ছোট খালাকে নিয়ে এসেছি ডাক্তার দেখাতে । সিরিয়াল বেশ লম্বা । অনেক সময় অপেক্ষা করতে হবে । অবশ্য আমার হাতে তেমন কোন কাজ নেই । সমস্যা হচ্ছে খালা এতো সময় বসে থাকতে পারবে কি না । আমি মোবাইল বের করে আপন মনে ব্রাউজিং করছি । মাঝে মাঝে খালার দিকে তাকাচ্ছি । খালা আপন মনে তজবি গুনে যাচ্ছে ।
যাক, এখনও যে সে বিরক্ত হয় নি এটা অনেক বড় ব্যাপার । খালা সব কিছুর উপরই বড় জলদি বিকক্ত হয়ে যান । তার বড় দুই ছেলে থাকতেও তিনি আমাকেই বলেছেন ডাক্তারের কাছে নিয়ে আসতে । তার ছেলেদের উপর তিনি বেশ বিরক্ত ।
-আপনারা আসুন আমার সাথে ।
আমি মোবাইল থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে দেখি ডাক্তারের রোগী ম্যানেজ করার জন্য যে ছেলেটা থাকে সে এসে দাড়িয়েছে আমার সামনে । আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম
-আমাদের সিরিয়াল তো অনেক পরে !
ছেলেটা একটু হাসলো । তারপর বলল
-সসম্যা নেই । আসুন !
আমি কিছু বুঝতে পারলাম না । অবশ্য খুব বেশি চিন্তার কিছু নেই । সুযোগ যখন আসছে তখন সেটার সৎব্যবহার করাই উত্তম । খালাকে নিয়ে পাশের কেবিনের দিকে হাটা দিলাম । প্রধান ডাক্তারকে দেখানোর আগে ছোট ডাক্তার অর্থ্যাৎ এসিস্ট্যান্ট ডাক্তারের কাছে যেতে হবে । তিনি সব কিছু দেখবেন, সব সমস্যা তাকেই বলতে হবে । তিনি রিপোর্ট লিখে দেবেন, সেটা বড় ডাক্তারকে দেখালে, তারপর চিকিৎসা দেওয়া হবে ।
যাই হোক, দরজা দিয়ে ঢুকে যখনই আমার চোখ ছোট ডাক্তারের উপর পড়লো তখনই আমার কাছে সব কিছু পরিস্কার হয়ে গেল । কেন আমাদেরকে সিরিয়াল ভেঙ্গে আগে নিয়ে আসা হল । ছোট ডাক্তার দিকে হাসি মুখ তাকিয়ে আছে । বলল
-কেমন আছেন ভাইয়া ?
আমি হাসলাম । মিতুকে এখানে দেখবো আশা করি নি । ও যে মেডিক্যালে চান্স পেয়েছে এটা আমি জানতাম । তারপর ওর কোন খোজই আমি পাই নি । বলতে গেলে রাখি নি । আর মিতুও হয়তো সেটা চায় নি । বললাম
-ভাল । তুমি ? এখানে ?
এই প্রশ্নের উত্তরে মিতু কিছু বলল না । খালা ততক্ষনে পেছনে ঢুকে পড়েছে । তাকে সামনে নিয়ে বসালাম । মিতু তাকে পরীক্ষা করতে লাগলো । মিনিট দশেক পার হয়ে গেল সেখানেই । খালার পরীক্ষা শেষ করে তাকে ভেতরের রুমে বসানো হল । সেখান থেকে তাকে বড় ডাক্তারের কাছে পাঠানো হবে ।
মিতু এবার আমার দিকে ফিরলো । বলল
-আমি ভাল আছি । ইনি আপনার খালা হন ?
-হুম । ঐ যে আগে যাদের বাসাতে থাকতাম আমি !
-উনার ছেলেরা কোথায় ? আপনি নিয়ে এসেছেন যে ! এখনও বেগার খাটার অভ্যাস গেল না আপনার ?
