গল্প এক
নিকিতার চোখ এদিক ওদিক ঘুরে বেরাচ্ছে। প্রতিনিয়ত খুজছে সেই মানুষটাকে। যদিও এই গাড়ি ঘোড়ার ভীড়ের মাঝে তাকে খুজে পাওয়া একেবারে অসম্ভব। আর সেই ছেলেটা বাইক চালাচ্ছিলো। এই জ্যামের ভিতরে বাইক নিয়ে যত সহজে এগিয়ে যাওয়া যায় গাড়ি নিয়ে যায় না। তবুও নিকিতার মনে হচ্ছে ছেলেটার সাথে আরেকবার দেখা না হলে ও হয়তো মারা যাবে। কিন্তু ছেলেটাকে সে চিনেও না। পনের মিনিট আগে ছেলেটাকে সে চিনতোও না।
কাটাবন সিগনালে নিকিতার গাড়ি দাড়িয়েছিল। ওর থেকে একটু দূরে একটা বাইক দাঁড়িয়ে। বাইরে তীব্র শীত পরেছে। ঢাকা শহরে এতো শীত এর আগে কোন সময় পরেছে কি না সেটা নিকিতার জানা নেই। অবশ্য ওর খুব একটা সমস্যার কথা না। শীতে স্বচ্ছল মানুষ গুলোর কষ্ট হয় না। কষ্টে পড়ে গরীবেরা।
নিকিতার চোখ ফুটপাথের দিকে যেতেই এমন একজনকে দেখতে পেল। বৃদ্ধ মহিলার বয়স ৬০/৬৫ হবে। এই তীব্র শীতেও কেবল একটা শাড়ি ছাড়া আর কিছুই নেই তার শরীরে। নিকিতা গাড়ির ভেতর থেকে বৃদ্ধার শীতের কাঁপুনি পরিস্কার বুঝতে পারছিলো। মনটা খারাপ হল খুব।
বৃদ্ধ মহিলা ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে সেটা বুঝতে নিকিতার কষ্ট হল না। খুব ইচ্ছে করতে মহিলাকে সাহায্য করতে। কিন্তু এখন গাড়ি থেকে নেমে সাহায্য করতেও আবার কেমন লাগছে। প্রতিবার নিকিতার এমন হয়।
নিকিতার মনটা খারাপ হয়েই রইলো। ঠিক তখনই একটা অদ্ভুদ কান্ড হল। নিকিতার সামনে যে বাইক ছিল সেটার উপর থেকে বাইকার ছেলেটা লাফ দিয়ে নামলো। দৌড়ে চলে গেল বৃদ্ধ মহিলার কাছে। ছেলেটার শরীরে একটা কালো চাদর জড়ানো ছিল সেটা বৃদ্ধ মহিলার গায়ের উপর চাপিয়ে দিল।
নিকিতা দেখলো ছেলেটার শরীরে কেবল একটা হাফ হাতা টিশার্ট রয়েছে।
তারপরেই সব কিছু নড়ে চড়ে উঠলো। সিগনাল ছেড়ে দিয়েছে। ছেলেটা যেমন দ্রুত বাইক থেকে নেমেছিল ঠিক তত দ্রুতই আবার বাইকে ফিরে এল।
নিকিতা কেবল মন্ত্র মুগ্ধের মত ঘটে যাওয়া ঘটনার দিকে তাকিয়ে রইলো। বৃদ্ধ মহিলার চোখে তখন পানি টলমল করছে। ছেলেটার প্রতি কৃতজ্ঞতায়।
নিকিতার নিজেরও চোখ সিক্ত হয়ে এল। তখনই মনে হল ছেলেটার সাথে ওর কথা বলতেই হবে। তখনই নিকিতার কেবল।মনে হল ছেলেটার সাথে যদি কথা না বলতে পারে তাহলে ও দম বন্ধ হয়ে মারা যাবে। কিন্তু তাকিয়ে দেখে ছেলেটা ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে। ড্রাইভারকে তাগা দেয় ছেলেটার পিছু নেওয়ার জন্য কিন্তু তত সময়ে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
তারপর থেকে নিকিতা কেবল মন খারাপ করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ওর বুকের ভেতরে কি যে কাজ করছে সেটা ও বলতে পারবে না। কেবল একটা কথাই মনে হচ্ছে যে ছেলেটার সাথে ওর কথা বলতেই হবে।
তারপর কেটে গেল আরও পনের মিনিট। নিকিতা যখন ধরেই নিল ছেলেটার সাথে আর কোন দিন ওর দেখা হবে না ঠিক তখনই ছেলেটাকে সে দেখতে পেল। রাস্তার পাশে একটা চায়ের দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে। ছেলেটাকে চিনতে নিকিতার বিন্দু মাত্র কষ্ট হল না। পাশে বাইকটাও পার্ক করা। এই তীব্র শীতে কেবল ছেলে টা একটা টিশার্ট পরে রয়েছে।
নিকিতা আর কোন কথা চিন্তাই করলো না। গাড়িটা থামার আগেই নেমে পড়লো। একটুও যেন দেরি সহ্য হচ্ছে না।
ছেলেটার সামনে গিয়েই বলল
-তোমার নাম কি শুনি?
