নিকিতা অনেক দিন পর ক্যাম্পাসে আসলো । অনেক দিন পরে মুক্ত বাতাসে যেন নিঃশ্বাস নিতে পারছে । দো-তলার সেমিনার লাইব্রেরির সামনে দাড়িয়ে রইলো কিছুটা সময় । আজকে যেন সব কিছু ভাল লাগছে । সেই শেষ কবে এখানে এসেছিল । তারপর থেকেই ঘরে বন্দী । বাবা তাকে কিছুতেই বাইরে বের হতে দিবে না । ঘরের ভেতরেই আটকে রাখবে । অবশ্য বাবাকে দোষ দিয়ে লাভও নেই । তিনি কেবল তার মেয়েকে রক্ষা করতে চাচ্ছেন । প্রথম যেদিন সে খবরটা শুনেছিলো নিজের কাছেই ভয় লাগছিলো ।
এই দেশে আকসার আহমেদের নাম শোনেনি এমন কেউ নেই । দেশের নাম করা সফল ব্যবসায়ী । প্রচুর টাকার মালিক । দেশের ব্যবসা অঙ্গন থেকে শুরু করে রাজনীতি সব জায়গাতে তার দাপট সমান । ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিবিদ সবাই তাকে সমীয় করে চলে । নিকিতার বাবাও নাম করা ব্যবসায়ী কিন্তু সেটা আকসার আহমেদের কাছে সেটা কিছুই না ।
কিন্তু এই ক্ষমতাবান লোকটা যখন নিকিতাকে বিয়ের প্রস্তাব পাঠালো তখন নিকিতার বাবা সাহাবুদ্দিন আহমেদ অবাক না হয়ে পারলো না । লোকটার বয়স নিকিতার প্রায় দ্বিগুণ তাছাড়া তার ব্যবসার সব কিছু সঠিক পথে আসে না । তাই নিকিতার বাবা সোজা মানা করে দিল । প্রথমে ব্যবহার ভাল করে নানান প্রস্তাব দিয়ে নিকিতার বাবাকে রাজি করাতে চেষ্টা করলো । কিন্তু যখন কোন ভাবেই রাজি করানো গেল না তখন আকসার আহমেদ নিকিতার বাবাকে হুমকি দিতে লাগলো । সেই সাথে এও বলতে লাগলো যে নিকিতাকে তার চাই ই চাই । প্রয়োজনে সে তাকে তুলে নিয়ে যাবে ।
সাহাবুদ্দিন তখন থেকেই ভয়ে ভয়ে আছেন । তিনি জানেন আকসার আহমেদের ক্ষমতা কতটুকু । সে যা বলেছে সেটা সে করতে পারবে । তার মেয়েকে সে তুলে নিয়ে যেতে পারবেন । তাই তিনি নিকিতার ঘর থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিলেন । এই কদিন নিকিতারও বেশ ভয় ভয় করছিলো । বারবার মনে হচ্ছিলো এই বুঝি তাকে কেউ তুলে নিয়ে যাবে ।
তবে দিন যাওয়ার সাথে সাথে সেই ভয়টা অনেক কমে এসেছে । আজকে সকালে একটা পরীক্ষা আছে । সেটা মিস করতে চাইলো না । তাই চলে এল । অবশ্য তার বাবা অনেক প্রস্তুতি নিয়েই তাকে পাঠিয়েছে । তার জন্য নতুন বডিগার্ড ঠিক করা হয়েছে সেই ড্রাইভারের পাশেই বসে ছিল আসার সময় । তার কাছে আবার লাইসেন্স করা পিস্তল আছে । ক্যাম্পাসের ভেতরে পিস্তল নিয়ে ঢোকার নিয়ম নেই । সে বাইরে বাড়িতে বসে আছে । অবশ্য তাদের ক্যাম্পাসটা নিরাপদ । এখান থেকে তাকে কেউ নিয়ে যেতে পারবে না !
তবে নিকিতার ভাবনাতে একটু ভুল ছিল । দোতলার সেমিনামর লাইব্রেরির সামনের বারান্দাতে দাড়িয়ে থাকার সময়ই ওর মনে হল কিছু যেন একটা ঠিক নেই । একটা তীব্র চিৎকার শুনে ওর চোখটা চলে গেল বারান্দার ডান দিকে । সেদিকে তাকিয়ে ওর চোখ বড় বড় ফেলল । একটা টাই পরা লোক ওর দিকে একটা পিস্তল তাক করে আছে । তার চোখ মুখ দেখেই মনে হচ্ছে এখনই লোকটা তাকে গুলি করে দিবে । সেই পিস্তল দেখেই একটা মেয়ে চিৎকার দিয়েছে ।
নিকিতা কেবল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো । কিছুই যেন বুঝতে পারছে না । ওর ঠিক বিশ্বাসও হচ্ছে না যে আকসার আহমেদ বিয়েতে রাজি না হওয়ার কারনে তাকে মেরে ফেলতে লোক পাঠাবে । নিকিতার নিজের মায়ের চেহারাটা মনে হল । শেষ বারের মত ইচ্ছে হল মাকে আরেকবার দেখতে পায় !
নিকিতা খুনির দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ওর চোখটা খুনির পেছন দিকে গেল । কয়েকজন ছাত্র ছাত্রীর ভেতরে হঠাৎ করেই একজনকে ওর চোখে পড়ে গেল । যেখানে অন্য সবাই খুনির কাছ থেকে পালাচ্ছে সেখানে একজন খুনির দিকে এগিয়ে আসছে ।
সাদিক !
মেজর সাদিক
ওর বডিগার্ড । গত সপ্তাহে তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে । আজকেই ওকে নিয়ে সে প্রথম বের হল ।
আর সময় নেই । খুনি এবার সত্যি সত্যি গুলো করে দিবে ।
কয়েক সেকেন্ড পার হয়েও গেল । নিকিতার মনে হল এবার ওর দিন তাহলে শেষ । তার বডিগার্ডও তাকে বাঁচাতে পারবে না । পিস্তলের গুলির থেকে গতি তো আর কারো বেশি নেই ।
একটা গুলির আওয়াজ হল । নিকিতা চোখ বন্ধ করে ফেলল ।
কয়েকটা মুহুর্ত কেটে গেল । কিন্তু নিকিতা অনুভব করলো তার শরীরে কোন রকম ব্যাথা অনুভব হচ্ছে না ।
তাহলে কি তার গায়ে গুলি লাগে নি ?
চোখ খুলে দেখলো সাদিক ততক্ষনে সেই খুনির কাছে চলে এসেছে । তার হাতে একটা পিস্তল দেখা যাচ্ছে । সেটা দিয়েই গুলি চালিয়েছে সে । আর খুনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে । সাদিক কাছে এসে খুনি তলপেট বরাবর খুব জোরে একটা লাথি মারলো । সেই সাথে সাথেই খুনির হাতে ধরে পিস্তলটা হাত থেকে ছিটকে গেল । সাদিক আর সেদিকে সময় নষ্ট করলো না ।
আবার সেটা তাক করলো নিকিতার বরাবর । কোন কথা না বলে চেপে দিলো ট্রিগার !
নিকিতা আবার চোখ বন্ধ করলো । কেবল অনুভব করলো ওর কানের পাস দিয়ে কিছু একটা চলে গেল । পর মুহুর্তে পেছনে থেকে কারো আর্তনাদের আওয়াজ এল ! চোখ খুলতেই দেখলো সাদিক একেবারে কাছে চলে এসেছে ।
নিকিতা কেবল বলল
-এরা কারা ?
-আমি কিভাবে বলব ?
নিকিতার প্রথম থেকেই তার এই বডিগার্ডকে পছন্দ হয় নি । এক্স আর্মি ছিল নাকি ছেলেটা । মেজর পর্যন্ত রাঙ্ক উঠেছিলো । কিন্তু তারপর কি একটা কারনে আর্মি থেকে অবসর নিয়ে নিয়েছে । এখন একটা প্রাইভেট সেফটি এজেন্সিতে কাজ করে । সেখান থেকেই এই বডিগার্ডকে ঠিক করা হয়েছে । এই লোকটার আচরন নাকি মোটেই ভাল নয় । খুব বেশি বদ মেজাজী । তবে নিজের কাজে বেশ দক্ষ বলেই এখনও টিকে আছে !
সাদিক নিকিতার হাত ধরলো । তারপর বলল
-লাফ দিতে পারবে ?
-কি বলছেন ?
সাদিক কেবল দুদিকে ইংগিত করলো । নিকিতা তাকিয়ে দেখে ওরা ঠিক যেখানে দাড়িয়ে আছে তার দুদিন থেকে আরও চারজন মানুষ হাতে উদ্ধত পিস্তল নিয়ে এগিয়ে আসছে । নিকিতা কেবল বলল
-আমি লাফ দিতে পারবো না ।
সাদিক অবশ্য এই দিকে খুব একটা মনযোগ দিল না । নিকিতার কোমর চেপে ধরলো । তারপর ওকে এক প্রকার জোর করে চেপে ধরেই বারান্দার রেলিং চেপে ধরে নিচে ঝাপিয়ে পড়লো । নিকিতার মনে হল ও বুঝি এখনই মারা যাবে । তবে অবাক হয়ে দেখলো কিছুই হয় নি । বরং খুব স্বাভাবিক ভাবেই ওরা মাটিতে এসে পড়লো । নিকিতা তাকিয়ে দেখলো দুই তলা থেকে লাফ দেওয়ার সময় সাদিক ইন্টানেটের একটা তার চেপে ধরেছিলো । এই জন্য পতনটা আরও সহজ হল ।
নিচে পড়তেই ওরা ছাদের আড়ালে চলে এল । তাই উপরে যারা দৌড়ে আসছিলো ওরা ওদেরকে গুলি করতে পারলো না ।
সাদিক নিকিতাকে নিয়ে পেছনের দরজার দিকে দৌড়াতে লাগলো । নিকিতা বলল
-এদিকে কোথায় যাচ্ছেন ? আমাদের গাড়িতো সামনের দিকে ।
-ওদিক গিয়ে লাভ নেই । ওরা ওদিকে থাকবে ।
নিকিতা সাদিকের সাথে সাথে দৌড়াতে লাগলো । তবে সাদিক ওর হাত ধরে রেখেছে । নয়তো এতো দৌড়ানো ওর পক্ষে সম্ভব ছিল না । দৌড়াতে দৌড়াতেই নিকিতা একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখলো যে সাদিক তাদের ক্যাম্পাসটা খুব ভাল করে চেনে । কোন দিক দিয়ে যাওয়া লাগবে সেটা ওকে বলে দেওয়া লাগছে না ।
আরও মিনিট তিনেক দৌড়ানোর পরেই ওরা ক্যাম্পাসের পেছনের রাস্তায় এসে হাজির হল । সেখানে বড় জারুল গাছের কাছে যেতেই দেখতে পেল একটা কালো রংয়ের বাইক দাড় করানো রয়েছে । নিকিতাকে নিয়ে সেটাতেই উঠে বসলো । বাইকের চাবিটা সেখানেই ছিল । নিকিতা অবাক না হয়ে পারলো না । বলল
-এটা কার বাইক ? এখানে কিভাবে এল ?
সাদিক বলল
-জানি না !
-জানি না মানে কি ? এভাবে অন্যের বাইক নিয়ে পালানো ঠিক হচ্ছে নাকি ?
-চারজন লোক আমাদের কে মারার জন্য দৌড়ে আসছে । এই সময়ে কোন ঠিক বেঠিক নেই । আর এই বাইকটা আমাদের জন্য রাখা ।
-কে রেখেছে ?
-জানি না । তবে আমরা সেখানেই যাচ্ছি !
-কোথায় ?
