রিয়াদ কিছুটা সময় মায়ের দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে রইলো । কিন্তু মায়ের চেহারাতে কোন পরিবর্তন দেখতে পা পেয়ে আবার বলল
-মা ! এমন কেন করছো ?
রিয়াদের মা রাবেয়া পারভিন শান্ত কন্ঠে বলল
-কেমন করছি ?
-তুমি জানো না কেমন করছো ?
রাবেয়া বলল
-শোন, আমাকে তুই শেখাতে আসিস না । তোকে আমি কিছুতেই ঐ মেয়েকে বিয়ে করতে দিবো না ।
-কিন্তু আমি বুঝতে পারছি না সমস্যাটা কোথায় ? কই যখন তুমি সুপ্তিকে দেখলে তখন তো তোমার খুব পছন্দ হয়েছিলো। তখন তো খুব রাজি ছিলে !
-তখন ছিলাম কারন তখন আমি জানতাম না । এখন জানি আর জানি বলেই আমি এখন রাজি না ।
-কিন্তু আমি সুপ্তিকে বিয়ে করবো !
রাবেয়া ছেলের দিকে এবার ভাল করে তাকালেন । ছোট বেলা থেকে রিয়াদ একটু এক রোখা টাইপের । যা একবার বলবে তাই করবে । এই জন্য তার হাতে সে কম মার খায় নি । কিন্তু তবুও রিয়াদের জেদ একটুও কমে নি । রাবেয়া কি করবেন ঠিক বুঝতে পারলেন না । বললেন
-তুই যদি ঐ অপয়া মেয়ে কে বিয়ে করিস তাহলে আমাকে আর কোন দিন মা বলে ডাকিস না । আমি কোন দিন আর তোর বাসায় আসবো না !
রিয়াদকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাবেয়া ভেতরের ঘরে চলে গেল । তারপর কিছু সময় পরেই ব্যাগ গুছিয়ে বাইরে বের হয়ে এল । রিয়াদ কেবল মায়ের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । বিয়াদের একবার ই্চ্ছে হল মাকে থামায়, আরেকবার ইচ্ছে হল আটকানোর দরকার নেই । অবশ্য খুব একটা চিন্তা করার কারনও নেই । রাবেয়া খুব বেশী হলে এখন যাবে রিয়াদের বড় ভাইয়ের বাসায় । রাগ পড়ে গেলে আবার চলে আসবে । এমন এর আগেও অনেক হয়েছে। রিয়াদের তবুও কেন জানি মনে হল মা কে আটকানোর দরকার । তবে জেদের কারনে আটকালো না । কেবল বলল
-মা আকাশে মেঘ করেছে । যাবাই যখন একটু পরে যাও ।
-না । তুই থাক তোর বাড়িতে । যে ছেলে আমার কথা শুনে না তার বাসায় আমি থাকবো না !
রিয়াদ আর কিছু বলল না । রাবেয়া দরজা খুলে চলে গেলে সেদিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় !
সব কিছু ঠিক চলছিলো । সুপ্তির সাথে আস্তে আস্তে ওর সম্পর্কটা ভাল হচ্ছিলো । সুপ্তিকে ওর অফিসের সবাই কেমন যেন এড়িয়ে চলে সব সময় । খুব একটা দরকার না পড়লে কখন কথা বলে না । সুপ্তিও ঠিক সেই রকমই । দরকার না হলে কারো সাথে কথা বলে না । নিজের মত করেই থাকে । সুপ্তিকে নিয়ে অফিসে অনেক রকম কথা প্রচলন আছে । সেসব রিয়াদের কানে এসেছে তবে ঠিক বিশ্বাস করে নি । মেয়েটা ওমন চুপচাপ বলেই হয়তো সবাই ওর ব্যাপারে এমন কথা ছড়ায় ।
রিয়াদের সাথে একদিন লাঞ্চ ব্রেকে হঠাৎ করেই সুপ্তি কথা বলল এগিয়ে এসে । দুপুরের খাবার শেয়ার করলো । রিয়াদ একটু অবাক হয়েছিলো । যে মেয়েটা কোন দিন কারো সাথে দরকার ছাড়া কথা বলে না সেই মেয়ে নিজে এসে ওর সাথে গল্প করলো তারপর একসাথে খাবার শেয়ার করে খেলো । তবে সব থেকে বড় অবাক হয়েছিলো তার পরপরই । ম্যানেজমেন্ট থেকে বদলির নির্দেশ এসেছে । ওর কিছু বেতন বেড়েছে সেই সাথে ওকে এইচ আর সেকশনে বদলি করা হয়েছে । সুপ্তি কাজ করে এইচ আর সেকশনে । রিয়াদের ডেস্কটা গিয়ে পড়লো একদম সুপ্তির পাশেই ।
