মনে হচ্ছে একদম সঠিক কাজটাই করতে যাচ্ছে !
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:৫০