অনির ফোন পেয়ে একটু অবাক হল তৃষা । খুব দরকার না পড়লে অনি সাধারনত এই সময়ে ফোন দেয় না । ওরা সবাই জানে এই সময়ে ও কাজে থাকে । ওর সাথে কথা বলার সময় হচ্ছে রাতের বেলা । ও নিজে অনেক রাট পর্যন্ত জেগে থাকে । অনেকের সাথে কথা হয় তখন ।
একটু চিন্তিত হয়েই ও ফোনটা রিসিভ করলো ।
-কি হল রে ?
-তুই কি ফ্রি এখন ?
-নাহ । একটু ব্যস্ত । বলা কি সমস্যা ?
-আমি তোর অফিসের ক্যাফেটরিয়াতে । হাতের কাজ শেষ করে আয় । আমি অপেক্ষা করছি ।
-আরে কি হয়েছে বলবি তো ।
-হাতের কাজ শেষ করে আয় তারপর বলছি ।
তৃষা এবার সত্যিই একটু চিন্তিত হল । মনে হল যে সত্যিই বড় কোন সমস্যা হয়েছে ।
তবে হাতের কাজ শেষ করতে একটু সময় লেগে গেলই।
ক্যাফেটেরিয়ারতে গিয়ে দেখলো অনি এক কোনার একটা টেবিলে বসে আছে। তৃষার আসলেই মাথায় কিছু আসছে না। কি এমন দরকার হয়ে পড়লো যে অনি একেবারে এখানে এসে হাজির।
-বলবি কি হয়েছে? এতো সিরিয়াস কেন?
অনি কিছুটা সময় ওর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল
-তুই ভাল আছিস?
তৃষা বলল
-ভনিতা না করে বল কি হয়েছে?
-বললাম তুই ভাল আছিস? ভুলে গেছিস অপুকে?
তৃষার মনে হল ও একটা ধাক্কা খেল। এই নামটা ও ভুলে যেতে চেয়েছিল কিন্তু কোন ভাবেই সেটা সম্ভব হচ্ছিলো না। কোন মতে নিজের মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দাবিয়ে রেখেছিলো এতো দিন। কিন্তু আজকে আবার অনি মনে করিয়ে দিল।
তৃষা বলল
-তুই কি এই কথা বলার জন্য এখানে এসেছিস? দেখ আমার কাজ আছে। আমি গেলাম।
অনি ওর হাত চেপে ধরলো। তারপর বলল
-চোখ লুকাচ্ছিস কেন? আমার দিকে তাকিয়ে বল, তুই ভাল আছিস, তুই আর ঐ অপুকে মনে করিস না, ওর কথা ভাবিস না। বল!
তৃষা কোন কথা বলতে পারলো না। নিজের মনের ভেতরে অদ্ভুদ একটা অনুভূতি হচ্ছে। একটা কষ্ট যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
অনি বলল
-ঠিক এই ভাবেই কষ্ট পাচ্ছে সেও। তোর কাছ থেকে দূরে থেকে।
তৃষা খানিকটা অবাক হয়ে অনির দিকে তাকালো। তারপর বলল
-মানে? কি বলছিস তুই?
-তুই আমার আর তোর একটা ছবি দিয়েছিলি ওকে হয়তো। তাই না?