রিয়াদের তখন খানিকটা সন্দেহ হল যে এই জন্যই সুপ্তি ওর সাথে এগিয়ে এসে কথা বলল । কারন ও কি বুঝতে পারছিলো যে রিয়াদ কিছু সময়ের ভেতরেই ওর পাশের ডেস্কে আসবে ! তারপর থেকেই রিয়াদ একটু যেন নিজ থেকেই সুপ্তির দিকে এগিয়ে এল । প্রতিদিন টুকটাক কথা দিয়ে শুরু হত ওদের দিন টা । অফিসের পুরোটা সময় এক সাথে থাকার পরে বিকেল কিংবা সন্ধ্যাটাও ওরা এক সাথে কাটাতে লাগলো ।
আস্তে আস্তে একে অন্যের জীবনের সব ঘটনা জানতে শুরু করলো । সুপ্তি কেন এমন চুপচাপ থাকে সেই ঘটনাই একদিন রিয়াদ জানতে পারলো সুপ্তির মুখ থেকেই । অবশ্য সেটা আরও আগেই মানুষের মুখে শুনেছিলো ভাসা ভাসা ভাবে । সুপ্তি মুখ থেকে ঘটনাটা আরও ভাল করেই জানতে পারলো ।
সুপ্তি ছোট বেলাতে একবার মারা গিয়েছিলো । শুনতে খানিকটা হাস্যকর শোনালেও ব্যাপারটা সত্যি । রিয়াদ কথাটা সুপ্তির মুখে খানিকটা চমকে গেল । সুপ্তি তখন স্বাভাবিক ভাবেই বলল যে ঘটনা সত্যি । রিয়াদ আগ্রহ নিয়ে শুনতে লাগলো সুপ্তির কথা ।
সত্যি সত্যিই সুপ্তি একবার মারা গিয়েছিলো । তখন ক্লাস সেভেনে পড়তো । একবার খুব বেশি জ্বর হল । তিন দিনের মাথায় ও মারা গেল । স্থানীয় ডাক্তার ওকে মৃত ঘোষণা করলো । ওকে গোসল করানো হল । যানাজা পড়ানো হল । যখন ওকে কবরে নামানো হল ঠিক সেই সময় ও নড়ে উঠলো । এইটা দেখে যারা ছিল সবাই ভয়ে দৌড় দিল । তবে ঠিকই ও কবর থেকে উঠে এল । নিজের বাসায় ফিরে এলো সবাই দৌড়ে পালালো কেবল বাসা থেকে । কেবল সুপ্তির মা ওকে জড়িয়ে ধরে কান্না কাটি করতে লাগলো ।
এলাকা বাসী ব্যাপারটা হজম করতে একটু সময়ই লেগেছিল । আড়ালে আবডালে অনেকে অনেক কথা বললেও সুপ্তির সামনে কেউ কোন কথা বলতো না । ওকে সবাই কেমন ভয় পাওয়া শুরু করলো । সবাই এড়িয়ে চলতো । এমন কি ওর ভাই বোন আর বাবাও ওকে কেমন যেন ভয় পেত । তবে একটা মানুষই ছিলো যে সুপ্তিকে আগের মতই ভালবাসতো ।
যখন পড়া শুনার জন্য ও ঢাকায় এখন তখনও কিভাবে যেন সবাই এই ঘটনাটা জেনে গেল । সবাই ওর কাছ থেকে দুরে দুরে থাকতো । অবশ্য ততদিনে সুপ্তি নিজেও নিজেকে সবার কাছ থেকে গুটিয়ে নিয়েছে । নিজে নিজেই নিজের ভেতরে থাকাটা শিখে নিয়েছে । অফিসে এসেও ব্যাপারটা তেমনই । সবাই কেমন করে যেন জেনে গেল ব্যাপারটা । জানার পরেই সবাই ওর কাছ থেকে সরে যেত দুরে । তারপর থেকেই আস্তে আস্তে নিজেকে একদম গুটিয়ে নিল ।
কথাটা বলে সুপ্তি অনেকটা সময় চুপ করে থাকতো । রিয়াদ কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না । তারপর বলল
-কিন্তু এই ঘটনার ভেতরে নিশ্চয়ই অস্বাভাবিক কিছু নেই ।
সুপ্তি নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল । রিয়াদের কথা শুনে ওর দিকে ফিরে তাকালো । বলল
-মানে ?
-মানে এই তোমার মারা যাওয়া ব্যাপার ?
খানিকটা অবাক চোখে রিয়াদের দিকে তাকিয়ে রইলো । রিয়াদ আবার বলল
-হ্যা । দেখো তখন তুমি গ্রামে থাকো । আর গ্রামের ডাক্তারেরা কেমন হয় সেটা তো তুমি জানোই । তোমার প্রবল জ্বর ছিল । সম্ভবত তুমি কোমায় চলে গিয়েছিলে । সবাই ভেবেছিলো যে তুমি মারা গেছ । এমন হতে পারে যে কিছু সময়ের জন্য তোমার হার্ট কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছিলো । এমন ঘটনা পৃথিবীতে অনেক ঘটেছে । সো এর ভেতরে অস্বাভাবিক কি আছে ?
