সাইফুল চোখ বড় বড় করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে । নিজের বর্তমান অবস্থা তার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না । এমনটা কিছুতেই হতে পারে না । সাইফুলের বারবার মনে হচ্ছে ও কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে । সামনে জ্বলতে থাকা আগুনের কুণ্ডুলির দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে । তবে আগুনের ভেতরে গরম হতে থাকা লোহার শিকটার দিকে সাইফুলের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে । ওটা দিতে একটু আগেই ওর সাথে কি করা হয়েছে সেটা ও মনেও করতে চায় না । জোর করে ভাবনাটা দুর করে দিতে চাইলো কিন্তু তীব্র যন্ত্রনাটা দুর করতে পারলো না।
হঠাৎ সাইফুলের খুব পানি খেতে ইচ্ছে হল । সাইফুল শুনেছে সব থেকে নিষ্ঠুর মানুষটাও নাকি পানির কথা বললে না বলে না । কিন্তু সামনের মানুষটা কি ওকে একটু পানি খেতে দিবে? একটু নড়াচড়া করতে চেষ্টা করলো কিন্তু কোন লাভ হল না । ওর হাত আর পা শক্ত করে বেঁধে রাখা হয়েছে । মুখের ভেতরে এক দলা কাপড় দিয়ে তারপর মেডিক্যাল টেপ দিয়ে মুখটা শক্ত করে পেঁচিয়ে রেখেছে সামনের মানুষটা । একটু আগে যখন ঐ গরম লোহার শিকটা দিয়ে ওর গোপন অঙ্গে ছ্যাক দিল লোকটা, সাইফুল মুখ দিয়ে একটা শব্দও করতে পারলো না । তীব্র একটা চিৎকার বেরিয়ে এসে গলা পর্যন্তই আটকে থাকলো। এখন কিভাবে পানি চাইবে !
সাইফুল একটু নড়ার চেষ্টা করলো । সামনে বসা মানুষটার দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করলো কিন্তু কোন লাভ হল না । সে একভাবে আগুনের দিকে তাকিয়ে আছে । মাঝে মাঝে আগুনের মধ্যে কেরোসিন দিয়ে সেটা উস্কে দিচ্ছে । সাইফুল সেদিকে ভীত চোখে তাকিয়ে আছে । লোহার শিকটা আবার গরম হলে সেটা দিয়ে সামনে বসা মানুষটা কি করবে সেটা বুঝতে সাইফুলের কষ্ট হচ্ছে না । তীব্র একটা আতঙ্কে পেয়ে বসেছে । কিন্তু বুঝতে পারছে না সামনের মানুষটার সাথে তার কিসের এতো শত্রুতা ! সাইফুল কোন দিন তাকে দেখেছে বলে মনেও পড়ে না । তাহলে ওর সাথে এই কাজটা কেন করছে সে ?
দুই
সলিম আহমেদ চিন্তিত হয়ে পায়চারি করছে । একটু পরেই আযান দেওয়ার কথা । এই এতোটা সময় তিনি একটা বারের জন্যও স্থির হয়ে বসতে পারেন নি । কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেন না । তার যত যোগাযোগ আছে সবার সাথে যোগাযোগ করেছেন, তার সমস্ত শক্তি লাগিয়ে দিয়েছেন তবুও এখনও পর্যন্ত কোন খবর আসে নি । তার ছেলের কোন খোজ পাওয়া যায় নি । এমন কিভাবে হল !
বলতে বলতেই ফোন বেজে উঠলো । নম্বরের দিকে তাকিয়ে দেখেন ওসি সাহেব ফোন দিয়েছেন,
-কিছু পেলেন ?
-এখনও না । আমরা পুরো এলাকা চষে বেরিয়েছি কিন্তু রাফিকে কোথাও পাওয়া যাচ্ছে না ।
ওসি সাহেব কিছুটা সময় চুপ করে থেকে বললেন
-ম্যাডামের কি অবস্থা ?
সলিম আহমেদের মনে হল ওসি সাহেব কে কিছু বলে কিন্তু সেটা আর বলল না । ফোন রেখে দিলেন । উনি নিজেও কম চেষ্টা করে কি কিন্তু ছেলের কোন খোজই পাওয়া যাচ্ছে না । কিভাবে একটা মানুষ এতোটুকু সময়ের মাঝেই গায়েব হয়ে গেল । এটা কিভাবে সম্ভব ?
