বাবা আমার দিকে শান্ত কন্ঠে বললেন
-ঐ মেয়েকে পড়ানোর দরকার নেই । আর তোর এমন অর্থ কষ্টও নেই আমি যতদুর জানি । হাত খরচের টাকা তো ঠিকই পাস !
কথা সত্য । বাসা থেকে যথেষ্ঠ পরিমান টাকা আমাকে দেওয়া হয় । তবুও এতো বড় হয়েছি, কিছু না করে একেবারে হাত পেতে টাকা নিতে কেমন জানি বাঁধে নিজের কাছেই । তাই একটা দুটো টিউশনী করাই ।
বাবা আর কোন কথা না বলে তিনি ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন । সকাল বেলা নাস্তা করছিলাম । বাবা আগে আগে খেয়েই অফিসের দিকে রওনা দিলেন । মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কোন মেয়েটা রে ?
-আরে ঐ যে গলির একদম শেষ মাথায় যাদের বাসা ! তোমাকে বলেছিলাম মনে নেই ?
-তা তোর বাবা হঠাৎ ওকে চিনলো কিভাবে ? আর জানলোই বা কিভাবে যে তুই ঐ মেয়েকে পড়াতে যাস ?
-আমিও ঠিক বুঝতে পারছি না । মনে হয় এলাকার কারো কাছ থেকে শুনেছে ।
প্রতিদিন সকালে বাবা এলাকার আরও কয়েকজনের সাথে মর্নিংওয়াকে যান । খুব বেশি দিন হয় নি এই এলাকাতে এসেছি আমরা । এরই ভেতরে ঠিকই সঙ্গী খুজে পেয়েছেন । তাদেরই কেউ হয়তো বলেছে বাবাকে নাদিবার সম্পর্কে । আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে বললাম
-কেউ হয়তো বলেছে ।
-তোর কি মনে হয় ?
-আমার তো এমন কিছু মনে হয় নি নাদিবাকে দেখে । তবে .....
মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তবে ?
-তবে ওর সম্পর্কে আসলেই এলাকাতে বেশ কিছু কথা বার্তা রটে আছে । তার মধ্যে একটা যে ওর কোন টিচারই নাকি বেশি দিন টেকে না । সবার সাথেই নাকি ও কিছু একটা করে ফেলে ।
মা যেন কথা শুনে বেশ মজা পাচ্ছে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-তারপর ?
-তারপর আর কি ! ওর বাবা আবার নতুন কাউকে খুজে আনে ।
-কোন লেডি টিচার আনে না কেন ?
-আনে না । আরও ভাল করে বললে বলতে হয় আনতে পারে না । আদিবা কিছুতেই কোন মেয়ে টিচারের কাছে নাকি পড়তে চায় না ।
-তা তুই এই টিউশনীর খোজ কিভাবে পেলি ?
-আসলে ওর এক মামাতো ভাই আমার ক্লাসমেট । আমি জানতাম না ওরা যে এখানে আমাদের এলাকাতেই থাকে ।
আসলেই আমি আগে থেকে জানতাম না যে আমার নতুন টিউশনীটা সে এলাকাতে শুরু হবে আমরাও ঠিক সেই এলাকাতে গিয়েই উঠবো । যেদিন আমরা বাসা চেঞ্জ করে এখানে এলাম ঠিক সেদিন থেকেই ওকে পড়ানো শুরু করেছিলাম । ওর বাবাও শুনে একটু অবাক হয়েছিলো । পরে অবশ্য খুশি হয়েছেন । প্রয়োজনে হাতের কাছেই একজন স্যার পাওয়া গেছে এই দেখে ।
মা মুচকি হেসে বলল
-তা মেয়েটা দেখতে কেমন ?
-ভাল ।
-শুধু ভাল নাকি তার থেকেও বেশি ?
