চোখ মেলে অনেকটা সময় আমি সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে রইলাম । সিলিংটা অপরিচিত মনে হচ্ছে । এমন কি আমি যে বিছানায় শুয়ে আছি সেটাও আমার পরিচিত না । নাকি ঘুম থেকে ওঠার কারনে এমন হচ্ছে ! অথবা এমন হতে পারে যে আমি এখনও ঘুমিয়েই আছি । ঘুমে থাকলে আমার ঠিক কিছুই হুস থাকে না । অনেক টা সময় মাথাটা ঠিক মত কাজ করে না । ঘুম ভাঙ্গার পরেও সেই ঘুমের রেসটা থেকেই যায় ।
ঠিক তখনই আমার সব কিছু মনে পড়ে গেল । আমি এক ঝটকাতে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালাম ।
আমাকে গত রাতে কিডন্যাপ করা হয়েছে ! আমার শেষ স্মৃতি বলতে এটাই যে আমি হেটে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম । ঠিক সেই সময় আমার সামনে একটা মাইক্রোবাস এসে থামে । আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই দেখি পেছন থেকে কেউ আমার নাকে কিছু চেপে ধরে । তারপর আমাকে ঠেলে মাইক্রোতে ওঠানো হয় ! একটু রাত হয়েছিলো বলে রাস্তায় তেমন কেউ ছিল না । আর থাকলেও খুব একটা কাজ হত না । আমি কোন চিৎকার শুনলাম না । কেউ বলল না যে আমাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে ! চেতনা হারানোর আগে কেবল একটা কথাই মনে হল যে কি বেকুবের বেকুব এরা ! আমার মত ছা পোষা মানুষকে কেন এরা কিডন্যাপ করতেছে ।
আমার এখনও তাই মনে হচ্ছে । নিশ্চয়ই এরা ভুল করে আমাকে নিয়ে এসেছে । ওরা যাকে নিয়ে আস্তে যেয়েছিলো আমি কোন ভাবেই সেটা হতে পারি না । অবশ্য এই কথাটা আমি এমনি এমনি বলছি না ।
আমি একদম সাদামাটা একজন মানুষ । মানুষের সাথে আমি ঠিক ঠাক মত মিশিই না যে তাদের সাথে আমার কোন ঝামেলা বাঁধবে এবং আমার বাবা খুবই সাধারন একজন মানুষ । আমাকে তুলে নিয়ে গিয়ে যে টাকা চাইবে সেটারও কোন সম্ভাবনা নেই । মোট কথা আমি কিডন্যাপ হওয়ার মত কেউ না । তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে আমাকে কেন এরা তুলে নিয়ে এল ?
খুবই সহজ হিসাব ! রাতের বেলা ছিল । হয়তো অন্য কারো থাকার কথা ছিল । হয়তো সে আমার মতই দেখতে খানিকটা ! আমাকে যে ভুল করে তুলে নিয়ে এসেছে সেটা আমি শতভাগ নিশ্চিত ।
তখনই আমার মনে হল যে ওরা যখন বুঝতে পারবে যে ওরা আমাকে ভুল করে তুলে নিয়ে এসেছে তখন ? তখন কি হবে ? মেরে ফেলবে ? হতে পারে ! আমার এবার সত্যিই সত্যিই একটু ভয় করতে লাগলো ? যদি এমন কিছু হয় তাহলে কি হবে ?
আমি আর কিছু ভাবতে চাইলাম না । আমার এখন কি করা উচিৎ ? এখান থেকে পালানো উচিৎ ? আমি রুমের চারিপাশটা আরও ভাল করে দেখলাম । রুমটার চেহারাটা বেশ ভাল । যে বিছানাতে ঘুমিয়ে ছিলাম সেটাও বেশ নরম ! মনেই হচ্ছে না যে আমি বন্দী হয়ে আছি । মনে হচ্ছে আমি ছুটি কাটাতে আছি !
আমি নিচে নেমে বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করবো কি না এমন যখন ভাবছি তখনই সামনের দরজা খুলে গেল । তাকিয়ে দেখলাম একজন যুবক মত লোক রুমে ঢুকলো । তার পেছন পেছন একজন কোর্ট টাই পরা ভদ্রলোক ঢুকলো ! প্রথম জনের চেহারা বেশ গুন্ডা টাইপ হলেই পেছনের জনের চেহারা বেশ সম্ভ্রান্ত মনে হল । বস হবে হয়তো ।
যুবক লোকটা আমাকে ফোনটা ধরিয়ে দিয়ে বলল
-কথা বলেন !
আমি খানিকটা কনফিউজ হয়ে ফোনটা কানে দিলাম । জানি না কার কন্ঠস্বর শুনবো । নিশ্চয়ই অপরিচিত কোন মানুষের গলা শুনবো । কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে ফোনটা থেকে পরিচিত কন্ঠস্বর বের হয়ে এল ।
তৃষা !
-হ্যালো ! হ্যালো অপু !
