অফিসে পা দিয়েই মনে হল আজকে অফিসে আসা মোটেই ঠিক হয় নি । রিসিপশনের মেয়েটা আমাকে দেখে কেমন যেন মুখ টিপে হাসলো। একটা তীব্র অস্বঃস্তি আমাকে পেয়ে বসলো । আবার মনে হল যে আসলেই আজকে অফিসে আসা মোটেই উচিৎ হয় নি । কিন্তু না এসে উপায়ও ছিল না । আজকে প্রজেক্টের প্রেজেন্টেশন আছে । ছুটি যে নিবো সেটারও উপায় ছিল না । এখন এই জিনিস আমাকে সহ্য করতে হবে ।
লিফটের উঠেও ঠিক একই পরিস্থিতির স্বীকার হলাম । একবার মনে হল লিফটে না গিয়ে সিড়ি দিয়ে উঠি কিন্তু আমার ডেস্কটা ঠিক ৯ তলাতে । এই সকাল বেলাতে এতো উপড়ে উঠতে ইচ্ছা করলো না । লিফটে দেখা হল রফিক ভাইয়ের সাথে । আমার দিকে এমন ভাবে তাকাতে লাগলো যেন আমার গালে এখনও সেই লিপস্টিকের দাগ লেগে আছে । আমার গালের কাছে এসে বলল
-কই অপু লিপস্টিকের দাগ তো এখনও উঠে নাই ?
লিফটে আরও দুইটা মেয়ে ছিল । রিয়া আর অনু । দুইটাই আমার ডিপার্টমেন্টে কাজ করে । অনু মেয়েটা আবার সব সময় গম্ভীর থাকে । কারো সাথে ঠিক মেশে না । চুপ চাপ থাকে । রফিক ভাইয়ের কথা শুনে দুজনেই হিহি করে হেসে দিল । আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম । আমাকে এরকম বিপদে ফেলতে পেরে রভিক ভাই যেন খুব বেশি মজা পেল । রাগে দুঃখে তখনই ইচ্ছে হল চাকরি ছেড়ে চলে যাই । কিন্তু এই লিফটের ভেতর থেকে যাবো কোথায় আর আজকে যেন লিফট টা খুব বেশি আস্তে চলছে ।
লিফট থেকে বেরিয়ে কোন মতে দৌড়ে নিজের ডেস্কে চলে এলাম । আসার সময় কানে আরও নানা রকম হাসি ঠাট্টার আওয়াজ ভেসে এল । এই অফিসে আর কতদিন টিকতে পারবো আমি ঠিক জানি না । যদি এমন করেই চলতে থাকে তাহলে খুব বেশি দিন যে টিকতে পারবো না সেটা একেবারেই নিশ্চিত ।
আমি নিজে কোন দিন ভাবি নি যে এরকম একটা পরিস্থিতিতে পড়বো । গত পরশু দিন আমার সাথে এমন ঘটনা ঘটে গেছে যার ব্যাপারে আমার নিজের কোন হাত নেই । গত পরশু দিন আমাদের অফিসে অফিস পার্টি ছিল । সবাই সেখানে হাজির । তবে পার্টির কেন্দ্র ছিল আমাদের চেয়ারম্যান স্যারের বড় ছেলে মাহমুদ আহমেদ । বয়সে আমার মতই । তবে দেখতে খুবই সুদর্শন । বাইরে ছিল এতো দিন । মাত্রই পিএইচডি শেষ করে দেশে ফিরেছে । এখন বাবার অফিসের দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছে । আর তার জন্য মেয়ে খোজা হচ্ছে । এই পার্টিটা ছিল মোটামুটি তাকে সবার সাথে পরিচিত করিয়ে দেওয়ার জন্য ।
মাহমুদ আহমেদ অফিস জয়েন করেছে মাস খানেক হল । এরই মধ্যে পুরা অফিসের সব অবিবাহিত মেয়ে তার জন্য পাগল হয়ে গেছে । আর হবেই বা না কেন ? মাহমুদ আহমেদ কোন দিন দিয়ে কম না । একটা মেয়ের স্বপ্নের পুরুষ যেমন হওয়া উচিৎ মাহমুদ আহমেদ ঠিক তেমনই একজন ছেলে ।
