কাল থেকে আমাদের ক্যাম্পাসের অবস্থা খুব একটা ভাল না। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র শাখার সংগঠন টা মিনিটে মিনিটে মিছিল নিয়ে আসা যাওয়া করছে। কোন ক্লাশ পরীক্ষা হতে দিচ্ছে না।
অবশ্য এর পেছনে কারণ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মেয়েকে কে বা কারা ধরে হাত ভেঙ্গে দিয়েছে। সাধারন কোন মেয়ে হলেও না হয় কথা ছিল, যার হাত ভেঙ্গে দিয়েছে সে হচ্ছে ফিরোজা বানু হলের হল প্রেসিডেন্ট। বুঝায় যাচ্ছে কেন এখানে এতো ঝামেলা হচ্ছে। ব্যাপার টা তো আর ফেলে দেওয়ার মত না। ক্ষমতায় থাকা দলের কোন নেত্রীকে এভাবে আঘাত করা তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। বিরোধী দলের নেতা কর্মীরা সব ক্যাম্পাস ছেড়ে পালিয়েছে। আমরা সাধারন ছাত্ররা একটু ভয়ে ভয়ে ক্যাম্পাসে এসেছি। তবে অনেকেই আসে নি। ক্লাস হচ্ছে না, এসে কি হবে!
আমিও বেরিয়ে যাবো তখনই নিশিকে দেখতে পেলাম। ও আজকে আসবে ভাবতে পারি নি। আমার দিকেই এগিয়ে আসতে দেখলাম। আমার কাছে এসে বলল, ঈশিতা আপু কেমন আছে?
ঈশিতা হচ্ছে হচ্ছে সেই হল নেত্রীর নাম। এবং মেয়েটাকে আমি খুব ভাল করেই চিনি। সে আমার ক্লাসেই পড়াশুনা করে, আমার ক্লাসমেট। আমি নিশির দিকে তাকিয়ে বললাম
-কি ব্যাপার, তোমার আবার ঈশিতার খোজ খবর নিতে ইচ্ছে হল কেন?
নিশি বলল
-দেখুন আমি শান্তি মত ক্যাম্পাসে থাকতে চাই। আমি জানি না কাজটা কে করেছে কিন্তু একটা সন্দেহ আমার দিকেও আসতে পারে। আমি চাই না এটা হোক।
-তোমার সাথে সে যা করেছে তারপরেও বলছো এই কথা?
নিশি আমার ডিপার্টমেনন্টেই পড়ে। এক ব্যাচ জুনিয়র। ওকে আমি আগে থেকেই চিনতাম আমাদের কলেজ একই ছিল। কদিন আগেই নিশি ঈশিতার হাতে মার খেয়েছিল। ক্ষমতায় থাকা নেতারা নিজেদের ক্ষমতা দেখানোর সুযোগ পেলে ছাড়ে না। তার উপর নিশি আবার ঈশিতার হলেই থাকে। তাই ঈশিতা ওর সাথে অনেক কিছু করারই ক্ষমতা রাখে। সেদিন নিশি আমার সামনেই অনেক কেঁদেছিল। ওকে শান্তনা দেওয়া ছাড়া আর কিছুই আমি করতে পারি নি। আর আজকে এই মেয়েই কি না বলছে যাবে ঈশিতাকে দেখতে!
নিশি কিছুটা সময় আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-হ্যা বলছি। কারণটা না বোঝার মত অবুঝ আপনি নন। আপনি একটু ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?
