এক
দরজা দিয়ে শাফায়েতকে ঘরে ঢুকতে দেখে নীলু একটু নড়েচড়ে বসলো বসলো । এতোক্ষন খাটের উপর চুপ করে বসেছিল । মাথার উপর ফ্যান ঘুরছিল জোরে। ঠান্ডা একটা আবাহাওয়া চারিদিকে । তবে নীলুর মনে শান্তি নেই । একটা সুক্ষ কষ্টে বুকের ভেতরটা চিনচিন করছে ।
নীলু নির্দিষ্ট কিছু ভাবছিল না, তবে চিন্তা জুড়ে শাফায়েতই ছিল। কয়েকবার শাফায়েত সম্পর্কে ভাববে না বলে চেষ্টা করলেও মন থেকে কিছুতেই ওর চিন্তাটা বাদ দিতে পারে নি
যদি পরিস্থিতি অন্য রকম হত তাহলে এতোক্ষণ হয়তো শাফায়েতকে ঘরে ঢুকতে দেখে মিষ্টি করে হাসতো কিংবা ঘোমটা দিয়ে বসে থাকতো আর ভাবতো মানুষটা কখন এসে নিজের ঘোমটা খুলবে কিন্তু নীলু খুব ভাল করেই জানে এসব কিছুই এখন হবে না । নীলু এসব আশাও করে না। প্রিতম ছাড়া অন্য কারো ঘর করতে হবে এটাও কোন দিন ভাবে নি সে ! কিন্তু জীবনের সব কিছু তো আর নিজের মন মত হয় না ! জীবন চলে নিজের মত ।
শাফায়েতের দিকে চোখ পড়তেই দেখলো ছেলেটা হাসলো একটু ! নীলু হাসলো না ! কেবল শান্ত চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে । সেই চোখে কোন উত্তেজনা নেই । নেই কোন আগ্রহ । যে কোন নব বিবাহিত দম্পতির জন্য এরকম শান্ত সম্ভাষন খুব একটা স্বাভাবিক না । কিন্তু নীলুর কাছে এই ঠিক আছে ।
শাফায়েত নীলুর দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি এখনও জেগে আছো কেন ? ঘুমিয়ে পড় ।
-আপনি কোথায় ঘুমুবেন ?
শাফায়েত হাসলো আবার ।
-ভয় নেই। খাটে ঘুমুবো না । এও শোফা আছে এখানে । আর বাড়ি ভর্তি মেহমান । এখন বাইরে ঘুমানোর কোন উপায় নেই, তাই না ?
নীলু কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে বিছানায় শুয়ে পড়লো । চোখ বন্ধ করার আগে লক্ষ্য করলো যে শাফায়েত নিজের ল্যাপ্টপ খুলে বসেছে। বাসর রাতে নতুন বউ বিছানায় শুয়ে আর বর নিজের ল্যাপ্টপে কাজ করছে এমন দৃশ্যটা খুব একটা দেখাও যায় না !
নীলু কোন দিন ভাবে নি ওর সামনে এমন একটা দিন আসবে । প্রিতমকে ছাড়া অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা ও কোনদিন ভাবেও নি । কিন্তু আজকে অন্য এক মানুষের সাথে তার বিয়ে হয়ে গেছে । অন্য এক মানুষের সাথে সে বাসর রাত পার করছে । এমন কি হওয়ার কথা ছিল !
নীলু খানিকটা সময় ভাবার চেষ্টা করলো । হ্যা এমনটাই তো হওয়ার কথা ছিল । একজন মাদকাসক্ত ছেলের সাথে তার কোন ভাবেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল না । ওর বাবা হয়তো বেকার ছেলে সাথেও বিয়েটা মেনে নিতো কিন্তু মাদকাসক্ত ! ভালবাসার সম্পর্ক আর বিয়ে করা জীবন শুরু করাটা এক বিষয় না ।
বাবার চাপে যখন বিয়ের জন্য শাফায়েতের সাথে দেখা করতেই হল নীলু ভেবেছিল সরাসরি মানা করে দিবে । কিন্তু শাফায়েতের মুখ থেকে এমন অদ্ভুদ কথা শুনে ও নিজেই খানিকটা অবাক হয়ে গেল ।
শাফায়েতের কথা শুরুটাই ছিল অন্য রকম। ওরা একটা ফার্স্ট ফুডের দোকানে বসে ছিল । অনেক টা সময় চুপ থাকার পরে শাফায়েত বলল
-আমি জানি আপনি বিয়ে করতে প্রস্তুত না।
নীলু প্রথমে একটু অবাক হলেও সামলে নিল নিজেকে । তারপর বলল
-তাহলে, দেখা করার মানে কি ?
