ঘুম থেকে উঠেই অদ্রিতা একটু চমকে গেল । প্রথমে মনে হল ও হয়তো ভুল দেখছে কিংবা এখনও ঘুমিয়েই আছে । ঘুম ঘুম চোখে অনেক কিছুই মানুষ দেখে । কয়েক মুহুর্ত কেটে গেল । কিন্তু সামনের দৃশ্যের কোন পরিবর্তন হল না । অদ্রিতার বুঝতে বাকি রইলো না যে ও যা দেখতে সেটা বাস্তব ।
চোখ মেলতে দেখেও ফারিজ ওর দিকে এগিয়ে আসে নি । যেখানে বসে ছিল সেখানেই বসে ছিলো । অদ্রিতা যখন উঠে বসতে চাইলো তখন শোফা থেকে উঠে এসে বিছানার পাশে এসে বসলো । তারপর ওর কপালে হাত দিয়ে বলল
-এখনও জ্বর আছে শরীরে । শুয়ে থাকো !
অদ্রিতা কিছুই বুঝতে পারছিলো না । কেবল বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো ফারিজের দিকে । এমন তো হওয়ার কথা না । এসব কি হচ্ছে? অদ্রিতা বলল
-তুমি ঠিক আছো ?
ফারিজ একটু যেন অবাক হল ওর কথায় । তারপর বলল
-আমার কিছু হয় নি । গতকাল রাত থেকে তোমার শরীর একটু খারাপ । রাতে জ্বর বেড়েছিলো বেশ ।
অদ্রিতা বলল
-তুমি কি সারা রাত এখানে বসে ছিলে ?
ফারিজ কোন কথা বলল না । কেবল ওর দিকে তাকিয়ে রইলো । অদ্রিতা কেবল তীব্র বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে তার স্বামীর দিকে । বিয়ের পর এতোটা অবাক সে কোন দিন হয় নি । ফারিজের ভেতরে রাতারাতি এতোটা পরিবর্তন কিভাবে আসলো সেটা ও বুঝতে পারছে না ।
ফারিজের সাথে অদ্রিতার বিয়েতে অদ্রিতার মত ছিল না । কিন্তু বাবা ইচ্ছের বিপক্ষে অদ্রিতা কিছুই বলে নি । বিয়ের পর মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে । কিন্তু বিয়ের পরে ওর জন্য অন্য কিছুই যেন অপেক্ষা করছিলো । ফারিজের চরিত্রের আসল দিকটা ধরা পরলো অদ্রিতার কাছে । মূলত বিয়েটা হয়েছিলো ফারিজের বাবার ইচ্ছেতেই । তিনি ভেবেছিলেন হয়তো অদ্রিতার মত কারো সাথে বিয়ে দিলেই হয়তো তার ছেলে ঠিক হয়ে যাবে । তাই ছেলে জন্য নিজের অফিসে চাকরি করা অদ্রিতাকেই তার পছন্দ হয়েছিলো । কিন্তু বিয়ের পর বুঝতে পারলেন যে তিনি ভুল করেছিলেন । তার ছেলে কোন আর ঠিক হবার নয় । অদ্রিতার জীবনটা এভাবে নষ্ট করার জন্য তিনি নিজের কাছে সব সময় ছোট হয়ে থাকতেন । বারবার তার কাছে ক্ষমা চাইতেন । অদ্রিতার প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগতো । তবে একটা সময় সেও মানিয়ে নিলো । ফারিজের বাবাকে সে নিজের বাবার মতই ভালবাসতে শুরু করলো । এই মানুষটার জন্যই ফারিজের সংসার ছেড়ে যেতে পারলো না । সে ভেবে নিয়েছিল যে সবার কপালে সব কিছু জুটবে না । তবে বিয়ের পরেও সে চাকরিটা চালিয়ে গেল । শ্বশুর পুত্রবধু মিলে ব্যবসাটা ভালই চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো । তারপর কেটে গেছে একটা বছর । অদ্রিতার জীবনও এগিয়ে যাচ্ছে এভাবে ।
কিন্তু তাহলে আজকে এমন কি হল ? ফারিজ এমন আচরন কেন করছে ? অদ্রিতা কেমন দিশেহারা বোধ করলো । এসব কি হচ্ছে ?
