নিজের কাছেই কেমন যেন লাগছিলো । আমাদের কলেজ মাঠটা অনেক বড় । আমরা পাশ করে বের হওয়ার আরও জায়গা কিনে আয়তন বাড়ানো হয়েছে । মাঠের প্রায় সবটা জুড়েই প্যান্ডেল টাঙ্গানো হয়েছে । প্রতিবার এমনই করা হয় । এইচ এসসি পরীক্ষার্থীদের বিদায় দেওয়ার সময় খুব বড় করে আয়োজন করা হয় । এবারও ঠিক এমন ভাবেই অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে ! কিন্তু এবারের অনুষ্ঠানটা আমার কাছে একটু অন্য রকম ভাবে এসে উপস্থিত হয়েছে । কারন এবার মঞ্চের এই পাশটাতে আমি বসে আছি ।
মাইকটা হাতে নিয়ে আমি সবার উদ্দেশ্য প্রথম যে লাইনটা বললাম
-কারা কারা ডাক্তার আর ইঞ্জিনিয়ার হতে চাও?
লাইন টা জিজ্ঞেস করে আমি কিছুটা সময় সামনে বসা মেয়েদের দিকে তাকালাম। মেয়েদের প্রায় সবাই হাত তুলেছে। আমি জানতাম এমনই হওয়ার কথার ছিল।
ভাবতেও অবাক লাগে বারো বছর আগে আমিও ঠিক এই মেয়েদের স্থানে ছিল । এমনই কারো জানতে চাওয়ার পর হাত তুলেছিলাম। আর আজকে আমি মঞ্চে বসে আছি।
প্রতিবার কলেজের ফেয়ারওয়েল দেওয়ার সময় আমাদের কলেজ কর্তৃপক্ষ কাউকে না কাউকে ডেকে নিয়ে আসে মেয়েদের মোটিভেশন মূলক বক্তব্য দেওয়ার জন্য। জীবনের সব থেকে টার্নিং পয়েন্ট হল এই সময়টা।
এবার আমি দেশে বেশ কয়েকজন স্যার ম্যাডামদের সাথে দেখা করেছিলাম । যখনই আসি এমনটা করি । কিন্তু ঠিক ঠিক এই ফেয়ারওয়েলের সময় এসে হাজির হয়েছি আর ম্যাডামেরা আমাকেই ধরে এনেছে। প্রথমে আমি ঠিক আসতে চাই নি। কিন্তু আপাদের কথা ফেলা গেল না কিছুতেই। আসতেই হল। কি বলব কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। তারপর মনে হল এতো প্রস্তুতির দরকার কি! আমি তো আমাদের গল্পটাই বলতে পারি।
আমি আবারও মাইকটা হাতে নিলাম। তারপর বললাম
-দোয়া করি যেন সবাই তোমরা নিজেদের লক্ষ্যে পৌছাও। কিন্তু ধর তোমাদের মধ্যে কিছু মেয়ে মেডিক্যাল কিংবা ইঞ্জিনিয়ারিং চান্স হল না। তখন কি করবে তোমরা?
সব গুলো চোখ তখন আমার দিকে। আমিও সবার দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ একটা মেয়ে হাত তুলল। আমি বললাম
-হুম বল।
মেয়ে বলল
-আপু, আমি ছোট বেলা থেকেই ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে বড় হয়েছি। যদি আমার মেডিক্যালে চান্স না হয় আমি জানি না আমি কি করবো!
