ছেলেটির এখন কোন কাজ নেই । কোন কিছু করার নেই । সময়ের হিসাব অনেক আগেই সে হারিয়ে ফেলেছে । কখন সকাল হয় আর কখন রাত নামে সেটাও সে জানে না । মাঝে মাঝে তীব্র গরম অনুভুত হয় । তখন মনে হয় দুপুর বেলা । তার কিছু সময় পরেই খাবার দেওয়া হয় তাকে । সম্ভবত সেটা দুপুরের খাবার !
সারাটা সময় তাকে এই বদ্ধ সেলে আটক করে রাখা হয় । কখনই বাইরে বের করা হয় না । ঘরটা চার ফিট বাই চার ফিটের একটা ছোট্ট ঘর । কোন জানালা নেই । লোহার শিকের একটা দরজা আছে তবে সেটাও জেলখানার এই ভেতরের দিকে । বাইরের কোন আলো এখানে আসে না । এক কোনাতে একটা প্যান সেট করা আছে । সেখানেই বাথরুম করতে হয় । সেটা দিয়ে তীব্র গন্ধ আসে । এমন কি সারাদিন পানি ঢাললেও সেই গন্ধ যায় না ।
দিনে দুইবার তার জন্য খাবার আসে । ব্যাস আর কেউ এখানে আসে না । ছেলেটি কারো সাথে কথা বলতে পারে না । কোন কথা বলার মানুষ নেই । মানুষের সাথে কথা বলার জন্য তার মনটা ব্যকুল হয়ে থাকে । কিন্তু কেউ আসে না তার কাছে । কেবল খাবার নিয়ে আসা সেই লোকটা ছাড়া । সেও তার দিকে ঘৃণার চোখেই তাকিয়ে থাকে । কোন প্রশ্ন করলে উত্তর দেয় না । ডাক দিলেও শুনে না ।
-এই যে ভাই । শুনেন না ? এই পুলিশ ভাই ?
লোকটা খাবারের প্লেট টা সামনের দিকে ঠেলা দিয়ে কিছুটা সময় তাকিয়ে রইলো । ছেলেটা বুঝতে পারে কি ঘৃণা চোখেই তার দিকে তাকিয়ে আছে । এই দৃষ্টি তার চেনা । সেই দিনও ঠিক এই ঘৃণা চোখেই তার আসে পাশের মানুষ গুলো তাকিয়ে ছিল তার দিকে । তবে সেটা সে খুব বেশি সময় দেখার সুযোগ পায় নি ।
এতো দিন কেবল গনধোলাই কথা শুনেই এসেছিলো মানুষের মুখে । কিন্তু সেটা যে কি আসলে কি জিনিস সেটা ছেলেটা সেদিন বুঝেছিলো । ভেবেছিলো কাজটা করেই সে দৌড় মারবে । কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে দৌড় দিয়ে পার পেয়ে যাবে । আগেও অনেকে এমন কাজ করেছে । সবাই পার পেয়ে গেছে । ছেলেটিও তেমন ধারনা ছিল । তাকে সেই ভাবেই বলা হয়েছিলো ।
বলা হয়েছিলো একবার যখন আঘাত করা হবে তখন কেউ সাহস করে এগিয়ে আসবে না । সবাই ভয়ে পালিয়ে যাবে । সে ভেবেছিলো বড়ভাই যখন বলেছে তখন এমনই হবে । এমই হওয়ার কথা । জীবনে সে যখন অন্য পথে চলে যাচ্ছিলো তখন এই বড় ভাই ই তাকে সঠিক পথে নিয়ে এসেছে । সঠিক পথ দেখিয়েছে । কিন্তু সঠিক পথে তো অনেক বাধা আসবে । সেটা মোকাবেলা করতে হবে । এমনই বলেছিলো সেই বড় ভাই । সেই দায়িত্বই সে নিয়েছিলো । সেই বাঁধা সরাতে হবে ।
লোকটার ঠিক পেছনেই দাড়িয়ে ছিল । কালো রংয়ের একটা টিশার্ট পরেছিলো সেদিন । পেছন থেকে কেবল তার মাথা ভর্তি কাচা পাকা সাদা চুপ দেখতে পাচ্ছিলো সে । সুযোগের অপেক্ষা করছিলো । এসেও গেল সেই সময় ।
ব্যাস ।
আর দেরি করে নি ।
কিন্তু যেমনটা ভেবেছিলো তেমন কিছুই হল না । ওকে বলা হয়েছিলো সে প্রথম কোপের সাথে সাথেই সবাই পালিয়ে যাবে ভয়তে । কিন্তু তেমন কিছু হল না । কোপ গুলো সে ঠিক মত দিতেও পারে নি । তার আগেই চার পাশ থেকে মানুষ জন তাকে ধরে ফেলল ।
তারপর মাইর শুরু !
