মাইনুল আহসান প্রায় সপ্তাহ খানেক পরে আজকে বাসায় এল । এতোদিন সে হাসপাতাল ছিল । সপ্তাহ খানেক আগে অফিস থেকে ফেরার সময় তার গাড়িটা উল্টে যায় । সব সময়ই তিনি খুব সাবধানী চালক তবে সেই দিন কি হয়েছিলো তিনি বলতে পারবেন না । তবে একটা ব্যাপার পুরো সময় তার মাথায় ভেতরে ছিল ।
গাড়িটা উল্টে যাওয়ার সময় সেই ছেলেটার সেখানে থাকাটা । তিনি কিছুতেই এটা মাথা থেকে ভুলতে পারছেন না । যদিও তার পুরোপুরি জ্ঞান ছিল না তবে তিনি এই টুকু নিশ্চিত যে সেই ছেলেটাই সেখানে ছিল । এবং সে নিজেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে । নয়তো ঐ রাস্তায় তাকে আরও কত সময় পড়ে থাকতে হত কে জানে । মাইনুল আহসানের কেবল মনে হয়েছে ছেলেটা সেখানেই ছিল । তার জন্য অপেক্ষা করছিলো । যেন ছেলেটা জানতোই তার গাড়ি সেখানেই উল্টে যাবে ।
মাস খানেক আগেই ছেলেটা একদিন হঠাৎ তার অফিসে এসে হাজির হয় । তার পিএ এসে তাকে খবর দিয়ে যায় যে অপু নামের একজন নাকি তার সাথে দেখা করতে এসেছে । ছেলেটা সম্ভবত বাংলাদেশ থেকে এসেছে । এটা শোনার পড়েই তিনি ছেলেটাকে ভেতরে নিয়ে আসতে বলেন । তিনি এখানকার বাংলা কমিউনিটির সাথে ভাল ভাবে পরিচিত । অনেক ছেলে মেয়েরা বাংলাদেশ থেকে এসে এখানে বেশ বিপদে পড়ে । কি করবে ঠিক বুঝে উঠতে পারে না । তিনি তার যথাসাধ্য সাহায্য তাদের কে করেন । এই ছেলেটাও হয়তো তেমন কোন সাহায্যের জন্য তার কাছে এসেছে ।
কিন্তু ছেলেটা তার সাথে সেই ব্যাপারে কোন কথাই বলল না । কেবল তার হাতে একটা খাম ধরিয়ে দিল । তারপর বলল
-এখন আমার কথা আপনার কোন ভাবেই বিশ্বাস হবে না । কিংবা মনে হবে আমি আপনার সাথে মশকরা করছি কিন্তু এই খামটা খোলার পরে আপনি নিজ থেকে আমার সাথে কথা বলতে চাইবেন ।
মাইনুল হাসান ঠিক বুঝতে পারলেন না উনি কি বলবেন । ছেলেটা আসলে কি চাচ্ছে আর কেনই বা তার সাথে দেখা করতে এসেছে সেটা সে ঠিক ধরতে পারছে না । অপু বলল
-আপনি নিশ্চয়ই আপনার মেয়েকে ভালবাসেন । তাই না ?
-কি বলতে চাও ?
-তাহলে এটা খুব বেশি জরুরী । খুব বেশি । আপনি এই মাসের ২৮ তারিখের আগে এই খামটা কোন ভাবেই খুলবেন না । তাহলে পরবর্তি সময়ে যখন আমার সাথে আপনার দেখা হবে তখন হয়তো আমি এখানে আসার গুরুত্ব আপনি বুঝতে পারবেন না । এটা ঝুমুরের জন্য খুব বেশি জরুরী !
মাইনুল আহসান কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল । তার মেয়ের নাম আরিফা রহমান । এখানে ওকে অনেকেই তৃষা নামে চিনে কিন্তু ঝুমুর ! এটা তো কেবল ওর দাদী ডাকে । এই নাম এই ছেলে কিভাবে জানলো ?
-তুমি এই ....
