শুরুর আগে
সিলিং থেকে একটা ফাঁসের দড়ি ঝুলছে । ঠিক তার নিচে একটা টুল পেতে রাখা হয়েছে । টুলকে ঘিরে জলন্ত মোমবাতির একটা বৃত্ত । মোমবাতি গুলো জ্বলছে বেশ অনেক সময় ধরে । গলন্ত মোম এদিক ওদিক গড়িয়ে পড়ছে । সেই মোমবাতির বৃত্তের ভেতরে অজানা ভাষায় কত কিছু লেখা রয়েছে । ঠিক টুলটার উপর মানুষটা বসে আছে । তার বয়স খুব বেশি হবে না । সবে মাত্র ২৫ পার হয়েছে । ঘন চুলের ছেলেটা এক ভাবে কিছু পড়েই চলেছে । তার চোখ দিয়ে বিন্দু বিন্দু অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে ক্ষণে ক্ষণে !
ছেলেটার মন্ত্র পড়া শেষ হল একটা সময় । ছেলেটা ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালো টুলের উপর । ছেলেটা মৃদ্যু কাঁপছে । বুকের ভেতরে একটা ভয় কাজ করছে । কয়েকবার মনে হল কাজটা থেকে সে সরে আসুক । কিন্তু সেটা করলো না । এখন তার কাছে মরে যাওয়াটাই সব থেকে সহজ মনে হচ্ছে । কিছুতেই আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না । আরেকটা দিন বেঁচে থাকা মানেই মনের ভেতরে সেই তীব্র কষ্টটা ভোগ করে চলা । ছেলেটা সেই কষ্ট ভোগ করতে আর প্রস্তুত নয় । তবে বেঁচে থাকতে সে যেটা করতে পারে নি মরে গিয়ে সেটা ঠিকই করবে । সেই জন্যই এতো প্রস্তুতি সে নিয়েছে ।
ছেলেটা ফাঁসের দড়িটা নিজের গলার ভেতরে পরে নিল । তারপর আরেকবার তাকালো সামনে ঝুলানো ছবিটার দিকে । মনে মনে বলল আমি যদি তোমাকে না পাই তাহলে আর কেউ পাবে না । কেউ না ।
এক
শাহেদ এতো জোড়ে ব্রেক করলো যে সিট বেল্ট বাঁধা থাকা স্বত্ত্বেও ওর মাথাটা স্টিয়ারিংয়ের সাথে ঠুকে গেল । তবে ঠিক সময় নিজেকে সামলে নেওয়ার কারনে খুব বেশি ব্যাথা লাগে নি । পাশে বসা বোন আর পেছনে বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে নিল একবার । দেখে নিল তারা ঠিক আছে কি না ! শাহেদের বোন অরিন বলল
-কি হল তোর ? এভাবে কেউ ব্রেক চাপে ?
-ঠিক আছিস তুই ? মা বাবা তোমরা ?
ওনারা ঠিক আছে । একটু চমকে গিয়েছিলো তবে কোথাও ব্যাথা লাগে নি । অরিন আবার বলল
-এভাবে কেউ গাড়ি চালায় ? এভাবে ব্রেক চাপলি কেন ?
-আরে আমি কি আর এমনি এমনি ব্রেক করেছি নাকি ?
-তাহলে ?
-মনে হল কে যেন সামনে চলে এল । তাকে বাঁচাতেই তো এমনটা করলাম ।
শাহেদের দিকে অরিন কিছুটা সময় তাকিয়ে থেকে বলল
-বিয়ের আগেই বউকে নিয়ে এতো চিন্তা ! গাড়ি চালানোর সময় তো বউয়ের চিন্তা বাদ দে !
-কি বলছিস এই সব ?
-শোন আমি তোর পাশে বসে আছি , কই আমি তো কাউকে দেখলাম না সামনে আসতে । এই রাতে বেলা রাস্তা পুরোপুরি ফাঁকা । তুই মানুষ পেলি কই ?
শাহেদ কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর বাবা পেছন থেকে বলে উঠলো
-যা হয়েছে, হয়েছে এবার সাবধানে চালা । আর সমস্যা হলে আমি চালাই । তোর মাথায় হয়তো অন্য কিছু চলছে !
-না ঠিক আছে । এবার সাবধানেই চালাবো !
শাহেদ আবার গাড়ি স্টার্ট দিল । তবে মনের ভেতরে একটা কথা রয়েই গেল । ও পরিস্কার দেখেছে একজন যুবক মত মানুষ ওদের গাড়ির সামনে চলে এসেছে । তাই তো ও গাড়িটা ব্রেক করলো । নয়তো কেন করবে ? তাহলে কি ও ভুল দেখলো ? নাকি অরিনের কথাই ঠিক ! নিশির কথা বেশি বেশি ভাবছে ও । নিশির কথা মনে হতেই একটা মৃদ্যু হাসির রেখা দেখা দিল ওর মুখে । মেয়েটার সাথে তাহলে শেষ পর্যন্ত বিয়ে হতেই চলেছে । আজকে প্রায় পাঁকা কথা দেওয়া হয়েছে । সামনের মাসের ওদের এঙ্গেইজমেন্ট হবে । নিশির বড় ভাই সুইডেন থেকে ফিরলেই বিয়ে ।
হঠাৎই শাহেদের মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো । সে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরাতে ভুলে গেল । কেবলই মনে হতে লাগলো ওর দিকে কে যেন এগিয়ে আসছে । ভয়ংকর কিছু একটা ওর দিকে এগিয়ে আসছে ! তীব্র একটা ভয় জেঁকে বসলো ওর মন জুড়ে !
আকবার আলী ছেলেট ঘরের দরজার সামনে দাড়িয়ে রইলেন দীর্ঘ সময় । ভেতরে ঢুকবেন কি ঢুকবেন না এই চিন্তা করেই তার অনেকটা সময় পার করে ফেললেন । আগে একটা সময় ছিল ছেলের ঘরে হুট হাট করেই তিনি ঢুকে পড়তেন । যদিও শাহেদের এই হুট হাট করে ঢুকে পড়াটা ঠিক পছন্দ ছিল না তবুও বাবা বলেই সে কিছু বলতো না । তার ঘরে কেবল তার বাবা আকবর আলীরই এক রকম বিনা অনুমুতিতে প্রবেশের অধিকার ছিল । মেডিক্যালে পড়ার সময় শাহেদ যখন রাত জেগে পড়াশুনা করতো তখন আকবর আলীও জেগে থাকতেন । পরপর দুই সন্তান মৃত হওয়ার পর এই শাহেদের জন্ম । এই জন্যই সম্ভবত ছেলে তার চোখের মনি । আর আজকে সেই ছেলের কি হাল হয়েছে !
তিনি দরজার সামনেই দাড়িয়ে চোখ মুছলেন । শাহেদের কদিন পরেই বিয়ে হওয়ার কথা ছিল, মেয়ে দেখা পছন্দ করা সব হয়েও গিয়েছিলো কিন্তু সব মাঝ খান দিয়ে আটকে গেল । কি কারনে এমনটা হল কেউ বলতে পারে না । দেশের সব থেকে বড় ডাক্তার দেখিয়েছেন, শাহেদের কলেজের বড় বড় প্রোফেসরেরা দেখে গেছে কিন্তু কেউ কিছু বের করতে পারছে না ।
আর কেবল কি ডাক্তার ! পীর ফকির ওঝা কবিরাজ কি দেখান নি তিনি ! কিন্তু দিনকে দিন শাহেদের অবস্থা খারাপের দিকেই যাচ্ছে । ছেলেটার কি চমৎকার স্বাস্থ্য ছিল অথচ দিন যট যাচ্ছে তত ছেলেটা শুকিয়ে যাচ্ছে ।
শাহেদ কাউকে চিনতে পারে না । সব সময় মনে হয় কিছু একটা দেখে ভয় পাচ্ছে । বারবার চিৎকার করে ওঠে ! কোন মেয়েকে দেখলেই সেই চিৎকার আরও তীব্র হয় । শাহেদের মা কিংবা বোন অরিন তো শাহেদের রুমের ভেতরে যেতেই পারে না । আকবর আলী তো শাহেদের রুমে যেতে পারেন কিন্তু শাহেদের মা কিংবা বোন এমন কি যে কোন মেয়ে ওর রুমের ভেতড়ে ঢুকতেই পারে না !
