অপুকে আসতে দেখেই নিহিনের মনটা খারাপ হল । ছেলেটা ওর দিকে তাকিয়ে হাত নাড়ছে । নিজেকে আরেকবার জিজ্ঞেস করলো আসলেই কি সত্যি কথাটা বলতে চায় অপুকে ? যদি কথাটা না বলে তবে হয়তো কোন দিন অপু সেটা জানতে পারবে না । ওকে যেভাবে ভালবেসে যায় সেখাবেই ভালবেসে যাবে । কিন্তু সেটা নিহিন চায় না । ও চায় না কোন মিথ্যা দিয়ে ওর ভালবাসা টিকে থাকুক । আর এখন তো ওকে সত্যিই সত্যিই ভালবাসে । সেই ভালবাসাতে কোন প্রকার খাঁদ নেই, কোন ভেজাল নেই, কোন মিথ্যা নেই ।
অপুর মুখে হাসিটা দেখে নিহিনের মনটা আরও একটু খারাপ হয়ে গেল । আজকে ছেলেটার মন নিশ্চয়ই খারাপ হবে খুব । কিন্তু মন খারাপ হলেও আজকে সত্যি কথাটা ওকে বলতেই হবে । নয়তো ও কিছুতেই শান্তি পাবে না । এই অপরাধের দায় টা নিয়ে নিহিন আর থাকতে পারছে না ।
কিন্তু সত্যি বলার পর ?
নিহিন জানে না কি হবে ?
নিশ্চয়ই অপু খুব রাগ করবে ? চিৎকার চেঁচামিচিও করবে । তারপর ও ওকে যা বলবে তা হয়তো বিশ্বাস করবে না তবুও বলবে । হয়তো ওকে ছেড়ে চলেও যাবে । নিহিন তবুও আজকে সত্যি কথাটা বলবেই ।
অপু ওর পাশে এসে বসতেই বলল
-কি ব্যাপারে মহারানী মন খারাপ কেন ?
নিহিন কোন কথা বলল না । অপুর দিকে তাকিয়ে রইলো এক ভাবে । ছেলেটা ওর দিকে কেমন চোখে তাকায় । নিহিন যতবার এই দৃষ্টি দেখেছে ততবার আরও নিজেকে অপরাধি মনে হয়েছে । বারবার নিজেকে একটা প্রতারক মনে হয়েছে । অপু আবার বলল
-কি ব্যাপার এতো সিরিয়াস কেন ? আজকে আমার সাথে ব্রেক আপ করার ইচ্ছে আছে নাকি !
নিহিন কোন কথা না বলে বলল
-বসো । কথা আছে ! তবে কথা শুরুর আগে আমার দিকে তাকিয়ে বল আমাকে তুমি ভালবাসো ?
অপু হাসতে হাসতেই বলল
-এটা আবার কি ধরনের প্রশ্ন হল শুনি ? তুমি জানো না ?
এই বলে অপু ওর দিকে তাকালো । অপুর চোখ চিৎকারে বলছে যে সে নিহিনকে ভালবাসে ! অপু বলল
-তুমি বাসো তো ?