তৃষার উদ্দিগ্ন কন্ঠস্বর শুনে আমি কেন জানি নিজেও খানিকটা বিচলিত হয়ে গেলাম । বললাম
-হ্যা । বলছি !
-তুমি ঠিক আছো ? ওরা তোমার কোন ক্ষতি করে নি তো ?
-না । আমি অজ্ঞান ছিলাম এতো সময় । কেবল ঘুম ভাঙ্গলো ।
মনে হল ও একটু টেনশন ফ্রি হল । আমাকে বলল
-তুমি কোন চিন্তা কর না । ঠিক আছে ? একদম ভয় পাবে না । আমি দেখছি সব ।
-কিন্তু এরা আমাকে কেন নিয়ে এসেছে ? আমি কি করেছি ?
-তুমি কিছু কর না । এসব কিছু ভাবতে হবে না । ঠিক আছে ? একদম চিন্তা করবা না ।
আমি আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলাম লোকটা আমার হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিল । তারপর কথা বলতে বলতে দেখলাম ঘরের বাইরে চলে গেল । কিন্তু সেই ভদ্রলোক তখনও রুমেই রয়েছেন । একটা চেয়ার টেনে বসলেন আমার সামনে । আমার কিছু বলা উচিৎ তবে কি বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না । ভদ্রলোক নিজেই আগে কথা বলল
-তোমাকে এখানে কেন নিয়ে আসা হয়েছে জানো কিছু ?
-বুঝতে পারছিলাম না। তবে এখন বুঝতে পারছি । আপনারা তৃষার কাছ থেকে টাকা নিবেন ।
লোকটা একটু হাসলো । তারপর বলল
-আমাকে তুমি চেন ?
-জি না । চিনি না ।
লোকটা যেন খুব মজা পেল । তারপর বলল
-আমি তৃষার বাবা!
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । তৃষার বাবার কথা আমি তৃষার মুখ থেকে অনেক শুনেছি । কিন্তু কোন দিন ওকে দেখি নি । আজকে এখানে দেখবো সেটাও ভাবতে পারি নি । আমাকে অবাক হতে দেখে তৃষার বাবা বলল
-অবাক হচ্ছো যে তোমাকে ঠিক কেন এখানে এভাবে নিয়ে এলাম ?
-অবাক হওয়া কি স্বাভাবিক না ?
ভদ্রলোক আবারও হাসলেন । তারপর বললেন
-আমার মেয়ে যে তোমাকে ভালবাসে সেটা কি তুমি জানো ?
-হ্যা । জানি ।
-আমার মনে খানিকটা কনফিউশন ছিল । তাই এই কাজটা করতে হয়েছে । আমার কাছে সে এমন একটা ভাব নিয়ে থাকে যে তোমাকে সে ঠিক মত চেনেই না । তুমি যেন ওর পেছনে পরে আছো ।
আমি কি বলব খুজে পেলাম না । ভদ্রলোক বলল
-তুমি নিশ্চয়ই জানো যে সে যা ইচ্ছে তাই করে । কারো কথা শোনে না । তাই না ?
-হুম । জানি ।
তৃষাকে আমি খুব ভাল করে জানি । সে খুবই একগুয়ে আর জেদি । একবার যা ভাববে সেটাই করবে । কেউ সেটা আটকাতে পারবে না । তৃষার বাবা বলল
-কিন্তু তাকে অনেক কিছুইতে রাজি করাতে পারো । মানে তোমার কথা সে শোনা । একবার না আমি কয়েকবার দেখেছি । আর তোমার জন্য সে যে কি করতে পারে সেটা তো দেখছেই । তার কাছে এক কোটি টাকা চাওয়া হয়েছে । এবং সে এটা দিতে রাজিও হয়ে গেছে ।
আমি কি বলব বুঝতে পারলাম না । ভদ্রলোক উঠে দাড়ালেন । তখনই দেখি একজন ট্রে হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকলো । আমার জন্য নাস্তা । আমার সামনেই রাখা হল । ভদ্রলোক যেতে যেতে বলল
-নাস্তা খেয়ে নাও । আর আজকের দিনটা এখানেই থাকো । সন্ধ্যায় তোমাকে পৌছে দেওয়া হবে । বাইরে বের হতে পারো ইচ্ছে করলে । আর দয়া করে আমাদের যে কথা হয়েছে এটা যেন তৃষা না জানে । তোমার আর আমার দুজনের জন্যই ভাল । কারন বিয়ের পর আমার মেয়েকে তুমি একা সামলাতে পারবে না । এই শ্বশুরের হেল্প তোমার লাগবেই ।
এই বলে তৃষার বাবা হাসলেন আবারও । তারপর বেরিয়ে গেলেন ।
তৃষা কেন যে এমন হয়েছে সেটা বুঝতে আমার কষ্ট হল না । এই পরিবারের মানুষ গুলোর মাথায় সমস্যা আছে । সামনে আমার জন্য কি অপেক্ষা করে আছে কে জানে ।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৫৬