আমি হেসে ফেললাম । মিতুও হাসলো । এতো দিন পরে মিতুকে এখানে দেখবো আমি ভাবি নি । ভেবেছিলাম হয়তো আর কোন দিন মিতুর সাথে আমার দেখাই হবে না ।
আমি যখন ভার্সিটিতে পড়ি তখন যে বাসায় টিউশনী করাতাম সেই বাসার গেটের দারোয়ানের মেয়ে ছিল মিতু । আমি ওকে কোনদিন হয়তো চিনতামও না আমার সাথে ওর যোগাযোগের কোন কারনও ছিল না । কিন্তু একদিন টিউশনী করে বের হচ্ছি হঠাৎ দায়োয়ান আমাকে থামালো । বলল যে তার কিছু কথা আছে । খুব লজ্জিত কন্ঠে বলল যে তার মেয়েটা এইবার ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি হইছে । তাকে যে বাসায় স্যার রেখে পড়াবে সেই সামর্থ্য তার নেই । মেয়েটা এমনিতে পড়ালেখায় খুব ভাল তবে মাঝে মাঝে কিছু কিছু জিনিস সে বুঝতেছে না । আমি যদি সপ্তাহে কিংবা মাসে দু একটা দিন তাকে একটু দেখিয়ে দেই !
অনুরোধে ঢেকি গেলার মতই আমি রাজি হয়ে গেলাম । সপ্তাহে একটা দিন এই টিউশনীর থেকে বের হওয়ার পরে আমি মিতুদের বাসায় যেতাম । ওকে পড়াতাম । মেয়েটা এমনিতে পড়াশুনাতে বেশ ভাল ছিলো । আমার খুব বেশি কষ্ট করতে হত না ।
শান্ত স্বভাবের হলেও আমার মিতু আস্তে আস্তে টুক টুক করে অনেক কথা বলতো । সে কি করবে কি হবে এই সব । আমিও ওর সাথে মাঝে মাঝে কথা বলতাম পড়া লেখার বাইরেও । শান্ত স্বভাবের মেয়েটার চোখটা আমার অন্য রকম মনে হত । সব সময় মনে হত মেয়েটা কি যেন বলতে চায় আমাকে ! পরে জেনেছিলাম যে মিতু ছোট থেকে একা একাই পড়েছে । বাসায় এসে কোন স্যার তাকে কোন পড়াতে আসে নি । আমিই প্রথম এমন কেউ ।
এই ভাবেই চলছিলো । কিন্তু ঝামেলা বেঁধে গেল অন্য জায়গাতে । নিশি একদিন আমার কাছে এসে মিতুর কথা জানতে চাইলো । আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম
-তুমি জানলে কিভাবে ?
-পড়াও কি না বল ?
-হ্যা ।
-কই আমাকে তো বলো নি !
-এমন কিছু না তো । বলার মত কিছুই না ।
-তুমি কি জানো ঐ মেয়ে তোমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে !
-মানে কি ?
আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম । নিশিকে নিজের মোবাইল বের করে আমাকে বেশ কয়েকটা ছবি দেখালো । প্রত্যেকটা ছবিতেই মিতুকে দেখা যাচ্ছে । কারো দিকে তাকিয়ে আছে । আরেকটু ভাল করে লক্ষ্য করে দেখলাম মিতু ছবি গুলোতে যেখানে দাড়িয়ে আছে সেটা আমাদের ক্যাম্পাস । মেয়েটা এখানে এসেছিলো !
নিশি বলল
-এই মেয়ে কার দিকে তাকিয়ে আছে জানো ?
-আমার দিকে ?
-হ্যা তোমার দিকে । পরপর দুদিন আমি দেখেছি । প্রথমে মনে হয়েছিলো যে অন্য কারো দিকে হবে । কিন্তু মেয়েটা যার দিকে তাকিয়ে আছে সেটা আর কেউ নয় সেটা তুমি !