এমন মাইর সে তার জীবনে কোন খায় নি । যখন পড়াশুনা করতো তখন মাঝে মাঝে মার খেয়ে না পড়ার জন্য । ওর বাবার হাতেও খেয়েছে মাইর । কিন্তু এই মাইর সেই মাইরের কাছে কিছু নয় ।
প্রথমে কিছুটা সময় নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করলো সে কিন্তু একটা সময় দেখলো এটা দিয়ে লাভ নেই । চারিদিক থেকে কিল ঘুসি আর লাথি আসছেই । একটা সময় ছেলেটার স হ্যের সীমা হারিয়ে যায় । সে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় । তারপরেও কিছুটা সময় চলে তার উপর কিল ঘুসির বর্ষন !
তারপর যখন সে চোখ খুলে তাকালো তখনই সে হাসপাতালের বেডে শুয়ে ছিলো । তার দুইহাত বেডের সাথে হ্যান্ড কফ দিয়ে লাগানো । সেখানেও ওর সাথে কেউ কথা বলতো না । কেবল সবাই ঘৃণার চোখে তাকাতো !
কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না । সে তো ভাল কাজ করতে গিয়েছিলো । তাদের ধর্মের শত্রুকে শেষ করতে গিয়েছিলো । সবার তো তাকে বাহবা দেওয়া কথা । কিন্তু সবাই এমন করে ঘৃণা ভরা চোখে তাকে দেখছে কেন !
ছেলেটা কিছু বুঝতে পারে না ।
এমন তো হওয়ার কথা ছিল না । তাহলে কেন হচ্ছে !
হঠাৎই ছেলেটা আবার বাস্তবে ফিরে আছে । দেখলো আবারো সেই পুলিশ লোকটা এসেছে । তবে আজকে ছেলেটা খানিকটা অবাকই হল । কারন লোকটা একা আসে নি । তার সাথে আরও একজন এসেছে । লোকটা হাবভাব দেখেই মনে হচ্ছে বড় অফিসার । তার হাতে চাবি দেখে ছেলেটা আরও অবাক হল । লোকটা আগের পুলিশ কে চোখের ইশারা করতেই পুলিশটা এগিয়ে এল । তারপর ছেলেটার দিকে তাকিয়ে বলল
-এই উঠে দাড়া ! হাত সামনে দে !
ছেলেটা কোন প্রতিবাদ না করেই হাত সামনে দিল । তার হাতে একটা হাত কড়া লাগানো হল । তারপর গেটের তালা খোলা হল । বের করা হল তাকে । সেল থেকে বাইরে এসে সে দেখলো আরও দুইজন পুলিশ দাড়িয়ে আছে । ওকে নিয়ে যেতে এসেছে !