সলিম আহমেদ এলাকার বিশিষ্টি ব্যবসায়ী । এক নামে এলাকার সবাই তাকে চেনে । তার উপর তার স্ত্রী হচ্ছে ক্ষমতাশীন দলের এমএলএ । এলাকাতে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি অন্য রকম । সরকারি বেসরকারি সব লোকজন তাদের কে তমিজ করে চলে ।
গতকাল সন্ধ্যায় তার বাসাতে তার স্ত্রীর কাছে একজন লোক দেখা করতে এসেছিলো । সাধারনত স্ত্রীর মিটিং গুলোতে সে থাকে না কিন্তু আজকে তার স্ত্রীই তাকে থাকতে বলল । কথাটা ছিল তার ছেলের ব্যাপারে । ক্ষমতাসীন দলের নেতার ছেলের সে । তার এলাকাতে তার দাপট ছিল অন্য রকম । যখন যা ইচ্ছে, তাই করে বেরাতো । কদিন আগে এক মেয়েকে তুলে নিয়ে এসেছিলো । পরে যখন সেই মেয়ে তার নামে ধর্ষনের মামলা করে দিল তাকে আবারও ধরে আনা হয় । এবার সাক্ষী রাখা হয় নি । একেবারে মেয়েই ফেলে সে । যদিও এদিকটা সামলাতে খুব একটা ঝামেলা হয় নি তবুও সলিম সাহেবের মনে হয়েছে যে ছেলে একটু বেশি বাড়াবাড়ি করে ফেলছে । তাকে সামলানো দরকার ।
কিন্তু সেই লোকটা বলল অন্য কথা । গত কদিন থেকে পুরো দেশে কিছু খুন হচ্ছে । খুন গুলো হচ্ছে ভয়ানক ভাবে । ভিটটিমকে ভয়ানক কষ্ট দিয়ে মারা হচ্ছে । সর্ব শেষ সাইফুল নামের লোককে । রাতের আধারে সাইফুলকে শহরের চৌরাস্তার পাশে একটা কারেন্টের থামে সাথে ঝুলিয়ে রাখে কেউ । কিন্তু তাকে হত্যা করা হয়েছে আরও আগে । পুরো শরীর আঘাতে চিহ্ন । শরীর প্রায় সব হাড় ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে । আর সব থেকে ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে সাইফুলের পরিপাক ছিদ্র দিয়ে একটা রডের শিক ঢোকানো ছিল । পরীক্ষা করে দেখা গেছে যখন এটা সাইফুলের পেছন দিয়ে সেটা ঢোকানো হয়েছে তখন সেটা উৎতপ্ত ছিল ।
সলিম আহমেদ কথাটা চিন্তা করতেই শিউরে উঠলেন । তিনি বুঝতে পারছিলেন না এসব কথা তাদেরকে শোনানোর মানে কি!
কিন্তু লোকটা তারপর যা বলল তা শুনে সলিম আহমেদ চমকে উঠলো । লোকটা বলল যে সব গুলো খুন হওয়া লোক গুলোর মাঝে একটা ব্যাপার কমন, তারা সবাই ছিল রেপ কেসের আসামী । বিশেষ করে ৫-১৫ বছরের শিশুদের ধর্ষন করেছিল । কেউ বা পালিয়ে ছিল, জামিনে ছিল কিংবা প্রমানের অবাবে খালাস পেয়েছে । এরাই হচ্ছে টার্গেট । কে বা কারা এই কাজটা করছে কেউ বলতে পারছে না । কিন্তু কাজ গুলো হচ্ছে খুব নিখুত ভাবে । পুলিশ কোন ট্রেশ করতে পারছে না ।
সলিম আহমেদের কাছে এবার সব পরিস্কার হয়ে গেল । তার ছেলেও যে এমন কিছু করেছে সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । তার স্ত্রী বলল ছেলেকে তিনি বাইরে পাঠিয়ে দিবেন । কিন্তু যতদিন বাইরে না পাঠানো হচ্ছে ততদিন তাকে বাইরে রাখা নিরাপদ নয় কোন ভাবেই । তার থেকে তাকে পুলিশের কাছে আত্ম সমর্পন করানো হোক । তারপর সেখান থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে ।
সেই পরিকল্পনা মতেই তাকে রাতের বেলা পুলিশের কাছে পাঠানো হচ্ছিলো । কিন্তু তার ছেলে সেই পুলিশের কাছে পৌছাই নি । পুরো রাত ধরে পুরো এলাকা চষে বেড়ালোপুলিশ এবং তার লোকজন কিন্তু তার ছেলেকে কোথাও খুজে পাওয়া গেল না । সে যে গাড়িতে করে যাচ্ছিলো সেটা পাওয়া গেল শহর থেকে একটু দুরে । সেখানে তাদের ড্রাইভার ছিল বেহুশ হয়ে । তার মাথায় কেউ শক্ত কিছু দিয়ে বাড়ি দিয়ে অজ্ঞান করে তাদের ছেলেকে নিয়ে গেছে ।
এই খবর সলিম আহমেদ খুব বেশি বিচলিত হয়ে পড়েছেন । কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেন না । কিন্তু তার স্ত্রী একদম বিছানায় পড়ে গেছেন ।