পরের কয়েকটা দিন অদ্রিতা অবাক হয়ে দেখলো যে তার স্বামী যেন পুরোপুরি বদলে গেছে । আগে অফিসে যেতো অনিয়মিত ভাবে কিন্তু এই কদিনে সে একদম নিয়মিত অফিস যাচ্ছে । আগে মানুষের সাথে যাচ্ছে তাই ব্যবহার করতো । চিৎকার চেঁচামিচি ছিল প্রতি দিককার অভ্যাস কিন্তু এই কটা দিনে ফারিজ যেন একবারে অন্য রকম মানুষ হয়ে গেছে ! ব্যাপারটা কেবল অদ্রিতাই নয় অন্য সবাই লক্ষ্য করেছে । ওর মত আর সবাই ই ব্যাপার টা নিয়ে কথা বলছে কিন্তু কিছু বলার সাহস পাচ্ছে না । তবে সবাই যে ফারিজের এই পরিবর্তনে খুশি সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না । সব থেকে বেশি খুশি হচ্ছে ফারিজের বাবা । তারা ছেলে ভাল না এই জন্য তার দুঃখের শেষ ছিল না । ফারিজের বাবা অদ্রিতাকে ডেকে কারনটা জানতে চাইলো । অদ্রিতা নিজেও মাথা নাড়ালো । সে বলতে পারে না এমন কেন হচ্ছে । কেবল বলল যে ঐদিন ওর শরীর খারাপ ছিল । ও ঘুম থেকে উঠে দেখে যে ফারিজ ওর পাশে বসে আছে ! সেদিন থেকেই আসলে সব কিছুর শুরু ।
দুই
অদ্রিতা খুব একটা রাগে না কখনই । কিন্তু এখন সামনে দাড়ানো মানুষটার উপর খুব রাগ হচ্ছে । আজকে ওদের অফিসে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে । অফিসের একজন স্টাফ অফিসের সামনেই রাস্তা পার হতে গিয়ে গাড়ির নিচে পড়ে মারা গেছে । সেই জন্য আগে থেকেই ওর মনটা বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে । আর এখন একটু আগে জানতে পারলো যে ফারিজকে কোথাও খুজে পাওয়া যাচ্ছে না । ফোনে অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারে নি । ফোন বন্ধ করে রেখেছে কোন কারনে । সে নাকি তাট গাড়ি থেকে মাঝ পথেই নেমে গেছে । ড্রাইভারকে নাকি বলেছে চলে যেতে । আর এই গর্ভবটা চলেও এসেছে । সেই ড্রাইভার এখন অদ্রিতার সামনে দাড়িয়ে. অদ্রিতা নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রন করতে করতে বলল
-তোমার স্যার কোথায় ?
লোকটা বয়স ত্রিশ বত্রিশের বেশি হবে না । একটু খাটো ধরনের। কিছুটা সময় মাথা নিচু করে রয়েছে বলে আরও বেশি ছোট দেখাচ্ছে । কিছুটা সময় চুপ করে থাকার পর লোকটা বলল
-জানি না ম্যাডাম ।
-জানো না মানে কি ?
-স্যার হঠাৎ করেই গাড়ি থেকে নেমে পড়লো । তারপর আমাকে বলল চলে যেতে ।
-আর তুমি চলে আসলে ?