-না।
নিশি আর দাড়ালো না। যে পথে এসেছিল সেই পথেই চলে গেল। আমার মনটা একটু খারাপই হল। ভেবেছিলাম নিশি যখন এসেছে তখন ওর সাথে কিছুটা সময় গল্প করা যাবে। সময় ভাল কাটবে। কিন্তু হায়! এই মেয়ে আছে নিজের চিন্তা নিয়ে। আচ্ছা মেয়েটা কি আমার মনের অবস্থা একটু বুঝতে পারে না? ওকে যে এতো পছন্দ করি সেটা কি একটুও বুঝতে পারে না।
দেখতে দেখতে আরও অনেকদিন কেটে গেল। ঈশিতার হাত ভাঙ্গার ঘটনা ধীরে ধীরে চাপা পড়ে গেল। আমি নিশির সাথে আরও সম্পর্ক ভাল করার জন্য উঠে পড়ে লাগলাম। তবে ঈশিতার সাথে আমার প্রায় প্রতিদিনই দেখা হত। মেয়েটা সক্রিয় রাজনীতি করলেও ক্লাস করতো নিয়মিত। এমন কি পড়ালেখাতে বেশ ভাল। মাঝে চোখাচোখি হত। শান্ত নিরীহ মুখটা দেখে আমার মাঝে মাঝে বিশ্বাস করতে কষ্ট হত যে এই মেয়ে ভয়ংকর হতে পারে। মেয়েটাকে আমি তীব্রভাবেই অপছন্দ করতাম। এবং সেটা আমি লুকানোর চেষ্টাও করতাম না ।
কিন্তু তারপরই একটা অন্য রকম ঘটনা ঘটলো। নির্বাচনের বছর ছিল বলে ক্যাম্পাসে প্রায়ই মারামারি লাগতো। আমরা সাধারন ছাত্রছাত্রীরা যথা সম্ভব এড়িয়ে চলতাম এসব। তবুও মাঝে মাঝে কেউ কেউ পড়ে যেত দুই দলের সংঘর্ষের মাঝে। নিশিও একদিন পড়ে গেল। আমি এসবের কিছুই জানি না। সেদিন আমি ক্যাম্পাসে আসি নি।
আমার এক বন্ধুর ফোনে খবর পেলাম। নিশি নাকি আহত হয়েছে। আমি দৌড়ে হাসপাতালে হাজির হলাম। হাসপাতাল তখন মানুষ গিজগিজ করছে, যার বেশির ভাগই রাজনৈনিক দলের কর্মী। বুঝলাম যে নেতা কর্মী বেশ ভালই আহত হয়েছে। নিশিকে খুজে পেতে আমার কষ্ট হল না। ওর সামান্যই আঘাত লেগেছে। কিন্তু সব থেকে আশ্চর্য হলাম যখন আসল কথা শুনলাম।
নিশি সত্যি দুই দলের মাঝেই পড়েছিল। তারপরেও তার খুব একটা আঘাত লাগে নি। তার কারন হচ্ছে ঈশিতা। ঈশিতা নাকি নিজে ঢাল হয়ে নিশিকে রক্ষা করেছে। এবং সব আঘাত নিজের শরীর দিয়ে ঠেকিয়েছে। সে নাকি বেশ ভাল ভাবেই আহত হয়েছে।
আমার পা টা আপনা আপনিই দরজা দিয়ে বের হয়ে এল। আমি খুজতে লাগলাম ঈশিতার। একটু পরে খুজে পেলাম তবে সেখানে ঠিকমত ঢুকতে পারলাম না অনেক চেষ্টা করেও। অনেক লোকজন রয়েছে সেখানে। মনে চলে যাই কিন্তু কেন জানি যেতে পারলাম। হাসপাতালের করিডরে পায়চারি করতে শুরু করলাম। কতটা সময় আমি অপেক্ষা করেছি সেটা আমি সেটা বলতে পারবো না, একটা সময় একজন আমার পাশে এসে ডাক দিল। আমি মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই দেখি আমাদের ক্লাসের একটা মেয়ে। ঈশিতার সাথে একে অনেক দেখেছি। আমাকে বলল
-অপু ঈশিতার অবস্থা এখন বেশ ভাল। তুমি কথা বলবে?
-সম্ভব?
মেয়েটা বলল
-আসো।
এই বলে মেয়েটা হাটতে লাগলো। আমিও তার পেছন পেছন হাটতে লাগলাম। রুমে ঢুকে একটু অবাকই হলাম। ভেবেছিলাম অনেক মানুষ থাকবে কিন্তু দেখলাম রুমে কেউ নেই। মেয়েটাও আমাকে রেখে চলে গেল। আমি বিছানার দিকে তাকিয়ে ঈশিতার দিকে তাকালাম। ঈশিতা আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলো। তারপর একটু উঠতে চেষ্টা করলো। আমি জলদি করে এগিয়ে গেলাম। তারপর বললাম
-উঠতে হবে না। শুয়ে থাকো।
ঈশিতা বলল
-একটু উঠি। তোমাকে একটু ভাল করে দেখি। এতোদিন পরে তোমার চোখে আমার জন্য ঘৃণা দেখতে পাচ্ছি না। এটা সব সময় হয় না তো।
আমি তাড়াতাড়ি বললাম
-না আসলে তা না।
ঈশিতা আবার বলল
-অপু লুকিও না আর লজ্জাও পেও না। একটা মেয়ে সব বুঝতে পারে খুব ভাল ভাবে।
আমি কি বলব বুঝতে পারলাম না। ঈশিতা বলল
-আমার পাশে একটু বসবা? আমার ভাল লাগবে!
