তৃষা চাচ্ছে ওর যেন রাগটা না কমে যায়। কিন্তু কত সময় সে রাগটা ধরে রাখতে পারবে সেটা সে জানে না। রান্না ঘর থেকে আওয়াজ আসছে। অপু রান্না করছে। রাতে খাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। আর ভর পেট খাওয়া পর রাগ ধরে রাখাটা একটু কষ্টকর হয়ে যাবে। রাগ করা আর না খেয়ে থাকার একটা আলাদা যোগসুত্র আছে। কারন ভরা পেট নিয়ে রাগ করে থাকা যায় না।
কিন্তু রাগ করে যে খাবে না, এই কাজটা করার উপায় নেই। এটা একদমই নিষেধ। তৃষা আর অপুর যখন বিয়ে হয় সেই সময়ই অপু ওর সাথে এই কথাটা নিয়ে আলোচনা করেছিল।
বিয়ের প্রথম রাতেই অপু ওকে বলল
-দেখ সামনের দিন গুলোতে আমরা এক সাথে থাকবো আর এক সাথে থাকতে গেলে ঝগড়া, মন খারাপ, কথা বন্ধ এসব হবেই। আমি বলছি না যে হবে না। আমরা ঝগড়া করবো, জিনিস পত্র ভাঙ্গতে পারো আবার দরকার হলে তুমি রাগ করে বাবার বাসায়ও চলে যেতে পারো। তবে....
তৃষা কৌতূহল নিয়ে অপুর দিকে তাকালো। তারপর বলল
-তবে?
-তবে কখনও না খেয়ে থাকা যাবে না। রাগ কর ঝগড়া কর, যাই কর না খেয়ে থাকা যাবে না কিংবা খাবো না এমন কিছু বলা যাবে না। ঠিক আছে?
তৃষা হেসে বলল
-আচ্ছা ঠিক আছে। সমস্যা নেই।
তৃষা তখন সেই সময় ব্যাপারটা খুব একটা গুরুত্ব দেয় নি। কেবল হেসেছিলো। কিন্তু ব্যাপারটা যে কতটা গুরুত্ব বহন করে সেটা মাস ছয়েক পরে টের পেল। ওদের বিবাহিত জীবন ভালই চলছিল। একদিন দুজনের মাঝে একটু কথা কাটাকাটি থেকে ঝগড়া শুরু হয়। তারপর কথা বন্ধ। তৃষা রাগ করে অপুর সাথে কথা বন্ধ করে দেয়। রাতের বেলা যখন অপু নিজে ওকে খাওয়ার জন্য ডাকলো তৃষা সেই ডাকে কান দিল না। অপু কয়েকবার ডাক দিল কিন্তু তৃষা গেল না। তারপর অপু নিজেই প্লেট নিয়ে এল খাইয়ে দেওয়ার জন্য। তৃষা তবুও খেল না।
তৃষা ভেবেছিল অপু আরও কিছু সময় সাধাসাধি করবে কিন্তু অপু প্লেট টা পাশে সরিয়ে রাখলো। তারপর বলল, আমি কিন্তু আগেই ক্লিয়ার করে নিয়েছিলাম। না থেয়ে থাকা যাবে না।
তৃষা চুপ করে ছিল তখনও। অপু বলল
-খাবে না তুমি?
