অপু খানিকটা সময় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো নিথির দিকে । টেডিবিয়ারটা প্রায় নিথির সমান লম্বা । দুই হাত দিয়ে সেটা চেপে ধরতে ওর কষ্টই হচ্ছে তবুও চেপে ধরে আছে । এখনও ঠিক ওর বিশ্বাস হচ্ছে না যে এই টেডিবিয়ারটা ওর নিজের হতে চলেছে । মুখের আনন্দের আভাটা মেয়েটা কিছুতেই আটকে রাখতে পারছে না ।
তবে সেখানে একটা সংঙ্কার ভাবও দেখতে পেল । ওর বড় বোন নিশি এখনও কিছু বলে নি । সে যদি বলে যে নিতে হবে না তাহলে নিথি টেডিটা নিতে পারবে না । অপু আবার বলল
-কি খুশি ?
নিথি আবারও ওর বড় বোনের দিকে তাকালো । নিশি কি বলবে যেন খুজে পাচ্ছে না । অপুর দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি এটা কেন করতে ....
অপু নিশিকে কথাটা শেষ করতে দিল না । বলল
-আপনি কেন ওর আনন্দটা নষ্ট করতে যাচ্ছেন বলেন ?
-কিন্তু এটার অনেক দাম !
-দাম দিয়ে সুখ দুঃখ বিচার করা যায় ? বলেন যায় ?
নিশি কি বলবে ঠিক খুজে পেল না । অপু বলল
-আর এটা যদি ও না নেয় তাহলে জিনিসটা নষ্টই হয়ে যাবে । আমার কোন কাজে আসবে না । তখন এটার দাম হবে শূন্য টাকা । বুঝেছেন ।
অপু নিশির দিকে তাকিয়ে দেখলো নিশি যেন এখনও ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না । টেডি বিয়ারটা আসলেই একটু দামী । অপু একজনের জন্য কিনেছিলো কিন্তু তাকে আর দেওয়া হয় নি । কোন দিন দেওয়াও হবে না হয়তো । অপু জানতো ব্যাপারটা এরকম ভাবেই শেষ হবে তবুও সে কিনেছিলো তার জন্য । শেষ বার একটা চেষ্টা । ডুবন্ত মানুষ যেমন সব কিছু আকড়ে ধরে ভেসে থাকতে চায় সেই রকম । সব চেষ্টাই সে করেছে কিন্তু তাকে আর পাওয়া হয় নি । অবশ্য অনেক আগে থেকেই সে জানতো এমনটাই হবে ।
অপু আবারও বলল
-আজকে নিথির জন্মদিন । আজকে অন্তত কিছু বলবেন না । দেখুন ওর মুখটা !
নিশি বলল
-আজকে তো আপনারও জন্মদিন তাই না ?
অপু এই কথা শুনে একটু চমকে উঠলো । ওর জন্মদিনের কথা তো নিশির জানার কথা না । তাহলে মেয়েটা কিভাবে জানলো ? অবশ্য নিথিরও যে আজকে জন্মদিন সেটাও অপুর জানার কথা ছিল না । প্রতি জন্মদিনের মতই এই জন্মদিনেও অপুর মনটা খারাপই ছিল । তাই অফিস থেকে আগে আগেই ছুটি নিয়ে চলে এসেছিলো । সেই প্রথম থেকেই এই দিনটা ও একা একাই পালন করে । ফোন বন্ধ করে রাখে । এমন কি ফেসবুক আইডিও বন্ধ করে রাখে যাতে করে কেউ ওকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা না জানাতে পারে ।
আজকেও ও তেমনটাই করেছিল । নিজের ফ্ল্যাটে চলে এসেছিলো একটু আগে আগেই । অবশ্য ফ্ল্যাট বলতে কবুতরের ঘরের মত এই ছাদের দুই কামড়ার একটা বাসা । বাড়িওয়ালাকে অনেক অনুরোধ করেই এই বাসাটা ও ভাড়া পেয়েছে ।
বিকেল বেলা একা একাই হাটছিলো তখনই দুইবোনকে ছাদে আসতে দেখে । অবশ্য সিড়ি কিংবা ছাদে প্রায়ই নিশিদের সাথে অপুর দেখা হয়ে যায় । ওর মতই নিশিরাও এই বাসায় ভাড়াটিয়া । উঠতে নামতে দেখা হবে এটাই স্বাভাবিক । তবে কথা হয় না কখনও । অপু কোনদিন কথা বলার আগ্রহবোধ করে নি । পৃথিবীর বেশির ভাগ বিষয়ের উপর থেকেই অপু আগ্রহ চলে গেছে অনেক আগেই ।
আজকে যখন নিথি ওর আপুর কাছে একটা টেডিবিয়ার কিনের দেওয়ার জন্য বলছিলো তখনই কথাটা কানে গেল । মেয়েটার আজকে জন্মদিন সেটা জেনে একটু অবাকই হল । সেই জন্মদিনের উপহার হিসাবেই মেয়েটা একটা টেডিবিয়ার চাচ্ছে । তখনই অপুর মনে হল ওর কাছে একটা টেডিবিয়ার রয়েছে । প্যাকেট করা একদম নতুন । অনেক দিন আগে একজন কে দেওয়ার জন্য এই টেডিবিয়ারটা কিনেছিলো ও । তাকে আর দেওয়া হয় নি ।
অপু খানিকটা অবাক হয়ে বলল
-আপনি কিভাবে জানলেন ?