-আব্বু !
আকবর আলী পিছন ফিরে তাকালেন । তার ছোট মেয়ে অরিন এসে দাড়িয়েছে !
-কি হয়েছে ?
-একজন এসেছে দেখা করতে ।
-কে ?
-চিনি না । বলল যে সে ভাইয়ার ব্যাপারে কথা বলবে । কেমন যেন আমি বসতে বলে চলে এসেছি !
আকবর আলী অবশ্য কিছু বললেন না । ডাক্তারি চিকিৎসায় কোন ফল না পেয়ে যখন তিনি এই কবিরাজ ওঝার কাছে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন । তখন থেকেই কত অদ্ভুদ লোকজন তাদের বাসায় আসতে লাগলো । সবারই একই কথা যে তারা ঠিকই তার ছেলেকে সারিয়ে তুলবে । একটা সময় তিনি আশায় বুক বেঁধেছিলেন কিন্তু যতই সময় যেতে লাগলো তিনি বুঝতে পারলেন যে এগুলো সবই ভন্ড ! এরা কেবলই টাকা খাওয়ার জন্যই এসেছে । অন্য কোন কারনে না ।
ডুবন্ত মানুষ যেমন খড় কুটা যা পায় সব ধরে বেঁচে থাকতে চায় ঠিক তেমনি আকবর আলী তার ছেলেকে বাঁচানোর জন্য সব কিছুই করতে প্রস্তুত । তার কেবল তার ছেলেকেই চাই অন্য কিছু না । তিনি আরেকবার একটা দির্ঘ্যশ্বাস ফেললেন । তারপর বসার ঘরের দিকে পা বাড়ালেন ।
আকবর আলী ঘরে ঢুকে একটু অবাকই হলেন । সোফার উপর তার ছেলের বয়সীই একটা ছেলে বসে আছে । এক মনে নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে কি যেন দেখছে । এতোদিন তিনি যা দেখেছেন তাদের সাথে এই ছেলেটার কোন মিলই তিনি খুজে পেলেন না । কালো রংয়ের একটা শার্ট আর কালো প্যান্ট পরে আছে । মাথায় ঘনকালো চুল । মাথা তুলে না তাকালেও বুঝতে অসুবিঢা হচ্ছে না যে ছেলেটার মুখে খোচাখোচা দাড়ি রয়েছে । আচ্ছা ছেলেটা কি শাহেদের পরিচিত ! ওর বন্ধু ! তাই হবে হয়তো ! হয়তো শাহেদের সাথে দেখা করতে এসেছে আর আরিন ভুল বুঝেছে !
আকবার আলী একটু গলা খায়েরী দিলেন । ছেলেটা তখনই আকবার আলীর দিকে চোখ তুলে তাকালো । তবে উঠে দাড়ালো না । একটু হেসে বললেন
-আপনিই শাহেদের বাবা ?
-হ্যা ! তুমি কি শাহেদের বন্ধু ?
-জি না । আমি ওকে ঠিক চিনি না । আমি ওকে দেখতে এসেছি । মানে দেখি কিছু করা যায় নাকি !
আকবর আলী কি বলবেন ঠিক বুঝতে পারলেন না । তার কেবল মনে হল এই ছেলেটাও ঐসব ভন্ডদের মধ্যেই একজন । তার কাছ থেকে টাকা খসাতে এসেছে ।
সামনে বসা ছেলেটা একটু হেসে উঠলো । তারপর বলল
-ভয় নেই এই কাজের জন্য আপনার কোন টাকা পয়সা দিতে হবে না । আমি একটু ওর সাথে দেখা করতে পারি ?
আকবর আলী চমকে উঠলেন । ছেলেটা হাসি মুখে তার দিকে তাকিয়ে আছে তবে এই চোখের দৃষ্টিতে অন্য কিছু আছে । অরিন ঠিকই বলেছিল । এই ছেলেটা স্বাভাবিক কেউ হতে পারে না । এতো তীক্ষ চোখ কোন সাধারন মানুষের হতে পারে না । আকবর আলী কোন কথা বলতে পারলেন না । কেবল হাত বাড়িয়ে শাহেদের ঘরে যাওয়ার পথটা দেখি দিল ।
ছেলেটাও আর কোন কথা না বলে সেদিকে পা বাড়ালো । তিনিও কিছুটা সময় বিমূঢ় হয়ে দাড়িয়ে থেকে ছেলের ঘরের দিকে পা বাড়ালেন! সেখানে গিয়ে অদ্ভুদ একটা দৃশ্য দেখলেন । তাকিয়ে দেখলেন তার ছেলে শাহেদ খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাটের উপর বসে আছে । আর তার ঠিক পাশেই সেই ছেলেটা বসে আছে । আকবর আলীকে ঘরে ঢুকতে দেখে শাহেদ খুব স্বাভাবিক কন্ঠে বলল
-বাবা কেমন আছো ?
কয়েকটা মুহুর্ত আকবর আলী কোন কথাই বলতে পারলো না । কেবল মাত্র অবাক হয়ে শাহেদের দিকে তাকিয়ে রইলো । শরীর একটু খারাপ হয়ে গেছে তবে ওকে দেখে একদম স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে এখন ! পাশে বসা ছেলেটা বলল
-আপনার ছেলে কিছু জানতে চেয়েছে । বলুন !
আকবর আলীর টনক নড়লো । তারপর বলল
-হ্যা বাবা আমি ভাল আছি । তুই কেমন আছিস ?
-জানি না বাবা ! আমি কিছু জানি না । আমাকে এভাবে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছো কেন ? কি হয়েছে বাবা ?
আকবর আলী কেঁদে ফেললেন তারপর বললেন
-তোর কিছু হবেনা বাবা । কিছু হবে না ।
ছেলেটা শাহেদের বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো । কয়েক কদম পিছিয়ে আসতেই আকবর আলী দেখলে শাহেদের অবস্থা ঠিক আগের মত হয়ে যাচ্ছে । ঐদিনের পর থেকে শাহেদ কখনই স্বাভাবিক ভাবে বসে নি । বসেছে উল্টো করে । কিংবা পা টা উঠিয়ে দিয়েছে উপরের দিকে কিংবা অদ্ভুত ভাবে পিঠ পাকিয়ে হাটাহাটি করেছে ।
আকবর আলী ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বললেন
-কি হল আমার ছেলের কি ? আবার কি হল !
ছেলেটা বলল
-আসুন আমার সাথে ! এখানে আমাদের কিছু করার নেই । আসুন !
সামনে বসা মানুষটাকে ভয় পাওয়ার কোন কারন নেই তবে অরিনের কি এক অদ্ভুদ কারনে সামনে বসা এই মানুষটাকে ভয় লাগছে । শার্ট প্যান্ট পরা স্বাভাবিক এই মানুষটার ভেতরে একটা অস্বাভাবিকত্ব আছে । যেটা সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না । কিন্তু একটু সে যা দেখেছে সেটা দেখে নিজের চোখকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারে নি । ওর বাবা পিছন পিছন সেও গিয়েছিলো ওর ভাইয়ার ঘরে । সেখানেই সে দেখেছে এই মানুষটা কিভাবে তার ভাইয়াকে স্বাভাবিক করে দিয়েছে । কেবল হাতের ছোঁয়াতেই একদম স্বাভাবিক করে দিয়েছে ।
আর মানুষটার নামটাও কেমন অদ্ভুদ ! রাফায়েল !