তৃষা তখনও রাগ করেই আছে। ছোট করে বলল
-না।
অপু আর কোন কথা বলল না। শোবার ঘরের দরজা দিয়ে বের হয়ে গেল। তারপরই তৃষা শুনতে পেল মেইন দরজাটা সজোরে বন্ধ হওয়ার আওয়াজ। ওর বুঝতে কষ্ট হল অপু ঘরের বাইরে চলে গেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে তখন রাত এগারোটার মত বাজে।
একটার মধ্যে যখন অপু ফিরলো না তখন তৃষার একটু চিন্তা হতে লাগলো। চিন্তা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়লো বলতেই পারবে না। সকালে ঘুম ভেঙ্গেও দেখলো অপু ফিরে আসে নি। তখন একটু চিন্তাই হল। বসার ঘরে এসে যখন দেখলো অপু ফোন আর মানিব্যাগ টেবিলের উপরে রেখেই বের হয়ে গেছে এখন বেশ চিন্তিত হয়ে গেল। সকাল গড়িয়ে বিকাল তারপর যখন আবার রাত নামলো তখন তৃষাত অবস্থা সত্যি খারাপ হল। চিন্তায় অস্থির হয়ে গেল। সবার কাছে ফোন করা হয়ে গেছে কিন্তু অপু কোথাও যায় নি। টাকা পয়সাও নিয়ে যায় নি, মোবাইলও রেখে গেছে। কান্নাকাটি করতে করতে ওর অবস্থা শেষ। ঠিক দুদিন পরে অপুর খোজ পাওয়া গেল। যখন অপু আবার দরজার সামনে এসে দাড়ালো তখন ওকে শক্ত করে জড়িয়ে হুহু কিরে কেঁদে উঠলো।
তারপর থেকে রাগ হলেও তৃষা না খেয়ে আর থাকে নি কোন দিন। আজও তাই হবে। তৃষা জানে অপু ভূনা খিচুড়ি রান্না করছে। কারন ভূনা খিচুড়ি তৃষার প্রিয় খাবার।
আজকের রাগটাও অবশ্য খুব একটা বড় কিছু নিয়ে না । শুক্রবার এলেই তৃষার কেবলই এদিক ওদিক যেতে ইচ্ছে করে । পুরো সপ্তাহ দুরে দুজনেরই কাজ থাকে । কেবল শুক্রবার আর শনিবারটা দুজনেরই সময় থাকে । আগের দিন রাতে যখন তৃষা ওর মায়ের বাসায় যাওয়ার কথা বলল অপু বলল যে সে যাবে না । তার কোন এক বন্ধুর সাথে নাকি দেখা করতে হবে । তৃষা বলল যে মায়ের থেকে তোমার বন্ধু বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে গেল তারপর এক কথা দু কথা নিয়ে শুরু হয়ে গেল । শেষে কথা বলা বলি বন্ধু !
সকাল বেলা যখন সত্যিই অপু বের হয়ে গেল তখন মেজাজ টা আরও খারাপ হয়ে গেল তৃষার । সারা দিন মুখ হপ করে ছিল । বিকেল অপুও জানে যে ও রাগ করেই থাকবে । তাই সে আসার সময় ঠিকই সব রকম প্রস্তুতি নিয়ে এসেছিলো । সন্ধ্যা থেকেই তার রান্না বান্না শুরু ।
রাতে ডাইনিং এ বসে অর্ধেক রাগ কমে গেল। টেবিলের উপর ভূনা খিচুড়ি ছাড়াও সুন্দর করে সালাদ কেটে সাজানো। আর কোকাকোলার বোতল পাশে রাখা। তৃষা জানে ফ্রিজে আজকে ভ্যানিলা ফ্লেভারের আইসক্রিম আর চকলেট এনে রাখা হয়েছে । ওকে কিভাবে পটাতে হয় সেটা অপুর খুব ভাল করেই জানা আছে। তারপরেও ও ঠিক করে রাখলো যে আজকে রাগ করে কথা বলবে না। চুপচাপ খাবার খাবে তারপর চলে যাবে। চকলেট কিংবা আইসক্রিম খাবে না।
খিচুড়ি মুখে দিয়েই তৃষার রাগ আরো কমে গেল। রান্নাটা চমৎকার হয়েছে। কিন্তু ও এমন একটা মুখভাব করে রাখার চেষ্টা করলো যেন রান্না মোটেও ভাল হয় নি। কিন্তু আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিল যে খুব একটা লাভ হচ্ছে না। কারন অপু ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে মাঝে মাঝে। তৃষা কঠিন কন্ঠে বলল
-হাসছো কেন?
-হাসলাম কই? তুমি আমার রান্না করা খিচুড়ি খাচ্ছো এটা দেখে আনন্দ লাগছে। আর রান্না যে ভাল হয়েছে সেটা বুঝতে পারছি।
তৃষা বলল
-এতো বাজে রান্না আমি আমার জীবনেও খাই নি।
লাইনটা বলেই দেখলো ওর প্লেটের খিচুড়ি প্রায় শেষ। কিন্তু এখনও ওর খাওয়া শেষ হয় নি। আবার একটু আগে বাজে বলেছে খিচুড়ি কে। আবার ওর আরও একটু নিতেও ইচ্ছে করছে। অপু বলল
-আমিও জানি তো। নাও আরেকটু নাও দেখি।
এই বলে অপু নিজেই আরেকটু খিচুড়ি তুলে দিল তৃষার পাতে। বলল
-নাও নাও আমি আর তুমিই তো আছি । গরম গরম খেয়ে ফেলি !