-পুরান ঢাকায় । এতো কথা বল না তো । চুপচাপ আমাকে ধরে বস । আমিও কিছু বুঝতে পারছি না । তবে আগে তোমাকে নিরাপদ জায়গাতে নিয়ে যাই । তারপর সব কিছু বোঝা যাবে । আর কে আমাকে ফোন করলো, এই বাইক কে রাখলো আমাদের জন্য এটাও জানা যাবে ।
নিকিতা আর কথা বলল না । কেবল শক্ত করে সাদিকের কোমর চেপে ধরলো । সাদিক বাইক ছেড়ে দিলো । তার গন্তব্য এখন পুরান ঢাকার সেই মানুষটার কাছে । লোকটাকে সে চেনে না কিন্তু লোকটা তাকে যা যা বলেছে ঠিক সেই সেই জিনিস হয়েছে । সে যদি লোকটার কথা না শুনতো তাহলে এতোক্ষনে নিকিতা মরে ভুত হয়ে যেত ।
এভাবে হুট করেও যে কারো কথা শুনা মোটেই ঠিক হচ্ছে না কিন্তু এখন এর থেকে ভাল কিছু মাথায় আসছে না । ঢাকার বুকে এমন প্রকাশ্যে গুলাগুলির ব্যাপার সহজে মেনে নেওয়া যায় না । সাদিক যদি লোকটা কথা মত না চলতো, তাহলে সত্যি নিকিতাকে রক্ষা করা সম্ভব হত না । সাদিকের কেন যেন মনে হচ্ছে এই সময় আগে তার কাছে যাওয়া দরকার । অন্তত লোকটা অনেক কিছু জানে । কিভাবে জানে সেটা জানা দরকার আগে !
দুই
পুরান ঢাকার একটা গলির মাঝে যখন বাইকটা থচলতে লাগলো আস্তে আস্তে নিকিতা তখন চারি দিকে তাকাতে লাগলো । এতোটা সময় সে নিজের মধ্যেই ছিল । একটু আগে ও লক্ষ্য করে কেউ গুলি করেছে এটা ঠিক ও বিশ্বাস করতে পারছিলো না যে ওকে আসলেই কেউ খুন করার জন্য গুলি ছুড়তে পারে । জীবনে যে একটা মশাও ঠিক মত মেরেছে কি না বলতে পারবে না । আর ওকে মারা জন্য মানুষজন গুলি ছুড়ছে ।
নিকিতা নিজেও জানে ওর চেহারার ভেতরে অন্য রকম একটা আভা আছে । দেখলেই সহজে চোখ ফেরানো যায় না । কেমন একটা সবার চোখ আটকে যায় । প্রথম প্রথম ব্যাপারটা ও বেশ উপভোগ করলেও একটা সময় এটাতে কেবল বিরক্তই হত । বারবার মনে হত অন্য সবার মত হলেই সম্ভবত ভাল হত । একটু শান্তির জীবন পার করতে পারতো । তবে বাবা টাকা পয়সার কারনে সেটা অনেকটা সামলানো গেছে । গাড়ি ছাড়া কোথা যাওয়া আসা করতো না । মানুষজন ওকে দেখার খুব একটা সুযোগ পেত না । কিন্তু ক্যাম্পাস কিংবা অন্য কোন পাব্লিক মিটিং প্লেস গুলোতে এসব এড়ানো সম্ভব হত না । কত ছেলে যে ও পেছনে গেলে সেটা বলতে পারবে না । কিন্তু তাই বলে শহরের এরকম একজন মাঝ বয়সী লোকও যে ওর প্রেমে পড়বে সেটা বুঝতেই পারে নি । ভদ্রলোকের তো বউ থাকার কথা । সে কি কিছু বলছে না ? তার কোন আপত্তি নেই ?
নিকিতা খুজে পেল না । তবে এসব এখন ভাবার সময় নেই । তার এখন যত দ্রুত সম্ভব এই দেশ থেকে বের হয়ে যেতে হবে । বাইকে চলতে থাকা অবস্থাতেই নিকিতার আব্বুর সাথে কথা হয়েছিলো । ওর আব্বু খুব বেশি চিন্তিত ছিল । ও ঠিক আছে জেনে একটু দুঃচিন্তা মুক্ত হয়েছে ।
বাইকটা মানুষজনের ভীড় এদিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে চলছে । মাঝে মাঝে এর ওর কাছে পথ জেনে নিচ্ছে সাদিক । নিকিতা হঠাৎ প্রশ্ন করলো
-আচ্ছা একটা কথা জানতে চাই ?
-বল
একটু মেজাজ খারাপ হলেও নিকিতা কিছু বলল না । এই অবসর প্রাপ্ত মেজর সাহেব সেই শুরু থেকে ওকে তুমি করে বলে আসছে । ছেলেটাক দেখতে বেশ ইয়াংই মনে হয় । বয়স ঠিক বোঝা যায় না । তার মুখ থেকে এমন তুমি ডাক শুনতে ভাল লাগে না । তবে এই মানুষটা না থাকলে আজকে তার কি অবস্থা হত সেটা সে খুব ভাল করেই জানে । তাই বিরক্তিটা হজম করে ফেলল । বলল
-আচ্ছা আপনি কিভাবে জানলেন যে আমার উপর কেউ গুলি করতে যাচ্ছে ? মানে লোকটা যখন আমাকে গুলো করতে যাচ্ছিলো ঠিক সেই সময়েই আপনি এসে হাজির হলেন ! কিভাবে ?
-সেই প্রশ্নের জবাব পেতেই এখানে এসেছি ।
-মানে ?
-বললে বিশ্বাস করবে ?
-সকাল থেকে যা হচ্ছে বিশ্বাস না হওয়ার মত কিছু নেই ।
-আমি বসেই ছিলাম গাড়ির ভেতরে । তখনই আমার ফোনে একটা ফোন আসে । অপরিচিত নাম্বার । সেখান থেকেই আমাকে বলা হয় যে তোমার হামলা হতে যাচ্ছে । তুমি হয়তো দেখে থাকাবে আমার কানে এয়ার ফোন লাগানো ছিলো । পুরোটা সময় আমি ঐ মানুষটার সাথেই কানেকটেড ছিলাম । লোকটা আমাকে যেদিকে যেতে বলছিলো আমি সেদিকেই যাচ্ছিলাম । এমন কি বাইকটা যে ওখানে থাকবে সেটাও সেই বলেছে ।
-আর আপনি ওমনি চলে আসলেন ?
-ফলাফল দেখতেই পাচ্ছো । আমার কেবল কৌতুহল হচ্ছে । না দেখা করলে হয়তো কিছুই হবে না কিন্তু আমার কেবল জানতে ইচ্ছে করছে লোকটা কিভাবে এসব জানলো ? তাও আবার নিখুত ভাবে । আর বাইকটাও ফেরৎ দিতে হবে ।
কথা বলতে বলতে বাইকটা একটা পুরানো এক তলা বাসার সামনে এসে থামলো । নিকিতা বলল
-এই বাসা ?
-তাই তো হওয়ার কথা !
এতো সময় পুরান ঢাকার ভিড় থাকলেও এই এলাকাতে একটু মানুষজনের ভীড় কম মনে হচ্ছে । লোকটা ইতস্তত করে এদিক ওদিক দিয়ে হাটাহাটি করতে । একজন হঠাৎ ওদের সামনে এসে দাড়ালো । সাদিকের দিকে তাকিয়ে বলল
-বাইকটার কাজ শেষ । এটা নিয়ে যাই ?
বুঝতে পারলো ওরা একদম ঠিক জায়গাতেই চলে এসেছে । যদিও খানিকটা সন্দেহ কাজ করছে । যদি আবারও হামলা আসে তখন কিভাবে কি করবে সেটা অবশ্য ও আগে থেকেই ভেবে রেখেছে । দুজনই বাইক থেকে নেম গেল । ছেলেটা বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে বলল
-এই দরজা দিয়ে ঢুকে যান । সামনের রুমটা পার করে পরের রুমে বসবেন ।
ছেলেটা বাইক নিয়ে চলে গেল । নিকিতার একটু একটু ভয় ভয় করতে লাগলো । একবার মনে হল সাদিককে বলে যে কারো সাথে দেখা করার দরকার নেই । বাবাকে ফোন করে দিলেই বাবা গাড়ি নিয়ে চলে আসবে । এখান থেকে চলে পারলে বাঁচে । কিন্তু সাদিকের মত ওর নিজেরও খানিকটা কৌতুহল হচ্ছে । সাদিকের কথা যদি ঠিক থাকে লোকটা এতো নিখুত ভাবে এতো সব জানলো কিভাবে ?
দরজা ঠেলে দুজনেই ভেতরে ঢুকে পড়লো । দরজা আপনা আপনি বন্ধ হয়ে গেল । নিকিতার মনে হল ও যেন অন্য কোন জগতে চলে এসেছে । বাইরে ফঁকফকা রোঁদ ছিল । আর এই রুমের ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই মনে হল ওরা গভীর রাত পৌছে গেছে । নিকিতা যেন বাইরে ঝিঝি পোকার আওয়াজ শুনতে পেল ।
খুব আশ্চর্য্য হয়ে গেল । এমনটা কিভাবে হচ্ছে !
নিকিতা সমানে দাড়ানো সাদিকের হাতটা চেপে ধরলো । একটু অস্বস্থি লাগছিলো কিন্তু সেটা গায়ে মাখলো না । দুজনই সমানে এগোতে লাগলো । ঐতো দেখা যাচ্ছে সামনে একটা একটা । একটা যেন দরজা ।
সেই দরজা লক্ষ্য করেই ওরা এগিয়ে চলল । নিকিতার মনে হল ওরা অন্তত কাল ধরেই এগোচ্ছে । একটা রুম যে এতো বড় হতে পারে সেটা নিকিতার জানা ছিল । যখন সেই আলোর দরজা দিয়ে বের হয়ে এল তখন অবাক হয়ে দেখলো ওরা একটা আলোকোজ্জ্বল ঘরে চলে এসেছে । ঠিক যেমন করে ধুপ করে আগের রুমটাতে চলে এসেছিলো ঠিক সেই ভাবে এই চমৎকার রুমে চলে এসেছে ।
ওরা দুজনেই তাকিয়ে দেখলো ঘরে একটা ৪০ ইঞ্চি টিভি চলছে নিঃস্বব্দে । দু সারি শোফা সাজানো । সেখানটার একটা একটাতে একজন চুপ করে বসে আছে ।
ওদের জন্যই যেন অপেক্ষা করছে । নিকিতা তাকিয়ে দেখলো সামনের বসা মানুষটার বয়স খুব বেশি ২৫/২৬ হবে । মাথায় ঘন কালো চুল । মুখে খোচা খোচা দাড়ি ।ওদের দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে । মুখটা হাসি হাসি হলেও নিকিতার মনে হল লোকটার চোখ খুব বেশি তীক্ষ । এতো তীক্ষ চোখ যে কারো হতে পারে সেটা নিকিতার জানা ছিল না । সামনে বসা লোকটা হাসি মুখে বলল
-আসতে সমস্যা হয় নি তো খুব একটা ? বসুন ! আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছি আমি !