আমি মৃদ্যু হাসলাম। তারপর বললাম
-আমি জানি তোমাদের অনেকের মনভাবই এমন। যদি নিজেদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যটা অর্জন না হয় তাহলে মনে করে জীবন শেষ। আর কিছুই হবে না। আর জীবনের কোন মিনিং নেই। তাই না? কেউ কেউ তো আবার এতো হতাশ হয়ে পড়ে যে সুইসাইড করতে যায়, কেউ আবার করেও ফেলে। আমি কেবল বলতে চাই যে যে লক্ষ্যটা অর্জন করতে চেয়েছিলে সেটা না পাওয়া মানেই কিন্তু জীবন শেষ না।
কিছু সময় চুপ করে থেকে বললাম
-তোমাদের একটা মজার গল্প বলি। ঠিক মজার না একেবারে বাস্তব গল্প।
আরেকটু বিরতি নিলাম। তারপর বললাম
-জানোই তো আমিও তোমাদের মত ঠিক এখানেই একটা বসে ছিলাম। এরকম ভাবে ফেয়ারওয়েল নিচ্ছিলাম। আমার জীবনের লক্ষ্যই ছিল ইন্টারের পরে আমি বাইরে গিয়ে পড়াশুনা করবো। আমার সাথে আমার আরও তিন বান্ধু ছিল। বলতে পারে আমরা কেবল রাতে ঘুমাতাম আলাদা আলাদা। বাদ বাকি দুনিয়ার সব কাজই আমরা করতাম এক সাথে। আমার ঐ তিন বান্ধুর মধ্যে দুই জনের লক্ষ্য ছিল ডাক্তার হবে। আমার আর বাকি জনের ইচ্ছে ছিল আমরা হব টিচার।
ইন্টারের পরেই আমি বাইরে চলে যাই। আগে থেকেই আমি প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আগস্টেই সব ফাইনাল হয়ে যায়। এখন যে দুটি বন্ধুর লক্ষ্য ছিল ডাক্তার হবে তারা দুজনের কেউ চান্স পেল না। সেবার প্রশ্ন ফাঁস হল খুব। জানোই তো কদিন আগেও আমাদের দেশে কি পরিমান প্রশ্ন ফাঁস হত । একজন চান্স পেল না। অন্যজনের প্রস্তুতি খুব ভাল ছিল। কিন্তু তার সমস্যা কি ছিল কি জানো ? সে সব সময় খুব নার্ভাস থাকতো। এক্সামের এতো প্রেশার সে ঠিক ভাবে নিতে পারে নি। এমসিকিউ এর সেট কোড ভুল দাগিয়ে চলে এল। চান্স হল না কারো মেডিক্যালে। আর তৃতীয় জন ভাল কোন বিশ্ববিদ্যালয়েই চান্স পেল না। বাসা থেকে সেই বন্ধুটির বাবা বলল যে পড়া শুনা যখন হল না তখন আর মেয়েকে রেখে লাভ কি বিয়ে দিয়ে দেওয়া হোক ! আমি ঠিক কারো খোজ খবরই রাখতে পারতাম না । তখন কিন্তু এখনকার মত এতো ফেসবুক আর হোয়াটসএপও ছিল না যে ক্ষণে ক্ষণে যোগাযগ হবে । আমি কেবল শুনতে পেয়েছিলাম যে ওরা তিন জন দেশের তিন দিকে চলে গেছে । আমার সাথে যেমন ওদের কোন যোগাযোগ ছিল না ওদের নিজেদের মাঝেও তেমন যোগাযোগ ছিল না । বলতে পারো সবাই ছিল হতাশ ।
গ্রাজুয়েশন শেষ করলাম, সেই ইউনিভার্সিটি থেকেই পিএইচ ডির পরে জব অফার পেলাম। সেখানে শিক্ষকতা শুরু করলাম। বলা যায় চার জনের মধ্যেই কেবল আমিই আমার পছন্দ মত লক্ষ্যে পৌছাতে পেরেছি। যা হতে চেয়েছিলাম তাই হয়েছি ! তবে এটা কিন্তু আমার গল্প না । এই গল্পটা আমার সেই তিন বন্ধুর । এখন তোমাদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে আমার সেই তিন বন্ধুর কি হল?