নিশি এবার যেন একটু হাসলো কেবল । কিন্তু সেই প্রশ্নের জবাব দিল না । তারপর নিথির দিকে তাকিয়ে বলল
-ভাইয়াকে ধন্যবাদ দাও !
নিথির চেহারা থেকে এবার আনন্দটা ঠিকড়ে বের হয়ে এল । ওর যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না যে ওর অপু রাজি হয়ে গেছে । অপুর দিকে তাকিয়ে বলল
-থ্যাঙ্কিউ ভাইয়া ।
অপু কেবল হাসলো । তারপর ওর মাথায় একটু হাত দিয়ে বলল
-এ ভেরি হ্যাপি বার্থডে টু ইউ ।
-আপনাকেও ।
ওরা চলে যাওয়ার পরপরই অপু লক্ষ্য করলো ওর আজকে মন খারাপের ভাবটা অনেকটা কেটে গেছে । বিশেষ করে নিথির আনন্দমাখা মুখটা দেখে ওর খুব বেশি ভাল লাগছে । ছাদে আরও কিছুটা সময় সে হাটাহাটি করলো । তারপর নিজের ফোনটা চালু করলো । সাথে সাথেই অনেক গুলো মেসেজ এসে হাজির হল সেখানে । ওর পরিচিত অনেকে মেসেজ পাঠিয়েছে ।
অনেক দিন পর অপু সবার মেসেজের রিপ্লাই করলো । এর আগে কোন দিনই ও কাজটা করতো না । কয়েকজন তো অবাক হয়ে সাথে সাথে ওকে ফোন করলো । ওরাও খুশি হয়েছে যে অপু মেসেজ গুলোর রিপ্লাই করেছে ।
রাতের বেলা অপুর জন্য আরও বড় একটা ঘটনা অপেক্ষা করছিলো । নিশি আর নিথি এসে হাজির ওর ফ্ল্যাটে । ওকে এক প্রকার জোর করেই ওদের বাসায় নিয়ে গেল । সেখানে আজকে নিথির জন্মদিন উপলক্ষ্যে অনেক রান্না বান্না হয়েছে । এমন কি একটা কেকও কাটার ব্যবস্থা হয়েছে । নিথি আর অপু মিলে সেই কেকটা কাটলো । অপুর মনে হল ও যেন নিশিদের পরিবারের একজন সদস্য ।
রাতে যখন ওদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আবার ছাদের ঘরে ফিরে এল তখন নিশি এল ওর পেছন পেছন । দুজন ছাদে দাড়িয়ে রইলো অনেকটা সময় পাশাপাশি । তারপর হঠাৎ করেই নিশি বলল
-আপনি জানতে চাইলেন না আমি কিভাবে জানি আপনার জন্মদিন ?
-হ্যা । কিাভবে জানো ?
নিশি বলল
-আমি জেরিন আপুকে চিনতাম !
জেরিনের নামটা শোনার পরপরই অপুর মনটা আবার যেন সেই কয়েক বছর আগেই চলে গেল । এই মেয়েটার জন্যই ওর জীবনের সব কিছু বদলে গেছে । যতটা সময় মেয়েটা ওর সাথে ছিল সব কিছু যেন অন্য রকম ছিল । তারপর একদিন ওকে কিছু না বলেই মেয়েটা একদম গায়েব হয়ে গেল । আর কোন খোজই পেল না সে । কি তীব্র ভাবেই না মেয়েটাকে ও ভালবাসতো !
নিশি বলল
-এর আগে আপনি আমাকে একবার দেখেছিলেন । কিন্তু আপনার মনে নেই ।
-তাই নাকি ?
-হ্যা । শান্তিবাগে আমরা তখন জেরিন আপুদের পাশের ফ্ল্যাটে থাকতাম । আপনি মাঝে মাঝে তার সাথে দেখা করতে যেতেন । একদিন মনে আছে আপনি একটা মেয়েকে এক্সিডেন্টের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন ?