আগে পিছনে কিছু নেই । কেবলই রাফায়েল । এদেশে কারো নাম রাফায়েল হতে পারে এটা অরিনের জানা নেই । অরিন কেবল এক রাফায়েলকে চিনে । সে টেনিস খেলে । কোন দেশের অবশ্য সেটা এখন মনে পড়ছে না । রাফায়েল শোফার উপর চুপ করে বসে রয়েছে । অরিনের বাবা মা আর অরিন আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছে রাফায়েলের দিকে । শেষ আর চুপ করে থাকতে না পেরে আকবর আলী বলল
-কিছু বল বাবা ! তুমি কি দেখলে আর আমার ছেলেকে ঠিক করতে পারবে না ?
-দেখুন চেষ্টা করবো । এই জন্যই আমি এখানে এসেছি । তাই না ?
-বাবা তুমি যা চাও যত টাকা চাও আমি দিব !
রাফায়েল হাসলো একটু । তারপর বলল
-আমি আপনাকে আগেই বলেছি আমি এসব টাকার জন্য করি না । যাই হোক আপনাদের আসল কথা বলি । আপনার ছেলেকে যা ধরেছে সেটা খুব স্বাভাবিক কিছু না । আমি বলবো খুবই ভয়ংকর একটা জিনিস ! আমাদের এই মানুষ্য জগৎ আশে পাশে আরও অনেক জগৎ আছে সেখানে অন্য প্রাণীদের বাস । অনেক ধর্ম গ্রন্থে সেই জগতের কথা বলা আছে । সেই জগতকে আলাদা করে রাখা হয়েছে । কেউ বিশ্বাস করে আবার কেউ করে না । যাক সেটা না । এখন বিভিন্ন রিচ্যুয়ালের মাধ্যমে সেই প্রাণী গুলোকে আমাদের এই জগতে ডেকে আনা যায় ! এমন একটা অন্য জগতের প্রাণীকে কেউ ডেকে এনেছে । এবং সেটাই আপনার ছেলের উপর ভর করেছে !
-কিন্তু আমরা তো কারো ক্ষতি করি নি । কে করবে এমন ?
-আরও ঠিক করে বলবো স্পেসিফিক ভাবে আপনার ছেলের জন্যও তাকে নিয়ে আসা হয় নি ।
-মানে ? আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ।
-ধরুন আপনি আপনার বাসা পাহারা দেওয়ার জন্য একটা কুকুর আনলেন । তারপর সেই কুকুরকে এমন ভাবে ট্রেনিং দিলেন যে যেই এই বাসার ভেতরে পা দিবে তাকেই কামড় দিবে । এখন কুকুরটাকে কিন্তু আপনি কোন স্পেশিফিক মানুষের জন্য ঠিক করেন নি । যে আপনার বাসায় ঢুকবে তাকে ধরার জন্য ট্রেইন করেছেন । এখানেও ব্যাপারটা তেমন । এখন আমার জানতে হবে শাহেদ এমন কি কাজ করেছে যে যার জন্য এই প্রাণীটা এসে হাজির হয়েছে ।
ঘরের ভেতরে কেউ কোন কথা বলল না কিছুটা সময় । রাফায়েল আবার বলল
-আপনারা আমাকে ঠিক করে বলুন কবে থেকে শাহেদের এই সমস্যা শুরু হয়েছে ! তার আগে আগে পরে কি এমন অস্বাভাবিক কিংবা বিশেষ ঘটনা ঘটেছে ! এটা জানা জরুরী ।
আবারও কিছুটা সময় নিরবতা । অরিন বলল
-কোন দিন থেকে শুরু হয়েছে এটা আমার স্পষ্ট মনে আছে ! ঐদিন আমরা ভাইয়ার জন্য মেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম । ঠিক মেয়ে দেখা না । একেবারে কথা পাকাপাকি করতে গিয়েছিলাম । নিশি আপুকে ভাইয়া অনেক দিন থেকেই চিনতো । পছন্দ করতো । আপুরও মত ছিল । পারিবারিক ভাবে কথা হয় তারপর সেদিন আমরা গিয়েছিলো কথা বার্তা ফাইনাল করতে ।
-তারপর ?
-আমরা ফিরে আসছিলাম । আসার পথেই ভাইয়া হঠাৎ করেই খুব জোরে ব্রেক করে । আমাদের কে বলে সে নাকি সামনে কাউকে দেখতে পেয়েছে । কিন্তু তখন আমিও সামনের সিটেই বসে ছিলাম । আমি কাউকে দেখি নি । কেবল সামনের রাস্তায়ই না আশে পাশেও কেউ ছিল না । কিন্তু ভাইয়া নাকি কাকে দেখেছে । একটু পর ভাইয়া যেন কেমন করতে লাগলো । ওর কথা শুনে মনে হচ্ছিলো ভাইয়া কিছু দেখে ভয় পাচ্ছে । আমরা কেউ ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ভাইয়া আসলে কি দেখে ভয় পাচ্ছিলো । তবে সেটা খুব বেশি সময় স্থায়ী হয় নি । সমস্যা শুরু হয় তার পরের সপ্তাহ থেকে । তারপর অবস্থা দিন কে দিন খারাপই হতে থাকে !
রাফায়েল কিছুটা সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল
-আপনারা দেখুন আরও কোন কাহিনী আছে কি না, লাইক ও ঐ সময়ের আগে অন্য কোথাও গেছে কি না, কোন অস্বাভাবিক কাজ করেছে কি না ! কিংবা কোন জিনিস কি নে এনেছে কি না । এটা আমাকে বলবেন । আপাতত যা বললেন সেটা দিয়ে দেখি আমি খোজ খবর করে ।
দুই
নিশি ঠিক বুঝতে পারলো না সামনে বসা মানুষটার কথা বিশ্বাস করবে কি করবে না । মানুষ যা বলল তা বিশ্বাস করার কোন কারন নেই কিন্তু মানুষটাকে সে কিছুতেই অবিশ্বাস করতে পারছে না । কিছু কিছু মানুষ এমন থাকে যাদের কোন কথাই ঠিক অবিশ্বাস করা যায় না । নিশির সামনে বসা এই মানুষটাও ঠিক তেমন একজন মানুষ ।
গতকাল রাতেই নিশির ফোনে এই মানুষটার ফোন আসে । ফোনে নিজের নাম বলেছে রাফায়েল । সে নাকি শাহেদের পরিচিত । শাহেদের কথা শুনে নিশির মনটা খানিকটা চঞ্চল হয়ে উঠেছিলো । শাহেদকে তার বেশ পছন্দ হয়েছিলো । একই অফিসে চাকরি করে ওরা । ওদের অফিসের মেডিক্যাল অফিসার শাহেদ । সেখান থেকেই ভাল লাগা শুরু । তবে নিশির শুরু থেকেই বলেছিলো এই সব প্রেম ভালবাসায় সে কোন দিন জড়ায় নি । তবে শাহেদকে তার অপছন্দ নয় । সে যদি সত্যিই আগ্রহী থাকে তাহলে যেন বাসায় প্রস্তাব পাঠায় । শাহেদ তাই করেছিলো । এবং তাদের বিয়ের কথা বার্তা একেবারে পাকা হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু মাঝ খানে শাহেদ অসুস্থ হয়ে পড়লো ।
নিশি কিছুই বুঝতে পারছিলো না । তবে ওর বাবার মনভাব ছিল অন্য । তার ভাষ্য মতে যা হয়েছে ভালর জন্যই হয়েছে । বিয়ে হওয়ার পরে যদি এমন কিছু হত তাহলে তার মেয়ের জীবনটার কি হত ! আগে হয়ে তার মেয়ের জীবনটা রক্ষা পেয়েছে ।
ফোনেই রাফায়েল নামের মানুষটা বলল যে শাহেদের ব্যাপারে কয়েকটা কথা বলার আছে তার । যদি সে দেখা করে তাহলে উপকার হবে। নিশি খুব বেশি আপত্তি করে নি । অফিসের পরেই সময় দিয়েছিলো । মানুষটা একদম ঠিক সময়েই এসে উপস্থিত হয়েছে । প্রথম দেখাতে খানিকটা চমকে উঠেছিলো নিশি । বিশেষ করে তার ওর তীক্ষ্ম চোখ দেখে নিশির কেমন যেন অস্বস্থি থাকে । তারপর সে আস্তে আস্তে যা বলল তা শুনে নিশি কেবল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো ।
নিশি তারপর কোন রকম নিজেকে সামলে নিয়ে বলল
-তার মানে আপনি বলতে চান শাহেদের যা হয়েছে তার জন্য আমি দায়ী ?