অদ্রিতার কন্ঠে কিছু একটা ছিল যে ড্রাইভার চুপ করে গেল । মাথা নিচু করেই এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো । অদ্রিতা খুব চেষ্টা করলো নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে । একটা সময় ছিল ফারিজের সাথে ওর দিনের পর দিন দেখা হত না, কথা হত না । ফারিজ তখন ছিল অন্য জগতের মানুষ । অদ্রিতার ওর সাথে দেখা না হলে কথা না হলে কিছুই মনে হত না । কিন্তু এখন প্রতি ঘন্টায় অন্তত একবার যদি ফারিজের সাথে কথা না হয় তখন মনে হয় যেন ওর পুরো জগত অন্ধকার হয়ে আসছে ।
অদ্রিতা কিছু বলতে যাবে তখনই ওর ফোনটা বেজে উঠলো । ফোনের দিকে তাকিয়েই সব কিছু ভুলে গেল সে । ফারিজ ফোন দিয়েছে ।
ফোনটা রিসিভ করে সবার আগে একটা ধকম ছিল সে ।
-কোথায় তুমি ? ফোন বন্ধ কেন ? আর এভাবে রাস্তায় নেমে গেছো কেন ?
ওপাশ থেকে ফারিজ বলল
-এতো প্রশ্ন এক সাথে কেন ?
-তো কি করবো ?
-আচ্ছা শুনো সব প্রশ্নের জবাব দিব । এখন চট করে ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারের পিছনে চলে আসতো । আমি এখানে বসে আছি । জলদি !
অদ্রিতা কিছু বলতে যাবে কিন্তু তার আগেই দেখলো ফোনের লাইন কেটে গেছে । সামনে দাড়ানো ড্রাইভার ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-ম্যাডাম ! স্যারের খবর পাওয়া গেছে ।
অদ্রিতা সেই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল
-জলদি গাড়ি বের কর ।
অদ্রিতা যখন ধানমন্ডি ৩২ নাম্বারে পৌছালো নয়টা বেজে গেছে । এদিককার রাস্তা ঘাট অনেকটাই শান্ত হয়ে এসেছে । গাড়ি থামার সাথে সাথেই অদ্রিতা নেমে গেল । একটু এদিক ওদিক তাকাতেই ফারিজকে দেখতে পেল । ফুটপাথের উপর সিমেন্টের বেদির উপর বসে আছে । ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো । অদ্রিতা আর কিছু না বলে সেদিকেই দ্রুত পা চালালো । বলতে গেলে যেন দৌড়াতেই শুরু করেছে। অদ্রিতার মনে হল যেন কত বছর পর ও ফারিজকে দেখতে পাচ্ছে ।
তিন
ফারিজ অদ্রিতাকে গাড়ি থেকে নামতে দেখলো । মেয়েটার চোখে যে আকুলতা সেটা ও এতো দুর থেকেও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলো । ফারিজ দেখতে পেল অদ্রিতা ওকে দেখতে পেয়েছে । ওকে দেখতে পেয়েই মেয়েটা প্রায় দৌড়াতেই শুরু করলো । নিশ্চিত ওকে জড়িয়ে ধরবে !
ফারিজের হঠাৎ খুব মন খারাপ হল !
এই যে মেয়েটা ওকে এতো ভালবাসে কিন্তু আসল সত্যটা জানার পরে কি মেয়েটা ওকে ভালবাসবে ?
মেয়েটা যদি জানতে পারে যে সে ফারিজ নয় তাহলে কি এই ভালবাসার আকুলতা থাকবে ?
ও নিজে কি কোন দিন ভাবতে পেরেছে অদ্রিতার ভালবাসা ও কোন দিন পাবে ?