তৃষা কিছু বলল না । চুপচাপ খেতে লাগলো ।
খাওয়া শেষ করে উঠে গেল । উঠে যাওয়ার সময় ভেবেছিলো হয়তো অপু ওকে থামাবে । বলবে যে ফ্রিজে আইসক্রিম আর তোমার পছন্দের চকলেট রাখা আছে, আসো এক সাথে খাই কিন্তু সেসব কিছুই বলল না । আস্তে ধিরে প্লেট গুলো তুলে রাখতে শুরু করলো ।
তৃষা নিজের শোবার ঘরে গিয়ে চুপচাপ বসে রইলো । কয়েক মিনিট অপেক্ষা করে থাকলো, বারবার মনে হল এই বুঝি অপু ওকে ডাক দিবে কিংবা এখনই বাটি হাতে নিয়ে হাজির হবে ওর রুমে কিন্তু অপুর কোন খোজ পাওয়া গেল না ।
এবার তৃষার মেজাজটা আরও গরম হতে থাকলো । এতো সময় ও যে কারনে রাগ করে ছিল সেই কারনের বদলে এখন মেজাজ গরম হচ্ছে যে অপু কেন এখনও আসছে না ! কি করছে এখনও ! শেষে আর থাকতে না পেরে নিজেই উঠে গেল ।
বসার ঘরে টিভি চলছে । অপু শোফার উপর পা তুলে দিয়ে বসে বসে টিভি দেখছে । কিছু বলতে যাবে তখনই দেখলো সামনের টি-টেবিলে দুইটা বাটিতে আইসক্রিম সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে । ঠিক তার পাশে ওর পছন্দের ব্যন্ডের চকলেট । স্পষ্টই বুঝা যাচ্ছে যে ওর জন্যই সেটা রাখা । ওকে আসতে দেখে অপু একটা বাটি তুলে নিল । তারপর আবার টিভির দিকে তাকিয়ে রইলো ।
তৃষা এবার নিজেই অপুর পাশে বসতে বসতে বলল
-শোফার উপর পা তুলে বসতে না মানা করেছি !
-তাই নাকি ? কবে ?
-বাহ ! তা মনে থাকবে কেন ? আমার কোন কথাটা মনে থাকে তোমার ! আমি যা বলি তা তো এক কান শোনো আর আরেক কান দিয়ে বের করে দাও ।
-নেভেটিভ জিনিস নিজের ভেতরে না রাখাই ভাল !
-কি বললা তুমি ! কি বললা !!
অপু অবাক হওয়ার ভান করে বললাম
-কি বললাম ? বললাম যে আইসক্রিম গলে যাচ্ছে ! এখন না খেলে পরে কিন্তু ....
তৃষা বাটি হাতে তুলতে তুলতে বলল
-আমি তোমার উপর রাগ করে আছি । খিচুড়ি আর আইসক্রিম দিয়ে তুমি এবার পার পাবে না !
-আচ্ছা ! আর কি কি করতে হবে শুনি !
-বলব না !
অপু তখন পকেট থেকে দুটো টিকিট বের করে ওর সামনে রাখলো । তারপর বলল
-এতে চলবে ?
তৃষা সেদিকে তাকিয়ে বলল
-তুমি না ! এমন ড্রামা করতে পারো !
-আরে ড্রামা করলাম কই ? আগেই কথা দিয়েছিলাম তাই যেতে হয়েছে । কিন্তু আপনি সেটা শুনবেন কেন ? আপনার মনে হয়েছে আমি আপনার আম্মাজানকে গুরুত্ব না দিয়ে বন্ধুকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি ! কি করবো বলেন ! বউ তো ! সঠিক হোক আর বেঠিক হোক রাগ করলে রাগ ভাঙ্গানোর দায়িত্ব তো আমার উপরেই আসে । এসব তো জানতে হয় !
-হয়েছে হয়েছে ! কাল কখন শো ! দুপুরে !
তৃষা আর কিছু বলল না । এখনও চকলেট টা শেষ করতে হবে ! তারপর কাল কোথায় কোথায় যাওয়া যায় সেটা ঠিক করতে হবে ! এখন ও যা চাইবে তাই পাওয়া যাবে । প্রতিবারই এমন হয় !
এমনি ভাবে জীবন চলে যায় । প্রেম ভালবাসা রাগ অভিমান নিয়ে এগিয়ে চলে মানুষের জীবন !
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই নভেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৩:০৮