ছেলেটা ওকে ঠিক লক্ষ্য করে নি। এভাবে হঠাৎ করে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করাতে চমকে উঠলো। তারপর ওর দিকে খানিকটা অদ্ভুদ চোখে তাকিয়ে বলল
-আমাকে বলছেন?
-হ্যা তোমাকে বলছি। কি নাম?
-অনিক।
-গুড। আমার নাম নিকিতা। তা এই শীতে মাত্র একটা টিশার্ট পরে কেউ বের হয়? খুব তো চাদর টা দিয়ে দিলে!
ছেলেটা এবার সামলে উঠেছে অনেকটাই। বলল
-আমার অভ্যাস আছে।
-কচু আছে।
তারপর নিজের গায়ে জড়ানো সাদা চাদরটা খুলে অনিকের দিকে এগিয়ে দিল। বলল
-এটা নাও।
-আরে না না। দরকার নেই তো।
-খুব দরকার আছে। দেখ আমার গায়ে সোয়েটার আছে আর আমি গাড়িতে যাবো। সো সমস্যা হবে না আমার। আর তুমি যদি এটা না তাহলে এই চাদর আমি এখানেই ফেলে দিব। গায়ে সোয়েটারও খুলে ফেলে দিব। আমার ঠান্ডার সমস্যা আছে। ঠান্ডা লেগে যাবে। এটার জন্য দায়ি হবা তুমি।
নিকিতা হরবর করে এতো গুলো কথা বলে গেল সেটা দেখে ওর নিজেরই অবাক লাগছে। ও যেমন একটা আচরন করতে পারে সেটা ওর নিজেরই জানা ছিল না। অনিক ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো। যেন ওর কথা শুনে খুব মজা পাচ্ছে। তবে চাদরটা হাত বাড়িয়ে নিল। তারপর সেটা গায়ে জড়ালো। বলল
-এটা ফেরৎ দিব কিভাবে?
-যখন ইচ্ছা। তোমার মোবাইল নাম্বার দাও। আর.....
অনিক বলল
-আর?
-তোমার গার্লফ্রেন্ড নেই তো। যদি থাকেও ব্রেক আপ করে ফেলো। আমি এতো সহজে তোমার পিছু ছাড়ছি না।
অনিক এবার হো হো করে হেসে উঠলো। তারপর পকেট থেকে মোবাইল বের করে বলল
-মিস নিকিতা তুমি খুব ইন্টারেস্টিং ক্যারেক্টার!
যখন নিকিতা আবার গাড়িতে ফিরে এলো তখন ওর নিজের কাছেই যে কি পরিমান আনন্দ লাগছিল সেটা ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না। কেবল মনে হচ্ছে যে হঠাৎ করেই জীবনের খুব চমৎকার কিছু সে পেয়ে গেছে।
মাহবুব ভাইয়ের (ব্লগার স্বর্ণমৃগ) স্টাটাস থেকে অনুপ্রাণিত
গল্প দুই
তারিন বিয়ের প্রথম থেকেই বুঝতে পেরেছিল যে শাহেদকে বিয়ে করা ওর জীবনের সব থেকে বড় ভুল ছিল। যে সামাজিক আর আর্থিক নিরাপত্তার কথা ভেবে তারিন অনিককে ছেড়েছিল সেটার কোন কমতি ছিল না শাহেদের। ভাল চাকরি, সাথে চাকরি। কিন্তু তারিন এটা ভুলে গিয়েছিল যে চাকরির বেতন বেশি সেই চাকরির পরিশ্রমও বেশি। দিনের বেশির ভাগ সময়েই তারিনকে একা একা থাকতে হয়। শাহেদ দিন এবং রাতের বেশির ভাগ সময়ই বাইরে বাইরে থাকে। বড় চাকরি মানেই বড় বড় মানুষের সাথে ওঠা বসা। কত কাজ।
এই সবের সাথে তারিন নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছিলো। কিন্তু মানিয়ে নিতে পারছিলো না। দম বন্ধ হয়ে আসতে চাইতো ওর।
মাঝে মাঝেই তারিনের মনে হত অনিকের সেই অল্প টাকার সংসারটা নিশ্চয় এমন হত না। হয়তো সেখানে অভাব থাকতে প্রথমে কিন্তু এমন দম বন্ধ ভাবটা থাকতো না।
কিন্তু নিয়তিতে অন্য কিছু লেখা ছিল। অনিকের সাথে তারিনের আবার দেখা হয়ে গেল। এমন ভাবে দেখা হয়ে গেল যেটা তারিন কোন দিন ভাবতেও পারে নি।
শাহেদের অফিসের পার্টি ছিল। তারিনের ইচ্ছে ছিল না আসার কিন্তু আসতেই হল। শাহেদ ওর কলিগদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো।
-তারিন, এ হচ্ছে নিশি। নতুন জয়েন করেছে আমাদের অফিসে
তারিনের দিকে তাকিয়ে নিশি হাসলো। শাহেদ তখনও কথা বলেই চলেছে।
-নিশির কয়েক দিন আগেই বিয়ে হয়েছে। জানো ওর হাজব্যান্ড ওকে নিয়ে নাকি প্রতিদিন কবিতা লেখে। সকাল বেলা উঠেই নিশির প্রথম কাজ হচ্ছে বালিশের নিচে হাত দিয়ে কবিতার কাগজ বের করা! ভাবতে পারো!