যে ছেলেটা জীবনে কোন দিন কিছু পায় নি সে হঠাৎ করে এতো কিছু পেয়ে যাবে । এইতো কদিন আগেও সে ফারিজ ছিল না । সে ছিল সুমন । সুমন আহমেদ । সেই সুমন আহমেদ যে কিনা ফারিজদের কোম্পানিতে একজন সাধারন কর্মচারি ছিল এবং যে কিনা আজকে দুপুর বেলা রাস্তা পার হতে গিয়ে মারা পড়েছে ।
জীবনের যুদ্ধে সুমন একজন পরাজিত মানুষ ছিল । এই জগতে যার প্রিয়জন বলে কেউ ছিল না । সুমন যখন ওর মায়ের পেটে আসে তখন ওর বাবা মায়ের বিয়ে হয় নি । এমন কি পরেও সেই বিয়েটা আর হয় নি । দুজন চলে গিয়েছিলো দুদিকে । তাই জন্মের পর সুমনের জায়গা হয়েছিলো এতিম খানাতে । অনাদর আর কষ্টে মানুষ হয়েছে সে । কলেজে থাকতে একটা মেয়েকে পছন্দ হয়েছিলো, সেই কথা মেয়েটিকে বলেও ছিল সে কিন্তু এতিম ছিল বলে মেয়েটা ওকে তীব্রভাবে প্রত্যাখান করেছিলো । তারপর ও আর কাউকে পছন্দের কথা বলতে পারে নি । কিন্তু মন কি আর থেমে থাকে ।
চাকরি পাওয়ার পরেই অদ্রিতাকে দেখতে পেল ও । মেয়েটাকে কোন ভাবেই নিজের মন থেকে বের করতে পারলো না । কিন্তু তাকে কিছু বলার সাহসও ছিল না ওর । আবার যদি সেই মেয়েটির মত করেই অদ্রিতা ওকে প্রত্যাখান করে । এর থেকে ওকে দুর থেকেই ভালবাসার সিদ্ধান্ত নিল । কিন্তু কদিনের মধ্যেই অদ্রিতার বিয়ে হয়ে গেল কোম্পানির মালিকের ছেলের সাথে । চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না ওর ।
এভাবেই জীবন এগিয়ে যাচ্ছিলো ওর । এবং তার পরেই সেই অদ্ভুদ ঘটনা ঘটলো ওর সাথে । সেদিন তীব্র বৃষ্টি হচ্ছিলো । এরকম তীব্র বৃষ্টি হলেই সুমন সব সময় বৃষ্টিতে ভেজে । অফিস শেষ করে ভিজতে ভিজতেই সে বাসার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলো । হঠাৎ করেই আবিস্কার করলো সব পানির ফোটা গুলো যেন থেমে গেছে ।
বৃষ্টি আর পড়ছে না । আরও কিছু সময় পরে আবিস্কার করলো যে কেবল সে বাদ দিয়ে আর সব কিছু স্থির হয়ে গেছে । এমন কেন হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলো না ও । কি হচ্ছে ওর সাথে ?
ঘুরে দৌড় দিতে যাবে তখনই লোকটাকে দেখতে পেল সে । তার দিকেই এগিয়ে আসছে । সুমন একদম স্থির হয়ে গেল । মনের ভেতরে একটা তীব্র ইচ্ছে জন্মালো যে এখনই এখান থেকে দৌড়ে পালিয়ে যায় কিন্তু পারলো না । ওর কেবল মনে হল ওর দিন শেষ হয়ে এসেছে । সামনের এই লোকটার কাচ থেকে ওর নিস্তার নেই ।
-সুমন !
লোকটা দেখি ওর নামও জানে ! সুমনের এবার একটু ভয় কমে এল । লোকটার দিকে ভাল করে খেয়াল করলো । কালো রংয়ের একটা স্যুট পরে আছে । ওর দিকে তাকিয়ে আছে স্বাভাবিক ভাবেই । সুমনের তবুও ভয় কাটলো না । কারন চারপাশের সব কিছু তখনও স্থির হয়ে আছে ।
-কি হচ্ছে এসব ? কেন হচ্ছে ?
লোকটা যেন ওর কথায় খুব মজা পেল । সুমন আবার বলল
-আপনি কে ?
-আমি ?
লোকটা কি যেন ভাবলো কিছুটা সময় । তারপর বলল
-আমার নাম ধর কাশেম আলী ।
-কাশেম আলী ?