রাফায়েল শান্ত কন্ঠে বলল
-তুমি সম্ভবত আমার কথা মন দিয়ে শোন নি । আমি বলি নি তুমি দায়ী । এটার পেছনে অন্য কেউ আছে কিন্তু কারনটা তুমি !
নিশি কেবল চুপ করে শুনে গেল । অদ্ভুদ একটা কথা বলছে রাফায়েল নামের এই মানুষটা ! কিন্তু যা তথ্য সামনে রেখেছে সেটা সেগুলো সব ঠিক আছে । বুঝতেই পারছে সামনে বসা মানুষটা ওর ব্যাপারে সব খোজ খবর নিয়েই এসেছে । নিশি বলল
-এসবে কি প্রমান হয় ?
-হয় না ?
-না । কিছুই প্রমান হয় না ।
-শাহেদের আগে আরও দুইটা ছেলে তোমাকে দেখে গেছে । একজন যখন তুমি পড়া শুনা কর তখন আরেকজন যখন তুমি পড়াশুনা শেষ করেছো তখন । শাহেদ হচ্ছে তিন নম্বার । তিন জনের সাথেই তোমার বিয়ে হয় নি একটা অদ্ভুদ কারনে । কি সেই কারন ? বিয়ের কথা বার্তা চলা কালিন সময়েই পাত্রটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে তারা মেয়েদের দেখলেই ভয় পায় । এই তিনটার কানেকশন তুমি নিশি !
নিশি উঠে দাড়ালো । তারপর বলল
-দেখুন, আপনি আমার যথেষ্ঠ সময় নষ্ট করেছেন । আর না । আপনি কি বলছেন সেটা আমি বুঝতে পারছি না । বুঝতে চাচ্ছিও না । আমি এখন আসবো ।
এই বলে নিশি উঠে পড়লো । রাফায়েল উঠলো না । বলল
-চলে যাচ্ছো যাও তবে একটা কথা তোমাকে বলি আমি । ভাবছো যে এই তিনটা ছেলে অসুস্থ হয়েছে তো আমার কি ! কিন্তু তুমি যেই ছেলের সাথে এঙ্গেইজ হতে যাবে তারা সবাই বিপদে পড়বে । মনে রেখো ।
রাফায়েল আর কোন কথা বলল না । নিশির দিকে কিছু সময় তাকিয়ে থেকে তারপর চলে গেল ।
বাসায় এসেও নিশি কিছুতেই শান্তি পাচ্ছিলো না । কোন অতি প্রাকৃত জিনিসে নিশির বিশ্বাস নেই কিন্তু রাফায়েল নামের ঐ লোকটা ওর কথা গুলো যতটা জোর দিয়ে বলল সেটা ও মন থেকে মুছেও ফেলতে পারছে না । সত্যিই যদি এমন কিছু হয়ে থাকে তাহলে কি হবে ? ওর কারনে তিন মানুষ অসুস্থ হতে পারে ? সারাটা রাত ও কেবল ছটফট করলো এই চিন্তাতে । কিছুতেই ওর ঘুম আসলো না । সকালে উঠে ও সোজা গিয়ে হাজির হল শাহেদদের বাসাতে । ওকে এতো সকালে আসতে দেখে শাহেদের বাবা মা একটু অবাকই হল । কারন নিশির বাবা এমনিতেই বিয়ে ভেঙ্গে দিয়েছে । নিশিকে দেখে তাই শাহেদের বাবা মা একটু অবাকই হল । নিশি শাহেদকে একটু দেখতে চাইলো ।
শাহেদের বাবা নিশিকে শাহেদের ঘর পর্যন্ত নিয়ে গেলেন তবে তাকে ভেতরে ঢুকতে দিলেন না । বললেন যে শাহেদ কোন মেয়েকেউ সহ্য করতে পারে না । কোন মেয়েকে দেখলেই কেমন ভয়ংকর হয়ে ওঠে । হাত পা ছুড়তে থাকে । দরজার ফাঁকে নিশি কেবল একটু তাকিয়ে দেখলো । যে শাহেদকে ও চিনতো সেই শাহেদের সাথে এই শাহেদের কোন মিলই নেই । নিশির বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠলো । ওর কেবলই মনে হতে লাগলো শাহেদের এই অবস্থার জন্য ও দায়ী ।
শাহেদের সাথে ওর কোন ভালবাসার সম্পর্ক ছিল না । তবে অনেকটা দিন পাশ পাশি কাজ করার ফলে শাহেদের সাথে একটা চমৎকার সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো । তারপর বিয়ের কথা বার্তা চলার কালীন সময়েও একটা গাঢ় সম্পর্ক তৈরি হচ্ছিলো কিন্তু সেটা মাঝ পথেই থেমে গেছে । নিশি অনুভব করলো ওর চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে । শাহেদের বাবা নিশির মাথায় হাত দিয়ে বলল
-কেঁদো না মা !
নিশি নিরবে চোখের জল ফেলতে লাগলো । শাহেদের বাবা বলল
-শাহেদ এবার ঠিক হয়ে যাবে আশা করছি ! একজন সত্যি কাজের মানুষ পাওয়া গেছে । সে বলেছে কিছু করবে ! আমার বিশ্বাস আমাদের শাহেদ ঠিক হবেই ।
নিশি আর কিছু জানতে চাইলো না । ছুটে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে । তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল রাফায়েলের সাথে ও যোগাযোগ করবে । সে যা জানতে চায় যা সাহায্য চায় তার সবই করবে সে ! ব্যাগ থেকে মোবাইলটা বের করে নিল নিশি । মোবাইলের কল লিস্টেই রাফায়েলের নাম্বারটা থাকার কথা এখনও ।
তিন
-এবার আমাকে বল দেখি সব খুলে ! তবে অনার্সের আগের ঘটনাটা গুলো বলবে । কারন যেহেতু ঐ সময়ে তোমার একটা বিয়ে এসেছিলো এবং ঐ ছেলেও এফেক্টেড হয়েছিলো তাই ঘটনা তার আগেরই হবে ।
আজকে ওরা কোন রেস্টুরেন্টে বসে নি । বসেছে একটা পার্কে । পার্কটাতে খুব একটা মানুষ নেই । আর এই ভর দুপুর বেলা লোকজন নেই বললেই চলে । এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু কপোত কপোতি বসে আছে । একটু আগে এক বাদামওয়ালা ওদের সামনে বাদাম দিয়ে গেছে । রাফায়েল আস্তে আস্তে বাদাম চিবাচ্ছে আর নিশির কথা শুনছে ।
নিশি অনেক কথাই বলল তবে কোনটা যে কাজের ঠিক বুঝতে পারলো না । রাফায়েল এতো সময় মন দিয়ে শুনছিল ওর কথা । তারপর বলল
-নাহ । এমন কিছুই তো মনে হচ্ছে না । সবই তো স্বাভাবিক ।
নিশি বলল আমি আর কিছু জানি না আসলে ! আমার জীবনে যা অদ্ভুদ আর অস্বাভাবিক ঘটনা কিংবা দুর্ঘটনা ঘটেছে সবই আপনাকে বললাম । এর বেশি কিছু আমার মনে .....
কথাটা বলতে বলতেই নিশি থেমে গেল । রাফায়েল বলল
-কি হল ?