তিন
সন্ধ্যা পার হয়েছে অনেক আগেই । চারিদিকে ঝিঝির ডাক ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না । বড় বটগাছটার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে নদীটা । দিনের বেলাতে এখানে একটা হাট বসে কিন্তু সন্ধ্যা নামতেই সবাই এখান থেকে দুরে চলে যায় । আজ পর্যন্ত কেউ অবশ্য এখানে কিছু দেখেনি কিংবা ভয়ও পায় নি । তারপরেও এই জায়গাটাকে সবাই ভয় পায় ।
কিন্তু সুমনের এসব কিছুই মাথায় নেই । সেই বিকেল বেলা থেকে এখানেই বসে আছে । মাথার ভেতরে কেবল একটা চিন্তা কাজ করছে ।
আজকে দুপুরের ওর একটা চাকরীর রেজাল্ট দিয়েছে । চাকরিটা ওর শতভাগ হওয়ার কথা ছিল । পরীক্ষা তো ভাল হয়েছিলই সেই সাথে বাবার জমি বিক্রি করে লাখ পাঁচেক টাকাও দেওয়া হয়েছিলো । সে নিশ্চয়তা দিয়েছিলো যে চাকরিটা ও পাচ্ছে । কিন্তু যখন রেজাল্ট টা নোটিশ বোর্ডে টাঙ্গালো হল সেখানে ওর নাম ছিল না । আর বাসায় যাওয়া হয়ে ওঠে নি । আজকে হাটবার ছিল না তাই জায়গাটা একটু নির্জনই ছিল । এখানেই এসেই বসে ছিলো । আর ওঠে নি ।
কি মুখ নিয়ে সে বাসায় যাবে । ওর বাবা শেষ সম্ভব টুকু বিক্রি করতে চায় নি । সুমন এক প্রকার জোর করেই সেটা বিক্রি করে দিয়েছে । তার একটা চাকরি দরকার ছিল যে কোন মূল্যে । কিন্তু এখন ওর কাছে কিছু নেই । দেওয়া টাকা পাওয়া যাবে কি না কেউ বলতে পারে !
সুমন একভাবে নদীর পানির দিকে তাকিয়ে রইলো । এক বার মনে হল যে ঝাঁপ দেয় সে সাঁতার জানে । ঝাপ দিয়ে খুব একটা লাভ হবে না । কিন্তু এই জীবন রেখে আর লাভই বা কি হবে ? তখনই চোখ গেল ডান দিয়ে । রাত লামলেও আকাশে চাঁদ আছে । হাট বাড়ের এখানে বেশ ভাল দোকাট পাট বসে । সেখানেরই একটা অস্থায়ী দোনের চিহ্ন এখনও পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে । সেখানে বেশ কিছু দড়ি পড়ে রয়েছে ।
সুমন উঠে দাড়ালো । দড়ি টুকু হাতে নিয়ে টেনে টুনে দেখলো । তার ভর সহ্য করতে পারবে ঠিক ।
পানিতে ঝাপ দিলে হয়তো মরবে কিন্তু এই শক্ত দড়ি দিয়ে তো গাছ থেকে ঝুলে পড়তে পারে । তাহলেই সব ঝামেলা শেষ হবে তার । মায়ের চেহারাটা একটু মনে পড়লো । ছোট বোনটার কি হবে সেটা ও জানে না । বাবা কিছু একটা করবে নিশ্চয়ই ।
সুমন আর ভাবলো না । বেশি চিন্তা করলেই কাজটা করতে পারবে না । এই হতাশার জীবন আর তার ভাল লাগছে না । আজই সে মুক্তি চায় । আজকেই সব হতাশার সমাপ্তি হবে তার ।
সুমন দড়িতে একটা ফাঁস দিয়ে গাছে উঠে পড়লো । তারপর অন্য প্রান্তটা বাঁধলো একটা শক্ত ডালের সাথে । ফাঁসটা নিজের গলাতে পরালো ।চূড়ান্ত ভাবে লাফ দেওয়ার আগে আরেকবার ভাবলো সে । মনে মনে বলল এমন কিছু যদি থাকতো ! যে কোন কিছু তৈরি সে নিজের জীবনের এ হতাশা দুর করার জন্য । যে কোন কিছু !
কিন্তু জানে এমন কিছু নেই । কেউ ওকে বাঁচাতে আসবে না । কেউ এগিয়ে আসবে না সাহায্য করতে ।
আর ভাবলো না সুমন । চোখ দিয়ে একটু পানি গড়িয়ে পড়লো । পড়ুক । তবুও তো এই হতাশার জীবন থেকে মুক্ত পাবে সে !
চোখ বন্ধ করে ঝাপ দিল ।
গলাতে একটা হালকা ধাক্কা লাগলো । তারপর দড়ি ছেড়ার একটা আওয়াজ হল । তার পরেই সুমন নিজেকে মাটিতে আবিস্কার করলো। পেছনে একটা লেগেছে দড়ি ছিড়ে পড়ার জন্য ।
সুমন অবাক হয়ে পাড়লো না । দড়িটা ছেড়ার কথা ছিল না । সুমন ভাল করে পরীক্ষা করে দেখেছে । তাহলে ছিড়লো কিভাবে ?
-কি অবাক হচ্ছো ?
সুমনের বুকে যেন কেউ ধাক্কা মারলো । একটা নারী কন্ঠ শুনে এক পাক দিয়েই পেছন ফিরে তাকালো । চারিদিকে চাঁদের আলো দিয়ে আলোকিত হয়ে আছে । শাড়ি পরা মেয়েটাকে চিনতে সুমনের মোটেও কষ্ট হল না । দেখে মনে হচ্ছে গ্রামের কারো নতুন বিয়ে করা বউ । সুমন চেনার চেষ্টা করলো কিন্তু এমন চেহারা আর এমন কন্ঠের কারোর কথা সে মনে করতে পারলো না । সুমন বলল
-আপনি ?
-হ্যা । আমিই বাঁচিয়েছি তোমাকে ?
-মানে ? কি বলছেন আপনি ?
মেয়েটা হাসলো । তারপর হাতের দু আঙ্গুল দিয়ে একটা তুড়ি বাজালো সুমন অবাক হয়ে দেখলো ওর হাতের থাকা দড়িটা আবারও মাঝ খান দিয়ে দুভাগ হয়ে গেল । বিস্ফোরিত চোখ তাকিয়ে রইলো সেদিকে । মেয়েটি বলল
-তোমার জীবন আমি বাঁচিয়েছি ।
-কেন বাঁচালেন ?
-আমার দরকারেই বলতে পারো । মরেই তো যাচ্ছিলে । তা আমার দরকারে যদি আসো !
-যদি না আসি !
-কোন সমস্যা নেই তো মরার হাজারটা উপায় আছে । তবে জেনে রেখো আমার কাজ যদি আসো যদি রাজি হও তাহলে জীবনের সব থেকে বড় সাফল্য টা পাবে । যা চাইবে তাই পেয়ে যাবে তুমি ।
সুমন কিছু বুঝতে পারলো না । মেয়েটি বলল
-তোমার মোবাইলটা তো বন্ধ আছে । চালু করে দেখো । এখনই প্রমান পেয়ে যাবে ।
সুমন নিজের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে চালু করলো । পরিপূর্ণ ভাবে চালু হওয়ার সাথে সাথেই একটা মেসেজ এসে হাজির ।
ঢাকা ব্যাংক থেকে । মাস চারেক আগে এই ব্যাংকে সে ভাইভা দিয়েছিলো । তবে তখন ডাক আসে নি । মেয়েটি বলল
-এটা কেবল শুরু । যদি মনে হয় এটা আমার জন্য হয় নি তাহলেও সেটা তোমার ব্যাপার । কিন্তু যখন হঠাৎ করেই চাকরি হয়েছে ঠিক সেই ভাবেই চলে যাবে ! চিন্তা করে দেখো । আমার যে তোমাকেই লাগবে এমন কোন ব্যাপার না । তোমার মত হাজার হাজার হতাশ যুবক আছে এদেশে । তাদের কেউ না কেউ ঠিকই রাজি হয়ে যাবে !
সুমন আর কিছু ভাবলো না । ঢাকা ব্যাংকের এই চাকরিটাতে মাসে ৪৫ হাজার টাকা পাওয়া যাবে । আজকের চাকরি টার বেতনের প্রায় দ্বিগুন । হাতে আসা এমন সুযোগ কি ছেড়ে দেওয়ার কোন উপায় আছে ? কোন উপায় নেই । সুমন বলল
-আমি রাজি । আমাকে কি করতে হবে বলুন !
মেয়েটি আরও কাছে চলে এল । চাঁদের আলোতে মেয়েটার চেহারা এবার আরও পরিস্কার ভাবে ফুটে ওঠলো । সুমনের কেবল মনে হল ও জীবনের সব থেকে সুন্দর মুখটা দেখতে পেয়েছে । মেয়েটি হেসে বলল
-কিছু করতে হবে না । কেবল আমাকে বিয়ে করতে হবে ।
চাঁর
মেজর সাদিকের হাতটা তখনও নিজের পকেটের রিভালবারের উপর । যে কোন পরিস্থির জন্য প্রস্তুত সে । যদি সামনে বসা মানুষ ওদের উপর কোন প্রকার হামলা করতে চায় তাহলে সেটা সে রুখে দিতে তৈরি । নিকিতা ওর পেছনেই আছে । সামনে বসা মানুষটার দিকে তাকিয়ে আছে । সামনের শোফাতে বসা মানুষটা মুখ হাসি হাসি করে বলল
-মেজর সাহেব, পিস্তল থেকে হাত সরিয়ে নিশ্চিন্তে বসুন । আমার এখানে আপনারা নিরাপদ । আর আমি আপনাদের জন্য হুমকি না !
সাদিক বসার আগেই নিকিতা শোফাতে গিয়ে বসলো । লোকটার চোখে চোখ রেখে বলল
-আপনি কে বলুন তো ? কিভাবে এতো কিছু জানেন আর আমাদের কে বাঁচালেন কিভাবে ? আর ওরা কারা আমাকে মারতে চায় ? আকসার আহমেদের লোক ওরা ? বিয়ে করতে চায় নি বলে মেরেই ফেলবে !
সামনে বসা মানুষটা হেসে বলল
-আরে আস্তে আস্তে । সব উত্তর পাবেন । আগে নাম দিয়ে শুরু করি ।
সাদিক যদিও নিকিতার পাশের শোফাতে বসলো তবে সে এখনও প্রস্তুত আছে যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য । লোকটা বলল
-আমার নাম রাফায়েল !
সাদিক বলল
-রাফায়েল কি ? রাফায়েল চৌধুরী নাকি আহমেদ ?
রাফায়েল হাসলো ।
-নাহ ! আগে পিছে আর কিছু নেই । কেবল রাফায়েল ।
নিকিতা বলল
-ওরা কি আকসার আহমেদের লোক ? আমাকে মারতে চেয়েছিলো ?
-নাহ । ওরা তার লোক না । আকসার আহমেদ আপনাকে কোন ভাবেই মরতে দিতে পারে না । বলতে পারে যে কোন ভাবেই সে আপনাকে বাঁচাতে চাইবে ।
সাদিক সাথে সাথেই বলল
-তাহলে আপনি কি তার লোক ?
-নাহ ! আমি তার লোকও না ।
-একটু পরিস্কার করবেন দয়া করে ?
-বলছি ।
তারপর রাফায়েল খানিকটা সময় চুপ করলো । তারপর বলল
-এই দেশে বর্তমানে দুইটা গ্রুপ আছে । একটা গ্রুপ যে কোন ভাবেই নিকিতাকে মারতে চায় । তাকে মেরে ফেলতে চায় । আর আরেকটা গ্রুপ আছে সেটা হল ওকে বাঁচাতে চায় । কোন ভাবেই ওকে মরতে দিবে না । দ্বিতীয় দলটা হচ্ছে আকসার আহমেদের ।
সাদিক বলল
-আর প্রথমটা ?
-ওরা নিজেদেরকে বলে এওজি !
-মানে ?
-আর্মি অব গড !
-আমি কিছু বুঝতে পারছি না । তাহলে আমি কোথা থেকে এলেন ?
-আমি হচ্ছি তৃতীয় পক্ষ যে নিকিতাকে ঐ আর্মি অব গড দের থেকে রক্ষা করতে চায় কিন্তু কোন ভাবেই চায় না যে নিকিতা আকসার আহমেদের হাতে পড়ুক । কারন আকসার আহমেদও নিকিতার সাথে ঠিক একই কাজ করবে । ওকে বিয়ে করার পরে !
নিকিতা খানিকটা ভিত কন্ঠে বলল
-আমি কি করেছি ? আমার বাবা কি করেছে যার কারনে ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চায় ?