-আমি সব প্রশ্নের জবাব দিব । কিন্তু আপনি কথা রাখবেন । তাহলেই হয়তো আমার কথা গুলো আপনার বিশ্বাস হবে । আমি আসি আজকে ।
ছেলেটা আর কিছু না বলেই অফিস থেকে বের হয়ে গেল । খাম টা তিনি বেশ কিছু সময় হাতে নিয়ে বসে রইলেন । হাত দিয়েই বুঝলেন ভেতরে কেবল কাগজ ছাড়া আর কিছু নেই । কিন্তু সেই কাগজে কি এমন আছে ? আর ২৮ তারিখের আগে সেটা কেনই বা খোলা যাবে না । মাইনুল আহসানের খুব ইচ্ছে হল খাম টা খুলে দেখতে কিন্তু খুললেন না । একটু অপেক্ষা হয়তো করতে হবে তবুও ব্যাপারটা যখন ঝুমুরের সাথে যুক্ত তখন সেটা না খোলাই ভাল ।
হাসপাতালে বসে বসে তিনি ছটফট করেছেন । কেবল ২৮ তারিখের জন্য অপেক্ষা করেছেন । ঠিক ২৮ তারিখেই তাকে রিলিজ করে দেওয়া হয়েছে । তিনি বাসায় এসে সোজা নিজের শোবার ঘরের লকার রুমের দিকে হাটা দিল । সেখানেই রাখা আছে খাম টা । লকার খুলে খামটা বের করলেন । একটা ছিড়ে ফেলতেই একটা ফটোগ্রাফ বের হয়ে গেল । একটা কাপলের ছবি । যার ভেতরে ছেলেটা গত দিনে দেখা হওয়া অপু । তার পাশে মেয়েটাকে তিনি চিনতে পারলেন না । তবে চেহারাটা খুব পরিচিত মনে হল । কিন্তু চিনতে পারলেন না ।
মাইনুল আহসান সাথের কাগজটা খুললেন । সেখানে বেশ কিছু কথা লেখা । কিন্তু সম্মোধোনটা দেখেই তিনি বেশ অবাক হলেন । সেখানে লেখা
ডিয়ার ড্যাড,
আপনি বেশ অবাক হচ্ছেন যে আপনাকে ড্যাড বলে ডাকছি । কিন্তু বিশ্বাস করবেন না কি না জানি না তবে আপনি কিন্তু সত্যি সত্যিই আমার ফাদার ইন ল হতে যাচ্ছেন । আজ থেকে ঠিক ২২ বছর পরে ঝুমুরের সাথে আমি বিয়ে হবে । সাথে ছবিতে আমার সাথে যে মেয়েটাকে আপনি দেখতে পাচ্ছেন সেটা আপনারই মেয়ে ঝুমুর । এখন থেকে ঠিক ২০ বছর পরের ছবি এটা । আপনি হয়তো আমার এই কথা গুলো বিশ্বাস করছেন না তবে আমি কয়েকটা প্রমান দিলে হয়তো বিশ্বাস করবেন । এই চিঠিটা আমি আপনাকে দিচ্ছি এই মাসের ২ তারিখে । আজ থেকে ঠিক ২০ দিন পরে অর্থ্যাৎ ২২ তারিখে আপনার গাড়ি এক্সিডেন্ট করবে । আপনি হাসপাতালে ভর্তি হবে । ঐদিন আপনি একটা লাল রংয়ের শার্ট পরবেন । আপনার পছন্দের মার্সিডিস গাড়িটা ঐদিন আপনার স্ত্রী নিয়ে যাওয়ায় আপনি আপনি কালো স্পোর্টস গাড়িটা নিয়ে বের হবেন । আমি ভবিষ্যৎ থেকে এসেছি সেটা প্রমানের জন্য ২০ দিন পরের ভবিষ্যৎ বানী করলাম । খামটা ২০ দিন আগেই আপনার কাছে পৌছে দিলাম । আশা করি এটা পড়ার পরে আপনি বুঝতে পারবেন ।
চিঠিটা পড়ে বেশ কিছুটা সময় মাইনুল আহসান থ হয়ে বসে রইলেন । এমন কি কোন সময় হতে পারে ? একজন মানুষ কোন ভাবে ভবিষ্যৎ থেকে আসতে পারে ? কিন্তু ছেলেটা যে প্রমান তাকে দিল সেটা দেখে তিনি ঠিক অবিশ্বাসও করতে পারছে না । ছেলেটা ২০ দিন আগে থেকেই জানতো তার গাড়ি এক্সিডেন্ট করবে । আচ্ছা সেটা না হয় ছেলেটা নিজেই ব্যবস্থা করে রেখেছে কিন্তু তার শার্ট পরার ব্যাপারটা ? ওনার স্ত্রীর গাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ? এটা কিভাবে সম্ভব হয়েছে ?
