যখন বাংলামোটর পার হচ্ছি তখনই মোবাইলটা বিপ করে বেজে উঠলো। এক পাশে সাইকেলটা দাড় করিয়ে নোটিফিকেশন চেক করলাম।
"পাঠাও" এর রিকোয়েস্ট এসেছে।
কদিন হল পাঠাও এর সাথে রেজিস্ট্রেশন করেছি। বাইক না, সাইকেল সার্ভিস। যদি কারো কোন পার্সেল কিংবা কোন কাগজ পত্র জরুরী ভিত্তিতে এবং দ্রুত পাঠাতে হয় তখন পাঠাও এ রিকোয়েস্ট পাঠাতে পারে। আসে পাশে কোন রাইডার থাকলে সে চলে আসে।
আমি ডেস্টিনেশন দেখলাম। আমার বাসা থেকে একটু ভেতরের দিকে। অবশ্য খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না। আমি রিকোয়েস্ট কনফার্ম করে দিলাম। আমি ফোন দিতে যাবো, তার আগেই ফোন চলে এল।
-হ্যালো?
-আপনি কোথায় আছেন?
মেয়ে কন্ঠ শুনে কেমন যেন লাগলো। যদিও কিছু মনে হওয়ার মত কিছু না। যে কেউই রিকোয়েস্ট পাঠাতে পারে । আমি বললাম
-এইতো বাংলামোটর পার হলাম।
মেয়েটি বলল
-আমি বসুন্ধরারর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। উল্টো দিকে। আপনার পথেই পড়বে। আসুন। বটগাছটার কাছে আছি।
আজকে এমনিতে মঙ্গলবার তার উপর তীব্র শীত পড়েছে। রাস্তা ঘাট একেবারে ফাঁকা। রাতও হয়ে গেছে বেশ। এখনই সাড়ে দশটা বাজে। মোহাম্মাদপুর পৌছাতে পৌছাতে এগারো টা বেজে যাবে। একবার মনে হল রিকোয়েস্ট টা না নিলেই হত। কি দরকার ছিল! কিন্তু এখন আর এতো চিন্তা করে লাভ নেই কারন যা হবার হয়ে গেছে।
দ্রুত সাইকেল চালিয়ে হাজির হলাম। মঙ্গলবারে এই রাস্তাটা এমনিতেই একটু ফাঁকা থাকে। আর আজকে যেন কেউ নেই। বসুন্ধরার ঠিক উল্টো দিকে একটা বট গাছ আছে। খুব বেশি বড় না অবশ্য। আমি সেটার কাছে আসতেই মেয়েটাকে দেখতে পেলাম।
একটু অবাক না হয়ে পারলাম না। কারন আমি ব্লেজার জুতা মোজা কান টুপি মাফ্লার এমন কিছু নেই যে পড়ি নি। তার পরেও আমার শীত লাগতেছে আর এই মেয়ে কেবল একটা সাদা সেলোয়ার কামিজ পড়ে আছে। মেয়েটার কি শীত লাগছে না? অবশ্য মেয়েদের এমনিতেই একটু কম শীত লাগে। বিয়ে বাড়িতে গেলেই সেটা বোঝা যায়।
আমাকে থামতে দেখেই মেয়েটা এগিয়ে এল। আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি মেয়েটার চেহারাটা দেখতে পেলাম আরও ভাল করে। বেশ মিষ্টি একটা চেহারা। প্রথম দর্শনেই যে কারো ভাল লাগবে।
মেয়েটি আমার দিকে একটা ছোট বক্স এগিয়ে দিল। তারপর বলল
-এটা পার্সেল পাঠাতে হবে।
আমি বললাম
-এক্সাক্ট ঠিকানাটা বলবেন।
মেয়েটি বলল
-বসিলা ব্রিজ তো চিনবেন, তাই না?
-হ্যা।
-ওখানে গেলেই হবে। আপনার জন্য অপেক্ষা করবে। আমি ফোন দিয়ে দিচ্ছি। সে দাঁড়িয়ে থাকবে।
আর বেশি কথা হল না। মেয়েটি প্যাকেট টা আমার হাতে দিল। তাকিয়ে দেখি কাগজে মোড়া একটা প্যাকেট। হাতে নিতেই মনে হল ভেতরে থকথকে জাতিয়ে কিছু আছে। একটু নড়াচড়াও যেন করছে। আমি বললাম
-এর ভেতরে কি?
-আমার একটা পেট।
-পোষা প্রাণী?
মেয়েটি সেটার উত্তর না দিয়ে কেবল একটু হাসলো। তারপর আমার এপস দেখে আমার ভাড়া দিয়ে দিল। আমি রওনা দিয়ে দিলাম।
যখন সোবানবাগ পার হচ্ছি তখন মনে হল ভেতরের জিনিসটা বেশ ভালই নড়ছে। সাইকেলের হ্যান্ডেলের সাথে আটকানো, তারপরেও আমি নড়াচড়া টের পাচ্ছি। রাস্তা ঘাট একেবারে ফাঁকা। মাঝে সাজে একটা দুইটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি দ্রুত সাইকেল চালাতে থাকি। কিন্তু মনের ভেতরের খুঁতখুঁতে ভাবটা আমার কিছুতেই গেল না। বারবার মনে হতে লাগলো যে এইটা না নিলেই সম্ভবত ভাল হল।
মোহাম্মাদপুরের নতুন রাস্তা পার হয়ে যখন বসিলা ব্রিজটার কাছে এলাম তখন আমার কাছে কেবল মনে হল যে আমি যেন অন্য কোন জগতে চলে এসেছি।
বসিলার এই এলাকাতে আমি প্রায়ই আসি। এখানে খোলা মাঠ আর সবুজ দেখলে মনে হয় যে ঢাকার বাইরে চলে এসেছি। খানিকটা গ্রামের বাড়ির মত মনে হয়। কিন্তু রাতের বেলা এই প্রথম আসলাম। ব্রিজটা নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ব্রিজের মাথার কাছে সোডিয়াম লাইট জ্বলছে। আমি সেই লাইটের নিচে এসেই দাড়ালাম।
আমি ব্রিজটার কাছে এসে দাড়াতেই পার্সেলেত ভেতরের প্রাণীটা তীব্র ভাবে নড়তে লাগলো। আমি সাইকেল দাড় করিয়ে পার্সেলটা হাতে নিলাম। ভেতরের জিনিসটা যেন বের হয়ে আসবে। আমি কি করবো ঠিক বুঝতে পারলাম না। মনে হতে লাগলো ভেতরের প্রাণীটা যে কোন ভাবেই বাইরে আসতে চাইছে।
এদিকে যে নিতে আসবে তারও কোন দেখা নেই। মেয়েটি বলেছিল সে নাকি দাড়িয়েই থাকবে। কোথায় দাঁড়িয়ে আছে?
