ছোট বেলা থেকেই মানুষের ভীড় আমার পছন্দ না । যেখানে মানুষ বেশি সেখানে আমি নেই । এই জন্যই বিয়ে শাদীর অনুষ্ঠানে আমি একদমই যেতাম না । নিজের বড় ভাইয়ের বিয়েতেও আমার যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না কিন্তু আব্বার ভয়ে যেতে হয়েছিলো । আর আজকেও আসতে হয়েছে এই বিয়ের অনুষ্ঠানে !
আমি অফিসার্স ক্লাবের গেটের কাছে এসে আরেকবার ভাবলাম ভেতরে ঢুকবো কি না ! এখন থেকে ফিরে গেলে খুব বেশি কিছু হবে না । আন্টি একটু রাগ করতে পারে । তবে সেটা বড় কিছু নয় । কিন্তু আজকের পর হয়তো আর কোন দিন তাকে দেখতেই পাবো না । আদিবা বলছিলো তার কাজিন নাকি বিয়ের পরই আমেরিকা চলে যাবে । আর কোন দিন হয়তো দেখতেই পাবো না !
কি অদ্ভুদ মানুষের মন ! তার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না । এমন কি তার নামও জানি না । কেবল জানি সে আদিবার কাজিন । ওদের উপরতলাতে থাকে । সম্ভবত আমাদের ইউনিভার্সিটিতেই পড়ে । কিন্তু কিসে পড়ে কোন ইয়ার সেটাও আমার অজানা অথচ তাকে ভেবে রাতের পর রাত কেটে যাচ্ছে ! এখনও মনে হয় সেদিনের সেই দেখা টা না হলেই সম্ভত ভাল হত । আমি নিজের জীবন নিয়ে সুখে থাকতাম । অন্তত এই মানষিক যন্ত্রনার ভেতরে দিয়ে তো যেতে হত না !
তাকে আমি প্রথম দেখি আদিবাকে পড়ানো শুরুর পরপরই । খুব বেশি দিন হয় নি । একদিন পড়াতে গেছি । কলিংবেল চেপে দাড়িয়ে আছি দরজা খোলার অপেক্ষাতে । বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করেও কেউ দরজা খুলল না । আরেকবার বেল চাপতে যাবো তখনই দরজা খুলে গেল । তাকিয়ে দেখি একটা অচেনা মেয়ে দাড়িয়ে আছে । এই মেয়েটাকে আমি আগে এই বাসাতে দেখি নি । আমাকেও সম্ভবত সে দেখে নি । তবে সম্ভবত আন্দাজ করতে পেরেছে আমি কে ।
আমি তখনও তার দিকে একভাবে তাকিয়ে আছি । সাধারনত আমি মেয়েদের দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে থাকি না । কিন্তু তার ভেতরে এমন কিছু ছিল যে আমি তাকিয়ে না থেকে পারলাম না ।
মেয়েটা সাদা রংয়ের একটা সেলোয়ার পরে ছিলো । চুল খোলা ছিল । মেয়েটির হাতে মেহেদির গাঢ় রং তখনও পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে গভীর দুই চোখে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল । আমিও ঠিক একই ভাবে তার দিকে তাকিয়ে ছিলাম । কতটা সময় এমন ভাবে একে অন্যের দিকে তাকিয়ে ছিলাম আমি জানি না ।
একটা সময় সে নিজে সরে গিয়ে আমাকে ভেতরে যাওয়ার রাস্তা করে দিলো । আমি ভেতরে চলে এলাম কিন্তু আমার চোখের সামনে সেই চেহারাটা লেগেই থাকলো । নিজের ভেতরে একটা যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা বুঝতে আমার মোটেই কষ্ট হল না ।
তারপর থেকেই শুরু । তার চেহারা আমার চোখের সামনে থেকে কিছুতেই সরে না । যেখানেই যাই আর যাই করি সব স্থানে তার মনে পড়ে । বুঝতে পারলাম আমি তার প্রেমে পড়েছি । কিন্তু প্রেমে পড়লেও কিছু করার ছিল না । তার ব্যাপারে কোন খোজ খবর আমি নিতে পারলাম না । নিজের লজ্জার কারনে আদিবাকে একটা কথাও জিজ্ঞেস করতে পারলাম না । আদিবার মা কিংবা বাবার কাছে তো জানতে চাওয়ার তো প্রশ্নই আসে না ।
তবে আদিবার কথা শুনে এই টুকু জানতে পারলাম যে মেয়েটা আদিবার কাজিন । বড় মামার মেয়ে । থাকে উপর তলাতেই । মাঝে মাঝে এই বাসায় আসে ।