রাফায়েল বলল
-নাহ । তুমি কিছু কর নি । তুমি খুব বিশেষ সময়ে জন্ম নিয়েছো ! যে সময় ইমুপ্সা জন্ম নিয়েছিলো ! এই জন্য তুমি খুব বেশি গুরুত্বপূর্ন !
পাঁচ
নিকিতা আর সাদিক কি বলবে কিছু বুঝতেই পারলো না । সামনে বসা মানুষটা তাদের কে যা বলেছে তার কিছুই তাদের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না । আবার বিশ্বাস না করেও পারছে না । নিকিতা কিছু বলতে যাবে তখনই দরজা দিয়ে আরেকজন ঢুকলো । তিনজনই সেদিকে তাকালো । নিকিতার মুখটা একটু স্বাভাবিক হয়ে এল । লোকটা আর কেউ নয়, ওর বাবা সাহাবুদ্দিন আহমেদ ।
পেছন থেকে রাফায়েল বলল
-এখন তো আমাকে বিশ্বাস হচ্ছে যে আমি তোমাদের খারাপ চাই না । ওনার সাথে আমি অনেক আগেই যোগাযোগ করেছিলাম । সে আমার কথা মত চলছিলো । সাদিককে সেই নিয়োগ দিয়েছিল । আমাদের লক্ষ্য ছিল কেবল তোমাকে আকসার আহমেদের হাত থেকে রক্ষা করা । তোমাকে তার কাছে যেতে না দেওয়া !
নিকিতার বাবা বসতে বসতে বলল
-ঠিক তাই ।
রাফায়েল আবার বলল
-আমাদের মত আরেকটা দল আছে যারা চায় যে তুমি যেন কোন ভাবেই আকসার আহমেদের কাছে না পৌছাও ।
তখন এতোটা সময় চুপ ছিল । তারপর বলল
-তাই ওকে মেরে ফেলতে চাইছে । কারন ও যদি মরে যায় তাহলে কোন ভাবেই আকসার আহমেদের কাছে পৌছাবে না । তাই না ?
-হ্যা । এটা সব থেকে সহজ উপায় । এবং ওরা আবারও হামলা করবে । যে কোন ভাবেই ওরা চাইবে নিকিতা যেন মারা যায় । তবে নিকিতার উপর হামলার খবর এতোক্ষনে আকসার আহমেদের কাছে পৌছে গেছে । সেও এবার সরাসরি মাঠে নামবে । এতো সময় কেবল নিকিতার দিকে খেয়াল রাখছিলো । সেও চাইবে নিকিতাকে রক্ষা করতে । সম্ভবত আর সে কোন ঝুকি নিবে না । সুযোগ পেলেই ওকে তুলে নিয়ে যাবে । নিজের কাছে রাখবে !
নিকিতা বলল
-কিন্তু আমি কি করলাম ? আমাকে নিয়ে টানাটানি কেন ?
রাফায়েল কিছুটা সময় চুপ করে রইলো । নিকিতার বাবার দিকে তাকালো । কিছু যেন বলার চেষ্টা করলো চোখে চোখে। তারপর ওদের দিকে তাকিয়ে বলল
-তোমার আসলে কোন দোষ নেই ।
-তাহলে ?
-আগেই বললাম । তোমার দোষ নেই । বরং তুমি খুব বিশেষ কেউ । এই জন্যই তোমাকে দরকার তার !
রাফায়েল আরও কিছুটা সময় চুপ করে রইলো । তারপর বলল
-আজ থেকে বছর দশেক আগে আকসার আহমেদ কিন্তু খুব সাধারন একজন মানুষ ছিল । পড়ালেখা করে বেকার একটা যুবক । কোন ভাবেই সে যখন জীবনে কিছু করতে পারছিলো না তখন ঠিক করলো সে আর নিজের জীবন রাখবে না । কিন্তু ঠিক মৃত্যুর আগে যে এমন কিছু বলল এমন একটা আকাঙ্খা তার মনে জেগে উঠলো যে সে যে কোন কিছুই করতে প্রস্তুত ছিল সব কিছু ঠিক করার জন্য । বলতে পারো বেপোয়ায়া । ইমুপ্সার ঠিক এটাই দরকার ছিল । সে আকসার আহমেদ কে মরতে দিলো না । তাকে সব কিছু দিল জীবনে । সব ক্ষমতা আর সাফল্য এনে দিল । তার বদলে আকসার আহমেদকে কেবল একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর একজন বিশেষ মেয়েকে খুজে বের করতে হয় যার দেহে ইমুপ্সা প্রবেশ করতে পারে !
-ইমুপ্সা টা কে ?
প্রশ্নটা করলো সাদিক । সেদিক চুপ করে শুনেই যাচ্ছে । তার কাছে সব কেমন যেন মনে হচ্ছে । ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না । সব কিছু কেমন লাগছে তার । কিন্তু এই লোকটাই ওদেরকে যেভাবে বাঁচিয়ে নিয়ে এল সেটা দেখার পর থেকে ঠিক অবিশ্বাসও করতে পারছে না ।
রাফায়েল বলল
-আমি জানি আমার কথা তোমাদের ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না । তবে একটা কথা তো বিশ্বাস কর যে আমাদের পুরো পৃথিবীতে মানুষ ছাড়াও আরো কিছু আছে । সর্বোচ্চ শক্তি আছে যে আমাদের তৈরি করেছে । সৃষ্টি কর্তা । এই সৃষ্টি কর্তা তার পছন্দের কিছু মানুষকে বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে । অনেক কিছু করতে পারতো তারা । ঠিক তেমন ভাবে শয়তানও আছে । এই শয়তান অনেক নামে পরিচিত । একটা নাম লুসিফার ! সব কালো শক্তির মূল । এই লুসিফারেও কিছু কাছের মানুষ আছে । লুসিফারও তাদেরও কিছু ক্ষমতা দিয়ে এই পৃথিবীতে নিয়ে আসে । তেমন একজন হল ইমুপ্সা ।
নিকিতা বলল
-মহিলা শয়তান ?
রাফায়েল হাসলো । বলল
-হ্যা বলতে পারো । প্রত্যেক শয়তানের যেমন বিশেষ কিছু ক্ষমতা আছে ঠিক তেমনি এদের কিছু সীমাবদ্ধতাও আছে । এই মহিলা শয়তান পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে কিছু নির্দিষ্ট সময় পরপর একজনের বিশেষ মানুষের দেহের ভেতরে কিছু বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রবেশ করতে হয় । নয়তো সে টিকে থাকতে পারবে না ।
নিকিতা বলল
-আমি হচ্ছি সেই বিশেষ মানুষ ।
-হ্যা । লুসিফার ইমুপ্সাকে ঠিক যে তিথিতে এই পৃথিবীতে এনেছিলো তোমার জন্ম ঠিক সেই তিথিতে । সামনের সময়ে তার টিকে থাকতে হলে প্রত্যেকবারই নিকিতার মত কাউকে দরকার হবে । প্রতিবারই কোন না কোন ভাবে আকসার আহমেদ অনেক আগে থেকে সেই মেয়েকে নিজের কাছে এনে রাখে । কিন্তু এইবার নিকিতার বাবা বেশ ক্ষমতা বান হওয়ার তাকে নিজের কাছে নিয়ে যেতে পারে নি । এই জন্যই বিয়ের প্রস্তাব পাঠিয়েছে ।
সাদিক বলল
-এখন আমাদের কি করনীয় ?
রাফায়েল বলল
-আজকে মাসের ২০ তারিখ । এই মাসের ২৭ তারিখটা হচ্ছে সেই বিশেষ সময় । এই সময় পর্যন্ত আমাদের নিকিতাকে দুরে রাখতে হবে । কোন ভাবেই যেন আকসার আহমেদ নিকিতার সন্ধান না পায় ।
নিকিতার বাবা বলল
-আমার একটা বাংলো আছে সেন্ট মার্টিনে, ওখানে কি পাঠাবো ? আমি অনেক চেষ্টা করছি কিন্তু কিছুতেই নিকিতার ভিসার পাচ্ছি না । বারবার রিজেক্ট হয়ে যাচ্ছে । বুঝতে পারছি এর পেছনে কে রয়েছে । নিকিতাকে কিছুতেই সে দেশের বাইরে যেতে দিবে না । পুলিশের কাছে গিয়েও আমি কিছু করতে পারি নি । আকসার আহমেদের হাত আমার থেকেও বেশি লম্বা !
রাফায়েল বলল
-এক জায়গাতে থাকলে চলবে না । আগেই বলেছিলো নিকিতার ভেতরে বিশেষ কিছু রয়েছে । বলতে পারেন যে ওর শরীর থেকে একটা আলাদা ফ্রিকোয়েন্সী বের হয় যেটা ইমুপ্সা ঠিকই ধরে ফেলবে । এমন কি এখানেও চলে আসবে যদি এখানে বেশি সময় থাকেন । আমি ...
রাফায়েল কিছু বলতে যাবে ঠিক সেই সময়ে খুব বড় করে বিস্ফোরনের আওয়াজ হল । ঘরে থাকা সবাই একবার চমকে দরজার দিকে তাকালো ।
নিকিতার বাবা সাহাবুদ্দিন আহমেদ বলল
-কি হল ?
রাফায়েল বলল
-এতো জলদি ? না এটা তো সম্ভব না ।
তারপর নিজের ল্যাপ্টপের সামনে বসে দ্রুত কি যেন টেপাটেপি করতে লাগলো । তারপর বলল
-না এটা আকসার আহমেদ না । ঐ যারা নিকিতাকে ক্যাম্পাসে হামলা করেছিলো তারা !
-এখানেও চলে এসেছে ।
-তাই তো দেখছি । এরা তৎপর হবে ভাবি নি । তবে খুব একটা চিন্তার কিছু নেই ।
এই বলে রাফায়েল ঘরের অন্য দিকে আরেকটা দরজার কাছে চলে গেল । সেটা খুলে সাদিকের দিকে তাকিয়ে বলল
-কুইক । নিকিতাকে নিয়ে এদিক দিয়ে বের হয়ে যান । একটা বড় উঠান পাবেন । উঠানের উপর দেখবেন একটা গাড়ি রাখা আছে । চাবি পাবেন কি হোলেই । নিকিতাকে নিয়ে সোজা চলে যেতে থাকবেন । থামবেন না । কোন ভাবেই না । মনে থাকবে তো ?
নিকিতা বলল
-কিন্তু আব্বু ! আপনারাও আসুন আমাদের সাথে ।
রাফায়েল বলল
-ভয় নেই । ওরা আমাদের কিছু বলবে না । ওরা কেবল তোমাকে খুজছে ।
নিকিতা নিজের বাবাকে জড়িয়ে ধরলো । নিকিতার বাবা বলল
-চিন্তা করিস না মা । কিছু হবে না । সব ঠিক হয়ে যাবে ।
আবার কাছেই কিছু একটা আওয়াজ হল । কেউ যেন দরজা ভাঙ্গার চেষ্টা করছে ।
রাফায়েল বলল
-আর দেরি করবেন না। জলদি । আর ভয় নেই আমি আপনাদের খুজে নিবো । এখন চলে যান ।
সাদিক আগে থেকে তৈরি ছিল । নিকিতাকে নিয়ে দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল । ওরা বের হতেই রাফায়েল দরজা বন্ধ করে দিল । তারপর একটা মোচড় দিলো তালাতে । আপাতত আর চিন্তা নেই ।
ছয়
নিকিতা পেছনের উঠানে এসে খানিকটা অবাক হয়ে গেল । পেছনে আরেকবার ফিরে তাকালো । দরজাটা বন্ধ হয়ে আছে । রাফায়েল ওদেরকে যে দরজা দিয়ে বাইরে পাঠালো সেটা একটা বদ্ধ ঘরের ছিল । অন্ধকার একটা ঘর । সেটা পার হতেই এই উঠান ।
কিন্তু সমস্যা সেখানে না । উঠানটা পেরিয়েই রাস্তা দেখা যাচ্ছে । এবং রাস্তার ঠিক ওপাশেই পাহাড় দেখা যাচ্ছে । নিকিতা নিজের চোখকে ঠিক মত বিশ্বাস করতে পারছে না । দাড়িয়ে রইলো কিছুটা সময় । তারপর সাদিকের দিকে তাকিয়ে বলল
-ওটা কি পাহাড় ?
