কতটা সময় আমি ঘুমিয়ে ছিলাম আমি নিজেই বলতে পারবো না । হঠাৎ করেই আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল । একটু যেন শীত শীত করছে । নভেম্বরের শুরুতে শীত পরে যাওয়ার কথা কিন্তু ঢাকা শহরের যে কখন শীত আসবে সেটা কেউ বলতে পারবে না ।
চোখ মেলার সাথে সাথেই যে কথাটা সবার আগে মনে হল সেটা হল, ঘর অন্ধকার কেন ? আমিতো কখনও লাইট অফ করি না । আর একটা ডিম লাইট তো অন্তত জ্বালানো থাকেই । তাহলে পুরোপুরি অফ কেন হল ? ঘরের সব লাইট অফ দেখে আসলেই একটু অবাক হলাম । চোখ যখন দরজার দিকে দিবো তখনই চোখ গেল তখনই একটু চমকে উঠলাম ।
প্রতিদিন ঘুমানোর আগে আমার বই পড়ার অভ্যাস রয়েছে । সেই পড়তে পড়তেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি আমি বলতে পারবো না । অন্য দিন সুপ্তি টেবিল ল্যাম্পটা বন্ধ করে দেয় । কিন্তু আজকে ও বাসাতে নেই । তাই কেউ লাইট অফ করবে না । সেই হিসাবে লাইট বন্ধ হওয়ার কথা না । কিন্তু লাইটটা বন্ধ, এমন কি ডিম লাইটও জ্বলছে না ।
এসব চিন্তাই আমার মাথার ভেতরে ঘুরপাক খাচ্ছে দরজার পাশের মুর্তিটার দিকে তাকিয়ে । ঠিক সেই সময় মুর্তিটা উঠে দাড়ালো । তখনই আমি ওকে চিনতে পারলাম ।
সুপ্তি !
আমার দিকে এগিয়ে আসতেই আমি আরও অবাক হয়ে গেলাম । ওর তো আজকে ফিরে আসার কথা না । ওর অফিসে নাকি আজকে প্রচুর কাজ । পুরো টিম আজকে অফিসেই থাকবে । কালকেই নাকি টেন্ডার সাবমিট করার শেষ দিন ।
সুপ্তি কাছে আসতেই আমি বললাম
-কি ব্যাপার কখন এলে ?
সুপ্তি কিছু সময় আমার দিকে তাকিয়ে রইলো । কোন কথা বলল না । আমি অন্ধকারে ওর চেহারা ঠিক মত দেখতেও পাচ্ছি না । তবে ও যে আমার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা বুঝতে আমার কষ্ট হল না ।
ওর কি কোন কারনে মন খারাপ ? অফিসে কোন ঝামেলা হয়েছে ? আমি আবার বললাম
-কি হয়েছে ? কথা বলছো না কেন ?
সুপ্তি একটু শান্ত কন্ঠে বলল
-ভাল লাগছে না । তুমি শুয়ে ছিলে তাই আর ডাকি নি !
-সমস্যা নেই । তাই তুমি খেয়েছো কিছু ? বললে না যে অফিসে আজকে থাকতে হবে !
-কাজ শেষ হয়ে গেল । তাই চলে এলাম ।
-ও ! তা শুয়ে পড়বে এখন ? নাকি গোসল করবে ?
-নাহ । এতো রাতে আর গোসল করছি না । একটু হাত মুখ ধুয়ে শুবো !
-কিছু খাবে ? রাতে খিচুড়ি রান্না করেছি । গরম করে দেই ?
সুপ্তি হাসলো । তারপর বলল
-তোমার রান্না ? তাহলে আর হয়েছে !
-আমার রান্না মানে ! আজকে একদম ঠিক লবন হয়েছে ! আমি ইন্টারন্যাশনাল রাধুনী !
-হুম ! আমি জানি তো ! থাক তোমার আর কষ্ট করতে হবে না । আমি নিজেই গরম করে নিচ্ছি !
আমি উঠতে যাবো বিছানা থেকে তখনই কলিং বেল বেজে উঠলো । মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলাম রাত দেড়টা বেজে গেছে । এতো রাতে আবার কে এল ! আমি সুপ্তির দিকে তাকিয়ে বললাম
-এতো রাতে ?
সুপ্তি বলল
-আচ্ছা আমি দেখছি । তোমাকে উঠতে হবে না ।
আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সুপ্তি দ্রুত দরজা খুলে বের হয়ে গেল । আমি চুপ করে বসে রইলাম । কয়েকটা মুহুর্ত কেটে গেল । এতো সময়ে দরজা খুলে ফেলার কথা কিন্তু আমি দরজা খোলার আওয়াজ পেলাম না । এদিকে কলিংবেলটা বেজেই চলেছে ।
শেষে আমি আর না থাকতে পেরে নিজেই উঠে দাড়ালাম । ঘরের আলো জ্বালিয়ে মাঝের ঘরে এলাম । দেখি সেখানে কেউ নেই । সুপ্তি গেল কোথায় ?
চট করে রান্না ঘরটা দেখলাম !
নেই !
কমন বাথরুমে দেখলাম !
সেখানেও নেই !