তবে একটা ব্যাপার আমি লক্ষ্য করা শুরু করলাম যে সেদিনের পর থেকে আদিবার কাজিন যেন এই বাসা আসতে শুরু করলো । আমি ওকে যখন পড়াতাম সে টিভির ঘরে বসে থাকতো । টিভি দেখতো, মাঝে সাঝে আন্টির সাথে গল্প করতো । কিন্তু দুঃখের ব্যাপার যে তার নাম যে কি সেটা উদ্ধার করতে পারলাম না । লজ্জার কারনে জিজ্ঞেসও করা হল না পাছে ওরা কি না কি মনে করে । কেবল যাওয়া আর আসার সময় দেখা হত । চোখাচোখী হত ।
তবে আমার কেবল একটা ব্যাপার মনে হল যে আমি যেমন মেয়েটা আলাদা ভাবে লক্ষ্য করছি মেয়েটাও হয়তো আমাকে আলাদা ভাবে লক্ষ্য করছে । এটা অবশ্য আমার মনের ভুল হতে পারে ।
এভাবেই দিন চলে যাচ্ছিলো । আদিবাকে পড়াতে যেতাম । প্রায়ই দেখা হত তার সাথে । চোখাচোখী হত কয়েক মুহুর্তের জন্য । আমার জন্য সেটাও অনেক বড় কিছু ছিল । তাকে কল্পনা করে কত কিছু ভাবতাম । নিজের মন জগতেই ঘুরে বেড়াতাম । নতুন প্রেমে পড়লে মানুষ যেমন সুখে থাকে আমিও ছিলাম সেরকম সুখে !
কিন্তু সুখের দিন বেশি দিন টিকলো না । একদিন পড়াতে গিয়ে শুনলাম তার নাকি বিয়ে ঠিক হয়েছে । সেদিন আদিবা একটু বাইরে গিয়েছিলো । আমি বসে ছিলাম ওর জন্য । ফিরে এসে আদিবা নিজ থেকেই বলল যে ও গিয়েছিলো আপুর বিয়ের শপিংয়ের জন্য ! আপু বলতে সে কাকে বুঝিয়েছে সেটা আমার বুঝতে কষ্ট হল না । বুকের মাঝে কি যে একটা কষ্ট বিধে রইলো আমি ঠিক বুঝাতে পারবো না !
হঠাৎ করেই নাকি বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে । পাত্র খুব ভাল । আমেরিকাতে থাকে । ডাক্তার !
ছেলে একে তো ডাক্তার তার উপর আমেরিকাতে থাকে । এর থেকে ভাল পাত্র আর কি হবে ? আর আমি এখন তার নাম পর্যন্ত জানি না ।
কদিন কিছুতেই মন বসলো না । ঠিক মত খাওয়া দাওয়া বাদ গেল । কয়েকদিন টিউশনীও কামাই করে ফেললাম । কিছুই যেন ভাল লাগছিলো না । নিজের কাছেই কেমন যেন অস হায় লাগছিলো । বারবার কেবল মনে হচ্ছিলো একটা বার যদি মেয়েটার সাথে কথা বলতে পারতাম । যদি নিজের মনের কথাটা বলতে পারতাম তাকে !
হয়তো কিছুই হতো না কিন্তু নিজের কাছে একটা শান্তি লাগতো ঠিকই !
আন্টি যখন বিয়ের দাওয়াত দিল তখনও আমার কোন ইচ্ছে ছিল না বিয়েতে আসার । বিয়ের কার্ড অবশ্য দেই নি । সেটা দিলে হয়তো কন্যার নামটা জানতে পারতাম । মুখেই বলল আর বলল যেন আমি অবশ্যই আসি !
তাই তো এখানে এসে হাজির । ভেতরে ঢুকতেই আদিবাকে দেখতে পেলাম গেটের মুখে দাড়িয়ে আছে । আমাকে দেখেই হাত নাড়লো । আমি খানিকটা হেসে ওর সামনে গিয়ে দাড়ালাম । আমার দিকে তাকিয়ে আদিবা বলল
-স্যার আপনি এতো দেরি করে কেন আসলেন ?
আমি হাসলাম আবারও ।
আদিবার সাথেই ভেতরে গেলাম । স্টেজটা তখনই বেশ দুরে । আমি দেখতে পাচ্ছি স্টেজে বর বউ বসে আছে । বরের চেহারাটা বোঝা গেলেও বউয়ের চেহারাটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না । সে পাশ ফিরে কার সাথে যেন কথা বলছে ।
আমার তখনই মনে এখানে আসা আমার একদম উচিৎ হয় নি । আমি এখানে এসেছিলো মেয়েটাকে একবার শেষ দেখার জন্য । হয়তো আর কোন দিন দেখা হবে না । কিন্তু এখানে এসে বুঝতে পারলাম যে মেয়েটার সাথে অন্য কাউকে আমি কোন ভাবেই দেখতে পাবো না । আমার এখানে থেকেই চলে যাওয়াই ভাল !