তারিন চুপচাপ শুনছিল কথা গুলো। নিশির চেহারে একটা লজ্জা মিশ্রিত হাসি দেখে তারিনের বুকটা হুহু করে উঠলো। অনিক ওর জন্য প্রতিদিন কবিতা লিখতো। ওকে জড়িয়ে কত স্বপ্ন কাব্য ছিল তার। তারিন মুগ্ধ হয়ে পড়তো।
শাহেদ বলল
-দাড়াও তোমাকে কবি সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।
তারপর নিশির দিকে তাকিয়ে বলল
-এই তোমার জামাই কই?
নিশি বলল
-ওর ভীড় ঠিক পছন্দ না। এক পাশে আছে। যাই ওর কাছে, অনেক সময় ও একা বসে আছে। যাই ভাবি।
নিশি আর দাড়ালো না। এদিকে শাহেদও ব্যস্ত হয়ে গেল। তারিন একা একা ঘুরতে লাগলো। একটু নিরিবিলি খুজতে বারান্দার দিকে হাটা দিল। বারান্দার এসে নিজের লুকানো দির্ঘ্যশ্বাসটা ছাড়লো। কদিন থেকেই ওর সব কিছুই যেন অসহ্য লাগছে।
ও ডান দিকে ঘুরতেই ওর পুরো শরীরটা কেঁপে উঠলো। বারান্দাটা বেশ লম্বা। ডান দিকের একেবারে শেষে দুজন মানুষ দারিয়ে ছিল। তারিন প্রথমে ঠিক লক্ষ্য করে নি। এতো সময় নিজের ভাবনাতে ছিল বলে ঠিক লক্ষ্য করে নি। কিন্তু ওরা কাছে আসতেই তারিন কেবল অপলক চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলো। একটা কথাও যেন বের হল না মুখ থেকে।
নিশি তারিনকে দেখে বলল
-কি ব্যাপার ভাবি! একা এখানে?
তারিন কোন মতে বলল
-না মানে এতো কোলাহল ভাল লাগছে না।
-আমার এই মশাইটির আপনার মত মানুষজন ভাল লাগে না। যাই হোক এই হচ্ছে অনিক হাসান। আমার সেই কবি মশাই। আর অনিক উনি হচ্ছে শাহেদ ভাইয়ের ওয়াইফ।
তারিন কি বলবে খুজেই পেল না। জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করলো। নিশি বলল
-ভাবি কাল রাতে এটিএন বাংলায় টিউন করবেন। ওর লেখা একটা নাটক প্রচারিত হবে। কেমন? ভুলবেন না যেন। ঠিক সাড়ে নটায়। আর এইবার বই মেলাতে ওর বই বের হবে।
এমন সময় বলল
-উনি বোধহয় একা থাকতে চাইছে। চল যাওয়া যাক।
-আচ্ছা চল। আচ্ছা ভাবি গেলাম।
তারিন ওদের চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুটা সময়। বুকের ভেতরে কি তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে এরই মধ্যে।
অনিকের চেহারা আগের থেকে কত সুন্দর হয়ে গেছে। বই বের হচ্ছে, টিভি নাটক প্রচারিত হচ্ছে। বউ ভাল চাকরি করে। জীবন টা কত চমৎকার হয়ে গেছে। আর সব চেয়ে বড় কথা অনিক ওকে ভুলে গেছে। অন্তত ওকে হারানোর কষ্টে যে নেই সেটা তারিন পরিস্কার বুঝতে পারছে। ওকে দেখে একটু চমকে গিয়েছিল ঠিকই তবে সেটা সামলে নিতে সময় লাগে নি। এমন একটা ভাব করে থাকলো যেন ওকে জীবনে প্রথম বারের মত দেখলো।
তারিন কি করবে বুঝতে পারলো। নিজেকে বড় পরাজিত মনে হল। ওর কেবলই মনে হল ঐ যদি বেশি ভাল থাকাএ জন্য অনিককে ছেড়ে না আসতো আজকে নিশির জায়গাতে সে নিজে থাকতে পারতো, সেও আনন্দে চকমক করতে করতে নিজের স্বামীর নাটক আর বইয়ের কথা মানুষকে বলতে পারতো।
বারান্দাতে দাড়িয়েই তারিন নিজের ভাগ্যের কথা ভাবতে লাগলো। যে ভালবাসা একদিন সে উপেক্ষা করে চলে গিয়েছিল আজকে সেই ভালবাসার জন্য তার বুকটা হাহাকার করতে লাগল। এরই নাম হয়তো ভাগ্য।
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৪৯