আমি কি বলবো খুজে পেলাম না । নিশি বলল
-আজকে ধরেছিলাম । সেই স্বীকার করলো যে তুমি তাকে পড়াও । আর তোমার কাছেই সে এসেছিলো ।
আমি বললাম
-আর কি বলেছো ?
-আর কিছু বলি নি ।
তবে নিশির চোখ দেখেই মনে হল যে আরও অনেক কিছুই বলেছে সে । সন্ধ্যার সময় যখন টিউশনীতে গেলাম তখন সেটা আরও ভাল ভাবে নিশ্চিন্ত হলাম । মিতু বাবা আমাকে বলল যে মিতুর আর কোন সমস্যা নেই । বাকিটা ও সামলে নিতে পারবে । আমাকে আর কষ্ট করে যাওয়ার দরকার নেই ।
একবার মনে হল মিতুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করি নিশি আসলে কি বলেছে ওকে । তারপর মনে হল দরকার নেই । ও যখন আর পড়তে চাচ্ছে না তখন আমার কি দরকার ঝামেলা বাড়ানোর। তাছাড়া মিতুকে আমি অন্য চোখে কখনও দেখিও নি । নিশির কাছে শুনেই বেশ অবাক হয়েছিলাম ।
তারপর কেটে গেছে অনেক দিন । আমিও সেই টিউশনী ছেড়ে দিয়েছি । তারপর পড়াশুনা শেষ করেছি, চাকরি করছি । জীবনে অনেক কিছু বদলে গেছে । অনেক নতুন মানুষ এসেছে, চলে গেছে অনেক পুরানো কাছের মানুষ ।
মিতুর সাথে অনেক কথাই হল । জানতে পারলাম মিতুর বাবা মারা গেছে দু বছর আগে । সেই থেকে মিতু আর মিতুর মা । অবশ্য ততদিনে মিতু টিউশনী আর বিভিন্ন ক্লিনিকে কাজ করা শুরু করেছে । তাই সংসার আর আটকে থাকে নি । আমার কথাও জানতে চাইলো । আমি এখনও বিয়ে করি নি শুনে বেশ অবাক হল । নিশির কথা জানতে চাইলো । বললাম যে ওর বিয়ে হয়ে গেছে বেশ আগেই । যখন নিশির বিয়ে হয় তখন আমাদের পড়ালেখা শেষ হয় নি ।
ডাক্তার দেখিয়ে বের হয়ে আসতেই দেখি মিতু সামনেই দাড়িয়ে আছে । আমার দিকে তাকিয়ে বলল
-আপনার খালার অবস্থা বেশ ভাল । মনে হয় না আর আসা লাগবে !
-তাহলে তো ভালই ।
-আপনার জন্য ভাল । কিন্তু .....
-কিন্তু কি ?
-নাহ কিছু না ।
মিতু অন্য দিকে তাকালো । আমার তখনই মনে হল মেয়েটা কি এখনও আমাকে ভালবাসে ? নিশি বলেছিলো মেয়েটা নাকি আমার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো । এখনও কি আমাকে মনে রেখেছে ? এই কত গুলো বছরে নিশ্চয়ই কেউ না কেউ এসেছে তার জীবনে । সেই কিশোরী বয়সের প্রেমকে মনে রাখলে কি চলে ! মিতু হঠাৎ বলল
-আপনার মোবাইল নাম্বারটা কি দেওয়া যাবে ?
আমি হেসে বললাম
-হ্যা যাবে না কেন ?
নাম্বারটা দিতে গিয়ে আবারও মনে হল মেয়েটা এখনও হয়তো আমাকে মনে রেখেছে সেই ভাবে ।
দুদিন পরে মিতুই আমাকে ফোন দিল । তখন বেশ রাত হয়ে গেছে । বাইরে বেশ বৃষ্টি হচ্ছে তখন । আমি শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিলাম । তখনই মিতুর ফোন এসে হাজির ।
-বই পড়ছেন ?
আমি খানিকটা অবাক হয়ে বললাম
-তুমি কিভাবে জানলে ?