নিশি খানিকটা সময় ইতস্তর করে বলল
-আসলে আরেকটা ঘটনা আছে !
-বল কি সেটা ?
-আমি ঠিক বলতে পারবো না । আমার ঠিক মনেও নেই । আমি ঠিক জানিও না । মানে আমি ঠিক বলতে পারবো না । এই বিষয় নিয়ে আমাদের পরিবারে কথা বলা নিষেধ । আমরা তখন এখানে থাকতাম না । মুন্সিগঞ্জে থাকতাম, আমার বাবার ব্যবসা ছিল সেখানে । সেখানে আমাদের গ্রামের বাসা । সেখানে আমি স্কুল পর্যন্ত পড়েছি ।
-তারপর ? এখানে চলে আসার কারন ?
নিশি কিছুটা সময় চুপ করে ভাবলো । যেন কিছু মনে করার চেষ্টা করছে । তারপর বলল
-আসলে ওখানে আমার সাথে একটা ঘটনা ঘটে ছিল । আপনি জানেন যে আমার তিনটা বিয়ের প্রোপোজাল এসেছিলো কিন্তু আসলে তিনটা না । চারটা । স্কুলে থাকতেই আমার একটা বিয়ের প্রোপোজাল এসেছিলো । অবশ্য বাবা তখন মানা করে দিয়েছিলো । কিন্তু সেই মানুষটা কেন জানি হাল ছেড়ে দিতে নারাজ ছিল । সে আমার পিছনে হাত ধরে পড়েছিলো । আমাকে সে বিয়ে করবেই এমন একটা । তারপর একদিন .....
এইটুকু বলেই নিশি আবারও দম দিল । অনেকটা সময় কথা বলে যেন ক্লান্ত হয়ে গেছে । রাফায়েল ওকে বিশ্রাম নেওয়ার সময় দিল । নিশি আবার বলল
-তখন আমার সবে মাত্র এস এস সি পরীক্ষা শেষ হয়েছে । একদিন আমি বিকেলে একা একাই মার্কেট থেকে বাসায় আসছিলাম । সেই সময় সেই মানুষটা আমার সামনে এসে হাজির হল । আমাকে বোঝাতে শুরু করলো যে মানুষটা আমাকে কত ভালবাসে । কিন্তু আমার আসলে তখন কিছুই করার ছিল না । বাবা চাচাদের বিরুদ্ধে কিছু করবো সেটাও সম্ভব ছিল না । ইচ্ছেও ছিল না । তারপর যখন দেখলো আমি রাজি হই নি তখন সে আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে যেতে চাইলো । তবে আমি পালিয়ে যেতে সক্ষম হলাম । বাসায় এসে বলেও দিলাম সব ।
রাফায়েলের মনে হল যে ও আসল সমস্যা খুজে পেতে শুরু করেছে । এখান থেকেই সকল সমস্যার শুরু হয়েছে । রাফায়েল বলল
-এই মানুষটার নাম কি ছিল ?
-রায়হান সম্ভবত । রায়হান জোয়াদ্দার । এলাকাতে তার ব্যবসা ছিল । বাবা মা ছিল না । আমার থেকে বেশ বড়ই ছিল সে বয়সে । এই জন্য বাবা বিয়ে দিতে রাজি হয় নি ।
-তারপর ? তারপর কি হল ?
-বাবা তো শুননে একদম আগুন গরম হয়ে গেল । ছোট চাচা তখনই তার বন্ধুবান্ধব নিয়ে চলে গেল । তাকে ধরে সেই মাইর দিল । তারপর দিল পুলিশে ।
-তারপর ?
-তারপর আর জানি না । একদিন হঠাৎ করেই আমরা এলাকা ছেড়ে দিলাম । বাবা তার ব্যবসা নিয়ে এলেন ঢাকাতে । তারপর থেকে আর তার খবর জানি না ।
-তুমি জানো না কি হয়েছে ?
-না । আমি আর কোন দিন খোজ নেই নি । নতুন কলেজে ভর্তির পরপরই নতুন জীবন শুরু হয়ে গেল । আমার আর পুরানো কথা মনে পড়তো না ।
রাফায়েল অনেকটা সময় চুপ করে কি যেন ভাবতে লাগলো । তারপর বলল
-তোমার সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ ।
চার
নিশি ওর মাকে শক্ত করে চেপে ধরলো । সে আসলে জানতে চায় তারা কেন সেই সময়ে তারা তাড়াহুড়া করে ঢাকা চলে এসেছিলো । এর পেছনে কি কারন ছিল ? প্রথমে ওর মা কিছুতেই বলতে চায় নি কিন্তু একটা পর্যায়ে ওর মা বলতে বাধ্য হল যে ঐ সময়ে কি হয়েছিল ।
রায়হান নামেই ঐ মানুষটাকে পুলিশে দেওয়ার পর আরও কিছু সময় মারধোর করা হয় । কিন্তু শেষে পুলিশি ঝামেলা বাড়বে বলে কোন অফিশিয়াল অভিযোগ করা হয় নি । তাকে সাবধান করে দেওয়া হয় যেন এর পরে নিশির আসে পাশে যাওয়ার চেষ্টা না করে । কিন্তু ঝামেলা হয় একটু পরে । রায়হানকে ছেড়ে দেওয়ার দুইদিন পরেই রায়হান আত্মহত্যা করে । লোক মুখে শুনা যায় ওকে যেখানে পাওয়া যায় ঝলন্ত অবস্থায় সেইটার আশে পাশের পরিবেশ নাকি অন্য রকম ছিল । ঘরটার দেওয়াল ছিল পুরোপুরি কালো রঙ করা । তার মৃত দেহের চারিদিকে ছিল কালো একটা সার্কেল করা ছিল । সেখানে অদ্ভুত কিছু সাইন আঁকা ছিল । মানুষজন ঠিক মত বুঝতে পারে নি তবে সেটা যে স্বাভাবিক কিছু ছিল না সেটা তারা বুঝতে পেরেছিল । আর ছেলেটার চোখ দুটো পুড়ে কালো হয়ে গিয়েছিলো । কিভাবে এসব হল কেউ বলতে পারবে না । তবে পুলিশি ঝামেলা হতে পারে বলেই ওরা সেই এলাকা ছেড়ে চলে এসেছিল । তবে তার চাচারা ব্যাপারটা সামলে নিয়েছিলো ।
সত্যটা জানার পরেই নিশির বুঝতে কষ্ট হল না যে রাফায়েল নামের মানুষটা যা বলেছে সেটা মিথ্যা নয় । ওর সাথেই কিছু একটা করে গিয়েছে রায়হান । ও যদি শাহেদের ব্যাপারটা ভুলেও যায় তাহলেও সামনে ও যে যে মানুষকে বিয়ে করতে চাইবে তার বেলাতেই এই সমস্যা হবে । ওর কারনে দুইজন মানুষের জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছে । একজনের নষ্ট হতে চলেছে । নিশি এই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারছে না । ওর নিজের জন্য কাজটা করতে হবে । সামনে যার সাথেই ও যুক্ত হতে যাবে তার সাথেই এমন কিছু হবে । রায়হান নামের মানুষটার মনভাব ছিল যে ও যেহেতু নিশিকে পায় নি আর কাউকে পেতে দিবে না ।
নিশি আর দেরি করলো না । নিজের রুমে এসেই রাফায়েল নামের মানুষটাকে ফোন দিল ।
-আমি জানি এসব কেন হচ্ছে !
নিশির প্রথম কথাটাই এমন ছিল । রাফায়েল ওকে আরও একটু একটু অবাক করে দিয়ে বলল
-হ্যা আমিও জানি । রায়হান খুব খারাপ ধরনের একজন অপদেবতাকে ডেকে নিয়ে এসেছে এবং এনে তোমার সাথে আটকে দিয়েছে । এবং সেই অপদেবতার খাদ্য হিসাবে দিয়েছে নিজের জীবন । এটা হচ্ছে সব থেকে খারাপ । জীবনের বিনিময়ে যা অপদেবতাকে ডেকে আনা হয় সেটা হয় সব থেকে বেশি শক্তিশালী । এটা আজীবন থেকে যায় । যত সময় না তুমি মারা যাবে তত সময় এটা যাবে না ।
নিশি বলল
-এখন ? এটার থেকে মুক্তির উপায় কি ?