আমি মেয়েটির নাম্বারে ফোন দিলাম।
বন্ধ!
কেমন লাগে এখন?
এদিকে প্যাকেট টা খুব দুলছে। এতো জোড়ে যে মনে হচ্ছে এখনই ছিড়ে যাবে। ভেতরের প্রাণীটা নিশ্চয়ই ঠিক মত দম নিতে পারছে না এই জন্য লাফাচ্ছে। হাতে নিয়ে দেখলাম কোন ছিদ্রও নেই।
এখন যদি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়! তখন যদি আমার দোষ হয়?
আমি প্যাকেট টা হাতে নিলাম। তারপর আস্তে করে কাগজ টা একটু ফাঁক করলাম। দেখলাম সাথে সাথেই লাফালাফি বন্ধ হয়ে গেল।
যাক! বুঝলাম যে প্রাণীটা ঠিক মত শ্বাস নিতে পারছিলো না! এখন ঠিক আছে!
আমার কেন জানি খুব কৌতুহল হল। দেখতে ইচ্ছে হল আসলে প্যাকেটের ভেতরে কি পোষা প্রাণী রয়েছে। যত বড় সাইজ তাতে গিনিপিগ টাইপের কিছু একটা হবে।
আমি কৌতুহল থেকেই প্যাকেট টা আরেকটু ছিড়ে ফেললাম। তারপর প্যাকেটের ভেতরেই চোখ দিতেই আমার বুকেত রক্ত হিম হয়ে গেল। সোডিয়াম আলোতে স্পষ্ট দেখতে পেলাম একটা মাংস পিণ্ড। এবং সেটা কোন পোষা প্রাণীর নয়, সেটা কোন মানুষের ভ্রুনের। কেউ বাচ্চা নষ্ট করেছে, সেটা ভরে দিয়েছে এখানে।
নিশ্চয়ই ঐ মেয়েটা! নিজের কুকাম ঢাকতে গিয়ে বাচ্চাটাকে এই পৃথিবীতে আসতে দেয় নি। নিজে কোথায় ফেলবে ভেবেছিল তাই আমাকে দিয়েছে ফেলতে।
মেজাজটা খুব খারাপ হল। খুব রাগ হল মেয়েটার উপর।
কিন্তু তার পরেই একটা জিনিস আমার মাথার ভেতরে ধাক্কা দিল।
এতো সময় ধরে যে নড়াচড়া করছিল ওটা কি?
প্যাকেটের ভেতরে যদি এই বাচ্চাটা থেকে থাকে তাহলে নড়ছিল কি?
একটা তীব্র ভয়ের স্রোত আমার পুরো শরীরের উপর দিয়ে বয়ে গেল। আমার হাত থেকে আপনা আপনিই পড়ে গেল প্যাকেট টা। আর সেই সাথে সাথেই আমার মনে হল আমি যেন একটা বাচ্চার তীব্র কান্নার আওয়াজ পেলাম। ক্রমেই যেন কান্নার আওয়াজটা বাড়ছেই। আর আওয়াজটা যে ঐ প্যাকেটের ভেতর থেকেই আসছে সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হল না।
আমি ঘুরে দৌড় দিলাম সাইকেলের কাছে। গায়ের যত শক্তি আছে তত শক্তি দিয়ে প্যাডেল চাপতে লাগলাম। বারবার মনে হতে লাগলো আমার পেছন পেছন সেই বাচ্চার কান্নার আওয়াজটা আসছেই। আমি একটা বারের জন্যও পেছন ফিরে তাকালাম না। তাকাতে সাহস হল না। মনে হচ্ছিলো পেছনে তাকালেই আমি দেখবো ছোট ছোট পায়ে একটা মাংস পিণ্ড আমার পেছন পেছন আমাকে তাড়া করে আসছে।
যখন বাসার সামনে এসে থামলাম তখন আমার পুরো শরীর ঘামে ভিজে গেছে। তীব্র ভয়ে আমার চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে। আমার শরীরে আর একটুও বল নেই। আমি বাড়ির সামনেই রাস্তায় বসে পড়লাম। বাসায় ওঠার আগে খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে নেই।
এতো সময় কি হল আমার সাথে! নাহ এর পর থেকে রাত বিরাতে আর রিকোয়েস্ট গ্রহন করা যাবে না । কোন মেয়ের কাছ থেকে তো নয়ই !
(সমাপ্ত)
গল্পটা যখন লিখছিলাম তখন কি মনে হল সেটার স্ক্রিন ভিডিও রেকর্ড করে রাখলাম । সেটার ভিডিও নিচে দেওয়া হল ।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই জানুয়ারি, ২০১৮ রাত ১০:৫১