-আমি আপনার পছন্দের কথা জানি । রাতের বেলা ঘুমানোর আগে যে আপনার বই পড়ার শখ এটাও জানি । একটা কথা কি জানেন ?
-কি ?
-শুনলে হয়তো হাসবেন । তবুও বলি । প্রতি রাতে আমার ঘুমানোর আগে আমার খুব জানত ইচ্ছে করতো আপনি কি বই পড়ছেন । কেবল এই নামটা জানার জন্য আমি ছটফট করতাম । এখনও করি !
আমি কি বলব খুজে পেলাম না । চুপ করে রইলাম । মিতু আবার বলল
-এরকম বৃষ্টির রাত আপনার অনেক পছন্দ তাই না ? আপনি মাঝে মাঝেই এরকম রাতে নিশির আপুর বাসার সামনে চলে যেতেন ।
আমি হাসলাম । বললাম
-সেই সময় অনেক পাগলামো করেছি । এখন কি আর সেই বয়স আছে !
-আমি এখনও এই পাগলামী করি । বৃষ্টি হলেই বাইরে বের হয়ে যাই । একা একা হাটি ।
আমার মনে হল মিতু আজও বৃষ্টির ভেতরেই ভিজতেছে । আমি বললাম
-তুমি কি বৃষ্টিতে ভিজতেছো এখন ?
তখনই বাসার পাশের রাস্তার দিয়ে যাওয়া একটা ট্রাকের হর্ণ শুনতে পেলাম । এবং অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম আওয়াজটা ফোনের ভেতরে দিয়েও আসছে । আমি দৌড়ে গিয়ে জানলা দিয়ে তাকালাম । তাকিয়ে দেখি রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের পাশে ছাতা হাতে একটা নারী মুর্তি দাড়িয়ে আছে । আমি কেবল ফোন কানে বললাম
-তুমি কি পাগল নাকি !!
মিতু কোন কথা বলল না । আমি দ্রুত নিচে নামতে শুরু করলাম । তাড়াহুড়ার জন্য ছাতা নিতেও ভুলে গেলাম । যখন গেট খুলে বাইরে এলাম তখন বাইরে যেন আরও প্রবল জোরে বৃষ্টি হচ্ছে । মিতুর কাছে যেতে না যেতে একেবারে ভিজে গেলাম । আমি কাছে যেতেই মিতু বললাম
-আমি এতোটা দিন কেবল উদ্দেশ্যহীন ভাবে রাস্তায় হেটেছি । কেবল একটা আশায় !
আমার জানতে চাওয়া উচিৎ কি সেই আশা । কিন্তু আমি কোন কথা বললাম না । কেবল অবাক হয়েই তাকিয়ে
-একদিন আপনার হাত ধরে ধরে হাটবো ! আজকে হাটবেন আমার সাথে ?
আমি ল্যাম্প পোস্টের আলোতে মিতুর জ্বলজ্বল করতে থাকা চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম । কি তীব্র ভাবে মেয়েটা এতো দিন আমাকে ভালবেসে এসেছে ! এমন এক ভালবাসা যেটা উপেক্ষা করার ক্ষমতা এই পৃথিবীর কারো নেই !
পরিশিষ্টঃ
বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে যাত্রী ছাওনীর মাঝে শুয়ে থাকা কিছু মানুষ অবাক চোখে তাকিয়ে দেখলো একটা ছেলে আর একটা মেয়ে হাটছে এই তীব্র বৃষ্টির মাঝে । তারা যদি আরেকটু ভাল করে লক্ষ্য করলো তাহলে মেয়েটার চোখের জল আর বৃষ্টির জলের ভেতরে একটা পার্থক্যও ধরে ফেলতে পারতো ! যেমনটা আমি পারছি । কি অদ্ভুদ এই চোখের জল । রং এক হলেও আনন্দ বেদনা হতাশর উচ্ছাশের জন্য সব জলকেই আলাদা আলাদা ভাবে খুজে পাওয়া যায় !
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা অক্টোবর, ২০১৭ সন্ধ্যা ৬:১০