ঘন্টা পড়েছে একটু আগেই । জাফর উল্লাহ রোল কলের খাতা নিয়ে ক্লাস রুমের দিকে এগিয়ে চলেছে । তার মেজাজ টা আজ বেশ চড়া । আজ সকাল থেকেই তার মেজাজ গরম হয়ে রয়েছে । গত কয়েক দিন থেকেই দেশে যা হচ্ছে তা তিনি কিছুতেই সহ্য করতে পারছে না । সব চেয়ে বড় কথা তার নিজের ক্লাসের ছেলেই কি না এই আন্দোলনে গেছে ।
তিনি বুঝতে পারছেন না এখানে ছাত্ররা কেন রাস্তায় নামবে ? আরে দোষী ড্রাইভারকে তো পুলিশ ধরেছে । ব্যাস খেল খতম !
কিন্তু না এখানে আবার আন্দোলন !
আজকে আন্দোলন বের করবেন তিনি ।
কলেজে আসতেই প্রিন্সিপালের রুমে তার ডাক পড়ে । প্রিন্সিপাল তাকে ভাল চোখে দেখে । অবশ্য এই জন্য তাকে বেশ কিছু কাজও করতে হয় । আজও তেমনই একটা কাজ করতে বলা হয়েছে তাকে । তাকে বলা হয়েছে তার ক্লাসে কেউ আন্দোলনে গিয়েছিলো কি না সেটা খোজ বের করতে । তারপর সেই ছাত্রকে তার কাছে নিয়ে আসতে বলা হয়েছে । তার ভাষ্যমতে একজন দুইজনকে টিসি দিয়ে বের করে দিলেই আর কেউ আন্দোলনে যাওয়ার সাহস পাবে না ।
প্রিন্সিপালের কাছ থেকে কাছ থেকে কথাটা শুনেই জাফর উল্লাহ মনে মনে ঠিক করে নিয়েছেন কাকে তিনি আজকে টিসি দেওয়ার জন্য ধরবেন । গতকাল রাতেই তিনি টিভিতে ছেলেটাকে দেখেছেন । ছেলেটার নাম সবুজ । খুব ভাল করে চেনে তাকে । তার কাছে একদিন পড়তে গিয়েছিলো তারপর আর যায় নি । তার নাকি ভাল লাগে নি পড়ানো । আজকে তাকে মজা দেখাবেন ।
ক্লাস রুমে ঢুকতেই জাফর উল্লাহ চোখ তুলে সবাইকে দেখলেন । তার চোখ খুজতে লাগলো পরিচিত সেই চেহারাটা ।
এই তো পেয়ে গেছেন ।
পেছনের বেঞ্চের আগের বেঞ্চে বসেছে । তিনি খাতাটা জোড়ে শব্দ করে রাখলেন টেবিলের উপর । তারপর সবার উদ্দেশ্য করে বললাম
-তোদের সাহস দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে । শত মানা করা স্বত্ত্বেও তোরা রাস্তায় নেমেছিস ? কে কে গেছিস আন্দোলনে ?
সবাই মাথা নিচ করে দাড়িয়ে রয়েছে । জাফর উল্লাহ আবার চিৎকার করে উঠলো ।
-কে কে গেছিস ?
কেউ কোন কথা বলল না । তিনি সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন । সবাই একটু ভয় পেয়েছে তার কন্ঠ শুনে ।
-বস সবাই ।
সবাই চুপ করে বসে পড়লো । তারপর জাফর উল্লাহ বলল
-সবুজ দাড়া !
সবুজ খানিকটা ইতস্তত করে আবার উঠে দাড়ালো । ওর হাতের দিকে তাকিয়ে দেখলো সাদা কাপড় দিয়ে ব্যান্ডেজ বাঁধা । জাফর উল্লাহ বলল
-তুই কেন গিয়েছিস আন্দোলনে ? মানা করার পরেও !
সবুজ কিছু বলল না । চুপ করে রইলো ।
-খুব নেতা হয়েছিস ? খুব বড় নেতা ? বেড়িয়ে আয় ! তোর আর কলেজে পড়তে হবে না । আজই তোকে টিসি দিয়ে বের করে দেব । বেরিয়ে আয় এখনই !
সবুজ কিছুটা সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো জাফর উল্লাহর দিকে । তারপর ব্যাগটা কাধে নিয়ে বেঞ্চ থেকে বের হওয়ার জন্য যেই এক পা বের করেছে তখনই জাফর উল্লাহ দেখতে পেল দ্বিতীয় সারি থেকে একজন উঠে দাড়ালো । এই ছেলেটা তার কাছে প্রাইভেট পড়ে । রাজিব নাম । তার খুব পছন্দের একটা ছেলে । আর তিনি এও জানেন সবুজকে এই রাজিব একদম দেখতে পারে না । তার কাছে বের কয়েকবার সবুজের নামে নালিশ দিয়েছে । জাফর উল্লাহ ভাবলো রাজিব নিশ্চয় সাক্ষি দেওয়ার জন্য উঠে দাড়িয়েছে । কিন্তু রাজিব বলল
-স্যার আমিও গিয়েছিলাম সবুজের সাথে । ওকে টিসি দিলে আমাকেও দিতে হবে !