সুপ্তি কিছুটা সময় রিয়াদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-জানি না । আমি কোন দিন খোজার চেষ্টা করি নি ।
-উচিৎ ছিল । আর তোমার আশে পাশের মানুষেরও তাই করা দরকার ছিল । যাক অতীতে কি হয়েছে সেটা আমি বদলাতে পারবো না তবে সামনে যা হবে সেটা বদলানো যাবে !
এই বলে রিয়াদ নিজে সুপ্তির হাতের উপর নিজের হাত রাখলো । তারপর বলল
-আমি তোমার কাছ থেকে দুরে চলে যাবো না । এমন কি বিয়ে টিকে করে নাতিপুতি হওয়ার পরেও আমরা সব সময় বন্ধু থাকবো !
অবশ্য সেই বন্ধুত্ব্য খুব বেশি দিন থাকে নি । রিয়াদ একটা সময় বুঝতে পারলো সুপ্তি মেয়েটা ওর উপর দিন দিন নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে । অবশ্য এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক মনে হল । মেয়েটা এতো দিন কেমন মানুষের কাছ থেকে ভয় আর দুরত্ব মেশানো আচরনই পেয়েছে । এই প্রথম রিয়াদের কাছ থেকে পেয়েছে ভালবাসা আর পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি। এমন সময় একটা মেয়ের পক্ষে প্রেমে না পড়াটাই বরং অস্বাভাবিক ছিল ।
সুপ্তি আস্তে আস্তে রিয়াদের মা আর বড় ভাইয়ের সাথেও পরিচিত হল । সত্যি বলতে কি সবাই প্রথমে সুপ্তিকে খুব ভাল ভাবেই গ্রহন করে নিল । শান্ত শিষ্ট মিষ্টি চেহারার একটা মেয়েকে অপছন্দ না করার মত কোন কারন নেই । কিন্তু কোন ভাবেই সুপ্তির সেই ব্যাপারটা রিয়াদের মা রাবেয়ার কানে গিয়ে হাজির হল । তারপর থেকে সে বেঁকে বসলো । কিছুতেই সুপ্তির সাথে তার ছেলের বিয়ে দিবে না ।
সুপ্তির মনটা বেশ খারাপ । বিকেল থেকেই আকাশে মেঘ করেছিল । এখন এই সন্ধ্যার সময় থেকে তুমুল বৃষ্টি হচ্ছে ।
সেই দুপুর থেকে সুপ্তির মন খারাপ হয়ে আছে ! ও খুব ভাল করেই জানে রিয়াদের আম্মু ব্যাপারটা জেনে গেছে এবং তিনি কোন ভাবেই রিয়াদের সাথে ওর বিয়েতে মত দিবে না ।
অবশ্য সুপ্তির মন খারাপ অন্য কারনে । তার কারনে কোন মানুষের মৃত্যু হোক সেটা ও কখনই চায় না । এমন কি যে ওকে তীব্র ভাবে ঘৃণা করে কিংবা ওর কোন ক্ষতি করতে চায় তাদেরও মৃত্যুর কারন ও হতে চায় না । তাদের মৃত্যুও ও কখনও কামনা করে না ।
কিন্তু এমন কিছুই ঘটতে চলেছে । রিয়াদের মা খুব জলদিই মারা যাবে । ও পথের কাটা হয়ে কেউ বেঁচে থাকে না ।
ব্যাপারটা শুরু হয় ওর ঐ কবর থেকে ফিরে আসার পর থেকেই । প্রথম প্রথম ব্যাপারটা ও খুব বেশি আমলে নেয় নি কিন্তু একটা সময় লক্ষ্য করলো ও কোন কাজ চাইছে কিন্তু সেটার পথে অন্য কেউ বাধা হয়ে আছে এমন কেউ খুব বেশি দিন বাঁচে না । হয় অসুখে নয়তো দুর্ঘটনাতে মারা যায় ! এই ব্যাপারটা লক্ষ্য করার পরেই ও নিজেকে আরও বেশি করে গুটিয়ে নিল । কিন্তু রিয়াদের ব্যাপারে কিছুতেই নিজেকে গুটিয়ে নিতে পারলো না । রিয়াদকে কিছুতেই নিজের জীবন থেকে মুছে ফেলতে পারছে না । এই জন্যই রিয়াদের মাও খুব জলদি মারা যাবে । খুব জলদি মারা যাবে সে !
সুপ্তি এক ভাবে তাকিয়ে রইলো অন্ধকার ঐ আকাশের দিকে । ক্ষণে ক্ষণে মেঘ উঠছে । বিদ্যুৎ চমকে উঠে চারপাশ টা আলোকিত হয়ে উঠছে ।
হঠাৎ কোথাও খুব জোরে বজ্রপাত হল । সুপ্তি একটু যেন কেঁপে উঠলো । তবে সে জানতে পারলো না শহরের অন্য প্রান্তে এই বজ্রপাতের আঘাতেই একজন মাঝ বয়সী মহিলা মারা গেল । সে রাগ করে তার ছোট ছেলের বাসা থেকে বের হয়ে বড় ছেলেরার বাসার দিকে যাচ্ছিলো ।
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে জুলাই, ২০১৮ রাত ১১:১৫