ফোনের ওপাশে কিছু সময় নিরবতা বিরাজ করলো । নিশির মনে হল রাফায়েল একটু আগে কি বলেছিল । রাফায়েল বলেছিল নিজের জীবনের মূল্যটা হচ্ছে সব থেকে বেশি । এটার জন্য যা বিনিময় করা হয় সেটার শক্তি সব থেকে বেশি হয় । সেটা কোন দিন ওকে ছেড়ে যাবে । এর মানে হচ্ছে ওকে সারাটা জীবন এই অভিশাপ বয়েই বেড়াতে হবে । নিশি আবার বলল
-এর থেকে মুক্তির উপায় কি নেই ?
-সরাসরি নেই । তবে উল্টো দিক দিয়ে আছে। তবে সেটা খুব বেশি কঠিন !
নিশি আবারও চুপ করে গেল । রাফায়েল আরও কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলল
-কাজটা খুব বেশি কঠিন হবে । খুব বেশি কঠিন হবে তোমার জন্য ।
নিশি বলল
-এটা করলে কি শাহেদ ঠিক হয়ে যাবে ?
-হ্যা । তোমার কাছ থেকে ঐ অপদেবতা মুক্ত হয়ে যাবে ।
-তো ? আমাদের কি করতে হবে !
রাফায়েল আবারও চুপ করে রইলো । বেশ কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বলল
-আমাদের ঐ অপদেবতাকে মেরে ফেলতে হবে ।
-তো করুন না । আমাকে বলুন কি করতে হবে ? আমি আপনাকে সব ধরনের সাহায্য করবো ।
রাফায়েল আবারও তারপর বলল
-ঐ অপদেবতার জীবনটা তোমার জীবনের সাথে যুক্ত । কেবল মাত্র তোমার জীবন দিয়েই তাকে মারা যাবে ?
নিশি যেন ঠিক বুঝতে পারলো না রাফায়েল আসলে কি বলতে চাচ্ছে । নিশি বলল
-মানে ?
-মানে তোমাকে মরতে হবে !
পাঁচ
নিশি জানতো কাজটা কঠিন হবে । কিন্তু এতো কঠিন হবে সেটা বুঝতে পারে নি । গত দুই দিন ধরেই সে হেটেই চলেছে । এতোটা কষ্ট সে কোন দিন করে নি । সারা জীবন শহুরে মানুষ হওয়ার নিশির জন্য এই পাহাড় চড়াটা অনেক বেশি কষ্টের । ওর একটা সময়ে মনে হল ও হয়তো আর পারবেই না । তারপরেই ওর মনে হল ওকে পারতেই হবে । অন্তত যে তিনজন মানুষ ওর কারনে কষ্ট পাচ্ছে তাদের কে রক্ষা করতেই হবে ।
কাজটা কঠিন হলেও উপায়টা খুব সহজ । অপদেবতাটা আসলে ওর সাথে যুক্ত হয়ে আছে । ও যখনই কোন মানুষকে ভালবাসবে তখনই ঐ অপদেবতাটা ঐ মানুষটার উপর গিয়ে ভর করবে । কিন্তু তার এই পৃথিবীতে হোস্ট বডিটা নিশি নিজে । আর নিশির থেকে ঐ অপদেবতাকে মুক্ত করার উপায় হচ্ছে নিশিকে মেরে ফেলা । যখনই নিশির আত্মা নিজের দেহ থেকে মুক্ত হয়ে যাবে তখনই ঐ অপদেবতাও নিশির থেকে মুক্ত হবে । প্রতেক মানুষের দেহ এবং আত্মা একটা অটুট বন্ধনে যুক্ত থাকে । রায়হানের রিচুয়ালের ফোলে ঐ অপদেবতাটা ওর আত্মা এবং দেহের সাথে যুক্ত । যখনই আত্মা আর দেহ আলাদা হয়ে যাবে ঐ অপদেবতার বন্ডটাও আলগা হয়ে যাবে ।
নিশি হাঁপাতে হাঁপাতে বলল
-আর কত দুর ?
রাফায়েল একটু থামলো । ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-আর বেশি দুর নয় ।
তারপর নিশির দিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি নিশ্চিত যে তুমি কাজটা করতে চাও ?
-চাই ।
-কোন নিশ্চয়তা নেই যে তুমি মরে গিয়ে ফিরে আসবেই ।
-তবুও চাই ।
নিশি আসলেই কাজটা করতে চায় । যে কোন ভাবেই নিজেকে এই অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে চায় । এর জন্য যদি ওকে মরতেও হয় তাহলেও নিশির কোন আপত্তি নেই । যখন থেকে ও জানতে পেরেছে যে ওর কারনে আগে দুজন মানুষের জীবন নষ্ট হয়েছে তখন থেকেই ও নিজের মনকে কিছুতেই শান্ত করতে পারছে না । যতই ওর কোন দোষ না থাকুক তবুও কেবল মাত্র ওর কারনেই কাজটা হয়েছে । ও যদি না থাকতো তাহলে আজকে ঐ মানুষ দুটো সুস্থ স্বাভাবিক থাকতো ।
এটা জানার পর থেকেই নিশি কাজটা করতে আগ্রহ হয়েছে । আর তার উপর রাফায়েল মানুষটাকে প্রথম দিন পছন্দ না হলেও যতই ওর সাথে কথা বলছে ততই ওর এই বিশ্বাস জন্ম নিয়েছে যে এই মানুষটার উপর ঠিক ভরশা করা যায় । ওকে সে কিছু হতে দিবে না এটা নিশির শুরু থেকেই মনে হচ্ছে । এমনটা মনে হওয়ার কি কারন সেটা নিশি জানে না তবে কেবল মনে হচ্ছে মানুষটা ওকে ঠিক ঠিক রক্ষা করবে ।
তাই তো যখন ওকে কোথায় যেতে হবে বলল ও তখন সাথে সাথেই রাজি হয়ে গেল । একটা বারের জন্যও ওর মনে হল না যে এই মানুষটার সাথে এতোদুর অপরিচিত এক টা জায়গাতে যাওয়া ঠিক হচ্ছে কি না । কেবল মনে হল যে এই মানুষটার দ্বারা ওর কোন ক্ষতি হতে পারে না ।
ওরা এগিয়ে চলছে পাহাড় উপর দিয়ে । পার্বত্য অঞ্চলের এই পাহাড়েই মন্দিরটার অবস্থান । আদিবাসীদের এই মন্দিরটার কথা অনেকে জানে না । দেশের সীমানা ছাড়িয়ে মায়ানমারে গিয়ে পড়েছে সেটা । তবে রাস্তা অতি দুর্গম হওয়ার কারনে সেখানে কেউ যায় না । যেতে পারে না । যাওয়ার কোন পথও নেই । সেখানেই নিশিরা যাচ্ছে । এই মন্দিরের ভেতর থেকে নাকি কোন আত্মা বাইরে যেতে পারে না । সেখানেই আটকে থাকে । এই জন্যই নিশিকে মরতে হবে সেখানে গিয়ে ।
আরও তিন ঘন্টা চলা পরে ওরা মন্দিরে গিয়ে হাজির হল । নিশি মন্দিরটার দিকে তাকিয়ে রইলো । মন্দির বলে ঠিক চেনাও যাচ্ছে না । বন জঙ্গলে ভর্তি চারিদিকটা । নিশি শান্ত কন্ঠে রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি নিশ্চিত যে একখানেই ?
-হ্যা । এটাই ।
-তো ! কখন মরবো আমি ?