নিহিন কোন কথা বলতে পারলো না প্রথমে । প্রথমে আসলেই সে অপু কে ভালবাসতো না । কিন্তু এখন অপু ছাড়া সে অন্য কোন কিছু বুঝে না । চিন্তাই করতেই পারে না কিছু । নিহিন জানে আজকে সত্যি কথা বলার পরে অপু ওকে ছেড়ে যেতে পারে । কিন্তু তবুও সত্যিটা ওকে না জানিয়ে ও ঠিক থাকতে পারছে না ।
শুরুটা একদম খেলার জন্যই হয়েছিল । অপু হচ্ছে আদিবার কাজিন । আদিবার সাথে ও এক সাথে কলেজে পড়েছে । পরে আদিবা মেডিক্যালে চান্স পেয়ে যায় আর ও এখানে এসে ভর্তি হয় । এখানেই এসে দেখা হয় অপুর সাথে । ও যে ডিপার্টমেন্টে পড়ে সেখানের এক ব্যাচ সিনিয়র ব্যাচ । সেটাও নিহিনের ঠিক চেনার কথা না । কিন্তু একদিন আদিবা এসে ওকে অপুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল । তারপর আসল কথা বলল ।
আদিবার সাথে আগে নাকি অপুর একটা সম্পর্ক ছিল । ঠিক সম্পর্ক না, অপু নাকি আদিবাকে পাত্তা দেয় নি । তাই আদিবার একটা রাগ আছে অপুর উপর । সে অপুর উপর প্রতিশোধ নিতে চায় । এই জন্য নিহিনকে ঠিক করে । প্রথমে কাজ হবে অপুর সাথে নিহিন একটা সম্পর্ক তৈরি করবে । তারপর অপু যখন ফল করবে তখন তাকে একটা কঠিন ছ্যাকা দিতে হবে । প্রথমে নিহিন ঠিক রাজি হয় নি কিন্তু আদিবার জোড়াজুড়িতে রাজি হয়ে গেল ।
স্কুলে থাকার সময় থেকেই নিহিনের পেছনে অনেক ছেলে ঘুরেছে । কিন্তু নিহিন কাউকে কোন দিন পাত্তা দেয় নি । তবে চাইলেই অনেক ছেলের সাথেই প্রেম করতে পারতো । ছেলেটা কেবল ওর জন্য পাগল ছিল । কত মানুষ যে ওর পেছনে ঘুরেছে । এমন কি কলেজের এক স্যারও নিহিনকে পছন্দ করতো । কিন্তু লজ্জার কারনে ঠিক বলতে পারে নি । নিহিন শুনেছে সেই স্যার নাকি ওর বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোর কথা ভাবছে । আদিবা তাই নিহিনকে বেঁছে নিয়েছে । অপু ওকে মানা করতে পারবে না ! ঠিক ঠিক প্রেমে পড়ে যাবে !
তারপর থেকেই খেলা শুরু হয়ে গেল । নাম্বারটা আদিবার কাছ থেকেই নিয়ে নিল । তারপর ফোনে যোগাযোগ শুরু । এক কথা দুই কথা বলতে বলতে একটা সময় অপু সত্যিই নিহিনের প্রেমে পড়লো । কিন্তু সমস্যা বাঁধলো অন্য খানে । নিহিন নিজেও অপুর প্রেমে পড়ে গেল । বিশেষ করে ছেলেটার পাগলো গুলো ওকে অদ্ভুদ ভাবে আকর্ষন করতে শুরু করলো । কোন ভাবেই নিজেকে অপুর কাছ থেকে দুরে রাখতে পারলো না । শেষে যখন বুঝতে পারলো যে আর চেষ্টা করে লাভ নেই তখন সেটা বাদ দিল । কিন্তু তারপর থেকে এই অপরাধ বোধ ওকে পেয়ে বসলো । কিছুইতেই সেটা থেকে বের হতে পারছিলো না । শেষে সিদ্ধান্ত নেয় যে আজকে সব সত্যি কথা বলেই দিবে । আগে হয়তো ওকে ভালবাসতো না কিন্তু ওকে এখন তো ভালবাসে । এবং সেই ভালবাসাতে কোন খাদ নেই ।
সব কিছু যখন অপুকে বলল অপু ওর দিকে এক ভাবে তাকিয়ে রইলো । মুখের সেই হাসিটা আর নেই আগের মত । নিহিন কথা শেষ করে নিজেই মাথা নিচ করে রইলো । কখন যে ওর চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে সেটা ও নিজেই জানে না । অপু কোন কথা না বলে উঠে চলে গেল । নিহিন কেবল একভাবে ওর চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে রইলো । একবার ডাকও দিতে পারলো না ।