সবাই মাহমুদকে ঘিরেই কথা বার্তা বলছিলো । আমিও তার পাশেই ছিল । পার্টি চলা কালিন সময়ে হঠাৎ ই হল রুমে অন্ধকার হয়ে গেল । পুরা ব্লাক আউট । বুঝতে পারলাম ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে । সাথে সাথেই জেনারেটর চালু হয়ে যাওয়ার কথা কিন্তু হল না । হয়তো কোন একটা সমস্যা হয়েছে ।
আমাদের অফিস পার্টি রুমটা বানানো হয়েছে বেজমেন্টের নিচে । এই জন্য ইলেক্ট্রিসিটি চলে যাওয়ার সাথে সাথে পুরো ঘরটা একেবারে অন্ধকার হয়ে গেছে । আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম ।
ঠিক সেই সময়ে অদ্ভুদ একটা ঘটনা ঘটলো । আমি অনুভব করলাম যে কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরলো তারপর আমার গালে চট করে একটা চুমু খেল । এবং সাথে সাথেই আমাকে ছেড়ে দিল । আমি এতোই অবাক হয়ে গেল গেলাম কিছুটা সময় কোন কথা বলতে পারলাম না ।
আমার বিমুর্ত ভাবটা কাটলো যখন আবার আলো ফিরে এল । তাও আবার চেয়ারম্যান স্যারের কথায় । তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি ব্যাপার অপু ? গালে লিপস্টিক কেন ?
আমি মুছতে যাবো কি আশে পাশের সবাই আমাকে ঘিরে ধরলো । কেউ কেউ আবার ছবিও তুলে নিল । সবাই বিশেষ করে মেয়েরা আমার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করতে লাগলো । ঠাট্টা টিপ্পনি তো চলতেই লাগলো । আমি লজ্জায় মাটির সাথে মিশে গেলাম ।
কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম আমার সাথে আসলে কি হল একটু আগে ? আর আমাকে এভাবে চেপে ধরে চুমু খাওয়ার কি হল ।
তখনই আমার মাথায় কথাটা এল । আমাকে আসলে কেউ চুমু খেতে চায় নি । চুমু টা দিতে চেয়েছে মাহমুদকে । আমি যেহেতু ওর পাশেই দাড়িয়ে ছিলাম ভুল করে কেউ আমাকে চুমুটা খেয়েছে । কিন্তু তবুও সবাই তো আমার ব্যাপারেই কথা বলছে । যেখানে আমার কোন দোষ নেই ।
প্রেজেন্টেশন ভাল হল । কিন্তু সেটা শেষ হতেই আবার সেই সেই লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে পড়তে হল । এবার স্বয়ং মাহমুদই আমাকে টিজ করলো । আমি কাজ শেষ করে ফাইল পত্র গুাচ্ছি তখনই মাহমুদ বলল
-অপু সাহেব ?
-জি স্যার !
-আপনি কাজ ভাল করেন কিন্তু আপনাকে ভাবছি এখানে আর রাখবো না ।
-মানে ? আমি ঠিক বুঝলাম না ।
-আপনাকে রাখার উপায় আছে বলেন ? আপনি আমার ভাগের জিনি পত্র নিজে নিয়ে নিচ্ছেন । আজ কাল মেয়েদের চুমু কি আর সহজে পাওয়া যায় ?
পুরো মিটিং রুমে হাসির রোল পড়ে গেল । আমি কি বলব কিছুই বুঝতে পারলাম না । অন্যদের রশিকতায় না হয় মুখ কালো করে ফেলা যায় কিন্তু বস যেখানে আপনাকে নিয়ে রশিকতা করছে সেখানে সেটা হাসি মুখেই সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই । মনে মনে সেই মেয়ের উপর এমন রাগ হল যে বলে বোঝাতে পারবো না । এখন যদি তাকে কাছে পেতাম তাহলে খবরই ছিল । বেটা ফাজিল মাইয়া কোথাকার ! চুম্মাচাটি করবি ঘরের ভেতরে গিয়া কর । তার উপর আবার আসল মানুষকে কর আমাকে নিয়া টানাটানি ক্যান !