সাদিকও ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে । খানিকটা অবাক হয়ে বলল
-তাই তো মনে হচ্ছে ! কিন্তু আমরা এখানে এলাম কিভাবে ?
ওরা পুরান ঢাকায় ছিল । একটা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে এখানে এসে হাজির হলো । এটা আর যাই হোক পুরান ঢাকার পেছনের কোন অংশ মনে হচ্ছে না । এমন কি ঢাকার কোন অংশও মনে হচ্ছে না । কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব ? দুজনেই কিছু সময় চিন্তা করার চেষ্টা করলো কিন্তু কিছুই খুজে পেল না ।
কথা মত ঠিকই একটা গাড়ি দাড়িয়ে রয়েছে । দুজনে আর কিছু ভাবার চেষ্টা করলো না । সোজা গাড়িতে উঠে বসলো । সাদিক গাড়ি ছেড়ে দিলো । রাফায়েল বলেছিল যেন ওরা যেন কোথাও না থামে ! চলতেই থাকে ! এই সাতটা দিন কোন ভাবেই কোথাও থামা যাবে না !
নিকিতা জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে । সবুজ পাহাড়ের সারি গুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে খুব ভাল লাগছে । একটু আগেও ওর মাথার ভেতরে ঠিক ঢুকছিলো না ওরা এখানে কিভাবে এল । ঘন্টা খানেক আগেও ওরা পুরান ঢাকার একটা বাসায় ছিল । তারপর একটা দরজা দিয়ে যখন এই পাশ আসে ওরা অবাক হয়ে লক্ষ্য করে যে ওরা আসলে সিলেটে চলে এসেছে ।
ওদের দুজনের একজনও ঠিক ব্যাপারটা বিশ্বাস করতে পারছিলো না কিন্তু নিজেদের সাথে যা হচ্ছে তা বিশ্বাস না করে উপায়ও নেই । রাফায়েলের কথা মতই বাসার উঠানে একটা জিপ গাড়ি দাড়িয়ে ছিল । কিহোলে চাবিও ছিল । সাদিক আর নিকিতা আর কিছু চিন্তা করে নি । শুরু থেকেই ওদের সাথে যা হচ্ছে তার কিছুই মাথায় ঢুকছে না । তাই খুব বেশি কিছু চিন্তা না করাই ভাল । রাফায়েল ওদের কেবল বলেছে যে ওদের পালিয়ে যেতে হবে । কোন ভাবেই ঐ আর্মি অব গড কিংবা আকসার আহমেদের হাতে পড়া যাবে না । একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পালিয়ে থাকতে হবে । ওরা কোথায় যাবে কেউ জানে না । তবে এক জায়গাতে থামা চলবে না ।
ওরা যে কারো সাহায্য নিবে সেটারও উপায় নেই । নিকিতা শুনেছে আকসার আহমেদ প্রচুর টাকার মালিক । আর প্রচুর টাকা প্রচুর ক্ষমতা নিয়ে নিয়ে আসে । ওরা যদি কারো কাছে গিয়ে হাজির হয় তাহলে সেটা আকসার আহমেদের কাছে পৌছে যাবে । তাই এই কটাদিন থাকতে হবে পালিয়ে !
-এই দাড়ান দাড়ান !
নিকিতার চিৎকারে বলে উঠলো । সাদিক এক ভাবে গাড়ি চালাচ্ছিলো । নিকিতার কথা শুনে ওর দিকে তাকালো । তারপর বলল
-কি হল ?
-গাড়ি থামান ?
-কেন ?
-আরে দেখলেন না এক ভদ্রলোক গাড়ি দাড় করানোর জন্য হাত দেখালো ।
-দেখাক । আমরা এখানে কাউকে সাহায্য করতে আসি নি । আর আমরা কাউকে বিশ্বাস করতে পারি না । তুমি জানো ?
-আরে বাবা একটু থামালে কি হবে ? নিশ্চয় বেড়াতে এসেছিলো । দেখলাম গাড়ির পাশ দাড়িয়ে আছে । নিশ্চয়ই গাড়ি নষ্ট হয়ে গেছে । আর ইনারা কিভাবে জানবে যে আমরা এখানে এসেছি । আমি আর আপনি নিজেই তো জানতাম না আমরা এখানে কিভাবে এলাম !
কথাটা সত্য ! আসলেই ওরা নিজেরাও জানে না ওরা এখানে কিভাবে এল । সাদিক মিররে পেছনের দিকে তাকালো । দেখলো আসলেই একটা সাদা রংয়ের ল্যান্ড ক্রুজার দাড়িয়ে আছে । তার পাশেই এক ভদ্রলোক দাড়িয়ে আছে ওদের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে ।
নিকিতা আবার বলল
-গাড়ি থামান প্লিজ ! আমার তো ইনার কাছ থেকে কোন ক্ষতির সম্ভবনা দেখতে পাচ্ছি না ।
সাদিক গাড়ি থামালো । তারপর গাড়িটা আস্তে আস্তে পেছনে নিয়ে চলল । কিছু দুর আসতেই লোকটা ওদের দিকে এগিয়ে এল । সাদিকের জানলার পাশে এসে হাজির হল । তারপর ওর দিকে তাকিয়ে খানিকটা অপরাধীর মত মুখ করে বলল
-আসলে, আমাদের গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে । আর কোন গাড়ি আসছে না । শুনেছিলাম সামনে কোথায় যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়েছে । তার গাড়ি চলাচাল বন্ধ হয়ে আছে !
-ও !
সাদিক নিকিতার দিকে তাকালো । তারপর আবার ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনারা কোথাও যাবেন ? নামিয়ে দিব ?
-খুবই উপকার হয় তাহলে ! আসলে এই মাইল খানেক দুরে একটা রিসোর্ট আছে । আমরা আসলে ওখানেই যাচ্ছিলাম । কিন্তু পথে এই অবস্থা !
-আচ্ছা উঠে পড়ুন ।
-আমি আমার স্ত্রীকে নিয়ে আসি । ও খুব অস্থির হয়ে আছে ।
সাদিক দেখলো ভদ্রলোক গাড়ির ড্রাইভারকে কি যেন বলল । তারপর দরজা খুলে ব্যাগ বের করতে লাগলো । ব্যাগ দেখে সাদিকের দিকে মনের সন্দেহ টুকু দুর হয়ে গেল । লোকটা আসলেই তাহলে বেড়াতে এসেছিলো ।
ব্যাগ নিয়ে এগিয়ে আসা শুরু করতেই ভদ্রলোকের পেছন থেকে একটা মেয়ে নেমে এল । মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়েই সাদিক চমকে উঠলো । জীবনে এতো সুন্দর মেয়ে সে দেখেছে বলে সাদিকের মনে পড়লো না । ভদ্রলোকও যথেষ্ট সুদর্শন ! কিন্তু মেয়েটার চেহারার কাছে সেটা কিছুই নয় ! দুজনেই গাড়িতে উঠে আসতেই ওদের দিকে তাকিয়ে মেয়েটি হাসলো ।
কিন্তু সাদিকের কেন জানি সেই হাসিটা ভাল লাগলো না । কেমন যেন একটা কৃত্রিম ভাব রয়েছে । ভদ্রলোক বলল
-আপনাদের কি বলে যে ধন্যবাদ দিব !
তারপর সে নিজের আর তার স্ত্রীর পরিচয় দিকে লাগলো । ভদ্রলোকের নাম আবীর আহমেদ । তার স্ত্রীর নিলিমা আহমেদ । ভদ্রলোক একজন উপসচিব । স্ত্রী নিয়ে বেড়াতে এসেছে এখানে কিন্তু এখানে এসে বিপদে পড়েছে । নিকিতাও নিজের পরিচয় দিল । তবে ওর আসল পরিচয় দিলনা । বলল ওরা বিবাহিত । নতুন বিয়ে করেছে । এখানে ঘুরতে বেরিয়েছে । সাদিক কোন কথা বলল না । গাড়ি চালানোর দিকে মনযোগ দিল । তবে মাঝে মাঝে যাচ্ছে রিভার্স মিররে । আর নিলিমা আহমেদের সাথে চোখাচোখি হয়ে যাচ্ছে । মেয়েটা কেমন হাসি মুখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে তবে হাসিটা কেন জানি সাদিকের মোটেই ভাল লাগছে না ।
আরও কিছুটা সময় গাড়ি চালানোর পড়ে ওরা রিসোর্ট টা দেখতে পেল । আবীর আহমেদ নেমে ওদের বারবার ধন্যবাদ দিতে লাগলো । তারপর হঠাৎ করেই বলল
-আপনারা এখন কোথায় যাবেন ?
-দেখি সামনে কোথাও যাবো ।
আবীর আহমেদ অবাক হয়ে বলল
-আপনারা ঠিক করে আসেন নি কোথাও যাবেন ?
নিকিতা আর সাদিক দুজনেই দুজনের দিকে তাকালো । কি বলবে খুজে পেল না । নিকিতা বলল
-আসলে আমরা পালিয়ে এসেছি তো ! ওরকম কোন কিছুই ঠিক করে আসা হয় নি । বাবা মাকে জানানো যাবে না যে কোথায় আছি ! আর আমরা এখনও ঠিক বিয়েও করতে পারি নি । সরি আপনাদের প্রথমে মিথ্যা বলেছিলাম !
নিকিতার কথা শুনে আবীর আহমেদ খুব হাসলো । তারপর বলল
-কোন সমস্যা নেই । একটা কাজ করুন এখানে থাকুন ! সমস্যা কি !
নিকিতা আর সাদিক দুজন দুজনের দিকে তাকালো । আবীর আহমেদ বলল
-এটা খুবই রিমোর্ট এরিয়া । এর পরেই ভারত । আপনাদের বাবা মায়েরা এখানে খুজে পাবে না । আর এটা খুবই চমৎকার একটা জায়গা ! সকাল বেলা যখন ঘুম ভাঙ্গবে এখান থেকে মিজোরামের পাহাড় দেখতে পাবেন । এতো চমৎকার দৃশ্য এর আগে কখনও দেখতে পাবেন না ।
সাদিক আর নিকিতা দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলো । দুজনের মনের ভেতরেই খানিকটা কনফিউশন দেখা যাচ্ছে । এক সময় নিকিতা সাদিকের দিকে তাকিয়ে বলল
-তাই । এখানেই একটা দিন স্টে করি । তারপর না হয় ঠিক করা যাবে কোন দিকে যাওয়া যাবে !
সাদিকের মনটা কেন যেন সায় দিচ্ছে না । তবুও মনে হল যে এখানে থাকাটা মন্দ হবে না । বিশেষ করে এই রিসোর্টটার কথা ও আগেই জানে । যখন আর্মিতে ছিল তখন এদিকে আসতে হয়েছিলো একটা কাজে !