আমি পরোটার শেষ টুকরো টুকু মুখে দিতে দিতে বললাম
-ভালর থেকে অনেক ভাল ।
মা বলল
-সুন্দর মেয়েদের কে নিয়ে এলাকাতে এমন অনেক কথাই চলতে থাকে । তা একদিন নিয়ে আসিস তো এবাড়িতে !
আমি মায়ের দিকে তাকিয়ে এমন একটা হাসি দিলাম যে এমন হাস্যকর কথা আমি আর কোনদিন শুনি নি । ব্যাগ কাধে নিয়েই বসেছিলাম । আর বসলাম না ।
গেট দিয়ে বাইরে আসতেই আদিবাকে দেখতে পেলাম । আমাদের বাসা থেকে ওদের বাসাটা ঠিক দেখা না গেলেও ওদের বাড়ির সামনের রাস্তাটা দেখা যায় । সেখানেই দাড়িয়ে আছে কলেজ ড্রেস পরে । এর আগে আমি দুই দিন ওকে কলেজ ড্রেসে দেখেছি । সন্ধ্যা বেলাতে যখন ওদের বাসাতে পড়াতে যাই তখন ওকে একটু বড় বড় লাগে কিন্তু কলেজ ড্রেসে একদম পিচ্চি পিচ্চি মনে হয় । আমি বের হতেই দেখলাম ও আমার দিকে এগিয়ে এল । আমার কেবল মনে হল ও আমার জন্যই দাড়িয়ে ছিল । আমার সামনে এসে বলল
-আম্মু বলেছে আমাকে কলেজে দিয়ে আসতে !
-কি !
-হ্যা । আজকে আব্বু বাসায় নেই । আম্মুর শরীরও ভাল নেই ।
-আমার তো তা মনে হচ্ছে না । তোমার কলেজ তো আরও তিন ঘন্টা পরে শুরু হওয়ার কথা । এখন থেকে তোমার কলেজে যেতে লাগে মাত্র ১৫ মিনিট ! এতো আগে আগে কেন বের হয়েছো ?
-আপনি খুব বেশি প্রশ্ন করে । সব জায়গায় টিচারী ফলাবেন না তো ।
আদিবা এমন আদুরে সুরে বলল কথা গুলো আমি খানিকটা বিষম খেয়ে গেলাম । এই মেয়ের সমস্যা কি ! আব্বা যে আমাকে টিউশনীটা ছাড়তে বলেছে এমনি এমনি বলে নি । এতোদিন তো সব ঠিকই ছিল । তাহলে আজকে মেয়েটার কি হল ।
আমি বললাম
-আমি তোমাকে নিয়ে যেতে পারবো না । বুঝেছো ? এখন বাসায় যাও । যখন ক্লাস শুরু হবে তখন বের হবে !
আদিবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন না ?
-না । আমার কাজ আছে ।
-আপনি আমাকে নিয়ে যাবেন না ?
-না !
-আপনি সত্যিই নিয়ে যাবেন না ?
আমি বললাম
-না !
আমি আদিবার চোখে একটা সুক্ষ বিশ্ময় দেখতে পেলাম । আদিবার সাথে রিক্সাতে করে যাওয়াটা যে কোন ছেলের জন্যই বেশ আকর্ষনীয় ব্যাপার । যে কেউ সে সুযোগটা ছাড়তে চাইবে না । সেখানে আমি যেতে চাইছি না । আর সম্ভবত আদিবার অতীতে কারো কাছ থেকে এমন উত্তর পায় নি । তাই অবাক হচ্ছে ।
আমি ওর দিকে আর না তাকিয়ে সোজা হাটা দিলাম । একবারও পেছনে না তাকিয়েই বুঝতে কষ্ট হল না যে আদিবা আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে । যাই হোক ওর দিকে আমি খুব একটা মনযোগ দিলাম না । এই বয়সের মেয়েদের মনে সব দুষ্টামি বুদ্ধি কাজ করে । আমি সেই বুদ্ধিতে ধরা পড়তে চাই না ।
নাদিবাও বুঝে গেল যে এভাবে আমার সাথে পেড়ে উঠবে না । তখনই সে অন্য পথ অবলম্বন করলো । একদিন ক্যাম্পাস থেকে বাসায় এসে দেখি নাদিবা মায়ের রান্না ঘরে কাজ করছে । ঠিক কাজ না, মা রান্না করছে আর নাদিবা মাকে সাহায্য করছে । আমাকে দেখে কেমন করে যেন হাসলো । ঠিক বুঝতে পারলাম না যে এই মেয়ে এখানে কি করে ?