-অবশ্যই।
আমি টুল টেনে বসলাম ঈশিতার পাশে। ঈশিতার দিকেই তাকিয়ে রইলাম বেশ কিছুটা সময়। আজকে কেন জানি মেয়েটাকে আমার অন্য রকম লাগছে। ঈশিতা বলল
-অপু
-বল
-আমি যখন ঐদিন নিশিকে মেরেছিলাম তুমি খুব রেগে গিয়েছিলে আমার উপর, তাই না? এতোই রেগে গিয়েছিলে আমাকে আঘাত করতেও তোমার হাত কাঁপে নি।
আমি প্রবল বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলাম ঈশিতার দিকে। আমি নিশিকে অসম্ভব পছন্দ করি। তাই যখন ঈশিতা ওর উপর আঘাত করলো, আমি হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেললাম। লোক ভাড়া করলাম ওকে আঘাত করার জন্য। তারা কাজটা করলো ভাল ভাবেই।
ঈশিতা বলল
-আমি আগেই জেনে গিয়েছিলাম যে তুমিই ছিলে এর পেছনে। তবে বিশ্বাস কর আমার বিন্দু মাত্র রাগ হয় নি। তুমি ঠিকই করেছ। আমিও কিন্তু নিশিকে এই জন্যই মেরেছিলাম। তুমি ওকে পছন্দ কর বলে!
আমি জানি ঈশিতা কেন নিশিকে মেরেছিল। যখন প্রথম আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন থেকে এটা বুঝতে আমার কষ্ট হয় নি যে ঈশিতা কোন এক অদ্ভুদ কারণে আমাকে পছন্দ করে। আমি জানার পরেও সেদিকে এগোই নি। কারণ রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে যুক্ত কাউকেই আমার ঠিক পছন্দ ছিল না কোন দিন। ঈশিতাও এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিল। তাই সেও আমার দিকে এগোই নি। তবে আমি যে নিশিকে পছন্দ করি, এটা সে মেনে নিতে পারে নি। পছন্দের মানুষকে অন্যের হতে দেখাটা বেশ কষ্টের বিশেষ করে যখন আপনার কাছে ক্ষমতা আছে।
ঈশিতা বলল
-যে অপরাধ টুকু করেছিলাম আজকে হয়তো সেটুক কাটলো। আমি তোমার ভালবাসা না পাই, তোমার ঘৃণা পেতে চাই না।
আমি ঈশিতার দিকে তাকিয়েই রইলাম কেবল। আমার প্রতি মেয়েটার তীব্র অনুভূতি আমি উপলব্ধি করতে পারছি। আমি বললাম
-কিন্তু আমি যে অপরাধ টা করলাম, সেটার কি হবে? আমার কি শাস্তি প্রাপ্য না?
ঈশিতা হেসে বলল
-তোমার কোন কিছুই আমার কাছে অপরাধ নয়। বুঝেছো? এই গিলটি ফিলিংস রেখো না।
কিছুটা সময় কেউ কোন কথা বললাম না। তারপর ঈশিতা বলল
-আমার বাবা মা আসছে। ঢাকার বাইরে থাকে তো একটু সময় লাগবে। এই সময় টুকু আমার পাশে থাকবা! অসুখ করলে মানুষ কাছের মানুষের আসে পাশে থাকতে চায়। তুমি আমাকে কাছের মানুষ না হয় নাই ভাবলে, আমি তো ভাবি। থাকবা?
ঈশিতার কন্ঠে কি ছিল আমি জানি না, আমার কেবল মনে হল আমার বুকের ভেতরটা নড়ে উঠলো। তারপর নিজেকে একটা তীব্র চড় মারতে ইচ্ছে হল। এই মেয়েটা আমাকে কি তীব্র ভাবেই না ভালবাসে আর আমি এমন কারো পেছনে দৌড়ে বেড়াচ্ছি যার কাছে আমি এমন গুরুত্বপূর্ণ কেউ না!
আমি টুল থেকে উঠে ওর বেডটার পাশে বসলাম। তারপর ওর দিকে একটু ঝুকে ওর কপালে চুমু খেলাম। তাকিয়ে দেখি ঈশিতার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। কিন্তু সেটা দুঃখের নয়, আনন্দের আশ্রু।
(কেবলই কাল্পনিক গল্প। কোন বাস্তব ঘটনার সাথে দূর দূরান্তেও এর কোন সংযোগ নাই)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই এপ্রিল, ২০১৮ বিকাল ৫:১১