আর ওরা যে এখানে আছে এইটা কারো পক্ষেই জানা সম্ভব না । তাই শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল । গাড়িটা ঢুকিয়ে ফেলল রিসোর্টটার ভেতরে ।
সাত
নিকিতার মনে যে ভয়টা কাজ করছিলো সেটা চলে গেছে । ওর কেবল মনে হচ্ছে ও কোন এডভেঞ্চারে বের হয়েছে । ওকে রক্ষার জন্য সাদিক ওর সাথেই রয়েছে । প্রথমে সাদিককে ওর ঠিক পছন্দ না হলেও এখন কেমন একটা নির্ভরতা এসেছে ছেলেটার উপর । হ্যা উপর থেকে একটু রুক্ষ স্বভাবের তবে নিকিতাকে বাঁচাবেই ।
আজকে এই রিসোর্টে প্রবেশের পর থেকেই মনটা আরও ভাল হয়ে গেছে । ওরা যখন ঢুকছিলো তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল । রুমের বারান্দার এসে সামনের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে গিয়েছিল । মনের ভেতরের ভয় টুকু একেবারে দুর হয়ে গেল ।
আবীর আহমেদ এবং তার স্ত্রীর সাথে সময়টা বেশ ভাল কেটেছে । ওনারা অনেক বেশি আন্তরিক । এতো বেশি আন্তরিক যে নিকিতার কেবলই মনে হচ্ছে যে ওনারা নিকিতার ব্যাপারে একটু বেশিই আগ্রহী । এটাই নিকিতার কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক মনে হয়েছে একটু । তবে সেটা সেটা খুব একটা আমলে নেয় নি ।
নিকিতা আর সাদিকের রুমটা পাশাপাশিই । বারান্দাটা এক সাথে লাগানো । রাতে খাওয়া শেষ করেই চলে এল বারান্দায় । এসে দেখলো সাদিক আগেই বসে আছে ওখানে । সে নিজেও বারান্দা বসে রয়েছে । চোখটা দুরের পাহাড়ের দিকে ।
নিকিতা পাশে গিয়ে বসলো । সাদিক সেদিকে না তাকিয়েই বলল
-আবীর সাহেবের স্ত্রী তোমার মনকে খানিকটা অস্বস্থিতে ফেলছে, তাই না ?
নিকিতা অবাক হয়ে তাকালো সাদিকের দিকে । বলল
-আপনি কিভাবে বুঝলেন ?
-জানি না । তবে আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই । এখানে সব কিছু পার্ফেক্ট মনে হচ্ছে । পরিবেশ এমন হয় না । তুমি কি লক্ষ্য করেছো যে রিসোর্টে আর কেউ নেই । কেবল আমরা দুজন আর ওনারা দুজন ।
-এই সময় হয়তো টুরিস্ট সিজন না ।
-তারপরেও । এই রিসোর্টের সব সময়ই মানুষ আসে । শীত কিংবা গরম । সব সময় ! তাহলে । এটার নাম আমি আগেও শুনেছি । আসলে এইটা দেখেই আমি এখানে থাকতে রাজি হয়েছিলাম কিন্তু এখানে চেকইন করার পর থেকেই মনে হচ্ছে কিছু একটা ঠিক নেই । আমরা কাল সকালেই এখান থেকে চলে যাবো । ঠিক আছে ?
-আচ্ছা !
নিকিতা মাথা নাড়াতেই একটা অদ্ভুদ অনুভুতি হল । মনে হল যেন ওর পুরা পৃথিবীটা দুলে উঠলো । ভুমিকম্প কি হচ্ছে ?
পড়তে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল । সাদিকের কাধে হাত রাখলো । সাদিক ওর দিকে তাকিয়ে বলল
-কি হল ?
-জানি না । কেমন যেন মাথাটা ঘুরে উঠলো ।
মাথা ঘোরা নিয়েই নিকিতা লক্ষ্য করলো সাদিকও কেমন যেন করছে । সাদিক কোন মতে বলল
-খাবার ! আমাদের খাবারে কিছু একটা মেশানো হয়েছিলো !!
নিকিতার মাথাটা আরও জোরে জোরে চক্কর মারতে লাগলো । পুরোপুরি জ্ঞান হারানোর আগে নিকিতা কেবল দেখলো সাদিক ওকে নিয়ে রুমের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করছে । কিন্তু নিকিতার পক্ষে আর পা তুলে রাখা সম্ভব হল না । মেঝের নরম কার্পেটে লুটিয়ে পড়লো সে !
আট
নিকিতার মনে হচ্ছে ও কোন আরামদায়ক কোন বিছানাতে ঘুমিয়ে আছে । বিছানাটা আস্তে আস্তে দুলছে । নিকিতার ওর ঘুমটা আরও একটু আরাম দায়ক হচ্ছে । কিন্তু তারপরেই ওর সব কথা মনে পড়ে গেল । ও কিভাবে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাচ্ছিলো । সেটা মনে হতেই সে ধড়ফড় করে জেগে উঠলো । উঠতেই অনুভব করলো ও একটা গাড়িতে রয়েছে । গাড়িটা চলছিল সেই দুলুনিতেই একটা আমারদায়ক অনুভুতি হচ্ছিলো । পাশে তাকাতেই দেখলো আবীর আহমেদের স্ত্রী নিলিমা আহমেদ বসে আছে । ওর শরীরের সাথে সিটবেল্ট দিয়ে আটকানো রয়েছে তাই ও নড়তে পারছে না । ওর হাতদুটো পেছন দিক দিয়ে বাঁধা রয়েছে ।
নিলিমা আহমেদের দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনারা আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন ?
নিকিতা যেন খুব একটা মজার প্রশ্ন করেছে, এমন একটা ভাব করে নিলিমা হেসে উঠলো ।
-তুমি আমার কাছে যাচ্ছো মাই ডিয়ার !
কথাটা নিলিমা আহমেদ বলে নি । কন্ঠটা চিনতে পারলো ও । আকসার আহমেদ ! ড্রাইভারের পাশে বসে আছে সে । ওর দিকে ফিরে আছে হাসি মুখে । ওর দিকে তাকিয়ে আবার বলল
-এবার থেকে তুমি আমার কাছেই আসবে !
নিকিতা অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো । এই নিয়ে দ্বিতীয়বার আকসার আহমেদকে দেখলো সে । প্রথম যেদিন বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে ওদের বাসায় এসেছিলো সেদিনই দেখেছিল । নিকিতার মনে একটা তীব্র ভয় দেখা দিল ।
কিন্তু তারপরেই মনে হল সাদিক কোথায় ? ওর খাবার কিছু মেশানো হয়েছিলো তার মানে সাদিকেরও খাবারে কিছু মশানো হয়েছিলো । সেও নিশ্চয়ই অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো । ওর মনের কথা মনেই রয়ে গেল । আকসার আহমেদ বলল
-তোমার বডিগার্ড কে খুজছো ?
-সাদিক কোথায় ?
-তোমার বডিগার্ডকে এমন জায়গায় পাঠিয়েছি যে ওর বডি আর কেউ খুজে পাবে না ।
-মানে ? কোথায় সে !
বলতে বলতেই আকসার আহমেদ জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো । নিকিতা সেদিকে তাকাতেই ওর চোখে পড়লো রাস্তার পাশের খাদের দিকে । ওর মন বিশ্বাস করতে চাইছে না । এমনটা হতে পারে না । কোন ভাবেই পারে না । আসকার আহমেদ যেন ওর মনের কথাটাই বুঝতে পারলো । বলল
-মাঝে মাঝেই এই পাহাড় থেকে গাড়ি ছিটকে পড়ে । তোমাদের জিপ গাড়িটাও ছিটকে পড়েছে ।
-না !
আসকার আহমেদ কেবল একটু হাসলো । আর কোন কথা বলল না ।
নিকিতার মনে একটু আগে যে ভয় করছিলো সে স্থানে একটা তীব্র হাহাকার জেগে উঠলো । সাদিককে ওরা মেরে ফেলেছে । এই কথাটা ও মেনে নিতেই পারছে না । একটু আগেও সে নিকিতার সাথে ছিল ।
নিকিতা দেখলো আকসার আহমেদ ফোন বের করে কাকে যেন ফোন দিচ্ছে । মৃদ্যু স্বরে বলল, আমরা আসছি । সব রেডি রাখো !
নয়
সাদিকের মনে হল কেউ যেন ওর নাম ধরে ডাকছে । খুব দুর থেকে মৃদ্যু ভাবে কানে আসছে কথাটা ! কেউ ওর নাম ধরে ডাকছে বারবার । যেন কোথাও ট্রেন ছুটে যাচ্ছে । এখনই ওকে উঠতে হবে । নয়তো খুব বড় একটা ক্ষতি হয়ে যাবে ।
কেউ সাহায্যের জন্য হাত বাড়াচ্ছে ওর দিকে । একটা আট বছরের মেয়ের মুখ ফুটে উঠলো ওর সামনে । ছেলেটার গায়ের রং ফুটফুটে ফর্সা । ওর দিকে তাকিয়ে চিৎকার করছে । বারবার আরবিতে কিছু বলছে । ভাষা না বুঝলেও ছেলেটা যে ওর কাছে সাহায্য চাইছে সেটা বুঝতে কষ্ট হল না । নিজের কাভার ছেড়ে উঠে দাড়ালো ও তার সাথে সাথেই একটা গুলি এসে লাগলো ওর বাম কাধে । আর একটা মর্টার সেল এসে পড়লো ঠিক ছেলেটা যেখানে পড়ে ছিল সেখানে ।
একটা তীব্র ধাক্কা খেয়ে সাদিক উড়ে চলে গেল পেছনের দিকে । জ্ঞান হারানোর আগে কেবল দেখতে পেল যে ছেলেটার ছিন্ন ভিন্ন শরীর এদিক ওদিক ছড়িয়ে পড়েছে ।
সাদিক চোখ মেলে তাকালো । এই একটা দৃশ্যই ওকে দিনের পর দিন ঘুমাতে দেয় নি । এই ঘটনার পরেই ও আর্মি থেকে রিজাইন দিয়ে চলে আসে !
সাদিক এদিক ওদিক তাকালো । একটা সমতল স্থানে সে পড়ে আছে । চারিদিকে বড় বড় গাছপালা দেখা যাচ্ছে । দুরে দেখা যাচ্ছে উচু পাহাড় । উঠতে গিয়ে লক্ষ্য করলো ওর শরীরের প্রচন্ড ব্যাথা । কিন্তু একটা জিনিস লক্ষ্য করলো যে ওর ভেতরে কোন হাড় ভাঙ্গে নি । কোন মতে উঠে বসলো ! বসতেই অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো ওর ঠিক সামনেই একটা আগুনের কুন্ডলী । রাত হয়ে গেছে অনেক । আকাশে তারা উঠেছে ।
ওকে কেউ বাঁচিয়ে নিয়ে এসেছে ?
কে ?
নিকিতা কোথায় ?
প্রশ্নটার উত্তর পাওয়া গেল খুব জলদি । বনের থেকে রাফায়েলকে বের হয়ে আসতে দেখলো ।
-আপনি ?
-জ্ঞান ফিরেছে তাহলে ? কেমন লাগছে এখন ?
-নিকিতা কোথায় ?
সাদিকের সব কিছু মনে পড়লো । কিভাবে এবং কত সহজে ওরা আকসার আহমেদের ঝালে ধরা পরলো সেটা ভাবতেই নিজেকের চুপ ছিড়তে ইচ্ছে করল ওর । সাদিক বলল
-এখন কি হবে ?
-আমি জানি না । নিকিতাকে আকসার আহমেদ ওর নিজের আস্তানায় নিয়ে গেছে ।
-চলেন তাহলে । ওখান থেকেই ওকে নিয়ে আসতে হবে !
রাফায়েল তবুও আগের জায়গাতেই বসে রইলো । বলল
-আমি সব জায়গাতে যেতে পারি না । সেখানে আমি ঢুকতেই পারবো না ।
-আপনি পারবেন না । আমি পারবো তো । আমি যাবো !