আমি চলে আসার পর নাদিবা আর বেশিক্ষণ থাকলো না । এরকম বেশ কয়েকদিন চলতে থাকলো । শেষে আমি একদিন মাকে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম । বললাম
-নাদিবা প্রতিদিন এ বাড়িতে কি করতে আসে ?
মা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-কি করতে আসে আর ! দেখিস না আমাকে সাহায্য করতে আসে । আমি সারাদিন একা একা কাজ করি !
আমি বললাম
-ওর মাও তো বাসায় একাই থাকে । ওর মাকে তো সাহায্য করে না ।
-তোকে কে বলছে করে না । লক্ষি একটা মেয়ে !
-মা তুমি ওকে চিনো না ! ওর মত বদ মেয়ে এই পাড়াতে আর একটা নাই ।
-চুপ থাক । বেশি বুঝবি না । আমি ওকে ঠিকই চিনেছি । মেয়েটা কত্তভাল ।
বুঝলাম আদিবা মাকে পটিয়ে ফেলেছে । সামনে আরও কি করে কে জানে !
কিন্তু আসল ঝামেলা শুরু হল অন্য খানে । কদিন পরেই জানতে পারলাম যে পাড়ার এক চ্যাংরা মত ছেলে নাকি নাদিবাকে পছন্দ করে । তার বাবা নাকি আবার এই হাউজিং সোসাইটির চেয়ারম্যান । আমাকে ওদের বাসায় নিয়মিত যেতে এবং নাদিবাকেও আমাদের বাসায় ঘনঘন যেতে দেখে তাদের নাকি মাথা গরম । এটা নাকি এই এলাকার পরিবেশ নষ্ট করছে ! তাই তাদের কথা ঠিক হল যে আমাদের আর এই এলাকাতে থাকা চলবে না । এলাকা ছেড়ে দিতে হবে ।
এই খবর শুনে আবার বাবার মেজাজ তো খুব খারাপ হল । আমাকে তো আচ্ছা করে বকলেন সেই সাথে মাকেও বকলো । বকার কারনও অবশ্য আছে । এই এলাকা থেকে বাবার অফিসটা একেবারেই কাছে । আর বাসা ভাড়াও কম । এতো চমৎকার একটা বাসা ছেড়ে বাবা তাই যেতে চাচ্ছে না । তা ছাড়া বাসা বদল করা মানে হচ্ছে হাজার রকম ঝামেলা । কিন্তু কি আর করা ! আমরা এখানে স্থানীয় না । আমাদের কিছু বলারও নেই ।
কিন্তু আসল ঘটনা ঘটলো তার পরে । শুক্রবারের ঘটনা । আমি একটু বাইরে গিয়েছিলাম । সেখানে থেকে ফিরে দেখি আমাদের বাসায় নাদিবা বসে বসে টিভি দেখছে । আমাকে দেখে একটু মিচকি হাসলো । প্রতিবারই হাসে তাই আমি গা করলাম না । কিন্তু রান্না ঘর থেকে যখন নাদিবার মায়ের গলার আওয়াজ পেলাম তখন আমার কেন জানি মনে হল কিছু একটা ঠিক নেই । কোন একটা সমস্যা হয়েছে ।
তারপর একটু পরে যখন বাবা আর নাদিবার বাবাকে এক সাথে বাসায় ফিরতে দেখলাম তখন সত্যিই মনে হল যে সিরিয়াস কোন সমস্যা হয়েছে । যদিও তাদের মুখ দেখে তেমন কিছুই মনে হচ্ছিলো না । আমি কাউকে জিজ্ঞসেও করতে পারছিলাম না । বুঝতে পারছিলাম যে আমাদের বাসাতে নাদিবের দাওয়াত রয়েছে । কিন্তু তবুও আমাকে সন্দেহ গেল না । খাবার টেবিলে মা বোমা ফাঁটালো ।