মাইনুল আহসান কিছু ভাবতে পারছে না । ঠিক সেই সময় তার স্ত্রীর ডাক শুনতে পেলেন ।
-হাসান তোমার সাথে কেউ দেখা করতে এসেছে !
মাইনুল আহসান জানেন তার সাথে কে দেখা করতে এসেছে । যদি এই চিঠি সত্যি হয়ে থাকে তাহলে তার ভবিষ্যৎ সান ইন ল তার সাথে দেখা করতে এসেছে । তিনি ধীরে ধীরে নিচে নামতে শুরু করলেন
ছেলেটা সোফার উপরেই বসে ছিল শান্ত ভাবে । তাকে দেখে উঠে দাড়ালো । তারপর একটু হাসলো ।
-কেমন আছেন স্যার ?
-ভাল ।
অপু আবার হাসলো । অপুর হাসিটা মাইনুল আহসানের কাছে যেন খুব বেশি পরিচিত মনে হল । উণি বসতে বসতে বলল
-বস ।
অপু বলল
-আমি আশা করি আপনার মনযোগ আকর্ষন করতে সক্ষম হয়েছি !
-হ্যা হয়েছো । কিন্তু কিভাবে সম্ভব ?
অপু কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলল
-আসলে ওরা ঠিক নিশ্চিত ছিল না যে কাজ হবে কি না ।
-মানে যখন আজ থেকে ২৫ বছর পরেই জার্মান একটা রিসার্স ল্যাবে এই টাইম ম্যাশিন বানানো হবে । কিন্তু ওরা তখনও ঠিক জানে না যে এটা কাজ করবে কি না ।
-তুমি কিভাবে যুক্ত হলে এর সাথে ? তুমি কি বিজ্ঞানী ?
-নাহ । আমি বিজ্ঞানী না । তবে ...।
-তবে আমি মাদার ইন ল এক বিজ্ঞানী ....
মাইনুল আহসাম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন । তারপর বললেন
-তার মানে স্কারলেট ?
-হ্যা আপনার স্ত্রী । একটা জার্মান প্রোজেক্টে আন্টি যুক্ত হবে । সেখানেই আবিস্কার হবে এই টাইম মেশিন । সব কিছু ঠিক থাকলেও ওরা পরীক্ষা করতে পারছিলো না । খাওয়ার টেবিলে আমাদে সাথে আলোচনা করতেন আন্টি । তারপরই আমার মাথায় বুদ্ধিটা আছে ! আমি নিজে রাজী হয়ে যাই ?
-কিন্তু কেন ? কেন রাজী হলে ? কি জন্য এখানে এসেছো এখানে ?
-ঝুমুরের জন্য ।
-কেন ওর কি হয়েছে ? আই মিন হবে ?
অপু বেশ কিছু সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল
-দেখুন ঝুমুরের জীবনে আমি কিন্তু প্রথম জন নই ? আমার আগে সে আরও একটা ছেলেটা আসবে ওর জীবনে । এবং হি উইল ব্রেক হার আরফার সামটাইম । এই শকটা ওর জন্য সহ্য করা খুব টাফ হবে ।
-এখন কি করনীয় ?
-আমি এটার জন্যই এসেছি । আমি চাই যেন ঐ প্রথম ছেলেটা ঝুমুরের জীবনে না আসে । আমি চাই ঐ কয়টা বছর ও যেন কষ্ট না পায় কোন ভাবেই ।
মাইনুল আহসান কি বলবেন খুজে পেলেন না । তিনি ঠিক বুঝতেও পারছে না । তার সামনে এমন পরিস্থিতি চলে এসেছে যে তার মেয়ের জন্য সামনে গিয়ে কি হবে সেটা নিয়ে তাকে এখন সিদ্ধান্ত নিতে হবে ।
-কি করতে হবে ?