-আসলে আমি আপনার মতই একজন কে খুজছিলাম ।
-আমি ঠিক বুঝলাম না আপনার কথা ।
কিছুটা সময় শাফায়েত চুপ করে থেকে বলল
-আমি জানি আপনি একজনকে ভালবাসেন । মানে আপনার মনে অন্য একজন আছে । কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি সমাজ পরিবারের জন্য তার সাথে ঘর করা হয়ে উঠছে না ! তাই তো ?
-জি ।
-আমারও এরকম একজন আছে । কিন্তু ভাগ্যের কাছে আমি পরাজিত। জীবন চলেই যাচ্ছিলো এক ভাবে কিন্তু...
-কিন্তু ?
-পরিবার বলে তো একটা কথা আছে । শত হলেও বাবা মার কথা কিছুতেই ফেলে দেওয়া তো যায় না । যায় ? তাছার সমাজ বলেও একটা কথা আছে ! আছে না ?
নীলু কি বলবে ঠিক বুঝতে পারছিল না । শাফায়েত বলল
-আসুন আমরা একটা ডিল করা যাক ।
-কি রকম ?
-মানে সমাজ আর পরিবারকে শান্ত করার জন্য এই বিয়েটা আমরা করি । তারপর নিজেরা নিজেদের মতন। আপনি আপনার চিন্তা চেতনা নিয়ে থাকবেন আমি আমার টা । এক ছাদের নিচে হয়তো থাকবো কিন্তু একসাথে না ।
নীলু কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । নীলু খুব নিশ্চিত ভাবেই জানে যে এইখানে বিয়ে না হলে তার বাবা সমানে পাত্রদের লাইন লাগিয়ে দিবে ।
-আচ্ছা আমি আপনাকে পরে জানাই !
-ওকে । সময় নিয়ে ভাবুন । ঠিক আছে ?
বাসায় এসেও নীলু অনেক চিন্তা করেছে । কিন্তু কোন কূল কিনারা করতে পারে নি । শেষে আর কোন পথ না দেখে বিয়েতে রাজী হয়েছে ।
দুই
-আফা আর যামু না ?
-আর যাবে না মানে কি ?
-এটা কি ছবির হাট নাকি ?
-আফা সামনে গেলে পুলিশ ধরবো ?
-আরে এই কথা আগে বল নাই কেন ? আমি এতো দুর হেটে যাবো নাকি ?
-আফা ১০ টেকা কম দিয়েন । আর যামু না !
নীলু রিক্সাওয়ালার বিকার ভাব দেখে অবাক না হয়ে পারলো না । কথা ছিল ছবির হাট পর্যন্ত রিক্সাওয়ালা তাকে নিয়ে যাবে । কিন্তু এই টিএসসি পর্যন্ত এসেই রিক্সাওয়ালা বলছে আর যাবে না । কষে একটা চড় দিতে পারলো ভাল লাগতো, যে রাগটা উঠছে সেটা কমতো । কিন্তু চাইলেই সব কিছু করা যায় না ।
নীলু রিক্সা থেকে নেমে গেল । ছবির হাটে যেতে হলে এখনও বেশ খানিকটা পথ হাটতে হবে । নীলু কি করবে ঠিক বুঝতে পারলো না । ব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিয়ে টিএসসির দিকেই হাটতে লাগলো । বাসা থেকে বের হওয়ার সময় সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এখন সিদ্ধান্ত বদলালো । ওদিকে যাবে না । কি হবে ওদিকে গিয়ে ?
প্রিতম বিকাল হলে ওদিকেই আড্ডা মারে বন্ধুদের সাথে । আড্ডা তো না, অন্য কিছু করে ! আজও মনে হয় আড্ডা মারছে । গেলেই হয়তো দেখা হবে । ওকে দেখে কিছুই হয় নি এমন ভাব করে হয়তো বলবে, আরে নীলাঞ্জনা ? এতো দিন কোথায় ছিলে ?
সারাটা জীবন ছেলেটা এমনই রয়ে গেলে ! কোন কিছুতেই সিরিয়াস নয় ।
বিয়ের ঠিক আগের দিনও প্রিতম ওর সাথে এমন ভাবে কথা বলছিল যেন কিছুই হয় নি !