নিজের ডেস্কে এসেও অনেকটা সময় হপ করে বসে রইলাম । কারো সাথে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না । এমন কি লাঞ্চ আওয়ারে খেতেও গেলাম না । নিজের ডেস্কেই বসে রইলাম মাথা নিচু করে । এমন করেই কখন যে ঘুম চলে এসেছে টেরই পাই নি । যখন ঘুম ভাঙ্গলো তখন তখন দেখি পুরো অফিসে কেবল আমি একাই রয়েছি ।
আশে পাশেই বস ডেস্কেরই আলো নিচে গেছে । আমি এতো টা সময় ঘুমিয়েই ছিলাম । একটু অবাক হলাম, সেই সাথে একটু বিরক্তও । সবাই আমাকে রেখেই চলে গেছে। টের পেলাম বেশ ক্ষুধাও লেগেছে আমার । এতো সময়ে ক্যান্টিনও বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা, তাই সেদিকে আর পা বাড়ালাম না । সব জিনিস পত্র গুছিয়ে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম । বাইরে এসে আবারও বিরক্ত লাগলো । বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে । এখন এই বৃষ্টির ভেতরে বাসায় যেতে আমার খবর হয়ে যাবে । ধুর ! আজকের দিনটাই ছিল বাজে !
আমি পার্কিংয়ের সামনে দাড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম কখন বৃষ্টি থামবে তখনই একটা লাল রংয়ের গাড়ি এসে আমার সামনে থামলো । আমি চিনি এই গাড়িটা কার ! আমি খানিকটা অবাকই হলাম । আমার ধারনা ছিল যে পুরো অফিসে কেবল মাত্র আমিই ছিলাম । অনুও যে অফিসে থাকতে পারে সেটা আমার ধরনা ছিল না । অবশ্য এই মেয়েটা সব সময় নিজের চারিপাশে কঠিন এক দেওয়াল তৈরি করে রাখে । তার সম্পর্কে কাউকে জানতে দেয় না । আমি কেবল অনুর নাম জানি । জানি যে ওর বাবা একজন সরকারি কর্মকর্তা । আর এই লাল গাড়িতে করে প্রতিদিন অফিস আছে । নিচেই গাড়ি চালিয়ে আসে !
কাঁচ নেমে নেমে গেল । আমার মনে হল এই মেয়েও এখন আমাকে নিয়ে ইয়ার্কি ঠোঁট্টা করবে । এই জন্যই হয়তো গাড়িটা থামিয়েছে । কিন্তু সেটা করলো না । গাড়ির জানালা থেকে মুখ বের করে বলল
-বাইরে তো বৃষ্টি হচ্ছে ! উঠে এসো ...।
আমি মনে করার চেষ্টা করলাম অনুর সাথে এর আমার কথা হয়েছে কি না । হ্যা কয়েকবার যে হয় নি সেটা না কিন্তু সেটা কেবলই কাজ সম্পর্কৃত । তাও সম্ভব্যত আপনিতেই আমাদের কথা হয়েছিলো । আজকে দেখি মেয়ে আমাকে সরাসরি তুমি করে কথা বলছে । একটু অবাক না হয়ে পারলাম না । ঘটনা কি ?
আমি বললাম
-না ঠিক আছে !
-উঠে এসো । এই বৃষ্টি থামবে না ।
সত্যিই তাই । এই বৃষ্টি স হয়ে থামবে না । আমার কাছে মনে হল যেন কিছু একটা ঠিক নেই । অনুর তো আমাকে এভাবে লিফট দেওয়ার কথা না । তাহলে কেন দিচ্ছে ? আমি আর কোন কারন জানতে চাইলাম না । গাড়িতে উঠে এলাম ।
গাড়ি চলতে শুরু করলো । আমি জড়সড় হয়ে বসেই রইলাম । কোন কথা বলছি না । কি বলব বুঝতেও পারছি না । হঠাৎ অনু বলল
-তো টক অব টাউন হতে কেমন লাগছে ?