আমি চলে যেতে পা বাড়াতে যাবো তখনই বউ এদিকে ঘুরলো । আমি বিশ্মিত চোখে তাকিয়ে রইলাম !
আমি কেবল লক্ষ্য করলাম আমার হৃদপিন্ডটা যেন আরও দ্রুত লাফাতে শুরু করেছে । আমি কেবল অবাক হয়ে বউয়ের দিকে তাকিয়ে আছি । স্টেকে যে বউ বেসে বসে আছে সেই মেয়েটি অন্য কেউ । মানে আমি যাকে দেখেছি, যাকে ভালবেসেছি এই মেয়েটি সেই মেয়েটি নয় ! একবার ভাবলাম হয়তো ইদানিং মেয়েরা বিয়েতে যে পরিমান মেকাপ দেয় হয়তো এই জন্যই মেয়েটাকে চিনতে পারছি না কিন্তু আরও ভাল করে দেখলাম সেই মেয়েটির সাথে এই মেয়েটির কোন মিলই নেই । একদম অন্য রকম ! আমি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে আদিবাকে বললাম
-স্টেজে এই মেয়েটি কে ?
আদিবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-স্যার আপনি এমন কথা বলেন না ! কে আবার ! আমার কাজিন । যার বিয়ে হচ্ছে !
আমার তখনও বুঝতে খানিকটা সময় লাগছে । আদিবা আবার বলল
-স্যার, আপনি স্টেজে আসবেন নাকি আমি যাবো ?
কোন মতে বললাম
-তুমি যাও আমি আসছি !
আমি তখনও কিছু বুঝতে পারছি না । সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে । এমন সময় কেউ আমার পাশে এসে দাড়ালো । হাতে একটা শরবতের গ্লাস ! আমার দিকে সেটা বাড়িয়ে দিয়ে বলল
-মাস্টার সাহেব, এই শরবতটা খান । মাথা ঠান্ডা হবে !
আমি তাকিয়ে দেখি যে আমার দিকে গ্লাসটা এগিয়ে দিয়েছে সে আর কেউ নয় সেই মেয়েটি ! আমার দিকে হাসি মুখে তাকিয়ে আছে । আমি কোন মতে গ্লাসটা হাতে নিলাম । সে বলল
-কি খুশী হন নি যাকে স্টেজে দেখার কথা তাকে না দেখে !
আমি কোন কথা বলতে পারলাম না । আমি এখনও ঠিক বুঝতে পারছি না ! মেয়েটি বলল
-ও আমার বড় বোন ! ওরই বিয়ে হচ্ছে ।
আমি তখনও বোকার মত তার দিকে তাকিয়েই আছি । কিছু বলতে পারছি না । মেয়েটি বলল
-আমার এতো জলদি বিয়ে করার কোন ইচ্ছে নেই । আর এরেঞ্জ বিয়েতো নয়ই । আমি তাকেই বিয়ে করবো যাকে আমার পছন্দ !
কোন মতে বললাম
-আপ-আপনার কাকে পছন্দ ?
যেন খুব মজার কথা বলেছি এমন একটা ভাব করে মেয়েটা হেসে ফেলল । তারপর বলল
-জানতে চান কাকে পছন্দ ?
-হুম !
-দেখি আপনার মোবাইল টা ?
আমি যন্ত্রের মত মোবাইলটা বের করে দিলাম । সে মোবাইলে কিছু টেপাটেপি করলো । তারপর আমার দিকে মোবাইলের স্ক্রিনটা দেখিয়ে বলল
-এই নাম্বারটা দেখছেন না ? কাল বিকেল ঠিক পাঁচটার সময় ২৭ নাম্বরের আলফ্রেসকোতে আসবেন । এসে এই নাম্বারে ফোন দিবেন । মনে থাকবে তো । তখনই জানতে পারবেন সেই নাম !
মেয়েটি আমাকে মোবাইলটা ফেরৎ দিল । তারপর বলল
-এখন যাই । বোনের বিয়ে অনেক কাজ ! কাল দেখা হবে !
মেয়েটি পা বাড়াতে গেলে আমি বললাম
-আপনার নামটা আমি এখনও জানি না !
-কালই শুনবেন !
তারপর আরও একটু হাসি দিয়ে স্টেজের দিকে পা বাড়ালো ! আমি এক হাতে মোবাইল আর আরেক হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে দাড়িয়েই রইলাম । কি পরিমান খুশি লাগছিলো সেটা আর কাউকে বোঝাতে পারবো না ! মনে হচ্ছিলো আমি এখন পৃথিবীর সব থেকে আনন্দিত মানুষ !
(অনুপ্রাণীত খানিকটা)
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই অক্টোবর, ২০১৭ দুপুর ১:৩৭