-কি ব্যাপার নীলাঞ্জনা ! এতো গম্ভীর কেন ?
-আগামীকাল আমার বিয়ে ।
-তাই নাকি ? শাফায়েত সাহেবের সাথেই তো ?
-তুমি এখনও সিরিয়াস না ? তোমার খুব মজা লাগছে না ?
-নীলু ! আমি খারাপ থাকলাম কবে বল ? থেকেছি কখনও ?
-না থাকো নি । কেবল আশেপাশের মানুষ গুলোকে খারাপ রেখেছো ?
প্রিতম কিছু না বলে পকেট থেকে সিগারেট বের করে ধরালো । প্রথমবার ধোঁয়া ছাড়ার পরেই নীলুর মনে হল সিগারেটের ভিতর নিশ্চয়ই অন্য কিছু ছিল । অন্য রকম একটা গন্ধ আসছে ওটা থেকে ।
নীলু প্রিতমের দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি কি খাচ্ছো ?
-দেখছো না ? সিগারেট !
-না । এতে অন্য কিছু আছে ? কি আছে ? গাজা ?
-বুঝতেই পারছো তখন কেন জানতে চাইছো ?
-তুমি এমন কেন বলতো ? সেদিন না বললে তুমি আর নেশা করবে না ? তাহলে ? আমাকে কি কথা দিয়েছিলে !
প্রিতম কথা না বলে সিগারেটের দিকে মন দিল । প্রত্যেকটা টান দিচ্ছে আর চোখ বন্ধ করে নেশাটা পুরোপুরি ভাবে অনুভব করছে যেন ।
নীলু বলল
-আমি আজকে বলতে এসেছিলাম চল পালিয়ে যাই ! আর তুমি ?
নীলু কথা শুনে প্রিতম হেসে ফেলল । হাসতে হাসতে বলল
-শুনো জীবন টা নাটক সিনেমা নয় ! পালিয়ে যাবো বললেই পালিয়ে যাওয়া যায় না । আর আমিও এমন কোন নায়ক নই যে নায়িকার ভালবাসার জন্য নেশা করা টা বন্ধ করে দেবো।
-ঠিকই বলেছো । আমার আসলে এখানে আসাটাই ভুল হয়েছে ।
-হুম ! তুমি বারবার ভুলই কর মেয়ে !
আসলেই বরাবরই সে ভুল করে । ভুল মানুষকে ভালবাসে ।
-আফা চা দিমু ?
পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখে রাস্তার পাশেই এক পিচ্চি চা ওয়ালা দাড়িয়ে রয়েছে । টিএসসির ভিতরে না ঢুকে রাস্তার পাশেই বসে পড়েছিল নীলু । চারিপাশের লোকজন কোলাহল দেখছিল । চিরোচেনা এই পরিচিত জায়গাটা ওর বরাবরই ভাল লাগে । এখানে আসলে একটু মন ভাল হয় ।
টিএসসির ভেতরে পরিচিত কেউ থাকতে পারে । এখন কারো সাথে দেখা করতে ইচ্ছে করছে না । তাই আর ভেতরে ঢোকে নি !
পিচ্চি চা ওয়ালার দিকে তাকিয়ে নীলু বলল
-না। এখন চা খাবো না ।
নীলু ভেবেছিল অন্য চা ওয়ালার মত পিচ্চিটা তাকে কিছুটা সময় জোড়াজুড়ি করবে । কিন্তু সেদিকে না গিয়ে চা ওয়ালার পেছন ফিরে হাটা দিল । হাটা দিতে দেখেই কেন জানি নীলুর চা খেতে মন চাইলো ।
-এই পিচ্চি ! এই !
কিন্তু পিচ্চি আর পেছন ফিরে চাইলো না । হাটতে হাটতে চলে গেল ।
-চা খাবে ?
নীলু চমকে উঠলো। চা খাওয়ার আহবানের কন্ঠ টা তার খুব বেশি পরিচিত । আসছে পেছন থেকে। তাকাবে না তাকাবে না করেও পেছন ফিরে তাকালো ।
সেই চিরোচেনা হাসি নিয়ে প্রিতম ওর দিকে হেটে আসছে । ওর ঠিক পাশে এসেই বসলো।
প্রিতম আবার বলল
-চা খাবে ?
-না।
-তাহলে পিচ্চি কে ডাকছিলে কেন ?
-এমনি ? তুমি হঠাৎ এখানে ? এটা তো তোমার জায়গা নয় !