-আপনি গিয়েও কিচ্ছু করতে পারবেন না । নিকিতাকে কে কেউ বাঁচাতে পারবে না ।
সাদিক উঠে দাড়ালো । আবারও একটা তীব্র ব্যাথা ওর শরীর জুড়ে বয়ে গেল তবে সেটা গ্রাহ্য করলো না । উঠে দাড়িয়ে বলল
-আপনি বসে থাকুন । আমি যাবো ।
-আপনি মারা পড়বেন । গিয়ে কোন লাভ হবে না ।
-পড়লে পড়বো ! কিন্তু দ্বিতীয়বার আমি এই বোঝা মাথায় নিয়ে বাঁচতে পারবো না । আপনি জানেন আফগানস্থানে আমি যখন ছিলাম আমার চোখের সামনে আট বছরের একটা ছেলে মর্টার সেলের আঘাত পেয়ে মারা গিয়েছিলো । ছেলেটার নাম ছিল আয়াত । আমরা যেখানে ক্যাম্প করে ছিলাম ওটার ঠিক পাশেই ছিল ওদের বাসা । প্রায়ই বিকেলে আমি ওদের সাথে ফুটবল খেলতাম । ওদের বাসায় খানাও খেয়েছি আমি । ওদের কে কথা দিয়েছিলাম যে আমি ওদেরকে রক্ষা করবো । আমি পারি নি । কিন্তু এইবার আর তা হবে না । নিকিতা আমার উপর ভরসা করেছিলো । আমি ওকে রক্ষা করবো, যদি না পারি তাহলে রক্ষা করতে গিয়ে মারা পড়বো ! আপনি আমাকে সাহায্য করলে করবেন নয়তো না করবেন কিন্তু আমি যাবোই ।
দশ
তারপর কেটে গেছে আরও একটা সপ্তাহ । এই একটা সপ্তাহে সাদিককে আটকে রাখা বেশ কষ্টের ছিল । সে কোন ভাবেই অপেক্ষা করতে রাজি নয় । রাফায়েল তাকে অনেক কষ্টে ধরে রেখেছিলো । তাকে বলেছিলো একটা ক্ষুদ্র সম্ভবনাই আছে । নির্দিষ্ট সময়ের আগে নিকিতাকে ওরা কিছুই করবে না । যখন ইমুপ্সা নিকিতার দেহে প্রবেশ করা শুরু করবে তখনই বলা চলে আসল সুযোগ । এই সময়টাতে আকসার আহমেদের উপর থেকে ইমুপ্সা প্রভাব থাকবে না । সে একেবারে মানুষ হবে এবং এই সময়টাতেও ইমুপ্সা একেবারে শক্তিহীন থাকবে । আমাদের তখনই হামলা করতে হবে ।
সাদিক বলল
-কিন্তু এর আগেই যদি ওরা নিকিতাকে কিছু করে ফেলে ?
রাফায়েল বলল
-কোন ভাবেই না । সব কিছুর একটা নির্দিষ্ট সময় আছে । এক মিনিটও ওদিক ওদিক হওয়ার জো নেই । সেই নির্দিষ্ট সময়ের আগে ওরা নিকিতাকে কিছুই করবে না । এমন কি ওর কোন ক্ষতিও হতে দিবে না । এমনি নিকিতা নিজে চাইলেও সেটা করতে পারবে না ।
এই সাতটা দিন সাদিকের জন্য অপেক্ষা করা অনেক কষ্টের ছিল কিন্তু ওর কিছুই করার ছিল না । এই সাত দিন কেবলই নিজেকে তৈরি করার কাজে লাগিয়েছে । রাফায়েলের ভাষ্যমতে আকসার আহমেদ তার মুন্সগঞ্জের ফার্মহাউজের নিচে ইমুপ্সার মন্দির বানিয়েছে । সেখানেই হবে তার যাবতীয় পুজা আর্চনা । সেখানেই ওদের যেতে হবে ।
ওরা যখন নির্দিষ্ট স্থানে এসে হাজির হল তখন রাত প্রায় এগারোটা বেজে গেছে । ওরা অপেক্ষা করতে লাগলো ফার্ম হাউজ থেকে বেশ খানিকটা দুরে । দুর থেকে ফার্ম হাউজটা যেন খাঁ খাঁ করছে । কোথাও কেউ নেই মনে হচ্ছে । কিন্তু ওরা জানে পুরো বাসাটাকে নিরাপত্তা দিয়ে রাখা হয়েছে । দরজা দিয়ে প্রবেশ করা তো দুরে থাকুক, বাড়ির দশ মিটারের ভেতরে কেউ প্রবেশ করতে গেলেই তার শরীরের ঝাঝরা হয়ে যাবে বুলেকের আঘাতে ।
রাফায়েল বলল
-আর কিছু সময় পরেই প্রতিস্থাপন শুরু হবে । অর্থাৎ আকসার আহমেদ যে বলয়ের মাঝে থেকে এসেছে সেটা কেটে যাবো । যত সময় ট্রান্সফার চলবে তত সময় তার অ্স্বাভাবিক কোন ক্ষমতা থাকবে না । এই সময়েই আপনাকে ঐখানে প্রবেশ করতে হবে নিকিতাকে আলাদা করতে হবে । আর সম্ভব হলে এই ছুরিটা আমুলে বিধিয়ে দিতে হবে ইমুপ্সার বুকে । কিন্তু এটা আপনাকে করতে হবে একা । আমি এই বাসার ভেতরে ঢুকতে পারবো না ।
সাদিক বলল
-আপনি তখনও এই কথা বলেছিলেন । কেন ঢুকতে পারবেন না ?
-আপনি আমাকে কি ভাবছো আমি ঠিক জানি না তবে আমি আপনার মত নই । আমার জন্ম কিংবা আমি যেভাবে এখানে এসেছি সেটা আমাকে এটার অনুমুতি দেয় না । ইমুপ্সা এন্টিটিদের সাথে সরাসরি যুদ্ধে জড়ানোর ক্ষমতা আমার নেই যেমনটি ওদেরও নেই । আমি কেবল তোমাকে সাহায্য করতে পারি । তবে ....।
সাদিক বলল
-তবে কি ?
রাফায়েল নিকের পকেট থেকে একটা সাদা শিশি বের করে ওর হাতে দিল । তারপর বলল
-যদি মনে হয় শেষ রক্ষা কোন ভাবেই হল না তখন এই বোতলটা মাটিতে ফাঁটিয়ে ফেলবেন । আমি হয়তো তখন কোন সাহায্য করতে পারবো । আর আপনার সাহায্যের জন্য আমি আরেকটা ব্যবস্থা করেছি ।
-কি ?
-সময় হলেই দেখতে পারবেন । কিন্তু প্রধান কাজ আপনাকেই করতে হবে !
সাদিক ঘড়ির দিকে তাকালো । আর মাত্র কয়েক মিনিট বাকি ! সময় যেন কাটছেই না । বারবার নিকিতার চেহারাটা ফুটে উঠছে সামনে । সাদিক মনে মনে বলল, আর কটা মিনিট নিকি আমি আসছি । তোমাকে কিছু হতে দিবো না । কিছু না !
ঘড়িতে একটা বাজতেই বাড়ির গেটের কাছে একটা বড় বোমা ফাঁটলো ! সাদিক খানিকটা কেঁপে উঠলো । এটা কোন ভাবেই আশা করে নি । রাফায়েলের দিকে তাকালো । ততক্ষনে গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে ।
রাফায়েলের দিকে তাকিয়ে বলল
-এরা কারা ?
-আর্মি অব গড ! মনে নেই নিকিতার উপর যারা হামলা করেছিলো ! আমার বাসায় যারা আক্রমন করেছিলো ।
-এরা এখানে কেন ?
-এরা আপনাকে ব্যকআপ দিবে । সবার চোখে এড়িয়ে ভেতরে ঢুকতে সাহায্য করবে ! আকসার আহমেদের আর্মিরা ব্যস্ত থাকে এদের নিয়ে আপনার কাজ হবে আকসার আহমেদ সামলানো !
সাদিক আর কিছু ভাবলো না । এখনই তাকে ভেতরে যেতে হবে । সময় হয়ে গেছে । হাতে খুব বেশি সময় নেই ।
এগারো
নিকিতার খুব বেশি ভয় করছে । ওকে একটা বেদির উপর শুইয়ে রাখা হয়েছে উপুর করে । ওর হাত দুটো মাথার পাশ দিয়ে বেদীর উপরে শোয়ানো । সে দুটো হাত লোহার আংটা দিয়ে দিয়ে আটকানো বেদির সাথে । একই ভাবে গলার কাছেও একটা আংটা দিয়ে গলাটাও আটকানো শক্ত ভাবে । একই ভাবে দুই পা এবং কোমড়ের কাছেও আটকানো লোহার আংটি দিয়ে । ওর শরীরের কোন প্রকার কাপড় নেই । পুরো শরীরে তেল জাতীয় কিছু মাখানো হয়েছে । নিকিতা একটুও নড়তে পারছে না । ওর চোখ দিয়ে কয়েক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো । তখনই দেখলো বেদির পাশে সেই নিলিমা আহমেদ এসে দাড়ালো । মহিলার চেহারা ভয়ানক সুন্দর কিন্তু নিকিতার কেবলই মনে হচ্ছে সেখানে একটা কুৎসিত কিছু রয়েছে । নিকিতার দিকে তাকিয়ে বলল
-আর কিছু সময় সোনা । কোন কষ্ট হবে না তোমার !
নিকিতা কিছু বলতে গিয়েও বলল না । চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে কিন্তু সেটা আটকে রেখেছে । বারবার সাদিকের কথা মনে হচ্ছে । নিকিতা কোন মতে মাথা ঘুরিয়ে ডান দিয়ে তাকিয়ে দেখলো নিলিমা আহমেদ নিজের পোষাক খুলে পাশের বেদির উপর শুয়ে পড়লো । একই ভাবে তার হাত পাও আটকে দেওয়া হল ।
তারপর একটা অদ্ভুদ মন্ত্র কানে এল ওর । কিছু পরপরই সেই আওয়াজটা কানে এল । যেন ছোট বেলার ঘুম পাড়ানির গানের মত । নিকিতা বুঝতে পারলো গানটা ওকে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছে । নিকিতা আপ্রান চেষ্টা করলো জেগে থাকার কিন্তু খুব একটা লাভ হল না । পুরোপুরি ঘুমানোর আগে কেবল অনুভব করলো কোথাও যেন একটা বিস্ফোরনের আওয়াজ হল ।
আকসার আহমেদ চমকে উঠলো । বাইরে তীব্র গোলাগুলির আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে । আকসার আহমেদ একটু টেনশন পড়ে গেল । এই সময় তার ক্ষমতা বলতে গেলে শূন্যের কাছা কাছি । অবশ্য যে বাহিনী তিনি ঠিক করেছেন টা দিয়ে বাইরের সব কিছু অন্তত ঘন্টা খানেক আটকে রাখা সম্ভব । আর এই কেবল এই ঘন্টাখানেকই তার দরকার । একমাত্র একবার ট্রান্সফার শেষ হোক তাহলে আর কোন সমস্যা নেই । দেশের পুরো বাহিনী এসে দাড়ালেও কেউ তার কিছু করতে পারবে না ।
ট্রান্সফার শুরু হয়ে গেছে । তিনি দেখতে পাচ্ছেন কিভাবে বিন্দু দিন্দু প্রানশক্তি ইমুপ্সার শরীর থেকে নিকিতার শরীরের ভেতরে যাচ্ছে । তিনি মন্ত্রমুগ্ধের মত চেয়ে দেখতে লাগলো ।
আর ঠিক সেই সময়েই খুব কাছেই গুলির আওয়াজ হল । আকসার আহমেদ চমকে গিয়ে দেখলেন মন্দিরের দরজাটা নড়ে উঠছে । একটা প্রহরী উল্টে পড়লো তারপরই তাকে দেখতে পেল সে ।
মেজর সাদিক !
এই লোক এখানে কিভাবে এল ! আকসার আহমেদ কি করবে বুঝতে পারলেন না । এতো গুলো বছর ধরে তিনি এই কাজ গুলো করে যাচ্ছে কোন সমস্যা হয় নি কিন্তু আজকে কি হল ?