-হ্যা । কথা বার্তার সুবিধার জন্য ধরে নাও ।
সুমনের ভয়টা আরও একটু কমে এল । যদিও বুঝতে কষ্ট হল না যে সামনে দাঁড়ানো লোকটা স্বাভাবিক কোন মানুষ নয় । আদৌও মানুষ কি না সেটা নিয়েও সুমনের মনে সন্দেহ দেখা দিল । সুমনের মনের কথাটাই যেন বুঝতে পারলো কাশেম আলী । বলল
-আমাকে মানুষ ভাবার কোন কারন নেই ।
-তাহলে আপনি কি ?
-সেটা এতো জরুরী বিষয় না । তবে ধরে নাও আমি একজন প্রতিনিধি । আমি ডিল করি মানুষের সাথে ।
-কিসের ডিল ।
-আত্মার ডিল । জীবনের লেনদেন ।
সুমন আমতা আমতা করে বলল
-মানে ?
কাশেম আলী কিছু সময় যেন ভাবলো । যেন যেন ছোট বাচ্চাকে বুঝানোর জন্য আগে থেকে মনে মনে কিছু ঠিক করে নিচ্ছে । তারপর বলল
-আমি এমন কিছুর প্রতিনিধি করি যে মানুষের আত্মাকে মৃত্যুর পরে নরকে নিয়ে যেতে পছন্দ করে ।
-আমি এখনও আপনার কথা বুঝতে পারছি না ।
-মনে কর তুমি জীবনে কিছুই পাও নি । তখন আমি তোমার কাছে এসে হাজির হলাম । তোমাকে বললাম যে আজ থেকে আগামী ২০ বিশ বছর তুমি জীবনে সফল আর সফলতা সব কিছু পাবে । কিন্তু ২০ বছর পরে যখন তুমি মারা যাবে তখন তুমি আমার সাথে যাবে নরকে । কোন ভাবেই তোমার হেভেনে জায়গা হবে না । বুঝতে পেরেছো ?
সুমন কিছুটা বুঝতে পারলো । লোকটা নিজের আত্মার বিনিময়ে বৈশয়িক সুখ শান্তির প্রলোভোন দেখাচ্ছে । সুমন বলল
-আমি এসব ব্যাপারে আগ্রহী নই । দয়া করে চলে যান । আর সব কিছু স্বাভাবিক করে দিন ।
লোকটা হাত নেড়ে বলল
-আরে না না । তোমার জন্য সেই অফার নিয়ে আসি নি । বরং তোমার জন্য নিয়ে এসেছি উল্টো একটা ডিল ।
-কি রকম ?
-মানে হচ্ছে একজন নিজের পরকালের সুখ ত্যাগ করছে এই জগতে সুখ করার জন্য আর তুমি যদি এই জগতের সুখ ত্যাগ করতে রাজি থাকো তাহলে মৃত্যুর পরের জীবনে তোমার সুখের ব্যাপারটা আমি নিশ্চিত করতে পারি ।
-তাই কি ?