-আমার জায়গা !! আমার আবার জায়গা বলে কিছু আছে নাকি ? আমার বলে কিছু নেই । সব পরের ।
নীলু কি বলবে বুঝতে পারলো না । প্রিতম বলল
-তারপর ? তোমার বিবাহিত জীবন কেমন কাটছে ?
-ভাল ।
-তোমার হাজব্যান্ড কেমন ?
-ভাল ।
-হুম ! বিয়ের পর প্রাক্তন প্রেমিক থেকে হাজব্যান্ড রা ভালই হয়ে যায় ।
খানিকটা যেন বিদ্রুপের সুরেই বলল কথাটা । নীলুর হঠাৎ কেন জানি প্রিতমের উপর খুব মেজাজ গরম হয়ে গেল । ওর দিকে তাকিয়ে কঠিন কন্ঠে বলল
-তা তো হবেই । একজন নেশাখোর থেকে একজন ভাল মানুষকে তো ভালই লাগবেই । যে ভালবাসা মূল্য বোঝে না, প্রেমিকার বাঁচলো কি মরলো সেদিকে যার কোন লক্ষ্য নেই জন্য কষ্ট পেয়ে কি লাভ !
-এই নেশা খোরকেই তো ভাল বেসেছিলে একদিন ।
-চরম ভুল ছিল ! তুমিই তো আমি বরাবরই ভুল করি ।
নীলু নিজের রাগ সামলানোর চেষ্টা করছে । কিন্তু কিছুতেই যেন রাগ থামছে না ।
প্রিতমের দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি আমার সামনে থেকে যাও তো ? তোমাকে দেখলে অসহ্য লাগছে !
-চলে যাবো ?
-হুম চলে যাবে ।
-সত্যি ই চলে যাবো ?
-হ্যা !
-ভেবেছিলাম তোমার সাথে আজ দেখা হলে তোমাকে নিয়ে আমাদের হলে পুকুর পাড়ে একটু বসবো । ওখানে দারুন শাপলা ফুল ফুটেছে । তোমার ভাল লাগতো !
-তুমি এক্ষুনি আমার সামনে থেকে চলে যাও ! এখনই !
প্রিতম আর কিছু না বলে উঠে চলে গেল । প্রিতম চলে যাওর ঠিক কিছুক্ষন পরেই নীলুর মনে হল ওর সাথে পুকুর পাড়ে গেলেই হত । কি এমন ক্ষতি হয়ে যেত । আর বাসা থেকে বের হওয়ার সময় ও পরিকল্পনাই ছিল প্রিতমের সাথে দেখা করার !
তাহলে ?
প্রিতম নিশ্চই পুকুর পাড়ে গিয়েছে । এর আগে কতটা বিকেল কত সন্ধ্যা ওখানে গিয়ে বসে থেকেছে দুজন । কত রাজ্যের কথা বলেছে একে ওপরের সাথে । প্রিতমে মাঝে মাঝে ওকে গলায় গান শুনিয়েছে ওকে অথবা কবিতা শুনিয়েছে । ওকে নিয়ে লেখা কবিতা !
আচ্ছা আজকে কি ওকে গান শোনাবে ?
নীলুও পুকুর পাড়ের দিকে হাটা দিল !
তিন
নীলুর কান্না আসতে লাগলো খুব বেশি । পুকুর পাড়ে এসেও সে প্রিতম কে খুজে পেলো না কোথাও । ফোন যে করবে সেই উপায় আর নেই । প্রিতম ওর বিয়ের পরপরই মোবাইল নাম্বার বদলে ফেলেছে । আর তাছাড়া কদিন পর পরই নেশা করার জন্য প্রিতম নিজের মোবাইল বিক্রি করে দেয় । তখন আর ওর খোজ খবর নেওয়ার কোন উপায় থাকতো না ।
নীলু কি করবে ঠিক বুঝতে পারলো না । এভাবে এখানে একা একা বসে থাকার কোন মানে নেই । এখানে বসে থাকলে হয়তো ওর মন আরও খারাপ হবে । কিন্তু একা একা ওর কোথাও যেতেও মন বলছে না । কোন কারন নেই তবুও নীলু মোবাইলটা বের করে শাফায়েত কে ফোন দিল । কেন দিল সেটা ও নিজেও জানে না ।
-আপনি কোথায় ?
-এই তো অফিস শেষ করে বের হচ্ছি !
-একটু টিএসসির দিকে আসতে পারবেন ?