কিছু কিছুটা মনে করার চেষ্টা করলো । অনেক দিন আগের কথা । একটা সময় জেরিনরা শান্তিবাগের একটা ফ্ল্যাটে থাকতো । অপু মাঝে মাঝেই দেখানে যেত । তবে অবশ্যই লুকিয়ে । জেরিনের মা বাবার চোখের আড়ালে । ওদের বাসার সামনে গাছগাছালি ঘেরা একটা ছোট্ট মাঠ ছিল । সুযোগ পেলেই জেরিন ওকে ডাক দিতো । ওরা ওখানেই বসে গল্প করতো । একদিন ওকে বাসায় পৌছে দেওয়ার সময় অপু দেখলো একটা মেয়ের দিকে একটা টেম্পু বেপোরোয়াকে ভাবে আসছে । মেয়েটার সেদিকে খেয়াল নেই । সে যেন মাথা নিচ করে হেটে আসছে । সেদিন অপু না থাকলে মেয়েটার সত্যিই বড় কিছু হয়ে যেত । সেই মেয়ে কি এই নিশি ?
নিশি বলল
-আমি আপনাকে আগে থেকেই চিনতাম । আমি জানতাম যে জেরিন আপুকে আপনি ভালবাসেন । তবুও আপনাকে দেখলে কেন জানি আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যেত । কেন যেত আমি জানি না ।
অপু এবার সত্যি অবাক হয়ে গেল নিশির কথা শুনে । এমন কথা শোনার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না । নিশি আবার বলল
-ঐদিনও আমি আপনাকে আর জেরিন আপুকে দেখতে পেয়েছিলাম । তাই ওমন মাথা নিচ করে হাটছিলাম । পেছন থেকে যে গাড়ি আসছিলো সেটা টের পাই নি । ঐদিন আপনি না থাকলে আজকে হয়তো আমি থাকতাম না । তারপর থেকে ....
-তারপর থেকে ?
-আগে থেকেই আপনি আমার মাথার ভেতরে ছিল তারপর থেকে সেটা আরও পাকা পোক্ত ভাবে বসে গেলেন !
অপু কি বলবে খুজে পেল না । নিশি বলল
-আপনি আমাকে খারাপ ভাববেন জানি তবে জেরিন আপুর সাথে আপনার বিয়ে না হওয়াতে আমি খুশি হয়েছিলাম । সত্যিই হয়েছিলাম । কিন্তু তারপরই আপনাকে আমি হারিয়ে ফেলি । আমি সারাটা জীবন আপানকে কি তীব্র ভাবে চেয়ে গেছি আপনি হয়তো কোন দিন জানবেন না, এই দুঃখটা আমাকে পীড়া দিতো খুব । তবুও আমি সেটা মেনে নিয়েছিলাম । আর কোন দিন আপনাকে আমি দেখবো বলে আশা করি নি । কিন্তু এখানে যখন আপনাকে আবার আমি দেখতে পেলাম তখন আমার সত্যিই মনে হল যে .....
-কি মনে হল ?
-মনে হল যে ....।
এই লাইনটা নিশি শেষ করলো না । অপু অবাক হয়ে দেখলো নিশি মেয়েটা চট করে ওকে জড়িয়ে ধরলো তারপর ওর ঠোঁটে একটা গভীর চুমু খেল । ব্যাপারটা এতোই দ্রুত হল যে অপু যে কিছু বলবে সেই সুযোগটা পর্যন্ত পেল না । বিস্ময়টা কাটতে কাটতে বেশ খানিকটা সময় পার হয়ে গেল ।
নিশি ওকে ছেড়ে দিয়ে বলল
-আমি কোন দিন আপনাকে মন থেকে বের করতে পারি নি । চেষ্টাও করি নি । আর এখন আর আপনার কাছ থেকে দুরে যাবো না । আপনি যদি আমাকে দুর দুর করে তারিয়েও দেন তবুও যাবো না ।
নিশি আর দাড়ালো না । পেছন ঘুরে যেন দৌড়ে পালালো । এতো গুলো কথা, এই কাজ গুলো করতে মেয়েটার অনেক সাহস সঞ্চয় করতে হয়েছে সেটা অপুর বুঝতে কষ্ট হল না । এতোদিন মেয়েটা চোখের সামেনই ওকে দেখে এই কথা গুলো বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু পারে নি । আজকের টেডিবিয়ারটা দেওয়ার ঘটনার পর এবং ওদের ফ্যামিলির সাথে এভাবে সময় কাটানোর কারনেই হয়তো মেয়েটা এই সব কিছু বলতে পারলো ।
অপু আরও কিছু সময় ছাদে দাড়িয়ে রইলো । একটা সময় ওর মনে হত ও হয়তো আর কাউকে কোন দিন নিজের জীবনে জায়গা দিতে পারবে না । কিন্তু আজকে ওর মনে হচ্ছে যে ও ভুল ছিল । নিশির নামের মেয়েটা ওকে ঠিকই ভুল প্রমানিত করলো ।
অনেকটা সময় কষ্টে থাকা হয়েছে । এবার একটু ভাল থাকার সময় এসেছে ।
(সমাপ্ত)
(ফেসবুকে পড়তে চাইলে)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০১৮ বিকাল ৩:৩৬