নিশি কথাটা এমন ভাবে বলল যে রাফায়েল হেসে ফেলল । নিশিও খানিকটা কৌতুকের সুরেই বলেছে ।
ছয়
নিশি নিজের দেহের ভার মুক্তটা বুঝতে পারছে । নিশির কেবল মনে হল ওর দেহে যেন কোন ভার নেই । কিছুটা সময় এলোমেলো মনে হল ওর কাছে । তারপর চারিপাশে তাকিয়ে প্রথমে যে জিনিসটা বুঝতে পারলো ও ঠিক মাটিতে নেই । মাটি থেকে একটু উপরে উঠে ভাসছে । নিচে তাকাতেই সে প্রবল বিস্ময় দিয়ে দেখলো ঠিক ওর নিচেই ও শুয়ে আছে ।
সাথে সাথেই ওর মাথাটা ঝিম ঝিম করে উঠলো । নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করলো ও । ঠিক কি হচ্ছে ও বুঝতে পারছে না । ও নিচে যদি শুয়েই থাকবে তাহলে ও নিজেকে দেখবে কিভাবে ? এলোমেল হয়ে যাচ্ছে সব । ওর মনে হল ওকে এখনই চলে যেতে হবে । এখান থেকে পালাতে হবে ।
নিশি তখনই আশে পাশে তাকালো । অদ্ভুদ ভাবে লক্ষ্য করলো ও আসলে একটা খোলা প্রান্তরে আছে । যতদুরে চোখ যার কেবল ধুধু সমান মাঠ ছাড়া আর কিছু নেই । এ কোথায় চলে এল ও ? চারিপাশে আর কিছু নেই । ও আর এই নিচে শুয়ে থাকা ঘুমন্ত আরেক নিশি । তবুও ওকে এখান থেকে পালাতে হবে । যে কোন ভাবেই । এখানে থাকা যাবে না ।
পাখির পালকের মত হালকা শরীরটা ও সামনের দিকে বাড়ালো । ভেসে ভেসেই কিছু দুর যেতেই একটা ধাক্কার মত খেল । কিছুর সাথে যেন আটকে গেল । পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখলো ওর এই দেহ থেকে একটা দড়িটার মত কিছু গিয়ে আটকে আছে নিচে শুয়ে থাকা দেহটার দিকে । সেটার সাথেই আটকে আছে ও । হাত দিয়ে সেটা স্পর্শ করতেই অবাক হয়ে গেল । এটা কোন সাধারন দড়ি নয় । ওর কেবল মনে হল দড়িটা তৈরি কোন আলো জাতীয় জিনিস দিয়ে ।
বেশ কিছুটা সময় ও সেই আলোর দড়িটা ধরে টানাটানি করলো কিন্তু কোন লাভ হল না । নিশির কেবল মনে হল ওর এখন নিজেকে মুক্ত করতে হবে । যেকোন ভাবেই এই সংযোগটা বিচ্ছিন্ন করতে হবে । নয়তো মুক্তি পাবে না ।
এবার নিচে নেমে এল । ঠিক দাড়ালো শুয়ে থাকা দেহটার দিকে । দুটো আলোর দড়িই দুজনের নাভির থেকে বের হয়েছে । তারপর সে দড়িটা ধরে টানাটানি শুরু করে দিল । যে কোন ভাবেই এটা টেনে ছিড়তেই হবেই নয়তো ওর মুক্তি হবে না ।
ঠিক সেই সময়ে নিশির মাথার ভেতরে কেউ যেন ওর নাম ধরে ডেকে উঠলো ।
নিশিই ই ই ই ই ই
টানা টানি থেমে গেল ! আমার মনযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলো । আবার কি কেউ ডাকছে ওকে ?
নিশি ই ই ই ই ই
নিশি এবার এদিক ওদিক তাকালো কিন্তু কাউকে দেখতে পেল না । আওয়াজটা কোথা থেকে আসছে ?
কেউ যেন ওকে বলছে ছিড়ো না ! ছিড়ো না !
নিশির এবার বুঝতে পারলো কেউ ওকে কি করতে বলছে । ও যে কাজটা করতে যাচ্ছিলো সেটা করতে মানা করছে । কিন্তু তাহলে কি হবে ? ও এখানেই এভাবে বসে থাকবে । নিজেকে যদি এই এই সংযোগ থেকে মুক্ত করতে না পারে তাহলে ও এখান থেকে পালাতেও পারবে না ।
আবারও ও মাথার ভেতরে সেই আওয়াজটা শুনতে পেল ।
অন্য সুতাটা ছিড়ো ...
অন্য সুতা মানে ?
কোথায় সেটা খুজতে গিয়ে আবারও সে তাকালো ঘুমন্ত নিশির দিকে । প্রথমে কিছু দেখলো না । কিন্তু আরও একটু ভাল করে তাকাতেই দেখতে পেল ওর আলোর সুতাটা যেদিক থেকে বের হয়েছে ঠিক তার পাশে আরো একটা সুক্ষ সুতার মত দেখা যাচ্ছে ।
এটা ছিড়তে বলা হচ্ছে ।
নিশি সেই হলুদ সুতাটা ধরে একটু টান দিয়ে দেখলো । দেখলো সেটার কোন শেষ মাথা নেই ।
এটা ছিড়তে বলা হচ্ছে কি ?
নিশি কিছুই বুঝতে পারলো না । ওর কিছুই মনে পড়ছে না । ও কে আর এখানে কিভাবে এল আর কোথায় যাবে এসব কোন কিছুই যেন ওর মাথায় নেই । কেবল সামনে শুনে থাকা এই মানুষটাকে সে চিনতে পারছে । সে নিজেই যে সেখানে শুনে আছে সেটা বুঝতে পারছে । এর বেশি কিছু সে জানে না ।
কিন্তু মাথার ভেতরে এই শব্দটা কিসের !
তখনই একটা হুংকারের শব্দ কানে এল । নিশি কেবল অনুভব করলো কোন েক ভয়ংকর যন্তু ওর দিকে তেড়ে আসছে । কিন্তু ও পালাবে কিভাবে ? ওর এখানেই আটকে থাকতে হবে যতক্ষণ না এই সংযোগটা সে বিচ্ছিন্ন করতে পারছে ।
কি করবে এখন সে ?
তখনই মাথার ভেতর আবার সেই আওয়াজটা শুনতে পেল সে । ছিড়ে ফেল । অন্য সংযোগটা ছিড়ে ফেল !
রাফায়েল অনেকটা সময় তাকিয়ে আছে নিশির ঘুমন্ত চেহারার দিকে । কিন্তু রাফায়েল ভাল করেই জানে মেয়েটা ঘুমিয়ে নেই । মারা গেছে । সে নিজেই মেয়েটার শরীর থেকে ওর রুহটা আলাদা করে ফেলেছে । এতো সময়ে মেয়েটার রুহ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ারও কথা ছিল কিন্তু রাফায়েল জানে সেটা এখনও এই মন্দিরের ঘরের ভেতরেই আছে । তবে সেটা কত সময় থাকবে সেই বিষয়ে রাফায়েল জানে না ।
আবারও ঘরটা কেঁপে উঠলো । রাফায়েল জানে আওয়াজটা কিসের ! অন্য জগতের সেই প্রাণীটার এই জগতে টিকে থাকার ভিতই ছিল নিশি । যখনই নিশিই আর এই জগতে থাকছে না তখন তার এই জগতের থাকাটা অসম্ভব হয়ে যাবে । তাই শেষ করন কামড় দেওয়ার চেষ্টা করছে । মন্দিরের ভেতরে প্রবেশের চেষ্টা করছে । কিন্তু সেটা পারছে না । এই মন্দিরটা তৈরিই হয়েছিলো সকল অশুভ শক্তিকে রুখে দেওয়ার জন্য । কথিত আছে কোন দেবতা স্বয়ং নাকি এই মন্দিরটা তৈরি করেছিল । রাফায়েল জানতো সেই অন্য জগতের প্রাণীটা মন্দিরটা ভেতরে ঢুকতে পারবে না । কিন্তু সমস্যা হচ্ছে অন্য খানে !