পরদিনও গেল একই ভাবে । গতকাল তো কেবল নিজ এলাকা এবং তার আশে পাশে খোজ খবর চালানো হয়েছে এবার সেটা বাড়ানো হচ্ছে আরও । কিন্তু কোন লাভ হল না । তার ছেলে যেন একেবারে গায়েব হয়ে গেল । কেউ কোন খোজ খবর করতে পারছে না । সলিম আহমেদ কোন কিছু ভাবতে পারছে না । তিনি খানিকটা সেই মেয়েটির বাবার অবস্থা চিন্তা করতে পারছে । সেই মেয়েটিকে যখন তার ছেলে তুলে নিয়ে এসেছিলো তখন নিশ্চয় সেই এমন ভাবে দুয়ারে দুয়ারে ছুটে বেরিয়েছিলো কিন্তু কেউ তাকে সাহায্য করে নি । একজন বাবার জন্য এটা কত তীব্র কষ্টের সেটা বুঝতে বাকি রইলোনা সলিম আহমেদের ।
ঠিক সাত দিন পরে সলিম আহমেদ তার ছেলের খোজ পেলেন । তাও একটা ইউউিউব ভিডিওর মাধ্যমে । ভিডিওটা প্রায় ৩ লক্ষ্যবার দেখে হয়ে গেছে আপলোডের পরপরই ।একজন তার চ্যানেলে ভিডিওটি আপলোড করেছে । ভিডিও দেখেই বোঝা যাচ্ছে সে তার ক্যামেরাটা মোবাইলে ভিডিওটা করেছে । সেখানে দেখানো হচ্ছে একটা নগ্ন ছেলেকে রাস্তা দিয়ে হাটানো হচ্ছে । তার গলাতে একটা সাইনবোর্ড টাঙ্গানো সেখানে লেখা ধর্ষক ! তার তার গোপন অঙ্গটার সাথে শক্ত করে দড়ি দিয়ে বেঁধে একটা ইট ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে । যদিও সে অংশ টুকু ব্লার করে দেওয়া হয়েছে । সে হাটছে অতি কষ্টে । মানুষজন আশে ছুটছে । কেউ চড় থাপ্পড় মারছে কেউ আবার ইট ছুড়ে মারছে ।
সলিম আহমেদ কেবল হতভম্ভ হয়ে তাকিয়ে রইলো ভিডিওটার দিকে । ভিডিওর ছেলেটা যে তার নিজের ছেলে সেটা বুঝতে তার মোটেই কষ্ট হল না ।
পরিশিষ্টঃ
সলিম আহমেদের আরও ঘন্টা খানেক লাগলো তার ছেলে কোথায় আছে সেটা বের করতে । সে আছে দেশের অন্য এক প্রান্তে । কেউ তাকে ঐ অবস্থায় রাস্তায় ছেড়ে দিয়ে যায় । স্থানীয় পুলিশ জনতার কাছ থেকে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতাপে ভর্তি করে । এবং তারপর তাকে রাজধানীর দিকে পাঠানো হয় ।
সলিম আহমেদ নিজের গাড়িতে করেই রাজধানীর দিকে রওনা দিলেন । তার মা আসতে পারে নি কারন ছেলের এই অবস্থা দেখে বারবার অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে । তাকে স্থানীয় হাসতাপেল ভর্তি করা হয়েছে । ঘুমের ঔষধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে ।
গাড়ি চলতে চলতে যখন ফেরি ঘাটে এসে থামলো তিনি একটু বাইরে বের হলেন । সামনে লম্বা গাড়ির লাইন তবে তাকে খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হল না । আবার যখন গাড়িতে এসে হাজির হল তখন লক্ষ্য করলেন যে তার সিটের পাশে একটা নীল খাম পড়ে আছে । খানিকটা কৌতুহল নিয়েই তিনি খাম টা তুলে ধরলেন । তিনি যখন বের হয়েছিলেন তখন এটা এখানে ছিল না ।
ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করেও কোন লাভ হল না । সেও বলতে পারলো না খামটা কিভাবে এল । খামটা খুলে দেখলেন কয়েকটা লাইন লেখা সেখানে !
"নিজের কুলাঙ্গার ছেলের কৃত কর্মের শাস্তির ব্যবস্থা কর নয়তো পরের বার তার পরিণতি অন্য ধর্ষকের মতই হবে"
সলিম আহমেদ একটা তীব্র ক্রোধ অনুভব করলো । এই এতো সময়ের মাঝে কেবল এই প্রথম তিনি ছেলের দুষ্চিন্তা ফেলে রাগ অনুভব করল । কিন্তু সে জানে তার এই নিস্ফল রাগের কোন মূল্য নেই । নিশ্চয়ই ঐ মেয়েটার বাবারও তার এবং তার ছেলের উপর এমন রাগ হয়েছিল । কিন্তু সে কিছুই করতে পারে নি । তিনিও হয়তো কিছুই করতে পারবে না । হয়তো কোন দিন খুজেও পাবে না কে করেছে তার এই ছেলের এই পরিণতি !
==============
একটি নাম বিহীন গল্প
অপু তানভীর
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা এপ্রিল, ২০১৮ রাত ১১:০৯