-আমি আগেই বলেছি আমি একজনের প্রতিনিধি করি ।
-কিন্তু আমাকে আপনি হেভেনে কেন নিবেন ? আপনি না বললেন যে আপনি যার প্রতিনিধি করেন সে নরক বেশি পছন্দ করে ।
কাশেম আলী বলল
-ব্যাপারটা ঠিক ঐ রকম না । আমি তোমাকে হেভেনে নিয়ে যাওয়ার বদলে আরেকজনকে নিশ্চিত ভাবেই নরকে নিয়ে যাচ্ছি । দেখো হিসাবটা এরকম যে দুইজন মানুষ । এমন হতে পারে দুজনই মৃত্যুর পরে হেভেনে চলে যেতে পারে । তখন আমার মাস্টারের হাতে কিছুই আসবে না । কিন্তু একজনকে হেভেনের যাওয়ার পথ সুগম করে করে অন্যজনকে নরকে নিয়ে আসা যায় তাহলে অন্তত একজন নিশ্চিত হাতে আসছে । ঝুকি হীন ব্যবসার মত বলতে পারো ।
সুমন ব্যাপারটা বুঝতে পারলো । তারপর
-আচ্ছা । বুঝলাম ।
-একজন মারা যাচ্ছে । তার শরীরে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে । সে তার দেহকে পরিহার করে তোমার দেহে প্রবেশ করতে রাজিও হয়েছে । এখন কেবল তুমি রাজি হলেই আদল বদল সম্পন্ন হবে ।
সুমন বলল
-জি না । ধন্যবাদ ! আমি এসব চাই না ।
-আরেকবার ভেবে দেখো । তুমি না নিলে অন্য কেউ নিশ্চয় নিবে । তবে তোমার একটা ইন্টারেস্ট থাকতে পারে বলেই তোমাকেই আগে অফারটা দিলাম আমি । নয়তো যে কোন নীরোগ দেহতে ঢুকতে পারলেই সে খুশি ।
সুমন এবার একটু কৌতুহলী হয়ে উঠলো । তারপর বলল
-আমার ইন্টারেস্ট মানে ?
-শুনতে চাও কে আদল বদল করতে চায় ? কার ক্যান্সার হয়েছে ?
-কে ?
-তোমার বসের ছেলে । ফাজির আরিয়ান !
তখনই সুমন বুঝে গেল যে কাশেম আলী কেন বলল যে সুমনের কেন আগ্রহ থাকতে পারে । ফারিজের সাথেই অদ্রিতার বিয়ে হয়েছে । সুমন আগেই বুঝে গেছে যে সামনের দাড়ানো লোকটা কোন সাধারন কেউ না । তাই সে অদ্রিতার কথা জানতে পারবে সেটাই স্বাভবিক । কাশেম আলী বলল
-যদি তুমি রাজি থাকো তাহলে একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবে তুমি ফারিজ হয়ে গেছ । ফারিজ যা যা জানে তুমি নিজেও তা জানবে এবং তোমার স্মৃতি গুলোও তোমার মনে থাকবে ।
সুমন বলল
-ফারিজেও কি তাই হবে ?
-হ্যা হবে ।
-ফারিজের দেহে যে ক্যান্সার হয়েছে সেটাতে সে কতদিন টিকে থাকবে ?
-সেটা আমি বলতে পারছি না । মানুষের মৃত্যুর হিসাব রাখা আমার কাজ নয় । তবে ফারিজের ডাক্তারেরা বলেছে সে আরও বছর দুয়েক টিকে যাবে ।
দুই বছর ? তার মানে হচ্ছে দুই বছর সে অদ্রিতার কাছাকাছি থাকতে পারবে । আর তারপর নিশ্চিত হেভেন । একেবারে খারাপ না ডিলটা । সুমন বলল
-কি নিশ্চয়তা আছে যে আপনি যা যা বলছেন তা হবেই ।
-ওহে আমি তোমাদের দেশের নেতা না যে কথা দিয়ে কথা রাখবো । এখানে কথার ব্যতীক্রম হওয়া যায় না ।
তারপর একদিন সকালে ঘুম থেকে সুমন লক্ষ্য করলো সে আর সুমন নেই । দেহটা হয়ে গেছে ফারিজের । অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো যে ফারিজ যা যা জানে সে সব কিছু জানে । আর তার সুমনের স্মৃতিও সব মনে পড়ছে । সে আর সুমন নেই । এবং এতে তার কোন সমস্যা হচ্ছে না ।
তারপর থেকেই সে ফারিজের জীবন যাপন করছে । অবশ্য সেটা ওর মোটেই খারাপ লাগছে না । কেবল একটা কথা ও কিছুতেই ভুলতে পারছে না যে যদি অদ্রিতা যদি সত্যিটা জানতে পারে তবুও কি ওকে ভালবাসবে ?