এক টানা কথা বলে আমি খানিকটা হাঁপিয়ে উঠেছি। সামনে রাখা পানির বোতল থেকে কয়েক ঢোক পানি খেয়ে আবারও শুরু করলাম।
-দুই বছর আগে দেশে এসেছিলাম। দেশে এসে অনেক কষ্টে সবার কন্ট্যাক্ট নাম্বার জোগার করলাম । এখানকার জনপ্রিয় একটা রেস্টুরেন্টে দেখা করার জন্য বললাম সবাইকে। আসলে আমি এসেছি বলেও ওরাও এক সাথে হওয়ার একটা সুযোগ পেল । যদিও সবাই এখন এই শহরেই থাকে কিন্তু সেই হতাশার পরে আর কারো সাথেই তেমন যোগাযোগ ছিল না । সবাই নিজেদের লাইফ নিয়ে বিজি ছিল । আমার উথিলায় আবার সবাই অনেক দিন পরে এক সাথে দেখা করার সুযোগ পেল ।
আমি হাজির হলাম সবার আগে। তারপর আস্তে আস্তে বাকি তিনজন এল। খেতে খেতে গল্প চলল। কত গল্পই না করলাম আমরা । এই দশটা বছরের জীবনের কত কিছু বদলে গেছে ।
বলেছিলাম না প্রশ্ন ফাঁসের জন্য যে চান্স পায় নি, সে পরে ভর্তি হয়েছিল বুটানিতে। পড়াশুনা শেষ করে সে এখানেরই একটা কলেজের শিক্ষকতা শুরু করেছে। সেই সাথে সে তোমাদের মত বাচ্চাদের জীব বিজ্ঞান পড়ানো শুরু করে সে । প্রশ্ন ফাঁসের জন্য তার চান্স হয় নি কিন্তু সে প্রস্তুতি নিয়েছিলো ভাল ভাবে । ঠিক সেই ভাবে সে বাচ্চাদের পড়ানোর শুরু করলো । তার পড়ানো ধরনটা এতোই পপুলার হয়ে গেল যে এখন তার কাছে ভর্তি হওয়ার জন্য সবাই লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিন্তু ভর্তি হতে পারে না। আচ্ছা তোমরা চিনবে তাকে? আমি যতদুর জানি অনেকে এরই মধ্যে তার কাছে পড়ার জন্য যোগাযোগও করেছে। নাম কি তার বলতো?
আমি তাকিয়ে থাকলাম মেয়েদের দিকে । একজন মেয়ে চিৎকার করে বলল
-অদিতি ম্যাডাম। জীব বিজ্ঞানের টিচার। আমি ভর্তি হয়েছি ।
আমি হেসে বললাম
-এইতো চিনেছো। মেডিক্যাল ভর্তি সবার তাকে চেনে খুব ভাল ভাবেই।
এবার আসি অন্য জনের কাছে। ঐ যে খুব নার্ভাস থাকতো। সে কি করলো জানো । তার মনে কেবল এই জেদ চাপলো যে আমি যেকারনে চান্স পাই নি অন্য কেউ যেন এউ ব্যাপারটা ফেস না করে । সে ভর্তি হল সাইকোলজি নিয়ে। পড়াশুনা শেষ করে সে স্টুডেন্ট সবাইকে কাউন্সিলিং দিতে শুরু করলো। সে নার্ভাসসের কারনে সে চান্স পায় নি সেটা সে দূর করতে শুরু করলো মানুষের মন থেকে। আজকে সে শহরের নাম করা সাইকোলজিস্ট সে এখন। খুবই জনপ্রিয় সেও। তার নামও শুনে থাকতে পারো! আমি যতদুর জানি শহরের যে কজন ফিমেল সাইকোলজিস্ট আছে তার মধ্যে সে সব থেকে বেশি জনপ্রিয় ! গুলশানের দিকে তার চেম্বার !
একজন কে হাত তুলতে দেখলাম। উঠে দাঁড়িয়ে বলল
-আমি চিনি তাকে। আমার এরকম সমস্যা ছিল তার কাছেই গিয়েই সেটা দুর হয়েছে । ডা. জারিন ফাইজা।
আমি আবার হাসলাম। বললাম
-তাহলে কি দেখলে ? তারা কিন্ত কেউ ডাক্তার হতে পারে নি । কিন্তু তাদের কারনে কত মানুষ যে এই ডাক্তারীতে চান্স পেয়েছে তার ঠিক নেই ।
অন্য আরেক মেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল
-আপু আপনার বাকি ফ্রেন্ডটার কি হল?