জাফর উল্লাহ অবাক হয়ে তাকালেন রাজিবের দিকে । এমন কি সবুজও অবাক হয়ে তাকিয়েছে রাজিবের দিকে । সে ভাবতেও পারে নি রাজিব এমন একটা কথা বলতে পারে । জাফর উল্লাহ অবাক হলেও সামলে নিলো । তারপর বলল
-তোরা দুজনেই বেরিয়ে আয় !
রাজিব বের হতে যাবে তখন পেছন থেকে আরও দুজন ছেলে দাড়িয়ে গেল । দুজন এক সাথেই বলল
-স্যার আমরাও গিয়েছিলাম !
জাফর উল্লাহ কেবল অবাক হয়ে দেখলেন পরের এক মিনিটের মাথায় ক্লাসের প্রত্যেকটা ছেলে দাড়িয়ে গিয়েছে । সবাই গতদিন রাস্তায় নেমেছে । জাফর উল্লাহ কি করবেন বুঝতে পারলেন না । তিনি তখনই ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলেন । এক প্রকার দৌড়েই চলে গেলেন প্রিন্সিপালের ঘরে । ঘটনা খুলে বলতেই প্রিন্সিপালের চোখ আকাশ উঠলো । তারপরেও তিনি বললেন
-সবাইকে এখানে নিয়ে আসো ।
-কিন্তু স্যার পুরো ক্লাস !
-তো কি হয়েছে ? আপনি জানেন না এই কলেজের গভার্নিং বডিতে কে আছে ! কিছুতো একটা করতেই হবে ।
জাফর উল্লাহ কিছু বলতে গিয়েও বলল না । তিনি খুব ভাল করেই জানেন প্রিন্সিপাল কার কথা বলছে । আর কোন কথা বলল না । ঘর থেকে বের হতে যাবেন তখনই আরেক অবাক করা দৃশ্য দেখলেন । প্রত্যেকটা ক্লাস রুম থেকে পিলপিল করে ছাত্ররা বের হয়ে আসছে । সবাই এসে জড় হচ্ছে প্রিন্সিপালের রুমের সামনে ।
জাফর উল্লাহ আর প্রিন্সিপাল দুজনেই নিজেদের দরজার সামনে এসে দাড়িয়েছে । কারো মুখে কথা নেই ।
ভীড় থেকে একজন সামনে এগিয়ে এল । তারপর বলল
-স্যার সবাই রাস্তায় নেমেছি । আমার ভাই আর বোনের খুনের বিচার চাইতে নেমেছি । খুনের বিচার চাওয়া যদি অপরাধ হয় তাহলে আমরা সবাই অপরাধী । আপনি আমাদের সবাইকে বের করে দিন !
প্রিন্সিপাল কিছুটা সময় কেবল অবাক হয়েই ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে রইলো । কি তীব্র সেই চাহনী । তিনি তাকিয়ে থাকতে পারলেন না । নিজের কাছেও লজ্জিত লাগছে তার । একটু আগে তিনি কি ভাবছিলেন আর এখন কি দেখলেন !
ছাত্ররা দেখলো তাদের প্রিন্সিপাল ঘরের ভেতরে চলে গেল । ছাত্ররা দাড়িয়েই রইলো । ঠিক ৫ মিনিটের মাথায় স্কুলের মাইকে প্রিন্সিপাল স্যারের কন্ঠ শোনা গেল ।
"প্রত্যেক ক্লাস টিচারদের অনুরোধ করা যাচ্ছে আন্দোলনে যেতে ইচ্ছুক ছাত্রদের সাথে যাওয়ার জন্য । ছাত্রদের নিরাপত্তার দিকটা বিশেষ ভাবে দেখার জন্য বলা হচ্ছে তাদের । ছাত্রদের ন্যায্য দাবীর সাথে আমি একাত্বতা জানালাম"
পুরো কলেজ ক্যাম্পাসের ছাত্ররা একসাথে উল্লাস করে উঠলো । তাদের আন্দোলন চলবেই । আগে তো স্যারদের ভয়ে ভয়ে রাস্তায় নামতো তারা আজ থেকে স্যারেরা তাদের এই ন্যায্য আন্দোলনে সাথে আছে । চল চল সবাই আন্দোলনে চল !
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা আগস্ট, ২০১৮ রাত ১২:০৩