আমি সত্যিই অবাক না হয়ে পারলাম না । সুপ্তি গেল কোথায় !
এদিকে কলিংবেলটা বেজেই চলেছে । আগে তো নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে বাজছিলো এখন ঘনঘন বেজেই চলেছে । আমি তখনও সুপ্তিকে খুজে পাচ্ছি না । কলিংবেলের আওয়াজে আর থাকতে না পেরে আমি দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম । খুলে দিলাম দরজা !
এবং দরজা খুলেই একটা ছোট খাটো ধাক্কার মত খেলাম !
দরজার সামনে সুপ্তি দাড়িয়ে ! আমার দিকে তাকিয়ে আছে বিরক্ত হয়ে ! আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-এতো সময় লাগে ? কত সময় ধরে বেল বাজাচ্ছি !
আমি অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম কিছুটা সময় । তারপর বললাম
-তুমি ?
-হ্যা আমি আর কে ?
-তুমি না ছিলে ঘরের ভেতরে !!
সুপ্তি আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-অপু কি বলছো এসব ? আমি ঘরের ভেতরে ছিলাম মানে ? আমি মাত্র এলাম অফিস থেকে ।
-কিন্তু ......
আমি কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলাম । সুপ্তিকে বললে ও কোন দিন বিশ্বাস করবে না । তাহলে কি আমি ভুল দেখেছি । ঘুমিয়ে ছিলাম বলে কোন কিছু ঠিক মত দেখতে পারি নি । কিংবা স্বপ্ন ! আর ঘরের লাইটও বন্ধ ছিলো তাই হয়তো ঘুমিয়েই ছিলাম !
আমি কোন কথা না বলে কেবল ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম এক ভাবে । আমার মাথার ভেতরে কিছুই ঢুকছে না । সুপ্তি বলল
-কি ব্যাপার জনাব আমি আসবো না বলে তুমি আবার তোমার কোন প্রাক্তন প্রেমিকাকে নিয়ে আসো নি তো ? কই দেখি দেখি !
এই বলে সুপ্তি আমার কাটিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে পড়লো । শোবার ঘরের দিকে যেতে যেতে বলল
-কিছু কি আছে খাওয়ার জন্য ?
আমার ঘোর তখনও কাটে নি । আমি ঠিক বুঝতে পারছি না কি হয়েছে ! আমি বললাম
-খিচুড়ি রেধেছি !
-আচ্ছা । একটু গরম করবা প্লিজ ! আমি গোসল দিয়েই খাবো । অফিসে যা ধকল গেছে আজ ! খুব ক্ষুধা লেগেছে ।
আমি সুপ্তিকে আমাদের শোবার ঘরে ঢুকে যেতে দেখলাম । আমি তখনও আগের জায়তেই দাড়িয়ে । চিন্তা শক্তি ঠিক মত কাজ করছে না !
আমার সাথে একটু আগে কি হল ? ঐ আগের সুপ্তি কে ছিল ? নাকি আদৌও ছিল অথবা আমার মনের ভুল ছিল ? আমার আসলেই কোন কিছুই মাথায় আসছে না । এমন কিছু তো হবার কথা না । আমি কি ভুল দেখলাম !
আমি দরজা বন্ধ করতে যাবো তখনই আমার ফোনটা বেজে উঠলো । মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখি নম্বরটা জামানের ! সুপ্তির কলিগ ! এতো রাতে জামানের ফোন ! নিশ্চয় সুপ্তি বাসায় পৌছিয়েছে কিনা সেটা জানতেই ফোন দিয়েছে । আমি রিসিভ করলাম
-হ্যালো ।
-হ্যালো অপু ভাই !
-হ্যা বল জামান !
-অপু ভাই !
আমি জামানের কন্ঠ কেমনে কেমন একটা বিহব্বল ভাব পেলাম । বললাম
-কি হয়েছে ?
-অপু ভাই, সুপ্তি আপু আর নেই !
-মানে !!! কি বলছো এসব ! তোমার মাথা ঠিক আছে তো !
আমি জামানের কান্নার আওয়াজ পেলাম । জামান বলে চলেছে
-আমরা কাজ শেষ করে সবাই বাসায় আসছিলাম এক সাথে । অফিসের মাইক্রোটা আমাদের বাসায় ড্রপ করে দিচ্ছিলো কিন্তু মাঝ পথে একটা ট্রাক এসে আমাদের ধাক্কা মারে । আপু একদম সামনে বসে ছিলো । স্পট ডেড ! আমি এখনও হাসপাতালে ! আমি ....
আমি আর কিছু শুনতে পাচ্ছি না । আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না । এমন কিছু হতে পারে নাকি ! সুপ্তি একটু আগেই এখানেই দাড়িয়ে ছিল ।আমাকে কাটিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকলো ও । আর এই জামান বলছে যে সুপ্তি নেই । এমন হতে পারে নাকি !
আমি রোবটের মত আমার শোবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম । বাথরুমের দরজাটা হাট করে খোলা । লাইট জ্বলছে । আমি বাইরে থেকেও বুঝতে পারছি সেখানে কেউ নেই ।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে নভেম্বর, ২০১৭ রাত ৯:৫৭