মেয়েটা যদি ঐ ভুল সংযোগটা বিচ্ছিন্ন করে ফেলে তাহলে আর কোন ভাবেই নিশিকে বাঁচানো যাবে না । এই কেবল একটা ভয় । রাফায়েল তাকে বারবার কেবল এই কথাটাই বলার চেষ্টা করছিলো । মৃত্যুর পরে মানুষ যখন নিজ দেহ থেকে মুক্ত হয়ে যায় তখন তার আর কিছু মনে থাকে না । সে আশে পাশের সব কিছু থেকে মুক্ত হয়ে যায় । কেবল নিজের এই দেহ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পায় না সে । নিজেকে আবিস্কার করে একটা সীমাহীন খোলা মাঠের ভেতরে যেখানে কেবল সে আর তার মৃত দেখ টা রয়েছে ।
মৃত্যুর পরেও মানুষের আত্মা কিংবা রুহ কিছুটা সময় নিজের দেহের আসে পাশে ঘোরাঘুরি করে । দেহের সাথে আত্মার যে বন্ধন সেটা ছিড়তে একটু সময় লাগে । সেটা সংযোগটা আপনা আপনিই ছিড়ে যায় কিন্তু এখন যেহেতু নিশির মারা যাওয়ার সময় নয় তাই সেটা আর আপনাআপনি ছিড়বে না । নিশিকে নিজ থেকে ছিড়তে হবে ।
হঠাৎই বাইরের হুংকার একদম চুপ হয়ে গেল । রাফায়েল বুঝতে পারলো সময় হয়ে এসেছে । ঘটনা দুই হতে পারে । এক নিশি নিজের দেহের সাথে সংযুক্ত সংযোগটা ছিড়ে ফেলেছে । তাহলেও ঐ প্রাণীটা এই জগত থেকে নিঃশ্বেষ হয়ে যাবে । কারন নিশি মারা যাওয়া মানেই হচ্ছে তার হোস্ট বডি মারা যাওয়া । হোস্ট বডি ছাড়া যেমন কোন পরগাছা বাঁচতে পারে না তেমনি সেও বাঁচতে পারবে না । আর দুই হতে পারে যে নিশি সঠিক সংযোগটাই বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে । অর্থয়াৎ ঐ অন্য জগতের অপদেবতা নিশির দেহের সাথে যে সংযোগ দিয়ে দিল সেই সংযোগটাই নষ্ট করে ফেলেছে । তাহলেও ঐ অপদেবতাটা এই জগত থেকে চলে যাবে ।
এই সময় । রাফায়েল আবার দ্রুত মন্ত্র পড়তে শুরু করলো । এখনই নিশির আত্মাকে আবার ওর দেহের ভেতরে প্রবেশ করাতে হবে ।
রাফায়েল দ্রুত মন্ত্র পড়ে চলল ।
রাফায়েলের কপালে বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে । এতো সময় নিশির চোখ মেলে তাকানোর কথা ।
কিন্তু না । সে এখনও তাকালো না ।
তার মানে কি মেয়েটা সত্যিই সত্যি মারাই গেল ?
রাফায়েল আবারও পড়তে শুরু করলো মন্ত্রটা । তারপর আবার .....
একটা সময় মনে হল মেয়েটা আর উঠবে না ।
হঠাৎ করেই রাফায়েলের মিশুর চেহারাটা মনে হল । আচ্ছা মিশু কি ওর জন্য এমন কিছু করতো ? অন্য কাউকে বাঁচানোর জন্য এমন কিছু করতো ?
হ্যা করতো । রাফায়েলের মনে আছে মিশি কতটা সাহসীকতার সাথে নিজের বোনকে বাঁচানোর জন্য ঐ মৃত্যু পুরিতে ঢুকেছিল । এই মেয়েটিও ঠিক সেই কাজটা করতে করলো ।
রাফায়েলের বুকের ভেতরে একটা তীব্র হাহাকারের অনুভুতি জেগে উঠতো । এই মেয়েটাকে যখন সে বেদীর উপর শুয়ে মন্ত্র পড়তে যাবে তখন তাকে জিজ্ঞেস করেছিলো তার ভয় লাগছে কি না । নিশি বলেছিলো ওর কেন জানি ভয় লাগছে না । কারন হিসাবে বলেছিলো যে ওর ভরশা আছে যে রাফায়েল তাকে ঠিক ঠিক ফিরিয়ে নিয়ে আসবে । এই কথাটা বারবার মনে পড়লো রাফায়েলের । ইচ্ছে হল সব কিছু ছেড়ে ছুড়ে চলে যেতে । সামনে রাখা রিচুয়্যালের সব জিনিস পত্র গুলো ছুড়ে ফেলে দিল সে । মন্দিরের দেওয়ালে লেগে সব গুলো ঝনঝন করে উঠলো । তার তখনই নিশি জেগে উঠলো !
রাফায়েলের দিকে চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় । তারপর বলল
-আমি কি সত্যি সত্যিই মনে গেছি ? আপনার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে তাই ....
রাফায়েলের আটকে থাকা দমটা যেন বের হয়ে এল । সেই সাথে একটা স্বস্তির হাসিও বের হয়ে এল । এবার সত্যি সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলো সে !
পরিশিষ্টঃ
মিশু আজকে খুব চমৎকার করে সেজেছে । বাঙ্গালী মেয়ে যে কারো বিয়েতে যাওয়ার সময় পাল্লা দিয়ে সাজগোজ করে । যদিও মিশুর এসবে অভ্যাস নেই । তবে আজকে কেন জানি হঠাৎ করেই তার খুব সাজতে ইচ্ছে করছিলো । আর তখনই রাফায়েলের ফোন এসে হাজির । ওকে খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল যে সন্ধ্যায় ওর একটা বিয়ের দাওয়াত আছে । ও যেন তৈরি হয়ে থাকে ।
মিশুর প্রথমে কথাটা ঠিক বিশ্বাস হল না । তারপরই মনে হল এই অদ্ভুদ মানুষটার পক্ষে সব কিছু করা সম্ভব । হয়তো সে বুঝতে পেরেছে আজকে মিশুর অনেক সাজতে ইচ্ছে করছিলো তাই সেই ইচ্ছে পূরন করতেই এমন একটা কাজ করেছে ।
মিশু একা একাই বিয়ে বাড়িতে হাজির হয়ে গেল । অফিসার ক্লাবে বিয়ের আয়োজন । খবর নিয়ে জেনেছে বরের নাম শাহেদ আর বউয়ের নাম নিশি । অথচ মিশু এদের কাউকে চিনে না । কেবল বর বউ কেন বিয়েতে আশা কাউকেই সে চিনে না । কেবল একজনকে সে চিনে । কিন্তু সেই মানুষটা কোথায় ? এখনও তার আসার নাম নেই ?
আসবে তো আবার ?
সাথে সাথেই যেন মিশু রাফায়েলকে দেখতে পেল । গেট দিয়ে ঢুকছে । আজকে সে কালো শার্ট পরেনি তবে কালো পাঞ্জাবী পরেছে । বিয়ের অনুষ্ঠানেও কেউ কালো পাঞ্জাবী পরে । মিশুর ইচ্ছে হল কাছে আসলে খুব করে বকে দিবে কিন্তু তারপরই মনে হল থাকুক, সুন্দরই তো লাগছে ।
মিশু আপন মনেই হেসে উঠলো । যাক ধীরে ধীরে মানুষটা ওর কাছে আসা শুরু করেছে । আগে তো মাসের মাস চলে যেত তার কোন খোজই থাকতো না । যাক অন্তত ওকে নিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছে সে । মিশু এতেই খুশি ।
বলা যায় সামনে আবার ওদের কি অপেক্ষা করছে !
সমাপ্ত
রাফায়েল সিরিজ ০৯
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা জুন, ২০১৮ রাত ৮:৩০