তৃষা মনে করার চেষ্টা করলো। তারপর বলল
-হ্যা। দিয়েছিলাম। ও চেয়েছিল।
-আজকে বই মেলাতে গিয়েছিলাম। ওখানেই দেখা। আমাকে চিনে ফেলে ছবি দেখালো মোবাইলে। তারপর তোর কথা জিজ্ঞেস করলো।
তৃষা কি বলবে ঠিক বুঝতে পারলো না। চুপ করেই রইলো কিন্তু ওর মনের ভেতরে তখন চলছে তখন কাল বৈশাখী ঝড়। ছেলেটার সাথে এমন ভাবে নিজেকে জড়িয়ে যাবে ও কোন দিন ভাবেও নি।
কেবল খেলার ছলেই ছেলেটাকে নক দিয়েছিল। বন্ধুদের অনেকেই অপুকে চিনতো অনলাইনে। সেখান থেকেই একজন তৃষাকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলো যে অপুর সাথে প্রেম করে দেখাতে। ছোট বেলা থেকেই তৃষা বরাবর জেদি। কেউ ওকে কিছু করতে চ্যালেঞ্জ করেছে আর সেটা ও করতে পারে নি সেটা হয় নি।
ব্যাস শুরু হয়ে গেল খেলা।
তৃষার খুব বেশি সময় লাগে নি অপুর সাথে ভাব জমাতে । কিন্তু ঝামেলা বাঁধলো অন্য খানে । একটা সময় তৃষা অনুভব করতে শুরু করলো যে ছেলেটার সাথে কথা বলতে ওর আসলেই ভাল লাগছে । প্রতিদিনের একটা নির্দিষ্ট সময় ছেলেটার ফোনের অপেক্ষাতেই কাটতো তৃষার । লম্বা সময় কথা বলতে ওর কোন সমস্যা হতই না । অন্য পাশ থেকেও যে আগ্রহটা একই ধরনের সেটা বুঝতেও তৃষার খুব একটা দেরি হল না । তখনই ওর মনে হল যে সব কিছু বন্ধ করা দরকার ।
সত্যি তাই করলো । অপুকে সব বলা সহজ ছিল না । বলার আগে মনে হয়েছিলো অপু হয়তো খুব চিৎকার চেঁচামিচি করবে । ওর সাথে খারাপ ব্যবহার করবে । সেটা করলেই সম্ভবত তৃষার জন্য ভাল হত । কিন্তু অপু কোন কথা বলল না । চুপ করে কেবল শুনে গেল । কেবল শেষ একটা কথাই বলল
-তাহলে এটাই শেষ কথা ?
তৃষার অপুর কন্ঠে এমন কিছু শুনতে পেল যেন ওকে চিৎকার করে বলছে যে তৃষার আমি তোমাকে ভালবাসি । আমার কিছু যায় আসে না তুমি আমার সাথে কি করেছো, আমি কেবল তোমাকে ভালবাসি ।
তারপরই ফোনের নাম্বরটা বন্ধ করে দেয় । আর চালু করে নি কোন দিন । দেখতে দেখতে তিন মাস পার হয়ে গেছে । তৃষার ভাবতেও পারে নি ও অপুকে এভাবে মিস করবে । কিন্তু মিস করেছে ওকে ভুলতে পারে নি ঠিক মত । কতবার যে ফোনটা চালুকে করে ওকে আবার ফোন করতে গিয়েছে সেটার কোন ঠিক নেই । অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রন করে এনেছে ! আজকে অনুর কথা শুনে আবারও সেই দেওয়াল ভেঙ্গে গেছে । আজকে রাতে আর ঘুম আসবে না । যেমন আসে নি ঐদিন রাতেও ।
অনির দিকে কিছুটা সময় চুপ করে তাকিয়ে থেকে তৃষা বলল
-আমি এসব ভুলে গেছি । আসলে ওটা একটা খেলা ছিল । আর কিছু না ।
অনি বলল
-সত্যিই খেলা ছিল ? তুই ভুলে গেছিস !
-হ্যা ।
-অপু যায় নি । আর আমি তোর দিকেও তাকিয়েও বুঝতে পারছি তুই কেমন ভুলে গেছিস !
তৃষার ততক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে । তারপর বলল
-তোর কথা শেষ হয়েছে ? আমার হাতে অনেক কাজ আছে ।
অনি একটু চুপ করে থেকে বলল
-না । শেষ হয় নি । আর একটু বাকি আছে ।
-কি ?
-সেটা বলব না । তবে তুই সেটা টের পাবি আজই ।
-মানে ?
-মানে কিছু না । এটাই তোকে বলতে এসেছিলাম । যাই হোক আমার জানানো শেষ ।
তৃষা আরও অনেক চেষ্টা করলো কিন্তু অনি বাকি কথাটা কিছুতেই বলল না । কয়েকবার মনে হল যে অপুকে হয়তো ওর এই নাম্বারটা দিয়ে দিয়েছে । তাই যখনই ফোন বাজতে তখনই ওর বুকের ভেতরে কেমন যেন করে উঠছে । মনে হচ্ছে যে এই বুঝি ওকে ফোন দিলো । তৃষা খুব ভাল করেই জানে যে একটা বান যদি অপু ওকে ফোন করে ভালবাসি বলে তাহলে ওর পক্ষে কোন ভাবেই আর অপুর থেকে দুরে থাকা সম্ভব হবে না ।
বাকি দিনটা ওর কাটলো চরম উৎকন্ঠায় । সেই সাথে অনির উপর খুব রাগ হল । ইচ্ছে হল ওকে খুব বকে দিতে কিন্তু সেই সাথে অদ্ভুদ একটা অনুভুতিও হতে শুরু করলো । অপু ওকে এখনও ভুলে যায় নি এবং আগের মত করে ভালবাসে ।
এমন কেন ? কেন এমন ভাবে ভাবে ভালবাসে ছেলেটা ?