পিস্তলটা দিকে তাকিয়ে রইলো এক ভাবে । কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না । এখন যে যাই করুক না কেন ভাগ্য তার পক্ষ্যে থাকবে না । মেজর সাদিক বলল
-খবরদার চালাকির চেষ্টা করবেন না । একটুও নড়বেন না !
ট্রান্সফার শেষ হতে এখনও বেশ কিছুটা সময় বাকি ! এখন কি করবে সে ! আকসার আহমেদ বলল
-দেখ মেজর ! এই মেয়েটা মরলে তোমার কিছু যাবে আসবে না । এটা কেবলই তোমার একটা জব আর কিছু না ! আমার সাথে চলে এস জীবনে যা চাইবে তাই পাবে !
সাদিক কোন কথা বলে আরেকটু এগিয়ে এল । নিকিতা থেকে কয়েক হাত দুরে । ওর দিকে তাকিয়ে রইলো একভাবে । আস্তে আস্তে নিকিতার চেহারা বদলাতে শুরু করেছে । সাদিক একভাবে সেদিকে তাকিয়ে রইলো । আকসার আহমেদের মনে হল এই সুযোগ । তিনি সাদিককে লক্ষ্য করে লাফ দিল । কিন্তু সেখানে পৌছাতে পারলো না । তার আগেই সাদিক সাবধান হয়ে উঠেছে । দুই পা পিছিয়েই সোজা গুলি করলো । গুলিটা লাগলো আকসার আহমেদের ডান কাধে । তিনি পড়ে গেলেন । কাধ চেপেই গোঙ্গাতে লাগলো !
সাদিককে দ্রুত কাজ করতে হবে । রাফায়েল বলেছিল নিকিতাকে যথা সম্ভব বেদির উপর থেকে সরিয়ে দুরে নিয়ে রাখতে হবে । তাহলেই ট্রান্সফার বন্ধ হয়ে যাবে ! হাত পায়ের আংটা গুলো খুলে দিয়ে ওকে বেদি থেকে দুরে নিয়ে এল । নিকিতা তখনও অচেতন হয়ে পড়ে আছে । নিকিতার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা করলো না । আগে ইমুপ্সাকে শেষ করতে হবে ।
সাদিক রাফায়েলের দেওয়া ছুরিটা হাত নিয়ে অন্য বেদির সামনে এসে দাড়ালো । যেখানে নিলিমা চৌধুরী শুয়ে আছে । মেয়েটার দিকে তাকিয়ে সাদিক কিছু সময় ইতস্তত করলো । নিঃস্পাপ একটা মেয়ে শুয়ে আছে যেন । এই আস্তে ছুরিটা তার বুকে বিধিয়ে দিতে সাদিকের মন চাইলো না । কিন্তু এই অশুভ জিনিসটাকে এই পৃথিবী থেকে দুর করতেই হবে ।
ছুরি তুলে তখন সে নামিয়ে আনতে যাবে তখনই পেছন থেকে একটা কিছু এসে আঘাত করলো তাকে । সাদিকের হাত থেকে ছুরিটা দুরে পরে পড়ে গেল । পেছনে তাকিয়ে দেখে আকসার আহমেদই উঠে দাড়িয়েছে । তার হাতে একটা লোহার রড । সেটা নিয়ে আবার সাদিকে মারতে এল কিন্তু এইবার সাদিক প্রস্তুই ছিল । ডান দিকে পাশ কাটিয়ে ফেলল । তারপর আকসার আহমেদের ডান হাতটা ধরে ফেলল । এই পাশেই তার গুলি গেছেছিলো । তারপর দ্রুত দুটো ঘুসি চালালো মুখে আর পেটে ।
হাত থেকে রড পরে গেল । সে নিজেও মাটিতে পড়ে গেল আবার । শেষ একটা লাথি চালালো তার পেট বরাবর । তারপর আবার ছুটলো বেদির দিকে । ছুরিটা বিধাতেই হবে ।
ছুরিটা একটু দুরেই পরে ছিল । সেটা হাতে নিয়ে আবারও ফিরে এল সেই বেদির কাছে । এবার ছুরিটা তুলে ধরলো উপরে । কিন্তু তখনই দেখলো বেদিতে শুয়ে থাকা নিলিমা ওরফে ইমুপ্সা চোখ মেলে তাকিয়েছে । এক ঝটকাতে হাতের আংটা ছুটিয়ে ফেলল সে । তারপর সাদিকে এক হাত দিয়ে ধাক্কা দিল । সাদিক যেন উড়ে গিয়ে পড়লো সামনের দেওয়ালে !
একে একে সব গুলো আংটা পাট কাঠির মত খুলে ফেলল নিলিমা আহমেদ । সাদিক অবাক বিশ্ময়ে দেখলো সুঠম দেহের এক নগ্ন সুন্দরী নারী ওর দিকে এগিয়ে আসছে । কেবল তার চোখে যেন আগুন জ্বলছে !
ইমুপ্সা এসে আবারও সাদিককে এক হাত দিয়ে উচু করে তুলে ধরলো । ছুরে ফেলে দিলো আবারও । মাথা ঠুকে গেল ওর দেওয়ার সাথে । মাথাটা যেন ঝিমঝিম করতে লাগলো !
সাদিক কোন ভাবেই বুঝতে পারছিলো না যে এই মেয়ের গায়ে এতো আশুঢ়ে শক্তি কিভাবে এল । কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছিলো যে এই অশুভ মেয়ের কাছ থেকে তার মুক্তি নেই । হঠাৎই ইমুপ্সা বলে উঠলো
-ঐ মেয়ের জন্যই তুই এমন টা করলি ? আমাকে গ্রহন করতে দিলি না । দাড়া আগে ওকেই এই পৃথিবী থেকে বিদায় করে নেই ।
এই বলে ঘুমন্ত নিকিতার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো । সাদিকের মত এই এতো কষ্ট যাকে বাঁচানোর জন্য সেই নিকিতাকেই মারতে যাচ্ছে । নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে উঠে দাড়ালো । তখনও সেই ছুরিটা ওর হাতেই ধরা রয়েছে । দুইবার ছুড়ে ফেলার পরেও সেটা হাত থেকে ছুটে যায় নি ।
সাদিক নিলিমার শরীরের উপরে গিয়ে পড়তে গেল কিন্তু লাভ হল না । তার আগেই একটা হাত দিয়ে নিলিমা ওকে ধরে ফেলল । আগের মতই ওকে ছুড়ে ফেলে দিল ! এইবার এতোই জোড়ে দেওয়ার সাথে ধাক্কা খেল যে সাদিকের মনে হল ও আর বুঝি উঠতেই পারবে না । কেবল চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলো নারি মুর্তিটা নিকিতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ।
আর কিছু চিন্তা করলো না সে । রাফায়েলের দেওয়া শিশিটা পকেটে থেকে বের করলো । তারপর শরীরের সমস্ত শক্ত দিয়ে সেটা মেঝেতে আছার মারলো ।
সাথে সাথেই পুরো ঘর জুড়ে একটা একটা তীব্র আলোর ঝলকানি দেখতে পেল । সাদিক দেখলো সেই শিশির ভেতর থেকে একটা সাদা আলোর কিছু বের হয়ে দাড়িয়েছে ওর সামনে । অনেক টা ধোয়ার মত গুচ্ছ হয়ে দাড়িয়ে আছে । তারপর সেটা আস্তে করে সাদিকের নাক মুখ দিয়ে ওর ভেতরে প্রবেশ করলো । সাদিক অনুভব করলো ওর ভেতরে অন্য কিছু যেন একটা প্রবেশ করছে । নিজের বুকের হৃদস্পন্দনটা দ্রুত লাফাতে লাগলো !
বারো
নিকিতার যখন চোখ মেলল একটা অদ্ভুদ দৃশ্য দেখতে পেল । সেই নগ্ন মেয়েটির সাথে সাদিক লড়াই করছে । আরও ভাল করে বলল দুজন যেন পুরো ঘর ময় ছুটাছুট করছে । সাদিকের হাতে একটা ছুরি সেটা নিয়ে সে মেয়েটিকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে আর েময়েটিও যেন পালিয়ে বেড়াচ্ছে । সাদিকের কাছ থেকে পালাতে চাইছে । প্রতিবার আঘাত করতে চাইছে কিন্তু সাদিক সেটা ফিরিয়ে দিচ্ছে এবং পাল্টা আঘাত করছে । আস্তে আস্তে নিলিমা আহমেদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়ছে । তারপর একটা সময় সে হার মেনে মাটিতে পড়ে গেল !
তারপর ইমুপ্সা বলে উঠলো
-আমাকে তুমি মারতে পারবে না । মারলে তুমিও মারা যাবে ! তোমাকে ওরা খুজে খুজে মারবে !
এই কথা শুনে সাদিক যেন হেসে ফেলল । বলল,
-আমি এখানে নেই ইমুপ্সা। এটা আমি না । এটা মেজর সাদিক যাকে তুমি আঘাত করেছো একটু আগে । সে তোমাকে মেরে ফেলবে । আমি না !
-না । তুমি এটা করতে পারো না ।
সাদিক আবারও হেসে ফেলল
-আমি করছিও না । এটা এই ছেলেই করবে । দেখো কিভাবে করে !
এই বলে সাদিক তার হাতে ধরা ছুরিটা উপরে তুলে ধরলো !
নিকিতা দেখলো আবার সাদিকের শরীরটা একটা ঝাকি খেল । নিকিতার মনে হল সাদিকের শরীর থেকে কিছু একটা যেন আলাদা হয়ে গেল ।
তারপর সাদিক সেই ছুরিটা আমুলে বিঁধিয়ে দিল নিলিমার বুকের ভেতরে ...
কিছুটা সময় চটফট করে করতে করতে নিলিমার দেহটা শান্ত হয়ে গেল । চোখের সামনে সেটা মাটির ছাইয়ে পরিনত হত !
নিকিতা তখনই তাকিয়ে সাদিকের দিকে । ওর এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না যে সাদিক বেঁচে আছে ও নিজে বেঁচে আছে । ও তো ভেবেছিলো জীবনে আর কোন দিন এই মুখটা দেখতে পারে না যে ! কোন রকম উঠে গিয়েই সে সাদিককে জড়িয়ে ধরলো শক্ত করে ! ও নিশ্চিৎ জানে সব ভয় কেটে কেছে তারপরেও ও সাদিকের বুকঐ নিজেকে বেশি নিরাপদ মনে করলো !
পরিশিষ্ট
সেই ঘটনার পরে কেটে গেছে অনেক দিন ।আকসার আকাসার আহমেদকে ওরা আর কিছু করে নি । আর কিছু করার দরকারও পড়বে না । সে এমনিতেও ধ্বংশ হয়ে যাবে । শয়তানের সাহায্য নিয়ে যে সম্পদ তিনি অর্জন করেছেন সেটা এমনিতেও টিকে থাকবে না ।
অবঃ মেজর সাদিক এখনও নিকিতার বডিগার্ড হিসাবেই রয়ে গেছে । যদিও সাদিক আর থাকার ইচ্ছে নেই কিন্তু নিকিতা তাকে কোন ভাবেই যেতে দিবে না । তার বাবাও মেয়ের ইচ্ছে বুঝতে পেরেছেন বিধায় তিনিও সাদিকে থেকে যেতে বলেছেন।
ঐ ঘটনার কয়েকদিন পরে সাদিক আর নিকিতা দুজনেই হাজির হয়েছিলো পুরান ঢাকাতে কিন্তু হাজার চেষ্টা করেও রাফায়েলের সেই বাসাটা তারা খুজে পায় নি । কাউকে জিজ্ঞেস করেও খোজ পাওয়া যায় নি । বাড়িটা যেন গায়েব হয়ে গেছে ।
সর্বশেষ এডিট : ৩০ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৪৯