বাসায় ফিরে সারাটা বিকেল বালিসে মুখে গুজে কাঁদতে লাগলো । নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারছিলো না । কোন ভাবেই না । সন্ধ্যার দিকে ওর দরজায় আওয়াজ এল । নিহিনের মা দরজার ওপাশ থেকেই জানালো যে আদিবা এসেছে ওর সাথে দেখা করতে ।
নিহিনের একবার মনে হল বলে যে আদিবাকে চলে যেতে কিন্তু বলল না । দরজা খুলে দিয়ে আবার নিজের বিছানাতে শুয়ে পড়লো । ভেবেছিলো হয়তো কেবল আদিবাই এসেছে কিন্তু দরজার পেছন দিয়ে যখন অপুকেও ঢুকতে দেখলো তখন নিজের কাছেই ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিলো না । কোন কথা বলল না কেবল লাফ দিয়ে এসে অপুকে জড়িয়ে ধরলো । কোন ভাবেই ওকে আর ছাড়বে না । যেতে দিবে না কোন ভাবে । কাঁদতে কাঁদতে বলল
-আমি তোমাকে ছাড়া কোন ভাবেই থাকতে পারবো না । কোন ভাবেই না ।
-আরে বাবা আস্তে আস্তে ! তোমার আম্মু চলে আসবে ।
-আসুক । আই ডোন্ট কেয়ার ! আমি তোমাকে ছাড়বো না । তোমাকে ছাড়া আমার চলবে না । কোন ভাবেই না । তুমি আমাকে ছেড়ে যেতে পারবে না ।
-আচ্ছা বাবা যাচ্ছি না তো । যাওয়ার ইচ্ছে থাকলে কি আসতাম ?
-গিয়েছিলে তো ! যাও নি ।
-আচ্ছা বাবা বুঝতে পারছি । এখন ছাড় । তোমার আম্মু চলে আসবে ।
আদিবা বলল
-নাটকের নাটক নায়িকার মিলন শেষ । এখন ঢং বন্ধ কর তো !
বলেই সে অপুর দিকে তাকালো । দুইজনের ভেতরে একটা আলাদা দৃষ্টি বিনিময় হল যা হয়তো নিহিন কোন দিন বুঝতে পারবে না ।
পরিশিষ্টঃ
কলেজে থাকতেই অপু নিহিনকে দেখেছিল কিন্তু সেটা কেবল নিজের কাছেই রেখে দিয়েছিলো । তবে আবার যখন নিহিনকে নিজের ডিপার্টমেন্টে দেখলো তখন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না । আদিবার কাছে গিয়ে হাজির হয়ে গেল । আদিবা পরিস্কার বলে দিল যে নাম্বার হয়তো ও দিতে পারবে তবে নিহিনকে সে রাজি করাতে পারবে না । আর নিহিন রাজি হবে কি না সেটাও নিশ্চিত না । কলেজে থাকা কালিন সময়ে অনেক ছেলেই ওর পেছনে ঘুরেছে কিন্তু নিহিন কাউকে পাত্তা দেয় নি । অপুকেও দিবে না ।
তখনই অপু ওকে বুদ্ধিটা দিল । যা যা শিখিয়ে দিল তাই বলতে বলল । আদিবা বলল
-তুই কি নিশ্চিত যে নিহিন তোর প্রেমে পড়বে ? যদি না পড়ে তখন ?
-না পড়লে না পড়ুক । কিন্তু আমার বিশ্বাস ও পড়বেই । আমি ওকে সত্যিই সত্যিই অনুভব করাতে পারবো যে আমি ওকে ভালবাসি । আর এই এটা যদি একবার ও বুঝতে পারে তখন ও দুরে থাকতে পারবে না ।
অপুর কথাই সত্যি হল । নিহিন আসলেই অপুর প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো । সে নিজেকে অপরাধি মনে করছে কিন্তু আসল ঘটনা সে হয়তো কোন দিন জানতে পারবে না । অবশ্য সেটা জানার খুব একটা দরকারও নেই । অপু হয়তো একটা বাঁকা পথ বেছে নিয়েছে তবে সেটা তো নিহিনকে পাওয়ার জন্যই । যুদ্ধ আর ভালবাসা জয়ের জন্য সব কিছু করা যায় !
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:০৩