-এখন ?
-হুম ! আমি এখানে আছি । কেন জানি একা একা বাসায় যেতে ভাল লাগছে না । আমাকে যদি একটু নিয়ে যেতেন ! তবে খুব সমস্যা হলে দরকার নেই !
-না না ! ঠিক আছে । আমি আসছি ! তুমি ওখানেই থাকো !
ফোন কেটে দিয়ে শাফায়েত একটু অবাকই হলে । নীলুর সাথে বিয়ে হয়েছে প্রায় মাস খানেক পার হয়েছে । নিজেদের বাসায় চলে এসেছে তার পরপরই । কিন্তু এর আগে নীলু এমন করে ফোন দেয় নি কোন দিন ।
বাসায় থাকতে টুকটাক কথা অবশ্য হয়েছে । তারপর ও অফিস চলে আসার পরে আর কোন কথা হয় না । খাবার টেবিলে একটু কথা হয়। খাওয়া শেষে শাফায়েত নিজের স্টাডি রুমে চলে যায় । নীলু টিভির ঘরে বসে টিভি দেখে ।
বিয়ের পরে নিজের স্টাডি রুমটাতেই একটা সিঙ্গেল খাট লাগিয়ে নিয়েছে । এখানেই রাতে ঘুমায় । নীলু ঘুমায় ওদের শোবার ঘরে । আজকে হঠাৎ এমন কি হয়ে গেল । শাফায়েত দ্রুত গাড়ি চালালো টিএসসির দিকে ।
চার
সন্ধ্যা হয়েছে অনেক আগেই । নীলু চুপ করে পুকুর পাড়ে বসে আছে । জায়গাটা হঠাৎ করেই যেন নির্জন হয়ে গেছে । অবশ্য নীলুর তেমন একটা ভয় লাগছে না । কারন পাশে শাফায়েত বসে আছে । নীলুর ইচ্ছে ছিল শাফায়েত আসলেই ওর সাথে ফিরে চলে যাবে । কিন্তু এখানে আসতেই শাফায়েত বলল
-একটু বসি এখানে ?
নীলু খানিকটা সময় অবাক হয়ে বলল
-এখন ?
-হ্যা যদি সমস্যা না থাকে আর ! এদিকে তো আর আসাই হয় না । কতদিন পরে আসলাম !
নীলু আর কোন কথা বলে নি । চুপ করে বসে পড়লো । অন্ধকারের ভেতরে দুজন মানুষ চুপ করে বসেই রইলো কতটা সময় । হঠাৎ করেই নীলু অবাক হল শাফায়েত মৃদ্যু কন্ঠে গান শুরু করেছে । পুরো নির্জন পুকুর পাড়ে সেই গান যে অদ্ভুদ নেশা ছড়াচ্ছে । নীলু কেবল মন্ত্র মুগ্ধের মত গান শুনতে লাগলো । শাফায়েতের কন্ঠ যে আহামরি সুন্দর সেটা না তবে এই পরিবেশে বেশ লাগছে ওর । শাফায়েত মোটামুটি গানের রেওয়াজ করেছে সেটা শুনেই বুঝতে পারলো । কখন যে গানের ভেতরেই হারিয়ে গেল সেটা ও বুঝতেই পারলো না । যখন যখন শেষ হল তখনও যেন নীলুর ঘোর কাটে নি ।
-চুপ করলেন কেন ?
শাফায়েত একটু হাসলো । এই অন্ধকারের ভেতরেই । তারপর বলল
-এক সময় গানটান গাইতাম !
-এখন আর গান না ?
-নাহ ! আর গাওয়া হয় না । আসলে যাকে পছন্দ করতাম গান গুলো ছিল তার জন্যই । ভেবেছিলাম তাকে গান শোনাবো । তাই শখ করে শিখেছিলাম ।
-কোথায় সে ?
-সে কোন দিন জানেই নি যে আমি তাকে ভালবাসি । তার অন্য কেউ ছিল । এখনও আছে ।
-তার জন্য এমন ভাবে জীবন নষ্ট করে দিবেন ?