চার
চারিপাশের সব কিছু যেন থেমে গেছে । ফারিজের মনে হল যেন সব কিছু থেমে গেছে । এতোটা ব্যাকুল হয়ে মেয়েটা ওকে কেন জড়িয়ে ধরেছে । কিছু কি হয়েছে ।
-কি হয়েছে ? মানুষ জন দেখছে তো !
অদ্রিতা ওকে না ছেড়ে দিয়েই বলল
-দেখুক ! আমি কি অন্য কাউকে জড়িয়ে ধরেছি নাকি ? আমার স্বামীকে জড়িয়ে ধরেছি ।
-আচ্ছা ঠিক আছে বাবা । বুঝলাম । বাকি টুকু বাসায় গিয়ে ধর । এখন আসো একটু বসি এখানে !
অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও অদ্রিতা ওকে ছেড়ে দিল । তারপর ওর হাত ধরেই সিমেন্টের বেদীর উপর বসলো । ফারিজ বলল
-এই জায়গাটার কথা বেশ মনে পড়ে । অনেক দিন পর এলাম এখানে ?
-আগে আসতে এখানে ?
ফারিজ কিছু বলতে গিয়েও বলল না । বুঝতে পারছে না যে ওর এসব বলা ঠিক হচ্ছে কি না । ফারিজ হয়ে এখানে কোন দিন আসে নি । তখন এসেছে তখন সে সুমন ছিল । ফারিজকে চুপ থাকতে দেখে অদ্রিতা বলল
-আজকে আমাদের অফিসের সুমন নামের একজন মারা গেছে এক্সিডেন্ট করে । অফিসের সামনেই ।
ফারিজ একটা দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলল । তারপর বলল
-হ্যা । জানি ।
-এই জন্য তোমার মন খারাপ ?
অদ্রিতার এই কথা শুনে ফারিজের কেমন যেন লাগলো । ও অদ্রিতার চোখের দিকে তাকিয়েই একটা ছোট খাটো ধাক্কার মত খেল । কোন কারন নেই তবুও ফারিজের মনে হল যে অদ্রিতা সত্যটা জানে । ফারিজ কেবল বিস্ময় নিয়ে বলল
-তুমি জানো ?
অদ্রিতা হাসলো । তারপর বলল
-যে মানুষটা আমার দিকে কোন দিন ফিরেও তাকায় নি হঠাৎ করেই সেই মানুষটার চোখে আমি যখন তীব্র ভালবাসা দেখতে পাই তখনই আমার মনে হয়েছিলো যে সেই মানুষটা বদলে গিয়েছে । সেটা আর যাই হোক আগের মানুষ নেই । তারপর .....
-তারপর এই সুমন সাহেব আমাকে এসে আসল কথাটা বলেছিলো । তোমার যেমন সব কিছু মনে আছে তারও সব কিছু মনে আছে ।
-তারপর ?
-আমার প্রথমে বিশ্বাস হয় নি । কিন্তু তোমার আচরন দেখে মনে হল যে কিছু একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার আছে । ভেবেছিলাম হয়তো তোমার কোন নতুন চাল এটা । কিন্তু তোমার ক্যান্সারের রিপোর্ট দেখে এবং তোমার আচরন দেখে মনে হল সুমন সাহেব সত্য কথা বলছে ।
ফারিজ চুপ করে রইলো । অদ্রিতা বলেই চলল
-তারপর আমি সত্যি সত্যিই আবিস্কার করলাম যে এই তুমি আমাকে সত্যিই সত্যিই ভালবাসো আর এটা যে একদিনে তৈরি হওয়া ভালবাসা নয় সেটা বুঝতেও আমার কষ্ট হয় নি । যখন তুমি সুমন ছিল সেই তখন থেকেই আমাকে ভালবাসো আর এই নিজের এই জগতিক জীবনটা ছেড়ে দেওয়ার পেছনের কারনটাও নিশ্চয়ই আমি । কম সময় হলেও আমার সাথে এই কটা দিন থাকতে চাও তুমি, তাই না ?