আসল ঘটনা হচ্ছে, নাদিবা নাকি খুব কান্নাকারি করেছে আমরা চলে যাচ্ছি বলে । বিশেষ করে কারনটা যখন সে নিজে । নাওয়া খাওয়া বাদ দিয়ে দিয়েছে । তারপর সে তার মা বাবাকে রাজি করিয়ে ফেলেছে আমার ব্যাপারে । আর তার বাবা মা এসে ধরেছে আমার বাবা মা কে । মা তো আগে থেকেই রাজি ছিল বাবাকেও রাজি করাতে তাদের বেগ পেতে হয় নি ।
ঠিক হয়েছে আমরা এভাবেই পড়াশুনা করবো । এখানে কেবল পারিবারিক ভাবে বিয়ে হবে । আমি কিছু করার পরে বড় করে অনুষ্ঠান হবে ! আমি এসব শুনে আকাশ থেকে পড়লাম । আমি এই পরিকল্পনার প্রধান অংশ অথচ আমাকে এরা জানানো কিংবা আমার মতামত জানার প্রয়োজনই মনে করলো না । আমি বললাম
-মানে এসবের ?
বাবা বলল
-মানে কি আবার ? তুই তো এটাই চাচ্ছিলি । দেখ আদিবা আমাদের সবই বলেছে । আর আমরা আপত্তিও করছি না ।
-আদিবা কি বলেছে !
-ন্যাকামি করবি না । শোনা সামনের সপ্তাহেই সব কিছু ফাইনাল করে ফেলবো । বুঝেছিস !
আমি কি করবো ঠিক বুঝতেই পারলাম না । অবশ্য বাবা একবার কিছু করবে ঠিক করলে সেটা না করে ছাড়বে না । আমি নিজের ঘরে চলে এলাম । তখনও ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না । কিছু সময় পরে দেখি আদিবা আমার ঘরে এসে হাজির । হাতে মিষ্টির বাটি । আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল
-নিন ! বিয়ের মিষ্টি খান ।
আমি বললাম
-তোমার খুব মজা লাগছে তাই না ?
-বারে আমার বিয়ে হচ্ছে, মজা লাগবে না !
বলেই ফিক করে হেসে ফেলল । তারপর বলল
-সেদিন যদি আপনি আমার সাথে রিক্সায় উঠতেন তাহলে আজকে হয়তো এই দিন আপনাকে দেখতে হত না । আমাকে ইগ্নোর করে চলে যাবেন আর আমি আপনাকে ছেড়ে দিব এভাবে ! সারা জীবন আমাকে সহ্য করতে হবে এখন থেকে ।
আমি আদিবার দিকে তাকিয়ে রইলাম । এই পিচ্চি মেয়ে বলে কি ! আদিবা বলল
-আর কেবল মাত্র বিয়েটা হতে দিন । দেখবেন আপনার জীবন আমি একেবারে ত্যাজ পাতা বানিয়ে ছাড়বো ! হিহিহি !
তারপর মিষ্টিটা টেবিলের উপর রেখে আদিবা হাটা দিল । আমি কেবল বোকার মত চেয়ে রইলম । সামনের দিনে আমার জন্য কি ঝামেলা অপেক্ষা করছে সেটা বুঝতে আমার কষ্ট হল না ।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:১৭