-কোথায় নষ্ট করলাম ? তোমার মত সুন্দরী বউ পেয়েছি । হাহাহা
যেন খুব একটা মজার কথা বলেছে এমন ভাবেই শাফায়েত হেসে ফেলল জোরে । নীলুরও কেমন যেন মন ভাল হয়ে গেল । একটা মাস ধরে সে এই মানুষটার সাথে আছে । কেমন অদ্ভুদ এই মানুষটা । আর অদ্ভুদ ভাবেই তার সাথে তার বিয়ে হয়েছে । সব কিছুতেই শাফায়েতের নজর আছে । এই একটা মাসে ওর কি দরকার কি লাগবে এই সব দিকেই শাফায়েতের লক্ষ্য আছে । বিয়ের আগে ওদের ভেতরে কথা ছিল তারা দুজন হয়তো একই ঘরে থাকবে তবে নিজের জীবন হবে আলাদা । তখন নীলুর আর কিছু মনে হয় নি । মনে হয়েছে শাফায়েতের সাথে বিয়ে না হলেও ও বাবা ঠিকই অন্য কারো সাথে ঠিকই বিয়ে দিয়ে দিবে । আর সেই ছেলে যে শাফায়েতের মত হবে, ওকে নিজের মত করে থাকবে দিবে এমনটা ভাবার কোন কারন নেই । এর থেকে ভাল ডিল ওর জন্য আর হতেই পারে না ।
কিন্তু এই কটা দিনে নীলুর মনে অদ্ভুদ একটা পরিবর্তন আসছে । সেটা নীলু নিজেও বুঝতে পারছে খুব ভাল ভাবেই । বিয়ে জিনিসটা আসলেই এমন হয় ! একটা পবিত্র বন্ধন ! সামনের মানুষটার জন্য আপনা আপনি একটা মায়া জন্মে যায় !
না ! নীলু এসব কিছু ভাবতে চাইলো না । এসব মন থেকে দুর করে দিতে চাইছে !
পাঁচ
-এই কেডা এই খানে !
শাফায়েত আর নীলু দুজনেই চমকে উঠলো । কয়েকটা কন্ঠস্বর খুব কাছেই চলে এল কোথা থেকে যেন । শাফায়েত তখন উঠে পড়েছে । নীলুর হাত ধরেছে শক্ত ভাবে !
-কেডা ?
শাফায়েত শান্ত কন্ঠে বলল
-আমরা !
-আমরা কারা ! দেশের প্রধানমন্ত্রী ? নাম নাই ?
এই বলে দুজনের মুখের উপরেই টর্চের আলো ফেলল । শাফায়েত আবার বলল
-দেখুন আমরা স্বামী স্ত্রী ! এখানে কেবল বসে আছি !
-ধরা খাইলে সবাই কয় স্বামী স্ত্রী !
দুজন খুব বাজে ভাবে হেসে উঠলো !
শাফায়েত বলল
-দেখুন আমি এবং আমার দুজনেই এই ইউনিভার্সিটির প্রাক্তন স্টুডেন্ট ! আমরা ঝামেলা চাচ্ছি না । যেতে দিন আমাদের ।
ওদের মাঝ থেকে একজন হঠাৎ করেই বলল
-ভাই মাইয়াডারে চিনছি । এতো গাঞ্জা প্রিতমের মাল !
বড় ভাই গোছের মানুষটা যেন খুব মজা পেল কথা শুনে । তারপর বলল
-বাহ এতো দিন গাঞ্জা প্রিতম এখন এই ভদ্রলোক ! তা আমাদেরও কিছু দাও !
-দেখুন মুখ সামলে কথা বলুন !
-আবে চুপ । রাইতের আন্ধারে এইখানে $@%& করবা আর আমরা কিছু কমু না ।আজকা তোগো খবোর আছে ।
কিছু বুঝে ওঠার আগেই শাফায়েত নীলু হাত ছেড়ে দিল । তারপর চিৎকারেই বলল
-নীলু দৌড়াও ! দৌড় দাও
নীলু অন্ধকারের ভেতরেই অয়বয় গুলো নড়তে দেখলেো । শাফায়েত আগেই তিনজেনর উপর ঝাপিয়ে পরেছে । তিনজনকে আটকানোর চেষ্টা করে চলেছে । নীলুর বুঝতে কষ্ট হল না যে শাফায়েত ওকে পালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দিচ্ছে । পুকুর পাড়টা নির্জন । বেশ গাছ গাছালি আছে । তবে তার পরেই হল । সেখানে পৌছাতে পারলে আর কোন সমস্যা নেই ।
শাফায়েতের মুখে আবার দৌড়ানোর আওয়াজটা শুনতে পেয়েই নীলু দৌড় দিল । জীবনে এমন বিপদে সে পরেনি । যদি ঐ জানোয়ার গুলোর হাতে পড়ে তাহলে ওর কি অবস্থা হবে সেটা নীলু ভাবতেও পারছে না ।
কিভাবে যে ও হলের সামনে এসে হাজির হল সেটা ও নিজেই বলতে পারবে না । এসেই দেখলো কয়েজন ছেলে সেখানে দাড়িয়ে কথা বলছে । ওকে ঐ অবস্থায় আসতে দেখেই ছেলে গুলো এগিয়ে এল !