আমি আবার একটু হাসলাম। বললাম
-বলছি। যাই হোক, অনেক দিন পর দেখা হয়েছে। অনেক কথা হল। এতো সময় ধরে আমার সেই বন্ধুটা চুপই ছিল । সে কি করে আমরা তখনও কেউ জানি না । আসলে আমি শুনেছিলাম ওর বাবা মা নাকি ওকে বিয়ে দিতে চাচ্ছিলো । তখনই সে বাসা ছেড়ে চলে যায় । খুলনাতে তার ফুফুর বাসাতে গিয়ে থাকা শুরু করে । সেখানে ভর্তি হয় বিবিএ তে । ও যেহেতু বলতে চায় নি তাই আমরা আগ বাড়িয়ে কিছু শুনেও চাই নি । পাছে ওর খারাপ লাগে যে আমরা সবাই যে জায়গাতে পৌছে গেছি কিন্তু ও পৌছাতে পারে নি ।
এক সময় যাওয়ার সময় আসলো। বিল দিতে বললাম। বিলের খাতাটা আসতেই আমরা তিনজন কাড়াকাড়ি শুরু করলাম কে বিল দেবে এই নিয়ে। কিন্তু আমার ঐ বাকি বন্ধুটা চুপ করে বসেই রইলো। আমার খানিকটা মন খারাপ হল। মনে হল ওর হয়তো বিল দেওয়ার মত পরিস্থিতিই হয় নি। শেষে যখন বিলটা আমি খুলে দেখলাম, দেখি এমাউন্ট টা এসেছে টাকা জিরো জিরো। আমি প্রথমে কিছু বুঝতে পারলাম না । তারপর আমার সেই বন্ধুটির দিকে তাকিয়ে দেখি সে মিটমিট হাসছে।
আচ্ছা বল তো তোমাদের শহরের জনপ্রিয় একটা রেস্টুরেন্টের নাম বলতে বলি তাহলে কোন নামটা আগে আসবে? আমাদের কলেজের সামনেও একটা আছে।
অনেকেই বলে উঠলো
-ক্যাপ্সিয়াম।
-রাইট। এটার মালিক কে জানো? একজন মেয়ে উদ্যোক্তা। ফারিয়া নুশরাত। আমার সেই চার নম্বার বন্ধুটি ।
সবাই হাতে তালি দিয়ে উঠলো । গত দুই বছরে এই গল্পটা আমি এর আগেও করেছি । যখনই ক্লাস নিতে যাই, রেজাল্ট খারাপ করতে দেখে কাউকে যখন মন খারাপ করতে দেখি তখনই এই গল্পটা তাদের কে বলি । আজকে নিজের কলেজেই গল্পটা বলতে পেয়ে ভাল লাগছে ।
-একটা ব্যাপার লক্ষ্য করে দেখো আমাদের চার জনের ভেতরেই আমিই যে স্বপ্নটা দেখেছিলাম সেটা আমি পূরন করতে পেরেছি । আমার বাকি তিন বন্ধুর একজনও কিন্তু তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী স্থানে যেতে পারে নি । এখন তোমরা বলতো আমার থেকে তারা কি কোন অংশ কম সফল জীবনে ? বরং আমার তো মনে হচ্ছে আমার থেকে জীবনে তারাই বেশি সফল হয়েছে জীবন ।
ব্যাপার টা হচ্ছে তোমার ভেতরের মেধা ! তোমার ভেতরের কর্ম দক্ষতা । আর তোমার সামনে এগিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে । যদি তোমার ভেতরে মেধা থাকে আর তুমি যদি সেই অনুযায়ী কাজ করো তাহলে তুমি জীবনে ঠিকই সফল হবে । হ্যা, এমন হতে পারে যে তুমি ঠিক যেভাবে সফল হতে চেয়েছিলে তোমার সাফল্য হয়তো সেই ভাবে আসবে না কিন্তু এক না একভাবে সেটা আসবেই । কেবল দরকার চেষ্টা আর পরিশ্রম ! তাই একটাতে চান্স পাও নি বলে জীবন শেষ হয়ে যায় নি । সামনে আরও হাজারটা পথ খোলা আছে ! মনে রাখবে যে জীবন যখন তোমার থেকে একটা সুযোগ কেড়ে নিবে তার বদলে তোমার সামনে আরও দশটা সম্ভাবনা খুলে দিবে । তোমাকে কেবল থেমে গেলে চলবে না ।
গল্পের মূল ভাবনাঃ ফারিহা নুশরাত
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:০০