তাহলে আজকে ওর রায়ের দিন ! দুইদিন ওকে কোর্টে হাজির হতে হয়েছে এরই মধ্যে ! আজকেও কি নিয়ে যাবে তাকে ।
ছেলেটা আস্তে আস্তে হাটতে লাগলো । সামনে দুজন পুলিশ আর পেছনে দুজন । সে হাটছে মাঝখানে ।
কিন্তু তাকে আজকে কোন গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হল না । বরং একটা ঘরে এনে রাখা হল । একটা টেবিলের দুই পাশে দুইটা চেয়ার পাতা । একটা চেয়ারে তাকে বসতে বলা হল । তারপর তার হ্যান্ডকাফটা টেবিলের একটা আংটার সাথে আটকে দেওয়া হল ।
ঘরের এক কোনে একজন পুলিশ দাড়িয়ে আছে এটেনশন হয়ে । তাকে রেখেই সবাই বাইরে চলে গেল । কিছু সময়ে কিছুই হল না । ছেলেটা চুপ করে বসেই রইলো । তারপরে আবার দরজা টা খুলে গেল । ছেলেটা তাকিয়ে রইলো সেই দরজার দিকে । কিন্তু দরজা দিয়ে যে মানুষটা প্রবেশ করলো তাকে দেখার জন্য ছেলেটা মোটেই প্রস্তুত ছিল না ।
কোন ভাবেই প্রস্তুত ছিল না ।
কাঁচা পাকা সাদা চুলের চশমা পরা সেই মানুষটা ! মুখে একটা স্মিত হাসি লেগে আছে । ওর সামনে এসে দাড়ালো । লোকটার পেছনে সেই অফিসার পুলিশ । লোকটা সেই পুলিশের দিকে তাকিয়ে বলল
-এর হ্যান্ড কাফ খুলে দাও । এটা তো এমনিতেই জেলখানা । এর ভেততে আবার হাত কড়া কেন ?
পুলিশ অফিসার টি বললল
-স্যার, আপনি ভুলে যাচ্ছেন যে এ আপনার উপর হামলা করেছিলো । আবার করতে পারে !
এই কথা শুনে লোকটা আবার হাসলো । তারপর বলল
-ভয় পেও না । খুলে দাও ।
অফিসারটি অনিচ্ছা স্বত্তেও হাত কড়া খুলে দিল । লোকটা তার সামনের চেহারে বসলো । তখনও সেই হাসি লেগেই আছে । ছেলেটা অবাক হয়ে দেখলো এই এতো দিন যার সাথেই তার দেখা হয়েছে সবাই কেবল তাকে ঘৃণার চোখেই দেখেছে অথচ এই মানুষটা ওর দিকে তাকিয়ে আছে হাসি মুখে । চোখে বিন্দু মাত্র ঘৃণা নেই । বরং সেখানে একটা অদ্ভুদ মায়া আছে । ছেলেটার কাছে এই দৃষ্টি একেবারে অচেনা আর নতুন !
ছেলেটার মাথা ঠিক মত কাজ করছে না । এমন তো হওয়ার কথা না । এই সামনে বসা মানুষটা তো তাকে দেখতে আসার কথা না । কোন ভাবেই না। লোকটা কিছুটা সময় ছেলেটার সামনেই বসে রইলো । ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময় ! ছেলেটা তাকাতে পারছে না তার দিকে । অন্য রকম একটা অনুভুতি হচ্ছে তার ।
লোকটা হঠাৎ বলল
-তুমি ঐদিন আমাকে কেন আঘাত করেছিলে আমি জানতে চাইবো না । আমার ব্যাপরে তুমি কি ভাবো সেটাও বদলানোর চেষ্টা করবো না । কেবল একটা কথা বলতে এসেছি যে তোমার উপর আমার কোন রাগ নেই । তুমি যে ধর্মের দোহাই দিয়েই আমাকে আঘাত করেছো কেবল সেটাই নয়, পৃথিবীর কোন ধর্মই হিংসা বিদ্বেষ আর হানাহানিকে সমর্থন করে না । এমন কাজ করে নিজের এই ধর্মকে কুলষিত কর না । ঠিক আছে !
এই বলে লোকটা আবারও হাসলো । তারপর উঠে দাড়িয়ে ছেলেটার কাছে এসে দাড়ালো । মাথায় হাত দিয়ে বলল,
-আমি চেষ্টা করবো যেন তোমার কম সাজা হয় । আইন তো আমার হাতে নেই তবুও চেষ্টা করবো ! কেমন ? চেষ্টা করবো যাতে জেল থেকে বের হয়ে নতুন করে আবার জীবন শুরু করতে পারো ! নিজের ধর্মকে সঠিক ভাবে জানতে পারো !
কথা শেষ করে লোকটা আরও কিছু সময় দাড়িয়ে রইলো ওর মাথায় হাত দিয়ে । তারপর বলল
-আজ আমি যাই !
ছেলেটা একটা কথাও বলতে পারলো না । কেবল প্রবল বিশ্ময় নিয়ে লোকটার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো ।
(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১:০৯