-আজ থেকেই করতে হবে । আজকে বিকেল বেলা আপনাকে দেখতে আসবে আপনার বন্ধু । তার সাথে থাকবে তার ছেলে ..
-তুমি বলতে চাও শ...
-ইয়েস স্যার । এই নামটা আমি উচ্চারন করতে চাই না । এই নাম শুনলে আমার মাথায় আগুন ধরে যায় । যে মানুষটা আমার ঝুমঝুমির জীবনে এমন ভাবে নষ্ট করে দিয়েছে সেই মানুষটাকে আমি কোন ভাবেই সহ্য করতে পারি না । আমার কেবল মনে হয় এই ...
-আমাকে এখন কি করতে হবে ?
-আপনি কেবল এইটা ব্যবস্থা করবেন যেন ঝুমুর কোন ভাবেই ঐ কার্লপ্রিটের সাথে দেখা না হয় ।
-তাহলেই হবে ?
-হ্যা ।
তারপর বেশ কিছুটা সময় কেউ কোন কথা বলল না । মাইনুল আহসান বলল
-আই ক্যান ডু দ্যাট ফর হার ! কিন্তু একটা কথা বলার ছিল ।
-বলুন
-এই যে তুমি চাচ্ছো না যে ঝুমুরের জীবনে সে আসুক । কিন্তু মানুষের জীবনে তো একটা হারমনি থাকে । একটা ঘটনার পরে আরেকটা ঘটনা ঘটে । যদি সে না আসে তার জীবনে তাহলে এমন তো হতে পারে যে তুমিও হয়তো আসবে না । তাই না ?
অপু খানিকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল । তারপর বলল
-হ্যা আমি জানি । এমনটা হতে পারে । ওকে হয়তো আমার পাওয়া হবে তখন কিন্তু ওর জীবনে এই যে কষ্ট টা পেয়েছে সেটা তো আর পাবে না ।
মাইনুল আহসান বলল
-এতো ভালবাসো আমার মেয়েকে ?
-সব কিছু থেকে বেশি ! আমি চাই যেন ও সব সময় ভাল থাকে । এমন কি আমি যদি ওকে নাও পাই তবুও !
মাইনুল আহসান খানিকটা সময় তাকিয়ে রইলেন অবাক হয়ে অপরিচিত ছেলেটার দিকে । তার চোখে তার মেয়ের জন্য যে ভালবাসা দেখছেন সেটা তিনি অনুভব করতে পারছেন । তার মেয়ের জন্য ছেলেটা এতো বড় ঝুকি নিয়ে টাইম মেশিনে পা দিয়েছে । তিনি উঠে গিয়ে তার পাশে বসলেন । তারপর বলল
-ইয়াং ম্যান, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি যে আমি এই ব্যবস্থা করার সর্বাত্তক চেষ্টা করবো যেন আমার মেয়ের বিয়ের তোমার সাথে হয় । যে ছেলে আমার মেয়ের সুখের জন্য সময় কে পেছনে ফেলে এগিয়ে আসতে পারে সেই ছেলের থেকে ভাল মেয়ে জামাই আমি আর খুজে পাবো না ।
পরিশিষ্টঃ
-স্কারলেট
-কি হল ?
-এক কাজ কর তৃষার ন্যানির সাথে ওকে একটু বাইরে পাঠাও তো ।
-কেন ?
-যা বলছি কর । আমার বন্ধু আসছে আমাকে দেখতে । আমি চাই না তৃষার সাথে ওদের দেখা হোক !
-কিন্তু কেন ?
-আহ এতো প্রশ্ন কর না তো । যা বলছি কর তো ।
তৃষার আম্মু কিছুর বুঝতে পারলো না । তবে স্বামীর কথা অমান্যও করলো না । তৃষাকে তখনই তৈরি করে সিটি সেন্টারে পাঠানোর ব্যবস্থা করলো । তিনি জানতেও পারলেন না তৃষাকে বাইরে পাঠানোর কারনে তার মেয়ের জীবনে অনেক বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটতে চলেছে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুন, ২০১৮ বিকাল ৩:৩৪