-কি হয়েছে আপু ?
নীলু বুক ফেটে কান্না এল । কোন মতে ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলল তার হাজব্যান্ডকে কিছু মানুষ ঐ পুকুর পাড়ে মারছে !
ছেলে গুলো দ্রুত হাক ডাক দিল । আর ১০/১২ হল থেকে নেমে এল জলদি । তারপর তারা ছুটে গেল পুকুর পাড়ের দিকে । নীলুকে ওরা যেতা মানা করলো তবে নীলু না গিয়ে থাকতে পারলো না । পুকুর পাড়ে গিয়ে দেখলো শাফায়াত সেখানে পড়ে আছে । শরীরে বেশ খানিকটা আঘাতে দাগ ।
শাফায়েত কয়েকজন মিলে উঠে দাড়াতে সাহায্য করলো তখন শাফায়েতের মুখে প্রথম কথাই আমার নীলু কোথায় ? ও ঠিক আছে ? আপনারা প্লিজ আগে দেখুন !
একজন বলল
-ভাইয়া আপনি ভয় পাবেন না । আপনার স্ত্রী একদম ঠিক আছে ।উনিই আমাদের কে নিয়ে এসেছেন ! ঐ দেখুন ওখানে আছে । আসুন আপনি আমাদের সাথে !
ছয়
শাফায়েতের কপালে আরেকবার হাত দিল ও । বাচ্চার মত ঘুমাচ্ছে আরাম করে । আঘাতের দাগ গুলো এখনও পরিস্কার হয়ে আছে । আজকে ঘটনা নীলুকে বেশ ভাল ভাবেই শক দিয়েছে । নিজের ক্যাম্পাসেই যে সে এমন ঘটনার স্বীকার হবে সেটা নীলু কোন দিন ভাবতে পারে নি । কিন্তু যে ব্যাপারটা ওর সব থেকে বেশি ভাবাচ্ছে সেটা হচ্ছে শাফায়েতের প্রতিক্রিয়া ! ছেলে গুলো যখন শাফায়েতকে খুজে পেল ওর প্রথম কথাই ছিল আমার নীলু কোথায় ? ঐ কন্ঠে যে কি পরিমান আকুলতা ছিল সেটা নীলুর বুঝতে কষ্ট হয় নি । মাত্র মাস দুয়েক পরিচয় ওদের । এর ভেতরেই শাফায়েত ওকে এভাবে ভালবাসতে শুরু করেছে ?
না । এটা নীলুর মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে । কিছু একটা লুকিয়েছে শাফায়েত ওর কাছ থেকে !
কি ?
নীলু শাফায়ের ফোনটা হাতে নিল । যদিও এভাবে অনুমুতি না কারো ফোনে হাত দেওয়া ঠিক না । প্যাটার্ন লকটা কিভাবে খুলবে সেটা ভেবে ফোনটা রেখে দিল । কিন্তু তখনই কি মনে হল ও ফোনটা আবারও হাতে নিল । প্যাটার্নটা এন দিতেই খুলে গেল । নীলু মোটেই অবাক হল না । তারপরই গ্যালারিতে গিয়ে বড় রকমের একটা ধাক্কা খেল । পুরো গ্যারালী ভর্তি কেবল ওর ছবি ! আর কারো না । যার বেশি ভাগ ছবিই তোলা হয়েছে ওর অসচেতন অবস্থার । ও জানতেও পারে নি ছবি গুলো ককখন তোলা হয়েছে । কিছু তোলা হয়েছে ওর ঘুমের অবস্থায় !
নীলু কিছু বুঝতে পারছিলো না । এমন তো হওয়ার কথা না ।
নীলু মনে করার চেষ্টা করলো বিয়ের আগে শাফায়েত আর নীলুর ভেতরে কি কথা হয়েছিলো । শাফায়েত বলেছিলো ও বিয়ে করতে চায় না । ও কাউকে ভালবাসে কিন্তু এই এক মাসের বিয়েতেই সব কিছু এমন কেন হয়ে গেল ।
-অন্যের ফোন এভাবে দেখতে নেই ?