আমি ওর দিকে ফিরে তাকালাম । অনুর চেহারাতে আজকে আশ্চর্য্য এক উজ্জলতা দেখতে পাচ্ছি । মুখটাও কেমন যেন একটু হাসিহাসি । অনু সাধারনত এমন হাসিখুশি থাকে না । আজকে মেয়েটার কি হল ?
আমি কি বলব খুজে পেলাম না । কেবল হাসলাম । অনু বলল
-তুমি এমন লজ্জা পাচ্ছো কেন বলতো কিংবা বিব্রত হচ্ছো কেন এতে ?
-মানে ?
-মানে একটা মেয়ে তোমাকে চুমু খেয়েছে এতে তো তোমার খুশি হওয়ার কথা । তাই না ? সবার ভাগ্য কিন্তু এমনটা জোটে না ?
আমি অনুর কথাটা ভাবতে শুরু করলাম । আসলেই তো ! এটা তো খারাপ কিছু না । কিন্তু তারপরেই মনে হল এসব গল্প উপন্যাসে ভাল লাগে বাস্তব জীবনে এসব ঘটলে খানিকটা অস্বস্তিতে পড়তে হয় । অনু বলল
-বুঝতে পারছি । তোমার অস্বস্তি যাচ্ছে না । তাই না ?
আমি কেবল মাথা নড করলাম । অনু আবার বলল
-তবে তোমার কিন্তু জানায় একটা ভুল আছে !
-কি ভুল ?
অনু হাসলো একটু । তারপর বলল
-তুমি কিংবা তোমরা ভাবছো যে চুমুটা আসলে মাহমুদ স্যারের জন্য ছিল । ওটা ভুল করে তোমার গালে এসে হাজির হয়েছে ! তাই না ?
আমি কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম অনুর দিকে । হঠাৎ লক্ষ্য করলাম গাড়ি থেমে গেছে । গাড়ি থামিয়ে অনু আমার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । আমি কেবল দেখতে পেলাম ওর ঠোঁট দুটো মৃদু ভাবে কাঁপছে । আমার বুকের ভেতরে আলাদা একটা অনুভূতি হল । আমার মনে পড়লো পার্টির ঐদিন অনু ঠোঁটে লাল লিপস্টিক ছিল । আর আমার গালে যে লিপস্টিকের দাগ ছিল সেটাও ছিল লাল ! আমি কেবল অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলাম অনুর দিকে ।
অনু আমার কাছে এসে আমার ঠোঁটে আলতো একটা চুমু খেল । তারপর বলল
-চুমুটা তোমার জন্যই ছিল ।
আর কোন কথা বলল না । গাড়ির দরজা খুলে বাইরের বৃষ্টির ভেতরে বের হয়ে গেল । আমার বিস্ময়টা কাটতে আরও কিছুটা সময় লাগলো । আমি কখনও ভাবতেও পারি নি যে অনু কোন দিন আমাকে পছন্দ করতে পারে !
আমি যখন বাস্তবে ফিরে এলাম তখন তাকিয়ে দেখি গাড়িটা থেমে আছে মিন্টু রোডের রাস্তায় । চারিদিকে তীব্র বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে সব । গাড়ির হেড লাইটের আলোতে আমি অনুকে দেখতে পাচ্ছি আপন মনে বৃষ্টিতে ভিজছে । আমার কেবল কয়েক মুহুর্ত লাগলো বুঝতে যে আমার এখন কি করা উচিৎ !
আর অন সব কিছু ভুলে গেলাম মুহুর্তেই । তারপর গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে এলাম বৃষ্টির ভেতরে । আমার চোখ তখন কেবলই অনুর দিকে ! আমার কেবল মনে এই পৃথিবীতে আমি আর অনু ছাড়া আর কেউ নেই ! এই পৃথিবীটা কেবল আমাদের দুই জনের !
সর্বশেষ এডিট : ০৬ ই জুন, ২০১৮ দুপুর ১:২৬