ফারিজ কোন কথা না বলে মাথা ঝাকালো ।
অদ্রিতা বলল
-এখন বল যে মানুষটা কেবল আমার সাথে থাকার জন্য এতো বড় কিছু ছেড়ে দিতে পারে সেই মানুষটাকে কি ভাল না বেসে থাকা যায় ?
অনেকটা সময় কেউ কোন কথা বলল না । ফারিজের আজকে অন্য রকম আনন্দ হচ্ছে । এতোদিন একটা সুক্ষ অপরাধবোধ কাজ করতো যে অদ্রিতা ওর আসল ব্যাপারটা জানে না বলেই হয়তো ওকে ভাল বাসছে । কিন্তু আজকে আর সেই রকম কোন অনুভুতি নেই । আসল সত্যটা জেনেই তার ভালবাসার মানুষ তাকে ভালবাসে । এর থেকে আনন্দের ব্যাপার আর কি হতে পারে !
হঠাৎ ফারিজ বলল
-সাইকেলে চড়বে ?
অদ্রিতা বলল
-মানে ?
-আমার একটা সাইকেল আছে মানে ছিল তখন । আমি মাঝে মাঝেই সেটা চালাতাম ।
তারপর হাত দিয়ে ওদের থেকে একটু দুরে বসা এক সাইকেলিস্ট কে দেখালো । লোকটা সম্ভত অনেক সময় ধরে সাইকেল চালিয়ে এসেছে । এখন এখানে বসে বিশ্রাম নিচ্ছে । ফারিজ ওকে নিয়ে লোকটার সামনে গিয়ে হাজির হল । তারপর বলল
-ভাই সাহেব একটা উপকার করবেন ?
লোকটা খানিকটা অবাকই হল । তারপর বলল
-কি উপকার ?
-মানে আমার স্ত্রী খুব সাইকেলে চড়তে চাচ্ছে । আপনার সাইকেলটা একটু ধার দিবেন ।
লোকটা যেন আরও একটু অবাক হল । চেনা নাই জানা নাই এক লোক এসে বলল যে সাইকেল দেন তাই দেওয়া যায় নাকি ? লোকটার মনের কথা বুঝতে পেরে ফারিজ বলল
-আপনি দেখি ঘামছেন । এক কাজ করুন আমরা যতক্ষন আনার সাইকেল চালাই আপনি আমাদের গাড়িট এসিতে বসে জিরিয়ে নিন । কেমন ?
এইবার মনে হল লোকটার প্রস্তাবটা পছন্দ হল । লোকটাকে গাড়ির ভেতরে বসিয়ে রেখে ড্রাইভারকে বলল এসিটা বাড়িয়ে দিতে । তারপর ফারিজ সাইকেলের উপর উঠে বসলো । অদ্রিতাকে উঠতে বলল তারপর । অদ্রিতা বলল
-তুমি আমাকে ফেলে দিবে না তো ?
-আমার উপর ভরসা নেই ।
অদ্রিতা আর প্রশ্ন করলো না । তবে একটু ভয়ে ভয়ে উঠে বসলো সাইকেলের রডের উপর । যখন চলতে শুরু করলো তখন ওর একটু ভয়ভয় করছিলো তবে সেই সাথে একটা ভালোলাগাও কাজ করছিলো । এই মানুষ আর খুব বেশি দিন ওকে এভাবে ভালবাসতে পারবে না । তাই যতটা পারা যায় ভাল বাসতে চায় মানুষটাকে । ফারিজ কিংবা সুমন যাই হোক, ওকে যে তীব্র ভাবে সে ভালবাসে সেটা নিয়ে অদ্রিতার কোন সন্দেহ নেই । অল্প সময়ই হোক না কেন ভালবাসাময় জীবন পার করাটা পরম সৌভাগ্যের একটা ব্যাপার !
সমাপ্ত
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মে, ২০১৮ রাত ১২:০৭