নীলু চমকে উঠলো । তাকিয়ে দেখে শাফায়েতের ঘুম ভেঙ্গেছে । ওর দিকে তাকিয়ে আছে । নীলু নিজের চমকানো ভাবটা কাটিয়ে উঠলো মুহুর্তেই । তারপর বলল
-আচ্ছা অন্যের ফোন দেখতে নেই অনুমুতি ছাড়া তা অন্যের ছবি তুলতে হয় হয় বুঝি ?
শাফায়েত একটু হাসতে গেল । তখনই ব্যাথায় কাঁকিয়ে উঠলো । নীলু কাছে এগিয়ে এসে বলল
-এখনও ব্যাথা করছে ?
-হুম !
-ওমনটা কেন করলে ?
-যদি তোমার কিছু হয়ে যেত ওরা যদি কিছু করতো তখন ? আর তোমাকে কি অসম্মান করে কথা বলছিলো আমার ভাল লাগে নি ।
-তাই বলে এমন নায়ক হতে হবে ?
-নায়ক তো হই নি । নায়ক হলে তো সব কটাকে পিটিয়ে সোজা করতাম । সাধারন মানুষ বলেই মার খেয়েছি ! সাধারন মানুষ বলেই কবিতা লিখতে পারি না !
নীলু বেশ খানিকটা সময় শাফায়াতের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-তুমি যে এই গান গাওয়া শিখেছো এটা আমার জন্য ? আমিই কি সেই মানুষ যার কথা বলেছিলে ?
শাফায়েত কোন কথা না বলে কেবল তাকিয়ে রইলো । নীলু কি বলবে খুজে পেল না । কতটা সময় এভাবে চুপ করে রইলো কারোই জানার নেই ।
একটা সময় সাফায়েত বলল
-আমি প্রথম যেদিন তোমাকে দেখি সেদিন থেকেই আমার জীবন পুরো জীবন বদলে গিয়েছিলো । আমি কতবার যে চেষ্টা করেছি তোমাকে মন থেকে বের করে দিতে ! বিশেষ করে যখন জানতে পারলাম যে তুমি অন্য কাউকে ভালবাসো । কিন্তু ছেলেটা ভাল না জেনে কষ্ট লেগেছিলো খুব । কতবার ইচ্ছে করেছে তোমাকে গিয়ে বলি কিন্তু বলতে পারি নি । কোন দিন চেষ্টাও করে নি তোমার কাছে যাওয়ার ! পছন্দ করার মত কিছুই ছিল না । খুবই সাধারন ছিলাম ।
এই বলেই চুপ করলো শাফায়েত । নীলু তখনও এক ভাবে তাকিয়ে রয়েছে শাফায়েতের দিকে । কি টলটলে চোখে ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে । এই দৃষ্টি ও কেন আগে লক্ষ্য করে নি । একটা বার ভাল করে দেখলেই ও বুঝে ফেলতো ছেলেটা ওকে কত ভালবাসে ! শাফায়েত আবার বলল
-চাকরি পাওয়ার যখন বিয়ে করতে চাইছিলাম না তখন বাসা থেকে খুব ঝামেলা শুরু করে দিল । তারপর যখন বাসার চাপে পড়ে প্রথম মেয়ের সাথে দেখা করতে গেলাম তখনই ধাক্কার মত খেলাম । মেয়েটা ছিলে তুমি ! আমার মাথায় আর কিছু আসে নি । কেবল মনে হয়েছে ভাগ্য আমাকে এই সুযোগ দিয়েছে । তারপর... তুমি জানো..
নীলু একটা সময় নিজেকে প্রস্তুত করেই নিয়েছিলো যে হয়তো আর কাউকে ভালবাসা হবে না ওর দ্বারা । আর কাউকে ভালোবাসতে পারবে না । নিজের সাথেই তেমনই বোঝাপড়া করে নিয়েছিলো । এই জন্যই হয়তো শাফায়েতের সাথে এমন একটা বিয়ে করতে রাজি হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু এখন কি করবে ও ! কিন্তু এখন ? কি করবে ও ! একদিনে ওর পেছনে ফেলে আসা ভালবাসা যে হয়তো ওর কথা ঠিক মত ভাবেও না । অন্য দিকে ওকে পাগলের মত ভালবাসে এই ছেলেটা । কোন দিকে যাবে ও !
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুলাই, ২০১৮ সন্ধ্যা ৬:৩৫