এমন কেউ করে নাকি !
রাতে বাসায় ফিরে খুব ইচ্ছে হল যে সেই নম্বারটা আবার চালু করতে । কিন্তু সেটা করলো না । ইচ্ছেটা দমন করতে ওর বেশ বেগ পেতে হল অবশ্য । তবে রাতে যে আর ঘুম আসবে না সেটা ওর ঠিকই জানতো ।
এও জানে যে যতই চেষ্টা করুক না অপুর কথা না ভেবে সে থাকতে পারবে না । তাই সে চেষ্টাও করলো না । কি অদ্ভুদ ভাবেই না ওদের কথা শুরু হয়েছিলো । একটা গল্প লেখার সাইটে অপুর একাউন্ট ছিল । সেখানেই ওকে প্রথম মেসেজ দিলো । প্রথম প্রথম একদম কথাই বলতে চাইতো না । যা জানতে চাইতো এর বেশি একটা কথাও বলতো না । কিন্তু যখন মেজেস থেকে ফোনে কথা শুরু হল, অপু আস্তে আস্তে কথা বলা শুরু করে । এবং একটা সময় তৃষা নিজে ওর সাথে কথা বলে পারতো না ।
এতো সহজ আর সরল ভাবে কথা বলতো যে তৃষার কেবলই শুনতে ইচ্ছে করতো । তৃষার কে নিয়ে ওর কতই না স্বপ্ন ছিল । একটা অদ্ভুদ স্বপ্ন ছিল যে রাস্তার মাঝে ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরা । খোলা আকাশের নিয়ে যেভাবে মুভিতে নায়ক নায়িকা একে অন্য কে জড়িয়ে ধরে ঠিক সেভাবে ! তৃষা খুব হাসতো । মজাও পেত ।
কলিংবেল বেজে উঠলো !
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে বারোটা বেজে আরও এগারো মিনিট । তৃষা একটু অবাক হল । এতো রাতে কারো আসার কথা না । আসতে হলে আগে ফোন করতো । ও শান্তিতে থাকার জন্যই এখানে একা একা থাকে । অপরিচিত কেউ হলে আগে ইন্টারকমে ফোন আসতো । তাহলে কে আসলো ?
পাশার বাসার আপু হবে হয়তো ! মাঝে মাঝে উনি আসেন তৃষার কাছে !
কিন্তু দরজা খুলে দেখলো দারোয়ান দাড়িয়ে !
-কি চাই ?
দারোয়ান ওকে একটা কাগজ দিয়ে বলল
-একজন দিছে ।
-কে ?
-আমি চিনি না । বলল যে আপনাকে চিনে ।
তখনই ওর বুকের ভেতরটা লাফিয়ে উঠলো । তৃষা খুব ভাল করেই জানে কে এই কাগজটা দিয়েছে । অনি সোজাসুজি বাসার ঠিকানাই দিয়ে দিয়েছে ।
দুরদুর বুকে তৃষা চিঠিটা খুললো । সেখানে কেবল একটা লাইনই লেখা ।
লাইনটা পড়ার তৃষা আর দাড়িয়ে থাকতে পারলো না । এতো দিন যে দেওয়া সে বানিয়ে রেখেছিলো সেটা একেবারে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল । দারোয়ান তখনও দাড়িয়েই ছিল । পাশ কারিয়ে সোজা লিফটের দিকে দৌড় দিল । এখনই ওর অপুর সাথে দেখা করতে হবেই ।
অপু রাস্তার উপর দাড়িয়ে আছে । আজকেই অপুর সেই স্বপ্ন পূরণ করার দিন । আজকে ওকে জড়িয়ে ধরতেই হবে ।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে মার্চ, ২০১৮ রাত ১০:৩৭